
সিরিয়ার কবি আডোনিস-এর কবিতা
অনুবাদ ও ভূমিকা – সুদেষ্ণা ঘোষ
‘ডিজায়ার মুভিং থ্রু ম্যাপস অফ ম্যাটার’-এ সিরিয়ার কবি আডোনিস আইফেল টাওয়ারকে উপড়ে ফেলে বসাতে চেয়েছিলেন দামাস্কাসের জুঁই-চারা, দেখেছিলেন লুভর ভেসে চলেছে ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্তের দিকে। কবিতার নিজস্ব মানচিত্রকে সারাজীবন এক অসহ্য সুগন্ধ হিল্লোলে টলমল করে দিয়েছেন তিনি। দেশ বা ধর্মের রাষ্ট্রীয় বিভাজনরেখার দিকে ছুড়ে দিয়েছেন রাগ ও রূপকথার মতো প্রতিবাদ। যা শরীরী হয়েছিল আলি আহমদ সইদ এসবার প্রায় কিশোর বয়সেই যখন ‘আডোনিস’ নাম গ্রহণ করেছিলেন—'to exit the world of religion'। ভারতবর্ষের বর্তমান দগ্ধ রাজনৈতিক চালচিত্রে আশ্চর্য প্রাসঙ্গিকতায় ঝলসে ওঠেন আডোনিস, আরবি কবিতার আলোকস্তম্ভ, যখন তিনি বলেন, ‘Nothing will change unless there is a separation between religion and the state. If we do not distinguish between what is religious and what is political, cultural, and social, nothing will change and the decline of the Arabs will worsen.’ তবে এও সত্যি বৈপরীত্যের আর্তি, অভিঘাত ও দ্বন্দ্ব তাঁর পিছনে যে জটিল চালচিত্র তৈরি করেছে, তা একইসঙ্গে রূপময় ও অনির্বচনীয় অরূপ। দালির ছবির মতো! কারণ এই ইস্তেহার যেমন সপাট, তেমনি যে দীর্ঘ আত্ম-অভিযাত্রার সিম্ফনি আডোনিস বুনে চলেছেন তাঁর কবিতার বয়ানে, তার ভরকেন্দ্রে টলমল করছে গোধূলিগগনের একটি তারা, একটি অস্ফুট সত্য। শাসকের ভাষা যদি হয় বন্দুক ও বেয়নেট, তা হলে তার বিপ্রতীপে বুক পেতে দাঁড়াক জীবন ও সঙ্গীত। মহসেন মাকমালবাফের ‘আ মোমেন্ট অফ ইনোসেন্স’ ফিল্মটির মতো তারার করুণ আলোয় বিদ্ধ ও ঋদ্ধ আডোনিসের এই অন্তশ্চেতনা বড় বিরল হয়তো এই একমাত্রিক, বিড়ম্বিত, মেরুকরণপ্রিয় সময়ের কাছে। অবস্থানের গোঁড়ামির কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। তবে মাথায় রাখতে হবে, তিনি কিন্তু বলেছেন, মানবাধিকারের জন্য, মৌলবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়ছেন, তিনি তাঁদের বিপক্ষে নন। কিন্তু I'm not like them.' কেননা A creator always has to be with what's revolutionary, but he should never be like the revolutionaies. He can't speak the same language or work in the same political environment.' আমরা দেখেছি কী আশ্চর্য অনাবিলভাবে মধ্যপ্রাচ্যের এক কবির বোধের প্রাচীরে উড়ে এসে বসেছে রবীন্দ্রনাথের গানের পাখি...‘যে সচল ছবির মতো, আমি নীরব কবির মতো--/ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।/ এই-যে আমি ঐ আমি নই, আপন-মাঝে আপনি যে রই,/ যাই নে ভেসে মরণধারা বেয়ে—’ বিশ্বপাঠকের প্রাপ্তি, আডোনিসের রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ভাবাবেগ তাঁর কবিতাকে গিলে নেয়নি। এও কি ভোলা যায়, দামাস্কাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আডোনিস অল্পবয়সে যোগ দিয়েছিলেন সোশ্যাল সিরিয়ান ন্যাশনালিস্ট পার্টিতে। স্বপ্ন দেখতেন গ্রেটার সিরিয়া-র, যেখানে মিলেমিশে যাবে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন। মুক্তি পেয়ে বেইরুটযাত্রা। এবং যাত্রা সক্রিয় রাজনীতি থেকে কবিতার উন্মাদনার দিকেও। হ্যারিয়েট মনরোর প্রথিতযশা ‘পোয়েট্রি’-র আদলে আডোনিস শুরু করেন পত্রিকা-Shi'r (কবিতা), যেখানে আরবিতে অনূদিত হয়েছে এজরা পাউন্ড, এলিয়ট, ইভ বনফোয়া, স্যাঁ-জন পের্স প্রমুখের কবিতা। দামাস্কাল, প্রিন্সটন, সরবোন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পর ১৯৮৫-তে পাকাপাকি চলে আসেন প্যারিস। সেবছর প্রকাশিত ‘দ্য বুক অফ সিজ’-এর একটি কবিতায় লিখেছিলেন আডোনিস, 'the cities dissolve, and the earth is a cart loaded with dust. /Only poetry knows how to pair itself to this space.' ২০২১ সালে পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিকস-এ অন্তর্ভুক্ত হল তাঁর ছয়ের দশকে লেখা ক্লাসিক কাব্যগ্রন্থ ‘সংস অফ মাইহার দা দামাসিন’। সে বই থেকে পাঁচটি কবিতার অনুবাদ হয়তো রক্তাক্ত হৃদয় চিরে দেখাতে পারে ‘তোমার ধুলার ধরার 'পরে উড়িয়ে যাব সন্ধ্যাবায়ে॥’ -শূন্যের ভিতরে ঢেউয়ের ফিসফাস.... অনুবাদ ও ভূমিকা - সুদেষ্ণা ঘোষ
একটি প্রার্থনা
আমি প্রার্থনা করি তুমি ছাইয়ের মধ্যে থাকো।
প্রার্থনা করি কখনও যেন না জাগো, ভোরের আলো না দ্যাখো-
আমরা কখনও জানিনি তোমার রাত, কখনও ভেসে বেড়াইনি অন্ধকারের সঙ্গে।
ফিনিক্স, আমি প্রার্থনা করি
মায়াজাদু শান্ত করো আর আমাদের
দেখা হোক আগুন ও ছাইয়ে।
আমি প্রার্থনা করি উন্মাদনা আমাদের হাত ধরুক।
যে দেশ থেকে ফেরা যায় না
যদি তুমি ফিরে আসতে ওডিসিউস,
যদি ওই দূরত্ব তোমায় বন্দি করতে শুরু করত
এবং প্রমাণ ভস্ম হয়ে যেত
তোমার ট্র্যাজিক মুখে
বা তোমার গোপন ভয়ে
তুমি আজও প্রস্থানের ইতিহাস হতে,
তুমি সেই দেশেই থাকতে যার কোনও প্রতিশ্রুতি নেই,
তুমি সেই দেশেই থাকতে যেখান থেকে ফেরা যায় না কখনও।
যদি তুমি ফিরেও আসতে ওডিসিউস।
বিদ্যুৎ
বিদ্যুৎ আমাকে ইশারা করে- ও কাঁদে আর ঘুমোয়
বিশ্বাসের বনভূমির ভিতর।
ও জানে না আমি কে,
ও জানে না আমি অন্ধকারের প্রভু।
বিদ্যুৎ আমাকে ইশারা করে- কাঁদে, ঘুমোয়।
ও তখন থেকে আমার হাতের মধ্যে ঘুমোচ্ছে
যখন থেকে আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল।
চেয়ার
(একটি স্বপ্ন)
অনেক আগে আমার কান্না শহরে বেজে উঠেছিল:
পৃথিবীর ত্বক ছিল আমার মুঠোয়,
অনেক আগে আমি জাহাজকে গান শুনিয়েছিলাম নিচু গলায়,
রক্তিম শিখার মতো আমার গান-
সমস্ত বা কিচ্ছু না।
আমার নবীন কনিষ্ঠরা, আমি বড় ক্লান্ত
আমাকে নিয়েও আর সমুদ্রকেও,
আমাকে একটা চেয়ার এনে দাও।
নীরবতার পরে
আমি সেই নীরবতার দিকে কেঁদে উঠি যেখানে কথা পৌঁছতে পারেনি,
আমি গলা ছেড়ে কাঁদি: কী দেখতে পাও তুমি?
আকারহীন ধ্বংসস্তূপ? এই নীরবতার নীচে মরণোদ্যত ধ্বংসাবশেষ?
হাওয়ার জন্য আমি কেঁদে উঠি আমার কণ্ঠস্বর বহুগুণ বাড়ানোর তাগিদে,
আমার রক্তে আর গানে যাতে
সকাল হয়ে ওঠে ভাষা।
আমি কেঁদে উঠি: কী দেখতে পাও
এই নীরবতার নীচে যেখানে কথা পৌঁছয় না?
নিশ্চিতভাবে একা হওয়ার জন্যই তো আমি কাঁদি-
অন্ধকারের সঙ্গে একা।
খুব সুন্দর লাগলো
অ্যাডোনিসের কবিতার ফ্লেভার বোঝা গেল তরতাজা অনুবাদে। ‘বিদ্যুৎ’ অথবা ‘নীরবতার পরে’ গভীরতাস্পর্শী। কবি-পরিচিতিতে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ ধ্রুপদী অভিক্ষেপ যোজনা করেছে।
অ্যাডোনিসের কবিতার ফ্লেভার বোঝা গেল তরতাজা অনুবাদে। ‘বিদ্যুৎ’ অথবা ‘নীরবতার পরে’ গভীরতাস্পর্শী। কবি-পরিচিতিতে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ ধ্রুপদী অভিক্ষেপ যোজনা করেছে।