একটি অসমাপ্ত চিঠির খসড়া প্রাপক : শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
: দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য
এখন আকাশ নীল
লক্ষ জোনাকি
মনের ভিতর ওড়ে
নীলকণ্ঠ পাখিতুমি কি আসতে
তুমি কি গান চাও
অলোকরঞ্জন
লোরকার কবিতাওমুঠোয় রেখেছি
পাতার মর্মর
হাওয়ায় ভেসে যায়
ইক্ষুদানা-ঘোরদৃষ্টি, খুঁটে খাও
এখন আকাশ নীল
তবু কি আসতে
শিউলি ছুঁয়ে হিমইচ্ছে জমেছে
আপনি কখন কীভাবে যেন আমার কাছে ‘অলোকদা’ হয়ে গিয়েছিলেন। আমার অলোকদা, আমাদের সবার অলোকদা! কখনো এই কথা আপনাকে বলতে হবে ভাবিনি, আমার বন্ধ সিন্দুকের ভিতরে তুলোয় মুড়ে সেসব সুগন্ধি আলোড়ন আমি একান্তে তুলে রেখেছিলাম। কখনো সেগুলোর সত্যি-মিথ্যে যাচাই অবধি করতে ইচ্ছে হয়নি, আপনার ভালোবাসার আলোয় এতই তড়িৎ উজ্জ্বল ছিল সেই মুহূর্তকণাগুলি! জানেন অলোকদা, দুপুরের দিকে আপনার ফোন আসত যখন, তা সপ্তাহে দু’দিন তো হবেই, কখনো বা তার থেকেও বেশি, অফিস ঘরের বাইরের চত্বরে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় এত দমকে দমকে হাসতাম, ঘরে ফিরে আসার পরে আমার সহকর্মীরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকত আমার দিকে। মেধার কী যে লাবণ্য আকাশ থেকে ঝরে পড়ত সার্থক সেই দিনগুলোতে, কোটি টাকা দিয়েও কেউ কখনো তা কিনে নিতে পারবে না! সত্যি বলতে কী, আপনার সঙ্গ করে যা পেয়েছি, তা কি আমার এই ভাঙা কুলোতে সাধে, বলুন! কী সব স্মৃতি!… “এখনো কি দপ্তরে, তুমি?” — ‘না অলোকদা, এইমাত্র অফিস বন্ধ করলাম।’ — ” অ-বাইক? ” — ‘হ্যাঁ, হেঁটে যাচ্ছি।’ — “বন্ধু শুভেন্দুর বাড়ির দিকে?” — ‘হ্যাঁ।’ — ” একদিন দেখতে চাই হারুন অল রসিদের মতো কীভাবে তুমি রাতের নগরী পরিক্রমা কর।”… একদিন রাতের দিকে আপনার ফোন এল, ‘শোনো, বক্তৃতা দিতে তিন দিন শহরের বাইরে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম, তোমার কণ্ঠস্বর এইবেলা একবার ছুঁয়ে নিই।”
একটা ঝড়-ঝাপটার ভিতর দিয়ে চলেছি এ’কদিন। বধূ নির্যাতনের ভুয়ো মামলায় বৈকালির ভাইয়ের জামিন হল না এখনো! শুনানির তারিখ হাইকোর্টে যত পিছিয়ে যাচ্ছে, ওদের পরিবারের উৎকণ্ঠা ততই বেড়ে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ফোনটি আসছে আমার মোবাইলে, যেন বা শুনানির তারিখ আড়াল করে ‘শের আফগান’ হয়ে স্বয়ং আমি দাঁড়িয়ে ! বৈকালি বা আমি যতই তাঁদের বোঝাতে যাই, উচ্চ আদালতের এই বিষয়টি শুনতে একটু সময় লাগতে পারে, এ সময় ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোনো পথ নেই আমাদের, ওর বাবা-মা কিংবা ভাই, ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে থাকেন আমাদের দিকে, যেন এই কথাটুকুর ওপারেই আছে আরও একটা ‘আসল’ কথা! এ সময়ে আপনার কাছ থেকে সত্যি প্রেমের দু’একটা গল্প যদি আরো একবার শুনে নেওয়া যেত! সেই যে মেয়েটি, যে দু’টি সন্তানের মা হতে চেয়ে জুরিখের একটি ছেলেকে ভালোবেসে চলে যায়, আর সেই যে পেশায় গাড়ির চালক পোলিশ ছেলেটি, যে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এসে একদিন আপনার জগৎজোড়া সংসারের অভিন্ন সদস্যপদ পেয়ে গিয়েছিল – তাদের কথা! খুঁটেখুঁটে যতটুকু সুযোগ হয়েছে আপনাকে পড়ার, তাতে ওই জীবনছোঁয়া গল্প-দুটির কোনোই হদিশ ছিল না আমার কাছে। গতকাল রাতের স্বপ্নে ওই ছোট্ট ঘটনাটি আমাকে ১০ রিখটার মাত্রায় ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল আবার। ওই ছেলেটিকে গোপনে কি একটু ঈর্ষাও করে বসলাম!
গত রবিবার দীপকদার ডাকে চুঁচুড়া ষ্টেশনের গায়ে লাগানো রাইস রিসার্চ সেন্টারে গিয়েছিলাম। জমিতে জল দেবার জন্য যে চৌবাচ্চাগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে, তারই একটার পাড়ে বসে আপনাকে নিয়ে আলোকদার ( আলোক সরকার) লেখাটা পড়া হল, দীপকদা আর আমি ভাগাভাগি করে পড়লাম। উনি লিখেছেন, ওঁর সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আপনার জন্য। আপনার থেকে সাহায্য নিয়ে এম এ পাশ করা, আপনার লেখার পাশে ওঁর নিজের লেখা খুব সাধারণ মনে হওয়ায় গোপনে লেখার চর্চা করা, আপনারই উদ্যোগে নানান পত্রিকায় ওঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকা, আপনারই উদ্যোগে শ্যামসুন্দরে চাকরি করতে যাওয়া… । মনে পড়ে গেল, চিত্রক পত্রিকায় আমার নেওয়া আলোক সরকারের একটি বড়ো সাক্ষাৎকার ছাপানো নিয়ে আপনার ব্যস্ত হয়ে থাকার কথাও । তক্ষুনি একবার ফোন করে বসলাম আপনাকে। আপনি ছিলেন না বোধহয়, ভয়েস রেকর্ডার চালু হয়ে গেল।
অনেক ব্যক্তিগত কথা বলে ফেললাম একটানা। বলতে ইচ্ছে করছে আজ! ভালো খারাপ সবই বলতে ইচ্ছে করছে। ‘যৌবনবাউল’ বইটি নিয়ে আনন্দবাজারে প্রকাশিত আপনার অসাধারণ লেখাটি পড়তে পড়তে হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল অন্য একজন বিবাদী মানুষের কথা। তাঁকে ঘিরে এক টুকরো গল্প। তিনি এই লেখা পড়ে উঠতে পারলেন কি না কে জানে ! ভদ্রমহিলা বহুদিন জার্মানিতে থেকে অল্প কিছুদিন হয়তো পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে ফিরেছেন। বছর কয়েক আগে তাঁর সঙ্গে নিজে থেকেই কেমন যোগাযোগ হয়ে গে’ছিল । পূর্বপল্লিতে ঘরোয়া একটা গানের আসরে নির্বিঘ্ন শ্রোতা হয়ে হাজির হয়েছি আর দৈব দুর্বিপাকে বৈকালির সঙ্গে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেও হয়েছে সেদিন। অলৌকিক ঘনঘটায় আমার একটি নতুন এসরাজ প্রাপ্তিও ঘটে গেছে। চুক্তি হয়েছে প্রতিমাসে তাঁর কাছে গিয়ে শাস্ত্রীয় যন্ত্রবাজনার তালিম নিতে হবে। একদিকে আমার অক্ষমতা, অন্যদিকে নীলকর সাহেবদের মেজাজের মাপসই তাঁর কঠিন আগ্রহে শিক্ষা যেমন এগোবার, এগোচ্ছে। ব্যাপার হয়েছে কী, আপনার ওপর তাঁর রাজ্যের অভিযোগ ! আপনি সেই দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাকি যথেচ্ছ সমালোচনা করে বেড়ান, এইরকম ছিল তাঁর মৌলবাদী বিধান। কীভাবে আপনি একটা আপাত-শ্রদ্ধার ভাব দেখিয়ে ধীরে ধীরে তাঁর মূর্তি ভেঙে দিয়েছেন, তাঁর ঋজু অনমনীয় ভঙ্গীতে সে কথা তিনি শোনাতে ছাড়েননি। পরে আপনার বক্তৃতা শোনবার সুযোগ হল যখন, কী তাঁরা বলতে চান, কী তাঁরা শুনতে চেয়েছেন, সব বুঝলাম। ধীরে ধীরে এও বোঝা গেল রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাঁর বিশ্বে যেকোনো বাঙালিই অবশ্য-বিস্মরণযোগ্য ! শুধু পণ্ডিত রবিশঙ্করকে তিনি সামান্য একটু রেয়াত করতে রাজি। তিনি নাকি তাঁর জার্মানির স্কুলে এসে বাজিয়ে যাননি শুধু , সঙ্গীসাথী মিলে ভরপেট খেয়ে সাধু সাধু বলে গেছেন ! তাই তাঁর জন্য এই লঘু দণ্ডবিধি!
একটা জরুরি কথা ! আপনার তাস-ক্ষণিক ( এই শব্দ প্রতিস্থাপনের রয়্যালটি বলাবাহুল্য আপনারই প্রাপ্য) নির্দেশ-অনুরোধের যুগল শিরোধার্য করে দীপক রায়দা লিখে ফেলেছেন ইউরোপের ডায়রি। আর তাতে সপ্তসিন্ধু-দশদিগন্তের অনায়াস অনুপ্রবেশও ঘটেছে। সেদিন যখন ওঁর লেখা একটি পর্ব দীপকদা আমাদের পড়ে শোনাচ্ছেন , এবং সেখানে ‘বুড়ো নাবিকের উপকথা’টি ধাপে ধাপে আপনার অনুবাদ থেকে উঠে আসছে, আর আমরা, আমরা মানে শুভেন্দু, ওর স্ত্রী পুত্র সকলেই সংক্রমিত হচ্ছি, আহা উহু, হায় হায় করে উঠছি, তার একটু পরেই এল ইয়েট্সের তিনটি কবিতার অনুবাদ। আমার ‘হয়নি-হয়নি’ মাথা দোলানিতে দীপকদা মাঝপথে পড়া থামিয়ে দিলেন। কী দীপক ? কিছু বলবে ? বন্ধু শুভেন্দু জানতে চাইল । আমি ওকে বললাম , এ তো ইংরেজি কবিতাগুলোর অর্থের একরকম অনুবাদ হল। আগের কবিতায় মূল কবিতাটির ধ্বনির যে অনুবাদ , টান টান উত্তেজনার, পল-অনুপল যতির যে অনুবাদ, তা কি আদৌ হয়ে উঠল – ওকেই ফিরতি জিজ্ঞেস করে বসলাম। কোনোটাই ভালো লাগে নি বলছ ? – একটাও না… দীপকদা বলে উঠলেন আমার তো বেশ লেগেছে, এই বলে আবার পড়তে শুরু করে দিলেন। এই বোকামির জন্য সেই থেকে খুব মাথা নুইয়ে আছি। আপনার কাছে পাপস্বীকার করলাম এখন।
ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘রাস্তার ভাষা’-ই সময়ের ক্ষয় আর ফাঁপা মননকে ধরার ভবিষ্যৎ কাব্যভাষার বীজঘর কি না, কোনোদিন সুযোগ হলে আপনার কাছে বিস্তারিত জানতে চাই। কবিতায় ‘আধুনিকতা’ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝব, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই দ্বি-খণ্ডিত আমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফরাসি কবিদের নিয়ে একটা আলোচনা পড়েছিলাম, যার মূল কথা সম্ভবত ব্যক্তি-বিশ্বের উন্মোচন। Walter Benjamin-এর Illumination নামের একটা বই পেয়েছি, জানেন। পশ্চিমি ভাবুকদের কথাই শেষ পর্যন্ত আমাদের মাথায় তুলে নিতে হবে, কী বলেন আপনি ? রুশো, দেরিদা ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নেই! আপনি নিশ্চয়ই খোঁজ রাখেন, বিশ্ববিদ্যালয়স্তরের ছাত্রদের ‘জ্যাক অ্যান্ড জিল’ ছড়াটিকে অবিনির্মাণ করতে দেওয়া হয়! টিনটিনের কার্টুনগুলি ডিকন্সট্রাকশনের পোস্ট ডক্টরাল থিসিস অবধি জাঁকিয়ে বসেছে? আপনি বলছেন,‘যাকে আমরা ঐতিহ্য বলে চিহ্নিত করি তার ধর্ম নিশ্চই প্রবহমাণতা। কবিতার পরিসরে সেক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের কোনো বিভাজন নেই।‘ আবার শঙ্খবাবু যখন বলেন ‘আমাদের এখানে পশ্চিম একটা বড় মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কিছুই লেখা হচ্ছে ওই মানদণ্ডে বিচার করা হচ্ছে। এটা হওয়া উচিত নয়’, তখন দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে ভাবতে বসি – কোথাও কি আমার বুঝতে ভুল হচ্ছে!
টেলিফোনে এত কথা তো হওয়া সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে আপনার কথাগুলি সংগ্রহ করে রাখার সুযোগও হারাব। জানি আপনার কোমরের চোট ইদানীং ভোগাচ্ছে আপনাকে, আপনি কখনো না বললেও জানি। তবু আপনি দেশে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই একটি দিন আপনাকে হাইজ্যাক করে নেব ভেবেছি। আপনার দীর্ঘতা, আপনার ছায়া, আমার ছাত্রজীবনে কখনো তো পাইনি —অসময়েই তাই হ্যাংলামি করতে হচ্ছে।
অরুণ কুমার সরকারের ওপর আপনার অসাধারণ লেখাটি এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম সেদিন। শুরু করা যাক এই বলে যে, আপনার কলমের এক আবগাঢ় দুষ্টুমি আছে যা জীবনানন্দের মৃত্যূত্তর ‘বোনাস’ এর কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই বাংলা কবিতার ‘প্রাপ্তিযোগ’-এর কথা তুলে আনতে পারে, মতি নন্দীকে সামনে রেখে সমর সেনকে প্রতিহত করতে পারে( ক্যারাম! ক্যারাম!) এবং ‘রাত্রি যখন অতীব চতুর পকেটমার’-এর বহুপ্রবহ-অন্ধকারে শংকর চট্টোপাধ্যায়কে ‘বেকায়দায়’ ফেলতেও পারে। সুধীর কর্মকারের ইউ টার্ন নিয়ে ফিরতি শটে করা একটা বিখ্যাত গোলের কথা পড়েছিলাম কাগজে, আর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে শ্যাম থাপার ব্যাকভলিতে করা অবিশ্বাস্য সেই গোলটা তো স্বচক্ষে দেখেছিও – আপনার লেখার কথা উঠতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল! অবাক হয়ে যাই কী-অনায়াসে আপনি গল্প বলার মতো করে এই ছোট্ট লেখাটার বুকে সুতীক্ষ্ণ সব যুক্তির তির সাজিয়ে দিয়েছেন। ‘বহিরারোপিত কোনো আইন-ই-আকবরি’ সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে পঞ্চাশের লেখকদের উদ্যত ভারসাম্যের সন্ধানজাত এক বিস্তৃত মূল্যবোধের কথা বলেছেন, সত্তা ও পঞ্চেন্দ্রিয়ের বিরোধাভাস উদ্যাপনের ভাবনাতে আলো ফেলেছেন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বৈতের কথা বলেছেন,বলেছেন অরুণ কুমারের ক্ষণসাম্প্রতবাদে ভর দিয়ে বাঁচার কথা এবং রূপক-পেরোনো এক ‘রহস্যময় প্রতীকের আভাষণে’ অরুণ কুমারের কবিতার ‘মজা ও ম্যাজিক’এবং সেই সঙ্গে যথার্থ আধুনিকতা – এই কথা বলতে বলতে একইসঙ্গে আধুনিকতার ক্রমজায়মান ভাবনাটিতে একমুঠি জলসেচন করেছেন। ‘বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা’-র নির্বাচিত উল্লেখ সময়ের ধুলো সরিয়ে জেগে-থাকা প্রত্নচিহ্নগুলো সহজেই কুড়িয়ে নিতে পারে,স্বচ্ছ ইতিহাসপাঠের জন্য যা বিকল্পহীন মনে হয়! গুরুচণ্ডালির ভারসাম্য কোথায় তুলে নিতে পারে লেখার মাধুর্যকে, তা শেখবার পক্ষে আমার সময় বড়ো পেরিয়ে গেল অলোকদা, এখন আফশোস হয় সেই কথা ভেবে। – ‘সমীপসময়’, ‘ক্রান্তিসঞ্চারী’ ‘কবিসামগ্র্য’, আবার এরই পিঠোপিঠি ‘দোটানাপনা’, ‘পই পই’। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ থেকে একঝলক কবিতাগুলো দেখেও নিলাম। ‘জন্মদিন’ কবিতাটিতে ছিল ‘পাবো’, আপনি লিখেছেন, পাব। এখন যেভাবে বানান লেখা হয়, তাইতে ‘পাব’-ই তো হবার কথা। ‘শতভিষা’-র ‘মুহূর্ত’ কবিতাটা দেখা সম্ভব হয় নি যদিও।
আপনার কাছে কবুল করতে কোনো দ্বিধা নেই, বরাবরই আমি সভা থেকে সভায় ছুটে গেছি আশ্চর্য কোনো উচ্চারণ শোনবার আগ্রহে, একটি একান্ত স্বরসঙ্গতির উন্মাদনায়, আর, বলা ভালো, প্রাথমিক সামান্য দু’এক কদম পেরিয়ে , থমকে, হোঁচট খেয়ে, ফিরে আসতে হয়েছে দৌড় শুরু হবার সেই আদি জায়গাটাতেই। এইভাবে অবাক হতে চাওয়া নিশ্চয়ই অনান্দনিক, কিছুটা অসাংবিধানিকও – এইভাবে, যেভাবে উস্তাদ আমির খানের চাঁদনি-কেদার আমার কাছে ধরা দেয়, যেভাবে প্রকাণ্ড কোনো প্রাসাদের থাম একের পর এক ভেঙে পড়ার অনুভূতি নিয়ে বাখ্-এর বাজনার অভিঘাত বুকে এসে পৌঁছোয়, যেভাবে যে-কোনো অছিলায় প্রিয় পঙ্ক্তিমালার কাছে ফিরে ফিরে যায় মানুষ, সেইরকম কোনও উষ্ণ উচ্চারণ আর পাই কোথায়! ফলত, ক্রমাগত উষ্ণীষধারী ওস্তাদ শিল্পীদের থেকে দূরে, স্ব-ঘোষিত, কথায় কথায় কানে-হাত-ছোঁয়ানো ঘরানাদারদের থেকে বেশ একটা মনোমত দূরত্বে, আসরে আসরে ভেসে বেড়ানো মঞ্চ পিপাসুদের থেকে নিভৃত অপরিচয়ে সরে যাওয়াই আমার নিয়তি। কিছুদিন আগে সেই একই আশা-আশঙ্কায় দুলতে দুলতে হাজির হয়েছিলাম একটি সভায় – যা আমার অনায়ত্ত, তেমন একটি ঘনীভূত একক উচ্চারণ যদি কেউ শোনান! … কী আশ্চর্য ,গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো সারবার আর সেই সঙ্গে আত্মঘোষণার এমন অকল্পনীয় যোগাযোগ কেউ কি সহজে নষ্ট হতে দেন! প্রগাঢ় কোনো কথকতা পূর্বনির্ধারিত নিয়তির মতোই এবারও প্রায় হাতছাড়া হয়ে যায় আমাদের।
আপনার পাঠকদের কথা ভাবতে গিয়ে কয়েক বছর আগে শোনা একটি আশ্চর্য কথোপকথন মনে পড়ে গেল! সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাহিত্যের অধ্যাপককে বলতে শুনেছিলাম, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে নাকি অলোকরঞ্জন পড়ানোর লোকের নিতান্ত অভাব – আপনার কবিতা সিলেবাসে ঢোকানোর সেটাই নাকি একটা বড়ো বাধা! আর এর বিপরীতেই ভেবে চলেছি মারুফের লেখাটির কথা! পাঠকের মনের এক আশ্চর্য প্রিজ্মে, ছাড়া-ছাড়া, হয়তো দূর-থেকে-হাত-ধরে-থাকা কথাগুলো কীভাবে ঘনীভূত হয়ে আলোয় ছায়ায় কবিতার মর্মে এসে মিশে যায়, ‘সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছে’ লেখাটি পড়ে তা বেশ বুঝতে পারি। সামনে আর পিছনে গাড়ির জটলায় পড়ে, চুরাশি দিন দূরের বইমেলাকে একঝলক ভাবতেই যেন শীতের হাওয়াটুকু আরও একটু কাছ দিয়ে বয়ে যায়, তবে তা বিশেষ একটা অনুভূতি হয়েই থাকে যতক্ষণ না জানতে পারা যায় ( মারুফের চিঠিতে জানানো নেই) লেখাটি সায়েন্স সিটির চৌমাথায় সবে শুরু হল , আর তক্ষুনি, একটা কনে দেখা আলোয় যেন ভেসে ওঠে চিঠি-লেখা মনটির পরম্পরা, আর শব্দগুলো সরে সরে, হয়তো বা একটু উঠে বা সামান্য ধাপে ধাপে নেমে, অলীক কোনো এক সাজে সেজে উঠে, গলে গিয়ে, মজে গিয়ে, হঠাৎ পুরোদস্তুর একটি কবিতাই হয়ে ওঠে। এই যে পাঠক, তাকে আমি কী বলব ? সেই কি এই লেখাটির কবিতা হয়ে ওঠার বড়ো ঘরের অংশীদার নয়? এই পাঠকই তো বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের বিশ্বাস আর প্রকৃত কবিতার মাঝের একমাত্র ভেনিসিয় জলরাস্তা ! পত্রলেখকের মনের অব্যক্ত কথার কুঁড়িটাকে সেই কি আলোয় মেলে ধরে নি, সেই কি ভাবে ফুটিয়ে তোলে নি ! আহা, সবার মনের মধ্যে যদি এই ছড়িয়ে দেবার অপলক চরাচর থাকতো !
বিশ্বাস করুন, মাঝেমধ্যে যখন পলি উমরিগড় বলে আমাকে প্রভোকিত (!) করেন, আমি ভালোবাসা আর স্নেহের সেই নরম উপত্যকার ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটছি মনে হয়। চিন্ময় গুহ একবার শঙ্খবাবুকে বলছিলেন, ‘আপনার কবিতা সম্পর্কে তাঁর( অলোকরঞ্জনের) লেখা, ভালোবাসা…এগুলোকে খুব তাৎপর্যময় লাগে’। খানিক বাদেই শঙ্খবাবু বলছেন, ‘ আত্মীয়তায় বা ভালোবাসায় সবকিছুকে বাড়িয়ে দেখা অলোকের আবাল্য অভ্যাস,আমার বিষয়ে ওর লেখায় তারই কিছু চিহ্ন থেকে গেছে।‘ আপনার পুরোনো একটি কবিতাবইয়ে তেমনই এক ভালোবাসার স্মারক হঠাৎ চোখে পড়ে গেল, যার একমাত্র স্বত্ব চুঁচুড়াবাসী আমাদের দুই দীপকের। দীপক রায়দাকেও দেখিয়েছি আপনার কবিতাটি :
এখন হাঁটতে গেলে চৌকাঠে ঠোক্কর লাগবেই,
ঘরের মধ্যে পৌঁছে দেখবে রক্ত ও শ্রমে গড়া
দ্বিভাষিক সেই সংকলনের পাণ্ডুলিপিটা নেই
দেরাজে লুকোনো প্রথম প্রেমের দলিল চিদম্বরা
এবং একটি আলোকচিত্র কোথায় আচম্বিতে
বিলুপ্ত হল, ভাবতে-ভাবতে হিতে আর বিপরীতে
কী যেন ঘটল মতদ্বৈধ – এইবার মানে মানে
অন্ধকারের আগেই নিজেকে ঈষৎ গুটিয়ে নিলে
ভারি মজা হয়, কিন্তু ঈষৎ পড়ে গেছি মুশকিলে
কালকে সকালে চুঁচুড়ার এক প্রাচ্য আকাদেমিতে
কজনা আসবে আমার অশীতিপূর্তির সম্মানে,
দুই সজ্জন – দুজনেরই নাম দীপক – আমাকে নিয়ে
পড়বেন এক শংসাপত্র, তার প্রত্যুত্তরে
অনিবার্যত আমাকেও কিছু বলতে হবে বানিয়ে,
সেটুকু লিখতে গেলে চৌকাঠে ঠোক্কর লাগবেই। ( অশীতিপর। এখন নভোনীল আমার তহবিল)
দীপক রায় তাঁর প্রথম দিকের একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘চারুপ্রকাশ বাবু, বলুন তো এই লোহিত মেঘের ভার এই পেরেকের বিছানা এই মোমের তৈরি ঘরবাড়ি আমি চেয়েছিলাম কিনা ?’ দীপক রায়ের এই চারুপ্রকাশ চরিত্রটি কথা বলেন না, চোখ রাঙান না – শুধু তার অনুচরের হাতে চাবুক থাকে। আজকাল হঠাৎ কেমন যেন মনে হয় আমিও কোনো চারুপ্রকাশের ফেরে পড়ে গেছি। প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার আগে এক বিপুল কান্নার মুখোমুখি দাঁড়ানোই আমার নিয়তি। আমার কাজের আবহাওয়া আজ এত বেশি করে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলছে আমায়, এতটুকুও খোলা হাওয়া বইবার যেন জো নেই কোথাও ।
এইভাবে ভেঙেচুরে থাকা আমি কীভাবে যাই বলুন তো আপনার কাছে ? আপনি বলেছিলেন মানুষের জীবনে উৎসবের সময়টুকু একেবারে বাঁধা , কোনোভাবেই তাকে দৈনন্দিন করে নেওয়া যাবে না। আপনার সঙ্গ পাবার সব থেকে বড়ো এই উৎসবও তাই অপরিসরের চোখ রাঙানি দিয়ে ঘেরা। শুধু একটা মাত্র কথা অলোকদা, যখন আপনাকে লিখছি না, আপনাকে ফোন করছি না, তখনো আপনাকেই লিখছি, আপনারই সঙ্গে অবিরত কথা বলে চলেছি, এইটুকুই আজ শুধু জানাতে চাই।
যাই হোক, ঢাকে কাঠি পড়েছে আবার, জন্মদিন
জন্মদিন! কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নব্বই বছর পূর্তি। নদীবাঁকের ফলসা গাছ বলছে এই কথা, চাঁপাগাছের ডালে বসা হলুদ কাজল পরা ময়না বলছে। আলোবাতাস চুইয়ে সেই শুভেচ্ছা ঝরে পড়ছে আজ! আমার নিজের ত্রুটিতে আপনাকে পাবার সমস্ত অধিকার হারিয়ে ফেলেছিলাম একদিন। একটু একটু হুঁশ ফিরে আসছে আমার। আবার আপনার পায়ের কাছে বসবার কথা ভাবতে পারছি। আপনার সহাস্য মুখ কতদিন দেখিনি ভাবুন তো একবার ! আমাদের প্রণাম জানবেন।
দীপকরঞ্জন
৫ অক্টোবর, ২০২৩
ভালো লাগলো। তবে কলিকাতা ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় এ অলোকরঞ্জনের শ্রেষ্ঠ কবিতা কিন্তু বহুদিন ধরেই পাঠ্য হয়েছে। অলোকরঞ্জন তরুণ মুখোপাধ্যায় পড়াতেন, বছর সাত আট পড়িয়েছেন টানা। আর প্রেসিতে এখন আমি পড়াই। ওঁর অনুবাদ প্ৰবন্ধ সবই এখন আমাদের সিলেবাসে আছে। প্রেসিতে বছর ৫ হলো এগুলো এসেছে।