
চৈতালীর কবীর – অনুবাদের এক ভিন্ন ভাষা
হিন্দোল ভট্টাচার্য
চৈতালীর কবীর/ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ধানসিড়ি প্রচ্ছদ সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায় দাম-১২৫ টাকা পাওয়া যাবে ধানসিড়ির আউটলেটে, ফ্লিপকার্টে, বইঘরে
সাহিত্য অকাদেমি থেকে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে কবীরের অনুবাদ বা হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবীর অনুবাদ এবং আরও অসংখ্য কবীর অনুবাদের চেয়ে চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের কবীর অনুবাদ কোথায় আলাদা, তা নিয়ে আলোচনা করতে হলে সমস্ত অনুবাদ নিয়ে বসে যে আলোচনা, তা করার প্রয়োজনই মনে হয় আমাদের নেই। কারণ বইটির নাম হল ‘চৈতালীর কবীর’ এবং এই অনুবাদের মাধ্যমে কবীর চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের মর্মে কতটা প্রবেশ করেছেন, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা এখানে একটু ভিন্ন ধরনের অনুবাদের জগতে প্রবেশ করলাম। এই ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, যে অনুসৃজন এবং অনুবাদের মধ্যেকার পার্থক্যের জায়গাটি আমরা জানি। আমরা এখন এও জানি, ভাব, কবিতা এবং কবিতার মধ্যবর্তী যে ভাবনার বয়ন তা যখন একজনের মনে ও মেধায় প্রবেশ করে, সেখানে ব্যক্তি কবি কিছুতেই নিজেকে একটি অনস্তিত্বে পরিণত করতে পারেন না। এইবার প্রশ্ন হল তিনি কতটা নিজেকে সেই টেক্সটের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন একজন পাঠক হিসেবে এবং কতটা সমালোচক হিসেবে। চৈতালীর কবীরে পাঠকের সমালোচক সত্তাটি একেবারেই নেই। বলা যেতে পারে, তিনি তাঁর মরমীয়া সত্তা দিয়েই কবীরের সেই সব কবিতাগুলিকেই বেছে নিয়েছেন, যেগুলি তাঁর প্রাণের পরে খেলা করে বসন্তের হাওয়ার মতো। এই করতে গিয়ে অনেকের মধ্যেই একপ্রকার বিচ্যুতি দেখা যায় এই ভাবে, যে, সেখানে আবার সেই অনুবাদক কবি এমন ভাবে ঢুকে পড়েন,যে মূল কবি হারিয়ে যান। এখানে চৈতালী একেবারের সচেতন, কবীর নামক হিমালয় সদৃশ্ অস্তিত্বটির সম্পর্কে। ফলে তিনি কখনও মিশিয়ে দিচ্ছেন নিজেকে তাঁর সঙ্গে এবং কখনও আলাদা থাকছেন তাঁর থেকে। এই যাওয়া আসার এক মধুর সংলাপ আমরা অনুভব করছি, কিন্তু তা অশ্রুত। অনেকটা কীটসের আনহার্ড মেলোডিজের মতো।
” কীই বা চাইতে পারি/ সব নশ্বর/ চোখের সামনে দিয়ে/ কেবলই দৃশ্য সরে যায়” অথবা যখন তিনি বলছেন, “যখন যেখানে যাই/ আত্মধ্বংসকারী/ জ্বলছে বারুদ। আমি যাই…” তখন অনুবাদকের ব্যক্তিত্বের কাব্যভাষা অনেকটাই আধুনিক ফ্রেমে এনে হাজির করছে কবীরকে। আসলে অনন্তকালের দিকে যাঁরা তাকিয়ে থাকেন, তাঁদের তো কোনও সময় হয় না সেভাবে। তাঁরা ভাষা দিয়ে আলাদা থাকেন অনন্তকালীন সময়ের থেকে। ভিন্ন ভাষা বলে আমরা অনেকেই ভুল করে সেই কবিতা বা টেক্সট-কে প্রাচীন বলি অর্বাচীনের মতো। কিন্তু এই প্রাচীনত্বের মধ্যে থাকে চিরকালীন এক ভাষা। আর সেই ভাষাকেই ধরার চেষ্টা করেছেন এখানে চৈতালী। ধরে রেখেছেন এমনভাবেই যেমন নাড়ী ধরে থাকে কেউ। তার পর তাকে নিজের ভাবগত ভাষায় কাব্যে পরিণত করেছেন। ফলে সমগ্র গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে চৈতালীর কবীরের সঙ্গে এক মিথষ্ক্রিয়া, এক সংলাপ যা শেষ হয় না, এক যাপন, যার কোনও বাঁধন নেই, কিন্তু প্রেম রয়েছে।
ফলে কবীর যেমন সরল, কবিতাগুলিও তেমন সরল ভাষায় অনূদিত। সেখানে কোনও তত্ত্বের প্রবেশ নেই। এই যে সেতুবন্ধনটি সম্ভব হয়েছে এই বইতে, এ এক অন্যরকম পাওয়া আমাদের। ‘হরিনাম ভজে যারা/ আমার হৃদয়ে তারা” – এর মতো সুন্দর এবং সরল সত্য উচ্চারিত হচ্ছে এই গ্রন্থের প্রায় সর্বত্রই। কবি ডুব দিচ্ছেন এবং ডুব দিয়ে ওঠার পর তাঁর স্নানরত ভিজে অথচ ঝলমল করা চিত্তটিকে আমরা স্পর্শ করতে পারছি। কবি, কবীরকে যেন জল থেকে তুলে আনলেন। আর আমাদের সামনে হাজির করে বললেন, এই হল আমার কবীর।
একটি অনুবাদে যেমন তিনি বলছেন, ” পণ্ডিত, তোমাদের তর্কবিতর্কগুলো/ তুচ্ছ বই তো নয়!/ আশ্চর্য! এমন সম্বল করে/ পালিয়ে বেড়াচ্ছ সত্য থেকে”। এই অনুবাদে কবীরের আত্মাটুকু ধরা আছে অল্প কয়েকটি কবিতার মধ্যেই। তাঁর পড়া এবং অনুবাদ দুটিই মিশে গেছে তার কারণ তিনি যে অনুবাদগুলি করেছেন এখানে, সেগুলি আসলে তাঁর পাঠক্রিয়াই। অর্থাৎ, আমরা এটুকু বুঝতে পারি, তিনি প্রায় আদর করার মতো করে কবীরের দোঁহাগুলির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। ‘চৈতালীর কবীর’ তাই চৈতালীর কবীর পাঠ এবং একজন কবি কীভাবে আরেকজন কবিকে পাঠ করেন, তা ফুটে উঠছে তিনি যখন তাঁর পাঠকেই করে তুলছেন অনুবাদক্রিয়া।
এটি এক স্বতন্ত্র অনুবাদের ধারা হয়ে উঠতেই পারে। যা অ্যাডাপ্টেশন নয়, অনুসৃজনও নয়, লাইন থেকে লাইন অ্যাকাডেমিক অনুবাদ নয়, বরং এক ভিন্ন ধারার প্রতিনিধি, যে ধারা অনুবাদকৃত কবিকে হৃদয়ে পুনরায় স্থাপন করে।
কবির পাঠক্রিয়াকেও আমরা বুঝতে পারি।