
অজিত সিং বনাম অজিত সিং একচল্লিশতম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
৪১
এইট বি-র মোড়ে গিয়ে দিশাহীনভাবে হাঁটছিল দোলন। যেহেতু এটা এলোমেলো হাঁটার জায়গা নয়, কলকাতার সবথেকে বেশি ট্রাফিক থাকে যেখানে যেখানে, এই জায়গাটা তাদের অন্যতম, তাই কেবলই লোকজনের ধাক্কা লাগছিল ওর সঙ্গে। আগে আগে হলে দোলন সিঁটিয়ে যেত। সেই যে ক্লাস সিক্স থেকে মা শিখিয়েছিল বুকের সামনে ব্যাগ বা খাতা দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চলাফেরা করার কৌশল। বরাবর তো ওইভাবেই হেঁটেছে সে। তার মতো সব মেয়েরাই ওইভাবে হাঁটত। একদম ঝাড়া হাত পা হয়ে দুহাত ইচ্ছে মতো দুলিয়ে যা ইচ্ছেমতন হাঁটা, শুধুই হাঁটা, কোথাও পৌছনো নয়, সেটুকুও তারা হাঁটতে পারেনি কোনদিন। বিদিশা কিন্তু হাঁটত ওইভাবেই। মনে হত ও শ্বাপদদের কথা জানেই না। খাতা বা ফাইল দিয়ে বুক ঢেকে হাঁটতে দেখেনি কোনদিন ওকে। কোনদিন ওর মুখে শোনেনি এমন কোন কথা। সবসময় যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকত। ওর কথা এখন ভাবতে চায় না দোলন। অনেকদিন পর ও বেরিয়েছে।নিজের পুরনো জায়গা গুলো ঘুরে দেখবে বলে। তার বাড়িতে কোন কাজ নেই তেমন। প্রদীপ্ত আবার ভুবনেশ্বর গেছে।ওখানে নাকি কোলাবরেশনে একটা প্রজেক্ট শুরু হবে, পি এইচ ডি সম্ভবত ওখানেই করবে, কারণ এখানে সবার সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গেছে, কাউকেই অ্যাপ্রোচ করতে পারবে না।
কয়েকদিন আগে যখন দোলন শুনল প্রদীপ্ত আবার ভুবনেশ্বর যাচ্ছে, তখন বলেছিল ‘এত ঘন ঘন বাইরে যাচ্ছ কেন? আমি কীভাবে থাকব বল তো? এই কোয়ার্টারে কোন সমাজ নেই, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না, আমি তো চাকরিও করি না’
‘কেন তোমার তো বই আছে’ কম্পিউটারে কীসব সার্চ করতে করতে বলেছিল প্রদীপ্ত।
কথাটা কেমন ধাক্কা দিয়েছিল দোলনকে। সে বলেছিল ‘আজকাল তো আমাকে কিছুই বল না, জানি তুমি ওখানে পি এইচ ডি করছ। হয়তো এনরোল করেই ফেলেছ। করলে এখানেই করো। আমি কি বাধা দেব? আমাকে এত মিন ভাবো?’
‘এখানে করব? কথাটা বলতে লজ্জা করে না তোমার? আজ তোমার জন্যে সবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই আমার দিকে মকিং চোখে তাকায় বউয়ের জন্যে শহিদ হয়েছি আমি বুঝলে? তোমার বালের পড়াশোনা, বালের চাকরি, অধ্যাপক হবে। কেন আই টি তে অত ভালো অফার এল, গেলে না। রুবির কাছে ওই স্কুল টা, সায়েন্স পড়ানোর জন্য ডাকল, পায়ে ধরল প্রায়, স্কুল তো কি, প্যাকেজ ভালো, আর পড়ানোই তো, গেলে না। কি না ইউনিভার্সিটি ঢুকবে’
দোলনের পৃথিবী চুরমার হয়ে যাচ্ছিল।
দোলন যেদিন থেকে বুঝতে পারছিল সে ভালো হয়ে যাচ্ছে, খুব খুব আনন্দ হচ্ছিল ওর। ও নিয়মিত ল্যাপটপে বসে, লেখে, খুব শিগগিরই একটা স্মার্ট ফোন কিনবে, তারপর একটা কাজ খুঁজে নেবে নিশ্চয়ই। দরকার হলে বিদিশার সঙ্গে কথা বলবে।
যেদিন প্রদীপ্ত এই কথাগুলো তাকে বলল, সেদিন ওর মনে হয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বিদিশাকে ফোন করে। কিন্তু বিদিশার নম্বর যেমন তার জানা নেই, তেমনি ওকে কল করার জন্যে হোয়াটস্যাপ, মেসেঞ্জার বা স্কাইপ- যা যা তার থাকার দরকার, কিছুই এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। আর তারপর কয়েকদিন এসব নিয়ে তার ভাবার মতো অবস্থাও ছিল না। সে আবার ফিরে গিয়েছিল আগের অবস্থায়। বরঞ্চ আরও খারাপ, ভায়লেন্ট হয়ে উঠেছিল। জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিল, চিৎকার করছিল, খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দিয়েছিল। আগে আগে এমন হলে প্রদীপ্ত পাগলের মতো হয়ে যেত, ডাক্তারের কাছে ছুটত ওষুধ বদলে দেবার জন্য, ছুটি নিয়ে বাড়ি থাকত।এবার প্রদীপ্ত কিছুই করল না। নিজের মতো খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেল, ফিরল অনেক রাতে, ওর চোখে একটা হিংস্রতা খেলা করতে দেখছিল দোলন। প্রদীপ্তর এই চোখমুখই তাকে সেরে উঠতে সাহায্য করল, দোলন বুঝতে পারছিল প্রদীপ্ত আর তার জন্যে বসে নেই। পৃথিবী নিজের নিয়মে এগিয়ে গেছে। সে কেন বসে থাকবে? সে কেন নিজের জীবন নষ্ট করবে? তাকে সেরে উঠতে হবে একা একা। এই কথা মনে হতেই, জীবনে প্রথমবার নিজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে সে ডাক্তারের কাছে গেল একা একা। ডাক্তার ওকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন ‘এই তো আপনি একেবারে ভালো হয়ে গেছেন। খুব শিগগির আপনাকে আর ওষুধ খেতেই হবে না’
সে কথায় অবাক হয়ে গেল দোলন। সে ভেবেছিল তার সঙ্গে প্রদীপ্তকে না দেখে ডাক্তারবাবু খুব রেগে যাবেন, ওকে বকবেন কেন সে একা এসেছে, প্রদীপ্তর নামে যা তা বলবেন, সে কেন এত দায়িত্বজ্ঞানহীন। কিন্তু তার বদলে উনি খুশি হলেন, কৃত্রিম খুশি নয়, ওঁর মুখে ফুটে উঠল নির্ভেজাল আনন্দ। আর সেটা দোলনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, সে একটা আলাদা মানুষ আর কোন মানুষের অস্তিত্বই অন্য মানুষের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে থাকা ভালো নয়, যে সে একা হাঁটতে ভুলে যায়, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে না পারে। প্রদীপ্ত তার জন্য অনেক করেছে, কিন্তু সে সারাজীবন এইরকম থাকবে এটা মনে করাই অন্যায়। সবাই বদলাচ্ছে। চেঞ্জ ইজ দা অনলি কন্সট্যান্ট। সেই বদলের ধাক্কা তারাই এড়িয়ে যেতে পারে, যারা নিজেদের বদলে নিতে পারে। সোনির প্রতিষ্ঠাতা, আকিও মোরিতা,বলেছিলেন, না কর্পোরেট কোন লিডার মনে পড়ছে না ‘মেক ইয়োরসেলফ অবসলিট বিফোর সামওয়ান মেকস ইউ অবসলিট’ নিজের পচে যাওয়া, ছাতা পড়া, সত্বাটাকে ফেলে দাও, বাতিল করো। সেই প্রথম নিজের ভেতরের দিকে তাকাল দোলন, নিজেকে বলল ‘দোলন, এসব কিসের ব্যাগেজ তুমি টেনে নিয়ে চলেছ? লোকে তোমাকে প্রেম দেবে, চাকরি দেবে, আর না দিলেই তোমার জগত ভেঙে পড়বে! কেন দোলন কেন? তোমার জগত এত ঠুনকো কেন? কেন বাইরের ইশারায় তোমার মন কেবল ওঠা নামা করবে? তুমি নিজে কেন নিজের জীবনের নিয়ন্তা হতে পারছ না? কেন দোলন কেন?’
সেদিন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়েই ক্যাব নিল না দোলন। একা একা উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটল। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে পড়ল তার ইনার নেই সেরকম।কতদিন, কত বছর সে বাড়িতে রয়েছে, বহুবছর ধরে তার পোশাক কাফতান বা নাইটি, অনেক সময় এসবের নিচে সে ব্রা-ও পরে না। সে এখন সালোয়ারের নিচে যা পরে রয়েছে, তা বহু বছর আগে কেনা, তাও এটা কিনে এনেছিল প্রদীপ্ত। ডাক্তারের চেম্বারে পরে যাবার মতো কোন ব্রা ছিল না বলে। ছোট্ট দোকানে দাঁড়িয়ে কতদিন পরে নিজের ব্রা কিনতে চাইল দোলন।
চটপটে দোকানীটি বলল
‘কী চাই বলুন দিদি?
কোন ব্র্যান্ড দেখাব?’
দোলন প্রথমে মনে করতেই পারল না কী ব্র্যান্ড পরত সে। সব কিছু কেমন ব্লারড হয়ে গেছে। যেন হাজার হাজার বছর আগের কথা। ভাগ্যিস দোকান তখন ফাঁকা ছিল। নইলে সুবেশা স্মার্ট মেয়েরা থাকলে তার মাথা আরও ঘেঁটে যেত।
সে বুদ্ধি করে বলল ‘আপনারা কী কী ব্র্যান্ড রাখেন?’
‘নিউ লুক, জকি, ডেইজি ডি, বেল, এনামোর’ গড়গড় করে আরও কত অচেনা নাম বলে যাচ্ছিল ছেলেটা। একটি নামে দোলনের মাথার কোন চাপা পড়া অন্ধকার কোষে আলো জ্বলে উঠল। এইটা, এইটাই পরত সে।এর এম্বলেমটা অব্দি মনে আছে তার। দাম তখনই বেশ বেশি ছিল। তবু তাতে কোন অসুবিধে হয়নি তার। তাদের। প্রদীপ্ত বলেছিল মনে করবে আমরা দুজনে মিলে একটা চাকরি করি। এ আমাদের যৌথ রোজগার। যদিও দোলনের প্রয়োজন খুব কম ছিল। আর পাঁচটা মেয়ের মতো শখের কেনাকাটা তার কোনদিন ছিল না। সাজ গোজ করতে ভালোবাসত না, পারতও না। বিয়ের দিন যা একটু মেকাপ করেছিল। নইলে কানে ছোট হিরের টপ, প্রচুর ঝাঁকড়া চুলে কোনমতে একটা ব্যাকক্লিপ, আর লিপস্টিক। টিপ পরত না কোনদিনই। তবে সেসব তো মনে হয় অন্য কোন দিন। অন্য কোন সময়। যখন নিজের টুকটাক প্রয়োজনের কেনাকাটাটুকু সে নিজে করতে পারত। তারপর কত বছর পর সে এসে দাঁড়িয়েছে দোকানের সামনে একা। চাইছে তার অন্তর্বাস।সত্যিই তার দরকার অন্তরের বসনটুকু।
ঝলমলে মুখে সে বলে ‘হ্যাঁ ডেইজী ডি। ব্ল্যাক আর অফ হোয়াইট দিন।‘
‘আর কিছু লাগবে না?’
আর? আকাশ পাতাল ভাবে দোলন। অনেক কিছুই তো লাগবে তার। এই সালোয়ার গুলোও একদম আউট অফ ফ্যাশন, বাইরে বেরোনোর মতো জুতো ব্যাগ কিছুই নেই তার। রুমাল লাগবে এক ডজন। সেফটিপিনের পাতা, ক্লিপ, একটা ডিওডোরেন্ট। আরও কত কী। ব্যাগে ডাক্তারের ফি দিয়ে পড়ে আছে বারশ টাকা। ক্যাবের ভাড়াও দিতে হবে।
ও বলল ‘এই দুটো কত?’
‘ছশ কুড়ি’
দোলন হিসেব করে দেখল সে বড়জোর রুমাল আর সেফটিপিন কিনতে পারে এই টাকায়। ঠিক আছে, একটা কোল্ড ড্রিংক খাওয়া যেতেপারে, তাই না?
সেদিন প্রথম উপলব্ধি করেছিল সেফটিপিন, লঁজারি বা মোবাইলের চেয়েও ওর যা জরুরি, তা হচ্ছে নিজের রোজগার, নিজস্ব টাকার উৎস। সেই টাকা, জমানো টাকা হতে পারে না। বসে খেলে কুবেরের ধনও একসময় ফুরিয়ে যায়। আজ যেমন এখানে আসবে বলে প্রদীপ্ত ওকে দু হাজার টাকা দিয়েছে, ডাক্তারের ভিজিটই আটশ টাকা। ক্যাবে তিনশ পড়েছে একপিঠে।দোলন ঠিক করল ফেরার পথে ও খানিকটা মেট্রো, খানিকটা অটো করে নেবে। তার জন্যে যে টাকাটা বাঁচবে, তাতে কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনবে। এই যে টাকা কম আছে, সেটা হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে, এটা ওর খারাপ নয়, বরং ভালো লাগল। কারণ এই চিন্তাটা ও একদম নিজে নিজে করছিল। ও বুঝতে পারছিল, একদম ছোট থেকে ওর বড় হয়ে ওঠার পথে শুধু বই আর বই ছিল, কিন্তু নিজের জীবনটাকে নিয়ে কীভাবে চলতে হয়, কীভাবে একা একা সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেসব ওকে কেউ বলেনি। শুধু বলা হয়েছে অনেক অনেক নম্বর পাও, ফার্স্ট হও। অথচ টাকা পয়সা রোজগার শুধু নয়, বাড়ি বসে হোমমেকাররাও যে টাকা পয়সা হ্যান্ডল করতে পারে, সেটা শেখানো হয়নি।ও যখন চাকরি করত, মা ওর মাইনেটা নিয়ে ব্যাঙ্কে ফেলে দিত, বলত এত টাকা ও বুঝবে না, উল্টোপাল্টা খরচ করে ফেলবে। একটা মান্থলি ইঙ্কাম স্কিমে টাকা জমা হত, যা নাকি তার ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করবে। ভবিষ্যৎ! সুরক্ষা! এই শব্দ দুটো ভাবলে হাসি পায় খুব। মা তার ভালো করছে ভেবে তাকে পরনির্ভর করে চলে গেছে। এই প্রথম ভালো লাগল এই ভেবে যে তার কোন সন্তান নেই। থাকলে সে সন্তানের ক্ষতি করত হয়তো। যেমন লোকের নিজের পুজোর ঘর থাকে, তেমনি ওর নিজস্ব ঘর চাই।চিন্তা করার জন্যে।
সেদিন বেরিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাস হয়েছে দোলনের। আবার সে বেরিয়ে পড়েছে আজ। হাঁটছে হাঁটছে।
সেদিন হয়তো হাতে টাকা কম ছিল, অনেক কিছু কিনতে পারেনি, কিন্তু প্রচুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিরেছিল দোলন, যা বছরের পর বছর মনোবিদের চেম্বারে গিয়েও হয়নি।
হাঁটতে হাঁটতে সে এইট বির যেখানে আগে অনেকে টাইপরাইটার নিয়ে বসতেন, সেখানে থমকে গেল। কেউ নেই এখন। আগে এখানে কত লোক টাইপরাইটার নিয়ে বসে থাকতেন। একজন বুড়ো টাইপিস্টের কাছে দোলন তার ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্ট টাইপ করিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টুলে বসে সেই কাজ করানো। কিন্তু কি থ্রিল ছিল সেই কাজের। সেই মানুষগুলোর একজনকেও দেখতে পেল না সে। এখন তো সবারই কম্পিউটার, নিজেরাই টাইপ করে নেয়। যাদের নেই, তারা সাইবার কাফে যায়। সেই লোকগুলোই কি কম্পিউটার শিখে সাইবার কাফে খুলে বসেছে? মনে হয় না। অত ভাবতেও পারল না দোলন। বেশি ভাবলে তার মাথা ঝিমঝিম করে। এর পরেই ফুটপাথে একটা পুরনো বইয়ের দোকান ছিল। বিদিশা খুব এখান থেকে বই কিনত ঘেঁটে ঘেঁটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাঁটলেও ওরা কিছু বলত না। কারণ বিদিশা ছিল ওদের নিশ্চিত ক্রেতা। কিছু না কিছু বই কিনতই ও। সেই পর্বে, বিদিশা আর ও সব জায়গায় একসঙ্গে যেত। তাই বিদিশা যখন মাটিতে আধ বসা হয়ে বই খুঁজত, ওর মুখ্য উৎসাহ ছিল পাঠ্যের বাইরে সাহিত্য ইতিহাস, দর্শন এবং প্রযুক্তি, তখন দোলন অল্প স্বল্প খুঁজত ওর সাবজেক্টের রেফারেন্স বই, থার্মোডায়নামিক্স বা কন্ট্রোলের খুব ভালো বই সস্তায় পেয়ে গেলে তার ভারি আনন্দ হত।
দোলন দেখল, সেই দোকানটা আছে, একই রকম, আর কি আশ্চর্য দোকানে যে লোকটা বসত, সেই লোকটাই আছে। রোগা, মাঝারি উচ্চতার, শ্যামলা, ওদের দেখলেই একটা মিচকে হাসি দিত। একবার বলেছিল, বাড়িতে পুরনো বই থাকলে ওরা কিনতে আগ্রহী, গিয়ে নিয়ে আসবে। সেই শুনে বিদিশা খুব এক্সাইটেড হয়ে বাড়ি গিয়ে পুরনো বই, যেগুলো কাজে লাগে না, বাছতে শুরু করেছিল। আর বাছতে গিয়ে একটা মজা হয়েছিল। বিদিশা দেখেছিল সব বইই ওর কাজে লাগে, কোন বইই ও বেচে দেবার মতো বাছতে পারেনি।প্রানে ধরে একটা বইকেও ও দিতে পারেনি কাউকে। আজ সেই বিদিশা কত দূরে? ওর বইগুলোর কী হল কে জানে?
দোলন যেচে জিজ্ঞেস করল ‘কোন কন্ট্রোলের বই আছে?’ লোকটা এক দল তরুণ তরুণীর সঙ্গে কথায় ব্যস্ত, ওর দিকে এক ঝলক দেখে বলল ‘দেখুন না বেছে’ তারপর আবার কথায় মেতে গেল। ওকে চিনতে পারেনি, পারার কথাও নয়। তবু দোলনের মন খারাপ হল না।
হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাথ বদল করল দোলন। এইদিকের ফুটপাথ আগে কত নির্জন ছিল, একটা সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান ছিল, আর টুকিটাকি। এখন সেখানটা যেন গড়িয়াহাটের মতো গমগম করছে। মাঝের সরু গলিটাও আর শুনশান নেই। কালার কপিয়ার, নিট কোচিং, কত কর্মকাণ্ড সেখানে। মার্কেটের ওপরে যেখানে কফি হাউস, তার অন্যদিকটা একদম অন্যরকম, মাছের বাজারের মধ্যে দিয়ে ওঠার সিঁড়ি ছিল। সেখানেও কয়েকজন টাইপিস্ট বসত। আর ছিল রেশনের অফিস। সেখানে এলে অন্য একটা জীবন, যা তার নয়, হবার কথাও নয়, তার স্বাদ পেত দোলন। একবার ভাবল বাঁদিকের গলিটায় ঢুকে মার্কেটে ওঠে একবার। কিন্তু মাছ বাজারের গা গোলানো গন্ধটা নাকে আসতে আর ইচ্ছে করল না। সে ইডলি ধোসার দোকানটা দেখল একবার। একসময় কত খেয়েছে এখানে। খাবারের স্বাদ নিশ্চয়ই বদলায়নি, কিন্তু দোকানটা অনেক বড় আর ঝাঁ চকচকে লাগল। সামনের ফুটপাথ দখল করে চেয়ার পাতা, সেখানে এখন বসে খাওয়া যেতে পারে। আগে ইউনিভার্সিটির বাইরে তিনটে খাবারের জায়গা ছিল তাদের, কম পয়সার পেট ভরা খাবার। এক নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে একটা পরোটা আর সাদা আলুর তরকারির দোকান। সরু, পরিচ্ছন্ন। চেয়ার টেবিল পাতা। পাঁচ টাকায় সম্ভবত চারটে পরোটা আর তরকারি পাওয়া যেত। অত পাতলা নরম পরোটা কোথাও খায়নি সে, তেলের কোন চিহ্ন থাকত না। ওখানকার কর্মচারীদের মধ্যে কেমন এক সুদূরতা ছিল। তারা কখনো গ্রাহকদের ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করত না অথচ তাদের ব্যবহারে কর্কশতাও ছিল না।এর উল্টোদিকে কালীগংগা বস্ত্রালয়ের পাশে ছিল একটা রোলের দোকান। সেসময় ওরা সবাই এগ রোলই খেত। চিকেন রোল খাবার কথা মাথাতেও আসেনি। এগ রোলই ছিল যথেষ্ট মহার্ঘ টিফিন। ওই দোকানের এগ রোলের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। তার মধ্যে আলুর পুর ভরা থাকত। তাই একটা রোল যথেষ্ট হেভি হত। সারা দিন ক্লাসের পর বিকেল বা সন্ধের টিফিনের পক্ষে ছিল আদর্শ। এই আলু রোল, পরোটা আর দোসা বাদ দিলে বাইরের আর কোন খাবার খেয়েছে কিনা মনে পড়ল না। কখনো হয়তো পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে তাড়াতাড়ির ডিম পাউরুটি। দোলনের হঠাৎ রণদীপ বলে একটা ছেলের কথা মনে পড়ল। তখন তেজাব সিনেমাটা রিলিজ করেছে। মাধুরীর ‘এক দো তিন’ গানে পাগল ভারতবর্ষ। এই গানটা গাইত রণদীপ, আর ইন্টারলুডের মিউজিকের জায়গায় বলত ‘ডিম পাঁউরুটি ডিম পাঁউরুটি’।
এটা মনে পড়ে তার ভীষণ হাসি পেল হঠাৎ। তার সারা মুখ হাসিতে ফেটে পড়তে চাইল। সেইসময় গম্ভীর মুখের দুই তরুণী নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বাঁপাশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসছিল। দোলনকে একা একা হাসতে দেখে ওরা কি অবাক হল? পাগল ভাবল? দোলন একবার তাদের মুখের দিকে চেয়ে পড়ার চেষ্টা করল ওদের মনের কথা। কী উজ্জ্বল ওদের চেহারা। জিনস টি শার্ট স্মার্ট ফোন, একজন বলছিল এ টি এম যাবে, ট্রিট দিতে হবে আজ ডিপার্টমেন্টকে, আর একজন বলছিল আজ বিকেলে দীপায়নের সঙ্গে দেখা করতেই হবে, ওর বার্থডে। এদের পথ কি খুব মসৃণ ? দোলনের মতো এরা প্রত্যাখ্যাত হয়নি কোথাও? আজ যাকে দেখে ওরা পাগল ভাবছে, সে পরেও আছে আউট অব ফ্যাশন সালোয়ার, ওরা বুঝতেই পারছে না ওদের সামনে একজন ন্যাশনাল স্কলারশিপ পাওয়া, গোল্ড মেডেল পাওয়া ঝকঝকে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দোলন, দোলন কি আর ভ্যালিড এখন? না ওর এক্সপায়ারি ডেট চলে গেছে? ওর সময় অতিক্রান্ত? আর কোন সুযোগ আসবে না তার জীবনে? সেসব প্রশ্ন এক মুহূর্তের জন্যে চেপে ধরল দোলনকে। তারপর সেসব উপেক্ষা করে সে হাঁটতেই লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে ও একটা ঝকঝকে ক্যাম্পাস পেরিয়ে ও একটা পোড়ো জমির সামনে এসে দাঁড়াল। গেট ভেঙে পড়েছে এতদূর যে নামই পড়া যাচ্ছে না। শুধু ছড়িয়ে থাকা, খেয়ে যাওয়া হরফগুলো থেকে ও ইন্সট্রুমেন্টস শব্দটা পড়তে পারল, মরচে ধরা লোহার গেট, ভেঙে হেলে পড়েছে এতটাই যে একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে ঢুকে পড়তে পারে। দোলন গেট ধরে ভেতরটা দেখছিল। বিরাট ক্যাম্পাস, একসময় নিশ্চয় ছাঁটা গাছ আর সবুজ ঘাসের লন ছিল। এখন মনে হচ্ছে আমাজনের জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। বড় কাঠামো, কিন্তু পোড়ো চেহারা। বাড়িটা ওকে টানছিল। দোলন ঢুকে পড়ল।
বাঁদিকে একটা ছোট একতলা বাড়ি, দেখে মনে হয় অফিস ছিল, ডেস্ক, ডেস্কে কম্পিউটার, সামনে সোফা, সব নিখুঁত সাজানো, কিন্তু ধুলো আর ঝুলে ঝাপসা,সোফায় একটা কুকুর শুয়ে আছে, ডেস্ক বেয়ে উঠেছে একটা রাক্ষুসে লতা। মানুষের সময়কাল কতটুকুই বা, অল্প কদিন গেরেম্ভারি অফিস ঘর, মানুষজনের ফাইল হাতে আসা যাওয়া, কাজ কাজ খেলা, সুযোগ পেতেই প্রকৃতি সেসব আগ্রাসী ডালপালা মেলে ঢেকে দিয়েছে সভ্যতার অহংকার, অফিসঘর বাঁদিকে ফেলে দোলন সামনের মস্ত বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল, এর গেট বলে এখন আর কোন বালাই নেই, লোহা কাঠ যাই থাক না কেন, চুরি হয়ে গেছে, লোহা কিলো দরে বেচা হয়ে গেছে, কাঠের দরজা কারো বাড়িতে লাগানো হয়ে গেছে হয়তো। কিন্তু ভেতরের মেশিনগুলো কেউ নেয় নি কেন কে জানে। যেভাবে দেখে গেছিল ওদের বহু বছর আগে, সেভাবেই ওরা রয়ে গেছে, এটা দেখে ভারি ভালো লাগল দোলনের। ওদের এখানে আনা হয়েছিল একবার একটা প্রজেক্টের জন্যে, সপ্তাখানেক আসতে হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রি ভিজিটের একটা অংশ হিসেবে। এটা তো ইন্ডাস্ট্রি নয়, ইন্সট্রুমেন্টস ল্যাবরেটরি, অনেকে বলেছিলেন। এখানে কোন প্রডাকশন হয় না, তবে ছেলেমেয়েদের এখানে পাঠানো হচ্ছে কেন? হেড ডিপ বলেছিলেন, এখানে একসঙ্গে যত ফাইনেস্ট ইন্সট্রুমেন্টস দেখতে পাবে ওরা, কলকাতায় আর কোথাও পাবে না, ক্যাম্পাসের এত কাছে, রাস্তার এপার থেকে ওপার জাস্ট। সেই দিনগুলো মনে আছে স্পষ্ট, বাড়ি থেকে সোজা এখানে আসত, টিফিন খেত টিফিন বাক্স খুলে দুপুরে, বিকেলে বাড়ি ফিরত এখান থেকেই। মস্ত একটা সাদা খাতায় মেশিন ধরে ধরে স্কেচ করেছিল দোলন, প্রতিটার গায়ের নেমপ্লেট যত্ন করে টুকেছিল সে আর বিদিশা। দেখে ছেলেগুলো হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। ‘শালা কাজ নেই মালগুলোর, মেশিনের নেমপ্লেট টুকছে বসে বসে, খালি স্যারেদের কী করে তেল দেওয়া যায় সেই ধান্দা’ ওরা কিছুই টোকেনি, এক কোণে একটা টেবিলের ওপর বসে সারাদিন গজল্লা করেছিল, এমনকি দু তিনজন সুট করে কেটে নবীনার নুন শো ও দেখে এসেছিল, স্বর্নেন্দু পেছনের বাগানের ঘাসে শুয়ে শুয়ে কবিতার বই পড়েছিল, তারপর যখন প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দেবার কথা, তখন বিনা বাক্যে বিদিশা আর দোলনের রিপর্ট চোথা করেছিল, যার নাম ছিল মাদার করা। ‘আরে ভাই তোরাই তো আমাদের আদি জননী, তোদের থেকে মাদার করব না তো, কাদের থেকে করব?’ এরকম প্রতি সেমেস্টারেই হত, কিন্তু এখানকারটা খুব মনে আছে, এই কারণে, এখান থেকেই প্রদীপ্ত আর ওর কাছাকাছি আসা শুরু। আর এই ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে ওদের সেই হাঁটাগুলো, যদিও ওরা কোথাও পৌঁছতে পারেনি।
দোলন ভেতরে এসে একটা ক্যালিব্রেশন মেশিনের নেমপ্লেটে হাত বোলাচ্ছিল। ওর স্পষ্ট মনে আছে একে। জার্মান মেক ছিল। এর স্কেচ করতে গিয়ে বেশ নাকাল হয়েছিল সে। তাই সিনিয়র প্রদীপ্ত ধরের কাছে বুঝতে গিয়েছিল। খুব ভালোভাবে বুঝিয়েছিল প্রদীপ্ত, তারপর তো ওরা খুব কাছাকাছি চলে এল।যদিও প্রদীপ্ত বেশ উন্নাসিক ছিল, জুনিয়রদের কোন খবরই রাখত না।
দোলন মেশিনটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবছিল, এই বছরগুলোতে মেশিনটা প্রায় বদলায়নি, কিন্তু প্রদীপ্ত কত বদলে গেছে। এখন সে প্রায়ই ভুবনেশ্বর চলে যায়। দু তিন দিন পরে ফেরে। প্রথম বার গিয়ে মিনিটে মিনিটে ফোন করেছিল। দোলনকে একা ফেলে গেছে বলে তার গলায় ফুটে উঠেছিল খাঁটি উদবেগ এবং অপরাধ বোধ। এখনকার প্রদীপ্ত ওসবের ধার ধারে না। একবার তো ইউনিভার্সিটি থেকেই জানাল আজ তাকে ভুবনেশ্বর যেতে হবে,বাড়িতেও আসতে পারবে না।
‘ব্যাগ নিতে হবে না?’
‘ডিপার্টমেন্টে একটা ব্যাগ গুছোনই আছে,’
সেটা শুনে বুকে একটা ধাক্কা লাগল দোলনের। যে মানুষটা ক্লাসের পরে বাড়ি ছাড়া কিছু করেনি বছরের পর বছর, মনে আছে, কত কত সেমিনারের রাতের পার্টি তেও যায়নি কোনদিন, দোলন একা থাকবে বলে, দোলনের খারাপ লাগবে বলে, অফিসে তার ব্যাগ গুছোন থাকে ট্যুরে যাবার জন্যে, এ তার কাছে একটা ধাক্কা, একই সঙ্গে আই ওপেনার ও। বোকামি তো ওরই। ও নিজের বৃত্তে ঢুকে থাকবে আর পৃথিবীটা এক জায়গায় থাকবে, সেটা ভাবাই তো ওর বোকামি। চেঞ্জ ইজ দা অনলি কন্সট্যান্ট অফ লাইফ। ভালই হয়েছে, প্রদীপ্ত এগিয়ে যাচ্ছে, অন্তত ওকে বেঁধে রাখার আটকে রাখার ওর উন্নতির পথে অন্তরায় হবার দোষ দিতে পারবে না। এবার থেকে দোলনও নিজের মতো ভাবতে পারবে।
দোলন দেখল মেশিন ঘরের প্রতিটা মেশিনের পাশ থেকে গাছ গজিয়েছে, যেন প্রত্যেকটা যন্ত্র একদিন সবুজ গাছ হয়ে যাবে, তখন তারা সালোকসংশ্লেষ করবে। কিন্তু মেশিন গুলোকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দিল কে? একটা চালু সংস্থা রুগ্ন হয়ে যায় কী করে? কোথায় গেল সেইসব কর্মীরা যারা এখানে কাজ করত?
হঠাৎ দোলন দেখতে পেল ধুলোমাখা মেঝের ওপর পায়ের ছাপ, পান পরাগের প্যাকেট, মদের খালি বোতল, আর একদম পেছনে দেওয়াল ঘেঁষে একটা শতরঞ্চিতে একজন ঘুমোচ্ছে, তার পাশে একটা বই, মার্কেজের ‘লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা’ আর পেছনের দেওয়ালে একটা পোস্টার ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিন আসন্ন?’কী শান্ত ভাবে ঘুমোচ্ছে লোকটা। ওইখানে যদি এইভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারত দোলন!