
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দশম পর্ব
সন্দীপন চক্রবর্তী
এই সূত্রে এসে পড়ে চিন্তার আরেকটি গাঁট – একজনের বিরোধিতা করা মানেই কি তার বিপরীতকে মানসিকভাবে সমর্থন করা? বোধহয় না। এ দুয়ের মধ্যে দিয়ে বা বাইরে কিন্তু একটা তৃতীয় রাস্তাও থাকতে পারে। আমি মোহনবাগান সাপোর্টার নয় মানেই কি ইস্টবেঙ্গল? সিপিএম নই মানেই কি তৃণমূল? বিরাট লম্বা নই মানেই কি খুব বেঁটে? চিন্তার মধ্যে এই মেরুকরণের ধারণা ঢুকে গেলেই মৌলবাদীদের খুব সুবিধা হয় মানুষের মগজধোলাই করতে। ফলে চিন্তায় এই মেরুকরণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি। শিল্পের বিরুদ্ধে এই গায়ের জোর বা হুমকি দেখিয়ে আসলে কোনো লাভ হয় না। আর গায়ের জোর দেখিয়ে বেড়াতে হয় তাকেই, যে আসলে দুর্বল। গৌতম বুদ্ধ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা এদের কোনোদিন গায়ের জোর দেখিয়ে নিজের দিকে লোক টানতে হয়নি। সুতরাং এইধরণের ধর্মীয় হুমকি বা আস্ফালন শুধুমাত্র অপর ধর্মের মৌলবাদকে আরও উশকে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।
একটা ঘটনাকে ঠিকঠাকভাবে বুঝতে গেলে, সেই ঘটনার থেকে একধরণের দূরত্ব প্রয়োজন হয় – স্থান-কালগত দূরত্ব। এতদিন পর হঠাৎ মনে পড়ল যে, বছর চার-পাঁচ আগে শ্রীজাত ‘অভিশাপ’ নামে একটি কবিতা লেখায় তার বিরুদ্ধে FIR দায়ের হয়, মামলা করা হয় জামিন অযোগ্য ধারায়। কিন্তু কেন? শ্রীজাতর লেখা কবিতাটি শুধু একটি উদাহরণমাত্র। কিন্তু এই ‘কেন’-টিকে বুঝতে চাইলে, তাকে সম্প্রসারিত করে নিয়ে যাওয়া যায় সাহিত্যের শ্লীলতা-অশ্লীলতা বা ঔচিত্য বা এমনকি ‘সাহিত্যের কাজ কী’ এই প্রশ্ন পর্যন্ত। ধরা যাক, যদি কোনো পাঠক বলেন যে – কবিতাটিকে কবিতা হিসেবে আমার আদৌ ভালো লাগেনি, তাহলে তার মানে খুব স্পষ্টই বোঝা যায়। আমার নিজেরও ব্যক্তিগতভাবে একেবারেই ভালো লাগেনি ওই কবিতাটি। কিন্তু কেউ যদি বলেন যে – ও যা লিখতে চেয়েছিল, সেটাই লিখেছে, তবে এই লেখাটা ওর একেবারেই উচিত হয়নি, সেক্ষেত্রেই পাকিয়ে ওঠে একটা সমস্যা। আর এই জায়গায় এসে যদি, বিশেষ থেকে সাধারণীকরণের দিকে আমরা যাই, তখন দেখবো যে – শিল্প হিসেবে ভালো বা খারাপের বাইরেও, যে কোনো শিল্পের আরেকটা জায়গা থাকে। সময়ের টালমাটাল নাড়ি ছুঁয়ে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। সংবেদী মানুষ হিসেবে যে কোনো শিল্পীর অবশ্যকর্তব্য সেটি। নাহলে তাঁর সমস্ত শিল্প পর্যবসিত হয় মিথ্যের জঞ্জালে। কেউ বলতেই পারেন যে, শিল্পী তো সুন্দরের সাধক, তিনি কেন অসুন্দরকে প্রশ্রয় দেবেন বা তিনি তো নিরপেক্ষভাবে সব দেখার কথা, তিনি কেন কোনো পক্ষ নেবেন। একে একে বিষয়গুলো দেখি –
কাকে বলে সুন্দর? সংস্কৃতে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ খুবই পরিচিত কথা। সত্যই শিব ও সুন্দর। আবার কিটসের কথা অনুযায়ী ‘Beauty is truth, truth beauty’। তাহলে সত্যই সুন্দর। এবার তাহলে কাকে বলবো সত্য? সত্য ধ্রুব বা অনড় নয়, পরিবর্তনশীল। সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সত্যের নির্ধারণ করতে হয়। আমরা সবাই জানি – সবার উপরে মানব সত্য, তাহার উপরে নাই। ফলে যা মানবতার বিরোধী, তা সত্যেরও বিরোধী। আবার যা সত্যের বিরোধী, তা সুন্দরেরও বিরোধী। সাহিত্যের কিন্তু ‘সিভিলাইজড’ হওয়ার কোনো দায় নেই, সত্যি বলার দায় আছে — এটা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত। তাই শিল্পীকে সংকটকালে পক্ষ নিতেই হয়। সত্যের পক্ষ, মানবতার পক্ষ, বিবেকের পক্ষ। নাহলে তাঁর সমস্ত সৃষ্টি শূন্যে বানানো মিনার হয়ে ওঠে। প্রকৃত শিল্পী জানেন যে — পাশের লোকটার গায়ে হাত পড়লে যদি শিল্পী আর্তনাদ না করে ওঠেন, ধিক্কার না জানান, তাহলে একদিন আশেপাশের সমস্ত লোকের গায়েই হাত পড়বে। তাই সেই আর্তনাদ, সেই ধিক্কারের পক্ষ তাঁকে তাই নিতেই হয়। নাহলে পিকাসোর ‘গুয়েরনিকা’ আঁকার কোনো দরকার পড়তো না। আর কাকেই বা বলে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী? একটি অসাধারণ লাইন ছিল জয়দেব বসুর – ‘কেউ নয় নিরপেক্ষ, কেউ নয় ব্যক্তিগত, প্রত্যেকেই অনিবার্য তিরের ফলক’, কারণ ‘Personal is political’। কিন্তু এক্ষেত্রে কাকে বলবো ‘politics’? এইখানে এসে আমাদের কারো কারো মনে পড়ে লেনিনের সেই উক্তি – Politics is the crystalization of every human essence.
এবার আসা যাক পরের প্রসঙ্গে – কাকে বলে অশ্লীল? শব্দের নিজস্ব কোনো শ্লীলতা বা অশ্লীলতা থাকে না। ব্যবহারের কৌশলে তার ভাব নির্ধারিত হয়। অনেক তথাকথিত শ্লীল শব্দও ব্যবহারের জন্য অশ্লীল হয়ে ওঠে। আবার অনেক তথাকথিত অশ্লীল শব্দও ব্যবহারের জন্য শ্লীল মনে হয়। যেরকম নগ্নতা সংক্রান্ত অশ্লীলতার কথা যদি ভাবি, তাহলে দেখবো যে – সম্পূর্ণ নগ্ন কোনো নারীদেহ দৃশ্যত অশ্লীল নয়, কিন্তু সেই একই নগ্ন নারীদেহকে যদি হাঁটু-পর্যন্ত মোজা, মাথায় টুপি আর চোখে সানগ্লাস পরিয়ে দেওয়া যায়, দৃশ্যত তা অশ্লীল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যদি ভাবি যে, ‘অকথ্য ভাষা’ কোনটা? ধরা যাক, শ্রীজাতর ওই কবিতারই দুটি শব্দ – ‘কন্ডোম’ আর ‘ধর্ষণ’। এর একটার বিজ্ঞাপন টিভিতে রোজ দেখায়, বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার সামনেই। আর আরেকটার খবর এখন ঘুম থেকে উঠেই প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে পড়তে হয়, সেটাও বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার কাছে প্রকাশ্য। আবার এই শ্লীলতা বা অশ্লীলতা খানিক শ্রোতার উপরেও নির্ভর করে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবো যে, শিল্পে অশ্লীলতা বা সেই সূত্রে বারবার ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু কাকে বলবো ধর্ম? জীবনানন্দের সেই লাইন মনে আছে – ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’! নেহাত শরীরী এক ‘মানুষ’-এর গণ্ডিকে অতিক্রম করে ‘মানব’ সত্তার দিকে পৌঁছনোর নানা চেষ্টা হয়েছে নানা যুগে। এই পথ খননের বিধিগুলিকেই যা ধারণ করে থাকে, তাকেই বলতে পারি ধর্ম। নানা পথের নানা দর্শন। সেই দর্শনকে আগলে রাখার জন্য ধর্মীয় সংগঠন। তাদের বেঁধে রাখতে গিয়ে সংগঠন নিয়মকঠোর। এবং এভাবে চলতে চলতে একসময়ে দর্শন গৌণ হয়ে গিয়ে সংগঠন ও তার নিয়মটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তখনই ধার্মিকের বদলে দেখা দেয় ধর্মান্ধ, এমনকি ধর্মোন্মাদ। তারাই তখন ফতোয়া দেয়। ধার্মিককে আঘাত করা এত সোজা নয়, কারণ সে দর্শনে বিশ্বাসী। একটা কবিতা বা একটা উপন্যাস বা একটা ছবি দিয়ে তাকে আঘাত করা যায় না। বিশেষত হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে, যে ধর্ম যুগ যুগ ধরে হাজার আক্রমণের দর্শনগত মোকাবিলা করে এসেছে, এমনকি নাস্তিকতাকেও তার মধ্যে ঠাঁই করে দিয়েছে চার্বাক দর্শনে। কিন্তু ধর্মান্ধ বা ধর্মোন্মাদকে তো তাদের অন্ধত্ব বা উন্মাদগিরির জায়গায় অবশ্যই আঘাত করা দরকার একজন শিল্পীর; নইলে অন্যরাও কেন অন্ধ আর উন্মাদ হবে না – এই নিয়ে তারা অত্যাচার চালিয়েই যাবে, সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দেবে না মানুষকে! আর তার থেকেও ভয়ঙ্কর হলো যে, তারা এই একই মিথ্যাকে ক্রমাগত প্রচার করে যেতে যেতে তাকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইবে সবার কাছে, যেভাবে গোয়েবলস একসময়ে একই মিথ্যে বারবার বলতে বলতে হিটলারের গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করে তুলেছিলেন।
এই সূত্রে এসে পড়ে চিন্তার আরেকটি গাঁট – একজনের বিরোধিতা করা মানেই কি তার বিপরীতকে মানসিকভাবে সমর্থন করা? বোধহয় না। এ দুয়ের মধ্যে দিয়ে বা বাইরে কিন্তু একটা তৃতীয় রাস্তাও থাকতে পারে। আমি মোহনবাগান সাপোর্টার নয় মানেই কি ইস্টবেঙ্গল? সিপিএম নই মানেই কি তৃণমূল? বিরাট লম্বা নই মানেই কি খুব বেঁটে? চিন্তার মধ্যে এই মেরুকরণের ধারণা ঢুকে গেলেই মৌলবাদীদের খুব সুবিধা হয় মানুষের মগজধোলাই করতে। ফলে চিন্তায় এই মেরুকরণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি। শিল্পের বিরুদ্ধে এই গায়ের জোর বা হুমকি দেখিয়ে আসলে কোনো লাভ হয় না। আর গায়ের জোর দেখিয়ে বেড়াতে হয় তাকেই, যে আসলে দুর্বল। গৌতম বুদ্ধ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা এদের কোনোদিন গায়ের জোর দেখিয়ে নিজের দিকে লোক টানতে হয়নি। সুতরাং এইধরণের ধর্মীয় হুমকি বা আস্ফালন শুধুমাত্র অপর ধর্মের মৌলবাদকে আরও উশকে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।