
রিমঝিম আহমেদ -এর গদ্য
প্রেম আসিল তবু আসিল না
প্রেম কীভাবে আসে, আর কীভাবেই বা যায়? কেন প্রেম হয় আর কেনই বা হারায়! এ কথা কে বলতে পারে? কোনও সমীকরণ আছে কি? আছে কি প্রেমের সময়-অসময়? তবু প্রেম আসে তার সশব্দ ডঙ্কা বাজিয়ে। সেই শব্দ কেবল নিজেই শুনতে পায়। অন্য কেউ তার আঁচ পায় শুধু। অথবা পায়-ই না।
“বিরস দিন বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে/ এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী সমারোহে।।”
এমনই হঠাৎ তার আসা। প্রেম এক অমোঘ ঘটনাপ্রবাহ। মানব অন্তরকে তাড়িত করে তার আপন আলোর মায়াময়তা। মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে এই অমোঘতায় সাড়া দেবে বলে। দরজা খুলে আদরে ঘরে বসাতে তৎপর হয়। যাবেই জানে, তবু তার প্রতি অকাতর সমাদর। যেন বহুল প্রতীক্ষার পর প্রেমের এই আসাটুকু। আরেকটু বসুক আরাম করে মনে মনে এই-ই চাওয়া।
“আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি
সেথায় চরণ পড়ে তোমার…”
এমনই কেটে রাখা পথে কেউ কেউ আততায়ীর মতো ঢুকে পড়ে। তাদের যত্ন করে ভালোবাসি, একা একা। মনে হয় অস্থির বর্ষার ফাঁকে একটা রোদওঠা দিন মায়াময় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে, চরাচরে। তার বহুবর্ণিল, বহুরৈখিক আলো। আমাদের চোখেমুখে এসে লাগে। উতলা হয় ভেতর বাহির। রবির কথায়—
“কার পদপরশন-আশা
তৃণে তৃণে অর্পিল ভাষা
সমীরণ বন্ধনহারা উনমন কোন বনগন্ধে”
আমাদের ভালো লাগে। অহেতুক বাঁশি বাজে মনে। পাগলপারা এই প্রেম আদিগন্ত কাঁপিয়ে দেয়। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের তারে তারে বেজে যায় সে গান। মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে তার দ্যোতনা। যে প্রেম আমূল কাঁপায় না, চোখে জল আনে না, হৃদয়কে নরম করে না সেটা আমার কাছে প্রেমই নয়। প্রেম হলো, মনের ভেতর টলটলে জলের পুকুর। কেউ ঢিল ছুড়লে সে পুকুরে ঢেউয়ের বলয় তৈরি হয়। তখন সব কুৎসিত সুন্দরে পরিণত হয়। সবই আলো হয়ে ওঠে।
“পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে–
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো”
শুধু ভালোবাসা পাবার জন্য নয়, ভালোবাসার জন্যও মানুষ উতলা হয়। ভালোবাসতে পারার সহজাত আনন্দ ভালোবাসা প্রাপ্তির আনন্দেরচে কোনো অংশে কম নয় বোধহয়।
আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, নিজেকে বাসি বলেই। তোমার আয়নায় নিজেকে দেখবার এ এক অনন্ত কৌতূহল। আর তাই ফিরে ফিরে আসি। তোমার কথায় আমার কথা শুনি, তোমার আলোয় নিজের স্বরূপ দেখি। তুমি নেই, তুমি কি আদতে নেই? এই যে না-পাওয়া, হাহাকার এ-ই তো প্রকটভাবে আছে। না-পাওয়াই তবে একমাত্র পাওয়া! চিন্তাক্লিষ্ট, দুঃখদীর্ণ মুখে যন্ত্রণার আভাসের মতো আছো!
“বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক’
ওগো দুখজাগানিয়া ॥
এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে,
তরী এল তীরে
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো”
তোমার আয়না ছাড়া আমার দর্শন অচল। এই হয় প্রেমের বোধ। ভালোবাসার বোধ। নিজেকে এমন খুলে খুলে দেখা যায় না। তাই অন্যের চোখ দিয়ে নিজের ভেতরটা ভ্রমণ করে আসি যেন। অপূর্ণতার বোধ থেকে মানুষের কাতরতা। এক অজানা পূর্ণতাকে পাবার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে লড়ে।
নিজেকে নিজে এমন খুলে না দেখতে পারার অপূর্ণতা থেকে ‘তাকে’ চাই। যে আমাকে ‘সঠিক আমি’কে দেখায়। কিন্তু সঠিকেরই বা শেষ কোথায়? শুরুই বা কী! বিভ্রম, দোলাচল, অন্তহীন।
আর এই অন্তহীনতার পথেই প্রেম বারবার আসে যায়। খেলে। মারে, মুখ চুন করে। আকাশ নামিয়ে রেখে আরেক আকাশে হারায়।
“ভুলি মান অপমান দাও মন প্রাণ,
নিশিদিন রহো পাশে।
ওগো আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও
হৃদয়রতন–আশে। ”
সকলই এক আশার খেলা। ভাসার খেলা। ভাষার খেলাও বটে! হৃদয়ে আর্ত বাঁশি বেজে উঠলে বুঝি বিরহের গাছ ডালপালা মেলেছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রেমের ছায়া ছায়া আরামের দিন। এবার তপ্ত হবে খুলি। মস্তিষ্ক হয়ে উঠবে বাকবিহ্বল। প্রেমঘোর সাময়িক আর বিরহই মৌলিক। সে বিরহের ভেতর থেকে যায় অনন্তকাল প্রেমের সুখমুহূর্ত, হাসির দোলন। আর এভাবেই সাময়িকতা অনন্তের হয়ে ওঠে। না থাকার ভেতর থাকা মূর্ত হয়ে যায়। দিকচিহ্নহীন প্রেমের সমুদ্রে চোখ রেখে ভাবি ওপারের কথা। ওখানেও সকাল হয়, রাতের গুঁড়া ভোরের বাতাসে ওড়ে। তারপর বাড়বাগ্নি মুখ তুলে বলে আমিও আছি।
“যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি—
লই গো বুক পেতে অনলবাণ।”
এ মরণ স্বেচ্ছা মরণ। ভালোবেসে কে না মরতে চায়! শরীরে জড়িয়েধরা আকুল বিরহ। এ শুধু কাঁদায় না, পুড়িয়েও দেয়। সত্যের রন্ধ্রে মিথ্যে গুঁজে দিয়ে বলো, বেছে নাও এবার! সত্য কী আর মিথ্যে কী! তখন ক্লান্তিহীন সত্য-মিথ্যা যাচাই। আলো ও অন্ধকার হাতড়ানো। কে জেতে? “আমার ভুবন তো আজ হলো কাঙাল…” কী পেতে চেয়ে কী হারালো, বুঝে আসে না। আরও কাঙালপনার দিকে পা বাড়ায় জীবনের গহন অভিনিবেশগুলো।
“আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো।
যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার।”
ঘরে কি কেবল দরজা-ই থাকে, জানালা থাকে না? জানালায় কেবল মেঘ-রোদ্দুর খেলা নয়, বাতাসভরা গন্ধকাতরতা নয়, এ একপ্রকার শ্বাস ফেলাও।
আরেকটা পৃথিবী রচিত হয় মনে মনে। বীণার সুক্ষ্ম তারে ঝংকৃত হয় অন্যবাসনা। তাতে আশা থাকে, প্রাণ থাকে। সংমূঢ় চেতনা দ্যোতিত করে। মানুষ কি একবারই ভালোবাসে কাউকে? আর বাসে না? আমার তো তা মনে হয় না! সব মানুষই আলাদা, সব মানুষই নতুন। প্রতিবারই প্রেম তাই নতুন কাঁপন নিয়ে আসে। নতুন করে লুন্ঠিত হয়ে নিঃস্ব হতে প্রস্তুত হয় মানুষ। আর তখনই কি মনে হয় না—
“তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।”
অথবা
“বিশ্ব চরাচর লুপ্ত হয়ে যায়,
একি ঘোর প্রেম অন্ধ রাহুপ্রায়
জীবন যৌবন গ্রাসে। ”
তারপর একদিন “তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে” বলে চলে যায়, যে এসেছিল। খেয়ালে। তার খেয়াল ফুরালেই পাতার বাঁশি রেখে চলে যায়। থাকে সুর, আর্ত বাঁশি। বেদনাবিধুর। আর তখন সন্ধ্যেগুলো ভারিমেঘ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় জানালার পাশে, এই নেমে আসবে শান্তিবিলাপ, ছলছল। আসে না, বাতাসের মতো শুকিয়ে আছে শীতের মন। যেন এই শুষে নেবে সকল সান্নিধ্য। তবুও মরিয়া হয়ে বেঁচে যাই, বেঁচে থাকার সুখে বেঁচে যাই… যেন বাঁচতে বাঁচতে মরেও বেঁচে যাব। আর চিরকুটগুলো শাদা বক হয়ে ছুঁয়ে আসবে কালো হ্রদ।
“মোর হৃদয়ে লাগে দোলা, ফিরি আপনভোলা–
মোর ভাবনা কোথায় হারা মেঘের মতন যায় চলে॥”
কোথাও রাস্তা থাকে না বহুদিন! যাবার থাকে না। কেবল থির হয়ে যন্ত্রণা পাহারা দেওয়া। নিজেকে খোঁজার ব্যর্থ প্রয়াস।
“শরীরে জড়াবে দ্রুত রেশমি সুতোর জটিলতা”— এই ভেবে, খুব কম সকাল আনন্দ নিয়ে আসে। মানুষ ফুরিয়ে যাওয়া দিনে বই আঁকড়ে, কাগজের ঘ্রাণ নিয়ে সময় টপকে যাওয়া আজ আর নতুন নয়। হয়তো অল্প সময় বেদনাহত ঝিনুকের নীল আভা আমাকে ঢেকে রাখে, কিন্তু বিস্তৃত আকাশের কতটুকুই বা মানুষ কেড়ে নিতে পারে!
“তুমি কি নিরুদ্ধ কোন অভিমান বুকে নিয়ে ওখানে বসেছ?” এ-প্রশ্ন করবার চোখ কমে এসেছে পৃথিবীতে। যতটুকু বাঁচা শব্দের জগতে আরো নিঃশব্দ অবতরণের জন্য। পাহাড় না থাকলে কোথাও তো সমুদ্র থাকে! সমুদ্র না হোক, নদী…। অথবা কিছুই না থাকে যদি শরীরের নিচে ছায়াটা থাকেই! তাকেই ভালোবাসা লাগে অগত্যা। গতিহীন। যে বিরহবিষাদ ঘুরিয়ে দেয় যাপনের গতিপথ তাকেও আত্মীয় করে নিতে হয়। ভালোবাসতে হয় নিজের করে।
“ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি
চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী।”
***
“যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।”
কিংবা
“সখী, তরল কোমল নয়নের জল
নয়নে উঠিবে ভাসি।
সখী, বিষাদনীরে নিবে যাবে ধীরে
প্রখর চপল হাসি। ”
এভাবেই রবিকে পাই আপন-তাপনে, হরিষে-বিষাদে।
মানুষের দেওয়া কোনও অপমানের জন্য প্রতিশোধস্পৃহা জমা করি না। করিওনি কখনো । বুঝি, মান থাকলে অপমানও থাকবে। আশার পিঠে হতাশা, প্রেমের পিঠে বিচ্ছেদ। অপমানের অন্ধকার খুঁড়ে, নিজের ভেতর থেকে আলো ছেনে আনি। অন্ধকারের নিজস্ব আলো। সে আলো জুনিপোকার মতো সুন্দর। কোমল। ঝোপের আড়ালে হাসে।
তারপর, সে কোমল আলোর সামনে একদিন ব্যথারও মাথা নত হয়ে এলে, আমিও আলোক সামান্য হাসি। এরচে ভালো প্রতিশোধ আর হয় নাকি!
তুমি যাকে পেয়েছিলে, তুমি তাকে চাওনি কখনো। সবাই সবাইকে পায় না পৃথিবীতে। আলো ধারণ করবারও উদারতা লাগে।
বুঝে যাই অমোঘ সত্যখানি। তারে প্রাণে ভরি, ধারণ করি—
“তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে। ”
***
“অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি। ”
জীবন এমন ছেড়ে আসতে শেখায়, না-পাওয়াকে মেনে নিতে শেখায়, শেখায় সময়ের পানে চোখ রাখো। সে তোমার প্রাপ্য ঠিক বুঝিয়ে দেবে।
আজকাল বড্ড আকাল জমে আছে আমার সদরে। ভাবি- “শূন্য হৃদয় আর বহিতে যে পারি না।” কে যেন নিঃশব্দে বদলে দিচ্ছে আমার দেয়াল, ঝাড়বাতি, ড্রয়িংরুম, বিছানা। যেন আমি নই মানুষ কোনও, শুধু একটা ফ্ল্যাট, বদলে বদলে আসছে ভাড়াটে, যাচ্ছেতাই আমিও বদলে যাচ্ছি তাদের পরিপাটি ইচ্ছের কাছে…
বয়সের আয়না ভেঙে কেউ বিপ্লব নিয়ে আসে, সকল যুদ্ধ, হত্যা শেষে সারিসারি লাশ ডিঙিয়ে উড়ে যায় তার অহংকারী পা। আমি যেন মানুষ নই, একটা ফ্ল্যাট, উদোম শহর; আমি যেন কাচের গ্লাসভরা ঘোলা ভদকা; কারো চুমুকের আশায় দাঁড়িয়ে থাকি খুব নিঃশব্দে….
“নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,
বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।
মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার–
সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি॥”
প্রেম/ভালোবাসা একপাক্ষিক হয়। একই সময়ে দুটো হৃদয়ের প্রেমের স্রোত সমান বয় না। অথবা কারো দিকে বয়-ই না। এমন তো হতেই পারে! তবে সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক। সম্পর্কহীন কতো সম্পর্ক আমরা বয়ে বেড়াই গোপন তোরঙ্গে। জন্মদাগের মতো সেসব আমাদের চেনা। তাই, নিজের ঘরের কোণে টবটির মতো, দেয়ালে টানানো ছবির মতো, ঘরময় ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো বিরহও নিজস্ব হয়ে যায়। আর সে না-থাকা কিংবা না-থাকতে চাওয়া মানুষটিও। তবু নিরন্তর একটা আপন জানালা লাগে। শ্বাস ফেলবার জন্য এটাই এক সাধনাপদ্ধতি। ডাকঘর নাটকের অমলের সে-ই জানালা, যেখানে থাকে সরল, আনন্দিত প্রতীক্ষা। জীবন ছন্দের নয়, তার আছে অপরিমেয় ছন্দভঙ্গুরতা। তাও তা আমাদের অদৃশ্য উত্তরাধিকার।
“যা-কিছু পেয়েছি, যাহা-কিছু গেল চুকে,
চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে…/
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা,/
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা, ”
….
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক