![গান্ধী <br /> প্রথম পর্ব <br /> [মূলগ্রন্থ : ভিখু পারেখ কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘গান্ধী: অ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাক্শন্’] <br /> অনুবাদ- গৌতম বসু গান্ধী <br /> প্রথম পর্ব <br /> [মূলগ্রন্থ : ভিখু পারেখ কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘গান্ধী: অ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাক্শন্’] <br /> অনুবাদ- গৌতম বসু](https://abahaman.com/abahaman/wp-content/uploads/2021/01/MKG-as-a-law-student-London-1890.jpg)
গান্ধী
প্রথম পর্ব
[মূলগ্রন্থ : ভিখু পারেখ কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘গান্ধী: অ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাক্শন্’]
অনুবাদ- গৌতম বসু
বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে জোর করে 'ওয়ান নেশন'-এর একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে কিছু রাজনৈতিক শক্তি। আমরা কিছুই করতে পারি না, শুধুমাত্র একটা বিপরীতমুখী সংস্কৃতির যুদ্ধ করে যাওয়া ছাড়া। মহাত্মা গান্ধীর ভাবনা এবং জীবন নিয়ে তাই এই ধারাবাহিকের সূচনা। ভিখু পারেখের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ 'গান্ধী, এ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন' যার অনুপ্রেরণা। সেই গ্রন্থ থেকেই অনুসৃজন করলেন কবি গৌতম বসু। আজ এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব প্রকাশ পেল।
প্রথম পরিচ্ছেদ
ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৬৯-এ বন্দরনগরী পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হলেও শহরটি তখন রাজন্যবর্গের প্রশাসনের অধীন বহু ক্ষুদ্র রাজ্যের মধ্যে এক রাজ্য, যা আজ, স্বাধীন ভারতবর্ষের অন্তর্গত গুজরাট প্রদেশের একটি অংশ। জাতপ্রথা অনুসারে গান্ধীরা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ভুক্ত, এবং যদিও ‘গান্ধী’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘মুদী’, তবুও তাঁরা অনেকেই বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মোহনদাসের পিতা ছিলেন পোরবন্দর রাজপরিষদের প্রধান প্রশাসক ও আদালতের সদস্য। মোহনদাসের পিতামহ পার্শ্ববর্তী জুনাগড় রাজ্যে ওই একই পদে আসীন ছিলেন।
গান্ধী বহুধারাপুষ্ট এক ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়ে ওঠেন। তাঁর পিতামাতা উভয়ই বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী। মা ছিলেন ‘প্রণামী’ ধর্মীয় উপগোষ্ঠীর সদস্যা, তাঁরা হিন্দু ও ইসলামী ধর্মমতের সমন্বয়ে বিশ্বাস রাখতেন, সমান মর্যাদা দিতেন বৈষ্ণবীয় ধর্মগ্রন্থ ও পবিত্র কোরানকে, প্রচার করতেন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। মায়ের সারা জীবনব্যাপী নিয়মিত উপবাস ও কঠিন ব্রতপালন গান্ধীর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তাঁর পিতার বন্ধুবান্ধবেরা অনেকেই জৈন ধর্মাবলম্বী, তাঁরা ছিলেন অহিংসধর্ম ও কঠোর আত্মসংযমের একনিষ্ঠ প্রচারক। শৈশব থেকেই খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের সঙ্গে গান্ধীর যোগাযোগ থাকলেও খ্রিস্টধর্ম তাঁর উপর তখনই বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে নি। হিন্দু পরিবারভুক্ত অন্য অনেকের মতো, তাঁর অবচেতন একাধিক ধর্মীয় বিশ্বাস আহরণ করেছিল বটে, কিন্তু হিন্দু অথবা অহিন্দু, কোনও ধর্মীয় ঐতিহ্য-বিষয়েই বিশেষ জ্ঞান তিনি তখনও অর্জন করতে পারেন নি ।
স্বভাবে লাজুক প্রকৃতির, গান্ধী বালকবয়সে সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন এবং সাধারণ নম্বর পেয়েই তাঁর স্কুলজীবন সমাপ্ত হয়। তাঁর সঙ্গে কস্তুরবাঈের যখন বিবাহ হয় তখন তাঁদের উভয়েরই বয়স মাত্র তেরো; এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁকে প্রবল রকমের বাল্যবিবাহ-বিরোধী ক’রে তুলেছিল। প্রথম যৌবনের স্বভাবানুসারে তীব্র যৌনতাড়না তাঁকে চালিত করতো ব’লে শোনা যায়। একবার, ষোল বছর বয়সে অল্প কিছুক্ষণের মুমূর্ষু পিতার সেবা না ক’রে তিনি স্ত্রীর সঙ্গ করেন। তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতির মধ্যেই পিতার মৃত্যু হয় এবং তাঁর মনে তা এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। অনেক আলোচক ওই ঘটনাকে গান্ধীর যৌনতা-বিরোধিতার মূল কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন, কিন্তু তথ্যপ্রমাণ এই মত সমর্থন করে না। গান্ধী তাঁর আত্মজীবনীতে কেবল এইটুকুই লিখেছেন যে, সেই ঘটনা তাঁর মনে এক গভীর ‘লজ্জাবোধ’ জাগিয়েছিল। প্রসঙ্গত, ওই ঘটনার পরেও অনেক বছর জুড়ে তিনি স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন, চার পুত্র লালন-পালন করেছেন। ঘটনাটির দীর্ঘ ষোল বছর পর ব্রহ্মচর্য সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ জন্মায়, এবং সেই পুরানো অপরাধবোধের একটা গৌণ ভূমিকা রয়ে গেলেও, মনে হয়, আসন্ন ঘোর সংগ্রামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবার জন্য শারীরিক ও আত্মিক শক্তির সংরক্ষণের সঙ্কল্পই তাঁর সংযমপালনের মূল কারণ।
আইনশাস্ত্রে শিক্ষালাভের জন্য, ১৮৮৮-তে গান্ধী ইংল্যান্ড রওনা হয়ে যান; যাবার আগে তাঁর মায়ের কাছে সঙ্কল্প ক’রে যান যে তিনটি প্রলোভন ─ সুরা, নারী ও আমিষাহার ─ তিনি পরিহার ক’রে চলবেন। প্রথম কয়েক মাস সম্পূর্ণ সাহেবী আদব-কায়দায় তিনি দিন কাটান; মর্নিং সুট, টপ হ্যাট আর রুপোর হাতলের ছড়ি কেনেন, ভর্তি হন পাশ্চাত্য নৃত্য, আবৃত্তি ও বেহালাবাদন শিক্ষার ক্লাসে। ওদিকে অর্থভাণ্ডার দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে আসছে, নারীঘটিত প্রলোভনের কবল থেকে কোনওরকমে নিষ্কৃতি পাবার পর তাঁর সম্বিত ফেরে, এবার তিনি পাশ্চাত্য জীবনের মননশীল দিকগুলির প্রতি টান অনুভব করতে শুরু করেন। ঔপনিবেশিক যুগের অন্য অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মতো তিনিও, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে প্রায় একই সঙ্গে আবিষ্কার করেন, একের ভিতর দিয়ে অন্যকে। ভিন্ন বিষয় মনোযোগ সহযোগ সহকারে তিনি অধ্যয়ন করেন, যেমন, ব্রিটেন ও য়ুরোপের আইনশাস্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি; থিওসফিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, খ্রিস্টধর্মের গ্রন্থাদিও পড়েন,‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ তত আকর্ষণ না করলেও, ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ তাঁকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়ে যায়। নিজের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গেও এই সময়ে তাঁর পরিচয় হয়, বিশেষত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং এড্উইন্ আর্নল্ডের লাইট অফ্ এশিয়া সঙ্গে, যা, তাঁকে, যথাক্রমে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে। জুন ১৮৯১–এ গান্ধী ব্যারিস্টার হন এবং তার দু-দিন বাদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশে তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন।
গান্ধীর পক্ষে ভারতে ব্যবহারজীবীর বৃত্তি ছিল অসন্তোষজনক। স্বভাবে অতিশয় লাজুক, আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি কথাই বলতে পারতেন না। বস্তুত, ব্যারিস্টারী কর্মজীবনের প্রথম ‘ব্রিফ্’টিই তাঁকে অন্য এক আইনজীবীকে হস্তান্তর করতে হয়। অগত্যা, দরখাস্ত লিখে তিনি কোনওরকমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। কাজ মনঃপুত ছিল না, তার উপর আদালত চত্বরের ক্ষুদ্র রাজনীতির চক্রে জড়িয়ে পড়ে তিনি অবসন্ন বোধ করতেন। এই পরিস্থিতিতে, দক্ষিণ আফ্রিকার এক মুসলমান আইন-প্রতিষ্ঠান তাঁকে যখন ব্যবহারজীবী ও পত্রলেখক-কেরানীর চাকরির প্রস্তাব দেন, তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন। ১৮৯৩-তে গান্ধী সমুদ্রপথে দক্ষিণ আফ্রিকা রওনা হন, ইচ্ছা ছিল এক বছর সেখানে কাটিয়ে দেশে ফিরে আসবার, কিন্তু, সেখানে রয়ে যান ২১ বছর।
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধীর জীবনের অভিমুখটিই ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দেয়। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখে উপস্থিত করে, দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁকে আমূল রূপান্তরিত করে দেয়। সেখানে পৌঁছনোর এক সপ্তাহের ভিতর ঘটে-যাওয়া একটি ঘটনা তাঁর জীবনের ধারাটিই বদলে দেয়। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীর টিকিট কাটার স্পর্ধা দেখাবার জন্য ডার্বান থেকে প্রিটোরিয়া যাবার সময়ে তাঁকে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়, এবং বাকি রাতটা প্রবল শীতে কাঁপতে-কাঁপতে তাঁকে কাঁটাতে হয় পিটরম্যারিটজ়ব্যর্গ ষ্টেশনের প্রতীক্ষালয়ে। তীব্র অসম্মানবোধে বিপর্যস্ত, তিনি বিচার করতে থাকেন, ভারতবর্ষে ফিরে যাবেন, না এখানে রয়ে গিয়ে স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে লিপ্্রযস্ত; শেষে, থেকে যাওয়াই সাব্যস্ত হয়। পরের দিন নির্বিঘ্নে চার্লসটাউন পৌঁছলেও, সেখান থেকে যোহ্যানেস্ব্যর্গ যাবার সময়ে জুড়িগাড়ির চালক, গাড়ির ভিতরে বসার অনুমতি না-দিয়ে তাঁকে বাইরে, তাঁর পাশে বসতে বলেন। অগত্যা, গান্ধী রাজি হয়ে যান। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর, তাঁকে নিচে পাতা একটা চাটাইয়ের উপর বসতে বলা হয়। এবার তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন এবং সঙ্গে-সঙ্গে জোটে প্রহার, গাড়ি থেকে তাঁকে বলপূর্বক নামিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। সহৃদয় সহযাত্রীদের হস্তক্ষেপে তিনি সেদিন রক্ষা পান। এর কয়েক মাস বাদে প্রিটোরিয়া-য়, প্রেসিডেন্ট ক্রুগ-এর সরকারী আবাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার ঔদ্ধত্য প্রকাশের শাস্তি হিসেবে এক সান্ত্রি তাঁকে পদাঘাত ক’রে রাস্তার পাশের নালায় ফেলে দেয় (তথ্যসূত্র: ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি: দ্য স্টরি অফ্ মাই এক্সপেরিমেন্টস্ উইথ ট্রুথ’ / এম. কে.গান্ধী দ্রষ্টব্য)।
১৮৬০-এর দশক থেকে যে-ভারতীয়রা দেশান্তরী হয়ে আখের এবং কফি ক্ষেতে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে দলে-দলে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁরা সেখানে পৌঁছে নানারকম লাঞ্ছনা ও বৈষম্যের শিকার হতেন, বিশেষত নাতাল, ট্রান্সভ়াল প্রভৃতি অঞ্চলে, যেখানে সংখ্যার দিক থেকে তাঁরা কেন্দ্রীভূত। এপ্রিল ১৮৯৪-তে, যখন গান্ধীর স্থায়ীভাবে স্বদেশে ফেরার কথা, ঠিক সেই সময়ে প্রস্তাবিত ‘ইণ্ডিয়ান ফ্র্যান্চাইস বিল’ নিয়ে নাতাল বিধানমণ্ডলীতে বিতর্ক শুরু হয়, যা প্রকৃতপক্ষে, ভারতীয়দের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার আইনের খসড়া। প্রস্তাবিত আইনপ্রণয়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার জন্য গান্ধীর মুসলমান নিয়োগকর্তা তাঁকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন এবং গান্ধী সাদরে সম্মতও হন। তিনি ‘নাতাল ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর সাংগঠনিক উদ্যোগের ফলে বিলের কঠোর জনবিরোধী অভিঘাত কিছুটা হ্রাস পায়। প্রসঙ্গত, তাঁর অন্য কর্মসূচী, যথাক্রমে অভিবাসী(ইমিগ্রেশ্ন)নিরোধক ব্যবস্থার এবং বৈষম্যমূলক লাইসেন্স-আইনের বিরুদ্ধাচরণ, তত সাফল্য পায় নি। ক্রমে, তাঁর মনের ভিতর এই অভিযোগ দানা বাঁধতে শুরু করে যে, যাঁদের মন পক্ষপাতদুষ্ট, তাঁদের উপর সাংবিধানিক চাপসৃষ্টি, আবেদন, যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা প্রভৃতি কোনও কিছুই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তিনি বিকল্প প্রণালী বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন।
কয়েক বছর বাদে তিনি সমাধানসূত্রটি খুঁজে পান। ১৯০৭-এ, ট্রান্সভ়ালে, যখন সমস্ত ভারতীয়ের নথিভুক্তিকরণ, আঙুলের ছাপ গ্রহণ এবং নথিভুক্তির তদারকি করবার জন্য ঘরে-ঘরে পুলিশের অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়ার আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন তিনি সত্যাগ্রহ কর্মপদ্ধতিটি, যা পরবর্তীকালে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিল, সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন। এটি অহিংস প্রতিরোধের এক প্রণালী, যাতে নথিভুক্তি-কেন্দ্রে প্রতিবাদীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান, নথিভুক্তির কার্ডে প্রতীকী অগ্নিসংযোগ, স্বেচ্ছায় কারাবরণ, শাসক কর্তৃক প্রদত্ত নিয়মভঙ্গের শাস্তি প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করা প্রভৃতি কর্মসূচী অন্তর্গত। গান্ধীর প্রতিবাদী কার্যক্রমের ফলে কিছু দাবিদাওয়া আদায় হয়, যদিও তা মূল দাবিসনদের এক ভগ্নাংশ মাত্র। এর কিছুকাল পরে, ব্যক্তি-ভিত্তিক করপ্রথা রদ ও ভারতীয় ধর্মমতে বিবাহকে স্বীকৃতিদান প্রভৃতির দাবি ছাড়াও, অভিবাসী-বিষয়ক নিয়ম কানুন এবং চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকনিয়োগে নানা অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভারতীয় নারী ও খনিশ্রমিকদের একত্রিত ক’রে আরও একটি সত্যাগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই আন্দোলন বিশেষ সাফল্য অর্জন করে, যার ফলে ১৯১৪ সালে ‘ইণ্ডিয়ান রিলিফ্ অ্যাক্ট’ পাশ হয় ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ২১ বছর ব্যাপী প্রবাসকালে গান্ধীর ভাবনাপদ্ধতি ও জীবনপ্রণালী নানা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল।তাঁর ভাবনার জগৎ ও জীবনকে চালনা করার মধ্যে, বস্তুত, কোনও ভেদরেখাই ছিল না। যে-ভাবনাপ্রবাহ জীবনযাপনে প্রয়োগ করা যায় না, তা তাঁর বিচারে সম্পূর্ণ মূল্যহীন, এবং, এর বিপরীতে, যে-কালযাপনে জীবন-বিষয়ে সুচিন্তিত অন্তর্দৃষ্টি নেই, তা তাঁর বিচারে অগভীর। নতুন কোনও ভাবনাসূত্রের সম্মুখীন হলে, গান্ধী প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করতেন, ওই চিন্তাসূত্র জীবনে অনুসরণযোগ্য কি না। উত্তর ‘না’ হলে, ওই ভাবনাসূত্র সম্পর্কে তিনি আর কোনও আগ্রহ বোধ করতেন না। আর, উত্তর ইতিবাচক হলে তিনি তাকে নিজের জীবনে অন্তর্গত করে নিতেন, পরীক্ষা করতেন তার অন্তরস্থ সত্যকে, অন্বেষণ করতেন তার নৈতিক শৃঙ্খলা। গ্রন্থাদি বিষয়ে তাঁর ওই একই মনোভাব লক্ষনীয়। বই বিশেষ পড়তেন না, পড়তেন ততটুকুই যা তাঁর নিজের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হত। কোনও বিশেষ বই তাঁকে আকর্ষণ করলে তিনি সে-বইয়ের বার্তা-বিষয়ে একাগ্রচিত্তে ভাবতেন, কেন্দ্রীয় ভাবনাকে জীবনে প্রয়োগ করতেন, যাতে ‘সত্য থেকে আরও মহৎ সত্য’-এ উপনীত হওয়া যায়। প্রধানত ধর্মগ্রন্থ ও নীতিশাস্ত্র-বিষয়ক বইয়েই তাঁর আগ্রহ ছিল, যেমন প্লেটো-র অ্যাপলজি, যা তিনি নিজের মাতৃভাষা গুজরাটিতে অনুবাদ করেছিলেন, এবং ওয়াল্টার সল্টারের এথিকাল রিলিজন (১৮৮৯) যার একটি সংক্ষিপ্তসার তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসের সময়ে তিনটি বই তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল; হেনরি থরোর অন্ দ্য ডিউটি অফ্ সিভ়িল্ ডিসোবিডিয়েন্স(১৮৪৭), যাকে তিনি ‘এক পথপ্রদর্শক সন্দর্ভ’ মনে করেছিলেন, টলস্টয়ের দ্য কিংডম্ অফ্ গড্ ইজ় উইদিন ইয়ু (১৮৯৩), যা তাঁকে ‘অভিভূত’ করেছিল এবং তাঁর মতানুসারে যে-বইতে, প্রীতি ও অহিংস-নীতির সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল; এবং জন্ রাস্কিনের আন্টু দিস্ লাস্ট্ (১৮৬২), যার ‘ঐন্দ্রজালিক প্রভাব’ তাঁর জীবনে ‘এক দিগ্নির্ণায়ক’ (তথ্যসূত্র:‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি: দ্য স্টরি অফ্ মাই এক্সপেরিমেন্টস্ উইথ ট্রুথ’/এম. কে.গান্ধী দ্রষ্টব্য)। রাস্কিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গান্ধী এক কমিউন্বাসী ও কৃচ্ছসাধকের অনাড়ম্বর জীবন বেছে নেন, প্রথমে নাতালের ‘ফিনিক্স ফার্ম’–এ এবং পরবর্তীকালে যোহ্যানেস্ব্যর্গের উপকণ্ঠে ‘টলস্টয় ফার্ম’–এ।
‘এই বইটি (আন্টু দিস্ লাস্ট্) একবার পড়তে শুরু করে, সেটি নামিয়ে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। গভীরতম প্রত্যয়ের প্রতিফলন আমি সেখানে দেখলাম। যোহ্যানেস্ব্যর্গ থেকে ডার্বন চব্বিশ ঘণ্টার যাত্রাপথ। ট্রেন পৌঁছল সন্ধেবেলায়। সে-রাত্রে ঘুমোতেই পারলাম না। আমার জীবনযাত্রা আমি এই বইটির আদর্শ অনুসারে পাল্টে নেব,এমন একটা সংকল্প আমি করলাম।’
খাদ্যাভ্যাস, শিশুদের লালনপালন, প্রাকৃতিক রোগনিরাময়, ব্যক্তিগত ও পেশাদারী জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই সময়ে গান্ধী অবতীর্ণ হন। ধাত্রীবিদ্যার একটি বইয়ের দ্বারা তিনি এতদূর প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তাঁর চতুর্থ পুত্রের জন্মের সময়ে ধাত্রীর সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করেছিলেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বস্থানীয় একজন ব্যক্তির পক্ষে চারিত্রিক শুদ্ধতা আয়ত্ত করা আবশ্যিক, এই বিশ্বাস থেকে তিনি আত্মশুদ্ধির এক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা প্রতিনিয়ত গায়ে প’ড়ে তাঁর নিজের ধর্মবিশ্বাস ব্যাখ্যা ক’রে আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য তাঁর উপর জোর খাটাতেন, অন্যথা তাঁকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করতেন; গান্ধী এতে দিশাহারা বোধ করতেন। আত্মা, মোক্ষ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মতত্ত্বের বিমূর্ত ধারণাগুলি তাঁর কাছে তখনও অস্পষ্ট থাকায়, তিনি ভারতবর্ষে তাঁর পরামর্শদাতা রাইচাঁদভাইকে চিঠি লিখে ব্যাখ্যা ও উপদেশ চেয়ে পাঠাতেন। গান্ধীর স্বধর্মশিক্ষা যেহেতু হিন্দুধর্মের কোনও সমৃদ্ধ ও জীবন্ত পরম্পরার উৎস দ্বারা পুষ্ট না হয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিকূল ও সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে সম্পূর্ণ ভাবে বইয়ে-পড়া বিদ্যা ও নিজের অপরিণত ভাবনাচিন্তার ভিতর থেকে গ’ড়ে উঠেছিল, সেহেতু তা কিয়দংশে অবাস্তব ও অগভীর রয়ে গেছিল। তাঁর জীবনের অন্য অনেক অভিজ্ঞতার মতোই, হিন্দুধর্মের স্বগঠিত আকারটি, সংশ্লিষ্ট ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সহ, তিনি পথ চলতে-চলতে সংগঠিত করেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর অনেক ইহুদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাঁদেরই একজন ১,১০০ একরের ‘টলস্টয় ফার্ম’ কিনে তাঁকে উপহার দেন। জুডাধর্ম এমন একটি প্রধান ধর্ম যার সঙ্গে তাঁর কোনও পরিচয় হয় নি, তাঁদের সংস্পর্শে এসে তিনি তাঁদের বিশ্বাসের জগৎ ও আচারাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করেন। ইহুদিদের তিনি ‘খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অস্পৃশ্য’ বলে মনে করতেন; হিন্দুদের মধ্যে অস্পৃশ্যদের মতো, তাঁদের উপর নির্যাতন দাঁড়িয়ে রয়েছে মহৎ ধর্মমতের সুগভীর দূষণ ও ভুল পাঠের উপর(‘দ্য কলেক্টেড ওয়ার্কস অফ্ মহাত্মা গান্ধী’ দ্রষ্টব্য)। খ্রিস্টানদের সঙ্গেও গান্ধী নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন, বিশেষত ব্রিটিশ ধর্মযাজক সি. এফ্. অ্যানড্রুজ়ের (১৮৭১-১৯৪০)সঙ্গে, যাঁর বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, এমন আর-কেউ নেই যার সঙ্গে তাঁর এমন ‘নিবিড় বন্ধন’ অনুভব করেছেন(তথ্যসূত্র : ‘গান্ধী: হিস লাইফ অ্যান্ড মেসজ ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’/ লুই ফিশর)। তাঁদের প্রভাবে গান্ধী নতুন ক’রে খ্রিস্টধর্মে পাঠ নিতে শুরু করেন এবং তার একাধিক বৈশিষ্ট্য, নিজের পুনর্সংজ্ঞায়িত হিন্দুধর্মে তিনি অন্তর্ভুক্ত ক’রে নেন, বিশেষভাবে প্রেমসঞ্জাত দুঃখভোগের ধারণাটি, ক্রুশবিদ্ধ যিশু যার প্রতীক। ক্রুশবিদ্ধ যিশুমূর্তি তাঁর চেতনাকে আজীবন প্রবলভাবে আলোড়িত করে রেখেছিল, হয়ে উঠেছিল তাঁর গভীরতম ভাবের উৎসমুখ। ১৯৩১-এ রোমে ভ্যাটিকান পরিভ্রমণের সময়ে ক্রুশবিদ্ধ যিশুমূর্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি; সেবাগ্রাম আশ্রমের নিরাভরণ দেওয়ালে তিনি একটিই ব্যতিক্রমের দিয়েছিলেন। আইস্যাক ওয়াট্স্ রচিত ‘হোয়েন আই সার্ভে দ্য ওয়ান্ডর্স্ ক্রস’ যা খ্রিস্টের অন্তিম শোকানুভূতি ও আত্মাহুতির এক মর্মস্পর্শী গীতিরূপ, এবং যার অন্তিম চরণ এইরকম, ‘লভ় সো অ্যামেজ়িং, সো ডিভ়াইন, ডিমান্ডস্ মাই সোল,মাই লাইফ্, মাই অল’ তাঁর অন্যতম প্রিয় ধর্মীয় সঙ্গীত; এবং তাঁর জীবনের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন প্রহরে ক্রুশবিদ্ধ যিশুমূর্তির ভিতর দিয়ে তিনি তাঁর সমস্ত যাতনা নিভৃতে প্রকাশ করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন গান্ধী কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দক্ষতা ও শিক্ষা অর্জন করেছিলেন, যার কিছু-কিছু পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে প্রয়োগের সময়ে সুফল দিয়েছে, আবার অন্য কিছু–কিছু ক্ষেত্রে, কুফল। সংবাদমাধ্যমের উপযোগিতা সম্পর্কে সচেতন হবার পর থেকে সাপ্তাহিক পত্র ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’-এর মাধ্যমে তিনি তাঁর মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। তিনি এটাও লক্ষ করতেন, তাঁর স্বদেশবাসী্র মনোবল কতটা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, সুনিশ্চিত পদক্ষেপ গ্রহণে তাঁরা এখন কতদূর অক্ষম। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের পরিবর্তে, তাঁরা চান তাঁদের লড়াই লড়বেন অন্যরা, এবং যতদিন তা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন বৈষম্যমূলক নিয়মবিধি পাশ কাটাবার জন্য সরকারী কর্মচারীদের উৎকোচ দিয়ে কার্যসিদ্ধির পথই তাঁর পক্ষে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক। স্বভাবতই, গান্ধী তাঁদের বারংবার তিরস্কার করতেন, নিজেদের বিরুদ্ধে ‘রুখে দাঁড়াবার’ জন্য তাঁদের প্ররোচিত করতেন, এই বলে তাঁদের সতর্ক করতেন যে, ‘যারা নিজেরাই কীটবৎ, অন্যদের দ্বারা পদদলিত হওয়ার জন্য অভিযোগ করা তাদের সাজে না’। আত্মপ্রচার এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ বিস্তারের শৈলীও রপ্ত করেন গান্ধী। বিভিন্ন প্রভাবশালী বিদেশীদের, বিশেষ করে টলস্টয়-কে চিঠি লিখে নিজের কাজের বিষয়ে তিনি অবহিত করেন, ভারতীয় ও ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যত্নসহকারে সুসম্পর্ক গ’ড়ে তোলেন, তাঁর কর্মকাণ্ডের বিবরণ ভারতে ও ব্রিটেনে যাতে প্রচারিত হয়, তাও সুনিশ্চিত করেন। হিন্দু ও মুসলমান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একত্রিত করতে তাঁকে বিশেষ বেগ পেতে হয় নি দক্ষিণ আফ্রিকায়, কারণ তাঁদের অনেকের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল অভিন্ন। সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি সর্বত্র প্রযোজ্য মনে করেছেন, ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যকার পারস্পরিক দূরত্ব সঠিক পরিমাপ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, এবং সে-ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবার সাধ্য-বিষয়ে নিজের ক্ষমতাকে তিনি স্ফীত ক’রে দেখেছেন।
ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের সময়ে গান্ধী ছিলেন নড়বড়ে, মুখচোরা, অসফল এক আইনজীবী। ১৯১৪-তে সে-দেশ ত্যাগ ক’রে ভারতবর্ষে প্রবেশ করার সময়ে তিনি হয়ে উঠেছেন আত্মবিশ্বাসী, আত্মসম্ভ্রমযুক্ত, গভীরভাবে ধার্মিক এবং সুপরিচিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্থায়ীভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করবার পিছনের কারণগুলি স্পষ্ট নয়। তিনি অন্যরকম ভাবলেও এবং লিখলেও, সেখানে তাঁর সাফল্য ছিল আংশিক, এবং তিনি নিশ্চয় এও বুঝেছিলেন যে, ওখানে এর চেয়ে বেশি কিছু অর্জন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। এর প্রতিতুলনায়, ইত্যবসরে তিনি যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন, যোগাযোগের কার্যকরী সূত্র স্থাপন করতে পেরেছিলেন ভারতে, হয়তো তাঁর মনে হয়ে থাকবে, সেখাএ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কারণ যাই হোক,ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবনের এক সুপরিকল্পিত, দীর্ঘকালীন কার্যক্রম এবং নতুন কর্মপ্রণালীতে ঋদ্ধ হয়ে, তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। সেই সময়ে গান্ধী ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক উৎসাহী সমর্থক। তিনি তখন ভাবতেন, যে-উচ্চমার্গের আদর্শবোধের তিনি ন্যায়সঙ্গত ‘প্রেমে পড়েছেন’, তাঁর মতো এক ব্যক্তির জন্য যে–উদারতাসহ ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের দুয়ার উন্মুক্ত ক’রে দিয়েছে, এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে তাঁর জীবনে ও ভাবনাচিন্তায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বুঝি সর্বত্র সেই আদর্শই তুলে ধরেছে। ফলত, আমরা এই সংবাদে আশ্চর্য হই না যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের সামরিক উদ্যোগকে আরও বলশালী করবার জন্য তিনি লন্ডন ও ভারতে তাঁর স্বদেশবাসীদের সমর্থনের আবেদন জানিয়েছিলেন, ১৯১৪-এ লন্ডনে গ’ড়ে তুলেছিলেন এক অ্যাম্বুলেন্স-বাহিনী, এবং ১৯১৮-এ ভারতের ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে নতুন সৈনিক অন্তর্ভুক্তি-কার্যক্রমেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অহিংসার প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে প্রত্যয় জন্মেছিল যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি তাঁর আনুগত্য সেই সংকটকালে তাঁর পূর্ণ সমর্থন দাবি করে।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর, গান্ধী, তাঁর ‘রাজনৈতিক গুরু’ তথা উজ্জ্বল, উদারপন্থী নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে-র পরামর্শ মান্য ক’রে, যে-দেশ তিনি কুড়ি বছরেরও আগে ছেড়ে গেছিলেন, সেই দেশকে সম্যক জানার জন্য, ‘কান খোলা রেখে এবং মুখে কুলূপ এঁটে’ তিনি সারাটা দেশ ঘুরে-ঘুরে দেখেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে উঠে আসে। প্রথমত, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তখনও ধ্বনিত না হলেও, ঔপনিবেশিক শাসনের ক্রমবর্ধমান অত্যাচার প্রতিরোধের উদ্দেশে প্রতিনিধিভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনবোধ তখনই ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছিল। একই সঙ্গে, এক দিকে, ১৮৮৫-এ প্রতিষ্ঠিত ও সম্পন্ন মধ্যবিত্ত পেশাদারদের দ্বারা পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আত্মমর্যাদাবোধহীন ভিখারির মনোবৃত্তি নিষ্ফল প্রমাণিত হচ্ছিল; এবং অন্যদিকে, প্রভাব বাড়ছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকারীদের, যাঁদের মুখপাত্রদের সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক পরিচয় হয়েছিল লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় এবং যাঁদের সঙ্গে পরবর্তীকালে অহিংস আন্দোলনের নীতিতত্ত্ব-বিষয়ে তিনি বিস্তর তর্কবিতর্ক করেছিলেন। গান্ধীও সন্ত্রাসবাদীদের অধীরতার অংশীদার ছিলেন, তাঁদের নির্ভীকতা ও দেশপ্রেম তিনি শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন, কিন্তু নৈতিক ও ব্যবহারিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁদের সহিংস কার্যকলাপ সম্বন্ধে তাঁর গভীর আপত্তি ছিল। হিংসা, সহজাত ভাবেই অমঙ্গল; তদুপরি, ঔপনিবেশিক শাসকরা যে প্রজাদের নিরস্ত্র করে রেখেছে, তাঁদের ক্ষেত্রে হিংসা অনুসরণযোগ্য কোনও কার্যকরী পন্থা নয়; সাধারণ মানুষদের মধ্যে নৈতিক বল, সমষ্টিগত আত্মবিশ্বাস এবং পরিকল্পিত কর্মোদ্যোগ সঞ্চারিত করতে তা অক্ষম। গান্ধী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর দ্বারা উদ্ভাবিত সত্যাগ্রহ কর্মপ্রণালী ভারতবর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট আশা।
দ্বিতীয়ত, ভারতভ্রমণের ফলে, স্বজাতির অধঃপতিত অবস্থা সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দেহ হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসের সময়তেই এটি তাঁর নজরে পড়েছিল, এবং তাঁর প্রথম গ্রন্থ হিন্দ স্বরাজ-এ তিনি সে-বিষয়ে লিখেওছিলেন; সেখানে ভারতের তদানিন্তন পরিস্থিতির প্রণালীবদ্ধ বিশ্লেষণ এবং মীমাংসাসূত্রের রূপরেখা লিপিবদ্ধ ছিল(তথ্যসূত্র: ‘দ্য মরাল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটিংস্ অফ্ মহাত্মা গান্ধী’/ সম্পাদনা রাঘবন আইয়র)। কয়েক শতাব্দী ব্যাপী বিদেশী শাসনের প্রভাবে ভারতবর্ষের মানুষ সর্বতভাবে আত্মবিভক্ত, জাতপাতের বিভাজনে-বিভাজনে ক্ষতবিক্ষত, নিয়মের অন্ধ-অনুসরণকারী, খণ্ডিত মনোবৃত্তিসম্পন্ন, স্বার্থপর, কলহপ্রবণ, ভীরু, নীতিবোধভ্রষ্ট এবং সামাজিক বিবেকবুদ্ধি ও নাগরিক সৌজন্যবোধচ্যুত হয়ে পড়েছিলেন। যতদিন দেশ পুনরুজ্জীবিত না-হচ্ছে, ‘পুনর্জন্ম’ লাভ না-করছে, ততদিন স্বাধীনতা অর্জন এবং একবার অর্জন করতে পারলেও তা সুরক্ষিত রাখা, কোনোটাই সম্ভব হবার নয়। তদনুসারে, জাতীয় পুনার্জাগরণের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ক্রম প্রস্তুত করে, তার একটি যথোপযুক্ত নামকরণও, ‘গঠনমূলক কার্যক্রম’, তাঁর কৃতিত্ব। গান্ধীর স্বভাবোচিত রীতিতে, ছোটবড়, জীবনের সবদিকই সেখানে ধরা ছিল, এবং, বিশেষ কিছু বিষয় তাদের প্রতীকী গুরুত্ব বিচারে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে কিছু ছিল ‘অত্যাবশ্যক’ প্রস্তাব, যেমন, হিন্দু–মুসলমান সদ্ভাবপ্রতিষ্ঠা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, মাদকদ্রব্য বর্জন, খাদিবস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার, গ্রামীণ শিল্পোদ্যোগ এবং বৃত্তিমুখী শিক্ষা। এ-ছাড়াও, নারীর সমান অধিকার, স্বাস্থ্যশিক্ষা, প্রাদেশিক ভাষার অধিক ব্যবহার, বহুভাষিক দেশে জাতীয় স্তরে একটিই সাধারণ ভাষা গ্রহণ, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক-কৃষক কল্যাণ সমিতি গঠন, উপজাতীয় জনজাতিগুলিকে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূলধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণ, ছাত্রছাত্রীদের পালনযোগ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়মবিধি, কুষ্ঠরোগী ও ভিখারিদের সহায়তা দান, এবং পশুপাখিদের প্রতি সহৃদয় ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা-বিষয়ে প্রচার প্রভৃতিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
কয়েকটি প্রস্তাব অকিঞ্চিৎকর ঠেকলেও, কোনোটিই নিতান্ত মূল্যহীন ছিল না। যেমন, খাদিবস্ত্রের ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে একটি লক্ষ্য ছিল একটি সাধারণ ইউনিফর্ম প্রচলন করা, যাতে আর্থিক বৈষম্যে ভয়ানক পীড়িত দেশে, অন্তত বাইরের দিক থেকে সাম্যের চেহারা ফুটে ওঠে, যাতে ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের একটি ঐক্যসূত্র রোপিত হয়, যাতে ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন হন, এবং যাতে দেশে আমদানির বোঝা হ্রাস পায়। প্রাদেশিক ভাষা-ব্যবহারে প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ভারতীয় ও সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যকার বিরাট ও ক্রমবর্ধমান খাদের উপর দিয়ে সেতু নির্মাণ করে সাংস্কৃতিক প্রবহমানতাকে সুনিশ্চিত করা, ভাবনা ও প্রয়োগে প্রামাণিকতাকে উৎসাহ দেওয়া, এবং যৌথ আত্মপ্রকাশের উপকরণনির্মাণ। গ্রামীণ শিল্পোদ্যোগের কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ দারিদ্র্যমোচন, লাভজনক কর্মসৃষ্টি এবং গ্রাম থেকে পলায়নরত মানুষের স্রোত রুদ্ধ করা। সামগ্রিক বিচারে, যে-যে গুণাবলী ভারতীয় সভ্যতার সামাজিক ও ভৌগোলিক ভিত্তিপ্রস্তর ব’লে গান্ধী-র মনে হয়েছিল, তিনি তাদের প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন।
সুপরিকল্পিত সত্যাগ্রহ এবং বিশেষ করে, ‘গঠনমূলক কার্যক্রম’; গান্ধী মনে করতেন এ-দুটিই ভারতের নৈতিক পুনরুজ্জীবন ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি। প্রায় ত্রিশ বছর ধ’রে, একাগ্রচিত্তে, নিজের সমস্ত প্রাণশক্তি ঢেলে দিয়ে, এই দু’টি লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি কাজ ক’রে গেছেন। এর জন্য, প্রাথমিক ভাবে, চারিত্রিক গুণাবলীতে পরস্পরের পরিপূরক নারীপুরুষের এক ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী গঠন করা তাঁর পক্ষে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রথমে তাঁদের তিনি দক্ষতার সঙ্গে শনাক্ত ক’রে, তারপরে তাঁদের সযত্নে লালন ক’রে, অবশেষে একের সঙ্গে অন্যকে তিনি সংযুক্ত করতেন। কখনও-কখনও এইভাবে তিনি গোটা পরিবার অধিগ্রহণ ক’রে নিতেন, তাঁর আদর্শের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার দৃঢ়তর করবার জন্য একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের ব্যবহার করতেন, এমন কি, কখনও-কখনও তাঁদের অভিভাবকের জায়গাও নিয়ে নিতেন, প্রশমিত করতেন মতান্তরজনিত তাঁদের অভ্যন্তরের উত্তেজনা, আবেগের দ্বারা তাঁদের উপর, বিশেষ করে নারী ও নাবালকদের উপর, তাঁর প্রভাব বিস্তার করতেন। পরিবারে-পরিবারে যোগাযোগ স্থাপন ক’রে তিনি এইভাবে সারা দেশ জুড়ে দৃঢ়রূপে সংঘবদ্ধ এক সুবিশাল জাল বিস্তার করেছিলেন, যার শীর্ষবিন্দুতে স্বয়ং তিনি অধিষ্ঠান করতেন। নিজের ভাষায় নিজের বার্তা প্রচারের জন্য যেহেতু একটি মাধ্যমের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল সেহেতু, নবজীবন শিরোনাম দিয়ে তিনি একটি উপযুক্ত সাময়িকপত্রের সম্পাদনা কর্মে হাত দেন, যার সঙ্গে পরবর্তীকালে হরিজন-কে যুক্ত করা হয়। এই সমস্ত কর্মকাণ্ড রূপায়নের জন্য যেহেতু প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, সেহেতু ভারতের সর্বাধিক ধনী ছয়জন শিল্পপতির সঙ্গে সুসম্পর্ক গ’ড়ে তুলে তিনি সুচতুর উপায়ে তাঁদের সহযোগিতা আদায় ক’রে নেন। দেশবাসীকে জাগিয়ে-তোলা, তাঁদের একত্রিত করবার প্রয়োজনবোধ থেকে, প্রারম্ভে তিনি পর-পর কয়েকটি সুপরিকল্পিত সত্যাগ্রহ কার্যক্রম আয়োজন করেন, যার প্রতিটির লক্ষ্য একটি ভিন্ন জনমণ্ডলী। একটি বলবান রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন ছিল; ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-কে তিনি একেবারে সর্বনিম্ন ধাপ থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজান।
ভারতের বিপুলসংখ্যক জনতাকে চালনা করাই ছিল গান্ধীর সর্বপ্রধান প্রয়োজন। দীর্ঘকালব্যাপী চিন্তাভাবনা এবং নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি এক স্বতন্ত্র, কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ উপায় উদ্ভাবন করলেন। কাজ করার ইন্দ্রিয়জাত উদ্যম মানুষ সংগ্রহ করে নিজের হৃদয়বৃত্তি থেকে, এবং সেই অনুভূতি জাগ্রত করতে পারে কেবল কিছু সুনির্বাচিত প্রতীক; এ-প্রসঙ্গে নিঃসন্দেহ হবার পর, গান্ধী এক গুচ্ছ অত্যন্ত শক্তিশালী, বাঙময়, সাধারণ দেশবাসীর সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত এবং সেই কারণে সহজবোধ্য প্রতীকের প্রচলন করলেন; যেমন, চরকা, খাদি, দুগ্ধবতী গাভি এবং গান্ধী টুপি। চরকায় সুতো কাটতে তিনি সকলকে উৎসাহ দিতেন, এবং এর এক প্রতীকী তাৎপর্যও ছিল; যেমন, আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার আগ্রাসনের নীরব বিরুদ্ধাচরণ ক’রে গ্রামীণ ভারতীয় জীবনপ্রণালীর গুণকীর্তন প্রচার। পাশ্চাত্য আদবকায়দায় অভ্যস্ত নগরসভ্যতা ও সাধারণ গ্রামীণ সমাজের মধ্যকার মৈত্রী ও ঐক্যের প্রতীক রূপে চরকাকে গ’ড়ে তোলা হয়। সনাতন ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কায়িক শ্রমকে নিচু চোখে দেখা হয়; সেই দিক থেকে বিচার করলে, চরকা, কায়িক শ্রম এবং যাঁরা কায়িক শ্রমের দ্বারা প্রাণ ধারণ ক’রে থাকেন, তাঁদের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়ারও প্রতীক। চরকা, আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষদের জন্য সামাজিক সহায়তার প্রতীকও হয়ে উঠেছিল, যাঁদের কাছে উদ্বৃত্ত খাদিদ্রব্য ছিল, তাঁদের অনুরোধ করা হত অভাবীদের মধ্যে তা বিতরণ করার জন্য, এবং যা, নৈতিক ক্রিয়া হিসাবে অর্থসাহায্যের চেয়ে বহু গুণ উন্নত এক সৎকর্ম। মৌনব্রত পালন চরকার আরও একটি উপযোগিতা, কারণ, ধ’রে নেওয়া যায়, অন্তত সুতো কাটার সময়ে একজন ব্যক্তি আত্মমগ্ন হয়ে থাকবেন, অবগাহন করবেন নিজের ভিতর। গান্ধী যে কেবল এইরকম অগণিত প্রতীক উদ্ভাবন করেছিলেন তা নয়, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতীক। এটি আংশিক ভাবে তাঁর পূর্বপরিকল্পনার ফল, এবং আংশিক ভাবে তাঁর সামগ্রিক জীবনযাপনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ; তাঁর পরিধান, তাঁর ভাষা-ব্যবহার, তাঁর বক্তৃতা দেবার ধরন, তাঁর খাদ্যাভ্যাস, তাঁর শরীরের প্রকাশভঙ্গিমা, বসার ধরন, তাঁর হাঁটাচলা আর কথা-বলা, ওই অনাবিল হাসি, তাঁর রসবোধ এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর লাঠিখানা, সমস্তই এক বিশেষ ধরনের বেঁচে-থাকার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এরা প্রত্যেকেই বাঙময়, অত্যন্ত জটিল বার্তা প্রেরণে সক্ষম, প্রত্যেকেই কৃষ্টির যৌথস্মৃতির গভীরে উৎকীর্ণ চিহ্নসকল সার্থক ভাবে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল।

Mahatma Gandhi coming out of the Dum Dum central jail after the interview with the political prisoners.
প্রতীকগুলি আবেদন কেবল আবেগ সঞ্চার ক’রেই থেমে থাকে নি, তারা যুক্তিসিদ্ধও, তাদের মধ্যে কোনোটাই দুর্বোধ্য অথবা গূঢ় নয়, সবই সাধারণ ভারতবাসীর দৈনন্দিন জীবন থেকে তুলে আনা সামগ্রী।বুদ্ধিবৃত্তি এবং হৃদয়বৃত্তি, নতুন আগ্রহ এবং যৌথস্মৃতির ভাণ্ডার, অতীত ও বর্তমান, একইসঙ্গে সবদিকের প্রতি সমান লক্ষ্য রেখে দেশবাসীর সামগ্রিক সত্তার নিকট সরাসরি পৌঁছে গিয়ে তাঁদের নৈতিক তেজপুঞ্জ জাগ্রত করাই হয়ে উঠতে পেরেছিল প্রতীকগুলির নিয়তি। নিজেদের মতো ক’রে তারা এক নবীন নন্দনতত্ত্ব গ’ড়ে তুলেছিল, এক ঘরোয়া এবং সর্বজনীন আলোচনা সভা, যেখানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। গান্ধীর পূর্বে কোনো রাজনৈতিক নেতা এমন স্বচ্ছ, সামগ্রিক ও শক্তিশালী কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারেন নি, তাঁর মতো গগনচুম্বী আত্মবিশ্বাস, সাংগঠনিক দক্ষতা ও মানুষে-মানুষে সংযোগ সৃষ্টির গুণ তাঁদের কারুরই ছিল না। পরবর্তী পঁচিশ বছর তিনি যে ভারতের জাতীয় জীবনে অদ্বিতীয় প্রভাব বিস্তার করবেন, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না।
স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনকে গান্ধী ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবনের অধীনস্থ একটি অধ্যায় হিসাবে দেখতেন এবং তাকে তিনি সেইভাবেই পরিচালনা করতে মনস্থ করেছিলেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি একমাত্র অথবা, একমাত্র না হলেও, দুইয়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠত, তা হলে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তার নৈসর্গিক গুণের জন্য মূল্য দেবার ঝুঁকি নেওয়া দেশবাসীর পক্ষে সম্ভব ছিল; যেমন, রাজনীতিকে একটি পেশা হিসাবে দেখা, নিচুতলার কর্মীদের অগ্রাহ্য ক’রে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া, ইত্যাদি। গান্ধীর অভিমত প্রণিধানযোগ্য হলেও, তা তাঁর জন্য কিছু সমস্যারও সরিসটি করেছিল। বস্তুত, স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও নৈতিক পুনরুজ্জীবন দুটি পৃথক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে উভয়ের মধ্যে কখনও–কখনও সংঘাতের সৃষ্টি হত। তদুপরি, আন্দোলনের স্বার্থে, একদিকে সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ আর তার বিপরীতে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রতিনিধিস্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করার সূত্রে বিপরীতমুখী টানেরও সম্মুখীন হতে হত। নৈতিক পুনরুজ্জীবন ও ‘গঠনমূলক কার্যক্রম’কে গান্ধী যতটা অগ্রাধিকার দিতেন, ততটা গুরুত্ব দিতে নেতৃবৃন্দের অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁদের অভিমত এই ছিল যে, স্বাধীনতা লাভ নৈতিক পুনরুজ্জীবনের এক আবশ্যক শর্ত এবং এই দুইয়ের মধ্যে স্বাধীনতাই অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। গান্ধী যেখানে সত্যাগ্রহকে ভারতীয় সমাজে তার অভিঘাত ও পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা সৃষ্টির দিক থেকে বিচার করতেন, তাঁরা সেখানে সত্যাগ্রহকে কেবল সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল ও প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়া আদায়ের স্তরেই তাঁদের বিচার সীমাবদ্ধ রাখতেন। অধিকন্তু, যেহেতু, একদিকে প্রথানুগ রাজনীতি এবং অন্যদিকে সত্যাগ্রহ ও ‘গঠনমূলক কার্যক্রমে’র আভ্যন্তরিক সম্পর্কটি গান্ধী চিহ্নিত করেন নি এবং যেহেতু সদাপরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাকে সংজ্ঞায়িত ও পুনর্সংজ্ঞায়িত প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল, সেহেতু তাঁর সার্বিক সংগ্রামকৌশল কিয়দংশে অসংলগ্ন ঠেকত এবং তাঁর নেতৃত্ব কখনও-কখনও যুক্তিবর্জিত ও অনিশ্চয়তাদুষ্ট বলে বোধ হত।
গান্ধী এ-বিষয়ে অবহিত ছিলেন এবং এর একটি মীমাংসাসূত্রের সন্ধানও তিনি করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, বিভিন্ন ব্যক্তির গুণাবলী ও ধাত ভিন্ন, এবং তাঁরা প্রত্যেকেই ভিন্ন-ভিন্ন কাজ করার জন্য উপযুক্ত। কেউ গঠনমূলক কাজ করতে পারলে বেশি খুশি হন, কেঊ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করতে বেশি আগ্রহী, আবার অন্য কেউ প্রথানুগ রাজনৈতিক কার্যক্রম পালনের জন্য বেশি উপযুক্ত। প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামে এই ভিন্ন-ভিন্ন প্রবণতাগুলিকে এমন ভাবে অঙ্গীভূত করে নিতে হবে যাতে যিনি যে কাজে পারদর্শী তিনি সেই কাজ করার সুযোগ পান। এর দ্বারা ব্যক্তিগত স্তরে তৃপ্তিলাভের সঙ্গে-সঙ্গে সঠিক শ্রমবিভাজনের সুবিধাও সুনিশ্চিত করা গিয়েছিল, যা বস্তুত, পুনরুজ্জীবন ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রয়োজনেরই একটি অঙ্গ। গান্ধী নিজের আগ্রহ ছিল প্রথমত গঠনমূলক কাজে এবং তারপরে সত্যাগ্রহে, প্রথানুগ রাজনীতিতে তাঁর কোনোই রুচি ছিল না। সেই কারণে প্রথম দুটি কাজে তিনি মনোযোগ দিতেন এবং তৃতীয়টি ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁদের উপর যাঁরা সে-কাজে দক্ষ। প্রথানুগ রাজনৈতিক কার্যকলাপকে অন্য দুটি থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করা যায় না, এবং এইখানে স্পষ্টতই এক কার্যকরী আপোষ করতে হত। ফলত,গান্ধীর সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক কিছুটা শিথিল ও তরল রয়ে যায় । একদিকে, কংগ্রেস তার স্বায়ত্তশাসনক্ষমতা বজায় রাখতে পেরেছিল, পার্টিকে গান্ধীর ইচ্ছার দাসে পরিণত হতে হয় নি, আবার অপরদিকে, তিনিও তাঁর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পেরেছিলেন, তাঁকে কংগ্রেসের আরও-একজন নেতা হয়ে পড়তে হয় নি। যদিও ভারতবর্ষে গান্ধীর সত্যাগ্রহ কার্যক্রমগুলি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত ধারা অনুসরণ করত, তবু, নতুন প্রয়োজনবোধ ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য কিছু–কিছু পরিবর্তনেরও প্রচলন করা হয়েছিল। এ-প্রসঙ্গে আমরা পরে ফিরে আসব। অনশন তেমন একটি নতুন ধারণা, যাকে ঘিরে বিতর্ক তাঁর সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থেকেছে। গান্ধী নিজে নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, তাঁর অনশনের কার্যক্রমগুলি, আর যাই হোক, ভুখ-হরতাল নয়, স্নায়ুযুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য ব্ল্যাকমেল-অস্ত্র নয়, এমন কি, অন্যদের সমবেদনা আদায় করার পন্থাও নয়, বরং, আত্মাহুতির এক-একটি দৃষ্টান্ত, নীতিসিদ্ধ এক কর্মপন্থা। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে মানুষের কাজ করার স্পৃহা বুদ্ধিবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তি থেকে একযোগে উৎসারিত হয়; কেবল উপদেশ এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে তাঁর মানসিক নিষ্ক্রিয়তাকে সচতেনতায় রূপান্তরিত করা যায় না। তাঁর হৃদয় স্পর্শ করতে হবে, আবার জাগ্রত ক’রে তুলতে হবে তাঁর বিবেক, এবং অনশন, ওই লক্ষ্যে পৌঁছনোর একটি কার্যকরী উপায়। উপবাসের প্রকৃতি ও পদ্ধতি-বিষয়ে গান্ধীর উপলব্ধি অনুসারে, অনশনের দুটি ভিন্ন উৎসমুখ লক্ষণীয়; প্রথমত, হিন্দুধর্মে তপস্যার প্রথা এবং দ্বিতীয়ত, প্রধানত খ্রিস্টধর্ম থেকে গৃহীত প্রেমসঞ্চারধন্য যাতনাভোগের ধারণা। উপবাস, স্বেচ্ছায় বরণ করে নেওয়া সেই আত্মপীড়া, যা অনশনকারীর চিত্তশুদ্ধি ঘটায় এবং একইসঙ্গে যাঁরা সেই অনশনের লক্ষ্য বিবেককে সচল করে।
ভিখু পারেখ ইউনিভার্সিটি অফ হাল-এর ‘পলিটিকাল থিয়োরি’-এর একজন অধ্যাপক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে একজন প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক। প্রচুর স্বীকৃতি এবং সম্মান পেয়েছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘Gandhi’s Political Philosophy: A Critical Examination’, Marx’s Theory of Ideology, Rethinking Multiculturalism: Cultural Diversity and Political Theory ইত্যাদি অসংখ্য গ্রন্থ।
(ক্রমশ)
বঙ্গানুবাদ – গৌতম বসু
লেখাটি পড়লাম। ভালো লাগল।
আপনার মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই । পরের কিস্তি তৈরি করছি।