ক্রোড়পত্র: নিশীথ ভড় <br /> নিশীথদা <br /> গৌতম বসু

ক্রোড়পত্র: নিশীথ ভড়
নিশীথদা
গৌতম বসু

সাতের দশকের প্রধান কবিদের মধ্যে অনেকেই সত্তর বছর বয়সের মাইলফলক পেরোতে পারলেন না। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কোনও ক্রমে সত্তর ছুঁয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার আর বেশি দূর অগ্রসর হতে না-পেরে একে-একে বিদায় নিয়েছেন। অধুনা, এই কথাটি নিজের কাছে যতবার ফিরে আসে ততবার নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করি, এ-বিষয়ে বিষণ্ণ বোধ করার কোনও কারণ ঘটে নি কারণ জাতীয় স্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে, পুরুষ ও নারীর গড় আয়ুষ্কাল এখন যথাক্রমে ৭০.২ ও ৭৩.৩ বছর। বিষণ্ণতার কারণটি ভিন্ন; মৃত্যুর সময়ে তাঁদের প্রত্যেকের ─ তুষার চৌধুরী, নিশীথ ভড়, বীতশোক ভট্টাচার্য, শম্ভু রক্ষিত, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল প্রমুখের ─ কলম ছিল সচল, আমাদের প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেই তাঁদের প্রত্যেকের কর্মজীবন দপ্‌ ক’রে নিভে গেছে। মাত্র পাঁচজন লেখকের নাম আমরা এখানে উল্লেখ করলাম, বাঙলা কবিতার পাঠক জানেন, প্রয়াতদের তালিকা দীর্ঘ। ১৯৪৭ থেকে শুরু ক’রে দশ-বারো বছরের পরিসরে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ওপারে চ’লে যাওয়া কবিদের সংখ্যা, এপারে রয়ে যাওয়াদের চেয়ে বেশি হলেও আশ্চর্য হব না। এটা আমার মনের ভুল, না কি এর পিছনে কোনও গূঢ় কারণ আছে, তা নির্ধারণ করা যাবে না বটে, কিন্তু নিশীথদার কবিতা নিয়ে লিখতে ব’সে ওই হিমশীতল ভাবনাটি অস্বীকারই বা করি কী ক’রে? আমি যে নিশীথ ভড়-কে অল্পস্বল্প চিনতাম তিনি ছিলেন একই সঙ্গে মুখচোরা ও সপ্রতিভ, যতটা প্রত্যয়ী ঠিক ততটাই সংশয়াচ্ছন্ন। কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের বিপরীত ফুটপাথে কোনও-একটা বাড়ির দোতলায় ছিল নিশীথদা-র আপিস, সেখানে আমি মাঝে-মাঝে হাজির হতাম। হাতের কাজ সেরে, নিশীথদা আমাকে নিয়ে নেমে আসতেন, রাস্তা পার হয়ে আমরা কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে প্রবেশ করতাম। সংস্কার-পূর্ববর্তী মার্কেটের চেহারা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, তার এক প্রান্তে ছিল চপ-কাটলেট-ফিস ফ্রাইয়ের মস্ত বড় এক রেস্তোরা, সেইখানে শ্বেতপাথরের লম্বা টেবিলের দু’পাশে, ভেজিটেবিল চপ আর দু’কাপ চা নিয়ে আমরা আধ ঘণ্টা সময় কাটাতাম। আপিস পালিয়ে আড্ডা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না, আমরাও বেরিয়ে আসতাম ঘড়ি ধ’রেই, নিশীথদা তাঁর ছিপছিপে চেহারা নিয়ে এক দৌড়ে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট পার হয়ে, ওপারে পৌঁছে, একবার পিছন ফিরে হাত নেড়ে, সেই পুরানো বাড়ির ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতেন। প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বলতে এইটুকুই; তাঁর কবিতার মতোই, তাঁর শান্ত অবয়ব থেকে তাঁর মনের ক্রিয়া বুঝে ওঠা আমার পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে নি কখনও। গভীর মানুষেরা শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিচিতজনের কাছেও অচেনা রয়ে যান, অনেকটা সেইভাবে নিশীথদার গভীরতাও আমার কাছে অচেনা রয়ে গেছে। নিশীথদা লিখেছেন:

‘আমার দুরাশা নিয়ে, আমার বাসনা নিয়ে, আমার সংশয় নিয়ে

আমি বাঁচি, আমি লিখে যাই

কল্পনায়-সত্যতায়, শিল্পে, মিথ্যা জীবনে-মরণে

তরুণ-প্রেমিক আর, যাত্রীদের অদ্ভুত বর্ণনা

ঘটেছিল বা ঘটেনি অথবা ঘটবে কিনা ঘটে আছে কিনা।’

[‘স্বগত ২’](অংশ)]

আজ, এতগুলি বছর ব্যাপী বিস্মৃতির পর, তরুণদের মধ্যে তাঁর কবিতা ঘিরে আগ্রহ যখন দেখি, তখন এক দৌড়ে তাঁর কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট পার হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি মনে প’ড়ে, আর ভাবি, মৃত্যুর পরে পাঁচ-দশজন পাঠকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অর্জন করা একজন লেখকের পক্ষে কি দুর্লভ এক সিদ্ধি!

নিশীথদা যাকে ‘অদ্ভুত বর্ণনা’ বলেছেন তার নানা অভিমুখ লক্ষ করতাম তাঁর লেখায়, কখনও তিনি কাতরতালক্ষণাক্রান্ত, কখনও উত্তাল, আবার কখনও সুরমূর্ছনায় মধুর, এবং বলা বাহুল্য, যে শান্ত মানুষটিকে আমি তখন চিনতাম, তার সঙ্গে এই বৈশিষ্ট্যগুলির কিছু-কিছু মেলাতে পারতাম না। তাঁকে এ- বিষয়ে প্রশ্নও করেছি আমাদের দু’জনের নিভৃত আড্ডায়, সদুত্তর পাই নি। তাঁর পুরানো বন্ধুদের কাছে এ-প্রসঙ্গ উত্থাপন ক’রেও বিশেষ লাভ হয় নি, তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ জানিয়েছিলেন, শ্যামবাজারের মোড়ের কফি-হাউসের তরুণ কবি নিশীথ ভড়-কে না চিনলে এই রহস্য ভেদ করা যাবে না। যুক্তির দিক থেকে যতই দুর্বল হোক এই অভিমত, তাঁদের আবেগের জায়গাটি আমায় স্বীকার করতেই হয়েছিল।

নিশীথদার এই লেখাটি আজও আমার কাছে অধরা রয়ে গেছে। একইসঙ্গে বুঝি, এই কবিতা তার ন্যায্য জীবদ্দশা একদিন ফিরে পাবেই:

‘সুতোয় গাঁথা প্রণয়রাশি ওড়ে আমার হৃদয় জুড়ে

ওখানে তোর নূপুর বাজা, আধেক ভাঙা ধ্বনির চিহ্নে

যা আছে তা সব মুছে যায়, স্তনে করাঙ্গুলির মতো

এ অনন্ত চিত্রশালা ঝাঁপ দিয়েছে মদের পাত্রে।

ও মদ জ্বালো শিখার সূত্রে, সুড়ঙ্গপথ, ওই গভীরে

প্রাচীন লিপির মতো জ্বলো, জ্বরাগ্রস্ত, অভিশপ্ত।

জ্বলো হাওয়ায় অন্ধকারে, ব্যাকুলতার রন্ধ্রটি শ্যাম

পেয়েছে, বাঁশি বাজায়, নূপুর কি আরো ক্রুদ্ধ হবে রাধার।

এমনভাবে খেলতে-খেলতে খেলনা কত টুকরো হলো

জন্ম তোকে মনে পড়ে না, ভ্রমণে কত মুখচ্ছবির

ময়লা জমে উঠল মনে, এ গহ্বরে কে দেবে পা

লেলিহ লোল, জ্বলো তরল, তরলতার সরল অঙ্গে।

সুতোই যদি ছিঁড়ে পড়বে, বর্ণমালা দুলবে না আর

ভ্রূকুটি কার কঠিন হয়ে উঠবে মন্থনের পরে।

যাব কোথায়! নিরুদ্দেশও বাধা গড়ল আপন হাতে

এজন্ম বাম, প্রিয় কোনো তৈজসেরও দেখা পাইনি।

[‘তৈজসেরও দেখা পাইনি’]

অনেক উত্তীর্ণ কবিতা রচনা করেছেন নিশীথদা, যেখানে তাঁর কাব্যভাষা তাঁর মুখের ভাষা থেকে দূরে স’রে যায় নি। এর বিপরীতে রয়েছে ‘তৈজসেরও দেখা পাইনি’-র মতো অগণিত কবিতা, যেখানে কাব্যভাষা নির্গত হচ্ছে তাঁর মনের অজ্ঞাত কোণ থেকে; এই অঞ্চলের উপর স্বয়ং কবিরও পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। মজার কথা, গভীরতর কণ্ঠস্বরটি প্রথমে নিজে শোনা, এবং পরবর্তী সময়ে অপরকে শোনানোর জন্য কবিকে কোনও বই পড়তে হয় না, কোনও কবিগোষ্ঠীতে নাম লেখাতে হয় না, কেবল সেই বিরল চৈতন্যের প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে জানতে হয়। নিশীথদা এটা পেরেছিলেন। শ্বেতপাথরের লম্বা টেবিলের এপাশে ব’সে অনেকবার ভেবেছি তাঁকে জানাব এই কথা, সে আর হয়ে ওঠে নি।

নিশীথদার সান্নিধ্য লাভ করার মধ্যে আকস্মিকতার একটা কৌতুকময় আবহ থাকতো। আপিস, টিউশনি আর বাড়ি, এই জাল ছিঁড়ে তিনি যে হঠাৎ কখন কোথায় উপস্থিত হবেন, এটা অন্তত আমি কোনওদিন বুঝে উঠতে পারি নি। এইরকম কোনও এক দিনে, তিন ফর্মার একটা পত্রিকা হাতে তাঁর আবির্ভাব, মোটা ফ্রেমের চশমার পিছনে চোখ দু’টি অল্প-অল্প হাসছে। ‘এবারের(১৯৯৩) রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে এই কাজটা করলাম’। দেখি, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’-এর চতুর্থ বর্ষ নবম সংখ্যাটি পুরোটাই নতুন ক’রে ছেপে, পাঁচ টাকা দাম ফেলে, বিনামূল্যে বিতরণ করছেন। পৌষ ১২৮২। আমি ভয়ানক ভয় পেয়ে গিয়ে বিস্ময় প্রকাশ ক’রে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এ যে ১৮৭৫ সালের কাগজ, এ তিনি পেলেন কোথায়? কোনও কথা নেই নিশীথদার মুখে, কেবল লক্ষ করলাম, চোখ দু’টির হাসির মাত্রাবৃদ্ধি পেয়েছে। সেই পুনর্মুদ্রিত ‘বঙ্গদর্শন’ আজও আমার সঙ্গে আছে। সেই সংখ্যাটি এইভাবে শেষ হয়েছিল:

‘তখন সেই অন্ধকার নিশীথে, সেই বিজন কুটীরমধ্যে, সেই সদ্যবিমুক্ত প্রাণ মনুষ্য দেহপার্শ্বে বসিয়া, সেই যুবতী, রজনীকান্তের নিকট বলিতে লাগিল। সেই ভীষণ সর্ব্বস্বান্তকর কথা, কুমুদিনী যেমন মৃত্যুর নিকট শুনিয়াছিলেন, তেমনই বলিতে লাগিলেন; ক্ষুদ্র, নিস্তেজ দীপের ক্ষীণালোক কুটীরমধ্যে কাঁপিতেছিল,

─ মধ্যে মধ্যে কুটীর ভিত্তির উপর ভৌতিক ছায়া সকল প্রেতবৎ নাচিতেছিল ─ কুমুদিনীর অশ্রুসমুজ্জ্বল চক্ষে বিদ্যুৎ ঝলসাইতেছিল; ─ নিকটস্থ বৃক্ষশাখার কদাচিত কোন অতি মৃদু, কি ভীষণ মৃদু রব হইতেছিল ─ দূরে কদাচিত কোন বিকট পশু রব করিতেছিল। সেই সময়ে, সেই আলোকে কুমুদিনী, ধীরে ধীরে, অস্ফুটস্বরে, গম্ভীরভাবে সেই সর্ব্বস্বান্তকারিণী কাহিনী রজনীকে শুনাইলেন। মেঘ বলিল, চাতক শুনিল, ─ যা শুনিল, তা ─ বজ্রাঘাত!’

বাড়ি ফেরার পথে, বাসে বসার জায়গা পেয়ে নিশীথদার পত্রিকাটি পড়তে শুরু ক’রে দিলাম, ক্রমে মনে হতে লাগল, নিশীথদা আমায় একটি শোকসভায় বসিয়ে রেখে অন্তর্ধান করেছেন।

গৌতম বসু

ঋণস্বীকার:

রণজিৎ দাশ

সোমাইয়া আখতার

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80