
ইতালো কালভিনোর গল্প
ভূমিকা ও অনুবাদ – অনুপ সেনগুপ্ত
জার্মান ভাষায় গ্রিম ভাইদের রূপকথার সংকলনের সমতুল্য সংকলন একসময় ইতালীয় ভাষায় ছিল না। ১৯৫৪ সালে এক প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে প্রখ্যাত ইতালীয় লেখক ইতালো কালভিনো (১৯২৩ - ১৯৮৫) এই দায়িত্ব নিলেন। তবে তিনি গ্রিম ভাইদের মতো কারও কাছ থেকে শুনে গল্প সংগ্রহ করলেন না। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই ইতালির আঞ্চলিক ইতিকথার সংকলন প্রকাশিত হতে শুরু করে। যেমন, গ্যুসেপ্পে পিত্রের সিসিলিয়ান ফেবলস, গেরার্দো নেরুচ্চির তাস্কান উপকথা কিংবা দোমেনিকো গ্যুসেপ্পে বেরনোনির ভেনেশিয়ান টেলস। কালভিনোর প্রকল্পের উৎস হয়ে উঠল এমনতর প্রকাশিত সংকলন। এছাড়া বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি এবং সাময়িকপত্রে প্রকাশিত রূপকথাও তিনি বাদ দিলেন না। আবার ইতালীয় ভাষার বিভিন্ন ডায়ালেক্টে যখন একই কাহিনীর রূপভেদ দেখলেন, তখন নিজের বিচারে শ্রেষ্ঠতমটিই বেছে নিলেন। তবে গল্পচয়নের ক্ষেত্রে কালভিনোর লক্ষ্য ছিল ইতালীয় ভাষাতাত্ত্বিক অঞ্চল, ভৌগোলিক ইতালি রাষ্ট্র নয়। যেমন ফ্রান্সের নিস কোস্টের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, তা প্রভাঁশ্যালের থেকেও ইতালীয় ডায়ালেক্ট লিগুরিয়ানের নিকটাত্মীয়। কালভিনো এই অঞ্চলের কাহিনী নিলেন। আবার ইতালির আওস্তা উপত্যকার মানুষ ফরাসি ডায়ালেক্টে কথা বলে। তাই এখানকার কাহিনী বাদ দিলেন। গল্প জোগাড়ের পর শুরু করলেন পুনর্লিখন। এ ব্যাপারে তাঁর মন্ত্র সেই তাস্কান প্রবাদ – কিছু সংযোজিত না হলে কোনও কাহিনীই সুন্দর হয় না। প্রকৃতপ্রস্তাবে কালভিনোর ভার্বাল অ্যালকেমি এইসব লোককথাকে সোনার মহিমায় উদ্ভাসিত করল। অবশেষে ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হল দুশোটি কাহিনীর সংকলন – ‘ফিয়াবে ইতালিয়ানে’ (‘ইতালিয়ান ফোকটেলস’)। ‘যেখানে কেউ মরে না’ (‘দ্য ল্যান্ড হোয়্যার নো ওয়ান ডাইজ়’) এই বইয়ের সাতাশ নম্বর গল্প। এই কাহিনী ইতালির ভেরোনা অঞ্চলের। আর্রিগো বাল্লাদোরোর ‘ফোকলোর ভেরোনিজ়’ থেকে কালভিনো এই গল্প পেয়েছিলেন। বৃদ্ধদের দাড়ির দৈর্ঘ্যের তারতম্য অবশ্য কালভিনোর সংযোজন। অমরতার আকাঙ্ক্ষাই এই অ্যালিগোরিক্যাল ফ্যান্টাসির মোটিফ। কিঞ্চিৎ গথিক ফ্লেভারও রয়েছে। সেইসঙ্গে একের পর এক বৃদ্ধের উপস্থিতি দেখে মনে পড়তে পারে জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাফ ইয়ুং-এর সেনেক্স বা ওল্ড ওয়াইজ় ম্যান আর্কিটাইপ। যৌথ নির্জ্ঞান মনের এই আর্কিটাইপ হয়ে উঠতে চায় মানুষের পথপ্রদর্শক – ফ্রেন্ড-ফিলোজ়ফার-অ্যান্ড-গাইড। বিভিন্ন দেশের রূপকথায় ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে এমন জ্ঞানী বৃদ্ধের তাই দেখা মেলে। হিন্দু ধর্মে যেমন এই আর্কিটাইপই মূর্ত হয়ে ওঠে গুরুর মধ্যে।
| যেখানে কেউ কখনও মরে না |
একদিন একটা ছেলে, বলা যেতে পারে সদ্য যুবক, হঠাৎই ভাবতে বসল – এই যে প্রত্যেকেই একদিন মরে যায়, আমারও তো তাহলে একই পরিণতি হবে। না, না, মানতে পারছি না। আমাকে এমন এক জায়গার খোঁজ পেতে হবে, যেখানে কেউ কখনও মরে না।
বাবা, মা, কাকা, জ্যাঠা, ভাইবোনদের বিদায় জানিয়ে ছেলেটি বেরিয়ে পড়ল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হাঁটে। যার সঙ্গে দেখা হয় তার কাছেই এই জায়গার হদিশ জানতে চায়। কিন্তু কেউই বলতে পারে না, কেউই জানে না এমন মুলুকের খবর। একদিন ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল একজন বৃদ্ধের। বৃদ্ধের সাদা দাড়ি নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। একটা হাতলওয়ালা একচাকার গাড়ি পাথরে বোঝাই করে ঠেলছেন। ছেলেটি তাঁকে জিজ্ঞেস করল – যেখানে কেউ কখনও মরে না এমন জায়গার সন্ধান কি জানেন?
–মরতে চাও না? তাহলে আমার সঙ্গে থেকে যাও। দেখতেই পাচ্ছ, ওই পাহাড় একটু একটু করে ভেঙে সেই পাথর এই ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে সরাচ্ছি। যতদিন না ওই পাহাড় উধাও করে দিতে পারছি, ততদিন মরবে না।
– কতদিন লাগবে করতে?
– অন্তত একশো বছর।
– আর তারপর মরে যাব?
– হ্যাঁ, তা তো বটেই।
– তাহলে আর এ ঠাঁই আমার উপযুক্ত নয়। যেখানে কেউ কখনও মরে না, সেখানে যেতে চাই।
বৃদ্ধকে বিদায় জানিয়ে ছেলেটি আবার হাঁটতে শুরু করল। মাইল-মাইল পথ পেরিয়ে সে পৌঁছোল এক অরণ্যে। এমনই বিস্তার সেই অরণ্যের, বুঝি এর কোনও শেষ নেই। আবার একজন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা। তাঁর দাড়ি নাভি ছুঁয়েছে। একটা বড় কাঁচি দিয়ে ডালপালা ছেঁটে সাফ করছিলেন। তাঁকেও ছেলেটির সেই এক প্রশ্ন – দয়া করে কি এমন জায়গার কথা বলতে পারেন, যেখানে কেউ কখনও মরে না?
আমার সঙ্গে থাকো। যতদিন না ডালপালা ছেঁটে এই বনের সব গাছ ঝকঝকে পরিপাটি করে দিতে পারছি, ততদিন তুমি মরবে না – বৃদ্ধ জবাব দেন।
– কতদিন লাগবে?
– তা ধরো, দুশো বছর তো বটেই।
– আর তারপর আমার মৃত্যু হবে?
– হ্যাঁ, অবশ্যই। কেন, দুশো বছর কি তোমার বাঁচার পক্ষে যথেষ্ট নয়?
– না, তাহলে আর এখানে ডেরা বাঁধতে পারব না। আমি খুঁজছি সেই জায়গা যেখানে কেউ কখনও মরে না।
একে অপরকে বিদায় জানিয়ে ছেলেটি ফের রওনা দেয়। কয়েকমাস পর পৌঁছোয় এক সমুদ্রতীরে। এখানেও দেখল একজন বৃদ্ধকে। তাঁর দাড়ি নেমেছে হাঁটু পর্যন্ত। একটা হাঁস সমুদ্রের জল খেয়ে চলেছে, আর তা সতৃষ্ণ নয়নে দেখছেন বৃদ্ধ। ছেলেটি তাঁকেও সেই একই প্রশ্ন করল – আপনি কি এমন জায়গার খোঁজ দিতে পারেন, যেখানে কেউ কখনও মরে না?
তোমার যদি মরতে ভয়, তাহলে আমার সঙ্গে থাকো। হাঁসটা দেখছ? যতদিন না ওই হাঁস জল খেয়ে গোটা সমুদ্র শুকিয়ে ফেলতে পারে, মৃত্যু তোমায় স্পর্শ করবে না – ছেলেটিকে আশ্বস্ত করতে চান বৃদ্ধ।
– কতদিন লাগবে?
– তা মোটামুটি তিনশ বছর।
– তারপর আমাকে মরে যেতে হবে?
– এর চেয়ে বেশি কী আশা করো? এরপরেও কতদিন বাঁচতে চাও তুমি?
– না, না, তাহলে আর এখানে ঘাঁটি গাড়তে পারব না। আমি একদন অবশ্যই সেখানে পৌঁছোব, যেখানে কেউ কখনও মরে না।
ছেলেটি আবার হাঁটতে শুরু করে। এক সন্ধেয় অপূর্ব একটা প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃদু করাঘাত করতেই দরজা খোলেন একজন সৌম্য বৃদ্ধ। ঝরনার মতো তাঁর দাড়ি নেমেছে পায়ের পাতায়। জিজ্ঞেস করেন – ছেলে, তুমি কী খুঁজছো?
– আমি খুঁজছি এমন জায়গা যেখানে কেউ কখনও মরে না।
– এই সেই জায়গা। এখানে কেউ কখনও মরে না। যতদিন আমার সঙ্গে থাকবে, নিশ্চিত থাকতে পারো, কখনোই মরবে না।
– মাইলের পর মাইল রাস্তা পেরিয়ে বেশ কাহিল আমি। অবশেষে সেখানে এলাম, যার খোঁজে এতদিন হেঁটেছি। কিন্তু আমি এখানে থাকলে আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?
– একেবারেই না। বরং তোমার সঙ্গে তো বেশ আনন্দেই কাটবে।
এরপর বৃদ্ধের সঙ্গে ওই প্রাসাদে রাজার হালে থাকতে লাগল ছেলেটি । এমন আনন্দে বছরের পর বছর দ্রুত কাটল যে সময়ের গতিবিধি, সন-তারিখের হিসেব সে আর নিরূপণ করতে পারে না। তারপর হঠাৎই একদিন ছেলেটি বৃদ্ধকে বলল – জগতে এখানকার মতো আর কোনও ঠাঁই নেই, কিন্তু আমার পরিবারকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্তত দেখতে ইচ্ছে করছে। তারা কেমন আছে, কে জানে!
– কোন পরিবারের কথা বলছো? তোমার শেষ আত্মীয়ও মারা গেছে বেশ কয়েকবছর আগে।
– তবু আমার জন্মস্থান থেকে একটু ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে। হয়তো আত্মীয়দের ছেলের ছেলেদের দেখতে পাব।
– তোমার যখন এতই ইচ্ছে, তাহলে যাও। কিন্তু যা বলব, ভালো করে শোনো। আস্তাবল থেকে আমার সাদা ঘোড়াটা বের করবে। বাতাসের বেগে ছুটতে পারে ও। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক না কেন, এই প্রাসাদ চত্বরের বাইরে ওই ঘোড়া থেকে একবার যদি নামো, তাহলে ওখানেই তোমার মৃত্যু অনিবার্য।
– না, না, এ নিয়ে ভাববেন না। ঘোড়ার জিনেই বসে থাকব, নামব না। আর জানেনই তো, মৃত্যু আমার কতটা অপছন্দের।
ছেলেটি আস্তাবলে গিয়ে সাদা ঘোড়াটা বের করে। তারপর ওর পিঠে বসে এক নিমেষে বেরিয়ে গেল বাতাসের বেগে। প্রথমে সেই জায়গা পেরোয়, একদিন যেখানে হাঁস আর একজন বৃদ্ধকে দেখেছিল। এখন সমুদ্রের জায়গায় বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। আর এর ধারে পড়ে আছে সেই বৃদ্ধের স্তূপীকৃত হাড়গোড়। তা দেখে ছেলেটি মনে-মনে বলে – ভাগ্যিস এখানে রইনি, তাহলে ওই বুড়োর মতো আমারও হাড়গোড় পড়ে থাকত।
আরও এগিয়ে সেই অরণ্যস্থলে এল। এখানেই গাছ ছেঁটে পরিপাটি করছিলেন এক বৃদ্ধ। এখন আর অবশ্য অরণ্য বলে কিছু নেই। একটি গাছও নেই। মরুভূমির মতো হয়ে গেছে এই এলাকা। এবারও সে নিজের মনে বলে ওঠে – ভাগ্য ভালো এখানে থাকিনি। থাকলে ওই গাছ-ছাঁটা বুড়োর মতো কবেই মরা মানুষের দলে যোগ দিতাম।
আবার অনেকদূর এগিয়ে দেখল সেই জায়গা, একসময় যেখানে একটা মস্ত পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই পাহাড় ভেঙেই একজন বৃদ্ধ ঠেলাগাড়িতে পাথর বয়ে নিয়ে যেত। এখন পাহাড় সরে গিয়ে যেন একটা খেলার মাঠ। ফের সে স্বগতোক্তি করে – এখানে মোটেই আমার ভালো থাকার কথা ছিল না।
মাইল-মাইল পথ পেরিয়ে অবশেষে সে পৌঁছোল নিজের শহরে। কিন্তু শহরটা এমনই পাল্টে গেছে যে প্রায় চেনাই যাচ্ছে না। তার বাড়ি তো নেইই, এমনকি যে-রাস্তার ওপর সেই বাড়ি ছিল, তাও নেই। আত্মীয়স্বজনেরও খোঁজ করল। কিন্তু কেউই তার পরিবারের নাম পর্যন্ত শোনেনি। যথেষ্ট হয়েছে, আর এক মুহূর্ত এখানে না দাঁড়িয়ে ফিরব এবার – এমনই সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটি।
ঘোড়া ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল। বাড়ি থেকে প্রায় অর্ধেক পথ পেরিয়েছে, দ্যাখে পুরোনো বাতিল জুতো বোঝাই একটা গরুর গাড়ি, একটা চাকা কাদায় আটকে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়োয়ান ছেলেটিকে বলে – একবার কি ঘোড়া থেকে নেমে গাড়ির চাকাটা কাদা থেকে তুলতে আমায় সাহায্য করতে পারেন?
– আমার তাড়া আছে। আর তাছাড়া ঘোড়া থেকে নামতে পারব না।
গাড়োয়ান কাকুতি-মিনতি করতে লাগল – দয়া করুন, একটু সাহায্য করুন। দেখতেই পাচ্ছেন, বনের ধারে এই রাস্তায় আমাকে সাহায্য করার অন্য কেউ নেই। একটু পরেই রাত নামবে। জানি না, বাঘ ভাল্লুক আছে কি না এই বনে।
দয়ার বশেই ছেলেটি মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেল প্রাসাদের বৃদ্ধের নির্দেশ। যে মুহূর্তে তার এক পা মাটি স্পর্শ করেছে, অন্য পা তখনও রেকাবে, ছেলেটির হাত চেপে ধরল গাড়োয়ান। তারপর বলল – অবশেষে তোমাকে পেয়েছি। জানো, আমি কে? হ্যাঁ আমিই মৃত্যু। এই যে গাড়িতে বোঝাই বাতিল জুতো দেখছ, আসলে সব জুতো-জোড়াই তোমার পিছনে আমার দৌড়োতে গিয়ে ক্ষয়ে গেছে। এখন তুমি পড়েছ আমার হাতে যেখান থেকে কেউ কখনও পালাতে পারে না।
আয়ুর মায়ার মধ্যে দীর্ঘ-দীর্ঘ দিন আত্মগোপন করে থাকা ছেলেটিকেও মৃত্যু শেষপর্যন্ত নিজের খেলায় টেনে নিল।