
‘যে যার ভূমিতে দূরে দূরে’
শঙ্কর বসু
মাস্টার্স ডিগ্রি সেকণ্ড ইয়ার… ২০০৬-০৭… বালিগঞ্জ সাইন্স কলেজ… ছ’তলায় বায়োকেমিস্ট্রি ! এক সহপাঠিনী বান্ধবীর সঙ্গে প্রাণের দোস্তি তখন… মফঃস্বলী স্বভাব তার… মাটির সুরে বাঁধা মন… শৈশব কেটেছে তার ওপার বাংলায়… খুব ঘুরতাম আমরা ! ওলি-গলি-ভ্যানরিক্সা-লোকাল-খেয়া…
ফুলন্ত আষাঢ় মাস তখন ! সে বছর প্রায় বন্যা-পরিস্থিতি কোলকাতায়… আমাদের ডিপার্টমেণ্টের ঠিক পাশেই একটা বিরাট নেড়া ছাদ ! আটতলায় ক্যান্টিন থেকে সেটা জরিপ করে খুব সুখ পেতাম আমি আর মফঃস্বলী, আরো কেউ কেউ… কোলকাতার একটা অন্য ল্যান্ডস্কেপ… উত্তরের ছেলে আমি… দক্ষিণে এলে অনেক সময়েই ঠাঁই খুঁজতাম গুম্ হবার… তো ওইটে ছিল আমাদের একটা ঠেক… অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম পাশাপাশি… দেখতাম… নিচু স্বরে কথা বলতাম, ছুটির পর কিম্বা অফ পিরিয়ডে…
ন্যাড়া ছাদটার তিনদিক ঘিরে উঁচু উঁচু গাছ… ‘যে যার ভূমিতে দূরে দূরে চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা…’ সে এক বিচিত্র গাছপাড়া…বাগান ছিলনা… ছিল এবড়োখেবড়ো ঘাসজমি পুকুরপার ছাড়িয়ে রাস্তার মোড় ওব্দি সিমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে এইসব উঁচু উঁচু গাছ… যাদের মাথাগুলো ওই ছাদ বরাবর জুড়ে গিয়ে বুনেছিল এক ঝুলন্ত নন্দনকানন… প্রচূর মরাল মরালীর বাসা সেখানে… তাদের অনেকেই এই শহরে, শুরুতে পারিযায়ী হয়ে এসে কানন পেয়ে দোচালা ঘর বেঁধেছে, কুটো দিয়ে, শুখা তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের যাযাবরবৃত্তি থেকে একদা বেরিয়ে এসে মাটির গুনে যেভাবে গৃহী হয়ে উঠেছিল আর্য্যরা…কাদাখোঁচা – হাড়গিলে – বক – সারস… সারাদিন ক্যাঁচর-ম্যাচর…ঝুলন্ত ছাদকানন জুড়ে ঝগড়ুটে পাখিপাড়া…তা, বৃষ্টিতে যখন সব ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ আবিষ্কার করা গেল, যে এক বেচারি খোঁড়া বক… একটু বয়েসও হয়েছে তার… ছাদের কার্নিসের কোণ থেকে কোণে ছায়া হাতড়াচ্ছে ! গাছ ওব্দি উড়ে যাওয়ার মতো ডানায় বাতাস নেই তার… উপরন্তু দুর্যোগ… আমরা বন্ধুরা বেশ অনেকবার চেষ্টা করলাম ওকে নিরাপদে শুখায় আনতে… কিন্তু হল তাতে হিতে বিপরীত ! পাখি টা ভয় পেয়ে আরো সরতে সরতে জলের দিকেই পিছোতে থাকল ক্রমশ ! আমরাও অগত্যা প্ল্যান বাতিল করে পিছিয়ে এলাম… পাখিটা আবার ছায়ায় চলে এল… অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম যে বিপদের মুখে সে বিভ্রান্ত হয়ে যায়নি…
তারপর সারাদিনই মনের একার্ধ পড়ে রইল তার পিটপিটে চোখে চিটচিটে পালকের আঠায় ! মঙ্গলবার… বুধবার… সারাদিন বৃষ্টি… বেষ্পতিবার থামল… পাখি, দেখলাম দিব্যি রোদ পোয়াচ্ছে… সে কি তৃপ্তি আমাদের ! বুঝলাম, কুলাহীন, পরিত্যক্ত, তিনকুলে কেউ নেই… আমরা শুকনো ডাঙার ছাদে গিয়ে খাবার দাবার রেখে এলাম ওর জন্যে… ভাঙা বিস্কুট রুটি যে যা পেলাম… পাখি দেখলাম যথেষ্ট সজাগ ও হুঁশিয়ার… আয় আয় ক’রে ডাকলে দূরে বসে পিটপিট ক’রে দেখে, আর, সরে এলে রেখে যাওয়া খাবার ঠুকরে খেয়ে যায়… ‘মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস…’ যাইহোক, সেদিন ঢের নিশ্চিন্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম যে যার !
পরের দিন কোথাত্থেকে কার কি খেয়াল কে জানে ! আবার মুষলধারে নামল… এমন নামল যে বেরোনোই গেলনা ঘর ছেড়ে ! ফোনে কথা হল… প্রার্থনা হল… রাতে বৃষ্টি ধ’রে এল… পরেরদিন দেখতে দেখতে চড়চড়িয়ে রোদও উঠে গেল… কলেজে এসে যথারীতি প্রথমেই এক ছুটে বারান্দায়…যথারীতি, পাখি টা কোথাও নেই… ক্লাস শেষে চিরুনি তল্লাশি হল বন্ধুদের ! পাওয়া গেলনা কোত্থাও…
গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ হতে পারত… টলটলে বুকের ভার নিয়ে অন্য গল্পে ঢলে পড়া যেতে পারত বেমালুম ! কিন্তু হল না ! পরেরদিন টিফিনে পুনরাবিষ্কার করা গেল পাখি টাকে… কার্ণিসের কিনারে… একটু যেন নিঃস্পৃহ… ক’দিনের ভারী বর্ষন আর চড়া রোদের খামখেয়ালিতে যতটা না বিস্মিত তার চে বিরক্ত বেশি… নির্জনতালোভী… যেন তার ছেড়ে আসা গ্রামদেশ তার বিগতযৌবন তাকে বেমানান মেদুর করে রেখেছে এক উদাস নেশায়… সেই আড়াল ভাঙতে পা সরেনা… আমরাও ক্রমে ক্রমে পর্বান্তরে চলে এলাম তারপর… কত কি ঘটছে চারপাশে আরো ঢের জাগতিক মহাজাগতিক… তদুপরি, সেমেস্টার…সে বয়েসের ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের বাড়াবাড়ি…
… সুবচনীর খোঁড়া হাস আমাদের টপটপে হৃদাকাশ থেকে এক ছোট্ট নীল রিদয়’কে পিঠে নিয়ে উড়ে গেল কোন চখা নিকোবরের বাঞ্জারার দলে… দুদিন পর শশব্যাস্ত ছুটদৌড়ের মধ্যেও তাকে একঝলক দেখতে পেলাম… ধীরে বেখেয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছে কার্নিস ধ’রে… এককালের অবাধ আকাশচারণার স্মৃতির লাঠিতে ভর ক’রে…
তিনদিনের দিন সকালে খুব একছটাক ইলশেগুঁড়ি হল… যেন কদিন আগের আকাশভাঙার খোঁয়ারি না-কাটা মেঠো-রগড়… সেদিন বিকেলে চোখে পড়ল খণ্ড খণ্ড মাংসল পালক ছড়ানো ছাদের একদিকে ! এতটাই অখাদ্য ছিবড়ে যে অন্য পাখি দেরও গা নেই… ‘যেহেতু সকলে জানে তার সাদা পালকের নিচে…’
পুরো এপিসোডটা একটা রহস্য-বিষাদ হয়ে থেকে গেল…সেভাবেই থেকে যেতে পারত ! কিন্তু সেখানেও শেষ নয়… শীতের সেমেস্টার এসে পড়ল মাস ছয়েক পর ! জীবনে নানান অশান্ত উত্তেজনা… সেবার পরীক্ষা শুরুর দু’হপ্তা আগের স্টাডি লিভের দুপুরগুলো গড়পারের বাড়ির ছাদে চলে আসতাম বইখাতা নিয়ে… মান্ধাতার আমলের বাড়ি আমাদের… ছাদে খসখসে ধুলোটে টাইলস বসানো…সেরকম দুটো টাইলের মধ্যিখান থেকে কি জানি কি করে দেখি মাথা তুলে উঠেছে একটা ক্ষণজন্মা খুদে বটচারা… জল নেই… ধুলো-ওড়া শুখা শীত…তবু, নাছোড়বান্দা প্রাণের অবিশ্বাস্য চাক্ষুষ সত্যি ! বই হাতে পায়চারি করতে করতে সেই নিঃশব্দ চারা হয়ে উঠল আমার আশ্চর্য্য অলীক সঙ্গী… মাঝেমাঝে থেমে থেমে গায়ে হাত বুলিয়ে দি, অতি সন্তর্পণে…পরক্ষণেই আবার মন ফেরাতে হয় সিলেবাসের দিকে… একদিন সকালে ছাদে গিয়ে আর দেখতে পেলামনা ! চিহ্নমাত্র নেই ! ছায়াবাজি ? উড়ে গেছে দূরে ? দেখতে দেখতে এক অবাক হুতাশ বুক জুড়ে ঘন হল ! হঠাৎ অযত্নের তুলশীর টবের পাশে চোখে পড়ল… নিচে শুয়ে আছে… অমলীন… যেন দেবশিশু… চোখ, আদরে বোজানো… বুক নিংড়ে ককিয়ে কান্না পেল ! আর, গ্যালো-আষাঢ়ের সেই উলোঝুলো বুড়ো পাখি টার সেই মাংসল পালকের খণ্ড খণ্ড ছড়িয়ে পড়ে থাকার ভারী ও ঝাপ্সা জলছবিখানা ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই হতে থাকল… বন্ধ ভেজা চোখের ভেতরে ধাক্কা মারতে থাকল ঢেউয়ের পর ঢেউ… তুচ্ছ অতীত… তবু, ‘স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে’ হয়তো ‘কিছু বেশি’…
উদ্ধৃতিঋণ – বিনয় মজুমদার; যুগান্তর চক্রবর্তী