চিন্তার চিহ্নমালা ১
সন্মাত্রানন্দ
'প্রকৃতি’ বলতে আমি আপাতত ‘নিসর্গ’-ই বোঝাচ্ছি। যেখানে মাথার উপর অনন্ত অন্ধকার আকাশ, নক্ষত্রবীথি, ধীরসঞ্চরণশীল মেঘ, কুয়াশার কুহকের ভিতর থেকে একটু একটু করে যেখানে জেগে ওঠে নদীর আদল, যেখানে পড়ন্ত বেলার আলোর রেণুকা মেখে পড়ে থাকে মাঠের অলীক, অরণ্য যেখানে তার যাবতীয় রহস্য ও মহৎ মৌনের ভিতর নির্জন নির্জন কোনো পাতাঝরা পথের কথা বলে, পাহাড় যেখানে ডাক দেয় পাখিদের, আমি সেই প্রকৃতির আবেষ্টনীর ভিতর ফিরে গিয়ে যন্ত্রণার উপশম পেয়েছি প্রতিবার। আবহমানে শুরু হল সন্মাত্রানন্দের নতুন ধারাবাহিক ' চিন্তার চিহ্নমালা'। আজ প্রকাশ পেল তার প্রথম পর্ব৷
নিসর্গ
জীবনে যতোবার বড়ো বড়ো আঘাত পেয়েছি, অপমানিত হয়েছি, বিষাদের বিষ সমস্ত শরীরে মনে ছড়িয়ে পড়ে আমাকে একেবারে কাঠ-একা করে দিয়ে গেছে, ততোবার ফিরে গেছি প্রকৃতির কাছে; ফিরে গিয়ে উপশম পেয়েছি দুঃখের, নিরাময় পেয়েছি অসুখের। ‘প্রকৃতি’ বলতে আমি এখানে প্রাথমিকভাবে সাংখ্য দর্শনের ‘অব্যক্ত’ কিংবা বেদান্তের ‘মায়া’ কিংবা তন্ত্রের ‘শক্তি’ বোঝাচ্ছি না, এমনকি প্যান্থেয়িস্টদের তত্ত্ব অথবা হুইটম্যান-থোরো-এমারসনের কাছেও আমার এই ‘প্রকৃতি’কে বুঝবার জন্য এখনই যাওয়ার দরকার নেই। প্রাথমিকভাবে আমি এখানে ‘প্রকৃতি’ শব্দটি সব থেকে সহজবোধ্য অর্থেই ব্যবহার করছি। অর্থাৎ ‘প্রকৃতি’ বলতে আমি আপাতত ‘নিসর্গ’-ই বোঝাচ্ছি। যেখানে মাথার উপর অনন্ত অন্ধকার আকাশ, নক্ষত্রবীথি, ধীরসঞ্চরণশীল মেঘ, কুয়াশার কুহকের ভিতর থেকে একটু একটু করে যেখানে জেগে ওঠে নদীর আদল, যেখানে পড়ন্ত বেলার আলোর রেণুকা মেখে পড়ে থাকে মাঠের অলীক, অরণ্য যেখানে তার যাবতীয় রহস্য ও মহৎ মৌনের ভিতর নির্জন নির্জন কোনো পাতাঝরা পথের কথা বলে, পাহাড় যেখানে ডাক দেয় পাখিদের, আমি সেই প্রকৃতির আবেষ্টনীর ভিতর ফিরে গিয়ে যন্ত্রণার উপশম পেয়েছি প্রতিবার।
এমন একটা সময় ছিল আমাদের দেশে, যখন দুরারোগ্য মহামারী দেখা দিলে ভারতের প্রাচীন ভিষগেরা পুথির পাতায় তার সমাধান না খুঁজে চলে যেতেন নিরুদ্দেশে। কিছুদিন তাঁদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যেত না। জনশ্রুতি রটে যেত নগরের রাজপথে, হয়তো-বা মারা গেছেন তাঁরা। আসলে কিন্তু তাঁরা তখন লোকালয় ছেড়ে প্রবেশ করতেন গহন অরণ্যে। সেখানে অপরিচিত লতাপাতা, ওষধি, বৃক্ষত্বকের গুণাগুণ নিয়ে তাঁরা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতেন, সেসব থেকে কোনোভাবে প্রাদুর্ভূত মহামারীর নিরাময় খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। কখনও-বা ফিরে আসতেন মারণ রোগের অব্যর্থ ঔষধ নিয়ে হাসিমুখে। কুমার সিদ্ধার্থকে আমরা এই প্রাচীন ভিষগদের পদাঙ্কই অনুসরণ করতে দেখি। অনেক পরে বুদ্ধের চিন্তা ও প্রজ্ঞাকে দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এমনকি পরমতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর হিরন্ময় নিস্তব্ধতা থেকেও গড়ে উঠেছে দার্শনিক মত। এমন হওয়ার ফলে, আমরা ভেবেছি বুদ্ধ বুঝি দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনকাহিনির দিকে খালি চোখে তাকালে মনে হয়, তিনি তো আসলে এই ভবরোগের চিকিৎসক ছিলেন। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ব্যথিত কুমার সিদ্ধার্থ এক রাত্রে অতিক্রম করেছিলেন কপিলাবস্তু রাজ্যের শাক্য-অধিকৃত সীমা, অনামা কোনো নদী পেরিয়ে তিনিও প্রবেশ করেছিলেন পরপারের গহন অরণ্যে। সেখানে ধ্যাননিষ্ঠ যোগীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মানব-অস্তিত্বে বিলগ্ন অনাদি দুঃখরাশির নিরাময় হয় কী উপায়ে। তাঁদের কাছে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে নৈরঞ্জনা নদীতীরে উরাইল বনের ভিতর তিনি নিজেই বসেছিলেন ধ্যানে, দুঃখের কোথায় শেষ তা জানতে। এই যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া, এটি তাহলে আমাদের দেশের এক অতি প্রাচীনকাল হতে অনুসৃত পন্থা।
এখানে দুটো ঘোর আপত্তি উঠবে, আমি জানি। প্রথমত, সেই নিসর্গপ্রকৃতি এখন আর নেই কোথাও। আমরা গাছ কেটে ফেলেছি, মাঠ ভরিয়ে তুলেছি উন্নয়নের অট্টালিকায়, নদীকে দূষিত করেছি নানা রাসায়নিকের বিষ দিয়ে, মাটির অতল থেকে জল সব তুলে খরচ করে ফেলেছি, আকাশ ঘুলিয়ে তুলেছি বিষাক্ত ধোঁয়ায়। কাজেই ভারতের প্রাচীন ভিষগরা যে চলে যেতেন রাজ্য ছেড়ে বনপথে, শরীরের শান্তি খুঁজতে কোনো জীবক কিংবা মনের শান্তি খুঁজতে কোনো সিদ্ধার্থ—সেসব এখন আর সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের সমস্যার নিরাময় খুঁজতে কেন যাব আমরা মানুষকে ছেড়ে দূরে? কেন মানুষের সমাজের মধ্যে বসেই এসব কূট সমস্যার নিদান খুঁজব না? এই চলে যাওয়া তো এক ধরনের পলায়নপরতা।
প্রথম আপত্তির উত্তরে বলব, আমাদের চারিপাশে সেই প্রকৃতির বিস্তার এখন আর নেই কোথাও, সেকথা আমি জানি তো! প্রকৃতির সেই আততায়ী আমরাই—আমিই—আমারই দুই হাত ভরে গেছে প্রকৃতির রুধিরে। আমিই ঘাতক। কিন্তু এত কিছুর পরেও এখনও খুঁজলে আশেপাশে কোনো না কোনোভাবে খুঁজলে পেয়ে যাই এক টুকরো আকাশ, চলে যাওয়ার আগে প্রকৃতি তার হাসির শেষ আভাসটুকু রেখে গেছে তার ছেলেমেয়েদের জন্য, যারা তাকে হত্যা করেছে, সেই তাদেরই জন্য এই তার অন্তিম আশীর্বাদ। ঘর ছেড়ে একটু পথে বেরোলেই, শহর ছাড়িয়ে একটু মেঠোপথ ধরলেই আজও আমরা দেখি আমাদের শরীরের চারিপাশে তার জ্বলে যাওয়া আঁচলের শেষ খণ্ডখানি অনন্ত আশীর্বাদের মতো বিস্তারিত রয়েছে। সেটুকুর কাছে ফিরে যেতে চেষ্টা করতে পারি কখনও কখনও, যেহেতু এছাড়া অন্য কোনো ওষুধ আমি পাইনি।
দ্বিতীয় আপত্তিটি আমি ভালো বুঝি না। সমস্যার ভিতরে বসে থেকে সমস্যার সমাধান আমি কখনও পাইনি। সমাধান তো দূরের কথা, এমনকি সমস্যাকে ভালো করে বুঝতে হলেও অর্থাৎ সমস্যার সমগ্র অবয়বকে যুক্তিসিদ্ধভাবে ধারণা করতে হলেও সমস্যাটির থেকে একটা ন্যূনতম দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়। নাকের ডগায় ভীমরুলের চাক ঝুললেও টের পাওয়া যায় না, যতক্ষণ না সেই চাকটার থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। বস্তুকে অবলোকন করার জন্য সামান্য দূরত্বের প্রয়োজন, খুব কাছে এলে কিংবা খুব দূরে চলে গেলে তাকে আর দেখা যায় না। তাছাড়া সমাজের সম্যক হিতচিন্তকেরা আমার একথা কেন বুঝতে চান না যে, মানুষের খুব কাছে ফিরে আসব বলেই দূরে যেতে চাই আমি। নানা মানুষের ও ঘটনার আঘাতে যেখানে নিজের মনটাই গেছে বিগড়ে, সেখানে নিজের মন সুস্থ করে না তুলতে পারলে কী দিয়ে আমি অন্য মানুষের কথা ভাবব? মনের সেই শুশ্রুষার জন্যই আমাকে যেতে হবে জন ছেড়ে বনের দিকেই।
কেউ বলবেন, তা কেন? ভিড়ের মধ্যে থেকেও কি আমি ডুব দিতে পারি না মনে? সেভাবেও তো তাহলে অবলোকনসাপেক্ষ দূরত্বে যেতে পারি আমরা। তার জন্য বনে যেতেই হবে কেন? কথা সত্যি। কেউ যদি তা পারেন, তবে তো ভালই। যেখানে অন্তর্নিবিষ্ট হওয়ার অনুকূল পরিবেশ নেই, যেখানে ভিড়, যেখানে কথা কথা আর কথা, সেখানেও যদি কারও নিজের ভেতর ডুব দিয়ে নিজের ও অন্য মানুষের অসুখের নিরাময় খোঁজার অলোকসামান্য প্রতিভা থাকে, তবে তাঁর জন্য বনের দরকার নেই। কিন্তু আমি শুধু আমার বা আমার মতো করে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের কথাই বলছিলাম। আমি তো দেখেছি, প্রকৃতির অন্তরাল ছাড়া, নির্জনতা ছাড়া আমি আমার মনকে স্নান করাতে পারি না, কমণ্ডলুতে ভরে অন্যদের জন্য তুলে আনতে পারি না তীর্থজল।
নিসর্গপ্রকৃতির আবেষ্টনীর মধ্যে বসে কতবার আমার মনে প্রশ্ন উঠেছে, কেন এবং কীভাবে প্রকৃতি আমাকে শান্ত করে তুলছে? কেন সেই শান্তি আমি পাই না মানুষের কাছে বসে? এ প্রশ্নের একটা আবছা উত্তর এসেছে মনের ভিতর। আসলে প্রকৃতি আমাদের কোনোকিছুকেই সরাসরি ছাড়তে বলে না বলেই, আমাদের সমস্ত কিছুকেই সে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেই আমরা তার মধ্যে স্বস্তি পাই। শান্তি পাই। মা যেমন খেলাফেরত শিশুকে তার দুই বাহুর ঘেরে প্রথমেই জড়িয়ে ধরে, তারপর তাকে নানা কথায় ভুলিয়ে স্নান করায়, নিজেও স্নান করে, প্রকৃতিও অমনই আমার সীমাবদ্ধতা, আমার স্খলন-পতন-ত্রুটিকে অঙ্গুলিনির্দেশে চিহ্নিত না করে প্রথমেই সবসুদ্ধ আমাকে স্বীকার করে নেয়। তারপর তার শান্তকরুণ মুখখানি পরতে পরতে ঘোমটা খুলে দেখায়। সেই রূপ আমার মনকে তুলে নিয়ে যায় এমন এক উচ্চতায়, যার থেকে অনেক নীচে পড়ে থাকে আমার ছোটোবড়ো ভ্রান্তি, সীমাবদ্ধতা, বিষাদ, অপমান। ওগুলো যেন কিচ্ছু না প্রকৃতির চোখে। ওগুলো তখন আমি অক্লেশে ভুলে যেতেই পারি। ধুলোকাদা ধুইয়ে মুছিয়ে কোলে নেওয়ার এই-ই প্রকৃতিকৃত পদ্ধতি।
কিন্তু মানুষ তো প্রকৃতি থেকে অতিরিক্ত কিছু নয়। একজন মানুষকে দেখার সময় সেকথা কেন আমরা মনে রাখতে পারব না? কেন একটি মেয়েকে, একজন পুরুষকে দেখার সময় মনে রাখব না আমি, এই মানুষটিও আসলে এক অন্যরকমের গাছ? তা যদি পারি, তবে জনের সংশ্রবেও বনের শান্তিই পাব। তবে তার জন্যে এই ভিশনটি আয়ত্ত্ব করে নেওয়া দরকার। আর সেকথা আমাকে শেখাতে পারে শুধু নিসর্গপ্রকৃতিই।
ভারতবর্ষ প্রথাগতভাবে ধর্মের দেশ নয়। ভারতবর্ষ জিজ্ঞাসার দেশ। ভারতের আত্মা উপনিষদ। সেই উপনিষদের আলোকিত পৃষ্ঠায় বারবার এই জিজ্ঞাসাকেই উদ্রিক্ত করে তোলা হয়েছে। কী জানলে সব জানা হয়? কী আছে জন্মমরণের পর? কার দ্বারা প্রেরিত হয়ে আমাদের চোখ দেখে, কান শোনে? কে জেগে আছে শাশ্বত অন্ধকারের মধ্যে? শ্বাস না নিয়েও কে ধারণ করে আছে প্রাণ?
শ্রুতির আরণ্যক প্রদেশ এই প্রশ্নের আলোতেই অর্চিষ্মান হয়ে আছে। বৃহদারণ্যক তাই একটি উপনিষদের নাম। এসব জীবন-জিজ্ঞাসা মেটাতে তাই বারবার ভারতের মনীষা আমাদের চিরশিক্ষিকা নিসর্গপ্রকৃতির কাছেই ফিরে গেছেন। আমরাও যাব।
(ক্রমশ)
নিসর্গের নির্জন করুণ স্নেহ এই লেখার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। তাই এই গদ্যের কাছে এসে দাঁড়ালে সেই স্নেহের ছোঁয়া অনুভব করা যায়
এই স্নেহ প্রকৃতির।
আহা কী অপূর্ব ভাবনা , কী অসামান্য গদ্যশৈলী । যে ভাষায় এমন মানুষেরা লিখছেন এখনও , সে ভাষার আর ভয় নেই । সে ভাষা নিশ্চই আরও অনেকদূর হাঁটবে । বাংলা ভাষায় আপনার লেখা আসলে আমাদেরই আনন্দ । আমাদেরই স্ফূর্তি । আমাদেরই স্তব্ধতা মাখানো শান্তি ।
শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা
অপূর্ব লেখাটি । মন জুড়িয়ে দেয়।
ধন্যবাদ
ভিষগাচার্যের ওষধিগুণ সম্পন্ন শুশ্রূষা, উপসম ও উত্তরনের সন্ধান দেয় আপনার লেখনী।
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
অনেকখানি মনের শুশ্রূষা এই লেখাটি। ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জানাই।
শ্রদ্ধাবনত নমস্কার
খুব ভালো
ধন্যবাদ
অসাধারণ গদ্য লিখন… অভিভূত হলাম,পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ। পরের পর্ব ‘নৈরাজ্য’ প্রকাশিত হয়েছে।