উকুনের বারোমাস্যা : শ্রেণি সংগ্রামের এক বিচিত্র আখ্যান <br /> অমিত   মজুমদার

উকুনের বারোমাস্যা : শ্রেণি সংগ্রামের এক বিচিত্র আখ্যান
অমিত মজুমদার

তৃষ্ণা বসাকের গ্রন্থ উকুন-এর আলোচনায় অমিত মজুমদার

প্রখ্যাত সাহিত্যিক সামারসেট মম একজন কবি ও একজন গদ্যকারের মধ্যে তুলনা টানতে গিয়ে বলেছিলেন,
“The crown of literature is poetry, It is ist end and aim.
It is the sublimest activity of the human mind. It is the
achievement of beauty and delicacy. The writer of
prose step aside when the poet passes.”
শেষ লাইনের অর্থ একজন কবি যখন যাবেন তখন একজন গদ্যকার পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াবেন। এই পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টা খুব সম্মানের। সামারসেট মমের কথা অনুসারে একজন কবি সবসময় একজন গদ্যকারের থেকে এগিয়ে থাকেন। আজকের আলোচনা তৃষ্ণা বসাককে নিয়ে। যিনি শক্তিশালী কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। লিখেছেন বেড়াল না নীলঘণ্টা, উল্টেমেলো, অজাতক সমগ্র থেকের মতো কাব্যগ্রন্থ। সেই সঙ্গে লিখেছেন গল্প ৪৯, আত্মারামের নতুন খাঁচা সহ অসামান্য বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ। আবার তিনিই লিখেছেন বাড়িঘর, অনুপ্রবেশ, অগ্নিবলয়, চরের মানুষের মতো অনবদ্য উপন্যাস। অর্থাৎ কবিতার মতো গদ্য সাহিত্যেও নিজের কলম কতটা শক্তিশালী তা পাঠকের কাছে প্রমাণ করেছেন। আমাদের আজকের আলোচনা কিন্তু কবিতার বই নিয়ে নয়। আজকে আলোচনা একটা গল্পগ্রন্থ নিয়েই। এখানে দেখা হবে কবি তৃষ্ণা বসাককে সত্যিই জায়গা ছেড়েছেন গদ্যকার তৃষ্ণা বসাক নাকি তাঁর গদ্যই নিজের জায়গা করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের ভূমিতে।
উকুন একটা গল্প সংকলন। মোট বারোটি গল্প আছে এই সংকলনে। মজার বিষয় হচ্ছে বারোটা গল্পের নামকরণেই উকুন কথাটা আছে৷ উকুন এখানে একটা প্রতীক। বইটা উৎসর্গ করা হয়েছে “সারা বিশ্বের অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের উদ্দেশ্যে”। বইটার ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন, “ভদ্র ও সুশীল সমাজের চেপে রাখা, বলতে মানা কথাগুলো উকুনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে, যেমন উঠে এসেছে ক্ষমতার পীড়ন, বহুজাতিক সংস্থার নয়া ঔপনিবেশিকতা, যৌনতার অবদমন থেকে অতিমারীকালীন চরম রাষ্ট্রিক নিস্পৃহতা। উকুনের গল্পগুলো বারবার এই স্থবির সমাজের ক্ষমতার চেনা শ্রেণিবিন্যাসকে ভেঙেচুরে স্বপ্ন দেখছে এক অন্তর্ঘাতের যেখানে গুপ্তঘাতকের মতো উকুন, উকুনেরা ছড়িয়ে পড়ে ছোটো মাথা থেকে বড় মাথায়।”
গল্পগুলো একটা সিরিজ। মূল চরিত্র সুকান্ত, তার স্ত্রী রঞ্জা এবং অবশ্যই উকুন। নব্বই দশকে দূরদর্শনে বেশ কিছু সাপ্তাহিক ধারাবাহিক সম্প্রচার হয়েছিলো যেখানে আমরা দেখেছি একটা পরিবারের বিভিন্ন সমস্য মজার মজার ঘটনার মাধ্যমে উঠে আসছে প্রতি পর্বে৷ হিন্দিতে ইয়ে যো হ্যায় জিন্দেগী, গুনিরাম , মুঙ্গেরী কে ভাই নওরঙ্গিলাল, ইধার উধার, কিংবা বাংলায় মায়ার সংসার এখনও দর্শকের মধ্যে দাগ কেটে রেখেছে। সিরিজগুলো খুব মজার ছিলো আর দর্শকও একেবারে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতো প্রতিটা পর্ব। উকুন সিরিজও অনেকটা তেমনই। প্রতি গল্পে উকুন নিয়ে সুকান্ত ও রঞ্জার নতুন নতুন পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাই। ভীষণ মজার আঙ্গিকে কিছু অত্যন্ত সিরিয়াস কথা প্রতি গল্পে তুলে ধরেছেন লেখিকা।
প্রথম গল্পের নাম ‘প্রথম উকুন’। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে উকুনের যাত্রা শুরু এখান থেকেই। এখানেই রঞ্জা প্রথম আবিস্কার করে তার মাথায় উকুন হয়েছে। কিন্তু এমন একটা পরিবারে উকুন কোথা থাকে আসতে পারে ? সুকান্তর এই কৌতূহলে রঞ্জা জানিয়ে দেয় যে উকুন এসেছে তার মেয়ের মাথা থেকে। মেয়ে স্কুলের কোনো মেয়ের মাথা থেকে উকুন নিয়ে এসেছে। যে উত্তরটাও ঠিক মনঃপুত হয়নি সুকান্তর। মেয়ের কাছে যাচাই করেও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি সে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে সুকান্তকে ফেসবুকে পোস্ট পর্যন্ত দিয়ে হয় যে মাথার উকুন কিভাবে বিনাশ করা যায়৷ এখানে অনেক কমেন্টের মধ্যে একটা চিত্তাকর্ষক কমেন্ট আসে তা হলো ক্যানিং লাইনে ঘুটিয়ারি শরিফে নেমে বিবিপুকুরের হালিমাবিবির কাছে ওষুধ পাওয়া যেতে পারে। এখান থেকেই গল্পে চলে আসে হালিমাবিবি চরিত্রটা যে কখনও সরাসরি চরিত্র হিসেবে কোনো গল্পে আসেনি কিন্তু তার নাম ছাড়া উকুন পুরোপুরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই গল্পেই আসে আর একটা চরিত্র সীমা যে কিনা সুকান্ত রঞ্জার বাড়িতে কাজ করতে আসে। যাকে বলে কাজের মাসি। এখানেই ঈঙ্গিত রঞ্জার মাথায় উকুন এসেছে সীমার মাথা থেকে যে কিনা মাঝে মাঝে সামান্য টাকার বিনিময়ে রঞ্জার বডি মাসাজও করে থাকে।
দ্বিতীয় গল্পের নাম ‘উকুনসাম্য’। এখানে গল্পের শুরুতেই উকুনের উৎস নির্মুল করে ফেলতে কাজের লোক ছাড়িয়ে দেয় সুকান্ত। কিন্তু ততদিনে রঞ্জার মাথায় উকুনের বংশবিস্তার ভীষণভাবে হয়ে গেছে। সেই উকুনের পরিমান এতই বেশী যে রান্না করা তো দূরের কথা সামান্য শরবত করলেও তাতে উকুন পাওয়া যায়। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত বাড়ির সব কাজ সুকান্ত নিজেই করবে। তারপর থেকে রঞ্জাকে আর কিছু করতে হয় না। সে টিভি দেখে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়, নতুন কেনা ট্যাব নিয়ে খেলা করে। শুধু উকুনের কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না। এই গল্পে উকুনের বিষয়ে লেখিকা কিছুটা পরিস্কার করেছেন। রঞ্জা বলে, “উকুন বুঝলে, অনেকটা লিটল ম্যাগাজিনের মতো। আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকটিভিটি। তার মানে, বোঝাই যাচ্ছে এর মধ্যে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ব্যাপার আছে। আর অন্যদিকে কাগজ, টিভি, ইন্টারনেট — এরা হচ্ছে এক — একটা প্রতিষ্ঠান। উকুনের জন্য এরা স্পেস নষ্ট করবে ? উকুন যে আছে তা এরা স্বীকারই করে না।” এইখানেই গল্পটার প্রাসঙ্গিকতা। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা যতটা সম্ভব ছেটে অথবা ঢেকে রাখাই কাজ প্রতিষ্ঠানের। রঞ্জার মাথা ভর্তি চুলে উকুন বলে সুকান্ত কল্পনায় তাকে মুণ্ডিত মস্তক নারী ভাবতে শুরু করে দিলো। মাথার মধ্যে থাকা ফটোশপে সে দেখতে লাগলো বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর মতো একটা নারী এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ স্রেফ মনের বিকাশ ঘটিয়ে রঞ্জার আলুলায়িত কেশরাশি সে একটা অদৃশ্য ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে পেরেছিলো। এখানেও চলে আসে একটা শ্রেণি বৈষম্য। বিষয়টা কল্পনায় হলেও উকুন যুক্ত চুল কিন্তু সুকান্ত নির্মমভাবে দমন করে ফেলেছিলো রঞ্জাকে মুণ্ডিতমস্তক করে দিয়ে। অর্থাৎ উকুন ভ্যানিস করতে গিয়ে রঞ্জার চুলও কাল্পনিকভাবে সে ভ্যানিস করে দিয়েছিলো৷ এই শোষণটা কেবলমাত্র উকুনের ওপরই নয় গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় এই শোষণ রঞ্জার ওপরেও। সুকান্ত কিন্তু রঞ্জার মাথায় উকুন ছাড়া চুল কল্পনা করতে পারেনি।
তৃতীয় গল্প ‘উকুনায়ন’ -এ আমরা দেখতে পাই রঞ্জার মাথা থেকে সুকান্তর মাথায় উকুন সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলেছে। সুকান্ত উকুন আর হালিমাবিবির ওষুধের মধ্যে এতটাই ডুবে থাকে যে অফিসের পিয়ন তার কাছে ফাইল চাইতে এলেও সে ঘোরের মধ্যে বলে ফেলে, “ফাইল মানে উকুনের ওষুধের ফাইল ?” এমনকি সে তার বড়বাবুকেও বুঝিয়ে চলে উকুন মোটেও কোনো সাধারণ কীট নয়, উকুন একটা অস্ত্র। বই যেমন একটা ভুখা মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে তেমন যার কোনো ক্ষমতা নেই তার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে উকুন। এই উকুনই পারে একটা সিস্টেমকে ধ্বংস করে দিতে।
চতুর্থ গল্প ‘উকুন শিল্প’তে গল্পের একটা বাঁক লক্ষ্য করা যায়। এখানে সুকান্ত হঠাৎ স্বঘোষিত উকুন নিধন প্রতিবাদি মঞ্চের মুখ্য আহ্বায়ক হয়ে ওঠে। উকুন বাঁচাতে সে বদ্ধপরিকর। উকুনের অনেক উপকারী দিক আছে। তার একটা হলো উকুনই পারে মানুষের সঙ্গে মানুষের মহামিলনের সেতু গড়ে তুলতে। যেমন মা মেয়ের বা মেয়ে মায়ের মাথার চুল থেকে উকুন বেছে দিচ্ছে এটা প্রকৃত অর্থেই একটা মানবিক চিত্র। এই দৃশ্য প্রায় দেখাই যায় না এই সময়ে। একটা অদ্ভুত লাইনে সুকান্তর বয়ানে লেখিকা বলেছেন, “ভাইসব কল্পনা করুন ট্র‍্যাম্প যদি থেরেজা মের কিংবা জাপান যদি কোরিয়ার উকুন বেছে দিতে পারত, তাহলে বিশ্বের চেহারাটা কত সুন্দর হত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো ভয় থাকত না।” কথাটার একটা মানবিক আবেদন আছে। যত উকুন ততই মানুষের কাছে আসা। অতএব উকুন ধ্বংস না করে তার বিস্তার ঘটানো উচিত। উকুন নিয়েই হতে পারে গ্লোবাল মার্কেট। কিন্তু এই এত বড় মার্কেটের একটা শত্রুপক্ষও আছে। সে ক্যানিং লাইনের হালিমাবিবি যে কিনা উকুন মারার ওষুধ বিক্রি করে।
‘উকুনপাঠ’ গল্পে সুকান্ত উকুন নিয়ে আরও পড়াশোনা করার জন্য স্থানীয় পাঠাগেরের স্মরণাপন্ন হয় কিন্তু সেখানে উকুন নিয়ে কোনো বই না পেয়ে চিফ লাইব্রেরিয়ানের সামনে এসে টোকেন প্রতিবাদে বুকশেলফের কাচ ভেঙে ফেলে। এর জন্য তাকে কয়েক ঘণ্টা হাজত বাসও করতে হয়৷
‘উকুনিম’ গল্পটায় সুকান্ত কয়েক দিন ক্যানিং লাইনের ট্রেনে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে এক হকারের কাছে অনেক কষ্ট করে হালিমাবিবির ঠিকানা যোগাড় করে। জায়গাটার নাম ঘুটিয়ারি শরিফ৷ উকুনের গ্লোবাল মার্কেটিংয়ের ব্যাপারে তার একমাত্র প্রতিপক্ষ হালিমাবিবি। তবে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার কোনো পরিকল্পনা নেই। তাকে শুধু কিনে নিতে হবে। এই প্রতিপক্ষ কিনে নেবার বিষয়টা যথেষ্ট ঈঙ্গিতপূর্ণ। বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় চড়া দাম পেলে সেখানে হালিমাবিবি তো সামান্য একজন। কিন্তু ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে টোটোতে করে বিবিপুকুর যেতে হয়৷ সেখানেই নাকি তার বাসস্থান। কিন্তু ঘুটিয়ারি শরিফে এসে একটা ফলওয়ালার কাছে সে শুনলো এক বিস্ময়কর কাহিনি। হালিমাবিবি নামে নাকি বাস্তবে কেউ নেই। সরকার থেকে নাকি বলেছে একশো বছর আগে উকুন এই দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷ তাই উকুন মারা বিষও ব্যান হয়ে গেছে। বিষ ব্যন হলে সুকান্তর লাভ। কিন্তু যে দেশে সরকারি ভাবেই উকুনের অস্তিত্ব নেই সে দেশ থেকে উকুন নিয়ে কিভাবে গ্লোবাল মার্কেটিং হবে ? এখানেও একটা রাজনৈতিক বিষয় উঠে আসে। সুকান্তর চোখের সামনে উকুন অথচ সেই উকুনই কিনা আইনত অস্তিত্বহীন। উকুনকে সমাজের শ্রমজীবী মানুষের মতো সরকারি ভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
‘উকুনের যৌনজীবন’ এই সংকলনের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ গল্প। উকুন যে আছে এবং তারা নিয়মিত বংশ বিস্তার করে চলেছে এটাই প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যায় সুকান্ত। এবারের মিশন মোবাইলে বানানো দুই তিন মিনিটের একটা শর্ট ফিল্মের পরিকল্পনা। ফিল্মের নাম সেক্স লাইফ অফ ইনসেক্ট। প্রয়োজন হলো একমাথা ঘন চুল যেখানে উকুন আছে। এমন মাথা ঘরেই আছে। সে রঞ্জা। কিন্তু এই পরিকল্পনায় মাথা দিতে রঞ্জা মোটেও রাজি হলো না৷ অবশেষে নির্বাচন করা হলো কাজের মেয়ে সীমাকে৷ সে রাজিও হয়ে গেলো। কিন্তু মোবাইলে চুলের ছবি তুলতে তুলতে সুকান্তর ভয়েজ ওভার “উকুনেরাও মানুষ, তাদের ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, ইয়ে মানে সবকিছুই আছে। তারাও সহবাস করে। আসুন আজ আমরা উঁকি মারি উকুনের যৌন জীবনের ওপর।” এইটুকু শুনে সীমা এমন কুপিত হলো যে সে এই বাড়ির কাজই ছেড়ে চলে গেলো। এখানেই দেখতে পেলাম শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ। কোনো হরতাল নয়। আন্দোলন নয়। একক সিদ্ধান্তে সরাসরি কাজ ছেড়ে মালিকপক্ষকে বিপদের মুখে ফেলে দেয়া।
‘উকুনের বিলিব্যবস্থা’ গল্পের ভাবনা অন্য গভীরতার। মৃত্যুর পর মানুষের দেহদান বিষয়টা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেই মানুষের মাথায় যদি উকুন থেকে থাকে তাহলে সেই উকুনগুলো কেনো সংরক্ষণ করা হবে না ? এই ভাবনা নিয়ে এগোতে গিয়েই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় সুকান্ত। এই গল্পেই উঠে আসে উকুনের শ্রেণিবিভাজনের কথা। যখন সুকান্ত নতুন করে শোনে তাদের বাড়িতে উকুন অত্যন্ত দুঃস্থ ও নিপীড়িত পরিবারের প্রতিনিধি সীমার মাথা থেকে আসেনি এসেছে তার মেয়ে মানির হাই প্রোফাইল স্কুল থেকে তখন তার উপলব্ধি হয়, “মানির স্কুলের উকুন আর সীমার মাথার উকুন তাহলে আলাদা ? তার মানে ওদের শ্রেণি বিভাজনাছে। তার মানে ওদের এবার শ্রেণিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু তার আগে ওদের বিলিব্যবস্থা করতে হবে। মরণোত্তর দেহদান হয়, মরণোত্তর উকুনদান কেন হবে না ?”
‘উকুনিত বসন্ত’ গল্পটা একভাবে শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাঠককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়। শুরুতে বলা হয়েছে, “উকুনরা তো ফেলনা নয়। উকুনের প্রতি এই তাচ্ছিল্য ও অবহেলা আসলে কলোনিয়াল হ্যাংওভার ছাড়া কি কিছু নয়। উকুনের মতো উপকারী প্রাণী খুব খুব কম আছে। একমাত্র উকুনেরই আছে শ্রেণিসচেনতা ভেঙে মানুষে মানুষে বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষমতা। এই উকুনের জন্যেই যে বাঁদরেরা প্রাণী হিসেবে খুব সংঘবদ্ধ, তা সুকান্ত হলফ করে বলতে পারে।” আর এই গল্পেরই সজনে ফুলের ইস্যু নিয়ে সুকান্ত আর পাশের বাড়ির বৌদির সঙ্গে উকুন সংক্রান্ত সঙ্গবদ্ধ হবার চেষ্টা দেখা যায়৷
‘ঈশ্বর রোবট ও উকুন’ একটা অন্য স্বাদের গল্প। এখানে একসঙ্গে উঠে এসেছে ঈশ্বর ও রোবোট তত্ত্ব। “এই ভারতবর্ষে যাতেই হাত দিতে চাও, তাই নাকি ভগবান। হনুমান ভগবান, গরু ভগবান, কোনদিন শুনবে না উকুনও ভগবান হয়ে গেছে!” সেই ঈশ্বর কনসেপ্ট থেকেই রোবোটের কথা মাথায় চলে আসে সুকান্তর। ততৎক্ষনাৎ তিনি যোগাযোগ করেন রোবট বিশেষজ্ঞ আনন্দ করগুপ্তর সঙ্গে। কিন্তু সেখানে গিয়ে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয় তার৷ আনন্দবাবুর রোবট রাজিয়া তাঁর মাথা থেকে বের করব ফেলে উকুন সংক্রান্ত যাবতীয় চিন্তাভাবনা। সমস্যার সূত্রপাত এখানেই। মাথা থেকে সব পরিকল্পনা আর তথ্য চুরি হয়ে গেলে সুকান্ত গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। তার বদলে একটা রোবট হয়ে যাবে মানবজাতির পরিত্রাতা। এখানেও রণে ভঙ্গ দিতে হয় সুকান্তকে। একসঙ্গে ঈশ্বরতত্ত্ব আর রোবোটিকসের মাথায় উকুন বসিয়ে দেবার পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়।
‘উকুনশ্রী’ গল্পের একটা অসাধারণ মজা আছে। সুকান্ত আর রঞ্জা এক বিয়েবাড়িতে গিয়েও মাথায় উকুন থাকার কারণে না খেয়ে আসতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু পরের মুহূর্তেই রঞ্জার মামা ছুটে বাইরে আসেন। সঙ্গে ক্যাটারিং -এর একটা ছেলে। তার হাতে পেল্লায় দুটো প্যাকেট। তিনি সেই ক্যাটারিং -এর ছেলেটাকে বলেন , “জানো কত বছর ধরে ও এই পশুপালন করেছে, কাগজে টিভিতে প্রায়ই ওর খবর বেরোয় সুকান্ত আমাদের ভিত্তি, উকুন আমাদের ভবিষ্যৎ।” এই গল্পের সবথেকে বড় ঘটনা তারা একসঙ্গে ছ মাসের জন্য বিদেশে মেয়ের কাছে যাবার সময় সুকান্ত রঞ্জাকে বলে, “কুকুর, বেড়াল পুষলে ক্রেশে রেখে যেতে হত, ওদের জন্যে তুমি বিদেশে বসে ছটফট করতে, কিন্তু আমাদের পুষ্যিকে আমরা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছি।” ভালোবাসার মানুষকে আমারা মাথায় তুলে রাখি। কিন্তু গল্পের শেষে জানা যায় মেয়ে তার বাবা মাকে শুধু ভালোবাসার টানে কাছে নিয়ে আসেনি এসেছে তার প্রেমিকের গবেষণার কাজে। প্রেমিকের গবেষণার বিষয় উকুন। কিন্তু ওই দেশে উকুন সহজ লভ্য নয়। তাই তার বাবা মায়ের মাথা টেনে আনা হয়েছে উকুন গবেষণার কাজে।
বইটার শেষ গল্পের নাম ‘উকুনের মৃত্যু নেই’। এই গল্পে সুকান্ত একটা অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে অতিথি সেই সীমা। যাকে নিয়ে ‘উকুনের যৌনজীবন’ শুটিং শুরু হলেও তা ভেস্তে যায়। সীমা কাজ ছেড়ে দেয় শুধু কাজ ছেড়ে চলে যায় তাইই নয় পাড়ায় এমন বদনাম রটায় যে তাদের বাড়িতে আর কেউ কাজ করতে আসেনি। সেই সীমার ভার্চুয়াল ইন্টারভিউ নেয়া হবে৷ কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। সীমা দাবি করে তার মাথায় কোনোদিন উকুন ছিলো না। ইন্টারভিউ ভেস্তে যায়। শেষ পর্যন্ত উঠে আসে সেই হালিমাবিবি। এর পরের অংশ সাংঘাতিক ভাবে সিম্বোলিক। অনেক পথ হাঁটতে হাঁটতে কারা যেনো রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়েছিলো৷ মানুষ মারা যায় কিন্তু উকুন মরে না।
উকুন নিয়ে গল্পগুলো অনেক ছাঁচে ফেলা যায়। এগুলো একদিকে আখ্যান আবার অন্যদিকে ছোটো গল্প আবার প্রতিটা গল্প যদি একটা সুতোয় বেঁধে পরপর পাড়া যায় তাকে কি একটা উপন্যাস বলা যাবে না ? প্রতিটা ঘটনার সঙ্গে পরের ঘটনার একটা উল্লেখযোগ্য যোগসূত্র আছে। গোটা উকুন সিরিজটি পর্যালোচনা করলে যা পাওয়া যায় তা হলো এটা একটা গভীর জলের নদী। যে নদীর জলে একের পর একটা স্তর। একজন সাঁতারুর যত দম থাকে সে তত গভীরতায় প্রবেশ করতে পারে। কেউ জলের ওপরে সাঁতার পছন্দ করে কেউ বা ফুব সাঁতার পছন্দ করে। প্রত্যেক সাঁতারুর পছন্দের মাত্রা ভিন্ন। তেমন কোনো পাঠক যদি উকুনের কেবলমাত্র উপরিভাগ থেকে নিজের আনন্দটুকু খুঁজে পেতে চান তাহলে তিনিও আনন্দ খুঁজে পাবেন। আবার কেউ গভীরে নেমে মুক্ত খুঁজে পেতে চাইলে সেই আনন্দও পাবেন। উকুন আসলেই একটা গভীরতার গল্প। মূল বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে অনেক গভীরে প্রবেশ করতে হবে। বুঝতে হবে উকুন নামের রূপকের আড়ালে সমাজের কোন স্তর লুকিয়ে আছে।
উকুন সিরিজে গদ্যে জটিলতা নেই। লেখিকা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় লিখে গেছেন। ভীষণই সরস এই রচনা। পরতে পরতে হাসির উদ্রেক ঘটিয়েছে কিন্তু কোথাও অতিকথন বা অতিনাটক হয়ে যায়নি। খুব সাধারণ একটা দৃষ্টিতেই তিনি দেখিয়েছেন শ্রেণিসংগ্রাম, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আর তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের আসল চেহারা৷ লেখাটা শুরু করেছিলাম সামারসেট মমের একটা উক্তি দিয়ে। দেখতে চেষ্টা করছিলাম গদ্যকার নাকি কবি তৃষ্ণা বসাক কে অন্যকে সম্মান জানিয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। কিন্তু উত্তর যথাযথ পেলাম না। এই গদ্যপাঠের পর মনে হতেই পারে এমন গদ্য দেখলে যে কোনো কবি সম্মানের সঙ্গে পথ ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াবেন। এখানে কিন্তু সেই বিচারে যাচ্ছি না কারণ তৃষ্ণা বসাকের কবিতা পড়ার সময়ও ঠিক তার বিপরীত চিন্তা ভাবনাই ভীষণ ভাবে মনে আসে। একজনের লেখা কবিতা আর গদ্য দুটোই যখন ভীষণভাবে শক্তিশালী বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তাদের মধ্যে তুলনা না টানাই ভালো। তৃষ্ণা বসাক দুই ক্ষেত্রেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাই পাঠককে বলবো সুন্দর প্রচ্ছদ, অসাধারণ ছাপা ও দুর্দান্ত বাইন্ডিং -এ দুই মলাটে ধরা ‘উকুন’ অবশ্যই পড়ুন আর কিছুদিন উকুনের মধ্যে মজে থাকুন। আপনি আনন্দ পেতে বাধ্য।

উকুন
প্রকাশক – রা’ প্রকাশন
প্রচ্ছদ – ধীমান পাল

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes