ঘুমভাঙানিয়া কবি…   –  <br /> বেবী সাউ

ঘুমভাঙানিয়া কবি… –
বেবী সাউ

কবি শঙ্খ ঘোষের ৮৯ তম জন্মদিনে আবহমানের শ্রদ্ধার্ঘ্য

চারপাশে তাকালে কেমন যেন একটা ত্রাসের শব্দ ভেসে ওঠে। যেন একটা ভয় খেলে বেড়াচ্ছে। তার সেই রক্তাভ চোখ নিষেধের একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডি টেনে বলছে, অধিকার চাই, অধিকার দাও। চিৎকার, চেঁচামেচি, আস্ফালন দেখে দেখে সমস্ত দুনিয়া হয় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে একটা অন্ধকার কালো ঘরে না হয় বন্দুক হাতে নেমে পড়ছে। আরও হিংসা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে, রক্তের লোভে। নাম লেখাচ্ছে গতানুগতিক ধারায়। আর তাতেই যেন সমস্ত সমাজ, সমাজের চারপাশ আরও ভয়ার্ত, শীতার্ত হয়ে আকড়ে ধরছে হিংসাকে। কেননা, হিংসা তো হিংসাকেই ডেকে আনে। আমি যদি তোমাকে দু-থাপ্পড় মারি, অপমান করি দু’চারটে চার অক্ষর দিয়ে, তুমিও তখন হিংসায় জর্জরিত হয়ে আমাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছ গলা কাটা লাশ। সেই লাশ গড়াতে গড়াতে যখন এসে পৌঁচচ্ছে আমার উঠোনে, তখনই ঘরের কোণে রাখা মরচে ধরা কুঠার, দা, ভাঙা বঁটি যেখানে যা আছে, যা তোমাকে হিংসা দেবে, প্রতিহিংসাপরায়ণ এক দৃশ্য দেবে তাই নিয়ে দে ছুট… ততক্ষণে পেট্রোল, ডিজেল, বোমা, বারুদের পোড়া গন্ধে ভরে গেছে রাজপথ। টায়ার জ্বলছে। ভাঙা কাচের টুকরোর পা আরও ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠছে। মরে যাচ্ছে যাকে আত্মীয় ভেবেছি এতদিন, যাকে দিয়েছিলাম বন্ধুত্বের আসন। হত্যা আর হত্যা। মৃত্যু আর মরণের নেশা যেন ততক্ষণে গ্রাস করে ফেলেছে সমস্ত পরিবেশকে, সমস্ত আমিকে, আমার আমিত্ব বোধকে। কিন্তু হুঁশ নেই। বেহুঁশ এই অবস্থান থেকে আমাদের বাঁচাবে কে? কে পেতে দেবে অন্য গাল! কে বলবে, হিংসা নয়, কথা বল আগে। শোনা যাক, তোমার পাওয়া, না-পাওয়া, অসন্তোষ। কিন্তু শোনারই বা লোক কোথায়? কাকে বলা যাবে অভাব অভিযোগ! কে তুলে দেবে তৃষ্ণার জল, বারুদ গন্ধহীন বাতাস… কিন্তু একেবারেই যে কেউ নেই, তা নয়্য, আছে। . একমাত্র আমাদের এই অস্থির সময় থেকে বাঁচাতে পারে সেই— আমাদের সহিষ্ণুতা। ছোটবেলা যখন আমরা স্কুল-কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করতাম,,আমাদের প্রধান শিক্ষক ডেকে এনে সব কথা মন দিয়ে শুনতেন। আমরা তখন গলগল করে বলে যেতাম, পেনসিল ভাঙার কথা, রবার হারানোর কথা। গভীর মন দিয়ে তিনি সব কথা শুনতেন। তারপর মৃদু, শান্ত স্বরে আমাদের বলতেন, (যেন খুব একটা গোপন কথা, আমাকে ভালোবাসেন বলেই বলছেন এমন ভাব করে), “জানিস তো যে সয়, সে রয়!” এই যে শিক্ষা, নীতিবোধ আমাদের যাপনে ঢুকিয়ে দিতেন, আজ কী এমন কোনও শিক্ষা আছে, যে নম্র হতে শেখাবে! যে শেখাবে আরও শান্ত হয়ে পরিস্থিতির ভালো মন্দ খতিয়ে দেখার মত নিজেকে সংযত এবং সংহত করার শক্তি দেবে! দেবে আমাদের সহ্য এবং সহনের শক্তি এবং আমাদের বিবেকবোধ। বুদ্ধি। সত্য মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা… আমরা কি পারবো? আমরা যদি সত্যি সত্যি ক্রীতদাস না হয়ে সত্যকে আলিঙ্গন করি, সহিষ্ণুতা আমাদের স্পর্শ করবেই। আর অস্থির মুহূর্তে সেটাই একমাত্র ওষুধ। একমাত্র দওয়াই। কেননা, আমাদের মনের সেই সুপ্ত বিবেক, হারিয়ে যাওয়া সহিষ্ণুতার মন্ত্র আমাদের এখনও নাড়িয়ে তোলে। জেগে উঠতে চায়… তখনই এই ব্যথার দুনিয়ায়, ক্ষত বিক্ষত দুনিয়ায়, সমাজে উপশম হিসেবে পেয়ে যাই একটি অভিনব কাব্যগ্রন্থ “এও এক ব্যথা উপশম”। কবি শঙখ ঘোষ এই কাব্যগ্রন্থটিকে তিন পর্বে ভাগ করেছেন। জন্মভূমি, সন্ন্যাস এবং রাত্রিপথগামী। প্রথম পর্বটিতে কবি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ নিজের মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে, পশুরও অধম হয়ে উঠছে। এই পর্বের কবিতাগুলিতে কবির মনের হতাশাময় দিকটি ফুটে উঠেছে। ‘সন্ন্যাস’ পর্বের কবিতাগুলোতে মনের দোটানা, নিজের সঙ্গে নিজের বিরোধ, কষ্ট এবং শেষ পর্বে কবি তুলে আনতে চেয়েছেন অতীতের বিক্ষিপ্ত সুন্দর এবং অসুন্দরময় সহাবস্থানের পারস্পরিক বিরোধের কথা। ব্যথাময় এই শহরে তা কতটা মলমের কাজ করবে, তা জানি না। আসলে কবিতা তো একটা সময়ের সাক্ষী হয়ে ওঠে। আমাদের যাপন কথা বলে অক্ষরের মাধ্যমে, কবিতা হয়ে। সময় কথা বলে ওঠে। আসলে, সেভাবে বললে বলা যেতে পারে বাস্তব এই সমাজের জন্য ” এও এক ব্যথা উপশম”।
গন্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে যেমন, অন্তর্গত কথোপকথনের মধ্যেই উঠে এসেছিল সমকালীন যন্ত্রণাবোধের এক একটি অসহায় দৃশ্য। কবির সেই যে অসহায়তা, তা থেকে তিনি যেন এখানে একটু আলাদা। তিনি পরিত্রাণ খুঁজছেন। আর এই পরিত্রাণে তিনি আত্মশক্তি ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুর মধ্যেই সেই আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন না। আত্মশক্তির বিভিন্ন রূপ তাই নানাভাবে নানা মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে।

” লোকটা কি আজও চমকায়? আজও
স্বপ্ন ভাঙলে ধমকায়? ঝোড়ো
বৃষ্টির ঝাঁপ পেলে কি মুখোশ
উড়ে যায় এক দমকায়? আর
মানুষেরই হাত হাতে নেয় আজও
সনাতন অভ্যাসে?
না যদি, তাহলে নিশ্চিত জেনো
লোকটার হয়ে গেছে!

ধ্বংসের পাশে সংসার যদি
গোপনে আলোয় দংশায়, তবু
তোমার চোখের সঞ্চারে সে কি
আজও হয় নিঃসংশয়? আর
হঠাৎ সান্ধ্য গৈরিকে আজও
বুক কাঁপে সন্ন্যাসে?
না যদি, তাহলে নিশ্চিত জেনো
লোকটার হয়ে গেছে!
-এই তো আলো! এই তো জ্ঞান! এই তো ভেতরের প্রজ্ঞা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আলোময় এক পথের দিকে। আমরা কি এখনও নির্লিপ্ত হয়ে থাকবো? এখনও চাইবো অপমানের বদলা অপমানকে? খুনের বদলে ধর্ষণ, রাহাজানিকে? নাকি আলোর অপেক্ষা করবো? এই ব্যথার শরীরে লাগাবো আরও নুনের ছিটা নাকি ঠান্ডা অ্যান্টিবায়োটিক রোগ প্রতিরোধী মলম! এযাবৎ পুষে রাখা এই হিংসার ব্যথা আমাদের শুধু ক্ষতবিক্ষত করেছে। দেশ কেড়ে নিয়েছে। ভাবনা কেড়ে নিয়েছে, আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি আমরা। ব্যথার গভীরে হারিয়ে যেতে যেতে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের ধর্ম। মানবতার ধর্ম। মনুষ্য ধর্ম। কিছু মৌলবাদ জন্ম হয়েছে পরিবর্তে। এই দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? কখনও না। খেটে আনি, খাই। শান্তিতে হাঁটতে চাই, পেরোতে চাই পথ। এই টুকু তো চাওয়া আমাদের! আর কী! যেন এক করালবদন সময় তার পিপাসা মেটানোর জন্য আমাদের গ্রাস করে নিতে চাইছে। ভেঙে দিতে চাইছে। আমাদের সহানুভূতিশীল মননের ভেতর এতদিনে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে ধর্মের অন্য এক বিকৃত মানে! বিকৃতভাষ্য সেই ধর্মকে নিয়ে আমাদের মনুষ্যত্ব বশ্যতা শিকার করে নিচ্ছে শয়তানের। ধর্ম মানে যা ছিল বাঁচা এবং বাড়ার পথ, তা এখন রক্তের গন্ধে পিচ্ছিল। পা পিছলে আমরাও বেশ আছাড় খাচ্ছি। কিন্তু হুঁশ নেই। যে রাষ্ট্র আমাদের দায়িত্ব নেবে বলেছিল, যে গণতন্ত্র আমাদের অধিকার দিয়েছিল তারাই আমাদের করে তুলছে খুনী এক আত্মঘাতী জাতিতে। তার শেখানো ভেদাভেদ হয়ে উঠছে আমাদের ধর্ম। এগোনোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে আমাদের মনুষ্যত্ব বোধ, আমাদের নিজেকে ভালো রাখার, ভালোবাসার ক্ষমতাটুকু। কিন্তু কিসের এত জিঘাংসা? কেন এত বিক্ষুব্ধ অবস্থান আমাদের? মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ছাড়া আমাদের তো কোনও অধিকারও নেই? একটা একাকী মেয়ে কিছুতেই হেঁটে যেতে পারে না আজকাল নির্ভয়ে। ফুটপাতের পথে ওৎ পেতে থাকে ক্ষুধা। লোভ। বিকৃত শরীরের নেশা। একজন তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাওয়া মানুষ রোগে কাতরাতে কাতরাতে জল চাইলেও কে দেবে তাকে নিরাময়? কেন এটা কি গণতন্ত্র নয়? এসব কি গণতন্ত্রের আওতায় পড়ে না? নাকি মেকি এক সভ্যতার মানুষ হয়ে উঠছি আমরা ক্রমশ! যে সভ্যতায় ক্ষুধার্ত মাছের মতো গিলে খাচ্ছি নিজের বংশজকে! আর তখনই এক নির্জন কলম, শান্তির প্রত্যাশী হয়ে লিখে বসেন,
” গণতন্ত্র? গণতন্ত্র তন্ত্র মাত্র, গণ শুধু শোভা
গতি দিতে পারে তাকে তোমারই নিজস্ব কোনো প্রভা। ” (গুরুশিষ্য-সংবাদ, পৃ. ১৪.)

কিছুদিন হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পরিসংখ্যানগত নিউজ খুব ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে শেয়ার করে হাপিত্যেশও শুরু করে দিয়েছেন। নিউজটা এরকম –ভারতে সংখ্যা লঘু হয়ে পড়েছেন হিন্দুরা। তারপর বিভিন্ন রাজ্যে কত পারসেন্ট মুসলমান, খ্রিষ্টান, কত পারসেন্ট বৌদ্ধ, শিখ, জৈন এসব দেখানো হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখানো হচ্ছে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে। আর চিৎকার করে বলা হচ্ছে হিন্দুদের দুরাবস্থার কথা। কিন্তু কেউ একজন একবারও উল্লেখ করছেন না এরাও মানুষ। হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান সবাই তো মানুষ। শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ। এখানেই এদের জন্ম, এখানে তাদের বড় হয়ে ওঠা। এখানে এরা থাকে কারণ এখানে তাদের যাপন। পরিচয় পত্রে লেখা ভারতের নাম। তাছাড়া যার যেখানে বাড়ি সে তো সেখানেই থাকবে! নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে। ভালোবাসবে চারপাশটিকে। তবে? এত ভেদাভেদ আসছে কোথা থেকে? মানুষ তো আর হারিয়ে যাচ্ছে না! বিলুপ্তপ্রায় কোনও জীবের মতো তাকে তো আর সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই! তবে? এই ভেদাভেদ, এই ধর্ম নিয়ে ধর্মের এই উলঙ্গনৃত্য আমাদের কোন শমনের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে? আর আমরাও এক গিনিপিগ জীবে কী পরিনত হচ্ছি না? ক্ষমতা আমাদের যা শেখাবে তাই মেনে নেব? তাই সত্য হয়ে উঠবে আমাদের কাছে? এ বড় অস্থির সময়, এ বড় ভয়াল অবস্থান। এই ব্যথা থেকে উপশম একমাত্র আমরাই নিজেরাই বের করে নিতে পারি। নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারি এক স্বচ্ছতার স্বচ্ছন্দ যাপন। বিবেকবোধ, সহানুভূতি, মানবিকতার মনুষ্য ধর্মই পারে এই পঙ্কিল অবস্থা থেকে আমাদের তুলে আনতে! নাহলে সেই দুঃসহ দুঃস্বপ্নের মতো আমাদের নিয়ে যাবে পুরনো ইতিহাসে…

” পঁচিশ বছর আগে উঠেছিল এই সোর—
‘ইয়ে তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায়’
দুসরা ঝাঁকি ছিল বুঝি গুজরাতের অন্ধকারে
মুছে দেওয়া ন্যায়-অন্যায়।

আজ মনে হয় যেন সত্তর বছর পর
ঠিক ঠিক সবাই স্বাধীন—
গরিবি কোথাও নেই, ভুখা নেই কোনোখানে
সামনে শুধু স্বচ্ছ আচ্ছে দিন।

তিসরা ঝাঁকি দিকে দিকে, কোনোখানে কালবুর্গি,
কোথাও-বা গৌরী লঙ্কেশের
খরা জরা জলস্রোতে রক্তস্রোতে ভেসে যায়
স্বপ্ন যত ভবিষ্য দেশের।

গলায় মুন্ডুর মালা, তাথৈ তাথৈ নাচে
গোটা দেশ হয়েছে ভাস্কর–
আজ সে-পরীক্ষা হবে আমরা শুধু শববাহক
না কি কোনো সত্যভাষী স্বর! ( তিসরা ঝাঁকি পৃ.২৩)

কিন্তু তখনই কবি শেষ লাইনে এসে দেখালেন এক বিকৃত সমাজের চিত্রকে। ফুটিয়ে তুললেন আমাদের লোভ, আকাঙ্ক্ষার কদর্য রূপটিকে। আমাদের ভাষা নেই, স্বর নেই। কোনও আকাঙ্খাও নেই সম্ভবত। এই ভয়ের স্বদেশ আমাদের কাছে তুলে ধরেছে তার কদর্য লোভাতুর অবস্থানটিকে। এই ভয়াবহ দৃশ্যের মধ্যে বাস করতে করতে আমরা পালন করছি এক ভয়ার্ত উদ্রেককারী মনের। কিন্তু তার মধ্যেও তো স্বপ্ন দেখি। প্রত্যাশায় বাঁধি বুক। আবার অন্যভাবে ভাবলে দেখা যায়, প্রতিটি পালনের মধ্যেও একটা প্রত্যাশিত অপেক্ষা থাকে। সেটাই কী উঠে এসেছে এই কবিতাটিতে!

” একটা আশ্চর্য দিন আজ।
তন্ন তন্ন খুঁজে দেখি ভোরের কাগজে, কিন্তু কোনোখানে হত্যাকাণ্ড নেই!
মানুষ মানুষকে খুন করছে না গোটা একটা দিন—
এও কি সম্ভব হতে পারে?
সাংবাদিক ভুল করছে না তো?
মানুষ কি জঙ্গলের ভব্য সহিষ্ণুতা পেল পুরো এক দিন?
হতে পারে না তো।
বাঘকে খায় না বাঘ, সিংহকে সিংহেরা
সে তো জঙ্গলেই শোভা পায়।
মানুষ কি কখনোই অতদূর শোভাময় হবে?
এসো দেখি আরো একবার অক্ষরে অক্ষরে ঝুঁকে পড়ি
প্রাণপণ খোঁজে —
কোথায় লোলুপ কোন কৃপাণ বা ভল্ল ছুটে আসে
ধর্মাতুর নরমাংসভোজে। ” ( অক্ষরে অক্ষরে ঝুঁকে, পৃ. ১৯)

যে পর্বটি শুরু হয়েছিল “জন্মভূমি” নিয়ে, কথা মুখে ভেসে উঠেছিল কথা বলতে বলতে চলা গুরুশিষ্যের মধ্য দিয়ে ‘ গুরুশিষ্য -সংবাদ’, সেই পর্বটি এসে ফুরায় ‘জন্মভূমি’ নামকবিতায় এসে। সেখানে যেন কবি নিজেকেই নিজে বলে ওঠেন
” ১
এখনও কবিতা লিখছ? বাঃ!
ব’লে পিঠ চাপড়ে দিয়ে হালকা পায়ে চলে গেলে তুমি।

হতভম্ব চেয়ে দেখি, ওই কাছে দূরে
হাড়ভাঙা আনমনে পড়ে আছে আমার নিভৃত জন্মভূমি!


ঠিক। সব জানি।
দুহাতে অঞ্জলি করে তুলে নিচ্ছি আগুনের শাঁস।
দুচোখ যদিও পুড়ছে,তবু
এ-দুই চোখেই আমি দেখে যাচ্ছি সমস্ত– সমস্ত রাহাজানি।


সব দিকে ঘিরে ফেলছে। কোন দিকে দৌড়োব সেটা বুঝতেও পারি না ঠিক আর।
এই দিকে?— কাটা পড়বে হাত।
ওই পাশে?— হলকা আগুনের।
অন্যেরা কোথায়?— সঙ্গে নেব কাকে?
কাউকে কি ডেকেছি একবারও?
তবে কি পিছিয়ে যাব আরো?

পিছোতে পিছোতে— শুধু পিছোতে পিছোতে— কেটে গেল গোটা এ জীবন।

আরো যাবি? মন?

ক্ষত বিক্ষত একটা সময়ের সাক্ষী থাকা মানে নিজেকে সমান ভাবে বিক্ষত করে তোলা। অস্থির মুহূর্ত যেন প্রতিটি যাপনকে দুর্বিসহ করে তোলে। ভেঙে ফেলে। ‘নিভৃত জন্মভূমি’ বা একান্ত বলে যে জায়গাটির সঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমি, সেটুকুও যদি হারিয়ে ফেলি, তখন তো একজন মানুষ সম্পূর্ণভাবে পরবাসী। তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সন্ত্রাস। আততায়ীর বন্দুকের নিশানা। পরাজয় স্বীকার করতে করতে নিজেকে যেন পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি করে ফেলা হল, এই মুহূর্তে!

আর তাই বোধহয়, এর পরের পর্বের নাম ‘সন্ন্যাস’। তবে কী নিরুপায় হয়ে মানুষ নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে চায়? চারপাশের অশান্ত দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে একটা মোহহীন জগতের বাসিন্দা হিসেবে? নাকি এখানে কবি নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য, নিজেকে আরও ধৈর্যশীল, আস্থাশীল করে তোলার কথা বলতে চান! কেননা, সহনশীলতা, ধৈর্য, মানবতা চর্চাই একমাত্র বাঁচিয়ে তুলতে মনুষ্যত্বকে, বিবেকবোধকে।

এই পর্বের প্রথম কবিতাটি এই রকম,

“আচমকা সেদিন ফোনে প্রশ্ন করলেন একজন
‘অমন কবিতা লিখতেন
যে সমর সেন
মাত্রই তিরিশে এসে তিনি কেন এমনই হঠাৎ
লেখা ছেড়েছেন?
এর কোনো আছে সদুত্তর? ‘

মুখ খুলবার আগে নিজেকেই মনে মনে বলি;
‘বাপু, শোনো,
ও-প্রশ্নের জবাব দেবার আরো অনেক সময় পাবে পরে,
আপাতত ভাবো—
টেলিফোনে আজও বুঝি বাজেনি সে-স্বর —
তুমি কেন ছাড়োনি এখনও?’ ( টেলিফোনে, পৃষ্ঠা ৩৭)

এখানে কবিতা কি তবে প্রতিবাদের স্বর? বাঁচার প্রতিবাদ। বাঁচতে চেয়ে প্রতিবাদ। অধিকার পাওয়ার প্রতিবাদ। অধিকারী হয়ে ওঠার প্রতিবাদ। তাই বুঝি টেলিফোনের সেই স্বর হুমকি হয়ে বাজছে না তো। থামাও থামাও নিজেকে। এত ঝড় কেন? এত বিদ্রোহ কেন? জানো তো, আমরা শাসক। শাসনের অধিকার আছে আমাদের। যা বলবো, মেনে নাও। নাহলে মরো। এইযে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া, স্তব্ধ হও; আর ভয়ের চিহ্নস্বরূপ বেজে যাচ্ছে টেলিফোন… যার রিংটোন ধারালো, কর্কশ এবং চকচকে…
আর তখনই যেন দ্বিধাগ্রস্ত কবির অন্তরে ফুটে ওঠে সুর। সন্ন্যাসের সুর!

” একা ঘরে অন্ধকারে যখন ভেবেছি শুধু কিছুমাত্র সামনে নেই আর
যখন ফুরিয়ে আসে শ্বাস
চেতনা মলিন করে কেবলই বাড়ায় মনোভার
জানলা দিয়ে দেখি শুধু খণ্ড খণ্ড নিঃসাড় আকাশ
তন্দ্রা এসে ঢাকে—
তারই মধ্যে মনে হয় হঠাৎ যেন-বা কোনো পরিব্রাজকের ছন্দে এসে
কোনো এক স্বপ্নমূর্তি মিশে যায় সেই তন্দ্রাবেশে
ভাসে কোনো দূরায়ত স্বর;
‘ওই দেখ, কৃপার বাতাস বইছে সব দিকে, পাল তুলে দে না–‘

জেগে উঠি, কিছুমাত্র ভাবিও না আর
দুহাতে মেটাতে যাই সমস্ত জমিয়ে-রাখা দেনা
খুলে দিই ঘর
পরিব্রাজকের মূর্তি মুছে যায় মুহূর্তের শেষে
ডাক শুনে বাইরে এসে খুঁজি তবু কোথায় সে-স্বর
আদ্যোপান্ত গৃহীও যে, প্রশ্ন করে দেখি তারও কাছে—
ভিতরে সন্ন্যাস যদি না থাকে তো ঘূর্ণিটানে প্রতিদিন কীভাবে সে বাঁচে?” ( কৃপার বাতাস, পৃ. ৪১)

আর কবির কাছে এটাই যেন ব্যথা উপশমের ওষুধ। সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করতে পারে যে, যে পারে অপেক্ষা করতে সুসময়ের — তখনই তো মন শান্ত হয়ে ওঠে। শান্ত মন আশার আলো দেখে। আশার পথ বাঁধে। ভেতরের এই সন্ন্যাস তাকে উজ্জীবিত করে তোলে। কেননা, জীবন তো একটা বৃত্ত। সময়কে বেঁধে রাখার কৌশল শিখতে চেয়েছে মানুষ। আবার ‘চক্রানি পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুঃখানি চ’। কিছু তো হারায় নি কখনও। হারায় না। শুধু অবস্থান পালটে যায়। তাই হয়ত ‘স্বপ্নমূর্তি’ এখানে ব্যক্তি। জাগরিত বিবেকবোধ। শুধু বিভিন্ন ভাবে নিজের সঙ্গেই নিজের খেলা যেন খেলছে সে। কখনও সুখে, কখনও বা দুখের। কিন্তু ফিরে আসছে সেই পূর্ব অবস্থায়। ত্যাগ নেই যেমন তার, মায়াও নেই। স্থির নয় তাও মদো মাতালের মতো টলটলেও নয়। বিভিন্ন রূপের এবং রূপকের সাহায্যে সে যেন আজ এক বিস্তারিত সময়ের পথিক। হাঁটছে আর হাঁটছে। আর হাঁটতে চাইছে বলেই হেঁটে যাচ্ছে।
আর তখনই এই ঘূর্ণিটান স্থির হচ্ছে।

” চৈত্রে ছিলে ঈশানঝড়ের বিষম প্রতীক্ষায়
আচমকা এক বাঁক নিয়ে সে ছুটল অনেক দূরে—
দিগদিশাহীন ঘুরছ এখন পথ-বিপথের ধাঁধায়
আকাশজোড়া আকাট এ রোদ্দুরে!

সঙ্গ দেবার জন্য কোনো হাত নেই আর কোথাও
সংগোপনের মন বুঝবার মন–
কিসের উপর ভর করেছ হদিশ তো নেই তারও
দাহর পরে দাহই অনুক্ষণ।

ভুলটা ছিল কোথায় তবে? ছিল ঘরের কোণেই।
অবাধ কোনো টান ছিল না গৃহ-স্থ সন্ন্যাসে।
প্রশ্নটা তো এই নয় যে কেমন আছো তুমি—
প্রশ্ন ছিল, ওরা কেমন আছে।” ( গৃহ-স্থ সন্ন্যাস)

আর তারপরেই শুরু হচ্ছে ‘রাত্রিপথগামী’ পর্বটি। ‘এও এক ব্যথা উপশম’ কাব্যগ্রন্থটির এটা শেষ পর্ব। যে যাত্রা শুরু করেছিলেন কবি ‘জন্মভূমি’ তে, মধ্যিখানের ‘সন্ন্যাস’ পেরিয়ে, মনের দোলাচল পেরিয়ে সেই যাত্রা ঢুকে পড়ছে এক অন্ধকারময় এক পথ। আর তাকে অনুসরণ করতে করতে আরও বিভ্রান্ত হয়ে উঠছে সময়। নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কবি চোখ তোলেন নিজের দিকে। নিজেকে দেখেন। আসলে নিজেকে দেখা মানেই তো চারপাশটি আরও প্রকটভাবে প্রকাশিত করে তোলা, এই বলার মধ্যে, দেখার মধ্যে ক্ষীণ হলেও কী একটা আশার সুর বেজে ওঠে না! হয়তো সেই সুর দূরের, কিন্তু অসম্ভবের না। তাই হয়তো কবি বলে ওঠেন —

” আমি যদি অসুন্দর হয়ে উঠি, তবুও তো
সুন্দর চলেছে পাশে পাশে—
আমি যদি মুহুর্মুহু বাচালতা করি, তবু
সামান্যও কথা বলে না সে।
আমি যদি ভাঙা পায়ে এ-গলিতে থাকি লীন
সে তবু ছড়িয়ে যার ধান
এমনই অন্নদা হাতে মুখ থেকে মুছে নেয়
আমার সমস্ত অপমান।
আমি যদি কোনো দিন শব্দহীন হয়ে যাই
সে আমাকে বুঝে নেয় ঠিক
সে যতই দূরে গিয়ে ছুঁতে চায় সনাতন
আমি তত সমসাময়িক। ” ( সমসাময়িক, পৃ. ৫৫)

কিন্তু তার পরের কবিতাটিতে মনুষ্য সমাজের প্রতি কবির আফসোস-কষ্ট-লজ্জা যেন বিরাটভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। এই কাব্যগ্রন্থটির প্রথম পর্বে যে একটি কবিতাটিতে কবি স্বপ্ন দেখার মতো করে একটা আশাবাদ জিইয়ে রেখেছিলেন, ‘ মানুষ কি জঙ্গলের ভব্য সহিষ্ণুতা পেল পুরো এক দিন? /হতে পারে না তো। /বাঘকে খায় না বাঘ, সিংহকে সিংহেরা
সে তো জঙ্গলেই শোভা পায়।’ আজ শেষ পর্যায়ে এসে যেন স্বপ্ন দিবাস্বপ্নের আকার ধারণ করেছে। আর সেই ভাবের প্রকাশ হয়েছে ‘রাত্রিপথগামী’ কবিতাটিতে—
” সঙ্গী কোথাও ছিল না কেউ, কার্যত তার শোকে
গিয়েছিলাম ফিরে এবার বৃহদারণ্যকে।

অবশ্য ঠিক, এই কথাটাও বলতে পারে লোকে
সঙ্গ যে খুব দিতেই হবে এমন মানুষ ও কে?

এর তো কোনো জবাবই নেই। দেখছি ভেবে বেশ
আহ্লাদে-এই ভুলবাহারে পালটেছে অভ্যেস—

ইচ্ছেটা বেশ চিকনচাকন, কিন্তু ফেলে ঘর
ভয় পেয়ে সে এদিক-ওদিক দৌড়েছে বিস্তর।

এবার যদি জঙ্গলে কেউ কচমচিয়ে খায়?
শাসন করব তাকে তখন মনুষ্য আখ্যায়।

অসম্মানে পালিয়ে যাবে। এবং তখন আমি
বেড়ালছানার সঙ্গে হব রাত্রিপথগামী।” ( রাত্রিপথগামী, পৃ. ৫৬)

তখন রাত্রিকে, অন্ধকারকে মনে হয় খুব শান্ত, নির্জন। এই তো সহনের উপযুক্ত পরিবেশ। উপযুক্ত আনন্দ। আলো নগ্ন রূপ কবিকে যে শান্তি দিতে পারেনি, এই শান্ত অন্ধকার সেই শান্তির, সহ্যশক্তি দিয়েছে। রাত্রি এখানে ভয়াল নয়, শান্ত। জীবজন্তুরা এখানে স্বজন বোঝে। জানে স্বজনবিরোধ করা যায় না। কিন্তু আজ মানুষ মাখছে মানুষের রক্ত। মানুষ মারছে মানুষকে। মানুষের গন্ধে মানুষের জিভ ভরে যাচ্ছে জলে। যা দেখে বনের জন্তু জানোয়ারেরাও নিজেদের গালাগাল দিতে হলে বলবে, কবির ভাষায়,’ এবার যদি জঙ্গলে কেউ কচমচিয়ে খায়?/শাসন করব তাকে তখন মনুষ্য আখ্যায়। ‘
মানুষের নগ্ন রূপটি কবি এই দুটো লাইনে পুরোপুরি উপস্থাপন করলেন। আর তখন হয়ত সেই ‘কচমচিয়ে’ খাওয়া খাদকটিও হয়ত অসম্মানে, লজ্জায় পালিয়ে যাবে। কেননা, এর চেয়ে আর অসম্মানজনক গালাগাল আর কিছু হতে পারে না। আর তখনই সুযোগ বুঝে নিরীহ, শান্ত বেড়ালছানা হবে কবির অন্ধকার শান্ত ভেদাভেদহীন পথের সঙ্গী। কিন্তু যদি বলা যায় বেড়ালছানা কেন? এসব ধর্মপথের থিম হিসেবে আমরা তো দেখে এসেছি কুকুরকে। তখন মনেহয়, এ পথ তো আসলে সন্ন্যাসের। আত্মগোপনের। আত্মশ্লাঘারও বটে। যেভাবে কুন্তী, গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর বেছে নিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের পরে!

“… দড়িদড়া খুলে গিয়ে মাঝিরা ঘুমোয় অন্ধকারে—/ উর্ধ্বমুখে শুয়ে আমি— দুহাত ছড়ানো পাটাতনে।/ যতদূর দেখা যায় সবই শুধু সেই মুখচ্ছবি/ ভুলে যাই সমস্ত আঘাত ক্ষত, ভুলে যাই ত্রাস / মিহি শিশিরের কণা নিপাট শরীরে ঝরে পড়ে/ শেষ নিশ্বাসের পাশে ভেসে আসে প্রথম নিশ্বাস”— যেন কিছু হয়নি এতদিন
চারপাশের রক্ত মুছে গেছে। গুলি বারুদের গন্ধ নেই কোনও। চারপাশটি আজ বড় শান্ত, বড় শান্তির। এখন দুহাত ছড়িয়ে ঘুমোনো যায়। শিশিরের শব্দে আজ ‘আনন্দগান ঝরিছে’। যেন… যেন…যেন… প্রথম নিশ্বাসের মতো বিশুদ্ধ পবিত্র চারপাশ। আর তখনই অতীত ফিরে ফিরে আসে। আসে শান্ত সমাধিফলক, ‘সূর্যমুখী’, ‘পুবের কোঠা’, দিদিমার গন্ধ গল্প করে এসে। ‘ মায়া’ ময় এই পথ দীর্ঘ এবং ‘জটিলতাময়’। আর ফিরে আসে ‘সবরমতী’। ঈষৎমাত্র ভ্রুভঙ্গিতে আলতো স্বরে বলে: / ‘ চিনতে পারেননি তো? আমি সবরমতীর মেয়ে।’ ঠিক এখানেই ঘটে যায় ব্যথার উপশম। কিন্তু ব্যথা কী ফুরায়! ব্যথা কী মুছে কখনও! শুধু এক এক্কটা কাল রাত্রি পেরিয়ে হেঁটে যেতে হয় অন্য একটি কালের দিকে। আরেকটা অধিকতর ধারণার দিকে। তাই বোধহয় ” এও এক ব্যথা উপশম” কাব্যগ্রন্থটির শেষ কবিতায় ” নিকটজনের আঘাত? সে তো সক্কলেরই নসিব! /কাল সকালে পাবই ফিরে একলা চলার দ্যুতি।/ ঠিক বলেছেন। বাঁচিয়ে ঠিকই দেবেন রবীন্দ্রনাথ।” তারপর একটু স্পেস দিয়ে মারাত্মক, নিষ্ঠুর বাস্তব যেন ফুটে উঠল সমগ্র কাব্যগ্রন্থটির প্রতিনিধি হিসেবে ” আত্মহত্যা ঘটল এর ঠিক দু-ঘন্টা পর।”
তবে কি বলতে পারি স্বয়ং ইতিহাসের মতো, সময়ের মতো কবি এক নির্লিপ্তিকে খোদাই করেছেন এই পর্বের কবিতাগুলির মধ্যে? না, তাও মনে হয় বলতে পারি না আমরা। কারণ নিশ্চেষ্ট নির্লিপ্তি থাকলে কবি কখনওই ব্যথা উপশমের কথা বলতেন না। আসল কথা হল, কবি এখন জানেন, শুধুমাত্র ব্যথায় কাতর না হয়ে বোধির হাত ধরে ব্যথার মূল কারণকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলার কাজটিই করা আবশ্যক। কিন্তু তা একদিনে হবে না। কবি মূর্খ বড়, সামাজিক নয়। কিন্তু এই অ-সামাজিক অস্তিত্ব সত্যের কাছে নীরবতার শব্দ তুলে ধরছেন এক ভিন্ন ভাষায়। আবহমান পুরাণের এক একটি দৃশ্যের কাছে নতজানু হয়ে দেখছেন কীভাবে সেই সব দৃশ্য আজও বহমান। একজন কবি হিসেবে যেমন তিনি বহমান আবহমানকে স্পর্শ করছেন এই কাব্যগ্রন্থে, তেমন, সমকালের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিচ্ছেন। যেমন আরেক কবি বলেছিলেন- ওঠো হে, সময়ের ঝুঁটিতা এইবেলা শক্তহাতে ধর”। বহুদিন ধরেই কবি শক্ত হাতে সময়ের ঝুঁটি ধরে আছেন। এই ধ্বংসস্তূপ-সম সময়ের কাছে একজন বিবেকের মতোই তিনি শুধু প্রত্যক্ষ করে যাওয়াটাই তাঁর কাজ হিসেবে দেখছেন না, বরং, সমস্ত রাজনৈতিক কাজের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক কাজটি করছেন তাঁর কবিতায়। অসুখ অসুখ বলে আকাশ বাতাস এক না করে দিয়ে অসুখের মূল শিকড় সন্ধান করছেন এবং এমন ভাবেই করছেন, যার মল্ধ্যে দিয়ে ধরা পড়ছে আসলে আবহমান কাল ধরে মানুষের মধ্যে থাকা ‘মানব’ এই কাজটি করে চলেছেন। যেমন ব্যথা সত্য, যেমন দুঃখ সত্য, যেমন শোষণ সত্য, তেমন সত্য এই সমস্ত কিছুর বিপরীতে কোনও একজন মানুষের সময়ের কথাকার হয়ে থাকা। আর সেই মানুষ তো সময়কে ব্যথায় নীল বিষাক্ত হয়ে যেতে দেবেন না। তিনি সেই উপশম খুঁজবেন, এ কথা জেনেও এই উপশম একমাত্র আসতে পারে নিরাময়ের মাধ্যমেই। সুতরাং নিরাময় রয়েছে কোথায়?
কবি শঙ্খ ঘোষের আজীবনের কবিকৃতি, সাধনার সঙ্গে মিশে আছে এই সভ্যতার অসুখের নিরাময় খুঁজে যাওয়া। আমরা কি বলতে পারি তবে, বইয়ের নামকরণটাইকে একটু অন্যভাবে লিখে- এই হল ব্যথা উপশম?
এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত সময়ের কলমেই লেখা হতে পারে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Ranjita Chattopadhyay 5 years

    খুব সুন্দর আলোচনা।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes