কালিমুহির ইতিবৃত্ত <br /> বেবী সাউ

কালিমুহির ইতিবৃত্ত
বেবী সাউ

মা কালিমুহি। তাঁর কালিঝুরি শাড়ি। সাদা শাঁখা। পলা। কালো হাত দুটিতে। মা পরেন কালো শাড়ি। তাই সমস্ত গ্রাম কালো রঙের বস্ত্র ব্যবহার করেন না। করেন না মা কে ভালোবেসে। সেই মা যিনি এই পটলচেরা গ্রামটির রক্ষাকর্ত্রী। সামলে রাখেন। তাই সুখ হোক কিংবা দুখ গ্রামের প্রতিটি কাজের প্রথম প্রসাদ যায় কালিমুহি থানে। গ্রামের দক্ষিণ দিকে মা কালিমুহির বাস। অনেক অনেক দিনের পুরনো এক তেঁতুল গাছ। যার বয়েস কেউ জানেনা। বট গাছের মত তার ব্যাপ্তি এবং প্রশস্তি। ছড়িয়ে আছে সিঁদুর গৌরা পুকুরের পুব কোণে। এখানে থাকেন মা। গাছে কোনও অজাত কুজাত পাখি মানে কাক চিল শকুন বসে না। নীচে রাখা মায়ের হাতি এবং ঘোড়া। ছোট একটা সিংহাসনের মতো বেদি। এটাই তাঁর ঘর।

সিঁদুর গৌরা পুকুরের এই দিকটা যেন আরও আরও বেশি নির্জন। রাখাল বালকেরা মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে, মা কালিমুহিকে প্রণাম করে পুকুরের অপর পাড়ে এসে বিশ্রাম নেয়। তারা নাকি কালিমুহির দিকে পা করে শোয়, নাকি মাথা!

এই কালিমুহি রোজ রাতে তাঁর সাদা ঘোড়ায় চড়ে সারা গ্রাম পরিদর্শনে বেরোন। গভীর নিশুতি রাত তখন ঝনঝন করে বেজে ওঠে। সাদা ঘোড়ার চিঁ-হিঁ-হিঁ স্বর যাঁরা অনিদ্রা রোগের রোগী তাঁরা কান পেতে শোনে; আর ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে। দু হাত কপালে ঠেকায়। পূর্বকৃত পাপের জন্য দয়াভিক্ষা করে মায়ের কাছে। আর মা ধুনোর গন্ধে সারাটা গ্রামকে ভরিয়ে দিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে বেড়ান। গ্রামের যুবক যুবতী বাচ্চা বড় ঘুমের ঘোরে সেই গন্ধ পায়। আর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরেও তারা বুঝতে পারে ‘মা আছেন! ভয় নেই’!

এই গ্রামের একমাত্র মা মা কালিমুহি। তাই এখানে শীতলা পূজা নেই, ষষ্ঠী পূজা নেই নাকি জিতা অষ্টমী নাকি অন্য কোনও পূজা। গ্রামের ‘সাউ’ রা আগে ছিল সূর্যের উপাসক। তাঁরা মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী নন। শক্তি এবং আলোতে বিশ্বাসী। এই সাউদের ভিটেতে মা কালিমুহি বসবাস করলেও, তাঁরা মা কে পুজো দিতেন না। তো একদিন মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, মাকে কেউ এমন অচ্ছুৎ করে রাখে রে? কালো বলে আলো নই? সেই থেকে ‘সাউ’ বাড়ি থেকেও পুজো যায় মা কালিমুহির থানে। কিন্তু একটা শর্তে। এঁরা কখনও মাকে পশু পাখি বলি দিতে পারবেন না। বদলে মুড়ি-মুড়কি এবং মণ্ডা মিঠাই দিয়ে পুজো করবেন। মা তাতেই খুশি। সন্তানের সুখই তাঁর সুখ।

শিক্ষা আছে, দীক্ষা আছে কিন্তু গরীব গাঁ। খাদ্য তার বড্ড কম। গ্রীষ্ম থেকে সেই কার্তিক মাস পর্যন্ত চলে এই টানাটানি। একবার, সেবছর খরা খুব, ধানের রোয়া পোতার কাজ কিছুই হয়নি। সারা মাঠ ধূধূ করছে। জল নেই। বর্ষা নেই। ‘সাউ’ এত বড় বড় সব পুকুরের জল তলানিতে ঠেকেছে। দিশেহারা গ্রামবাসী এই কষ্টের মধ্যে ভুলে গেল মা কালিমুহিকে পুজো দিতে। মাও অভিমানী। মুখ ফুলিয়ে থাকলেন। কিন্তু কতদিন…

আমার তখন ক্লাস সেভেন। আমাদের ইতিহাস স্যার পূর্ণবাবু আমাদের শেখাচ্ছেন কীভাবে মোঘলরা ঢুকে পড়েছিল ভারতে। আর একের পর এক গ্রাম, শহর অধিকার করে নিতে নিতে এগিয়ে আসছে বাংলার দিকে। সারা ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে। সারা ক্লাস মনেমনে ঢুকে পড়েছে পূর্ণবাবুর সঙ্গে মোঘল সেনাবাহিনীর সঙ্গে। এই ঢুকে পড়বে বাংলার সীমানায়। আর তখনই… ঠিক তখনই… পূর্ণবাবু হুঙ্কার ছেড়ে বললেন—” এ্যাই! কী হচ্ছে কী! চুপ করে বসো!” সমস্ত ক্লাস এক নিমেষে ঘুরে পড়লো পেছনের বেঞ্চিতে। সবার চোখ ওইদিকে। দেখে ‘লক্ষ্মী’ নামে সেই কালো মেয়েটি, যে পাশের গ্রাম বালিয়া থেকে আসত উঠে দাঁড়িয়েছে বেঞ্চের ওপর। আর কাঁপছে। আমরা তো দেখে থ। ক্রোধ উন্মুক্ত পূর্ণবাবু যেই না আরেকটি হুঙ্কার ছাড়তে যাবেন, ওমনি ডেস্কের ওপর পা ফেলতে ফেলতে লক্ষ্মী হাজির স্যারের চেয়ারের কাছে! তারপর দে ছুট… ছুট…ছুট…

আমরা কৌতুহল প্রবণ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, হেডমাস্টার লক্ষ্মীর পিছু পিছু সবাই ছুটছি। কিন্তু সেদিন যেন লক্ষ্মীর পায়ে লাগানো হয়ে হাজার ঘোড়ার খুর। বন্য হাতির তেজ। কেউ তার কাছে পৌঁছাতে পারছি না। সাধারণ এক মেয়ে, পড়াশোনায় অত ভালো নয়, কালো, নাক বোঁচা— তার এত তেজ! সারা গ্রামে মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ল খবর। সবাই বেরিয়ে এসেছে। লক্ষ্মী পুবের স্কুল থেকে বেরিয়ে ছুটছে দক্ষণের পথে। গ্রামের প্রান্ত ছাড়িয়ে সোজা সিঁদুর গৌরা পুকুরে এসে হাজির। তারপর ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা… লক্ষ্মী গিয়ে বসল সেই মা কালিমুহির ছোট বেদিতে! চোখ তার রক্তবর্ণ। মৃদু মন্দ কাঁপছে। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ছে তাকে দেখার জন্য। আমাদের লাস্ট বেঞ্চের লক্ষ্মী সে কি না মা কালিমুহির বেদিতে!

তাড়াতাড়ি খবর গেল দেহুরীর কাছে। এই দেহুরী হলেন মা কালিমুহির পূজারী। তিনিই একমাত্র মায়ের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন। ধূপ-ধুনো, রাজ ডোমও ততক্ষণে তার ঢোলক নিয়ে হাজির। মা এসেছেন, তাঁকে তো সঠিক আপ্যায়ন করে বসানো চাই! সঠিক সম্মান দেওয়া চাই। নত, হয়ে সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম কিরে উঠে দাঁড়ালেন দেহুরী। মায়ের সামনাসামনি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কেন মা, এত ক্রোধ!’ তখন হুঙ্কার ছাড়লেন মা। ‘ধোঁয়া দে ধোঁয়া’… গলগল করে গিলতে লাগলেন ধুনোর ধোঁয়া। যেন কতকাল অভুক্ত। যেন কতকাল অনাহারে কেটেছে তাঁর। ঠিক যেন, আমদের গ্রামের জানকির মায়ের মত। দু মুঠো খাবার কেউ দিলে সে যেভাবে গোগ্রাসে খেত! সারা গ্রাম মায়ের এই বুভুক্ষু রূপ দেখে কান্না চেপে রাখতে পারছে না। সবাই ভয়ে হোক শংকায় হোক কাঁদছে। অপেক্ষা করছে মায়ের অন্য আদেশের। ধুনোর ধোঁয়া শেষ হওয়ার পর, তিনি দেহুরীর দিকে চোখ তুলে চাইলেন। বললেন, “দে দে কালো মুরগী দে! কালো মুরগী খাবো! দে দে…” যেন শত সহস্র বছরের খিদেতে কাতর তিনি।

কিন্তু কালো মুরগী! এই দুপুরে! সব তো মাঠে ঘাটে বেরিয়ে গেছে। ধরা যাবে না। উপায়? বললেন, ‘আতপ চাল দিয়ে, মা কালিমুহি ডাকছেন বলে ডাকলে এসে ধরা দেবে।’ হলও তাই। রিঙ্কুদাদার বাড়ি থেকে ধরে আনা হল কালো মুরগী। লক্ষ্মী ওরফে মা কালিমুহি ছিঁড়ে ফেললেন তার গলা। তারপর গলগল করে এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলেন সবটুকু রক্ত। সারাগ্রাম ভয়ে কাঁপছে! ভাবছে মা কে অবহেলা করার শাস্তি, পাপ। মা তো। জন্মদাত্রী। তাঁকে উপেক্ষা! আমাদের স্কুলের নাস্তিক বিজ্ঞান টিচার থেকে সাহিত্যের তন্ত্রসাধক কালীবাবু সবাই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে।

খিদে মেটার পর, মা উঠলেন বেদি থেকে। ঝঁাপ দিলেন সিঁদুর গৌরার কাকচক্ষু গভীর জলে। স্নান সেরে ওঠেই আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। অজ্ঞান। অজ্ঞান লক্ষীকে নিয়ে তখন নাজেহাল অবস্থা। কিছুক্ষণ পরে, চোখ মেলে তাকিয়ে বললো, মুঘলরা কী ঢুকে পড়েছে স্যার! তারপর চারদিকে তাকিয়ে সেও থ মেরে গেল। হাজারো প্রশ্ন — আমি এখানে কেন! আমার চুল ভেজা কেন! ইত্যাদি ইত্যাদি…

লক্ষ্মী তখন আর মা কালিমুহি নয়! আমাদের সাধারণ বান্ধবী। আমরাও খুব খুশি। কে আর দেবীকে চায়, বন্ধুকে ছেড়ে!

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes