
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পঞ্চত্রিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ৩৫তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
৩৫
কী একটা শব্দে ঘুম ভাঙল মোহরমালার।এমনিতে বেশ কিছুদিন ঘুম হচ্ছে না তাঁর। চোখ বুজলেই তিনি দেখতে পান একটা পুকুর, তার পাড়ে পড়ে আছে একটা বৌ। কেন এমন দেখেন তিনি? ওই বউটা কে? বউটার শাড়ির আঁচল একটা রাস্তার মতো হয়ে গেছে।তার ওপর দিয়ে কে যেন হেঁটে চলেছে। গ্রামের ছোট রাস্তা ক্রমে শহরের রাজপথ হয়ে যাচ্ছে। তার পায়ে এসে পড়ছে সেপাই মন্ত্রী কোতোয়াল বরকন্দাজ। লোকটাকে খুব চেনা লাগে, কিন্তু চিনতে পারেন না। হঠাৎ লোকটা একটা বড় গেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়ে, ঢুকে পড়ে একটা বিল্ডিঙের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে, তারপর পাশের দেওয়ালে পোস্টার মারে । ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ধবংসের দিন আসন্ন।বাঁচতে গেলে চাই অরিষ্টনেমি যজ্ঞ। যোগাযোগ করুন ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে ।’
কে এ? খুব চেনা লাগে। যদি মুখটা দেখা যেত একবার। কিন্তু কিছুতেই লোকটা পেছন ফেরে না। ওর মাথায় একটা পাগড়ির মতো বাঁধা। লাল, সবুজ, গেরুয়া বিচিত্র রং সে পাগড়ির মতো বাঁধা। লাল, সবুজ, গেরুয়া বিচিত্র রং সে পাগড়ির। একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়ায় লোকটা। পাগড়িটা টান মেরে খুলে ফেলে। অমনি পিলপিল করে এক গাদা লোক বেরিয়ে আসে তার থেকে, তারা গোল হয়ে জড়ো হয় চারদিকে।
একজন এসে বলে ‘স্যার স্যার সমিধ কোথাও পাচ্ছি না, এখানে কিছু মেহগনি গাছের ডাল কাটা আছে দেখছি। দয়া করে তাই দিয়েই চালিয়ে নিন এবারের মতো। আমরা মূল্য ধরে দেব।’
লোকটা অমনি একটা তরোয়াল বার করে জামার আড়াল থেকে। চেঁচিয়ে উঠে বলে ‘মূল্য মূল্য। মূল্য তো তোদের ধরে দিতেই হবে। শহিদ স্মরণে আপন মরণে রক্ত ঋণ শোধ করো’
অমনি সবাই মাঠের মাঝখানে একটা যজ্ঞ বেদী তৈরিতে হাত লাগায়। বেদীতে কাঠের টুকরো সাজায়। কে একজন একটা মস্ত ঘিয়ের বোতল এগিয়ে দিতেই লোকটা চেঁচিয়ে উঠে বলে ‘ঘি নয়, যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে রক্ত। রক্ত আনো রক্ত’
অমনি একটা মহা হুলুস্থুল পড়ে যায়। সেই রামায়ণের গল্পে যেমন আছে, ঋষিদের যজ্ঞস্থল অপবিত্র করত রাক্ষসরা রক্ত, মড়ার খুলি এইসব ফেলে- সেইরকম পড়তে থাকে আগুনে। কী জঘন্য গন্ধ, বমি উঠে আসেমোহরের। লোকটা আবার বলে ‘এইসব পবিত্র রক্ত আশা করি, আমার যজ্ঞে কোন পাপীর আহুতি চলবে না।’ অমনি মুহূর্তের মধ্যে অত বড় মাঠ ফাঁকা হয়ে যায়। মাঠের কেন্দ্রে চতুষ্কোণ যজ্ঞ বেদীর সামনে একা বসে আছে সেই লোকটা। গম্ভীর স্বরে মন্ত্র পড়তে পড়তে ওপরের দিকে মুখ তুলে বলল ‘পূর্ণাহুতি দিলাম। আজ থেকে দশ দিনের মধ্যে মোহরমালা ধর আর তার মেয়ে কিঞ্জলকিনি ধর যদি না এই আগুনে এসে ঝাঁপ দেয় তবে আমার নাম…’
মোহর ভালো করে শোনার চেষ্টা করলেন নামটা। নাহ, শোনা গেল না। কে যেন ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। একটা মেয়ে। আগুনের শিখার মতো রূপ তার। সে এসেই বলল ‘ফেরত দাও, ফেরত দাও। আমার রাজ্যপাট তোমার হাতে তুলে দিয়ে আমি চলে গেছিলাম। এখন ফেরত দাও। যা যেমন রেখে গেছিলাম, ফেরত দাও।’
আরও কিছু বলছিল মেয়েটা, কিন্তু কীসের শব্দে যেন ঢাকা পড়ে গেল সব।
শব্দটা বাইরের নয়, ভেতরের। এসি চলে বলে ঘর তো বন্ধই থাকে, বাইরের শব্দ আসার কথা নয় ভেতরে। কিছুদিন হল কিঞ্জল তাঁর সঙ্গে এসে শুচ্ছে। ক্লাস নাইন থেকে সে নিজের আলাদা ঘর আদায় করে নিয়েছিল। অনিল মৈত্র রোডের এই ফ্ল্যাটটা অন্ধকার অন্ধকার হলেও, তিন তিনটে বেডরুম, তাতে সুবিধেই হয়েছে। কিঞ্জলের ক্লাস নাইন অব্দি সে তাঁর সঙ্গেই শুত, আরেকটা ঘরে ভবানী। তৃতীয় ঘর ফাঁকাই থাকত, গেস্টরুম হিসেবে। যদিও পিসিমা ছাড়া কখনো কেউ আসেনি রাত কাটাবার মতো। সেই তৃতীয় ঘরটি ব্যবহার হত কোন রাতে, ভবানী যদি তাঁকে ডাকতেন। যদিও সে ক্বচিৎ কখনো। ভবানী বলতেন তাঁর কাম ইচ্ছা নাকি মা কালী নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছেন। সেটা ভবানীর বেলায় সত্যি হতে পারে, কিন্তু মোহর? তিনি তো রক্তমাংসের মানুষ। তাঁর শরীর মন কিছুই তিনি কোন দেব দেবীর কাছে জমা রাখেননি। খুব কষ্ট হত সে সময়। কিন্তু মার কথা মনে জেগে থাকত। অত রূপ, অত গুণ নিয়েও তো মা বাবার সঙ্গে শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন কাটিয়ে গেলেন।অন্য কারো দিকে চাননি। মার অনুরাগীর তো অভাব ছিল না।সেই মায়ের মেয়ে হয়ে ছিলেন মোহর অনেক দিন পর্যন্ত। পরিশ্রমও খুব ছিল সেসময়। মফস্বলের কলেজ, যাতায়াতেই অনেকটা কেটে যেত, তারপর মেয়ে ছোট ছিল, তিনি চাইতেন যতটা সম্ভব ওকে সময় দিতে। যেখানে যেখানে সম্ভব, মেয়েকে নিয়েই যেতেন মোহর, তাঁর মা যেমন তাঁকে নিয়ে যেতেন গানের ফাংশনে। তারপর সৈকত সেনগুপ্তের সঙ্গে আলাপ হল।ভবানীর সঙ্গে যেমন অনেক বছর আগে ট্রেনে আলাপ, সৈকতের সঙ্গেও আলাপ হল ট্রেনে। দুটো মোক্ষম আলাপই ট্রেনে আর দুটোই তাঁর জীবনের বড় বাঁক বদলের সাক্ষী। ভবানী যেমন বলেছিল ‘আপনার জীবনে খুব বড় সুযোগ আসছে, শুধু চিনে নেবার অপেক্ষা’, প্রাথমিক আলাপের পর সৈকত বলেছিল ‘আপনি সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, অপরচুনিটি ইজ নকিং এট ইয়োর ডোর। গো, ওপেন দা ডোর’
বিশ্বায়ন মানে যে দরজা খুলে দেওয়া তা তো নব্বই দশকের শুরুতেই জানা হয়ে গেছিল তাঁর। সময় একটা বহমান নদীর মতো, তুমি এখানে নিজেকে ভাসিয়ে দাও, ছুতমার্গের দিন শেষ। পৃথিবী এখন একটা বিরাট বাজার। টাকা থাকলে পাবে, নইলে তুমি ফোটো। আর এমনি এমনি কিছু পাওয়া যায় না।দাম চুকতে হয়।
মোহর সরল হাসি হেসে বলেছিলেন ‘কোথায় অপরচুনিটি? সেই তো মফস্বলের কলেজে ঘষে যাচ্ছি। পলিটিকালি কানেক্টেড না হলে এখন কিছু হয় না’
সৈকত ওঁর হাতের পাতায় নিজের ভিজিটিং কার্ড রেখে বলেছিলেন ‘এসব কথা এভাবে হয় না, সামনের সপ্তায় শনি রবি কী করছেন? দীঘাতে আমার একটা জায়গা আছে। কলকাতায় এত ব্যস্ততা, দু মিনিট বসার সময় নেই।ওখানে আমি চিল আউট করি আর এইরকম স্পেশাল দু চারটে কেস নিয়ে আলোচনা করি। ওখানে আসুন, কলকাতায় বদলি শুধু নয়, একদম প্রাইম কলেজে করিয়ে দেব’
মোহর বিস্ময়ে চেয়েছিলেন সৈকতের দিকে। তখনো অব্দি ভবানী ছাড়া দ্বিতীয় কেউ তাঁর জীবনে আসেনি। ভবানী তাঁকে সম্পূর্ণটা অধিকার করে রেখেছিলেন। শিক্ষা নয়, রূপ নয় শুধু ভাগ্যের নিয়ন্তা হিসেবে তিনি সম্মোহিত করে রেখেছিলেন মোহরকে। এখনো রেখেছেন অবশ্য। কিন্তু তা সেই চাঁদের মায়ার মতো, চাঁদটা নেই।
সৈকত পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক। ক্ষমতার অলিন্দে তার নিত্য যাতায়াত। সৈকতকে যে সেভাবে কোনদিন ভালো লাগত, তা নয়। কিন্তু ওকে কাজে লাগতে পারে সেটা বুঝে গেছিলেন তিনি। চোখের সামনে দেখেছিলেন সৈকত কতজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকাচ্ছে, কত জনের ট্রান্সফার করিয়ে দিচ্ছে। সৈকত বলেছিল বন্ধুদের জন্যে আমি এইটুকু করেই থাকি। এর মধ্যে কোন টাকার লেনদেন নেই। শুধু বন্ধু হতে হবে। সৈকত তো বন্ধু নন, পরিচিত, অ্যাকোয়েন্টেন্স। বন্ধু হওয়া ব্যাপারটা তখনো বোঝেননি মোহর। পরে বুঝলেন বন্ধুদের নিয়ে দীঘায় যায় সৈকত। মন্দারমণি তখনো গড়ে ওঠেনি। মোহরকেও যেতে হল দীঘায়। অনেকদিন পর শরীরের স্বাদ পেলেন তিনি, যদিও সে স্বাদ ভালো লাগেনি তাঁর। কেমন জন্তুর মতো আচরণ সৈকতের। উপরন্তু সে তাঁকে তার অন্তর্বাস কেচে দিতে বলেছিল। বাড়িতে বৌ যদি শুঁকে অন্য নারীর গন্ধ টের পায়!
তাই বহু বছর পরে অন্য শরীরের স্বাদ পেলেও সে স্বাদ রুচিকর মনে হয়নি তাঁর, মনে হয়নি এ এমন কিছু যা তিনি বারবার পেতে চাইবেন, মনে হয়েছিল যে শরীরের তীব্র ইচ্ছেয় তিনি রাতের পর রাত ছটফট করেছেন, সে যদি এই হয়, তবে তা তাঁর দরকার নেই। ইটস নট ওয়ার্থ ইট।সুখের কথা, সৈকত শুধু তাঁর কাছে ট্রান্সফারের দাম আদায় করতেই চেয়েছিল, সে দাম পেয়ে যাবার পর আর সে তাঁর শরীর যাচনা করেনি। পরে দেখা হলেও পরস্পর নিছক সৌজন্য করেছেন, যদিও সৈকতকে দেখলে ভীষণ খারাপ এক স্মৃতিই জেগে উঠত মোহরমালার মনে।
তবে সৈকত একটা উপকার করেছিল তাঁর। নিজের শরীরের যে একটা উপযোগিতা আছে, সেটাকে ব্যবহার করে যে অনেক কিছু পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারটা সৈকতের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। এটা অনেকটা ঘুষ দেবার বা নেবার মতো ব্যাপার। খুব কৌতূহল ছিল মোহরের, মানুষ কীভাবে ঘুষ চায়, কীভাবেই বা মানুষ ঘুষ দেবার কথা পাড়ে। এ যেন সেই কে প্রথম কাছে এসেছে-র মতো প্রশ্ন। শুরুটা কীভাবে হয়, এ নিয়ে কৌতূহল ছিল শরীর বিনিময়ের ক্ষেত্রেও, কীভাবে একজন শিক্ষিত অধ্যাপক মানুষ, সব বিষয়ে যার সফিস্টিকেশন, তিনি জানান যে আপনার শরীর আমার চাই, পেলেই তবে এই কাজটা করে দেব। কীভাবে এই কথা বলতে পারে মানুষ? সরকারি দপ্তরে একটা ফাইল পড়ে থাকে বছরের পর বছর, হয়তো এক টেবিল থেকে পাশের টেবিলে যাবে, কিন্তু যায় না, কারো প্রয়োজনে হাঁটাহাঁটি করলে, তদবির করলে সে শোনে এই কাজের জন্যে আমরা চায়ে পানির খরচা পেয়ে থাকি। চায়েপানি, নাস্তাপানি, কাট মানি গোলাপকে যে নামেই ডাকো, সে গোলাপই। কিন্ত একজন চতুর্থ বা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা যেভাবে কথাটা পাড়তে পারে, একজন উঁচু তলার লোক কীভাবে শুরু করে সে কথা? এই কৌতূহলের নিরসন হল সৈকতকে দেখে। আসলে এই লেভেলে এসব কথা কখনো পাড়াই হয় না। পোড় খাওয়া চোখ, দেখেই বুঝে যায় কে দেবে বলে বসে আছে, আর কে নেবে বলে বসে আছে।পরস্পরের মুখেই পড়া যায় এসব। কিন্তু যে একেবারেই আনাড়ি, তাকে নিয়েই হয় মুশকিল। খেলার নিয়ম সে জানে না, আর জানে না বলেই ভাবে যোগ্যতা থাকলে আবার টাকা বা শরীর দেব কেন? মূর্খের স্বর্গে বাস করে আসলে। যোগ্যতা তো এরকম লাখ লাখ লোকের আছে। সবাই কি মগডালে ঝুলে থাকা আমটি পেড়ে খেতে পাচ্ছে? সেইটি খাবার জন্যে তো এত ছোটাছুটি, এত ল্যাং মারামারি, এত লড়াই। মন্দিরে পুজো দিলেও তো দক্ষিণা ধরে দিতে হয়। এ তো খেলারই দস্তুর।মোহর কত ছেলেমেয়েকে জানেন যারা খেলার এই নিয়ম জানে না বা জেনেও শিখতে চায়নি, কিংবা শিখতে পারেনি বলেই সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকেই ছিটকে গেছে।কেউ অন্য লাইনে চলে গেছে, কেউ হাউস ওয়াইফ, কেউ বা স্রেফ মেন্টাল।একটা ভুলে যাওয়া গানের মতো, যেন মা ঘুম পাড়াতে পাড়াতে গাইত এমন গান, কার যেন মুখ মনে পড়ে মোহরের। ঠিক মুখ নয়, কোন ভাসা ভাসা কথা, গভীর জলের তলা থেকে একবার উঁকি মেরেই আবার জলের নিচে চলে যায়। অজিত সিং হাসতে হাসতে বলেছিল কি? কোন এক স্যারের বউর কথা কি? কোন স্যার? কোন ডিপ? অজিত বলেছিল, এই নোকরি নোকরি করা বাঙ্গালির একটা রোগ। বিশেষ করে একটু পড়ালিখা শিখল তো ভেবে নিল প্রফেসারি বাঁধা আছে। আরে অত সোজা নাকি? আমার কাছে বলতে এসেছে মিনমিন করে। এই প্রথম দেখলাম কেউ বউর নোকরি নিয়ে বলতে এল। তাও ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নাচবে বাঙালি। বলে কিনা, আমার এক রিলেটিভ, খুব ব্রাইট রেজাল্ট, কিছু হবে সিংজী?
কিছু হবে সিংজী! যেন বেসনের লাড্ডু! আরে উল্লুক, সব কিছুর একটা কিমত চুকাতে হয়।তুমি মাসে মাসে লাখ করোড় কামাবে, অত সফি সফি কাজ করে, আর আমরা তোমার রাজ্যপাট বাড়ার জন্য মাঠে ময়দানে লড়াই করব, খুন খারাবি যত খারাপ কাজ করব, আর তুমি ছাত্রদের সঙ্গে বসে বসে মিস্টি মিস্টি কথা বলবে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে স্যার স্যার ম্যাডাম ম্যাডাম শুনবে, তোমার পায়ে ছাত্র ছাত্রীরা লুড়িয়ে পড়বে, টিভি চ্যানেল তোমাকে ডাকবে, খবরের কাগজ তোমাকে দিয়ে লেখাবে, আর এসবের পেছনে কে? এই শর্মা, অজিত সিং, সিং ইজ কিং। অথচ রাজার সব কিছু থেকেও সে রাজা হতে পারবে না। কারণ তোমরা পড়ালিখা শিখেছ, তার চেয়েও বড় কথা তোমরা পড়ালিখা ঘরে জন্মেছ, তোমাদের মুখে চান্দির চামচ জন্ম থেকেই গোঁজা। আর আমি শালা একটা কীড়ে মকিড়ে, বাপ জেল খেটে খেটে মরল, মা তো, আর বউটাও… তর সইল না কারো। সবাই অজিতকে ছেড়ে চলে যাবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। এখন সে একা লড়ে যাচ্ছে, ময়দান ছাড়ে নি। কিন্তু তাতে কি? সবাই ভয় করে, সমীহ করে কথা বলে, কিন্তু আড়ালে তো গাল দেয়, বলে শালা বিহারীর বাচ্চা, এসে বঙ্গালে আতঙ্ক ফয়লে রেখেছে। আসলি রাজা সে, কিন্তু সেই সম্মান দিতে জানে নাকি এরা? সারাজীবন এরাই মাথায় থেকে যাবে। তার জন্যে কিছু খসাতে তো হবে। মুফত কিছুই পাওয়া যায় না।শালা বলে কিনা রিলেটিভ! আসলে বৌ, বিবি বিবি, জানি না নাকি আমরা? চাকরি পায়নি বলে পাগল হয়ে গেছে, হা হা।তা বৌ চাকরি পেলে তো টাকাটা ঘরেই গেল। ডাবল ইঞ্জিন। গাড়ি ডাবল জোরে ছুটবে। অত টাকা খাবে কে, কে জানে। বাচ্চাকাচ্চা তো হবার সিন নেই। চাকরি হবে না শুনে বাথরুমে পড়ে … অজিতের খোপরিতে ঢোকে না। মেয়েমানুষের কাছে চাকরি এত কিমতি? বাচ্চা সংসার এসবের থেকেও? যে না পেলে বাওরা হয়ে যেতে হবে। তাজ্জব কি বাত!আগের আমলে বলে দিয়েছিল এক পরিবার থেকে দুজনের চাকরি হবে না, হ্যাভ নটসদের তুলে আনতে হবে। যাদের নেই তাদের দিতে হবে। তেলা মাথায় তেল দিয়ে কী লাভ? স্বামীর চাকরি আছে, বৌ ঘর সংসার সামলাক।বাচ্চাকাচ্চা বড় করুক। দুজনের চাকরি কভি নেহি, তাও আবার এক ডিপার্ট্মেন্টে। যদিও যারা বলছে, তাদের প্রত্যেকের বৌকে এই বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য জায়গায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এর উত্তরও ছিল তৈরি। ওরা তো ফিটেস্ট ক্যান্ডিডেট। এ বেশ একটা ঘরে ঘরে সরকার রচনার প্রকল্প। ওরাই প্রার্থী ঠিক করবে, সেই মতো যোগ্যতার ফিরিস্তি লিখবে বিজ্ঞাপনে, ওরাই এক্সপার্ট ঠিক করবে, ওরাই ইন্টারভিউ নেবে, ওরাই প্যানেল তৈরি করবে।
তার থেকে তো এখন ভালো, টাকাই শেষ কথা বলবে। যন্তরটা মসৃণ ভাবে চালানর জন্যে অনেক টাকা লাগবে। সেই টাকা এইভাবে তুলতে হয়। অজিতের কাছে এইভাবে কাজ করাটা বেশ আরামের। কার কটা কাগজ আছে, এসব চুলচেরা হিসেবে তার ছেঁড়া যায়। আসল কথা কত টাকা আছে। তবে একটা জিনিস অজিত দেখেছে। এ আমল, ও আমল বলে আসলে কিছুই নেই। একটাই লোক, যখন সামনে করে দাঁড়িয়ে আছে, এক দলের জার্সি, পেছন ফিরলেই অন্য দলের জার্সি, চেহারা ছবি সব আলাদা। ছোট বেলায় তাদের গাঁয়ে নবরঙ্গের তামাশা হত। একটাই লোক সামনে থেকে ছেলে, পেছন থেকে মেয়ে। এও সেরকম।
যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে, এমনভাবে হাসতে থাকে অজিত। এমনিতে অজিত হাসে কম, যখন হাসে মনে হয়, ওর সব হাসির বাঁধ ভেঙে গেছে, হিস্টিরিয়ার রুগীর মতো হাসতে থাকে। ভয় লাগে মোহরের। মনে হয় অজিত নিজেই কি একটা মেন্টাল কেস নয়? যেমন অজিত, তেমনি ভবানী। এই যে ভবানী কোনদিন স্বাভাবিক একটা দাম্পত্য যাপন করল না, শুধু দাম্পত্য কেন? ওর মধ্যে বাৎসল্যের কোন ছিটেফোটা নেই, কিঞ্জলকে কেন কোনদিন ভালবাসতে পারেনি, কিঞ্জলও বাবাকে দেখলে সিঁটিয়ে থাকে। অথচ ভবানী আর অজিত এদের দুজনকেই দরকার তাঁর।একজন ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে যাবে মসৃণ ভাবে, আরেকজন ক্ষমতার অলিন্দে তাঁর উত্থান আরও নিশ্চিত করবে।
কিন্তু শব্দটা কীসের। মহালয়ার মতো মনে হচ্ছে, কিন্তু তা নয়। একটা মন্ত্রের সুরে কে যেন বলছে ‘মোহর তুমি যে ঘরে থাকো সেটা ভেঙে পড়বে এখুনি। ওঠো। পালাও’