অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br /> দ্বাবিংশতি পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
দ্বাবিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের দ্বাবিংশতি পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।

২২

লোকটা পেছন দিকে বসে ছিল। বাদামী আর হালকা সবুজ চেক চেক শার্ট আর বাদামী ট্রাউজার্স, মাথায় টুপি। টুপির ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। এখন শীতকাল নয় যে টুপি পরবে, অনেকে অবশ্য টাক মাথা ঢাকার জন্যে টুপি পরে। প্রথম থেকেই ওকে লক্ষ্য করেছেন ভবানী। এমনি এমনি তো আর তাঁর পসার হয়নি। কারা তাঁর কাছে আসছে, তা খেয়াল করতে হয় বৈকি। এমনও হয়েছে, যে খুন হবে আর যে খুন করবে তারা দুজনেই জন্মতারিখ, জন্মক্ষণ নিয়ে বসে আছে পাশাপাশি। দুজনের ছকই তিনি একইরকম মন দিয়ে করেন। তবে একেবারে প্রাইভেট চেম্বারে যারা আসে, তাদের একটু বেশি মনোযোগ দিতে হয়।
আজ অবশ্য শনিবারের সাজারে বাজার। সবার অবারিত দ্বার। তার ওপর অমাবস্যা। এমনিতেই মন্দিরে চাপ বেশি। সন্ধের পুজো সেরে একটু বৈকালী প্রসাদ মুখে দিয়েছেন কি দেননি, কাস্টমার আসতে শুরু করে। হ্যাঁ তিনি কাস্টমারই বলেন, ভক্ত নয়।
এই টুপি পরা লোকটা বসে থেকে থেকে বারবার মোবাইল দেখছে, একবার বাইরে গিয়ে ফোন করে এল। এরকম কোন নিয়ম নেই যে তাঁর এখানে কেউ এসে ফোন করতে পারবে না। মানে এরকম কোন লিখিত নিয়ম নেই। অলিখিত আছে, সেটা সবাই জানে। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান গণনা অত সোজা ব্যাপার নয়। ধ্যানে আনতে হয়। সামান্য শব্দে মনোযোগের ব্যাঘাত হয়। জন্মমুহূর্তের পল অনুপলে ভগ্নাংশ হেরফের হয়ে গেলে সর্বনাশ। সাধুর ছক শয়তানের হয়ে যাবে, কুলটার ছক হয়ে যাবে পতিব্রতার। যে মানুষজন এখানে আসে নিজের বা পরিবারের লোকের কুষ্ঠী বানাবার জন্যে, তারা যে তাঁর কথা বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করে। তারা মনেপ্রাণে জানে ভবানী শাস্ত্রীর গণনা অভ্রান্ত, তিনি কোন ভুল করতে পারেন না, ফলে কেউ যদি জেনে যায় তার সন্তান, জাতক বা জাতিকার ছকে লেখা আছে সে খুনী হবে কিংবা কুলটা বা লম্পট হবে, নিজের সন্তানের সঙ্গে তার ব্যবহারটাই বদলে যায়। তারা সন্তানের ওপর নানান বিধিনিষেধ আরোপ করে তার জীবনটাই বিষময় করে তোলে, যার ফল হয় ভয়ঙ্কর। যার খুব ভালো সুস্থ একটা জীবন পাবার কথা ছিল, বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে সে একটু নিঃশ্বাস নেবার জন্যে খারাপ সঙ্গের দিকে ঝোঁকে। ফলে সাধু আপসেই হয়ে ওঠে শয়তান। তখন অবশ্য ভবানীরই পসার বাড়ে। খারাপ পথ থেকে ভালো রাস্তায় ফিরিয়ে আনার জন্যে গ্রহশান্তি করতে তাঁরই শরণাপন্ন হয় মানুষ, সঠিক গ্রহরত্ন বাতলে দিতে হয় তাঁকে, তবে অন্য জ্যোতিষীদের মতো পাথরের ব্যবসা ফেঁদে বসেননি তিনি, ওসব যারা করে তাদের তিনি ঘৃণাই করেন। ঠিকুজি করা গবেষণার থেকে কম পরিশ্রমের নয়, তার সঙ্গে পাথরের ব্যবসা জুড়লে তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে, তাঁকে তার জন্যে আলাদা ঘর নিতে হবে, কর্মচারী রাখতে হবে। এখন সবটাই এই মন্দিরের ওপর দিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাঁর আলাদা ইনভেস্টমেন্ট নেই যেমন, তেমনি মাথাব্যথাও নেই। এখানকার লোকই ঘর পরিষ্কার রাখে, জল টল সব সাজিয়ে রেখে দ্যায়। তাছাড়া তিনি এইভাবে মানুষকে বিপদে ফেলে রোজগার করতে চান না।তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার মানুষ। আর তাই পেশার নীতি মেনে কাজ করেন। তাঁর কাছে ক্লায়েন্ট হচ্ছে ঈশ্বর, তাকে সর্বতোভাবে সেবা করতে চান তিনি। আর এই কারণেই কলকাতা শহরের সবচেয় সট আফটার এবং হায়েস্ট পেড জ্যোতিষী তিনি। শুধু কি কলকাতা? মাঝেমাঝেই দিল্লি, বম্বে থেকে, এমনকি দুবাই থেকেও ফোন আসে তাঁর। যেসব ঘর থেকে ফোন আসে, শুনলে সবার পিলে চমকে উঠবে।ভাবতে দুঃখই হয়, অত বড় বড় ঘরে এত অন্ধকার। বাবা পৃথিবীবিখ্যাত অভিনেতা, অথচ ছেলে রূপ গুণ সব থেকেও কোন সুবিধে করতে পারছে না। কী নেই ছেলের। বলতে নেই, বাবার চেয়ে ঢের ঢের সুদর্শন, শক্তিশালী অভিনেতা, মেয়েছেলে কি মাদক চক্র এই দুই ম-সংযোগী কোন স্ক্যান্ডালের কথা শোনা যায় নি কখনো, তার এমন হবার তো কথা নয়। টাকার গদিতে শুয়ে থাকা সেলিব্রিটি বাবা মার চোখে ঘুম নেই। ভবানী শাস্ত্রীকে ফোনে যিনি একবার মুম্বাই যেতে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, একসময় তিনি ভবানী কেন, সব তরুণেরই হার্ট থ্রব ছিলেন।তিনি ফোন করছেন ভবানীকে! কাতর অনুরোধ করছেন একবার তাঁদের বাড়ি এসে ছেলের ছকটা করে যেতে! ভাবা যায়! সেই বিখ্যাত বাড়ি, যার ব্যালকনিতে এসে বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে রাস্তার সমাগত মানুষজনের ভিড়ের দিকে হাত নাড়েন সেই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা, যে বাড়ির লনের হোলি ভারতবিখ্যাত, সেই বাড়ির অন্দরে যাবেন তিনি! ভাবতেই রোমাঞ্চ জাগে। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে, অপর প্রান্ত থেকে সেই অসামান্যা কাতর গলায় বলেছিলেন ‘কী হল শাস্ত্রীজী? আসবেন না আপনি? আপনার নাম কত শুনেছি। আপনি এলে আমার ছেলেটাকে নিশ্চয় একটা মার্গ দেখাতে পারবেন। আমি জানি, একমাত্র আপনার হাতেই ওর তরক্কির চাবি আছে। অনলি ইউ ক্যান ডু দিস। আমি বলছি, আসবেন না আপনি? আমি, জানেন তো বাঙালি’
বাংলা উচ্চারণে একটা অবাঙ্গালি টান এসে গেছে, তবু তিনি বাঙালি। উচ্চারণের থেকেও চেহারায় কেমন একটা ছাপ পড়ে গেছে, অবাঙ্গালি অবাঙ্গালি ছাপ। পোশাক আশাক নির্বাচন বা জীবনচর্যায় কোথাও কি বাঙালি আছেন সেই নারী, একসময় যাঁর গালের টোলে আর ঠোঁট মুচড়নো হাসিতে কাত ছিল আপামর ভারত, যাঁর স্বাভাবিক অভিনয় হিন্দি সিনেমায় একটা ট্রেন্ড সেট করেছিল? তিনি কী করে এত বদলে গেলেন, তাঁর চেহারায় কেমন একটা কুচক্রী ভাব, এও কি গ্রহ নক্ষত্রের খেলা! যে গ্রহ নক্ষত্র মাকে এমন করে দিয়েছে, তারাই কি ছেলেকে ওপরে উঠতে দিচ্ছে না?জাতকের মাতৃস্থান কেমন তা দেখা দরকার। নাকি ঐ যে বিখ্যাত বাড়ি, তার মধ্যেই দোষ আছে কোন? বাস্তু মেনে হয়েছিল নিশ্চয়। তিনি দেখেছেন ছোটখাটো অকিঞ্চিৎকর মানুষ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা জানে তারা খাটলে পয়সা আসবে, শরীরটাই তাদের ভগবান। শরীরটাই তাদের ঠিকুজি কুলুজি,শরীরটাই তাদের বাস্তুশাস্ত্র। কিন্তু যাদের টাকার লেখাজোখা নেই, তারা জীবনকে আরও সুরক্ষিত করতে চায়। নিজেদের বাঁচাবার কোন রাস্তাই ছাড়ে না। তাই এই বাড়ি যে বাস্তু মেনেই হয়েছে তাতে কোন সন্দেহই নেই ভবানীর।এর পেছনেই কত টাকা ঢেলেছে কে জানে। কিন্তু তাঁদের লাইনটা জচ্চর জালিয়াতে ভরে গেছে, তাই সঠিক লোক করেছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যে করেছে সে হয়তো কিছুই জানে না। শুধু বাড়ি কেন, নিউমেরোলজিস্ট কনসাল্ট করে হয়তো নিজের নামের বানান অব্দি বদলে ফেলেছে। নিজেদের জন্যে এরা কী না করতে পারে!
আবার সেই নারী বলেন ‘চুপ কেন শাস্ত্রীজী? আসবেন তো আপনি? আমি প্লেন ফেয়ার দিয়ে আনব আনাকে। আমাদের গেস্ট হাউসে থাকবেন আপনি। বম্বে গোয়া ট্রিপ করিয়ে দেব’
তাঁকে হতাশ করে শাস্ত্রীজী বলে ওঠেন ‘আমি আমার আসন ছেড়ে কোথাও যাই না ম্যাডাম। এই আসনে না বসলে আমি গণনা করতে পারি না। আপনি ছেলেকে নিয়ে একবার আসুন। আমি যতটা পারি করব ওর জন্যে।’
তাঁর কথায় খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন মীরাজী, হ্যাঁ মীরা গাঙ্গুলীকে আজকাল সবাই মীরাজী বলে ডাকে, এটা শুনলে প্রতিবারই কানে খট করে লাগে ভবানীর। যেমন চোখে লাগে ওঁকে দেখলে, সেই স্নিগ্ধ সুন্দর সরল মুখটা কোথায়, তার জায়গায় এক কুটিল নারী, সিরিয়ালের কুচক্রী ছোটিবুয়া বা মেজখুড়ির রোলেই যাঁকে মানায়।ওপ্রান্তে ফোন রেখে মীরাজীও নিশ্চয় জানলা দিয়ে সবুজ লনের দিকে তাকিয়েছিলেন চুপচাপ।ভাবছিলেন তাঁর সোনালি দিন কি সত্যিই শেষ হয়ে গেছে? নইলে একসময় আসমুদ্র হিমাচল যাঁর এক ঝলক দেখার জন্যে পাগল ছিল, যিনি কিছু চাওয়ার আগেই হুকুম শোনার জন্যে ছুটে আসত তাবড় তাবড় লোক, তাঁর এত কাতর অনুরোধ ফিরিয়ে দিল কলকাতার একজন সামান্য জ্যোতিষী! তাঁর, তাঁদের নামের ওজন, গ্ল্যামার, তাঁর বাঙালি জন্ম-কিছুই কাজে লাগল না? আশ্চর্য! খুব পুরনো একটা কথা মনে পড়ে গেল অনেক দিন পর।
‘দেহ পট সনে নট সকলি হারায়’
এর সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু বছর আগের কলকাতার স্টুডিওপাড়ার স্মৃতি। এক বিশ্ববিখ্যাত পরিচালকের একটি সিনেমায় কিশোরী বোনের চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজর কাড়েন। তাঁর চেহারাটা এমনই যে অনেক দিন পর্যন্ত কিশোরীর রোলে মানিয়ে যেত। একটি সিনেমায় তো রীতিমতো স্কুল ইউনিফরম পরে স্কুল বালিকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মেগাহিট হয়েছিল সেই সিনেমা। সে অবশ্য পরের কথা। প্রথমে তো কলকাতার সিনেমা মহল, সেখানে অল্প কয়েকটিই সিনেমা করা, এক কমেডি অভিনেতা ছিলেন তাঁর মেন্টর। অভিনয় যেমন হাত ধরে শিখিয়েছিলেন, তেমনি এই জগতে কীভাবে চলতে হবে সেই অতি জরুরি পাঠও তাঁর কাছে পাওয়া। এই অন্ধকার শো বিজ জগতটার বাঁকে বাঁকে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয়, একবার যদি ভুল লোকের খপ্পরে পড়েছ, তো তোমার জায়গা আস্তাকুঁড়ে।
মীরা গাঙ্গুলী জিগ্যেস করেছিল ‘এমন কেন হয় বিজনদা?’
‘কারণ আমরা এমন একটা জিনিস নিয়ে কারবার করি, যা ভারি গোলমেলে। শরীর। অভিনেতার অ্যাসেট বল, অস্ত্র বল, সব হচ্ছে এই শরীর। মনে রাখবি দেহ পট সনে নট সকলই হারায়। এই শরীরটাকে মন্দিরের মতো মেজে ঘষে তৈরি রাখতে হয়। তিনি আসবেন, তাঁর সিংহাসন তৈরি রাখতে হবে। ওই যে গানটা আছে না রবি ঠাকুরের? ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে’ শরীরের ওপর অত্যাচার করলে, এর অযত্ন করলে ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাবে। মনে রাখবি, ক্যামেরা আর দর্শক, এদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে আছিস, দেখতে ভালো, অনেকেই আসবে, অনেকের সঙ্গে ইন্টিমেট সম্পর্ক হবে। কিন্তু মনে করবি গঙ্গা দিয়ে যেমন ফুল আর মড়া একসঙ্গে ভেসে যায়, ওসবও তেমনি, ওদের বেশি পাত্তা দিবি না। তোকে বয়ে যেতে হবে নদীর মতো। বয়ে চলাটাই জীবন। থামলেই মৃত্যু। তুই অভিনেত্রী। অভিনয় তোর কাজ। সেই কাজের জন্যেই তোর এই শরীর। বাকি সব কিছু ট্রান্সজ্যাকশনাল ম্যাটার। পাত্তা দিবি না।’
তাঁর সঙ্গে মীরার সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছিল। মনে আছে দুজনে মিলে তোপচাঁচি গেছিলেন, বাড়িতে বলেছিলেন আউটডোর শুটিং আছে। সেইসময় তোপচাঁচি কী অসম্ভব সুন্দর। নীলচে জলের লেক, চারদিকে প্রজাপতি উড়ছে, একসঙ্গে অত প্রজাপতি আর দেখেননি মীরা তার পরে। আসলে হয়তো দেখেছিলেন, কিন্তু সেই যাওয়াটাই তো অন্যরকম ছিল। সেই তাঁর জীবনের প্রথম পুরুষ সংসর্গ। যদিও প্রেমিক যে অর্থে বলে, সেই অর্থে প্রেমিক ছিলেন না বিজনদা। মীরার প্রতি তাঁর একটা স্নেহময় অভিভাবকত্ব ছিল। বয়সে তো অনেকটাই বড়, ইন্ডাস্ট্রিতেও ঢের সিনিয়র। দেখতে সুদর্শন তো নয়ই, বেঁটে খাটো, বেশ কুদর্শনই বলা যায়, কিন্তু আশ্চর্য ঝকঝকে ছিল তাঁর চোখ দুটো, মেধা আর সংবেদনার অদ্ভুত সহাবস্থান। বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ দিয়েছিলেন মীরাকে। ওয়ার্ল্ড সিনেমায় দীক্ষিত করেছিলেন। তোপচাঁচির ওই তিনটে দিনই মীরার ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়েছিল। জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেওছিলেন তাঁর প্রথম মেন্টর বিজন ঘোষের কথা। বিজন ঘোষকে বলিউডে কেউ না চিনলেও আন্তর্জাতিক সিনেমা মহলে একেবারে অচেনা নাম নন, কারণ বিশ্ববিখ্যাত পরিচালকের বেশ কয়েকটা ছবি তিনি করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় মঞ্চে বিজন ঘোষের নাম বলতে কোন তরঙ্গই ওঠে নি, তাঁর প্রখ্যাত স্বামীটিও তাঁকে পরে রূঢ় ভাষায় ধমকে ছিলেন এত বড় প্লাটফর্মে কোথাকার কে হরিদাস পালের নাম করার জন্য। এও বলেছিলেন, বাঙালি জাতটাই এরকম, তরক্কির কোন চিন্তা নেই, কেবল পেছনের বেফালতু জিনিস আঁকড়ে পড়ে থাকতে চায়।সেদিন ঘর বন্ধ করে খুব কেঁদেছিলেন মীরা, সেটা তাঁর স্বামীর ভর্তসনার জন্যে নয়, তিনি এতগুলো বছর তাঁর বিজনদাকে ভুলে ছিলেন কী করে তাই ভেবে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে নামটাই তো বলেছেন শুধু, এত বছর তো যোগাযোগ করার কোন চেষ্টাই করেননি।
তাঁর মনে পড়ছিল তোপচাঁচি থেকে ফেরার পরের দিনই বম্বে থেকে ফোনটা এসেছিল। দারুণ বড় ব্যানারে, নামী পরিচালকের ছবিতে নায়িকার রোল! কাস্টিংও দারুণ। দুবার ভাবতে হয়নি। বিজনদাকে একবার জানাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু ওঁর বাড়ির ল্যান্ডফোন বেজে গিয়েছিল, স্টুডিওতে একটা কাজ সারতে গিয়ে শুনেছিলেন বিজনদা আউটডোরে বেরিয়ে গেছেন, সুন্দরবনে কাজ। আর কী ভাবে যোগাযোগ করতে পারতেন? একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছিলেন লাইটম্যান আলমদার হাতে। সেই চিঠি কি আলমদা দেননি বিজনদাকে? কে জানে। দিলেও সে চিঠির কোন উত্তর পাননি মীরা। হয়তো দেবার প্রয়োজনই মনে করেননি, হয়তো মীরার বম্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ওঁকে অসন্তুষ্ট করেছিল। সেই বিখ্যাত বাঙালি উন্নাসিকতা। একটু নাম বা টাকা হলেই গেল গেল রব। এই জন্যেই তো এই রাজ্যটার কিছু হল না। এই জ্যোতিষীটাই দেখো, কলকাতা ছেড়ে উনি নড়বেন না। ওঁর আসনে না বসলে গণনা করতে পারবেন না! অল রাবিশ।
না, বিজনদা মীরাকে কোন চিঠি লেখেননি, এমনকি একটা ফোনও করেননি কোনদিন। কিন্তু কঠিন কিছু ছিল না মীরার সঙ্গে যোগাযোগ করা। মীরার মাসীরা বরাবর নাকতলাতেই থাকতেন, সে বাড়ি চিনতেন বিজনদা, তাছাড়া হরবখত টেকনিশিয়ানরা কলকাতা বম্বে করত, তাদের হাতেও একটা চিরকুট পাঠাতে পারতেন তো। পাঠাননি, কারণ বিজনদা নিশ্চিত মনে করেছিলেন, মীরা আদর্শচ্যুত হয়েছেন, টাকার পেছনে দৌড়েছেন তিনি। তবুও সেইদিন কান্না শেষ হবার পর চোখ মুছে তিনি বিজনদার নম্বরে ফোন করেছিলেন, একটা মোবাইল নাম্বার, আলমের কাছ থেকে জোগাড় করা। দেখে তবু ভালো লেগেছিল, যাক, বিজনদা মোবাইল নিয়েছেন অন্তত, একে আবার আদর্শচ্যুতি ভাবেননি।
কিন্তু সেই নম্বরে ফোন করতে কেউ ধরল না প্রথমে। খানিকক্ষণ পরে একটা ফোন এল, অন্য একটা নম্বর থেকে। ট্রু কলার দেখাল ঊষষী ঘোষ কলকাতা। ঘোষ দেখে ধরলেন মীরা।
-একটা ফোন এসেছিল এই নম্বর থেকে।
-হ্যাঁ আমি বিজনদা মানে বিজন ঘোষের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম, আমার নাম মীরা কাপুর, মুম্বাইতে থাকি।
মীরা কাপুর নামটা এখনো লোককে নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মেয়েটি আশ্চর্য নিস্পৃহ গলায় বলল ‘ট্রু কলারে উঠেছে আপনার নাম। হ্যাঁ, আমি দেখেছি আপনার সিনেমা। আপনার জীবনের প্রথম প্রেম যে বিজন ঘোষ, তাও লিখেছে ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলো, আর বাই দা বাই, বাবাও খুব আপনার কথা বলতেন শেষের দিকে। আপনার চিঠির জবাব দেননি, সেই নিয়ে ওঁর একটু গিল্টি ফিলিং ছিল।’

বলতেন, শেষের দিকে, – এই শব্দগুলো তো একটাই কথা বলে, মীরার ভেতরের এতদিনকার চাপা পড়া দিন, মাস, বছরগুলো আর্তনাদ করে বলছিল ‘আমাদের মুক্তি দাও, তোমার এই ওপরে ওঠার নেশায় তুমি আমাদের স্বীকার করতে চাওনি, চিলেকোঠার ঘরে আমাদের আটকে রেখেছ এতকাল, আমাদের বাইরে আসতে দাও, আর কিছু না হোক, কাঁদো, কাঁদো মীরা কাঁদো।’
মীরার মনে উথাল পাথাল করছিল তোপচাঁচির সেই তিনটে দিন, স্টুডিওপাড়ার স্মৃতি, খবরের কাগজে মুড়ি আর বেগুনি খাওয়া। কিন্তু তিনি তো আর মীরা গাঙ্গুলি নন, তিনি মীরা কাপুর, আবেগের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ তো তাঁর কাছে সামান্য ব্যাপার, তিনি গলায় খাঁটি উদবেগ মিশিয়ে বললেন ‘বিজনদা কি তবে… কবে হল? তুমি তাহলে ওঁর মেয়ে বলছ? কী করো তুমি?’
যদিও আর কিছু শোনার কোন ইচ্ছে ছিল না, বিজনদা থাকলে অনেক কথা ছিল, এখন আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তবু তাঁকে শুনতে হল বিজনদা কীভাবে অনেকদিন কাজ না পেয়ে মদের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিলেন, প্রথম স্ত্রীকেও খোরপোশ দিতে হত। ঊষষী একমাত্র মেয়ে, অত্যন্ত মেধাবী, কানাডা থাকে। বাবা মারা যেতে এসেছে, সব ব্যবস্থা করে মাকে নিয়ে চলে যাবে খুব শিগগিরই।

কোন দরকার নেই তবু তিনি সৌজন্যের খাতির বললেন ‘কিছু দরকার লাগলে আমাকে বলতে কোন দ্বিধা করো না’
ঊষষী একটু দ্বিধা নিয়ে বলেছিল ‘মাই ফাদার ওয়াজ অ্যান অ্যামেজিং অ্যাক্টর। তাঁর স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু আমি এই লাইনের কাউকেই চিনি না, আর থাকিও না এখানে’
মীরা বলেছিলেন ‘আমি চেষ্টা করব’
কিছুই করেননি তিনি, ভবানীকে ফোন করতে করতে মনে হল সে কথা।
ভবানী ভাবছিলেন কত বড় বড় অফার ছেড়েছেন, কী ভাবে লোকে তাঁকে? কিন্তু এই লোকটা কে? ফোনে কথাই বলে যাচ্ছে এখনো।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes