অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প
পুকুর
‘মড়াপুকুরে কালো জল… মড়াপুকুরে কালো জল…’
শৈশব ঘেরা সুরে দুলছে নীলুপাগলি। হাততালি দিচ্ছে। ভাঙা স্বরে গাইছে, ‘মড়াপুকুরে কালো জল… মড়াপুকুরে কালো জল…’
অন্ধকার হয়ে এসেছে। এখন তাড়াতাড়ি আঁধার নামে। মানুষের ভুল হয়। রাস্তার আলো জ্বলে না। আভাস না দিয়ে বিকেল সরে যায়। হাওয়া কেমন নিস্তব্ধ শীতের গন্ধ আনে। পথেঘাটে লোকজন বড় দ্রুত মিলিয়ে যায়। পৃথিবী শান্ত হয়।
এমন ভূতগ্রস্ত সময়ে হিমঠাণ্ডা জলে নেমেছে নীলুপাগলি। ভারী পা দুটো নুড়ি-কাঁকড়ে গেঁথে বুকজলে দাঁড়িয়ে দুলছে। ওর আঁচল খসা, বাদামি কাঁচুলি লেপ্টে থাকা ভারী বুকে জল থইথই করে। ওপরে মাজা মাজা রঙের গলা, কালো সুতোর বাঁধুনি নিয়ে থুতনিতে উঠছে। মুখে সামান্য মেদ, নারী না পুরুষের মুখ, বোঝা যায় না। তারও ওপরে কাঁচা-পাকা ববকাট চুল মাথা ঘিরে চেপে বসে থাকে। প্রতিদিন ঠাণ্ডা বিকেলে নীলুপাগলি জলে নামে।
এখনও আমি দূরে মিলিয়ে যাইনি। আমার নীল রিবনের গিঁট খোলা। দূরে রাখা আছে আমার আশ্চর্য সাইকেল। পুরনো। হাফ-প্যাডেল শিখবার জন্য হারুদা দিয়ে গেছে। হারুদা আসলে চোর। চোরাই মাল বিক্রি করে। আকাশি রংচটা সাইকেলটা প্রথম শেখার যন্ত্র হিসেবে কম দামে দিয়েছে। হ্যান্ডেল খুলে আসতে চায়। বাঁক নিতে চাইলে আপত্তি জানায়। টায়ার- টিউব পাল্টাতে হবে। কত অজানা মানুষের ফেলে যাওয়া হাতের ছাপ ও গুনগুন গান নিয়ে খুব সাবধানে হাফ-প্যাডেল শিখেছি। এখন ফুল-প্যাডেলের সময়। আমার এই আশ্চর্য গ্রামে এদিক সেদিক ঘুরি, পিছনে তাড়া করে অচেনা মানুষের হাহাকার। ‘গেল গেল’ হাহাকার তাড়া করে, চোরাই সাইকেলে উঠে আমি হিন্দি গান করি। বিকেলে নেমে এসে মড়াপুকুরের সামনে দাঁড়াই।
নীলুপাগলির সামনে যাই না। প্রতিদিন ঠাণ্ডা অন্ধকার হয়ে আসার সময়ে ও বেটি জলে নামে। জলে দাঁড়িয়ে কালো জলের কথা সুর তুলে দুলে দুলে বলে। মেয়েদের কিছু বলে না। পাশের রাস্তা দিয়ে কোনও পুরুষ যেতে পারে না। পুরুষের হাঁটা, পথচলতি সাইকেল দেখে নীলু চেঁচিয়ে ওঠে… ‘এই শশালা শুয়োরের বাচ্চা…!’
কেউ কেউ গা করে না। কেউ তড়িঘড়ি রাস্তা ছাড়িয়ে যায়। কেউ ওর দিকে দু’হাতের বুড়ো আঙুল, তর্জনী, আর মধ্যমা দিয়ে সরেস অঙ্গভঙ্গি করে খিকখিক হাসতে হাসতে যায়। তাতে নীলুর মুখের আগল খুলে যায়। সে ভাঙা গলায় মা-বোন তুলে মোক্ষম গালাগালি ঝাড়ে। জল থেকে ওঠে না। শুধু বুকজলে দাঁড়িয়ে চেঁচায়।
গ্রামের কেউ জানে না নীলু কেন জলে নামে রোজ। আমি জানি। গামছাটা তুলে আনতে জলে নামে। সেই যে দূরের গোলাপি বাড়ি, নীল গরাদ, সেখান থেকে সারা দুপুর দেখি গামছাটা জলে ভাসছে। লাল রঙের গামছা। তবে বহু ব্যবহারে গোলাপি হয়েছে। সাদা খোপ। চেককাটা গামছাটা সারা দুপুর জলে ভাসে। যেন কেউ খুব যত্নে বিছিয়ে রেখেছে।
গামছাটা পল্টনের। আমার জন্মেরও আগে ভরা দুপুরে জলে নেমেছিল পল্টন। রোজকার স্নান। কোমরে গামছাটা বাঁধা ছিল। পরদিন ফুলেফেঁপে জল থেকে উঠল। পুকুরের নাম হল মড়াপুকুর আর গামছাটা পড়ে আছে একযুগ। প্রতি বিকেলে পল্টনের গামছাটা বুকে তুলে নিতে জলে নামে নীলুপাগলি। ওড়নার মতো জড়ায়। হারানো কিশোরের গামছা জলে ভাসে, নীলু আদর করে। আর পুরুষ দেখলে চেঁচায়… ‘এই শশালা…!’
নীল গরাদের ভিতর থেকে মড়াপুকুরটা অন্যরকম লাগে। গুনগুন, ফিসফাস, ঘষা চক, ধোঁয়াটে সকল রাগী স্বর ঘিরে থাকে, আমি গভীর মনোযোগে দেখি আজও গামছাটা ভাসছে কিনা। দেখতে পেলে ভাল লাগে। আজ তবে নীলু আসবে!
আজ নীলু এসেছে। দুলে দুলে নিজস্ব সুরে গাইছে। আজ এই সন্ধে-বিকেল সন্ধিক্ষণে নীলুর গায়ের পোকাগুলি বোঝা যাচ্ছে। পোকাগুলি বেরিয়ে জলে ভাসছে। চোখ থেকে পোকা বেরিয়েছে সবচেয়ে বেশি। সাদা মুড়ির মতো পোকাগুলি নীলুকে ঘিরে ধরে থাকে বহুদিন। আগে এত পোকা ছিল না। নীলুর শরীর বেয়ে এত পোকা এল সেদিন, মালগুদামের দিকে ঝোপে পড়েছিল যেদিন। সে’বার কয়েকদিন নীলু জলে আসেনি। ইস্টিশনের দিকে খোঁজ মেলেনি। পথেঘাটে কেউ তার গালাগালি খায়নি। কিছুদিন পর ঝোপে পাওয়া গেল নীলুকে। চুল পড়ে গেছে, সাদা সাদা পোকা ধরেছে, আর ন্যাংটো নীলুর তলপেট কাটা। ভিতরে বিশাল একটা হাঁ। কিডনি দুটো নেই। জানতাম বেটি উঠবে। উঠে গাল পাড়বে। উঠেছিল, সেদিন থেকে গায়ে পোকা নিয়ে ঘোরে, জলে নামে, গামছা নাচায়, আর গান গায়… ‘মড়াপুকুরে কালো জল… মড়াপুকুরে কালো জল…’
আমার সহপাঠিনীরা দূরে। বিকেল নামলে ওরা মিলিয়ে যায়। ওদের গোলাপি গা, নীল রিবন, নতুন সাইকেল, পৃথিবীর গল্প দূরে চলে যায়। আমি ঘরে ফিরতে দেরি করি। নীল গরাদ ছেড়ে নেমে এসে নীলুকে দেখে যাই। আজ সন্ধে হয়ে আসছে। চারপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া। এই ধোঁয়াশা আলো বেশ লাগে। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। একটা দুটো শাঁখ, গোপালমন্দিরে কাঁসর বাজে। খাটোয়া মানুষেরা ফেরে। দূরের রেললাইন পার হয়ে শীতবুড়ো আসে। আজও তা দেখছিলাম, নাম ধরে ডাক পেলাম, ‘পুতুল, এই পুতুল। ’
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি মিজানমামা। শীতবুড়োর গল্পটা মিজানমামাই আমাকে বলেছে। এইসব গল্পের ঝুলি শুধু তার কাছে থাকে। পল্টনের গল্পটাও খেতে খেতে বলেছিল মামা। শীতবুড়োকে কেমন দেখতে, আকাশের ভিতরের শূন্যতা, অমিতাভ বচ্চনের ‘দিওয়ার’, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের রোদ, গাজনের মেলায় হারানো, কিংবা পল্টনের ডুবে যাওয়ার গল্প… সব মিজানমামা জানে। সারা গ্রামে আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে মামা। আমার হজমিগুলির বন্ধু। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আমিই এনে দিই তাকে। কারণ মিজানমামা পয়সা কোথায় পাবে! সে তো বেকার। খেতে বসে খোঁটা খায়। ছ’ফুট লম্বা মানুষটার খুব উঁচু একটা সাইকেল আছে। খোঁটা খেয়ে উঠে যায়। সাইকেল নিয়ে গ্রামের পথে পথে ঘোরে। আর আমাদের দেখা হয়ে যায়। দেখা হলে গল্পের ঝুলি বেরোয়। মিজানমামা বলল, ‘অন্ধকার হয়ে এল। করিস কী?’
আমার ভারি ইচ্ছে করে, নীলুপাগলির গল্প, গামছাটার গল্প মিজানমামাকে বলি। ঘরে গিয়ে বলেছিলাম, চড় খেয়েছি। মামা কি আমায় চড় মারতে পারে? মনে মনে হিসাব কষি। উল্টো প্রশ্ন করি। ‘তুমি সাঁতার জান?’
‘কেন জানব না? মড়াপুকুরই এপার-ওপার করেছি কত!’
‘আমাদের গ্রামে আর একটাও পুকুর নেই কেন মামা?’
‘ছিল। আগে অনেক পুকুর ছিল। এখন বাড়ি উঠে গেছে। ’
‘তুমি এত জল ভালবাসো কেন মামা? দিদা তোমায় জলের পোকা বলে!’
‘তোর দিদা আমায় আরও অনেককিছু বলে। তবে হ্যাঁ, সাঁতারের ঝোঁকটা ছিল। ’
‘তোমার ভারি অভিমান হয়, না?’
‘আরে ধুর! ক’টা টাকার জন্যে অভিমান কীসের! ওসব বাদ দে। সময় ভাল না। আঁধারে ঘুরিস না। ’
‘নীলুপাগলিরও খুব অভিমান জানো…’
‘ওহ সেই পাগলিটা! পথে ঘুরত। জলে নামত। গালাগাল দিত। ইসস, কীভাবে মারল মেয়েটাকে। তলপেটটা হাটখোলা! চোখে দেখা যায় না!’
‘ওর গায়ে পোকা…’
‘পোকা ধরবে না? কতদিনের মড়া! আজ অবধি কেউ ধরা পড়ল না। ’
‘কেউ ধরা পড়ে না, না?’
‘তুই অংক শিখিস না, তাই এসব বোকা বোকা প্রশ্ন করিস!’
আমার রাগ হয়ে গেল। ‘তুমি ভারি অংক জানো! দিদা তো বলে, তুমিও অংক জানো না। ’
‘আমরা কেউ জানি না রে পুতুল। আমরা অজানাই থেকে যাব আজীবন। জল বুজে যাবে, কিডনি উধাও হবে, কাজ পাবো না, অংক জানব না, আমাদের এভাবেই কাটবে। ’
‘আজ তোমার গল্প নেই, শুধু অভিমান?’
‘নাহ, আজ তাড়া আছে।’ বলে জলে নেমে গেল মিজানমামা। যেমনভাবে রোজ নেমে যায়। কানফাটানো শব্দ হলে, গায়ে জ্বালা ধরলে যেভাবে জলে নেমে যেতে হয়।
তবে এমন শান্ত ভঙ্গিমায় জলে নামে না মামা। ওধারের পোড়া জমিটা থেকে আধখানা হয়ে বাতাসে উড়ে এসে নামে। কারখানা উড়ে যায়, মানবদেহ উড়ে যায়, দূরের গোলাপি বাড়ির গুটিকয়েক কাচ ঝনঝন ভেঙে পড়ে, চিৎকার ওঠে, আর আধখানা মানুষ সাঁতার দিতে পারে না। তাই মিজানমামা জলে থেকে যায়। জলে তার বাস। জল থেকে ওঠে, অংক শিখতে বলে।
নীলুপাগলি এখনও গাইছে দুলে দুলে… মিজানমামা জল থেকে ডাকল, ‘ঘরে যাবি না আসবি?’
আমি একবার হারুদার চোরাই সাইকেলের দিকে দেখি। দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায়। মিজানমামা তাড়া দিল, ‘কী করবি? আসবি?’
বহুদূরের কোন ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বলল। ওধারে কারখানার পোড়া জমি থেকে উত্তুরে হাওয়া এল। গোলাপি বাড়ির দুনিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। নীল গরাদের নাম- ষষ্ঠ শ্রেণি, বিভাগ – ক।
কেডস-মোজা সুদ্ধু জলে পা ডোবালাম।