ধারাবাহিক গদ্য <br /> সেপিয়া রঙের গলি – তৃতীয় পর্ব <br /> অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ধারাবাহিক গদ্য
সেপিয়া রঙের গলি – তৃতীয় পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আয় না শহর পরবাস, আঙুল-ফাঁকে স্মৃতির ঘাস

ন্যাড়ামাথা বেঁটেখাটো ছেলেটি ঘাসের ওপর কবর খুঁজছে। চরম অস্বস্তিকর মুহূর্তেও হাসি পেল প্রেমিক-যুগলের। তারা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। আসলে প্রথম ছেলেটি খুঁজে চলেছে আড়াল। অল্প কিছুক্ষণ আগের নীতি-পুলিশি বদলে গেছে সহযোগিতায়। কারণ একটি, মাত্র একটি চুম্বনের মোটা দাম সে পেয়েছে। তার অপুষ্ট বুকের ময়লাটে সাদা পকেট থেকে উঁকি মারছে তিনটে নোট। ছেলেটি তৎপর। প্রেমিক-যুগলের ইচ্ছে মরে গেছে। শহরে বৃষ্টি নামল।

এই মাটি বৃষ্টির ঘরবাড়ি। রোদ পড়লেও রোদের সঙ্গে আড়ি। এখানে ছায়া ঘন হয়ে থাকে। দিনেরবেলায় চিরকালীন মরা বিকেল আটকে রেখেছে। মাটি হয়ে যাওয়া মানুষের ইতিহাসে বসে পালিত হয় জন্মদিন।

সদ্য প্রেম। এই বৃষ্টি এই রোদের দিনে একটি চিড়বিড়ে অসহ্য শহরে মেয়েটি বলেছে, ‘ছায়ার শহর দেখতে যাবি?’

এই কলকাতাকে সে চেনে। পুজোর আগের কলকাতা, লুকোনো হেমন্তের কলকাতা, চৈত্র সেলের কলকাতাকে সে চেনে। গাছ পড়ে যাওয়া গোড়ালি জলের সান্ধ্যকালীন পার্কস্ট্রিট, শীতের দুপুরের লাল-চা রঙের ময়দান, কুয়াশা কাটা আলোয় যাদবপুর রেলগেট, শরতের শোভাবাজার ঘাট সবটা সে জানে। ফলে এলিজাবেথ জেন বারওয়েলের শেষ আস্তানাও সে জানে। প্রেম ভাঙার শহরে ছায়া খুঁজতে ছুটল সে মেয়ে। সঙ্গী ছেলেটি বিশ্বাস করল তাকে।

এলিজাবেথ ও রিচার্ড বারওয়েল একটি হারিয়ে যাওয়া পরিবার। দূর দেশ থেকে আসা পরিবারটি নতুন কলকাতায় মরে গিয়েছিল। একটি গড়ে ওঠা শহরে মরে যাওয়ার গল্প ছিল সাধারণ। গোলাপি দরজা দিয়ে ভিতরে চোখ রাখলে শুধুই কি ছায়াঘন রাস্তা? শুধুই কি নিঝুম স্থাপত্যে গড়ে ওঠা কলেজ পড়ুয়ার হল্লা? তার চেয়েও বেশি কিছু। অল্পক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়ালে বোঝা যায়, সেই সাদা পাথুরে সময়কালের মধ্যে ধরা আছে মিথের ভারতবর্ষ, সন্ন্যাসীর ভারতবর্ষ, দক্ষিণরায়ের ভারতবর্ষ, কলেরা ম্যালেরিয়ার ভারতও।

আড়াইশ বছরেরও আগের কলকাতায় তৈরি হয়েছিল ‘গ্রেট ক্রিশ্চিয়ান বিউরিয়াল গ্রাউন্ড’। চার্চের ছত্রছায়ায় না থাকা বিশ্বের অন্যতম পুরনো কবরখানা। এই যে রাস্তা, দু’ধারে পসরা, টিনের বাসের প্রবেশহীনতা, সুদৃশ্য যানবাহনের ভিড়, তা সত্ত্বেও অভিজাত নিস্তব্ধতা, সেই কলকাতায় এই মাদার টেরেসা সরণীর নাম দেওয়া হল ‘বিউরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’। কবরখানার পথ। পলাশীর যুদ্ধের দশ বছর, খুলে গেল কবরখানা। পরবর্তীকালে স্যর ইলাইজা ইম্পে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন একটি ডিয়ার পার্ক। রাস্তার নাম বদলে হল আজকের পার্ক স্ট্রিট।

সদরের সাদা পাথর নাম লিখেছে, ‘SOUTH PARK STEET CEMETERY – OPENED – 1767 – CLOSED – 1790’ … একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়, বন্ধ হয়ে যাবার দিনটি তুলনামূলক বড়ো হরফে লেখা। সেকালের কলকাতায় ব্রিটিশ সৈনিক, শাসক ও তাদের পরিবার, রাইটার্স, ভাগ্যান্বেষণে আসা যুবক, যুবতী- সকলের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল এই কবরখানা। ১৭৮৫ সালে পার্কস্ট্রিটের উত্তরে তৈরি হয় আরও একটি কবরখানা। মৃতের সংখ্যার আধিক্য মাত্র তেইশ বছরের মাথায় দক্ষিণের কবরখানায় ‘নো ভ্যাকেন্সি’ নোটিশ ঝোলাতে বাধ্য করলেও, ১৮৩০ সাল অবধি চলেছিল এই কবরখানা।

দেশ স্বাধীন হবার পরের কথা। আর্থিক সহায়তা আসা বন্ধ হলে উত্তরের কবরখানা ভেঙে সেই আয়ের ওপর চলতে থাকে দক্ষিণের এই কবরখানাটি। আশির দশকে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট ভাঙতে দেননি এই স্থান। তাই আড়াইশ বছর পরে বারওয়েলের পরিবারের কবরে এসে বসতে পারে আগামী পৃথিবীর মেয়ে।

এই শহরে সেই মেয়ের হাত ধরে থাকে ছেলেটি। সে মেয়ে তাকে নিয়ে যেতে চায় মৃতের শহরে, পুরনো প্রেম ভাঙার কবরে। সে তাকে বলে ডিসেম্বরের উৎসব কলকাতার গল্প।

অচেনা দু’টি প্রাণ আলাদা শহরে বেড়ে উঠছিল। স্বপ্ন ও ভাবনার আলাদা জগতে মেয়েটি সন্ধান পায় কবরের। বড়দিনের জাঁক, তীব্র ভিড়ের পথ পেরিয়ে বারওয়েলের কবরের নীচে বসলে শান্তি মেলে। নরম শান্তি, ঠান্ডা হাওয়া, ছায়া ঘিরে থাকে। ঘাসে ফুল ফুটে থাকে। সেই যে পুরনো ছেলেটি সমাধির গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিল দুই শতক পরের কলকাতায়, তাকে মেয়েটি প্রশ্ন করেছিল, ‘একটি মৃত পরিবারের ওপর বসে তুই পরিবার তৈরির কথা বলছিস, মজার না?’

মেয়েটির নাকে নেমে আসা চশমা তর্জনীর ধাক্কায় উঠিয়ে দিতে দিতে পুরনো ছেলেটি বলেছিল, ‘এইখানে সব পরিবার মৃত। দেখতে যাবি?’

তারপরে চোখের সামনে খুলে গিয়েছিল একের পর সমাধি। আধাভৌতিক ছায়ায় কবরখানার বাঁধানো পথের দু’পাশে একের পর এক অন্য যুগের মন্দির যেন। গথিক স্থাপত্যের বেশ বড় সমাধিটি যেন কোন হারানো যুগের গ্রিক লাইসিয়াম। অথচ ধুলো ও শুকনো পাতার রাজ্য মেঝেয় লম্বাটে ছ’কোণা ভাগে ভাগে শুয়ে রয়েছে পাঁচজন হারানো মানুষ। একটি হারানো পরিবার।

ডিসেম্বরের শহরে মেয়েটি একটি খেলা শুরু করল। বড় সমাধি মন্দির দেখলেই সে ছ’কোণা ভাগ দেখে ধরে নেয় কে পরিবারের কে ছিল। পুরনো ছেলেটি বিরক্ত হয়, বলে, ‘এমন উচিত নয়। তাদের বিরক্ত করতে নেই। তাদের সঙ্গে ওলটপালট কথা বলতে নেই। ’ অথচ ইন্দো-সারসেনিক, মিশরীয়, গথিক, নিও-ক্লাসিক্যাল সমাধি স্থাপত্যের মধ্যে থেকে মেয়েটি হারিয়ে যাওয়া প্রাণ খুঁজতে চায়। একেকটি এপিটাফ পড়ে, সে মানুষ কেমন ছিল বুঝতে চায়। বোঝা যায় না। শুধু কবরের এক নেশা রয়েছে বোঝা যায়। কবরের নেশা ধরেছে তার, বোঝা যায়।

একদিন সহজ গল্পের মতোই মৃত পরিবারের ওপর বসে দেখা স্বপ্নও মৃত হল। যেমন হয় আর কী। পুরনো ছেলেটি শহর পাল্টে ফেলল। মেয়েটি ডিসেম্বরের গন্ধ নিতে কবরখানায় যেত। ততদিনে পথঘাট তার চেনা। গোলাপি দরজা দিয়ে ঢুকে কতটুকু হাঁটলে ও ঠিক কখন বাঁ দিকে বাঁক নিলে পৌঁছে যাবে ১৭৮৬ সালে মৃত বারওয়েল পরিবারের কাছে, তা সে জানত। একা মেয়ে, বন্ধুহীন, প্রেমিকহীন, আজগুবি একা মেয়ে কোথাও দাঁড়াতে পারে না। কবরেও না। সমাধিতে পিঠ ঠেকিয়ে একা বসার কিছুক্ষণ পরে এক টিকিটের মেয়েটিকে ঘিরে পাহারাদার পুরুষদের কৌতূহল জমত। তারা আশেপাশে ঘুরত। হল্লাহাটি করতে আসা কলেজ পড়ুয়ারা, শখের ডিএসএলআরধারী টিনেজাররা, কবরের ওপর বার্থডে কেক কাটতে আসা দুই প্রেমিক বন্ধুরা তাদের চোখে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা জমাত। মেয়েটি আরও একা হয়ে যেত। আর যা’ই হোক, দৃষ্টিতে নীতি-পুলিশি বসেনি আজও।

তাই তো আজ বৃষ্টি ছিয়ান দিলে পর, নতুন প্রেমিককে মেয়েটি বলেছে, ‘ছায়ার শহর দেখতে যাবি?’

ছায়ার শহরে সার্কাস দেখাতে এল ন্যাড়ামাথা ছেলেটি।

আজ কত বছরের চেনা বাঁধানো রাস্তায় ঢুকে এলিজাবেথ ও রিচার্ডের ধারেকাছে যায়নি মেয়েটি। সে জেনে গেছে, এটাই নিয়ম, এটাই দস্তুর। আজ যা আছে, কাল তা থাকবে না। আজ যে আছে, কাল সে থাকবে না। বদলাতে বদলাতে একদিন ঘুমিয়ে পড়াই ব্রহ্মাণ্ডের বিশুদ্ধতম ইয়ার্কি। সে শুধু হাত ধরে থাকা ছেলেটিকে বলেছে, ‘যাকে ভালবাসতাম, তার সঙ্গে এসেছিলাম। তারপর থেকে একা আসি। ’ নতুন প্রেমের যেমন নিয়ম, ছেলেটি মেয়েটিকে আগলে নিয়েছে। আর সেই মুহূর্তেই হাওয়া থেকে উঠে এসেছে নীতিপুলিশি করা ময়লাটে সাদা পাঞ্জাবি পরা ন্যাড়ামাথা ছোটখাটো ছেলেটি। ‘এখানে চুমু অ্যালাউড নয়!’ বাংলা ভাষায় তার স্পষ্ট অবাঙালি টান। পাশাপাশি শুরু হল ভয় দেখানো!

ডাকাবুকো মেয়েটি রেগে উঠতে গিয়েও পারল না। চেনা তল্লাটে সে যেন অপরাধী! সে তো জানত, রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে চুম্বন ‘অ্যালাউড নয়!’ তবু যেন ভুল করে ফেলেছে! তার স্বভাবরাগ, প্রতিবাদ হঠাৎ কী এক আঘাতে যেন ভেঙে গেল। অথবা অদম্য রাগে সে নির্বাক হল। বুদ্ধিমান সঙ্গী ছেলেটি খানিক মজা দেখতেই ও ভয় দেখানো থামাতেই ন্যাড়া ছেলেটির হাতে দুটো নোট গুঁজে দিল। শুরু হল সার্কাস। ভয় দেখানোর সুর পাল্টে salgen.it আরও একটি নোটের জন্য কাকুতিমিনতি শুরু হল। দয়া! আরও একটি নোট দেওয়া হল। মুহূর্তে ‘এখানে চুমু অ্যালাউড’ হল। ঘাসের ওপর কবরের আড়াল খুঁজতে শুরু করল পাহারাদার ছেলেটি। অনুরোধ করল থাকবার। প্রেমিকযুগল হাসল। এত পরিশ্রম না করার অনুরোধ শেষে বেরিয়ে এল। স্যর উইলিয়াম জোন্সের সমাধিচূড়া পিছনে রেখে, ডিরোজিও’র সমাধি বাঁ পাশে রেখে, হারিয়ে যাওয়া মানুষের ঘুম রেখে ছেলে মেয়ে দু’টি আজকের শহরে নামল। ফের বৃষ্টি নামল।

যুগ পেরিয়ে আজকের কলকাতা। জল-কাদা মাখা রাস্তা, দু’জোড়া পা। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মধ্যেকার দমবন্ধ পাথর গুঁড়ো হল। দু’জন হাসতে শুরু করল। একটা সময়ে হাসির বুরবুরি পেট গুলিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু হল। বৃষ্টিমুখর শহরে ছেলে মেয়ে দুটো শিশুর মতো হাসল।

রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল ন্যয়না। নয়না নয়। ন্যয়না। আসল নাম নয়। তার আসল নাম সে নিজেই কি জানে! প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফুল বিক্রি করে। কোনও কোনও দিন পুতুল পুতুল চাবির রিং। কখনও সস্তা চুইংগাম। কাজল টানে, লালচে সোনালি আঠা আঠা চুল টেনে বাঁধে। বয়ঃসন্ধির শরীর লম্বা হচ্ছে। স্টিলের রিঙে কোমর ঘোরায় সে।

প্রেমিকের হাত ধরে হাসতে হাসতে সহসা মেয়েটি ভাবল, কবরের পাহারাদার ছেলেটি ন্যয়নাকে ভালবাসতে পারে তো! ওদের যদি ভালবাসা হয়, বেশ হয়। শুকনো প্রাণহীন দেহের ছায়াময় ছেলেটি, কবর পাহারা দেওয়া ছেলেটি রাসেল স্ট্রিটের ন্যয়নাকে ভালবাসবে বেশ। ভয় দেখিয়ে রোজগারের অর্থে সে কিনবে উপহার, জন্মদিনের কেক। একটি সমাধির ওপরে সে রাখবে যাবতীয় আয়োজন। তারপর… তারপর ন্যয়নাকে চুমু খাবে সে। মেয়েটি তার অসমাপ্ত চুম্বনের রেশ লাগা প্রার্থনা পাহারাদার ছেলেটিকে দিয়ে দিল। কারণ, রাষ্ট্র রাখেনি কোথাও চুম্বনের অবসর।

বৃষ্টির কলকাতায় দেওয়া নেওয়া চলে। চলতে থাকে।

ক্রমশ

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes