অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br /> পর্ব ৫৩ <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পর্ব ৫৩
তৃষ্ণা বসাক

৫৩
অজিত স্বপ্ন দেখছিল। ওর পালানোর জন্যে একটা গরুর
গাড়ি এনেছে কেউ। ও বলে মরে গেলেও গরুর গাড়ি
চড়বে না। যদি চড়েও,ওর জন্যে লাগবে তো একটা
গরুর গাড়ি, কিন্তু এত গরু কী করছে? আর গরুগুলোও
সুশৃংখল ভাবে, তাদের স্বভাবসিদ্ধ গদাইলশকরি চালে
আসছে না, তারা যেন ভয় পেয়েছে, যে যেদিকে পাচ্ছে,
ছুটছে। রাস্তা থেকে নেমে পড়ছে পাশের মাঠে, ঢুকে পড়ছে
লোকের বাড়ির উঠোনে। এমনকি একটা গরু, একটা
বাড়ির ছাদে জলের ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে,

দেখছিল অজিত। এই হুলুস্থুল একটু কমে এলে অজিত
দেখল তার ফ্ল্যাটের নিচে একটা গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে
আছে।অজিত সিং দা কিং গরুর গাড়িতে চড়বে? কার
মাথায় এমন বুদ্ধি এল? মোহর, মোহরমালা কি জানবে
কিছু? ও-ই কি এমন করতে পারে? গরুর গাড়ি চড়িয়ে
তাকে দূরে পাঠিয়ে দিতে চায়?
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল ওর। ঘুমচোখে নামটা কোনমতে
পড়ে বিরক্ত হল সে। সেই পি কে বি মালটা। আবার
বউয়ের চাকরি চাইবে। সে একবার ভাবল ফোন ধরবে
না, কিন্তু দাদাজী অভ্যেস খারাপ করে দিয়ে গেছে।
বঙ্গালী লোক সব উঁচা উঁচা পড়ালিখা করা জাত, তাদের
সমঝে চলতে হয়। ফোন ধরে সে তেড়িয়া গলায় বলে
‘বলুন স্যার, জলদি বলুন। আমাকে এখুনি বেরিয়ে যেতে
হবে শহর ছেড়ে।’
‘আমার খুব বিপদ সিংজী। এই মুহূর্তে আপনি ছাড়া
কাউকে মনে পড়ছে না যাকে বলতে পারি। আপনি কি
একবার আসতে পারবেন? আমার কোয়ার্টার, একদম
ক্যাম্পাসের শেষ দিকে। পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে
আসবেন’
মামারবাড়ি নাকি!
মুখে বলল ‘কী বিপদ? নোকরি নিয়ে এখন কিছু করতে
পারব না। আমাকেই শালা আন্ডারগ্রাউন্ড করে দিচ্ছে
সবাই। দাদাজী তো বলেনি বাঙালি শালা এত বেইমানের
জাত। জানলে কোন শালা এত রিস্ক নিয়ে কাজ করত।

নিজেদের বাল ছিঁড়তে পারবে না কেউ, আর আমি শালা
ফেঁসে যাচ্ছি’
‘চাকরি লাগবে না সিংজী। আমার স্ত্রী মিসিং। একটু
আসুন আপনি’
স্ত্রী মিসিং! হাসিতে ফেটে পড়ল অজিত। এত হাসির কথা
আর সে শোনেনি যেন। মোহরমালা পাশে থাকলে সে
ধমকে হাসি থামাত অজিতের। কিন্তু কোথায় মোহর?
এক মাসের বেশি সে বাইপাসের ফ্ল্যাটে আসছে না তার
কাছে। দেখা হলেও এমন ভাব করছে যেন কাজের বাইরে
কোন সম্পর্কই নেই তার সঙ্গে। এই মোহরের সঙ্গেই তো
তার একটু ভালো সম্পর্ক হয়েছিল, জীবনে এই প্রথম মনে
হয়েছিল সে আবার ঘর বসত পেতেছে। সপ্তায় ২৪ ঘণ্টা
মাত্র, তবু ওইটুকু সময়ের জন্যে তার মনটা কত শান্তিতে
থাকত, সারাজীবনে এমন শান্তি সে কখনো পায়নি। শান্তি
তো খানিক দিয়েছিল সেই পিংকিও। কিন্তু তাকে তো
কোনদিন সৌভাগ্য ভাবতে পারেনি। গাঁওয়ার অনপড়
একটা মেয়েকে বিয়ে করে সে উদ্ধার করে দিয়েছে, এটাই
তার মনে হত। কিন্তু মোহর, সে যে সব দিক থেকেই
তার স্বপ্ন আর সাধ্যের অতীত। তাকে পেয়েও হারাতে হল
কেন? সে হাসতে হাসতে বলল ‘শালা, এখন কোন যোগ
আছে বলুন তো? সবার বৌ মিসিং? ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে
যোগাযোগ করতে হবে দেখছি’
ভবানী শাস্ত্রী! নামটা খুব চেনা চেনা মনে হল প্রদীপ্তর।
কারো মুখে শুনেছে, নাকি কোথাও দেখেছে নামটা? টিভি

বা খবরের কাগজে কি? না, এরকম কোন বিগ মিডিয়ায়
নয়, দেখেছে এমন কোথাও, আপাতদৃষ্টিতে যা খুব লো –
কী বলে মনে হবে, কিন্তু কী অমোঘ আর অব্যর্থ তার
আবেদন। রাইট, সে দেখেছে দেওয়ালে। তাদের
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই, একটা নয়, দু তিন জায়গায় সে
দেখেছে, একটা পোস্টার। অনেকের চোখে পড়েছে সেটা।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ধবংসের দিন আসন্ন। অরিষ্টনেমি যজ্ঞ
চাই। যোগাযোগ করুন ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে।’ এটা
পড়লে সবাই পাগলের কাণ্ডই ভাববে, কিন্তু ভাববে না
এরকম লোকের সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ করে নিচে
নম্বর দেওয়া আছে তো।কিন্তু প্রদীপ্ত বুঝতে পারল না এই
নম্বর দিয়ে যে এমন পোস্টার মেরেছে, তাকে ট্র্যাক করা
তো পুলিশের কাছে জলভাত। যখন তা করা হচ্ছে না,
তখন নিশ্চয়… নাহ, ওসব ভাববে না প্রদীপ্ত, সে আদার
ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজে তার দরকার কি? সে শুধু
দোলনকে ফিরে পেলে খুশি।
সে কান্নাভেজা গলায় বলল ‘সিংজী, দোলনকে ফিরিয়ে
দিন প্লিজ। পুলিশ কিছু পারবে না, ওরা শুধু খোঁচা মেরে
আনন্দ পায়। আপনি একবার আসুন প্লিজ’

অজিত কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। একবার পিংকি
বায়না করেছিল কল্পতরু উৎসব দেখাতে নিয়ে যেতে
হবে। সেটা আবার কি চিজ? কল্পতরু?

পিংকি জানিয়েছিল জানুয়ারির পহেলা তারিখে ঠাকুর শ্রী
রামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়েছিলেন, মানে যে যা চাইবে তাই
পাবে। ওর বায়না মেটাতে নিয়ে যেতে হয়েছিল সেই
কোন মুলুকে কাশীপুর উদ্যান বাটিতে। খুব খুশি হয়েছিল
পিংকি।খুশিতে ডগমগ যাকে বলে। ওকে জিগ্যেস করা
হয়নি ও কী চেয়েছিল সেদিন। সেদিন জানার কোন
কৌতূহলই হয়নি। ঘরেলু আওরত, আনপড় গাওয়ার,
বরের তরক্কি ছাড়া আর কী-ই বা চাইতে পারে? আজ
মনে হচ্ছে কেন জেনে নেয়নি সে কথাটা? এরকম কি
হতে পারে পিংকি, পিংকি সন্তান চেয়েছিল? কোনদিন সে
কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি, অজিতের চমকে দমকে
একদম এইটুকু হয়ে থাকত, কখনো নিজের মনের কথাটা
মুখ ফুটে বলতেই পারেনি সে। যেন জানতই, তার কাজ
শুধু হুকুম তামিল করা।আর সেটা করতে করতেও যে
একেবারে মরে যেতে পারেনি, স্ত্রীর কতটা অধিকার হয়,
তা যে সে জানত, তার প্রমাণ সে মরে দিয়ে গেছে।
একদম শেষ গেট দিয়ে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে অজিত
ভাবছিল, পিংকি তো মরার মধ্যে দিয়েই জিতে গেছে, সে
তো পড়ালিখা জানত না কিছু, আর পিকেবি-র বৌ,
অত বড় ঘরের মেয়ে, অত পড়ালিখা করা, সে এত
সহজে হাল ছেড়ে দিল? একেবারে হারিয়েই গেল? হারিয়ে
যাওয়া মরার থেকেও আরও খারাপ মনে হয় তার। সে
তো বাড়ির লোককে একবারে মেরে রেখে যায়। সেই যে
কার যেন কথা শুনেছিল অনেক বছর আগে হারিয়ে

গেছিল একজন, তার মা আজও অপেক্ষা করে আছে তার
জন্যে, দরজায় কলিং বেল বাজলেই ছুটে আসে, ভাবে
তার মেয়ে এসেছে বুঝি। কে যেন বলেছিল কথাটা।
বুকের মধ্যে ছুরির মতো গেঁথে গেছে অজিতের। এর মধ্যে
ও যেন শত শত যুগের শত শত অপেক্ষা ফুটে উঠতে
দেখল। মা যেমন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকত,
একদিন পাপ্পু দেখল কেউ নেই তার জন্যে, পিংকি বসে
থাকত তার জন্য, রুটি করে রাখত না কোনদিন, গেলে
গরমগরম করে দেবে, তাও ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে কত
মারধোর, গালিগালাজ করেছে সে পিংকিকে।তবু পিংকি
তার জন্য জেগে বসে থাকত, এটা কি শুধুই রুটির
জন্য? নাকি এ সেই অমূল্য রতন যার মর্যাদা দিতে
পারেনি সে? তাই উল্টে সে অপেক্ষা করে পিংকির জন্য?
একবার একবার অন্তত ফিরে আসলে ওর দুহাত ধরে
ক্ষমা চাইবে সে, সারারাত কাঁদবে ওর কোলে মাথা দিয়ে।
অপেক্ষা না থাকলে জীবন কেমন আলুনি হয়ে যায় তা
তো এখন বুঝতে পারছে। মোহর, মোহর শনিবার
শনিবার তার জন্য ঘর সাজিয়ে অপেক্ষা করত, এটা যে
কত ভঙ্গুর আর অলীক –বোঝেনি সে। এটাকে সে ঘর
ভেবে বসেছিল। সে টিচার্স কোয়ার্টারের দিকে হাঁটতে
হাঁটতে ভাবছিল পিকেবি নাকি অন্য কোন ইউনিভার্সিটিতে
চলে গেছিল ছুটি নিয়ে। সবাই বলেছিল পাগল বউয়ের
কাছ থেকে পালিয়েছে সে, পি এইচ ডি-টা একটা বাহানা।
কী হাসাহাসি হচ্ছিল ওকে নিয়ে। অজিত দলের মধ্যে

থাকলে গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে, কিন্তু কথাটা শুনে তার হাসিই
তো পেয়েছিল। অথচ এখন সে যত পিকেবির কোয়ার্টারের
দিকে হাঁটছে, তত তার সাহস কমে যাচ্ছে। কেউ মরে
যায়নি, একটা মিসিং কেস, যার কাছ থেকে পালাতেই
চেয়েছিল পিকেবি- কেন এত ভয় করছে তার লোকটার
সামনা করতে? সে না অজিত সিং ইজ কিং? মনে হচ্ছে
এই সময় মোহরমালা তার পাশে থাকলে ভালো হত।
মোহর এমন একজন মহিলা যার ওপর নির্ভর করা যায়।
এরকম মহিলা জীবনে দুটো দেখেনি অজিত। একইসঙ্গে সে
নরম আর গরম হতে জানে। তার ব্যক্তিত্বের কাছে তাবড়
তাবড় লোক মাথা নোয়ায়। সে ধাঁ করে মোহরের নম্বর
টেপে। ফোন ঢুকছেই না। কী করে এমন হতে
পারে?একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে তার হার্টবিট থেমে
যায় মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যে। মোহর, মোহর তাকে ব্লক
করেনি তো? কিন্তু কী ঘটল এই অল্প কয়েক সপ্তার মধ্যে
যে তাকে ব্লক করতে হল? সেই যে এক বড় নেতার
মরদেহ পাহারা দিতে তাকে রবীন্দ্রসদন চলে যেতে হল,
সে ভেবেছিল সন্ধের দিকে অন্য কারো ঘাড়ে ডিউটি
ফেলে সে চলে আসবে মোহরের কাছে। কিন্তু অবস্থা এমন
দাঁড়াল, সে বের হতেই পারল না ওখান থেকে। পুরো
শ্মশান অব্দি যেতে হল। সব চুকতে রাত চারটে বেজে
গেল। যখন শ্মশান ছেড়ে বেরোচ্ছে, আকাশ একটু ফর্সা
হয়েছে। এর মধ্যে রাত একটা অবদি কয়েকবার ফোন
এসেছে, মোহর তখনো আশা করেছিল ও ফিরবে। কিন্তু

অজিতের চারপাশে অনেক চেনা লোক, সমর, চন্দন-
এরা ছিল ইউনিভার্সিটির।তাই অজিত একটু রুক্ষ স্বরেই
বলেছিল ‘এখানে বারবার ফোন করো না, ধরতে পারছি
না, প্রচুর লোক’ রুক্ষ তো হবেই। সেই কখন থেকে পড়ে
আছে, বারবার চা খেয়েছে শুধু আর দুটো বিস্কুট। খিদে
মরে গেছে। মোহরের কাছে ফিরতে না পারার রাগ
মোহরের ওপরেই উগরে দিল। শ্মশান থেকে বেরিয়ে
আর এক কেলো। চন্দন তাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে তার
ফ্ল্যাটে। ওকে কী করে না বলে? অত রাতে তো অন্য
কোথাও ফেরার কোন অজুহাত দিতে পারবে না। তখন
খিদে, ঘুম, ক্লান্তি অপরিসীম। সেইসব নিয়ে চন্দন তাকে
নামিয়ে দিল তার ফ্ল্যাটের সামনে। বলল ‘বাড়ি গেলে বৌ
যা বাওয়াল করবে না! নিমপাতা দাঁতে কাটো, আগুন
ছোও, হ্যানো ত্যানো, স্নান করাবে এত রাতে ভাবো,
তারপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঘরে তুলবে। চোদ্দবার ফোন
করে বলছে, তোমার হাতে মাদুলি বাঁধা আছে, কেন
গেলে? কেন গেলে শ্মশানে?’ বলে মিচকি হেসে বলেছিল
‘বৌ নেই বলে বেঁচে গেলে সিংজী। এই রাতে নইলে স্নান
করিয়ে ছাড়ত’
চন্দন হয়তো সরলভাবেই কথা বলেছিল, কিন্তু
আপাদমস্তকে চিড়বিড়িনি ধরে গিয়েছিল অজিতের।চন্দন
চলে যাবার পরে ও দাঁড়িয়ে ছিল দু এক মুহূর্ত ওর
ফ্ল্যাটের সামনে। তারপর ধাঁ করে একটা উবের বুক করে
ফেলেছিল। চন্দন একটা নরকের কীট, সে বাড়ি গিয়ে

বউয়ের নিয়ম রীত রেওয়াজে শুদ্ধ হয়ে উঠবে, আর সে
একা ঘরে কারো ছোঁয়া পাবে না, শুদ্ধ হতে পারবে না-
এটা ভেবেই তার ঝাঁট জ্বলে যাচ্ছিল। তখন বেশ ভোরের
আলো ফুটে গেছে, সে ফোন না করে সোজা গিয়ে
মোহরের দরজার বেল বাজাল। বাড়িতে বউয়ের কাছে
ফিরতে আবার ফোন করে পারমিশন নিতে হবে নাকি?
বেল টেপার সময় একটু ভয় করছিল যদিও, এভাবে ঘুম
ভাঙ্গালে বিরক্ত হবে নাকি মোহর?
ওকে অবাক করে এক বেলেই দরজা খুলল মোহর। প্রশান্ত
মুখ, যেন অন্যদিনের মতো সন্ধের মধ্যেই ঢুকেছে সে। ও
ঢুকে যখন জড়িয়ে ধরতে গেল, মোহর পিছিয়ে গেল।
‘আরে আগে স্নান’ বলে সে মুগ ডাল ভিজানো আর নিম
পাতা এগিয়ে দেয়, প্রদীপের তাপ দেয় বুকে দূর থেকে।
বাইরের দিকের ওয়াশ রুমে তোয়ালে, পাঞ্জাবি পাজামা
রাখা আছে জানায়। অজিত, হাড্ডাকাট্টা মানুষটার চোখ
ঝাপসা হয়ে আসে, তাহলে তারও একটা ঘর আছে,
বাঙালি বিবি আছে, যে তাকে মৃত্যুর গন্ধ মুছে পবিত্র
শুদ্ধ করে তুলছে।মহাবীরজীর কিরপা, অম্বামাইয়ের
কিরপা, দুর্গামাইয়ের বহোত কিরপা তার ওপর।
সেদিন স্নান করে আসার পর গায়ে সত্যি সত্যি গঙ্গাজল
ছিটিয়েছিল মোহরমালা। তারপর নিম্বুপানির গ্লাস এগিয়ে
দিয়েছিল। এক নিঃশ্বাসে সেটা শেষ করে অজিত বলেছিল
‘আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। কিছু অর্ডার করি?’

মোহর মুচকি হেসে ওকে টেবিলে বসিয়েছিল। সেখানে
ধোঁয়া ওঠা পোলাও আর মটর পনির ছিল। বলেছিল
‘রাত জেগে এসেছ, এখন নিরামিষ খাও। দুপুরে মাংস
খেও’
খেয়ে পরম সুখে মোহরের বুকে মুখ দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। এত সুখের দিন তার জীবনে
আসেনি আগে। পরেও আসবে কি? পিকেবি-র
কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হল তার জীবন
আবার শূন্য থেকে শুরু হচ্ছে। কোনদিকে যাবে সে জানে
না।
দু তিনবার কলিং বেল টেপার পরেও কেউ দরজা খুলল
না। একিরে! এই মালটাও হারিয়ে গেল নাকি। অজিত
ভাবল ফিরে যাবে। এখন তার প্রতিটা মুহূর্ত কিমতি।
এইভাবে ফালতু জিনিসের পেছনে নষ্ট করার কোন মানে
হয় ? ঠিক তখনই দরজা খুলল পিকেবি। তোয়ালেয় মুখ
মুছতে মুছতে এসেছে। মানে বাথরুমে ছিল। অজিতের
মনটা আবার সহানুভূতিতে ভরে গেল। বৌ ঘরে না
থাকলে কী যে মুসিবত পুরুষ লোকের।
যদিও সে মুখে যথেষ্ট গাম্ভীর্য বজায় রাখল। বাঙালি
এমনিই ছিঁচকাঁদুনে। ওর লাই পেলে হয়তো পিকেবি ওকে
জড়িয়ে কাঁদতেই শুরু করবে। পুরুষমানুষের কান্না মোটেই
পছন্দ হবে না অজিতের।
দরজা খুললে কেমন এক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল
পিকেবি। ভেতরে যেতে বলছে না কেন? অজিত ওর

কাঁধের ওপর দিয়ে ঘরটা দেখছিল। ঘরটা দেখে ওর
মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। তিরিশ না চল্লিশ বছর আগে
শেষ এইরকম কোন টিচার্স কোয়ার্টারে এসেছিল ও।পি
কেবির ঘর দেখে হুবহু সেই ঘরটাই মনে হল। মাঝখানে
যেন একটুও সময় এগোয়নি। সেই টিভির দুপাশে মাটির
ঘোড়া, সাধারণ সোফা আর দেওয়ালে একটা ঘোমটা
দেওয়া মেয়ের মুখ, যার চোখ দুটো কী টানা টানা, যেন
দুর্গামাইয়ের মুখ। অনেক বড় বড় হোটেলে এই ছবি
টাঙ্গানো দেখেছে অজিত। বাঙ্গালা মায়ের মুখ কি এমন
হয়? অজিত অবাক হয়ে দেখছিল ঘরটা। ও কি তিরিশ
চাল্লিশ সাল পিছিয়ে গেল নাকি টাইম মেশিনে চড়ে?
কেমন ভয় লাগছিল ওর। সেই সময়ে ফিরে গেলে ওর
দলের কাউকেই তো সে পাবে না। এই যে এখানকার
কোন সমস্যা হল তো লাগাও ফোন চন্দনকে, কিংবা
কেউ বাড়ি দিতে চাইছে না, বাপিকে ফোন করো।
কোথায় তখন বাপি কিংবা চন্দন, ফোনই তো নেই,
কারবার দফা গয়া, এই যে পিকেবি সিংজী, সিংজী করে
তেলিয়ে নিয়ে এল, এসব কি হত? তার দলটাই তো ছিল
না। তবে তাতে অজিতের কী? অজিত সিংকে সবসময়ই
লাগবে দুনিয়ায়। কিন্তু, কিন্তু এত চেনা লাগছে সব, তার
বুক থেকে একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এল। দাদাজী যদি
থাকত!তবে কত খুশি হত তার পাপ্পু বাঙ্গালির সবচেয়ে
ক্ষীর ননীর অন্দরে, প্রফেসরের ঘরে ঢুকে পড়েছে। সেবার
প্রফেসরের বৌ তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেনি। মোটের

ওপর মানুষই মনে করেনি। মেয়েকে দিয়ে জল মিস্টি
পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেটাই তো অজিতের জীবনে একটা
ল্যান্ডমার্ক। ওর শৈশব কৈশোরে যদি ভালো স্মৃতি বলে
কিছু থাকে, তবে সেই মৌটুসি পাখির মতো মেয়েটা।
মাঝে মাঝে খুব থকে গেলে সে চোখ বুজে সেই মেয়েটার
কথা ভাবে। ওইরকম একটা মেয়ের সঙ্গে হেসে খেলে বড়
হতে পারলে ওর জীবনটাই অন্যরকম হত। মেয়েটার
মুখটাই যে শুধু তার মনে আছে তা নয়, তার ফ্রকের
বেগুনি না না গোলাপি ফুলছাপ, মাথায় বাঁধা ফিতে, আর
বাঁশির সুরের মতো চলাফেরা- সেটাও চোখে লেগে আছে।
যে মহিলা অত উপেক্ষা করল, তার চেহারাও পরিষ্কার
মনে আছে, তবে সেই প্রফেসরকে তো ও চোখেই দেখেনি।
উনি অসুস্থ ছিলেন, শোবার ঘরে শুয়ে ছিলেন।
পিকেবি সম্বিত ফিরে পেয়ে ওকে ভেতরে আসতে বলে।
ওকে সোফায় বসিয়ে কফি নিয়ে আসে ভেতর থেকে।
কফিতে চুমুক দিতে ভাল লাগে অজিতের। এই প্রথম সে
কোন বাঙালি ঘরের এত অভ্যর্থনা পেল। তবু কফিতে
চুমুক দিয়ে ওর মুখে বাঁকা হাসি খেলছিল। এইসব বাঙালি
লোক এত বড় প্রফসর অফসর হয়েই বা কী হয়? সব
শালা দেখো, বিবির নোকর। বাড়ির সব কাজ করতে
হয়। মেয়েদের কাজই যদি করবে তবে এত টাকা কামিয়ে
কী লাভ হল?
পিকেডি থমথমে মুখে বলে ‘পুলিশের ওপর আমার কোন
ভরসা নেই। আপনি দোলনকে খুঁজে দিন’ বলে হাত চেপে

ধরে অজিতের। আচ্ছা মুশকিল তো। সে কড়া গলায় বলে
‘ওকে তো দেখিইনি আমি। একটা তসবির না পেলে কাকে
তালাশ করব? আমার লোকদের তো দেখাতে হবে’
প্রদীপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে একটা ওয়াল কেবিনেটের সামনে
দাঁড়িয়ে মোবাইল বার করে খুটখুট করে। তারপর বলে
‘ছবি পাঠিয়ে দিলাম। হোয়াটস্যাপ দেখুন’
হোয়াটস্যাপ না খুলে অজিত প্রদীপ্তর পাশে এসে
দাঁড়ায়।তাকে পরপর কটা ছবি। একা একটাই, আর
কোথাও বেড়াতে গিয়ে দুজনের, বিয়ের একটা। এ তো
অপূর্ব দেখতে ! পাশে আরও একটা ছবি দেখে পা
মাটিতে গেঁথে যায় অজিতের। এক বয়স্ক দম্পতির ছবি।
ও আঙুল দেখায় মহিলার ছবির দিকে ‘ইনি কে?’
‘দোলনের মা। উনি বাবা। ’
অজিত দুহাতে পাগলের মতো ঝাঁকায় প্রদীপ্তকে ‘ আপনি
আপনি! কেন, কেন এতদিন বলেননি স্যার, কেন,
কেন?’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Anindita Mandal 3 years

    মন গেঁথে গেছে। অজিত সিং একটা জটিল চরিত্র। কত কত শেড! ভীষণ গতি উপন্যাসের! অপেক্ষায় থাকি।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes