বনহংসী, হোয়াইট বার্ড অথবা হোজ্জাত হামিদির একটি ছবি  <br /> কুন্তল মুখোপাধ্যায়

বনহংসী, হোয়াইট বার্ড অথবা হোজ্জাত হামিদির একটি ছবি
কুন্তল মুখোপাধ্যায়

হোজ্জাত হামিদির উপরের ছবিটি দেখে জীবনানন্দের অমোঘ কবিতাটি মনে পড়ল । প্রসঙ্গত জানাই, হামিদির ইরানে বাড়ি । আরদাবিল নামে একটি জায়গায় থাকেন তিনি । মোবাইল ফটোগ্রাফি করেন । তাঁর ছবিতে ধরা পড়ে ইরানের নিসর্গ , সেখানকার গ্রামজীবন আর গ্রামাঞ্চলে থাকা মানুষদের বিভিন্ন কর্ম -প্রবণতা । তিনি এত সুন্দর ছবি তোলেন যে তাদের অনেকগুলোই মনে হয় যেন পেইন্টিং । হোজ্জাত হামিদি’র কিন্তু জীবনান্দের কবিতা পড়ার কথা নয়, কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমি যদি হতাম’ কবিতাটির সঙ্গে তাঁর তোলা ছবিটির মিল রয়েছে ! অন্তত ছবিটি কবিতাটির কাছাকাছি তো আছেই । একই কথা ইয়েটস-এর কবিতাটি নিয়েও । কবিতাটির নাম- দ্য হোয়াইট বার্ডস । সেখানেও প্রায় একই ছবি । কবি ইচ্ছে প্রকাশ করছেন যে তিনি এবং তাঁর প্রেমাস্পদ যদি সফেন সমুদ্রে দূতি শাদা পাখি হয়ে থাকতেন ! চিত্রকল্প খানিকটা এক হলেও একই কথা বলে তা কিন্তু নয় , এরা একে অপরের স্পর্শক হয়ে থাকে । তবু একটার সঙ্গে আর একটার তুলনা কেন করি আমরা ? একটা সৃষ্টির সঙ্গে আরেক সৃষ্টির মিল দেখিয়ে আরেকটাকে ছোট করতে? সবসময়ে সেটাই কি আমাদের লক্ষ্য থাকে নাকি ? নাকি একটি ছবির সঙ্গে আরও দুখানা কবিতাকে বুঝতে গিয়ে প্রত্যেকের জন্যেই একটা তুলনামূলক স্পেস তৈরি করতে চাই আমরা । যে স্পেস-এ দাঁড়ালে প্রত্যেককেই প্রত্যেকের আলোতে দেখতে পাওয়া যায় ? অন্তত যেখানে অন্ধকার ! তবে হামিদি ছবিতে নৈঃশব্দ্যে যা বলেছেন, জীবনানন্দ সেই বিষয় ছুঁয়ে তাকে অনেক দূর নিয়ে গেছেন । সে ইয়েটস-এর কবিতার থেকেও অনেক দূরে । কবিতা হয়ত এমনই লেখ মাধ্যম যার মাধ্যমে এমনই বহুদূর যাওয়া সম্ভব হয়ে যায় । অন্তত মহান কবিরা সেটা পারেন ।

আমি যদি হতাম

আমি যদি হতাম বনহংস

বনহংসী হতে যদি তুমি

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে

ছিপছিপে শরের ভিতর

এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে

ঝাউয়ের শাখার পিছনে চাঁদ উঠতে দেখে

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে

আকাশের রুপোলি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে

দিতাম–

তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার

পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন—

নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের

মতো অজস্র তারা,

শিরীষ বোনের সবুজ রোমশ নীড়ে

সোনার ডিমের মতো

ফাল্গুনের চাঁদ ।

হয়ত গুলির শব্দ :

আমাদের তির্যক গতিস্রোত,

আমাদের পাখায় পিসটোনের উল্লাস,

আমাদের কণ্ঠে উত্তর হওয়ার গান ।

হয়ত গুলির শব্দ আবার :

আমাদের স্তব্ধতা,

আমাদের শান্তি ।

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু

আর থাকত না;

থাকতো না আজকের জীবনের

টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার ;

আমি যদি বনহংস হতাম

বনহংসী যদি হতে তুমি:

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে ।

এই কবিতাটিতে একটি লাইন ভারী অবাক করার মতো । ” আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস” । এই লাইনটি সমস্ত কবিতায় আশ্চর্যভাবে বেমানান । অথচ বেমানান হলেও এখানে ‘পিস্টন’ শব্দটা একটা যন্ত্রসভ্যতার দ্বার খুলে কি দিচ্ছে না ? কবিতাটা পড়তে পড়তে দেখা গেল যে কবি আশা করছেন যে তিনি আর তাঁর ‘তুমি’ যদি বনহংসী হতেন ! হওয়ার পর একটা স্পেশ ।

এই স্পেসটার মধ্যে কী এমন ঘটে গেল যে তিনি আর তাঁর ‘ তুমি’ সত্যিই হয়ে গেলেন বনহংসী । মনে হল আরে এটাই তো কবিতার ম্যাজিক । এখানে অনেকেরই মনে পড়বে কিটস এর কবিতার কথা । নিজেই হয়ে গেলেন বনহংসী । আর রূপকথার ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পিছনে চাঁদ দেখতে তিনি নিম্নভূমির ‘জলের গন্ধ’ ছেড়ে উড়ান দিয়েছেন । আর নিসর্গদর্শন করছেন । দেখছেন চাঁদ । দেখছেন নক্ষত্র । এই জাদুর দেশে উড়তে উড়তে হঠাৎ গুলির শব্দ পাওয়া গেল । কিন্তু তা হারাতে পারলো না পাখিদের। এসময়েই সেই অদ্ভুত লাইনখানা এলো – :আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস’ । এইখানে ‘পিস্টন’ শব্দটার ব্যবহার অবাক করে দেয় না ? কেন মনে এলো এই শব্দ ? পিস্টনের উল্লাস !! এই প্রাণে বেঁচে যাওয়ার উল্লাস পিস্টনের কেন হবে ? পাখায় তো হাওয়া লেগে একটা অদ্ভুত শব্দ হয় । আমরা যারা গ্রামের মানুষ , আমরা যারা পাখি-ওড়া সকাল দেখেছি , জানি ডানার শব্দ হয় । সেই শব্দ তো কখনো পিস্টন মনে হয়নি । এই জায়গাটিতে এসে আমার মনে পড়লো একটা খেলনা পাখির কথা । তার দুটি ডানা নড়লেই ভিতরের পিস্টনের শব্দ হত । তাহলে কি খেলনার সেই শব্দে কবির মনে হচ্ছে এই কল্পনা কল্পনা খেলা শিশুতোষ ? জীবনানন্দের এমন সরলতা থাকবে ? ভাবতে ভাবতে মনে হয় এ কেবল উড়ে যাওয়া আর নিসর্গদর্শন হয়ত নয় !! অন্য কিছু থাকতে পারে এখানে !! এই শব্দটাই কি তার প্রমাণ নয় ? মনে কি হয় না যে এ হল কবি আর কবির সঙ্গিনীর যৌনতা? বিশেষত পিস্টন যেখানে যৌনতার ইঙ্গিতবাহী !! এমন যৌনতা যেখান থেকে শিশুজন্ম হয় ? যার ইঙ্গিত দিয়ে রাখছেন কবি !! তাহলে ঐ উড়ে যাওয়া , জলের গন্ধ হঠাৎ গুলির শব্দ একেবারেই অন্যভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয় । কারণ গুলির শব্দের পর ,আমাদের স্তব্ধতা শব্দটার পর দেখা যাচ্ছে অদ্ভুতভাবে এসে যাচ্ছে আমাদের শান্তি শব্দটা । এই শান্তি কি মৃত্যুর ? নাকি সন্তোষের ? আমার দ্বিতীয়টা মনে হয় ।

কবিতাটি পড়তে গিয়ে পাঠকের আরও একটি কবিতার কথা মনে পড়বে । সেটা ইয়েটস-এর ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য রোজ’ কাব্যগ্রন্থের ‘দ্য হোয়াইট বার্ডস’ কবিতাটি ।

I would that we were , my beloved, white birds on the foam of the sea !

We tire of the flame of the meteor, before it can fade and flee;

And the flame of blue star of twilight , hung low on the rim of the sky,

Has awaked in our hearts, my beloved, a sadness that may not die .

এই দুখানা কবিতা যে সম্পূর্ণ একই কথা বলছে তা নয় । তবে এই কবিতার মধ্যে এই যে গোধূলিসন্ধির ( এই শব্দটিই ব্যবহার করলাম) নক্ষত্রের আলো অথবা উল্কার শিখা যা ক্লান্ত করে ফেলেছে এই মানব-মানবীর প্রেম আর এই যে নীচু হয়ে ঝুলে থাকা নীল নক্ষত্রের আলো যা হৃদয়ে জাগিয়ে তুলছে এক বিষণ্ণতা ,এ কি একেবারেই জীবনানন্দীয় নয় ? কিন্তু জীবনানন্দের কবিতাটি “হয়ত গুলির শব্দ”-এর পরে একেবারেই অন্যদিকে চলে গেল । সেই অপ্রত্যাশিতের দিকে বাঁক নিয়ে সে যে কতরকম রঙ আর স্তর সৃষ্টি করলো তার একটির (খুব ব্যর্থতার সঙ্গে হলেও) লিখিত রূপ উপরে রেখেছি । অন্যদিকে ইয়েটস-এর এই কবিতাটি যে আদ্যন্ত একটি প্রেমের কবিতা রয়ে গেল তাতেও তার মহিমা এতটুকুও কি কমে যায় ? অথবা হামিদির ছবিখানা যা কৃষ্ণকালো একটি আবহে আঁকা হয়েছে ! সেখানে দুটো শ্বেত শুভ্র হাঁস যেন মুক্ত আর নিস্পাপ প্রেমের চিহ্ন , এত তীব্র সেই সাদা যে সমস্ত ছবিতে সেই দুটি হাঁসই আমাদের আকর্ষণ করে । তার সঙ্গে দর্শক যুক্ত হয়ে নিজেকেও অনবধানে যোগ করে নিতে পারেন । দূরের ধূসর শহর বা মানুষের ঘরবাড়ি থেকে এই প্রেম অনেক দূরে । ইয়েটস-এর সেই সফেন সমুদ্রও নয় বা জীবনানন্দের উড়ে চলা বনহংসীও নয় তবু এই ছবিও এই দুই শিল্পকর্মের কাছে নিয়ে আসে আমাদের !

আমার বিস্ময় শুধু এই জায়গাতে যে তিনটি দুরের নক্ষত্রের আলো কী আশ্চর্যভাবে একে অন্যের উপরে পড়লো ! সময় পেরিয়ে স্থান পেরিয়ে ! গ্রীক ভাবুকেরা যে তিনখানি ঐক্যের কথা ভেবেছিলেন ( টাইম , প্লেস আর একশান) , তা বোধহয় কবিতায় একেবারেই খাটে না , কারণ আমার কাছে এই তিনখানি অপূর্ব সৃষ্টির সবটা মিলিয়ে একটা মহাকবিতা !

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    SOUMANA DASGUPTA 3 years

    অসম্ভব ভালো লেখা! বিশেষত এধরনের লেখায় যে তাত্ত্বিক কচকচানি থাকে, তার মধ্যে না ঢুকে গভীর বোধের জগতে নিয়ে গেছ লেখাটকে। এটাই তোমার গদ্যের সিগনেচার, এ কারণেই এত ভালো লাগল।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    410 Gone

    410 Gone


    openresty