মেরু-নিশীথের নাবিকেরা
সপ্তম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
‘ছোট’ ও ‘ছোট্ট’ দুটি মেয়ে
পুরুষের ‘প্রথম’ ও ‘শেষ’ বীজ প্রদানের মধ্যে শুয়ে থাকা সময় কি আসলে দীর্ঘ এক বিস্মরণ প্রক্রিয়া?
নিজের ঔরসে সন্তানের জন্ম দিতে দিতে সে পেরিয়ে চলেছে দীর্ঘ অন্ধকার প্রান্তর… প্রত্ন-ভূমি। মাঝে মাঝে ফিরে তাকাচ্ছে; আক্রান্ত হচ্ছে বিষাদে। তাকে আপাদমস্তক ছেয়ে ফেলছে গূঢ়, অনির্বাচ্য অধিকারবোধ। তার হাত থেকে হয়তো পুরুষের মুক্তি নেই। সে বিষণ্ণ হচ্ছে, বিস্মৃত হচ্ছে… বিস্মৃতি থেকে ক্রমাগত প্রসব হয়ে চলেছে বিষণ্ণতার ধারা।
শেষ বীজ দান করার পর সে কি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যায় প্রথম বীজের স্মৃতি! জীবনানন্দ দাশের একটি লেখার ভেতর ফুটে ওঠা অন্তর্নাট্যের দিকে তাকিয়ে বারবার মনে হয়েছে এ কথাটি। সে লেখাটির কাছে পরবর্তী সময়ে ফিরে আসা যাবে, কয়েকটি কথা বলার পরই সে লেখার কাছে গিয়ে বসা সঙ্গত হবে। কারণ পুরুষ ও বিস্মরণের যে পথের দিকে আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে গেছেন জীবনানন্দ তার সাপেক্ষে (বিপ্রতীপে না-হলেও) আরেকটি পথের সন্ধানও তো পেয়েছি আমরা সেই কবেই।
সব থেকে আশ্চর্যের, দু’জন কবির এ দুটি কবিতাই ‘ছোট্ট’ ও ‘ছোট’ মেয়েকে আশ্রয় করে লিখিত হয়েছিল।
‘ছোট্ট’-মেয়েকে নিয়ে লেখা কবিতাটির সামনে আজ এসে দাঁড়ালে রোমাঞ্চ লাগে। হয়তো এ কবিতাটির সব থেকে ভিতরে প্রবেশ করবার অধিকার রয়েছে একমাত্র কন্যাসন্তানের পিতাদের। পরমুহূর্তেই মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত পিতা তাদের মানসকন্যার পিতা। কন্যাসন্তানের জন্ম দেবার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে সংযুক্ত করে নিচ্ছে এ রহস্যময় সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সঙ্গে।
‘গীতাঞ্জলি’ ‘বলাকা’র পর ১৩২৫ বঙ্গাব্দে কেন রবীন্দ্রনাথ-কে ‘পলাতকা’ প্রকাশ করতে হল, একটা সময়ে এ প্রশ্নটি তাড়া করে বেড়িয়েছে। এখন মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতর জগতের দিকে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ‘পুনশ্চ’ থেকে ‘শেষ লেখা’ পর্যন্ত সে পথের শুরুতে একটি ‘পলাতকা’র প্রয়োজন ছিল। প্রাচ্য-রহস্যের ঘেরাটোপে তিনি নিজেকে বন্দি রাখতে চাইছিলেন না যেন, বিশেষ করে কবিতায়। একটা বিশেষ সময়ে যাকে নিছক কাহিনি বলে মনে হত এখন তার সামনে এসে দাঁড়ালে সহজের রহস্য দেখতে পাই। ঠিক যেমন এ মুহূর্তে ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতাটি সে রহস্য নিয়ে আমার সামনে জ্বলজ্বল করছে।
কবিতাটি অতি-পরিচিত, একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার ভঙ্গিটি পঙক্তি-বিন্যাস ও শব্দে ধরে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথম তিনটি পঙক্তির পরই শুরু হয়ে যাচ্ছে আপাত-সরল অথচ রুদ্ধশ্বাস এক নাটক। প্রতিদিনের, চির-চেনা এক ঘটনা, একটি ছোট্ট মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ‘সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে।’
রবীন্দ্রনাথ অকল্পনীয় ভাবে ব্যবহার করলেন দুটি শব্দ – ‘থেমে থেমে’। মৃদু ভয় থেকে উৎপন্ন হতে শুরু করল দ্বিধা।
যে সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে অন্ধকারে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে ওই যে অন্ধকারটুকু- এ পথ কীভাবে পার হবে সে?
হাতে তার প্রদীপ রয়েছে, রয়েছে হাওয়ার ঝাপট’ও। মুহূর্তে আলো নিভে অন্ধকার হয়ে যেতে পারে সিঁড়ি। ফলে সেই মেয়ে ‘আঁচল দিয়ে আড়াল করে চলছিল সাবধানী’।
সপ্তম পঙক্তি’তে এসে একটি ফ্রেম সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছিল আরেকটি ফ্রেম’কে। সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছিল ‘আমি’, এক আমি-র দেখা।
এ আমি ওই ছোট্ট কন্যার পিতা, তাঁর মাথার উপর ঝলমল করছে তারায়-ভরা চৈত্রমাসের আকাশ। এ পৃথিবীর একটি ছোট্ট-মেয়ের থেকে কবিতাটিকে নক্ষত্রমণ্ডলে উড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করলেন ফ্রেমটিকে।
পর পর বেশ কিছু কনট্রাস্ট আছড়ে পড়ল, অথচ চরম সাবলীলতায় তারা প্রবেশ করল কবিতাটির শরীরে। বিন্দুমাত্র বাহ্যিক আলোড়ন দেখা দিল না কোথাও।
মেয়েটির হাতে একটি মাত্র প্রদীপ; আকাশে অগণন তারা।
মেয়েটি ছোট্ট, আকাশের বিপুল বিস্তার।
এবং এ দুটি ফ্রেমের মাঝখানে বসে রয়েছেন এক পিতা, তিনি সচকিত হয়ে উঠছেন মেয়ের কান্নায়।
যে ইঙ্গিত ছিল প্রথম ছয়টি পঙক্তি জুড়ে তাই যেন পরিণতি পাচ্ছে এবার।
মেয়েটির প্রদীপ নিভে গেছে, অন্ধকার হয়ে গেছে তার নীচে নেমে যাবার সিঁড়ি।
একটি ছোট্ট প্রাণ কেঁপে উঠছে অজানা আশঙ্কায়।
অতি-চেনা পথে সে হারিয়ে গেছে। আকাশের বিপুল বিস্তারে ফুটে থাকা অগণন তারাও সে ‘এক্সপেরিয়েন্সার’-এর ভয়কে দূর করতে পারছে না।
ব্যক্তিগত অন্ধকারে আলোর ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে তুচ্ছ হয়ে আসে কোটি কোটি মাইল দূরে ফুটতে থাকা নক্ষত্রমণ্ডল।
আগে তেমন করে অনুভব করতে পারিনি; এখন মনে হয় এই ‘হারিয়ে যাওয়া’র বোধ আসলে কী? তা হলে কি একটি প্রদীপ-শিখা আমাদের সংযুক্ত করে রাখে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলির সঙ্গে? এভাবেই কি নির্ধারণ হয়ে থাকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বিষয়ের সঙ্গে সত্তার সংলগ্নতা? না কি আরও একটি প্রশ্ন তুলে রাখা যায় পরাপাঠের জন্য, মেয়েটি তার হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে সচেতন… এটি কি আমাদের এ সিদ্ধান্তেই পৌঁছে দেয় না যে মেয়েটির সঙ্গে তার সমস্ত পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি! আসলে সে সংযুক্ত হয়ে রয়েছে, অথচ তার সত্তা সেই সংযোগটিকে আবিষ্কার করতে পারছে না।
এ প্যারাডক্সের শেষ নেই, তল নেই হয়তো।
এরপর অন্তিম ফ্রেমটি আবির্ভূত হচ্ছে, মেয়ের কান্না শুনে নিয়ে (হয়তো তাকে ‘সাবধানে’ নীচে নামার পথ অতিক্রম করিয়ে দিয়ে) আবার ছাতে ফিরে গিয়েছেন বাবা। তিনি চেয়ে রয়েছেন আকাশের দিকে, তিনি দেখছেন তার মেয়ের মতোই ‘অমনি কে এক মেয়ে’ আঁচল দিয়ে দীপশিখা আড়াল করে আকাশের প্রান্তর পেরিয়ে চলেছে।
তাঁর আত্মজা রূপান্তরিত হচ্ছে মহাজাগতিক কন্যায়।
তারপর তারা-ভরা আকাশে ফুটে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। একে একে নিভিয়ে দিচ্ছেন তারাগুলিকে, শুধু এটা দেখার জন্য যে আলো হারিয়ে ফেলার পর আলো-হারানো মহাজাগতিক-কন্যা কীভাবে কেঁদে উঠবে। লক্ষ করার, তারারা আর পৃথক পৃথক অস্তিত্ব বহন করছে না এখন; তারা সব-মিলিয়ে একটিই প্রদীপে রূপান্তরিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন এক আলো-হারা ব্রহ্মাণ্ডের সামনে, দেখছেন তার রূপ।
আলো-অন্ধকারের বিচিত্র রূপ নিয়ে রবীন্দ্রগানের শেষ নেই, ঠিক যেমন এ কবিতাটি পড়তে পড়তে, গীতবিতানের পাতা উলটে চলার সময় আবার সেই গানটির সামনে এসে থমকে যেতে হয়,
‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।
কখন তুমি এলে, হে নাথ, মৃদুচরণপাতে?
ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী, তোমায় বুঝি হারাই আমি-
আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে।।
যে নিশীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো
তারি মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো।
তোমার পথে চলা যখন ঘুচে গেল, দেখি তখন
আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে।।’
-ভাবতে অবাক লাগে, এত এত আলোর উল্লেখ যাঁর গানে-কবিতায়, তিনি পিতা-রূপে, সখা-রূপে, ভক্ত-রূপে বারবার অন্ধকার দেখতে চেয়েছেন। জীবনানন্দ অন্ধকারের যোনির ভেতর যে অন্ধকার প্রত্যক্ষ করেছিলেন এ-অন্ধকার তার থেকে বহুদূরের। ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতাটিতে একদম শেষে এসে রবীন্দ্রনাথ ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, এ গানে তিনি সুস্পষ্টভাবে লিখছেন নিজের হাতে আলো নিভিয়ে দেবার কথা।
আলো-নেভা অন্ধকারে জ্বলে উঠছে ‘তার’ ধ্রুবতারা। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সেই ব্রহ্মাণ্ড-সরোবর অন্ধকারের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকার আর কেইবা আছেন!
‘ছোট্ট’ মেয়েটিকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটির সঙ্গে পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশের ‘ছোট’ মেয়েটিকে নিয়ে লেখা কবিতাটি পাঠ করা শিহরিত করে তোলার মতো এক অভিজ্ঞতা।
যে প্রশ্নটি দিয়ে এ লেখা শুরু হয়েছিল সেটি আসলে অনেক বেশি জীবনানন্দের কবিতাটির সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে। জীবনানন্দের কবিতাটির প্রথম দু’টি পঙক্তি এরকম,
‘আমার এ ছোটো মেয়ে- সবশেষ মেয়ে এই
শুয়ে আছে বিছানার পাশে’ (মেয়ে)
-‘সবশেষ’ শব্দটি তীব্র, ভয়ংকর- এর পর কোনও সন্তান আসার সম্ভাবনা নেই আর। এখান পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে এ মেয়ে রক্তমাংসের মেয়ে (এবং শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেখা যাবে, এ মেয়ে রক্তমাংসেরই মেয়ে)- কিন্তু চতুর্থ পঙক্তি’তে জীবনানন্দ লিখলেন, ‘হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে মাঠে মাঠে আকাশে আকাশে ।…’
বারবার সরে সরে যাওয়া যে ফ্রেমের প্রসঙ্গ এসেছে ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতাটির ক্ষেত্রে এখানেও সে ফ্রেমের উপস্থিতি। পঞ্চম পঙক্তি’তে এসে এখানেও আবির্ভূত হল আরেকটি ফ্রেম, ‘সবশেষ’ মেয়ের জায়গায় এল প্রথম মেয়ে।
এবার একবার জীবনানন্দীয় ‘নিষ্ঠুরতার’ দিকে তাকানো যাক, তিনি লিখছেন, ‘ভুলে যাই ওর কথা- আমার প্রথম মেয়ে সেই / মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন’।
কার কথা ভুলে যাচ্ছেন জীবনানন্দ এখানে? ভুলে যাচ্ছেন ‘সবশেষ’ মেয়েটির কথা, অথচ তার বর্ণনা দিয়েই কবিতাটি শুরু হয়েছিল মাত্র চারটি লাইন আগে।
এরপর ফুটে উঠতে থাকে আরও গূঢ় এক নাটকের ইশারা, মেয়েটি তার বাবাকে প্রশ্ন করে,
‘ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি- আজো মনে করো?’
দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই
আমার চোখের ’পরে, আমার মুখের ’পরে মৃত মেয়ে;’
-মৃত্যু এক ধরণের বিস্মরণ; তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের প্রশ্ন ‘-আজো মনে করো?’। কিন্তু এখানে প্রায় এক কনফেশন রয়েছে, তা হলে কি জীবনানন্দ বলতে চাইছেন যে তিনি আসলে প্রথম মেয়ের কথা ভুলে গেছিলেন? কারণ তিনি একই পথে ভুলে গেছেন ‘সবশেষ’ মেয়েটির কথা।
বিস্মরণের অতল থেকে ফিরে আসছে প্রথম মেয়ে। বিস্মরণের অতল থেকে সম্পূর্ণ কল্পনায় প্রথম মেয়ে পুনর্নিমিত হয়ে চলেছে,
‘তবু তারে চাই আমি- তারে শুধু- পৃথিবীতে আর কিছু নয়
রক্ত মাংস চোখ চুল- আমার সে মেয়ে
আমার প্রথম মেয়ে- সেই পাখি- শাদা পাখি- তারে আমি চাই;
সে যেন বুঝিল সব- নতুন জীবন তাই পেয়ে
হঠাৎ দাঁড়াল কাছে সেই মৃত মেয়ে।’
– শিল্পের কাছে এসে পরাজিত হয়ে যায় সব ঔচিত্য; অন্তত জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে বারবার সে কথাই মনে হয়। না-হলে পরের ছয়’টি পঙক্তি লিখিত হত না,
‘বলিল সে; ‘আমারে চেয়েছ তাই ছোটো বোনটিকে-
তোমার সে ছোটো-ছোটো মেয়েটিরে এসেছি ঘাসের নীচে রেখে
সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এত দিন
ঘুমাতেছিলাম আমি’- ভয় পেয়ে থেমে গেল মেয়ে,
বলিলামঃ ‘আবার ঘুমাও গিয়ে-
ছোটো বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।’
-প্রথম মেয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ‘সবশেষ’ মেয়েটির আগমনের পথ; বাংলার গ্রামগঞ্জে লোককথায় এমন আখ্যান বিরল নয়। কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয় বাবার ভূমিকায় কবির (পোয়েট পারসোনা) কথায়।
যে প্রথম মেয়েকে তিনি বিস্মরণ থেকে তুলে ‘নির্মাণ’ করলেন তাকে এক লহমায় আবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, বিস্মরণের অতলের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন কবি। তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে উঠছে ‘সবশেষ’ মেয়েটিকে পৃথিবীতে আনা।
সৃষ্টির পথে অস্থিরমতি পুরুষ কি তার সব শেষ বীজের পরিপূর্ণতা দেখতে বেশি উদগ্রীব? তার সমস্ত বিষণ্নতা, কল্পনা, হাহাকার নিয়েও কি সে এ ক্ষেত্রে অসহায়? অথবা এই অসহায়তা থেকেই কি তার যাবতীয় বিষণ্ণতা ও হাহাকারের শুরুয়াৎ?
জীবনানন্দের কবিতাটির শেষ ছটি পঙক্তি উদ্ধৃত করা যাক,
‘ব্যথা পেল সেই প্রাণ- খানিক দাঁড়াল চুপে- তারপর ধোঁয়া
সব তার ধোঁয়া হয়ে খ’সে গেল ধীরে ধীরে তাই,
শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়ায় সে একবার
কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক-
চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে- আর কেউ নাই।’
-আবার স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়, যে বাবা প্রথম মেয়েকে ঘুমের অন্তরালে ঠেলে দিয়ে সবশেষ মেয়েটিকে আনতে চেয়েছেন তিনি ‘হৃদয়হীন’ নন; কারণ তাঁর কথায় প্রথম মেয়েটি যে ব্যথিত হয়ে উঠছে তা তিনি অনুধাবন করছেন। এ অনুভূতিপ্রবণ সত্তা নিয়েও তিনি দুর্জ্ঞেয় কোনও কারণে এক ‘আপাত’-নিষ্ঠুরতার ভিতর প্রবেশ করছেন। কেন যে তাঁর কাছে ‘সবশেষ’ মেয়েটি অধিকতর প্রার্থিত হয়ে উঠছে তার কারণ আবিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব।
আমরা কয়েকটি সম্ভাবনা নিয়ে ভাবিত হতে পারি, ছটফট করতে পারি মাত্র।
তাকিয়ে থাকতে পারি সে দিগন্তের দিকে, যেখানে আপন ঔরষে জন্মানো ছোট্ট একটি মেয়ের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ একে একে তারাগুলি নিভিয়ে দিচ্ছেন, কল্প-দর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং জীবনানন্দ অসম্ভব বেদনার ভেতর বসে নিঃশব্দে ভেঙে দিচ্ছেন শিল্প-সাহিত্যে ঔচিত্য-কেন্দ্রিক ধারণা।
দুটিই সমান সত্য ও ভয়ংকর ‘সুন্দর’।
আশ্চর্য আবিষ্কার!!!