অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br />  নবম পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
নবম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের নবম পর্ব।

আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন — (১), (২), (৩), (৪), (৫), (৬), (৭),

(৮)

কেয়ার অব বকুলতলা। এটাই ছিল দীর্ঘদিন মনোজিত কুমার মালের ঠিকানা। ডিনের সঙ্গে দেখা করতে হবে? ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না? বিদেশে না গেলে এই জায়গায় তাঁকে সন্ধে সাতটার পর ঠিকই পাওয়া যাবে। এই বকুলগাছটি অনেক প্রেম, ষড়যন্ত্র ও গোপন আঁতাতের সাক্ষী, তাই কি মনোজিত এই জায়গাটা বেছে নিয়েছেন?

অবশ্য প্রেম তাঁর জীবনে কোথায় যে আপাত ভাবে বোঝা যায় না।তাঁর সাদা চুল দেখলে মহান কোন সন্তের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক, কোন কোন ছাত্র প্রথম দেখার অভিঘাতে তাঁকে আইনস্টাইনও বলেছে এমন শোনা গেছে। তবে তাঁর জীবনে প্রেমের অভাব যদি বা থাকে, তাঁর স্ত্রীর জীবনে কিন্তু আদৌ নয়। বরং সেখানে সবসময় বাতাসে বহিছে প্রেম, বসন্ত এসে গেছে টিং টিটিং টিং।নিরন্তর শিক্ষা সেলের চাকরিটি নাকি ওঁকে ফোন করে বাড়ি থেকে ডেকে দেওয়া হয়েছিল। সেই সেলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক স্প্যানিশ ভাষা বিশারদ অমিত ব্যানার্জি আর শ্রীমতী মালের কেস যে পুরো মাকখন তা সাদা চোখেই বিভাগীয় কর্মীরা দেখেছে। বাইরে, বিদেশে বা স্বদেশে ট্যুরে গেলে একটাই নাকি ঘর বুক হত দুজনের জন্য। মনোজিত মাল সেসবে বিশেষ গুরুত্ব দেননি, তাঁর ডিন হবার পেছনে কিং মেকার অমিত ব্যানার্জিই, এ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছেরাও জানে। আলিমুদ্দিনের বরাবরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অমিত ব্যানার্জি, বাম আমলে অনেক অধ্যাপকেরাই তাঁর আশীর্বাদধন্য/ধন্যা হয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন।। কিন্তু ধীরে ধীরে অমিত ব্যানার্জি বা এবি ফেড আউট হয়ে গেলেন। শ্রীমতী মাল পুরো ডিপার্টমেন্ট এমনকি ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারদের পর্যন্ত নিজের দিকে টেনে নিলেন, অমিত ব্যানার্জি আস্তে আস্তে একদম কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। একটা পিয়নকে দিয়ে এক কাপ চা আনাবার ক্ষমতাও রইল না তাঁর। আগে চা তো শ্রীমতীর ঘরেই জুটত। ফ্লাস্ক ভরতি চা, রকমারি কুকিজ, টিফিনে চাইনিজ কিংবা স্যান্ডউইচ, সুপ বা রুটি-চিকেন- সবই ব্যবস্থা করে ফেলতেন ছন্দা মাল।তাঁকে অমিতের ঠোঁটে ওষুধ লাগিয়ে দিতেও দেখেছে সবাই। তাঁর একটুকরো হাসি পেলে বিভাগের কর্মী এবং ছাত্রেরা ধন্য হয়ে যেত। লোককে সম্মোহনের একটা সহজাত ক্ষমতা আছে তাঁর, এটা মানতেই হবে। ছাত্রদের তিনি কথায় কথায় বুকে জড়িয়ে ধরেন। এরকম বিলিতি স্টাইলের হাগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে কখনো পায়নি কেউ। ছাত্রকুল মোহিত, শিহরিত। পুরো মাকখন কেস থাকার সময় অমিত ব্যানার্জি সবাইকে ডেকে ডেকে বলেছেন, ‘দেখো, দেখে শেখো ম্যাডামকে, মাল্টিটাস্কিং করেন কীরকম। আর কখনো রাগেন না, মুখে সবসময় হাসি।’ সেই হাসি অমিত ব্যানার্জির জীবনে আর ফিরে এল না। কেউ জানল না, কোথায় সমস্যা হল, কিন্তু এবি আর নিরন্তর সেলে টিকতে পারলেন না। তিনি বিদেশেই পড়ে থাকতে লাগলেন। ডেনমার্কে তাঁর একটা ঘাঁটি করা ছিল ভাগ্যিস। গ্রুন্ডভিগের ওপর কাজকর্ম করার ডিভিডেন্ড আর কী। তারপর তো ভি আর এসই নিয়ে নিলেন একসময়।না নিয়ে উপায়ই আর কী। রাজ্যে তো পালাবদল হয়ে গেছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে সরে কালীঘাট চলে গেছে।লাল রক্ত সবুজ হয়ে গেছে, সরকারি বাড়িগুলো সব নীল সাদা, এমনকি কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের থাকার বাড়িও নীল সাদা রঙ করিয়েছেন। রঙবদল হয়েছে নিরন্তর শিক্ষা সেলের হৃদয়পুরেও। ছন্দা মালের প্রেমের অক্ষাংশ দ্রাঘিমা ততদিনে এক জুনিয়র লেকচারার খুঁজে নিয়েছে।
রাজনীতি আর প্রেম দুদিকেই ধাক্কা খেয়ে অমিত এখন স্প্যানিশ নিয়ে পড়েছেন। মাথার মধ্যে দুটি ভাষার চিন্তাবিশ্ব থাকলে অন্য সব দূরে সরে যায়।
ছন্দা মালের প্রেমভাগ্য মনোজিতের নেই বটে, কিন্তু তাঁকে ঘিরে আবার এক অন্যরকম বৌদ্ধিক স্তরের মুগ্ধতা।ছাত্র থেকে সহকর্মী, প্রশাসন থেকে পার্টিলাইন। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সে মুগ্ধতার শুরু। ছাত্রাবস্থা জীবনের বাল্যকাল ছাড়া কিছু নয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মাস্টার্স লেভেলেরই হোক, তার বাল্যাবস্থা ঘুচতে চায় না। সে যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধতায় টাল খায় পি এইচ ডি করতে গিয়ে। জীবনে পি এইচ ডি না করা মানুষটি সবার পি এইচ ডির কাণ্ডারী।কোন প্রজেক্ট থেকে কোন ফান্ড আনতে হয়, থালার জল কীভাবে মালায় আর মালার জল কীভাবে থালায় ঢালতে হয়, তা তাঁর মতো কেউ জানে না।কে যেন একজন বলেছিল বিয়ে টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রেম লাগে না, লাগে বাস্তববোধ। তেমনি পি এইচ ডি করতে জ্ঞান লাগে না, লাগে ঠিকঠাক লোক ধরার কৌশল।যাকে বলে বাবু ধরা। সাদা চুলওলা লোকটিকে দেখে বোঝা যায় না, ইনি একজন উচ্চমার্গের বাবু। তাঁকে ধরলে খাওয়া পরার চিন্তা চলে যাবে। কিন্তু ধরা তো অত সহজ নয়। ওই যে বকুলতলায় পৌঁছতে হবে। বকুলতলায় পৌঁছনোর মধ্যে এত জটিলতা কীসের? বিদিশা ভেবেছিল। ওর পেছনের ক্যান্টিনে তো মাঝে মাঝে খেয়েছে বি ই পড়ার সময়। সেখানকার ঘুগনির মধ্যে বড় বড় সোয়াবিনের স্বাদ মনে আছে এখনো। স্বাদ না বলে বিস্বাদ বলা ভালো। এই বকুলতলায় দাঁড়িয়ে একদিন মনোজিত তাঁর সদা এলোমেলো সাদা চুল ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন – পি এইচ ডি মানে বুঝলি, কয়েকটা খোপ, তোকে কিছু ডেটা দিয়ে সেই খোপ গুলো ভরতে হবে।
বিদিশা শুনে চমকে গেছিল। গবেষণা মানে শুধু তাহলে খোপে কিছু ডেটা ভরে দেওয়া? কোন উদ্ভাবন নয়, কোন যুগান্তকারী চিন্তার উদ্দীপন নয়, শুধু খোপ ভরে যাওয়া? সে তো অনেক আশা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির চাকরি ছেড়ে এসেছিল গবেষণা করবে, সবাই হাঁ হাঁ করে উঠেছিল ‘চাকরি ছাড়ছ কেন? কেরিয়ারে ব্রেক হয়ে যাবে’ বিদিশা শোনেনি। সে তো ভেবেছিল তার এত ব্রাইট রেজাল্ট, অ্যাকাডেমিক্সে যাবার ইচ্ছে বরাবর, সে গেলেই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে লাল কার্পেট পেতে লেকচারারশিপ দিয়ে দেবে। সে প্রথমে দেখা করেছিল ডিপার্টমেন্টে গিয়ে। চাকরি ছাড়ছে জানাতে নয়, একেবারে চাকরি ছেড়ে গিয়েছিল। তাদের হেড ডিপ, আড়ালে সবাই যাকে গাপ্পু বলত, যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গিয়ে কেবলই সাহিত্যের জগতের ইনসাইড স্টোরি শোনাতেন, যেহেতু তাঁর শ্যালিকা এক বিখ্যাত লেখিকা, তিনি ওর কথা শুনে স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন।
-চাকরি ছাড়লে? সেকি! কেন?
তারপর তিনি এর সঙ্গে যোগ করেছিলেন
– এইজন্যেই মেয়েদের চাকরি দিতে নেই, তাদের চাকরিটা হচ্ছে শখের চাকরি।
তিনি এরপর অনেক আদর্শের গল্প শুনিয়েছিলেন, তাঁরা কত কষ্ট করে বারোশ টাকার মাইনেতে ঘষেছিলেন, কত বছর ধরে, লয়ালিটি বলেও তো একটা বস্তু আছে।এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ঢুকলেন কত পরে।
গাপ্পু যখন কথা বলেন একটা ঘোর লেগে যায়, সেটা ছিঁড়ে বেরনো যায় না। বিদিশা খেয়াল করে দেখেছে তার জীবনে সে যাদের কাছে বেশি প্রতারিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই অসাধারণ কথা বলেন। যেমন তাদের ফরোয়ার্ড প্রেসের তপেন গাঙ্গুলি। একই কথা বলে যান, অথচ বারবার সেই এক কথাই হাঁ করে গেলে বিদিশা।
ইন্টারভিউ বোর্ডে তপেন গাঙ্গুলির কথায় এত মুগ্ধ হয়েছিল যে ভাল ভাল চাকরি ছেড়ে সে ফরোয়ার্ড প্রিন্টিং প্রেসে জয়েন করল।অবশ্য মুগ্ধ সে একা হয়নি, টেবিলের উল্টোদিকের লোকজনও মোহিত হয়ে গেছিল ইন্টারভিউতে তার উত্তর শুনে। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মেয়ে হিসেবে শপ ফ্লোরে অসুবিধে হবে না তার? সে বলেছিল, একজন ইঞ্জিনিয়ারের কাজ মেশিনের ডিজাইন বোঝা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া। অটোমেটেড মেশিনের কন্ট্রোল বোর্ড জানা দরকার তার। কায়িক শ্রমের জন্য লেবারার আছে। তাই শপ ফ্লোরে একজন ছেলের কাজ করতে অসুবিধে না হলে, তারও হবে না। সেই উত্তরে একদম বোল্ড আউট হয়ে গেছিল বাঘা বাঘা প্রশ্নকর্তারা।আর এরপর তপেন গাঙ্গুলি তার মাথায় ঐ কয়েক মিনিটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে এখানে সে মাইনে কম পাবে বটে, কিন্তু এত ভালো শেখার সুযোগ আর কোথাও পাবে না।তিনি ওর সামনে ফেলে দিয়েছিলেন ফরোয়ার্ডের মডার্নাইজেশন প্ল্যান। শতবর্ষের দিকে হাঁটা এই প্রেসটি খোলা হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন কাগজপত্র ছাপার জন্য। অত্যন্ত গৌরবময় ইতিহাস এর। এর পরের ধাপে শৈলেশ্বর গুহ একে ভারতের এক নম্বর প্রেসে পরিণত করেন। মুদ্রণ উৎকর্ষের জন্য কতবার জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে, সিঁড়িতে উঠতে উঠতে সেইসব ছবি তো দেখেছে বিদিশা। শৈলেশ্বর বাবু মুদ্রণের উৎকর্ষ বুঝতেন। কিন্তু তাঁর একটা দুর্বলতা ছিল, নির্বিচারে লোককে চাকরিতে ঢুকিয়েছেন।সিঁথি, বরানগর, কামারহাটি এলাকার লোক ঝেঁটিয়ে ঢুকেছিল সামান্য তদবির করে। যার জন্যে অতিরিক্ত অদক্ষ কর্মীতে সংস্থাটি ধুঁকতে শুরু করল। তার ওপর নতুন প্রযুক্তির প্রতি অনীহা, আর এর সঙ্গে যোগ হল রাজনীতির হস্তক্ষেপ। কংগ্রেসী জমানার শেষে বাম জমানা শুরু। মাঝে নকশাল আন্দোলনের সময় এই বরানগর, কামারহাটি অঞ্চল এক মৃত্যু উপত্যকা। বাম আমলে ট্রেড ইউনিয়নের দাপট তুঙ্গে উঠল।শৈলেশ্বর পদে পদে বাধা অসম্মান পেতে লাগলেন। একদিন অফিসেই হার্ট অ্যাটাক হল তাঁর। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে চলে গেলেন। ততদিনে তাঁর স্বপ্নের ফরোয়ার্ড রুগ্ন সংস্থা। অলাভজনক এই সংস্থাকে সরকার অধিগ্রহণ করল। অবসরপ্রাপ্ত আই এ এস দের সময় কাটানোর জায়গা হল এটা। সমস্যা হল প্রাইভেট মালিকের অধীনে কাজ করা কর্মীদের অভিমানের মূল্য তাঁরা দিলেন না। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গল্প ছিল। সেসব কে শুনবে? পদে পদে সংঘাত বাধল তাই।আর সেই সন্ধিক্ষণে বিদিশা ঢুকল সেখানে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হয়ে।

( ক্রমশ)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes