আমি এক-একটি স্বর মঞ্জরী সংগ্রহ করে তুলি
: তৃষ্ণা বসাক

আজকাল মনে হয় আধুনিকতা বড় সীমায়িত শব্দ। মনে হয় গতি একটি ভয়াবহ অসুখ বুঝি। ‘ইউ মুভ সো ফাস্ট/ ইউ ভায়োলেট দা পাস্ট’।মনে পড়ে যায় সেই কমিক স্ট্রিপটিকে। অফিস যাবার সময় গিন্নিকে চুমু খেতে ভুলে গিয়ে ছুটতে ছুটতে ফিরে আসছেন কর্তা, দরজায় দাঁড়িয়ে পুল-কার, সবাই বিরক্ত, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, সেই টেনশনে এত জোরে ছুটে আসছেন কর্তা যে প্রতিবারই বউয়ের ঠোঁট মিস হয়ে যাচ্ছে!
মডার্ন আর আপ টু ডেট এই শব্দ দুটোর মধ্যের ফারাক স্পষ্ট হয় দিন দিন। বাবা একবার বলেছিলেন আপ টু ডেট -র মধ্যে একটা সূচনাবিন্দু আছে। একটা সময় থেকে একটা সময় পর্যন্ত। মানে এর মধ্যে বিধৃত সংস্কৃতির ইতিহাস।
সেই ইতিহাসচেতনা শুধু যে একটা মানুষের সৃষ্টিতে নয়, তার আচরণে, তার আলাপনেও থাকতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ অলোকরঞ্জন। এত উষ্ণ, এত আন্তরিক, এত প্রাণময় বাংলা কজন নিজভূমে বাস করা বাঙালি বলেন এখন?
এঙ্গেলসের একটি কাব্যনাট্য অনুবাদ করেছিলেন তিনি। স্তিমিত সিংহাসন।
‘…ধ্রুপদী সেই শোভা জগজ্জনতার

সামনে উজ্জ্বল হোক পুনর্বার!

ফিনিক্স যেরকম দীপ্যমান

ভস্ম থেকে জাগে,

জাগুক সেই মতো রোমের প্রাণ,

প্রাচীন যুগ যেন আবার জেগে ওঠে অনশ্বরতায়

বিশ্ব তাকে দেখে চম্‌কে যেন যায়…’

তাঁর কবিতায় যেন সেই অনশ্বর প্রাচীন যুগের জেগে ওঠা, শুধু কবিতা নয়, গোটা মানুষটার মধ্যেই।বিষনুপুরের
জোড় বাঙ্গালা মন্দিরের মতো, রাসমঞ্চের মতো, আশ্চর্য সুন্দর আর প্রাচীন তিনি। যে কাছে এসেছে, সেই পেয়েছে এর স্বাদ। আর আমার মতো যে আসতে পারেনি, আদতে আসতে চায়নি, সে দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে।
The speech of genuine thinking is by nature poetic.
সেই যে নাসেরদা (কবি নাসের হোসেন) ফোন করলে ব্যগ্র জিজ্ঞাসা ‘সুসংবাদ দাও সুসংবাদ,’ এর মধ্যেও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতার প্রকাশ। বাংলাদেশ থেকে রাজু আলাউদ্দিন ফোন করেছেন, তাঁদের ফোনালাপেও সেই শুদ্ধ ঝর্নার স্বতোৎসার। রাজুর ‘দক্ষিণে সূর্যোদয়’ বইটির প্রশংসার জবাবে রাজু তাঁকে ধন্যবাদ দিতে চাইলে তিনি বলছেন
‘না, ‘ধন্যবাদ’টা খুব বৈঠকী শব্দ হলো। আমি বলছি, আমাদেরতো পরিচয় হয়েই আছে এবং এটা আমরা নিশ্চয়ই কখনো সখনো…এই বাঁধনটা অনেকটা প্রায় রাজা মিডাসের মতোন। রাজা যা-কিছু স্পর্শ করতেন সোনা হয়ে যেত, জল খেতে গিয়ে দেখলো জলটা সোনা হয়ে যেত। তিনি জল খেতে পারতেন না।এরকম একটা অভিজ্ঞতা হয় কিন্তু যারা অনলাইনের মধ্যে ডুবে থাকে। সেই জায়গায় আপনাকে আমি আপাতত একজন মিডাস বলে অভিহিত করলাম। বাড়িতে সব ভালো তো? বাচ্চারা সবাই ভালো তো?
বোঝা যায় প্রায় অপরিচিতের সঙ্গে সম্পর্কটাও তিনি বৈঠকখানা থেকে ভেতরে, অন্দরে টেনে আনছেন। যেভাবে তিনি একাত্ম হতে পারেন কলকাতার মৈথিলী ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে, যে তাঁর কাছে অনুযোগ করে সে স্টিয়ারিং হাতে নিলেই কোন এক অচেনা নারী তাকে কেবলই পথ বাতলে দিতে থাকে। তাঁর কবিতা, তাঁর জীবন আসলে মানুষে মানুষে এই ছোট ছোট যোগাযোগগুলো, এ তো বুকের গভীরে থাকা খুব গভীর বিশ্বাস থেকে আসে, সমস্ত সন্ত্রাস, হামলা, যুদ্ধ, নিষ্পেষণের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে শুধু ভাষার ঘরে বাস করা নয়, মানুষের ঘরেও বাস করা।
আমার একসময়ের সাহিত্য অকাদেমির সহকর্মী নাট্যাভিনেতা শান্তনুদা প্রায়ই মুখর হয়ে উঠতেন অলোকরঞ্জন প্রসঙ্গে। তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে আছে তাঁকে নিয়ে লেখা অপূর্ব ছড়াটি-
#শান্তনু

#অলোকরঞ্জন_দাশগুপ্ত

পাড়ায় পাড়ায় শ্রান্ত মুখে
ঘুরে বেড়ায়, সত্যি বলতে
তার কাছে পথ পিদ্দিম
আর সে তার সলতে
জানো তোমরা শান্তনুকে?

কোথায় থাকে শান্তনু?
কেউ জানে না, হয়তো জানে
ভুবনডাঙার রামধনু।

শান্তনু তার কোন ঝিনুকে
জল দিয়ে সেই মুমূর্ষূকে
জীবন দিল, সে সব কথা
বলতে গেলে সপ্তসিন্ধু।

তোমরা কি তার গানগুলি
শুনতে পাও নি, শুনলে জানবে
শান্তনু সে গাঙ্গুলি।

আবার শমীক বন্দ্যোপাধায়কে নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি। তাতে এক অসাধারণ কৌতূক এই সাইবার যোগাযোগ নিয়ে। তিনি যে নিজেই বলেছেন তিনি পৃথিবীর অন্যতম অফলাইনার।
শমীক
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
সুনির্বাচিত কৃতবিদ্যের উজ্জ্বল তালিকায়
নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট এক নাম
একদিন সন্ধ্যায়
সরাসরি গিয়ে তাঁর সঙ্গেই
বন্ধুতা পাতালাম

তারপর থেকে প্রায়
শমীক আমার কাছে আসে আর
যাবার সময় অনিবার্যত
মোবাইল ফেলে যায়

যন্ত্রটা খুলে শুনে নিই কান পেতে
শমীকের প্লুত শব্দচয়ন ভাষায় ভাষান্তরে
এই ভিয়েনার সেমিনারে এই বাংলার ধানক্ষেতে

বহুদিন ধরে শমীক আমায় দেয়নি চরণধূলি,
মাঝ-রাত্তিরে তার ফেলে যাওয়া মোবাইলগুলি থেকে
আমি এক-একটি স্বর মঞ্জরী সংগ্রহ করে তুলি…
(সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা ১৪২২)

সে মানুষ কখনো আবার পুরোন ব্যাগের চেন সারানো এক উটকো লোক।
‘ব্যালকনি থেকে
চেয়ে দেখি
শাল মহুয়ার
জনসভায়

সে কিছু আমায়
বলতে চায়

হঠাত বললঃ
‘পুরনো

ব্যাগের চেন
সারাবেন?’

তাকে যেই বলিঃ
‘আমার যে নেই
কোনই থলি’
বৈরাগী সে
পরক্ষণে
হাওয়ায় মিশে
আপন মনে ছেড়ে গেল ওই

শহরতলি’
(পুরনো ব্যাগের চেন, সুইনহো স্ট্রিট, ২০১৭)
আমি যেন দেখতে পেলাম, কাজ হারানো মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকেরা দলে দলে শহর ছেড়ে যাচ্ছে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (3)
  • comment-avatar
    মানস ঘোষ 5 years

    কবিকে যেন নতুন করে চেনা হল. খুব সুন্দর করে লিখেছেন তৃষ্ণা বসাক 🙏

  • comment-avatar
    Tapati Bindu 5 years

    গভীর অন্তর্মুখী বিশ্লেষণ তৃষ্ণা বসাকের । মুগ্ধ হলাম । 🍁

  • comment-avatar
    সমরেন্দ্র বিশ্বাস 4 years

    সুন্দর অলোকরঞ্জন, সুন্দর এই লেখা! ভালো লাগলো।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes