বালুগ্রন্থ <br /> হোর্হে লুইস বোর্হেস <br /> ভূমিকা ও অনুবাদ – অনুপ সেনগুপ্ত

বালুগ্রন্থ
হোর্হে লুইস বোর্হেস
ভূমিকা ও অনুবাদ – অনুপ সেনগুপ্ত

বিয়াল্লিশ বছর বয়সে লেখা আর্হেন্তিনীয় লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেসের ‘দ্বিশাখায়িত পথের বাগান’ (‘এল হারদিন দে সেন্দেরোস কে সে বিফুরকান’ বা ‘দ্য গার্ডেন অব ফর্কিং পাথস’) গল্পের সঙ্গে তাঁর ছিয়াত্তর বছরে প্রকাশিত ‘বালুগ্রন্থ’ (‘এল লিবরো দে আরেনা’ বা ‘দ্য বুক অব স্যান্ড’) গল্পের একটাই মিল। উভয় গল্পই একটা করে অদ্ভুত বইকে কেন্দ্র করে, এবং পরিশেষে উন্মোচিত হয় এসব বই প্রকৃতপ্রস্তাবে গোলকধাঁধা। পার্থক্য – প্রথম ক্ষেত্রে তৈরি হয় সময়ের গোলকধাঁধা। অসংখ্য অভিসারী, অপসারী ও সমান্তরাল সময়রেখার মিলিত জালে জগতের সব সম্ভাবনাই ধরা পড়ে, যেমন – তৃতীয় অধ্যায়ে নায়কের মৃত্যু হয়ে চতুর্থ অধ্যায়ে আবার বেঁচে ওঠে, কিংবা ধরুন আপনি কাউকে খুন করবেন ঠিক করলেন – সেক্ষেত্রে আপনি তাকে মারতে পারেন, তার হাতে নিহত হতে পারেন, দুজনেই মরতে পারেন, আবার দুজনেই বাঁচতে পারেন। এই যাবতীয় সম্ভাবনাই ওই সময়ের জালে আটকে যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ ‘বালুগ্রন্থ’ গল্পে যে বইটির কথা আছে, তাতে অদৃশ্য পরা-স্থান গোলকধাঁধা তৈরি করে। ফলে যতবার বইটি খোলা হয়, কখনও একই পৃষ্ঠাঙ্ক, লিখন ও ছবি দুবার দেখা যায় না। এই বই অসীম, ফলত পৃষ্ঠাঙ্কও অসীম। স্থানের অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি এই গল্পের গোলকধাঁধা তৈরিতে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে। গাউস প্রথম চতুর্মাত্রিক স্থানের কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সে-কাজ প্রকাশ করে যাননি। ব্যার্নহার্ড রিমান তারপর চতুর্মাত্রিক ও অধিকতর মাত্রার স্থান তাঁর মেট্রিক টেন্সরের সাহায্যে ব্যাখ্যা করলেন। রিমানের অবকল জ্যামিতি ছাড়া আইন‍্‍শ‍্টাইনের ‘ব্যাপক আপেক্ষিক তত্ত্ব’ সম্ভব ছিল না। পরে জার্মানির টিওডোর কালুৎজ়া ও অস্কার ক্লাইন চারটি স্থানের ও একটি কালের মাত্রা নিয়ে মহাকর্ষ ও তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের দুটো ক্ষেত্র-সমীকরণের ঐক্য স্থাপন করেন। ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজনের ‘মডুলার অপেক্ষক’ জগতে স্থানের মোট মাত্রা-সংখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সবকটা মৌলিক বলকে মেলাতে গেলে বিশ্বে স্থানকালের মোট মাত্রা-সংখ্যা দশ অথবা ছাব্বিশ হবে। আমরা প্রত্যেকেই যে গোলকধাঁধা, নিজের ভিতর ঘুরপাক খাই, তা তো নতুন কথা নয়। বোর্হেস যা করেন – কখনও এক আমি-কে বহু আমি-র গোলকধাঁধায় টেনে নিয়ে যান, আবার কখনও বহু আমিকে ফেলে দেন এক-আমির গোলকধাঁধায়। বোর্হেসের ‘সবকিছু ও নাকিছু’ (‘এভরিথিং অ্যান্ড নাথিং’- মূল স্প্যানিশ টেক্সটেরও এই ইংরেজি শিরোনাম) গল্পে আমরা যেমন বহু শেক্সপীয়রের দেখা পাই, তেমনই তাঁর ‘ধর্মতত্ববিদগণ’ (‘লোস তিওলোগোস’ বা ‘দ্য থিওলজিয়ানস’) গল্পে আউরেলিয়ান নামে এক ধর্মতত্ত্ববিদ মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে আবিষ্কার করেন পৃথিবীতে যে-প্রতিদ্বন্দ্বীকে সবচেয়ে ঘৃণা করতেন, এমনকি হেরেটিক সাব্যস্ত করে স্টেকে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই হুয়ান দে প্যানোনিয়া আর তিনি আসলে ঈশ্বরের চোখে একই ব্যক্তি। বোর্হেস সম্পর্কে ওক্তাবিও পাস বলেছিলেন, “বোর্হেস সর্বদাই ভিন্ন বোর্হেসকে আরেক বোর্হেসের মধ্যে অনন্ত অবধি মেলে দেন।” কবিতা কি প্রবন্ধ কি গল্পে বোর্হেস এই অনন্ত কিংবা অসীমকেই বন্দি করতে চান।

| বালুগ্রন্থ |

…তোমার বালির রশি…
– জর্জ হার্বার্ট (১৫৯৩-১৬২৩)

অসংখ্য বিন্দুতে গঠিত হয় রেখা, অসংখ্য রেখায় গঠিত তল, অসংখ্য তলে গঠিত আয়তন, অসংখ্য আয়তনে গঠিত হয় পরা-আয়তন… না – এই ‘জ্যামিতিক পন্থা’ বা ‘মোরে গেওমেত্রিকো’ আমার গপ্পো শুরু করার সেরা তরিকা হতে পারে না। প্রতিটা কাল্পনিক কাহিনীকেই সত্যি বলা রেওয়াজ, আমারটা যদিও সত্যি ঘটনাই।

কাইয়ে বেলগ্রানোর একটা অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচতলায় একাই থাকি। কয়েক মাস আগে এক সন্ধেয় করাঘাত শুনে দরজা খুললাম। একজন অপরিচিত দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা, মলিন অপরিচ্ছন্ন চেহারা, বা হয়তো আমার মায়োপিয়ার ক্ষীণদৃষ্টিতে তাঁকে ওইরকমই মনে হয়েছে। সত্যি বলতে কি, তাঁর সবকিছুতেই দারিদ্র্যের চিহ্ন – ফ্যাকাসে পোশাক, হাতে একটা ফ্যাকাসে স্যুটকেস। দেখেই আঁচ করলাম বিদেশি। প্রথমে ভেবেছিলাম বয়স্ক, পরে বুঝলাম তাঁর পাতলা, স্ক্যান্ডিনেভীয়দের মতো সাদাটে সোনালি চুলের জন্যেই আমার এই ভুল হয়েছিল। আমাদের এক ঘন্টার বেশি কথাবার্তার মধ্যে জেনেছিলাম, তিনি অর্কনি থেকে এসেছেন।

তাঁকে চেয়ারে বসতে বললাম। কথা বলতে একটু সময় নিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, এখন যেমন আমি ছাড়ি।

– আমি বাইবেল বিক্রি করি – অবশেষে বললেন।

আমার উত্তরে কিছুটা জাহিরই ধরা পড়ল:
– এ বাড়িতে তো বেশ কয়েকটা ইংরেজি বাইবেল রয়েছে, এমনকি প্রথম ইংরেজি বাইবেল, জন ওয়াইক্লিফের অবধি। এছাড়াও সিপ্রিয়ানো দে বালেরার বাইবেল, লুথারেরটা, সাহিত্যের বিচারে যা নিকৃষ্টতম, আর ভালগেটের লাতিন কপি। বুঝতেই পারছেন, এই মুহূর্তে আমার ঠিক বাইবেল প্রয়োজন নেই।

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন:
– আমি শুধু বাইবেলই বিক্রি করি না। আপনাকে একটা পবিত্র গ্রন্থ দেখাতে পারি। আপনার মতো মানুষের এতে আগ্রহ হতেও পারে। উত্তর ভারতের বিকানিরে এটা পেয়েছিলাম।

সুটকেস খুলে বইটা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। কাপড়ে বাঁধাই অক্টেভো সংস্করণ। স্পষ্টত অনেক হাত-ফেরতা হয়েছে। বইটা হাতে নিতেই এর অস্বাভাবিক ওজন আমাকে অবাক করল। পুটে ছাপা ‘হোলি রিট’, তার নীচে লেখা বোম্বে।

বলা যায় ঊনবিংশ শতকের – মন্তব্য করি।

জানি না, কখনোই জানতে পারিনি – উত্তর এল।

এলোমেলোভাবে বইটার পাতা ওল্টাই। চরিত্ররা আমার কাছে বেশ অপরিচিত। পাতাগুলো ক্ষয়ে গেছে, টাইপোগ্রাফিও তথৈবচ, বাইবেলের মতো দু-স্তম্ভে ছাপা। পাঠকৃতি ঘনসংবদ্ধ, প্রার্থনাগীতের ভঙ্গিতে লেখা। প্রতিটা পৃষ্ঠার ওপরের কোণে হিন্দু-আরবীয় সাংখ্যিক রীতিতে পৃষ্ঠাঙ্ক। একটা অদ্ভুত ব্যাপারে তাজ্জব বনে গেলাম। ধরা যাক, একটা ভার্সো বা জোড় সংখ্যার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠাঙ্ক ৪০৫১৪, তার পাশেই রেক্টো বা বিজোড় সংখ্যার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠাঙ্ক হয়তো ৯৯৯। পাতা ওল্টাই। পরের পাতায় একটা আট অঙ্কের সংখ্যা। অভিধানের মতো ছোটো অলংকরণ রয়েছে এই পাতায়: কালি-পেনে আঁকা একটা নোঙর । মনে হচ্ছে কোনও শিশুর অদক্ষ হাতে আঁকা।

এই মুহূর্তে সেই আগন্তুক আবার কথা বলে উঠলেন:
– ভালো করে দেখুন। আর কখনোই এটা দেখতে পাবেন না।

তাঁর বলা শব্দগুলোর মধ্যে একটা হুমকি ছিল, কিন্তু কণ্ঠস্বরে তা ছিল না।

পাতাটার জায়গাটা খেয়াল রেখে বইটা বন্ধ করি। একটু পরেই ফের বইটা খুললাম। পাতার পর পাতায় নোঙরের ছবিটা খুঁজে যাই। আমার অপ্রস্তুত অবস্থা ঢাকতে জিজ্ঞেস করি:
– এ কোনও হিন্দুস্তানি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ, তাই নয় কি?

– না – তাঁর উত্তর।

এরপর অনুচ্চ স্বরে কথা বলতে লাগলেন, যেন আমাকে কোনও গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব দিচ্ছেন:
– সমতলের এক গ্রামে এই বই দেখি। কিছু টাকা আর একটা বাইবেলের বিনিময়ে কিনে নিই। বইটা যার ছিল, পড়তে জানত না। আমার ধারণা সে এই বইয়ের মতো একটা বইকে রক্ষাকবচ হিসেবেই দেখত। নীচু জাতের লোক, অশুচি হওয়ার ভয়ে অনেকে তার ছায়া পর্যন্ত মাড়াত না। সে আমাকে বলেছিল একে বালুগ্রন্থ বলা হয়, কারণ বালির মতো এই বইয়েরও কোনও প্রথম বা শেষ নেই।

আগন্তুক আমাকে এর প্রথম পাতা বের করতে বললেন।

আমি প্রচ্ছদ বাঁহাতে রেখে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ভিতরে ঢুকিয়ে বইটা খুলতে যাই। কিন্তু অবিশ্বাস্য – প্রতিবারই কিছু পৃষ্ঠা প্রচ্ছদের সঙ্গে লেগে থাকছে, যেন বইটা তৈরি হওয়ার সময় থেকেই এইভাবে বিন্যস্ত।

– এবার বইটার শেষ খুঁজুন।

একইভাবে ব্যর্থ হই।

– অসাধ্য – কোনোক্রমে নিজের তোতলামি আটকে বিড়বিড় করি। আমার কণ্ঠস্বরই নিজের বলেই চেনা যাচ্ছিল না।

বাইবেল ফেরিওয়ালা এবারও অনুচ্চ স্বরেই বললেন:
– অসাধ্য, এখন পর্যন্ত তা-ই। এই বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রকৃতপক্ষে অসীম। প্রথম পৃষ্ঠা, শেষপৃষ্ঠা বলে কিছু নেই। জানি না, কেন এমন যদৃচ্ছভাবে পৃষ্ঠাঙ্ক করা হয়েছে, তবে এর উদ্দেশ্য বোধহয় কাউকে বোঝানো যে কোনও অসীম রাশির পদগুলো যে-কোনোভাবে সংখ্যাপিত করা যায়।

তারপর তিনি যেন সরবে চিন্তা করতে লাগলেন, তাঁর মনের ভাবনা ফুটে উঠছিল তাঁর কথায়:
– স্থান যদি অসীম হয়, তাহলে আমরা স্থানের যে-কোনও বিন্দুতে থাকি। যদি কাল অসীম হয়, তাহলে থাকি যে-কোনও কালবিন্দুতে।

তাঁর এইসব জল্পনাকল্পনায় বিরক্ত হচ্ছিলাম। তাই কথা ঘোরাই:
– আপনি ধার্মিক মানুষ, তা-ই না?

– হ্যাঁ, আমি প্রেসবিটারীয়। বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার। ওই লোকটাকে ঠকাইনি নিশ্চিত, ওকে যখন এই নারকীয় বইটার বিনিময়ে প্রভুর কথন দিয়েছিলাম।

আমি আগন্তুককে ভরসা দিই: এই কারণে তাঁর নিজেকে দোষারোপ করার কিছু নেই। জানতে চাইলাম, এই দেশ থেকে আবার অন্য কোথাও যাবেন কিনা। জানালেন, তাঁর পরিকল্পনা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বদেশে ফিরে যাবেন। তখনই জানলাম, তিনি স্কট, অর্কনি দ্বীপপুঞ্জে বাড়ি। স্টিভেনসন আর হিউমের প্রতি মুগ্ধতার কারণে আমি যে স্কটল্যান্ডের অনুরাগী. বললাম তাঁকে।

– আর রোবি বার্নস – তিনি আমার কথা যেন সম্পূর্ণ করতে চাইলেন।

কথা বলতে-বলতে বইটা পরখ করছিলাম। কপট উদাসীনতায় প্রশ্ন করি:
– এই অদ্ভুত বই ব্রিটিশ মিউজ়িয়মে দিতে আপনার ইচ্ছে হয়নি?

– না, এটা আপনাকেই দিতে চাইছি – এ-কথা বলেই তিনি বইটার দাম হিসেবে মোটা টাকা দাবি করলেন।

তাঁকে পুরোদস্তুর সততায় জানাই, এখন ওই পরিমাণ টাকা বের করা আমার সামর্থ্যের বাইরে। আমার মাথা কাজ করে যাচ্ছিল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা সমাধান মাথায় এল। বললাম:
– একটা বিনিময়ের প্রস্তাব দিতে পারি। কিছু টাকা আর একটা বাইবেলের বদলে আপনার বইটা আমাকে বিক্রি করতে পারেন। আপনাকে দেব আমার পেনসনের পুরো টাকা, একটু আগেই আমি তা পেয়েছি। আর দেব মা-বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ওয়াইক্লিফের ব্ল্যাকলেটার বাইবেল।

– ব্ল্যাকলেটার ওয়াইক্লিফ! – বিড়বিড় করলেন।

শোয়ার ঘরে গিয়ে টাকা আর বইটা নিয়ে আসি। গ্রন্থানুরাগীর উৎসাহে তিনি পাতা ওল্টাতে লাগলেন, তারপর পরখ করলেন বইটার বাঁধাই।

– ঠিক আছে, রাজি – বললেন।

অবাক হলাম তিনি দরাদরি করলেন না। পরে বুঝেছিলাম, বইটা বিক্রি করবেন কৃতসংকল্প হয়েই আমার বাড়িতে ঢুকেছিলেন। টাকা না গুনেই পকেটে ঢোকালেন।

আমরা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে, অর্কনি সম্বন্ধে এবং এই দ্বীপপুঞ্জ একসময় যাঁরা শাসন করতেন, নরওয়ের সেই ইয়ার্ল অভিজাত সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম। রাত হলে তিনি চলে গেলেন। আর কখনও তাঁকে দেখিনি। তাঁর নামও জানা হয়নি।

ভেবেছিলাম এই বালুগ্রন্থ ওয়াইক্লিফের জায়গায় রাখব। কিন্তু পরে মত পাল্টে ‘সহস্র এক আরব্যরজনী’র কয়েকটা অর্বাচীন খণ্ডের পিছনে লুকিয়ে রাখি।

শুলাম, কিন্তু ঘুমোতে পারলাম না। ভোর তিনটে বা চারটে নাগাদ আলো জ্বালাই। দুঃসহ বইটা বের করে পাতা ওল্টাচ্ছি, একটা পাতায় দেখি একটা মুখোশের ছবি, তার কোণে যে পৃষ্ঠাঙ্ক, এখন আর মনে করতে পারছিনা, তবে নবমঘাতের কোনও সংখ্যা ছিল।

আমার এই মহার্ঘ সামগ্রী কাউকে দেখালাম না। এর মালিকানার আনন্দের সঙ্গে যোগ হল ভয় যে আমার কাছ থেকে বইটা চুরি হতে পারে, আর সেইসঙ্গে সন্দেহ এটা আদৌ অসীম কিনা। উদ্বেগের এই দুই বিন্দু আমার স্বভাবগত মানবসঙ্গবিমুখতা আরও তীব্রতর করে তুলল। যে অল্প কয়েকজন বন্ধু আমার অবশিষ্ট ছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করাও ছেড়ে দিলাম। বইটাতে বন্দি হওয়াতে পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বেরোতাম না। এর পুট আর প্রচ্ছদ একটা আতসকাচ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম, তাতে কোনোরকম কুশলী দক্ষ চাতুরির সম্ভাবনা খুঁজে পাইনি। লক্ষ করি, ছোটো ছোটো অলংকরণ দু-হাজার পৃষ্ঠা অন্তর আছে। একটা খাতায় বর্ণানুক্রমিকভাবে ওদের নোট রাখতে লাগলাম। খাতাটা খুব শীঘ্রই ভর্তি হয়ে গেল। একই অলংকরণ পরে আর কখনও দেখা যেত না। রাতে অনিদ্রার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া বিরল অবকাশগুলোয় বইটার স্বপ্ন দেখতাম।

গ্রীষ্ম আসন্ন। বুঝতে পারছিলাম বইটা বীভৎস, দানবীয়। শুধু একটাই শীতল সম্ভাবনা এই ভেবে যে আমার মতো যে-লোক এই বই চোখে দেখেছে, আর রক্তমাংসের দশ আঙুল দিয়ে এতে আদরে হাত বুলিয়েছে, সেও কম বীভৎস, কম দানবীয় নয়। বইটাকে দুঃস্বপ্নলব্ধ, অশ্লীল জিনিস বলে মনে হচ্ছিল। অনুভব করছিলাম, বাস্তবতাকে তা দূষিত, কলুষিত করছে।

আগুনের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ভয় হল, কোনও অসীম গ্রন্থের দহনও একইভাবে অসীম হতে পারে, আর এর ধোঁয়া শ্বাসরোধ করতে পারে এই গ্রহের।

মনে পড়ল, একসময় কোথাও পড়েছিলাম, গাছের পাতা লুকোনোর সেরা জায়গা অরণ্য। অবসরের আগে জাতীয় গ্রন্থাগারে কাজ করতাম যেখানে ন-লক্ষ বই ছিল। জানতাম, সেখানে দরদালানের ডানদিকে একটা বাঁকানো সিঁড়ি নেমে গেছে পাতালঘরে। ওখানে মানচিত্র ও সাময়িকপত্র রাখা হয়। গ্রন্থাগার-কর্মীর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ওখানে স্যাঁতসেতে তাকগুলোর একটাতে বালুগ্রন্থ লুকোলাম। লক্ষ করার চেষ্টাও করলাম না তাকটা কত ওপরে কিংবা দরজা থেকে কত দূরে।

এখন একটু স্বস্তি অনুভব করি। তবে ওই গ্রন্থাগারের রাস্তা কাইয়ে মেহিকো দিয়ে হাঁটাচলাও ছেড়ে দিয়েছি।

| প্রাসঙ্গিক তথ্য |

জর্জ হার্বার্ট (George Herbert) (১৫৯৩-১৬৩৩) – ইংরেজ কবি, চার্চ অব ইংল্যান্ডের পুরোহিত। মাত্র ৩৯ বছরের জীবন। তাঁর কবিতায় আধ্যাত্মিক ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। লিখেছিলেন ‘দি অল্টার’ (The Altar), ‘ইস্টার উইংস’ (Easter Wings)-এর মতো প্যাটার্ন পোয়েম। মৃত্যুর বহুকাল পর ইংরেজি ভাষার অন্যতম মেজর পোয়েট হিসেবে স্বীকৃতি। বোর্হেসের গল্পের এপিগ্রাফটি (…thy rope of sand…) হার্বার্টের ‘দ্য কলার’ (The Collar ) কবিতার অংশ।

মোরে গেওমেত্রিকো ( more geometrico) – লাটিনে g-এর উচ্চারণ সবসময় গ, কখনোই জ নয়। ‘মোরে গেওমেত্রিকো’ মানে জ্যামিতিক প্রণালীতে, in a geometrical manner or order. দার্শনিক স্পিনোজ়ার ‘Principia philosophiae’ গ্রন্থের সাবটাইটল হচ্ছে more geometrico demonstrata (অর্থাৎ demonstrated in geometrical order).

কাইয়ে বেলগ্রানো ( Calle Belgrano) – স্প্যানিশ ‘কাইয়ে’ শব্দের অর্থ রাস্তা, স্ট্রিট। আর্হেন্তিতিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসের উত্তরাঞ্চলের একটি রাস্তার নাম কাইয়ে বেলগ্রানো।

অর্কনি (Orkney) – স্কটল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডের উত্তরস্থ দ্বীপপুঞ্জ । প্রায় ৭০টা দ্বীপের সমষ্টি, এর মধ্যে ২০টায় মানুষের বসবাস।

জন ওয়াইক্লিফ (John Wycliffe) (১৩২৮-১৩৮৪) – ইংরেজ ধর্মতত্ত্ববিদ, সংস্কারক ও লাতিন থেকে মধ্য ইংরেজি বা Middle English-এ বাইবেলের অনুবাদক।

সিপ্রিয়ানো দে বালেরা (Cipriano de Valera) (১৫৩১-১৬০২) – স্পেনীয় প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারক ও বাইবেল রচয়িতা।

লুথার (Martin Luther) (১৪৮৩ – ১৫৪৬) – জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ, প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশনের প্রাণপুরুষ, বাইবেল রচয়িতা। জার্মান (নিউ হাই জার্মান) ভাষার সাহিত্যিক রূপেরও জনক হিসেবে বিবেচিত।

ভালগেট বা য়ুলগাতা ( ইংরেজি – Vulgate, লাতিন – Vulgata; লাতিনে v-এর উচ্চারণ ইংরেজি w-র মতো) – লাতিন ‘য়ুলগাতা’ শব্দের অর্থ সাধারণ বা common. লাতিন ভাষায় বাইবেলের সাধারণ সংস্করণের নাম হয় Editio Vulgata. ৩৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ দামাসুসের নির্দেশে সেন্ট জেরোম (St. Jerome) লাতিনে বাইবেলের অনুবাদ শুরু করেন। প্রথমে তিনি গ্রিক টেক্সট থেকে অনুবাদ করলেও পরে মূল হিব্রু থেকে গোটা ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর রচিত লাতিন বাইবেলের কাজ শেষ হয়েছিল ৪০৫ খ্রিস্টাব্দে। ষষ্ঠ শতকে এক-মলাটের মধ্যে বিভিন্ন লাতিন বাইবেলের ভার্শনকে একত্র করে পূর্ণাঙ্গ বাইবেল তৈরি করা হয়, যার মধ্যে ওল্ড টেস্টামেন্ট অংশে মূলত জেরোমের অনুবাদ আর নিউ টেস্টামেন্টের জন্যে জেরোমের আগে রচিত বিভিন্ন লাতিন ভার্শন নেওয়া হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পূর্ণাঙ্গ লাতিন বাইবেলের বারবার পরিমার্জন ঘটে। ত্রয়োদশ শতকে পারী বিশ্ববিদ্যালয় এর উল্লেখযোগ্য সংস্করণ তৈরি করে। প্রথমদিকের মুদ্রিত সব ভালগেট বাইবেলগুলির উৎস ওই পারী সংস্করণ। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে পোপ অষ্টম ক্লিমেন্ট ভালগেটকেই (যা ক্লিমেন্টাইন ভালগেট নামে পরিচিত) রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রামাণ্য বিবলিক্যাল টেক্সট হিসেবে ঘোযণা করেন।

অক্টেভো (octavo) – বইয়ের একরকম টেকনিক্যাল ফর্ম্যাট। একটি বড়ো পেপার শিট বিশেষ ভাবে ভাঁজ করে ৮টি লিফের এপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে ১৬ পৃষ্ঠা ছাপানো হয়। সোজা ভাষায়, এখানে ১৬ পৃষ্ঠায় এক ফর্মা। প্রতিটি লিফ এখানে মূল বড় পেপার শিটটির আটভাগের একভাগ। তাই অক্টেভো নামকরণ। প্রসঙ্গত একটি বড়ো শিট একবার ভাঁজ করে যদি ২টি লিফের ওপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে ৪ পৃষ্ঠা যখন ছাপা হয়, তাকে বলে ফোলিও, আর যখন দুবার ভাঁজ করে ৪টি লিফের এপিঠ- ওপিঠ মিলিয়ে ৮ পৃষ্ঠা ছাপা হয়, তখন তাকে বলে কোয়ার্টো।

হোলি রিট (Holy Writ) – যে বই বা লিখন প্রশ্নাতীত কর্তৃত্বকামী। এই শব্দবন্ধ প্রথম দেখা যায় অষ্টম শতকের অ্যাংলো-স্যাক্সন স্কলার ভেনেরেবল বেদ (Venerable Bede)-এর লেখায়। উইলিয়ম শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’ নাটকে, আলেকজ়ান্ডার পোপের ‘ওয়াইফ অব বাথ’ কবিতাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে এই শব্দবন্ধ।

প্রেসবিটারীয় (Presbyterian) – জন কেলভিনের ধর্মতত্ত্ব দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত খ্রিস্টান সম্প্রদায়। স্কটল্যান্ডেই এর উৎপত্তি। অন্যান্য প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের মতো প্রেসবিটারীয়রাও বাইবেলকেই ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার একমাত্র প্রামাণিক ভিত্তিভূমি বা গ্রন্থ (সোলা স্ক্রিপতুরা) মনে করেন । ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ডে প্রেসবিটারীয় চার্চ গভরমেন্ট তৈরি হয়।

স্টিভেনসন (Robert Louis Stevenson) (1850- 1894) – স্কটিশ কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধকার। তাঁর বিখ্যাত বই ‘ট্রেজ়ার আইল্যান্ড’, ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’, ‘কিডন্যাপড’। ‘বালুগ্রন্থ’ গল্পের উত্তম পুরুষ কথকের মতো বোর্হেস নিজেও ছিলেন স্টিভেনসনের লেখার অনুরাগী।

হিউম ( David Hume) (1711-1776) – স্কটিশ অভিজ্ঞতাবাদী ও সংশয়বাদী দার্শনিক। অধিবিদ্যাকে বর্জন করে হিউমের দর্শনের মূল লক্ষ্য মানব প্রকৃতির বিশ্লেষণ। হিউমের মতে, অভিজ্ঞতালব্ধ প্রকৃত জ্ঞান বা প্রমা বলে কিছু নেই, যা আছে তা অভিজ্ঞতাজাত বিশ্বাস।

রোবি বার্নস (Robbie Burns) (১৭৫৯-১৭৯৬) – স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসের ডাকনাম রোবি। তিনি স্বদেশে রোবি বার্নস নামেও পরিচিত, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে রবি ঠাকুর।

ব্ল্যাকলেটার (Blackletter) – লেটারিং বা হরফের একরকম রীতি। গথিক বা ওল্ড ইংলিশ লেটার নামেও পরিচিত। আনুমানিক ১১৫০ থেকে এই হরফ বা ফন্টের প্রচলন। য়ুরোপ জুড়েই ব্যাপকভাবে একসময় ব্যবহৃত হত। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ ও ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ পত্রিকার লোগো ব্ল্যাকলেটার টাইপফেসে।

ইয়ার্ল (Jarl) – নরওয়ের অভিজাতদের টাইটল। খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত অর্কনি দ্বীপপুঞ্জ ইয়ার্লদের অধীনে ছিল। ইংরেজি আর্ল (Earl) শব্দটি ইয়ার্ল থেকেই এসেছে।

‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র কয়েকটা অর্বাচীন খণ্ড – ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র প্রথম য়ুরোপীয় ভার্শন ছিল ফরাসি ভাষায়। ১৭০৪ থেকে ১৭১৭-র মধ্যে ১২ খণ্ডে এই অনুবাদ করেছিলেন অঁতোইন গ্যালোঁ। তিনিই ‘আলাদিন ও তার আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ এই সব গল্প তাঁর অনুবাদে সংযোজিত করেছিলেন, যা মূল আরবি পাণ্ডুলিপিতে ছিল না। পরবর্তীকালে ইংরেজি ভাষায় এডোয়ার্ড লেন, জন পাইন এবং স্যার রিচার্ড বার্টন অনুবাদ করেন। ১৮৮৫ সালে ১০ খণ্ডে বার্টনের অনুবাদ বোর্হেসের বিশেষ প্রিয় ছিল। তিনি কৈশোরে বাবার পার্সোনাল লাইব্রেরিতে লুকিয়ে এই সব গল্প পড়তেন। বোর্হেসের বহু লেখায় ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র উল্লেখ আছে। ‘বালুগ্রন্থ’ গল্পে অর্বাচীন খণ্ড বলতে কার অনুবাদের কথা বলতে চেয়েছেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।

কাইয়ে মেহিকো (Calle Mexico) – বুয়েনোস আইরেসের একটি রাস্তা। এই রাস্তাতেই রয়েছে গল্পে উল্লেখিত আর্হেন্তিনার জাতীয় গ্রন্থাগার। একসময় বোর্হেস এই জাতীয় গ্রন্থাগারের ডিরেক্টর ছিলেন।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes