চিন্তার চিহ্নমালা ৩
সন্মাত্রানন্দ
"পাখিদের বাঙ্ময় আর গাছেদের নীরবতা—শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের এই যে সম্ভাব্য বিনিময়—সে যেন চেতনার একই সমতলে অবস্থিত নয়। পাখি-চেতনা আর গাছ-চেতনা একই স্তরের নয়। পতঙ্গ, মানুষ, পাখি ও গাছ চেতনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে স্পন্দিত হয়ে চলেছে। তবু এই সব স্তর একান্ত বিবিক্ত নয়। কোনো কোনো তন্ময় মুহূর্তে ওই সব ভিন্ন ভিন্ন স্তর পরস্পরকে ছেদ করে। সেই সব মুহূর্তে স্তরগুলির ভিতর বিনিময় হতে পারে। মানুষও তখন হয়ত বা ক্ষণিকের জন্য টের পেতে পারে পাখিদের কিংবা গাছেদের মনের কথা। দুটি ভিন্ন মানুষ মনের দুটি ভিন্ন স্তরে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনও কখনও একে অপরের চোখে চেয়ে পড়ে নিতে পারে যেমন অন্যের মনের কথা।" সন্মাত্রানন্দ লিখলেন ধারাবাহিক গদ্য 'চিন্তার চিহ্নমালা'-এর তৃতীয় পর্ব।
চিন্তার চিহ্নমালা’-র প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —-> প্রথম পর্ব
‘চিন্তার চিহ্নমালা’-র দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন—> দ্বিতীয় পর্ব
পাখি
‘পাখি পুঁতছি। পাখি গাছ হবে, বাবা!’
লখার তিন বছরের ছেলে নিতাই। নিতাই মরে গেছে। লখা পাখি ধরে বিক্রি করে বাজারে। লখার স্বপ্নে ফিরে আসে নিতাই। লখা দ্যাখে, নিতাই একটা মরা পাখি মাটিতে পুঁতছে। কেন সে এমন করছে জিগগেস করলে নিতাই উত্তর দেয়, ‘পাখি পুঁতছি; পাখি গাছ হবে!’
এমনই এক অদ্ভুত কথা নিতাইয়ের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর ‘চরাচর’-এ। অদ্ভুত, কেননা এভাবে ভাবি না আমরা সচরাচর। নিতাইয়ের বিশ্বাস, পাখি জন্মান্তরে গাছ হয়। তখন আবার সেই গাছে এসে বসে আকাশের পাখি।
পাখিরা আমাদের অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছে। আমরা দেখেছি, আকাশ ও মাটির ভিতর বিরতিবিহীন চলাচলই পাখির জীবন। পৃথিবীতে জন্মালেও আকাশের প্রতি তার আজন্ম ঔৎসুক্য। পাখিকে দেখেই মানুষ হয়ত প্রথম ওড়ার স্বপ্ন দেখেছে। বাস্তবের পাখি তাই মানুষের চোখে এক আশ্চর্য স্বপ্নবিকল্প।
কী ভাষায় কথা বলে পাখিরা, আমরা জানি না। সকালে ও সন্ধ্যায় আমরা তাদের ছেদহীন ডাকাডাকি করতে দেখেছি, শুনেছি। কখনও সে একা একা কোথাও বসে ডাকে। যেন কাউকেই সে তার সুর শোনাচ্ছে না। শুধু নিজের জন্যেই গাইছে সে। না গেয়ে পারে না, তাই গেয়ে চলেছে। সে একরকম। আরেকরকম তারা যখন একসঙ্গে একদল মিলে কোনো গাছে বসে কিচিরমিচির করে। নিশ্চয়ই পরস্পর কথা বলে তারা তখন। কিন্তু কী তাদের ভাষা? সেই ভাষা যেন অসম্ভব জৈবনিক, শরীরের নানারকম উত্তাপ থেকে সেসব ধ্বনির জন্ম। তাদের কথায় কি আকাশের অভিজ্ঞতা তারা পরস্পর ভাগ করে নেয়? আমরা তা জানি না।
অনেক সময় দেখেছি, সব ক-টা পাখি একইসঙ্গে কথা বলে চলেছে। তাহলে শুনছে কে? তবে কি তারা তখন নিজেদের মধ্যে নয়, কথা বলছে গাছের সঙ্গেই? তাদের সম্মিলিত ধ্বনি দিয়ে তারা কি গড়ে তুলছে কোনো ঐকতানের ভাষা, যে ভাষা গাছই শুধু বুঝতে পারে? একটি পাখির কথা হয়ত বুঝতে পারে না গাছ। অনেক পাখি মিলে ডাকাডাকি করে যে হারমনির জন্ম দেয়, সেই হারমনিই হয়ত একমাত্র স্পর্শ করে গাছের চেতনাকে।
গাছ কি কোনো উত্তর দেয় পাখিদের কথার? গাছের ভাষা—নিশ্চয়ই তেমন কিছু আছে। কিন্তু কেমন সে ভাষা? নীরবতা কি তেমন কোনো ভাষা হতে পারে, যা কেবল বুঝতে পারে পাখি? পাখি কি গাছকে বলে তার আকাশের কথা? আর বিপরীতে গাছ কি পাখিকে শোনায় মাটির গভীরে যেসব অপার রহস্য আছে, সেইসব?
মাটির অনেক গভীর অবধি গাছের শিকড়ের অন্তবিহীন সংগ্রামের উপাখ্যান পাখি জানে না। আমরা কেউই জানি না। আমাদের সে নিয়ে কৌতূহল নেই তেমন। পাখিদের আছে। তাই কি পাখি মরে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকে? মাটির সঙ্গে মিশে কোনো পুনর্ভবের বীজের ভিতরে ঢুকে পাখি গাছ হয়ে যায়? যেমনটা বলেছিল ‘চরাচর’-এ নিতাই?
গাছের ঊর্ধ্বমুখ শাখাপ্রশাখার আক্ষেপ দেখে মনে হয় আমার, গাছও ফিরে যেতে চাইছে যেন আকাশে। যেন তার পূর্বজন্মের কথা, পাখিজন্মের কথা মনে পড়ে গেছে। মনে পড়ে গেছে, সে একদিন পাখি ছিল।
পাখিদের বাঙ্ময় আর গাছেদের নীরবতা—শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের এই যে সম্ভাব্য বিনিময়—সে যেন চেতনার একই সমতলে অবস্থিত নয়। পাখি-চেতনা আর গাছ-চেতনা একই স্তরের নয়। পতঙ্গ, মানুষ, পাখি ও গাছ চেতনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে স্পন্দিত হয়ে চলেছে। তবু এই সব স্তর একান্ত বিবিক্ত নয়। কোনো কোনো তন্ময় মুহূর্তে ওই সব ভিন্ন ভিন্ন স্তর পরস্পরকে ছেদ করে। সেই সব মুহূর্তে স্তরগুলির ভিতর বিনিময় হতে পারে। মানুষও তখন হয়ত বা ক্ষণিকের জন্য টের পেতে পারে পাখিদের কিংবা গাছেদের মনের কথা। দুটি ভিন্ন মানুষ মনের দুটি ভিন্ন স্তরে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনও কখনও একে অপরের চোখে চেয়ে পড়ে নিতে পারে যেমন অন্যের মনের কথা।
সেটা সম্ভব, যেহেতু আলাদা হলেও দুজন মানুষের চেতনা খুব দূরবর্তী নয়। দুজনেই মানুষ। অনেককিছুই তাদের একরকম বলে, এটা সম্ভব। তাহলে গাছ ও পাখি—এদের চেতনার নৈকট্যও কি অনুমান করা যায় না? পাখি গাছনিষ্ঠ। গাছ পাখিনিষ্ঠ। কোথাও নিশ্চয়ই বোঝাপড়া আছে ওদের! ‘বোঝাপড়া’ শব্দটা কি এখানে খুব মনুষ্য-সমাজনিষ্ঠ হয়ে গেল?
বোঝাপড়া হয়ত নয়। জল আর বরফের মধ্যে যেমন বোঝাপড়া নেই, একটি আরেকটির রূপান্তর, তেমনই হয়ত হবে ব্যাপারটা। পাখির সুর স্তব্ধীভূত হয়ে থাকে গাছের নীরবতায়। গাছের নীরবতা একদিন কথা কয়ে ওঠে পাখির গলায়।
এসব প্রায় মিথিকাল, কল্পনা ছাড়া অন্য কোথাও এসবের সমর্থন মিলবে না। কিন্তু প্রমাণ সম্ভব নয় এমন সব কল্পনা থেকেই এক-একটা মৌলিক চিন্তার জন্ম হতে পারে। সেই চিন্তাটার পেছনে সঙ্গত যুক্তির অভাব নেই। তা হচ্ছে—পাখির ডিমের ভেতরেও তো আছে একই নীরবতা, একই অন্ধকার। সেই নীরবতায় জমে আছে সমস্ত সুরের সম্ভাবনা, যা একদিন পাখির গলায় গান হয়ে ঝরবে। সেই পাখি একদিন ডিম রেখে যাবে, ডিমের ভিতর রেখে যাবে তার জীবনব্যাপী সকল গানের স্বরলিপি—সকল সুরের স্তব্ধীভূত রূপ।
একটি ডিম যেন দুটি পাখির মাঝখানের অন্ধকার সেতু। যেন দেখা হয়নি এমন দুজন কবির মাঝখানের একখানি কবিতার বই। সেই কবিতার বইটি পেরিয়ে, সেই অন্ধকার সেতুটা পার হয়ে এক কবির সঙ্গে দেখা হতে পারে প্রজন্মান্তরের আরেক কবির কবিতাভুবনের। এক পাখির সঙ্গে আরেক পাখির।
পাখি জড়িয়ে আছে আমাদের সাহিত্যে, সঙ্গীতে, পুরাবৃত্তে। ক্রৌঞ্চমিথুনের বিচ্ছেদহেতু আদিকবির প্রথম উৎসার থেকে শুরু করে হংসদূতের মুখে প্রণয়ের বার্তা প্রেরণ সাঙ্গ করে অন্ধকার রাত্রে ঘাতককে হত্যার পরামর্শ দিয়েছে কোনো আদিম পেচক মহাভারতের সৌপ্তিক-পর্বে। । সেই পেচকের কোনো উত্তরসাধিকা, কোনো ‘প্রগাঢ় পিতামহী’ মধ্যরাত্রের অন্ধকারে ডানা ভাসিয়ে উড়ে গেছে জীবনানন্দের কবিতায় দুয়েকটা ইঁদুর ধরার তাগিদে। শান্ত, মধুর, বীভৎস, করুণা, জীবনপ্রীতি—পাখিকে দিয়ে অন্তহীন কাজ করিয়ে নিয়েছেন আমাদের কবিরা। তবু পাখিকে চেনা হয়েছে তাতে? কেন পাখি উড়ে যায় আকাশে, ফিরে এসে ডালে বসে কী কথা বলে, জানি কি আমরা কেউ?
আরেক অন্য ধরনের পাখির কথা বলেন রামকৃষ্ণ। তিনি বলেন, বেদে নাকি ‘হোমাপাখি’র কথা আছে। বেদের অনেক শাখাই হারিয়ে গেছে। জানি না, কোথায় আছে সেই হোমাপাখির কথা। কিন্তু সে পাখি বড়ো অদ্ভুত। সেই পাখি নাকি কেবল আকাশেই থাকে। কখনও মাটিতে এসে বসে না। আকাশেই সেই পাখিরা ঘনিষ্ঠ হয়। ডিম পাড়ে। সেই ডিম তখন পৃথিবীর টানে নেমে আসতে থাকে বাতাস বেয়ে। পড়তে পড়তে সেই ডিম ফোটে। তখন হোমাপাখির সেই সদ্যোজাত শাবক পড়তে থাকে নীচে। পড়তে পড়তে ডানা বের হয়, চোখ ফোটে পক্ষীশাবকের। সে দেখতে পায়, সে পড়ে যাচ্ছে। আরেকটু পরেই কঠিন পৃথিবীর উপর, শক্ত মাটির উপর পড়ে চৌচির হয়ে যাবে। তখন পাখা মেলে সে উড়ে পালায় ‘চোঁ-চাঁ’ করে সেইখানে, যেখানে তার মা আছে।
রামকৃষ্ণের এই ‘হোমাপাখি’ আর লালনের ‘অচিন পাখি’ তাঁদের সুগভীর মরমী অনুভবের অভিব্যক্তি। ‘হোমাপাখি’ সেই সব মানুষদের রূপকল্প, যাঁরা কখনও সংসারে জড়িয়ে পড়েন না। তাঁরা যেন অন্য ভুবন থেকে এসেছেন। তথাগত। সংসারের সংস্পর্শে আসামাত্রই তাঁদের মনে পড়ে যায় সেই প্রমুক্ত আকাশের কথা। কোথাও না জড়িয়ে পড়ে তাঁরা ফিরে যান স্বভুবনে। আর লালনের ‘অচিন পাখি’, তাকে চেনা যায় না, সে দেহের খাঁচার ভেতরে আসে, যায়, জড়িয়ে পড়ে না। মনোবেড়ি জড়িয়ে পাখির পা বাঁধা যায় না, সেই অন্তহীন আক্ষেপ আর বিরহের আগুনে পুড়ে কবি-সাধকেরা নিজেরাই হয়ে ওঠেন সেই অচিন পাখি।
আরও একধরণের পাখির কথা বলেন রামকৃষ্ণ। যার বাসা পুড়ে গেছে সংসারের আগুনে। বাসা পুড়ে গেছে বলে সে আকাশ আশ্রয় করে থাকে।
অথবা সেই চাতক, আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জল ছাড়া আর কোনো জলে যার তৃষ্ণা তৃপ্ত হয় না। নিদাঘ-মধ্যাহ্নে সারা আকাশের শূন্যতা যে ভরে দেয় তার অপার তৃষ্ণার আর্তিব্যাকুলতায়।
এইসব উপমার পাখিরা আসলে মানুষের ভিতরে বসে থাকা বিহগসত্তাকেই নির্দেশ করছে। মানুষ আসলে পাখিই। সে মরে গিয়ে গাছ হয়। মাটির রহস্য সামান্য বুঝে নিয়ে সে আবার পাখি হয়ে আকাশে ফিরে যেতে চায় এক আদিম ইকারুসের মতন।
(ক্রমশ)
অপূর্ব!পরের অপেক্ষায় রইলাম।মুগ্ধ হয়ে আছি রেশ এখনো কাটেনি।
ধন্যবাদ। নমস্কার নেবেন।
অপূর্ব।যেন এক কবিতা।এই লেখকের লেখা যত পড়ছি ততই মুখোমুখি কথা বলবার আগ্রহ বোধ হচ্ছে।
এখানে যে পাখিদের কথা আছে সেই সব পাখি ছাড়াও মানুষের সাহিত্যে আরেক পাখির কথা শোনা গেছে।সে হল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী।তারা রাজপুত্রকে বলে দেয় কীভাবে অশুভ শক্তিকে হারিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে আনবে।
ব্যঙ্গমার কথা লিখব ভেবেছিলাম। পরে লিখতে লিখতে ভুলে যাই।
দেখা হবে নিশ্চয়ই কোথাও। শুভেচ্ছা ও নমস্কার নেবেন।
অপূর্ব পাখি কথা ।মনকে কোন অতলে নিয়ে যায় এই লেখা ।শুভেচ্ছা এক আকাশ ।
অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
এটা তো গল্প নয়! এ তো একটা কবিতা! চরাচরব্যাপী পরিব্যপ্ত একটি কবিতা যা গাছ থেকে পাখি হয়ে আকাশে উড়ে যায়,সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। আবার ইকারুসের মোম-ডানা হয়ে টুপটাপ গলে গিয়ে ফিরে এসে মিশে যায় মাটির বুকে মাঝে। বৃত্তাকার পরিভ্রমনের আখ্যান।