
নিজার কব্বানি-র কবিতা
অনুবাদ : সন্দীপন চক্রবর্তী
নিজার কব্বানি ( ১৯২৩-১৯৯৮) ছিলেন সিরিয়ার জাতীয় কবি। একাধারে তিনি ছিলেন সিরিয়ার কবি,লেখক, প্রকাশক এবং কূটনীতিবিদ। মা ছিলেন তুর্কী এবং বাবা ছিলেন আরব। পুরনো দামাস্কাসে জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা। সেকালের দামাস্কার বিশ্ববিদ্যালয় ( যা এখনকার সিরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়( সেখান থেকে আইন নিয়ে পড়াশুনো করেন। রোমান্টিক গীতিকবিতা সমৃদ্ধ ‘ব্রুনেট টোল্ড মি’ সে সময়েই বেশ সাড়া ফেলে দেয়। নারীশরীরের বিবরণ থাকায় রক্ষণশীলদের নজরে পড়ে যান তিনি। যদিও, সে সময়কার সিরিয়ার জাতীয় নেতা এবং শিক্ষামন্ত্রী মুনির-আল-আজিয়ানির হস্তক্ষেপে ও লিখিত ভূমিকায় কব্বানি এই বিতর্ক থেকে মুক্তি পান। এর পর কবি সিরিয়ার বিদেশমন্ত্রকে যোগ দেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। তাঁর কবিতার সারল্য, অভিনব চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং অন্তর্লীন দুঃখবোধ কবিতাগুলির মধ্যে অন্য মাত্রা এনে দেয়।
ক্লাসিক পোয়েট্রি সিরিজে প্রকাশিত নিজার কব্বানির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন সন্দীপন চক্রবর্তী
আঁকা শেখার পাঠ
আমার ছেলে আমার সামনে তার রঙের বাক্সটা রাখে
আর বলে তার জন্য একটা পাখি এঁকে দিতে
ধূসর রঙের ভিতর চুবিয়ে নিই তুলি
আর এঁকে ফেলি তালা ও গরাদ দেওয়া একটা চৌকো
তার দু’চোখে উপ্চে ওঠে বিস্ময় :
‘…কিন্তু এটা তো একটা জেলখানা, বাবা,
তুমি কি জানো না, কী করে একটা পাখি আঁকতে হয়?’
আমি তাকে বলি ‘মাপ করে দে, বেটা।
ভুলেই গেছি পাখি কেমন দেখতে।’
আমার ছেলে আমার সামনে রাখে তার আঁকার খাতা
আর আমাকে বলে গমের শিষ এঁকে দিতে।
আমি পেন ধরে থাকি
আর এঁকে ফেলি একটা বন্দুক।
আমার মূর্খামি দেখে উপহাস করে আমার ছেলে,
বলে,
‘তুমি কি এটাও জানো না, বাবা, কত তফাৎ
গমের একটা শিষ আর একটা বন্দুকের ভিতর?’
আমি তাকে বলি, ‘বেটা,
সে এক সময় ছিল, তখন আমিও জানতাম গমের শিষ কেমন দেখতে
ফুলো-ফুলো রুটি কেমন দেখতে
গোলাপ কেমন দেখতে
কিন্তু এই কঠিন সময়ে
বনের গাছপালাগুলোও নাম লিখিয়েছে
মিলিশিয়ায়
আর গোলাপ ঢেকে ফেলেছে নিজেকে নিস্তেজ অবসাদে
সশস্ত্র গমশিষের এই সময়ে
সশস্ত্র পাখিদের এই সময়ে
সশস্ত্র সংস্কৃতির এই সময়ে
সশস্ত্র ধর্মের এই সময়ে
তুমি এমন একটাও রুটি কিনতে পারবে না
যার ভিতর একটা বন্দুক নেই
মাঠ থেকে তুলে আনতে পারবে না এমন কোনো গোলাপ
যা তোমার মুখের দিকে কাঁটা উঁচিয়ে নেই
এমন একটাও বই কিনতে পারবে না তুমি
যা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে না আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে।’
আমার খাটের ধারে এসে বসে আমার ছেলে।
আর একটা কবিতা প’ড়ে শোনাতে বলে আমায়,
আমার চোখ থেকে বালিশের উপর ঝরে পড়ে একফোঁটা জল।
আমার ছেলে চেটে নেয় সেটা, হতবাক হয়, বলে :
‘কিন্তু এ তো অশ্রু, বাবা, কবিতা তো নয়!’
আর আমি তাকে বলি :
‘যখন তুমি বড় হবে, বেটা আমার,
পড়বে আরবি কবিতার দিওয়ানগুলো
আবিষ্কার করবে তখন নিজেই, শব্দ আর অশ্রু – এরা যমজ
আর আরবি কবিতা
তার একফোঁটা অশ্রুর বেশি আর কিছুই তো নয়, যে আঙুল লেখে।’
আমার ছেলে নামিয়ে রাখে তার পেন, রঙের বাক্স
আমার সামনে
আর আমাকে এঁকে দিতে বলে তার জন্য একখণ্ড স্বদেশ।
আমার হাতে তুলি কেঁপে কেঁপে ওঠে
ডুবে যেতে থাকি, কান্নায়।
প্রতিবার যখন তোমায় চুমু খাই
প্রতিবার যখন তোমায় চুমু খাই
দীর্ঘ এক বিচ্ছেদের পর
টের পাই
হুড়মুড় করে লেখা একটা প্রেমপত্র রেখে আসছি আমি
লাল এক ডাকবাক্সে
সংলাপ
কখনো বোলো না, আমার ভালবাসা
একটি আংটি অথবা বাজুবন্ধ।
আমার ভালবাসা সশস্ত্র এক আরক্ষাবেষ্টনী,
সে উদ্ধত এবং বেপরোয়া,
যে খুঁজে বেড়ায় মৃত্যুর দিকে পাড়ি।
কখনো বোলো না, আমার ভালবাসা
চাঁদের মতো।
আমার ভালবাসা এক স্ফূলিঙ্গ-বিস্ফোট।
শব্দ দিয়েই গোটা বিশ্ব জয় করবো আমি
শব্দ দিয়েই গোটা বিশ্ব জয় করবো আমি
জয় করবো মাতৃভাষা আমার,
ক্রিয়া, বিশেষ্য, বাক্যগঠনরীতি।
গোড়ার ওসব ধারা আমি বিদেয় করবো ঝেঁটিয়ে
আর এক নতুন ভাষায়,
যার ভিতরে বইছে জলের সঙ্গীত, আগুনের নানা বার্তা
ভবিষ্যকে আলো দেখাবো আমি
তোমার চোখে থামিয়ে দেবো সময়
আর মুছে দেবো সেই রেখা,
যা ছিন্ন করে দেয়
সময়ধারাকে, আমাদের এই ক্ষণমুহূর্ত থেকে
গ্রীষ্মে
গ্রীষ্মে
হাত পা ছড়িয়ে তটে শুয়ে থাকি আমি
তোমার কথা ভাবি
যদি সমুদ্রকে বলি
তোমায় নিয়ে কীসব ভাবি আমি,
তাহলে সে ছেড়ে আসবে তটভূমি,
তার ঝিনুক,
তার মাছ,
অনুসরণ করবে তখন আমাকে।
ভাষা
একটা লোক যখন প্রেমে পড়ে
কী ক’রে সে আর ব্যবহার করে ওই জরাশব্দগুলো?
পারে কি কোনো মেয়ে
চাইতে, যে তার প্রেমিক
শোবে গিয়ে কোনো
ব্যাকরণবিদ বা কোনো ভাষাতাত্ত্বিকেরই সাথে?
আমি কিচ্ছুটি বলি না
সেই মেয়েটিকে, যাকে আমি ভালবাসি
কেবল জমিয়ে তুলি
ভালবাসার বিশেষণগুলো একটাই স্যুটকেসে
পালিয়ে যাই সব ভাষার থেকে
কবিতাগুলি পড়লাম। কী সুন্দর সহজ ভাষায় কিন্তু অত্যন্ত গভীর ভাবের লেখা। পড়তে পড়তে ভিতরে কোথায় যেন একটা মুগ্ধতার বোধ জেগে উঠছে।
ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো