অলোকপর্ণার গল্প
বার্ষিক বনভোজন,
তরুণ সংঘ ক্লাব,
১৩৯২
তরুণ সংঘ ক্লাবের পিকনিকে সে বছর কোনো মাংস হয়নি। কী কারণে যেন মেম্বারদের সবার মনখারাপ। সকাল থেকে চন্দননগরের বাগানবাড়িতে বসে তাই দুই হাতে ছাই মেখে মাছের আঁশ ছাড়াচ্ছে রাজু। গোবেচারা মৃতমাছ দেখে রাজুর বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মায়ের ইশারায় “সাবধান! বিশ্রাম!” করা লোকটা কেমন বেমালুম তিনদিনের জ্বরে কারো অনুমতি না নিয়েই চলে গেল। কাঠের চুল্লিতে জ্বলতে চায়, এমন খাপছাড়া শেষ ইচ্ছে নিয়ে লোকটা উবে গেল ডিসেম্বর মাসে। আর চুল্লি যখন দাউ দাউ, পাশে দাঁড়ান বিন্নু বলে ফেলেছিল, “কেমন চিকেন তন্দুরির মতো গন্ধ বেরুচ্ছে”, আর পেট গুরগুর করে উঠল রাজুর। সে বুকসমান শ্বাস নিতেই তার ফুসফুস ভরে গেল থকথকে জুইঁ ফুলের গন্ধে। একটু দূরে রাখা লরির টায়ারের মতো বিরাট গোলাকার পুষ্পস্তবকের দিকে তাকাল রাজু, বাবার অফিসের বন্ধুরা মস্ত কাজ সেরেছে এমন মুখ করে নিজেদের আনা সেই পুষ্পস্তবকের কাছাকাছি গর্বিত একটা জট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজুর চোখের সামনে বাবার মৃতদেহ পুড়ে ছারখার হয়ে গেল, অথচ ফুলের গন্ধ একচুল কমলো না। রাজু আড়চোখে পুষ্পস্তবক দেখে, জুঁই ফুলেরা গা জড়াজড়ি করে মরে যাচ্ছে সেখানে। রাজুর ইচ্ছে হল একটা লাথ মারে ফুলের টায়ারটায়, আর সেটা চাকার মতো সবার চোখের সামনে দিয়ে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়ুক শ্মশানের পাশের এঁদো ডোবাটায়। আর বগ বগ করে কিছু বুদবুদ জেগে উঠেই মরে যাক।
এবার মেয়েমানুষ কম এসেছে, পিকনিকের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় রাজুর। হয়তো মাংস হবে না জেনেই যারা আসেনি, তারা আসেনি। মেয়েদের মাংস খাওয়ার বা খেতে চাওয়ার ইচ্ছেকে রাজু সম্মান করে। বঁটিতে মন ফিরিয়ে সে মাছের গা ঘষে ঘষে আঁশ খুবলে ফেলতে থাকে। কাছেই বাগানবাড়ির বাঁধানো পুকুরঘাট। সেখানে কে যেন একটা লাল মাংকিটুপি ফেলে গেছে।
তপন এসে ঠক করে এক গ্লাস মদ নামিয়ে রেখে গেল রাজুর সামনে। সকাল থেকেই সে আকন্ঠ। মেয়ে বউ যে কজন এসেছে তারা তপনকে দেখে ভয় আর লজ্জা দুইই পাচ্ছে। আর রাজু হিংসে করছে তপনকে। তার ভিতরে একটা দগদগে ইচ্ছে হামাগুড়ি কাটছে এমন যে,-
আকন্ঠ মদ খেয়ে সে মেয়ে বউদের সামনে ল্যাংটো হয়ে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়াবে আর সবাই ভয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ ঢাকবে। তারপর হয়তো তাদের বরেরা, দাদারা, আর যা যা পুরুষ হয়, তারা মারমুখো হয়ে রাজুকে পুকুরপাড়ে নিয়ে এসে পেটাবে বেদম, আর রাজু একটা বেওয়ারিশ লাল মাংকিটুপির মতো বাঁধানো পুকুরঘাটে পড়ে থাকবে।
রাজু মাংকিটুপিটার দিকে তাকায়। আসার সময় তো কাউকে এটা পরতে দেখেনি… কিন্তু মেয়ে বউদের লজ্জা ভয় দেওয়ার জন্য তপনকে উলঙ্গ হতে হচ্ছে না দেখে রাজু জ্বলে বারোভাতারি ডেচকিতে চাপানো চা পাতার মতো। মাঝে মাঝে উথলে ওঠে, আবার মরেও যায়।
মাছ কোটা হয়ে গেলে রাজু পুকুরের জলে হাত ধুতে নামলো। আর দেখতে পেল পুকুরের ওপারের কলাবাগানের ভিতর সঞ্জয় আর শিউলি পরপর হারিয়ে যাচ্ছে। গতবছর পুজোর ঠিক আগে আগে সঞ্জয় বাড়ি থেকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে যখন বিয়ে করে ফেলল শিউলিকে, শিউলির বাবা বলেছিলেন “এ বিয়ে আমি মানি না”। এখন কেমন শিউলির নাকটা সারাদিন লাল হয়ে থাকে। রাজু ওদের বিয়ের আগে তেমন পাত্তা দেয়নি এসব, কিন্তু বিয়ের পরের শিউলিটা বেশ দাগী। ঠান্ডা হাতের ঠান্ডা জল রাজু গেঞ্জিতে মুছে ফেলে কলাবাগানের তাকালো। তাকে দেখছে এমন কেউ এই পিকনিকে নেই। পুকুরঘাট থেকে লাল মাংকিটুপিটা তুলে মাথায় পরে নিল সে।
কলাবাগানের ভিতরের আলো কলাবাগানের মতো। মাটিতে দাগ কাটলে এখানে গভীর ক্ষত তৈরি হয়। হাতে মদের গ্লাস নিয়ে ধীরে ধীরে কলাবাগানের কলা সেজে রাজু এগিয়ে চলেছে। বাগান ঘন হয়ে আসলে ধীরে ধীরে সঞ্জয় আর শিউলির স্বর কানে আসতে থাকে রাজুর। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সে ঘন হয়, তার পা টলে ওঠে। সঞ্জয় আর শিউলি, শিউলি আর সঞ্জয় কলাবাগানের আবহাওয়া এখন। রাজু চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই আবহাওয়ায়, শিউলির মৃদু শীৎকার কানে এসে পৌঁছোয় কোনোক্রমে। লাল বাঁদর রাজু চোখ বুজে সেই আওয়াজ শোনে। অনেকক্ষণ ধরে আওয়াজ করে লাল নাক শিউলি। রাজুর চোখ খোলে যখন, সে দেখে, কাছেই মাটিতে একটা মোটা জলের পাইপের মতো একটা দাঁড়াস তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের গ্লাস থেকে ধীরে ধীরে মদ শেষ করে লাল বাঁদরাজু। তারপর গ্লাসটা প্যান্টের পকেটে ভরে ফেলে। এবার ফেরা প্রয়োজন মনে করে সে সাপটাকে আবার দেখে। সাপটা নড়ছে না, সাপটা রাজুকে বোঝার চেষ্টা করছে। রাজু দাঁড়াস সাপের সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে প্যান্টের চেন খুলে ফেলল, তারপর সাপটার গায়ে সকাল সকাল গরম হিসি করে দিল। সাপটা নিমেষে চমকে উঠে কলাবাগানের ভিতর হারিয়ে কলা হয়ে গেল।
সুতনুর বাচ্চাটা সকাল থেকে শুধু ঘ্যানঘ্যান। সুতনুর বউ বিরক্ত, এখন পাত্তা না দিয়ে মেয়েদের ভিড়ে বসে গানের লড়াই খেলছে আর বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝে থাবড়া দিচ্ছে। তবু সে ঘ্যানঘেনিয়েই চলে। রাজু টলতে টলতে মেয়েদের বাজারে এসে পড়লে, সবাই গম্ভীর মুখে রাজুর দিকে তাকায়। রাজু বাচ্চাটার সামনে থেবড়ে বসে। বাচ্চাটা ঘ্যানরঘ্যানর বন্ধ করে রাজুকে ভয়ে ভয়ে দেখে। তার দুই গালে অশ্রুর দাগ, নাক থেকে জল বেরিয়ে আছে। রাজু সুতনুর বউকে জিজ্ঞেস করে, “ওকে একটু নিয়ে যাবো?”
“পুকুরের বেশি কাছে যাবি না রনি!”
পুকুরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রনি আর রাজু। রাজু আঙুল তুলে দেখায়, “দেখ জল!”
“দেখ পাতা!”
“দেখ ছায়া!”
“দেখ তুই!”
“দেখ আমি!”
একটা নারকেল গাছের পাতা নিয়ে রাজু জল ঘেঁটে দেয়।
পুকুরের জলের রনি আর রাজু পুকুরপাড়ের রনি আর রাজুর পায়ের কাছে টলমল টলমল করে।
ডানা মেলা তপন এসে রাজুর হাতে আরেক গ্লাস মদ ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।
“কাকু একটা গল্প বলো,”
গ্লাসে চুমুক দিয়ে ড়াজু বলে, “গল্পের নাম টিয়াপাখির আনন্দ।…জানালার বাইরে পাখিটা অকারণে এসে বসে। জানালার ইচ্ছেমতো খোলা বা বন্ধ হওয়া। জানালা খোলে কোনোদিন, কোনোদিন বা বন্ধ থাকে। অনেক সময় বাতাস লেগেও বন্ধ হয়ে যায় ভুল করে। পাখির দোষ নেই, জানালারও না। সব হাওয়ার খেল বা মালিকের মর্জি। জানালা বন্ধ থাকলে পাখিটা চুপ করে অপেক্ষা করে জানালা খোলার। জানালা খোলা থাকলে অল্প অল্প কিচিরমিচির শোনা যায় রান্নাঘরের দিক থেকে। পাখি খুঁটে খুঁটে শব্দ খায়- চামড়া থেকে পালক উপড়ে টেনে তোলার মতো। সবশেষে যখন জানালা বন্ধ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে, দেখা যায় পালকহীন, ন্যাংটা, খাপছাড়া একটা টিয়াপাখি ওভারহেড কারেন্টের তার আঁকড়ে ধরে কী প্রচন্ড দুঃসাহসে দুই পা ফাঁক করে দোতলার সেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়া বয়, অথচ উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা সে ততদিনে হারিয়েছে একদম। এরপর একদিন প্রচন্ড কারেন্ট বইবে তার দিয়ে, আর ন্যাড়া টিয়াপাখি ঝলসে রোস্ট হয়ে থপ করে রাস্তায় পড়ে যাবে। কারেন্টের তারের সেটা কাম্য নয়, এমনকি জানালাও পারতপক্ষে তা চায় না, কিন্তু টিয়াপাখির ধান্ধা এমনটাই। অন্যথায় রেহাই নেই। … বুঝলি?”
রনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ড়াজু অল্প অল্প করে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। গল্প শেষ হয়ে গেছে। রনি ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করে আবার।
বিন্নু এসে রাজুকে ডেকে নিয়ে যায়। আলু কাটতে হবে। ভাজার জন্য।
সঞ্জয়কে ঝকঝকে লাগছে সকালের চেয়ে। রাজু আড়চোখে দেখে।
শিউলির নাক এখনো লাল। রাজু আড়চোখে দেখে আর মদ খায়। আর আলু কাটে। হাতে ধরে ধরে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোসা ছাড়ায়। তারপর জলে ডোবায়। তারপর ফস ফস করে কেটে ফেলে। তারপর ফের জলে ফেলে দেয় তাদের। বিন্নু সেই জলে ভেজা আলুর ফালিদের তেলে চালান করে। তেল জল পেয়ে ছ্যাক করে ওঠে। প্রতিবার আলু তেলে যায়, আর প্রতিবার তেলের ছ্যাক ছ্যাক। রাজু ড়াজু হয়ে ওঠে সেই আওয়াজে। শিউলির নাক আর দাঁড়াস সাপের পলায়ন একাকার হয়ে যায়। পৃথিবীতে সকলই কেবল কলা, কাঁদি কাঁদি, গাছ হতে ঝুলে থাকা। রাজু ছ্যাক করে উঠে গলায় গ্লাস খতম করে দেয়।
শালপাতা, গরম ভাত, ডাল, আলু ভাজা, পোনামাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপর, নুন, নেবু, নংকা আর জল।।
শালপাতা, গরম ভাত, ডাল, আলু ভাজা, পোনামাছের ঝোল, শিউলি, মদ, সঞ্জয়, পাখি, জানালা, কারেন্টের তার, মদ, রাজু, মদ, নেবু, নংকা, মদ ও জল।।
খাওয়ার পর ঠিক হল দল বেঁধে পুকুরে চান করা হবে। মেয়েরা এক ঘাটে, আর পুরুষেরা ডুবে ডুবে জল খাবে। গামছা কিনতে তপন আর সুতনু বাজারে গেল, ফিরে এলো গামছা আর জুঁই ফুলের পাতলা মালা নিয়ে। উড়ন্ত তপন প্রত্যেকটি মেয়ে বউয়ের গলায় সেই মালা পরালো আর রাজু, আমাদের আকন্ঠ ড়াজু হতবাক হয়ে দেখলো সাদরে সেই মালা গ্রহণও করছে মেয়েরা। পুকুরের জলে পা পড়তেই রাজুর সার গা ছ্যাক ছ্যাক ছ্যাকছ্যাক।
জলে কি দাঁড়াস নামে? জলে কি দাঁড়াস ওঠে?
রাজুর মনে পড়ল, পিকনিকে মাংস হয়নি কারণ গত ডিসেম্বরে তরুণ সংঘের সক্রিয় সদস্য অহিভূষণ সরকার, রাজুর জলজ্যান্ত বাবা, তিনদিনের জ্বরে মারা গেছেন। রাজু পুকুরের মধ্যে থাকা তরুণ সংঘের বাদবাকি জলজ্যান্ত সক্রিয় সদস্যদের দিকে তাকায়।
ছেলেরা জলে গা ছেড়ে দিয়েছে। মেয়েরা এক ডুব দিতে না দিতেই তাদের গলার জুঁই ফুলের মালা খুলে ভুস করে ভেসে উঠছে জলে। রাজু আনন্দ পায়। সে দেখে তপন কেমন অসহায়ের মতো জলের উপর গোল গোল রিং তৈরি করে ভেসে থাকা গলাহারা মালাগুলোকে দেখছে।
রাজু একটু সাঁতরে গিয়ে একটা মালা গলায় পরে নেয়।
তারপর গামছা ও জুঁই ফুলের মালা পরা রাজু মাঝপুকুরে চলে এসে চোখ বুজে, নাক টিপে একটা ডুব দেয়।
তরুণ সংঘের ম্যাটাডোর প্রস্তুত। মেয়েরা আগেভাগে উঠে বসে পড়েছে। ছেলেরা কোনোরকমে লেগে পড়ছে ম্যাটাডোরের ছাদে, পাছায়। রাজু লাল মাংকিটুপিটা ঘাটে রাখতে পুকুরের কাছে আসে। সামনেই, জলে, একটা জুঁই ফুলের মালা স্থির হয়ে ভেসে আছে। কোথাও যাচ্ছে না। রাজু হাত বাড়াবে কি না ভাবে। রাজু হাত বাড়ায় না। সে কিছুই করে না। ফিরে আসে। স্থির জলে মালাখানি ভেসে থাকে।
ম্যাটাডোর ফিরে এলে, পিকনিক মরে ভূত হয়ে গেলে, রাজু বিছানায় মাথা রাখতেই চোখের সামনে জলজ্যান্ত জুঁইফুলের মালা ভেসে ওঠে। রাজু স্থির করে, তরুণ সংঘের ১৩৯৩ সালের বার্ষিক বনভোজনে, জুঁইফুলের মালাটা হাত বাড়িয়ে তুলে আনবে।
র্যাদার, তপনকে বলবে মালা-ই না আনতে।