
ইউজিন ইউনেস্কোর ‘দ্য চেয়ারস’ অবলম্বনে ‘ অ-বাস্তব’ ( বঙ্গীকরণ- হিন্দোল ভট্টাচার্য )
দ্য চেয়ারস ( Les Chaises) ইউজিন ইউনেস্কো ( অনেকের মতে আয়োনেস্কো) -র একটি একাঙ্ক নাটক, যা একপ্রকার অ্যাবসার্ডিস্ট ট্র্যাজিক ফার্স। এই নাটকটিকে আমি বঙ্গীকরণের পাশাপাশি বঙ্গীয়করণও করেছি। নাটকটি প্রিন্টে প্রকাশিত হয়েছিল একটি কাগজে। আজ আবহমান অনলাইনে দিলাম। কেউ যদি এই নাটক করতে চান, তাঁকে স্বাগত। বিশ্ব নাট্য দিবসে আবহমানের পক্ষ থেকে এই নাটকটি ইউজিন ইউনেস্কোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
অ-বাস্তব
একটি ট্র্যাজিক ফার্স
( ইউজিন ইউনেস্কোর ‘দ্য চেয়ারস অবলম্বনে)
রচনা—হিন্দোল ভট্টাচার্য
২০২৩
অ-বাস্তব
একটি ট্র্যাজিক ফার্স
চরিত্র
দেবব্রত, বৃদ্ধ, বয়স ৭৫
মিতালী, বৃদ্ধা বয়স ৭০
বক্তা , প্রৌঢ়, বয়স ৪৫
প্রথম অঙ্ক
মঞ্চ—একটি চমৎকার সুসজ্জিত ঘর। বেশ বড়। ডানদিকে তিনটি দরজা। তার পর একটি জানলা। তার সামনে একটি বড় টুল। তার পর আরেকটা দরজা। ব্যাক ওয়ালের সেন্টারে আর একটি বড় দরজা, দুটো আরও দরজা। দুটি দরজা দর্শকদের কাছে লুকোনো থাকবে। বাঁদিকে আপস্টেজে তিনটি দরজা। একটি জানলা। একটি টুল। ডানদিকে তার বিপরীতের একটি জানলা। তার পাশে একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং একটি ফুলদানি। ডাউনস্টেজে দুটি চেয়ার রাখা পাশাপাশি।
দৃশ্য-১
বৃদ্ধ লোকটি ঘরের জানলার পাশে একটি চেয়ারে বসে আছেন। ঘরের একটা ছোটো লাইট নিভিয়ে, আর একটা বড় লাইট জ্বালিয়ে বয়স্ক মহিলা, মিতালী বৃদ্ধ লোকটির অর্থাৎ দেবব্রতর কাছে গেলেন। তাঁর পাঞ্জাবির একটা কোণ ধরে-
মিতালী- ভিতরে এসো। জানলাটা বন্ধ করে দাও। কী একটা পচা গন্ধ আসছে বাইরে থেকে। মশা ঢুকছে।
দেবব্রত- আমায় একটু একা থাকতে দাও।
2
মিতালী- আরে ভিতরে এসো। অত জানলার দিকে তাকিয়ে থেকে তুমি কী পাও? কাল দেখছিলাম বারান্দা থেকে ঝুঁকে আছ। এই বয়সে পড়েও তো যেতে পারতে। একে এই জলা জায়গা। তার ওপর বৃষ্টি পড়েছে। জল জমে আছে। এই সময়ে পড়ে গেলে কী হবে। সুদিনবাবুর অবস্থাটা দেখলে না কী হল! তোমার যদি আবার ঠান্ডা লাগে এখন, কী হবে!
দেবব্রত—একটার পর একটা ইতিহাস। আমি এই অতীত নিয়ে ক্লান্ত। আমি কী দেখতে চাই জানো? কনে দেখা আলোয় রাঙা শস্যক্ষেত।
মিতালী- এখন কী করে দেখবে? এখন সূর্য কোথায়? রাত হয়ে গেছে।
দেবব্রত ( দূরের কোথাও তাকিয়ে) এখনো ছায়া আছে।
মিতালী ( জোর করে টেনে ধরার চেষ্টা করে) চলে এসো।। চলে এসো। ভয় পাইয়ে দিচ্ছ আমায়। এখন কাউকেই তুমি দেখতে পাবে না। কেউ আসবে না। অন্ধকার হয়ে গেছে। আর চেষ্টা করেও লাভ নেই।
দেবব্রতও মিতালীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়।
দেবব্রত- আমি দেখতে চাইছিলাম—তুমি তো জানো, জল দেখতে আমি কত ভালোবাসি।
মিতলী – কীভাবে? আমার মাথা ঘোরে। এই বাড়ি, পাশেই ভেরি। কে বলবে কাছেই বাইপাস। যেদিকে তাকাও শুধু জল। ঘরের বাইরে জল, ঘর থেকে দূরে তাকালেও জল। দিগন্তবিস্তৃত শুধু জল। জল জল আর জল। একটা মাত্র রাস্তা। জনজীবন থেকে দূরে। পালিয়ে পালিয়ে বাঁচি।
দৃশ্য-২
(মিতালী, দেবব্রতকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে থাকল ডাউনস্টেজে যেখানে দুটি চেয়ার রাখা আছে।)
দেবব্রত—সন্ধে ৬টাতেই কেমন শুনশান অন্ধকার। এত অন্ধকার আগে কখনো দেখিনি। চাপ চাপ অন্ধকার। এখানে এখন রাত। আগে, রাত বারোটাতেও জীবন কেমন গমগম করত। সব কেমন নিশুতি রাতের মতো হয়ে গেল তাই না?
মিতালী—ভাব। সত্যি কথা। তোমার স্মৃতিশক্তি নিয়ে কিন্তু কোনও কথা হবে না।
দেবব্রত- সব সত্যি সত্যি কেমন পালটে গেল।
মিতালী- কেন হলো বলো তো।
দেবব্রত- আমি জানি না। হয়তো তার একটাই কারণ। যত দূরে তুমি যাবে, তত গভীরেই তুমি ডুবে যাবে। এরও কারণ হয়তো পৃথিবী ঘুরছে ঘুরছে এবং ঘুরছেই।
মিতালী—চারদিকে ঘুরছে। ( একটু হেসে, দেবব্রতকে জড়িয়ে ধরে) এখনও তোমার মগজ কিন্তু সমান ক্ষুরধার। তুমি কতকিছুই না হতে পারতে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার গোয়েন্দা, স্পাই, কিন্তু কিছুই হলে না। যদি তোমার একটূ অ্যাম্বিশন থাকত জীবনে
দেবব্রত—আর কীই বা হতাম! এর চেয়ে ভালো ভাবে থাকা যেত না। আর তাছাড়া, এখানে আমাদের একটা পরিচিতি আছে। যাই হোক, এ বাড়ির তো আমিই জেনারেল। পুরুষ সিংহ।
মিতালী- ওরে আমার পুরুষ সিংহ রে
দেবব্রত- প্রচণ্ড বোর হয়ে গেছি।
মিতালী- জলের দিকে যতক্ষণ তাকিয়ে থাক, তুমি বেশ খুশি খুশি থাক। আচ্ছা, তাহলে নিজেদের আনন্দ নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। কিছু একটা গল্প বানাই চলো, আর তাতে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিই। যেমনটা তুমি আগের দিন সন্ধ্যায় করছিলে।
দেবব্রত- তুমিই শুরু করো। এবার তোমার পালা।
মিতালী- না না তোমার পালা
দেবব্রত- তোমার।
মিতালী- তোমার।
দেবব্রত- তোমার।
মিতালী- তোমার তোমার তোমার
দেবব্রত- প্রিয়ে, চাটা খেয়ে নাও
( অবশ্যই সেখানে কোনও চায়ের পাত্র নেই)
মিতালী- আচ্ছা, চলো, ধরে নিই এটা ফেব্রুয়ারি মাস
দেবব্রত- আমার এই মাসটা খুব একটা পছন্দের না।
মিতালী- আর মাত্র একটাই আছে আমাদের জন্য। এখনো পর্যন্ত। আরে ধরে নাও না প্লিজ, আন্তত আমার জন্য…।
দেবব্রত- বেশ ঠিক আছে। ধরলাম এটা ফেব্রুয়ারি মাস। ( নিজের মাথাটাকে ঝাঁকিয়ে কথাটি বললেন)
মিতালী- ( হাসতে হাসতে) ঠিক আছে, ঠিক আছে। ধন্যবাদ। কী মিষ্টি করে বললে! (দেবব্রতকে জড়িয়ে ধরে) তোমার ভিতরে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে… চাইলে তুমি জজ ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতে।
দেবব্রত- আমি তো জজ। বিচারক গাঙ্গুলি। ( সবাই স্তব্ধ)
3
দৃশ্য-৩
মিতালী – ওই গল্পটা যেন কী, বলবে আমায়। ওই যেখানে গল্পটা এমন “ তার পর শেষে আমরা এসে পৌঁছলাম”…
দেবব্রত- আবার? বারবার বলতে বলতে ক্লান্ত। “ তার পর শেষে আমরা পৌঁছলাম” এটাই আবার…তুমি সবসময় একই গল্প শুনতে চাও! “ তারপর শেষ পর্যন্ত আমরা পৌঁছলাম”। কিন্তু এ গল্প খুবই একঘেয়ে। বিয়ের পর পঁচাত্তরটা বছর কেটে গেল একই গল্প চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি সন্ধ্যায়, একটু মুড ভালো থাকলেই, আমাকে দিয়ে তুমি একই গল্প বলিয়েছ। একই চরিত্র, একই দিন, একই মাস, সব সময় সবকিছুই এক। সময় বদলায়, গল্প আর বদলায় না। নতুন কিছু একটা বলা যাক।
মিতালী- ডার্লিং, আমি ক্লান্ত হই না। তোমার জীবনটা আমায় খুব আনন্দ দেয়।
দেবব্রত- আমার জীবনটা তো তুমি জানো।
মিতালী—হঠাৎই যেন বা আমি সবকিছুই ভুলে যাই। যেন বা প্রতি সন্ধ্যায় আমার মনটা একটা ফাঁকা স্লেটের মতো হয়ে যায়। হ্যাঁ গো। আমি খুব জেনেবুঝেই তোমাকে বলি। অনেকটা ওষুধ খাওয়ার মতো। আর তারপর আবার নতুন হয়ে যাই। শুধু তোমার জন্য। চলো না আবার নতুন করে শুরু করি।
দেবব্রত- যদি তুমি চাও, তবে চলো।।।
মিতালী- তাহলে শুরু করো। তোমার গল্প বলো। তোমার গল্পটা আমারও। তোমার যা সব আমার। তাহলে, সবশেষে আমরা পৌঁছলাম…
দেবব্রত- পৌঁছলাম।
মিতালী- অ্যাট লাস্ট পৌঁছলাম।
দেবব্রত—তার পর সব শেষে আমরা পৌঁছলাম একটা দীর্ঘ বেড়ার সামনে। ভিজে গেছিলাম সম্পূর্ণ। বহুক্ষণ ধরে কাঁপছিলাম।।।
মিতালী- মাসের পর মাস ধরে…
দেবব্রত—বৃষ্টির মধ্যে… আমাদের কান পা কনুই, নাক দাঁত ঠকঠক করছি। প্রায় আশি বছর আগের কথা। ওরা আমাদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। অন্তত বাগানের গেটটা খুলে দিতে পারত আমাদের জন্য ( স্তব্ধতা)
মিতালী—বাগানে ঘাস ছিল ভেজা।
দেবব্রত- একটা রাস্তা ছিল, যেটা চলে গেছিল ছোট্ট একটা মোড়ের দিকে। যেখানে ছিল একটা পুরোনো শিবমন্দির… গ্রামটা যেন কোথায়… মনে পড়ে?
মিতালী—না গো, আমি ভুলে গেছি।
দেবব্রত- আমরা কীভাবে সেখানে পৌঁছলাম? রাস্তাটা কোথায় ছিল? জায়গাটা কলকাতা, তাই না?
মিতালী—কলকাতা বলে কোনও শহর ছিল না, জানো না?
দেবব্রত—কলকাতা শহরটা ছিল, তার কারণ একটা সময় এটা ধ্বংস হয়ে যায়। শহরটা ছিল আলোর শহর। কিন্তু সে আলো নিভে গিয়েছিল। চার লক্ষ বছরের জন্য সে আলো নিভে গিয়েছিল। আজ তার কিছুই পড়ে নেই। শুধু কিছু কবিতা এখনও গুনগুন করে।
মিতালী—কবিতা? সত্যিকারের কবিতা? অদ্ভুত! কেমন কবিতা, শুনি?
দেবব্রত—একটা আধুনিক কবিতা। কিছুটা পরাবাস্তব। “ কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে/ তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়”
মিতালী—আর সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা ছিল ওই বাগানের মধ্যে দিয়ে? অনেক দূরে।।
দেবব্রত ( কিছুটা স্বপ্ন দেখার মতো স্বরে) সেই কবিতাটা…বৃষ্টি…
মিতালী—তোমার প্রতিভা নিয়ে আমার সন্দেহ কোনওদিন ছিল না। সামান্য একটু অ্যাম্বিশন থাকলেই তুমি নেতা হয়ে যেতে, সাংবাদিক হতে, অভিনেতা বা গোয়েন্দা, বিচারপতি… সব বয়ে গেল নর্দমার জলে। হায় রে…কালো… নোংরা জলে… পুরোনো খাল দিয়ে ভেসে গেল ( স্তব্ধতা।।
দেবব্রত – তাহলে শেষে আমরা পৌঁছলা।।
মিতালী—হ্যাঁ, বলে যাও… থেমো না…
দেবব্রত ( যখন মিতালী অল্প অল্প করে হাসতে হাসতে একটু একটু করে হাসিতে ফেটে পড়বে, তখন কথা বলতে বলতে দেবব্রতও হেসে ফেলবে।
তার পর শেষমেশ আমরা পৌঁছলাম, যতক্ষণ না কেঁদে ফেলছি, ততক্ষণ পর্যন্ত হাসতেই থাকলাম। গল্পটা এতটাই বোকাবোকা ছিল… বোকাটা জোরে দৌড়তে দৌড়তে এসে পড়ল, খালি গায়ে, পেটমোটা, এক হাঁড়ি ভাত নিয়ে… আর ভাত পড়ছিল মাটিতে… বোকাটাও মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে… তার ভুঁড়িও মাটিতে…তার পর আমরা হাসলাম…আমরা হাসতেই থাকলাম, সেই বোকাটে ভুড়ি নিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা ভাত আর সেই ভাত ছড়িয়ে থাকার গল্প নিয়ে… আসলে গরম ভাত পড়ে যাওয়ার গল্পে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।।
মিতালী ( হাসতে হাসতে) শেষমেশ আমরা বোকা লোকটাকে পছন্দ করে ফেললাম, অন্তত শেষ পর্যন্ত খালি গায়ে সে মাটিতে পড়ে গেল… আর ওই হাঁড়িটা…পেটে ভাত, মাটিতে ভাত, ভুড়িতে ভাত …সব মাটিতে…
দেবব্রত এবং মিতালী ( একসঙ্গে হাসতে হাসতে)
অন্তত আমরা হাসলাম… আহা…হাসলাম…পৌঁছলাম কোথাও… গরম ভাত আর বোকার গল্পে… হাসলাম… আমরা অন্তত পৌঁছলাম কোথাও… ( কথা বলতে বলতে আর একটু হাঁটবে তারা একসঙ্গে) কী বোকা রে বাবা… এক হাঁড়ি ভাত নিয়ে… এক হাঁড়ি ভাত… এক হাঁড়ি আমরা হাসলাম… আমরা হাসলাম… আমরা পৌঁছলাম কোথাও।।
মিতালী- তার মানে গোটা ব্যাপারটা এই। তোমার সাধের কলকাতা।।
দেবব্রত- আর কেই বা এর চেয়ে ভালো ভাবে পারত।।
মিতালী- তুমি সত্যিই এত ট্যালেন্টেড। জীবনে কিছু না কিছু হতে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান তো হতেই…
দেবব্রত- ভোটে দাঁড়াতে পারতাম…মন্ত্রী হতাম…
মিতালী- জমির দালাল, টাটার দালাল, ( হাসতে হাসতে) রামের দালাল
দেবব্রত- টাকা তো রোজগার করতে পারতাম
মিতালী- আরে এত টাকা রোজগার করে কী করতে?
দেবব্রত- শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন
মিতালী- দাঙ্গা লাগাতে!
দেবব্রত- পার্লামেন্ট ভাঙতাম
মিতালী- মূর্তি?
দুজনেই হাসতে থাকে।।
SCENE 4
মিতালী- মনে হয় কেরিয়ারটা নষ্টই করেছ
দেবব্রত ( ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে) আমি নষ্ট করেছি? আমি? আহ! মা, তুমি কোথায়? মা, মা গো।
মিতালী- এই তো এই তো আমি। ভয় কীসের?
দেবব্রত—না, সুইটহার্ট, তুমি আমার মা নয়। আমার কেউ নেই। কে আমাকে আগলে রাখবে?
মিতালী- কিন্তু আমি তো এখানে। এই তো পাশেই।
দেবব্রত- দুটো এক ব্যাপার নয়। আমার মাকে চাই। না, তুমি আমার মা নও।
মিতালী- আমার মন ভেঙে দিও না। কেঁদো না। সোনা ছেলে।
দেবব্রত– আমাকে যেতে দাও। আমি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছি। আমার পুরো শরীর ভিজে গেছে। আমার জীবন শেষ। নষ্ট। পচা গন্ধ বেরোচ্ছে।
মিতালী—শান্ত হও। শান্ত হও। .
দেবব্রত ( একটা বাচ্চা ছেলের মতো মুখভঙ্গী করে) আমার কেউ নেই। আমি অনাথ।
মিতালী—( সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে) ও আমার অনাথ ছেলে, আমার মন ভেঙে দিও না। ( বাচ্চাদের পিঠ চাপড়ানোর মতো করে করতে থাকে)
দেবব্রত ( ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে) আমার মা! আমার মা কই? আমার আর মা নেই।
মিতালী- আমি তোমার বউ। আমিই এখন তোমার মা।
দেবব্রত – সত্যি নয়। আমি এখন অনাথ। .
মিতালী—আমার পোষা , আমার অনাথ, সোনা আমার চাঁদের কণা।
দেবব্রত ( জেদ করে) না, আমি চাই না, আমি চা—-ই—- না।
মিতালী – ওরে আমার খোকনপুচু অনাথপুচু সোনা রে
দেবব্রত– নাআআআআআআআআআআআআআ
মিতালী – চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে অনাথবাবুর বিয়ে, হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে।
দেবব্রত—আমার মা কোথায়?
মিতালী—আকাশে। তিনি ঠিক শুনতে পাচ্ছেন। তারাদের মধ্যে থেকে, ফুলেদের মধ্যে থেকে। আর কেঁদো না সোনা। এবার তুমি আমাকেও কাঁদিয়ে দেবে।
দেবব্রত—সত্যি কথা নয়। মা আমাকে আদৌ দেখতে পাচ্ছে না। শুনতে পাচ্ছে না। আমি অনাথ। আর তুমি আমার মা নও।
মিতালী—সোনা আমার শান্ত হও। কষ্ট পায় না। তোমার কত গুণ। তোমায় এভাবে কাঁদতে দেখলে তিনি কষ্ট পাবেন। সব হারিয়ে যায় না। সব নষ্ট হয় না। তুমি তাদের সব বলবে। তোমার একটা কিছু বলার কথা আছে। তুমি সব জানাবে তাদের… একদিন।
5
SCENE 5
দেবব্রত—আমার বলার কথা আছে। আছে। সত্যি কথা। আমি লড়ছি। আমার কিছু বলার আছে। মানুষকে জানানোর মতো আমার একটা বার্তা আছে। মানুষকে… মানবজাতিকে…
মিতালী—মানুষকে জানানোর জন্য? মানবজাতিকে…তোমার বার্তা!
দেবব্রত- হ্যাঁ সত্যি। বলার আছে।
মিতালী—বুঝেছি। তুমি একটা সময় যুদ্ধ করেছ। সেনাবাহিনীতে ছিলে। এই সব তো?
দেবব্রত—আমি অন্যদের মতো নই। আমার একটা আদর্শ আছে। হয়তো তুমিই ঠিক। আমি প্রতিভাবান। যা চলছে ঠিক চলছে না। আমি বুঝতে পারছি। আমি জানি। তাই জানাতে চাই। জানি, জানানোটা অপরাধ। শাস্তি পেতে পারি। কিন্তু জানানোটা কর্তব্য। মানুষের চোখ মাঝেমাঝে খুলে দেওয়াটা মানুষেরই কাজ…
SCENE 6
মিতালী—তোমার সে কাজ নয়। তুমি অন্যদের মতো নও। তোমার আরও মহৎ কাজ আছে। তুমি অনেককিছু দেখেছ। প্রচুর লোকেদের সঙ্গে তুমি মিশেছ। সব বন্ধুদের সঙ্গে তোমার ঝগড়া। একটা লোকের সঙ্গেও তোমার সদ্ভাব নেই। এমনকী তোমার ভাইয়ের সঙ্গেও।
দেবব্রত- এটা আমার ত্রুটি নয়। জানো খুব ভালো করে ও কী বলেছিল।
মিতালী- কী বলেছিল?
দেবব্রত—বলেছিল “ শোন ভাই, তুই একটা রক্তচোষা কীট”
মিতালী- লোকজন ওরকম একটু বলে। তোমার এই কথায় অত মনে করার কিছু নেই। সমীরের কথায় এত রেগে যাওয়ার কী ছিল? এটাও কি তারই কারণে?
দেবব্রত- আমায় এবার রাগিয়ে দিচ্ছ। আমার না, তারই দোষ। আমি এ বিষয়ে আর কিছুই বলব না । ( এটা বলে সে হাসতে লাগল, কিছুটা বোকার মতো)
মিতালী- কিন্তু ও তো খুব ভালো মানুষ। অন্য মানুষের প্রতি তো একটূ সংবেদনশীল হতে হয়।
দেবব্রত- শুনে হাসি পাচ্ছে।
মিতালী—তুমি তো থানার ওসি হতে পারতে, লোকাল কমিটির নেতা বা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট
( দুজনেই চুপ করে গেল। দীর্ঘ স্তব্ধত। কেউ একটু নড়ল না। চেয়ারে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে রইল)
SCENE 7
দেবব্রত ( স্বপ্নের থেকে উঠে) বাগানের শেষে, একটা… একটা… একটা… কী যেন ছিল?
মিতালী- কলকাতা!
দেবব্রত—কলকাতার শেষে, কী যেন একটা
মিতালী—কী না কে?
দেবব্রত—সেই জায়গাটা এবং আবহাওয়া, দুটোই দারুণ ছিল।
মিতালী—আবহাওয়া যে খুব সুন্দর ছিল এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?
দেবব্রত—আমি জায়গাটা মনে করতে পারছি না।
মিতালী—মনের উপর অযথা চাপ দিও না
দেবব্রত- আরে বাবা তার পর বহুদিন কেটে গেছে। মনেই করতে পারছি না। কোথায় যেন ছিল?
মিতালী—কিন্তু কী?
দেবব্রত—আরে যেটা… আরে কোথায় ছিল, বা কেই বা ছিল।
মিতালী—যেখানেই হোক কিছু এসে যায় না। আমি তোমার সঙ্গে যে কোনও জায়গায় যেতে পারি। আমি তোমার সঙ্গেই যাব।
দেবব্রত—আহ! নিজের কথা বলতে কত যে কষ্ট হয়! কিন্তু আমাকে বলতেই হবে।
6
মিতালী—এটা একটা পবিত্র কর্তব্য। সকলকে না জানিয়ে কোনও একটা বার্তা গোপন করে রাখতে পার না তুমি। তোমাকে জানাতেই হবে। লোকজন তোমার বার্তার জন্য অপেক্ষা করছে। এই মহাবিশ্বও অপেক্ষা করছে বন্ধু।
দেবব্রত—বেশ তাহলে তাই হবে।
মিতালী—ডিসাইড করে নিয়েছ কি? তোমাকে করতেই হবে।
দেবব্রত—চা খাও।
মিতালী- তুমি ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন হতে পারতে। জীবনে অনেক বেশি আত্মশক্তি আসত তোমার। আমি খুব খুশি হয়েছি এ কথা ভেবে যে তুমি শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বের সবাইকে তোমার গোপন কথটি জানাবে বলে স্থির করেছ।
দেবব্রত—দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নিজের কথা নিজেই মুখ ফুটে বলতে আমার এত কষ্ট হয়!
মিতালী- একবার শুরু করলেই হবে। জীবন- মৃত্যুর মতো। একবার শুরু হয়ে গেলেই আর মন তখন বেঁধে রাখতে পারবে না। ভাবনা নিজের থেকেই আমাদের কাছে আসে। শব্দ আসে। আর তার পর আমরা শব্দ দিই। কিছু একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাই। শহর গড়ে ওঠে। বাগান গড়ে ওঠে। আর তার পর আমরা আর অনাথ থাকি না।
দেবব্রত—না, আমি কিছুই বলব না। আমি একজন পেশাদার বক্তাকে নিয়ে আসব। সে বলবে। মন্ত্রীরা সব ঘোস্ট রাইটার ব্যবহার করে পুরস্কার নিয়ে যাচ্ছে, আর আমি ঘোস্ট বক্তা নিয়ে এলেই দোষ?
SCENE 8
মিতালী—তাহলে, আজ সন্ধ্যার এটাই মুখ্য অনুষ্ঠান। আর তুমি কি সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছ? সব চরিত্র, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী? সবাইকে?
দেবব্রত—ও হ্যাঁ, সবাইকে। ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবীদের তো বটেই। ( স্তব্ধতা)
মিতালী—আর বাংলা চ্যানেলগুলো? প্রোডিউসার? দালাল? পার্টির নেতা? সমালোচক? সম্পাদক? কবি? নাট্যকার? অভিনেতা? পুলিশ? এদের?
দেবব্রত—আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের কেরানি, পোস্ট অফিসের পিওন, ছবি আঁকিয়ে, ডাক্তার, সবাইকে। সবাইই কম বেশি বুদ্ধিজীবী।
মিতালী—আর পার্টির ক্যাডার?
দেবব্রত- একদম।
মিতালী—আর্বান নকশয়াল? লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক? বিপ্লবী? জীবনমুখী? ডোম? বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং যারা বিচ্ছিন্ন?
দেবব্রত—অবশ্যই। সবাইকে। সবাইকে। কারণ প্রত্যেকেই বুদ্ধিজীবী।
মিতালী—হতাশ হয়ো না। তোমায় রাগিয়ে দিতে চাইনি। তোমার তো ভুলো মন। জিনিয়াসদের যেমন হয়। তুমি কি কোনও জিনিয়াসকে বিশ্বাস করতে পারো? কেউ কথা রাখেনি।
দেবব্রত—চা খাও নীরা। (স্তব্ধতা)
মিতালী—কাগজী লেবু, কাগজী লেবু, কাগজ তুমি খাও? অক্ষর খাও?
দেবব্রত—আমি ওদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি ( স্তব্ধতা) আমি ওদের সব বলব। আমার সারাজীবনের ঘটনা। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। আর এবার ওরা সব কিছুই জানতে পারবে। তোমরা যে আমায় বুঝতে পেরেছ তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
মিতালী—তোমার জন্য আমার গর্বের শেষ নেই
দেবব্রত—মিটিংটা শুরু হচ্ছে আর কয়েক মিনিটেই।
মিতালী- তাহলে এটা সত্যি, আজকের সন্ধ্যায় তারা সবাই আসছেন? মনে হচ্ছে তুমি আর কান্নাকাটি করবে না। বাবা ও মায়ের জায়গা নিয়ে নেবে মালিকপক্ষ আর বুদ্ধিজীবীরা? ( স্যব্ধতা) এই মিটিংটা কি তুমি বাতিল করতে পারো? আমাদের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে না তো? ( প্রচণ্ড হিংসাত্মক উত্তেজনায় দেবব্রত মিতালীর দিকে ঘুরে তকাল তার পর একটা বাচ্চার মতো ছোটো ছোটো পায়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে আবার তার চারপাশে ঘুরতে লাগল।)
দেবব্রত- তুমি সত্যি সত্যি ভাবছ, এর ফলে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাব?
মিতালী—তোমার একটু ঠান্ডা লেগেছে।
দেবব্রত—কী ভাবে এখন সব বাতিল করি?
মিতালী—অন্য আরেকদিন আসতে বলো। তুমি তো ফোন করে দিতেই পারো।
দেবব্রত—না না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আর তা পারি না। হয়তো তারা চলেও এসেহে কাছাকাছি।
মিতালী- তোমার এ বিষয়ে আরও অনেক ভাবা উচিত ছিল।
SCENE 9
আমরা বাইরে রিক্সার শব্দ শুনতে পাই।
দেবব্রত- আমার মনে হচ্ছে কেউ একজন এসেছে ( বাইরে কোলাপসিবল গেট টানার শব্দ)
মিতালী উঠে পড়ে এবং কান পেতে শোনার চেষ্টা করে।
মিতালী—মনে হচ্ছে অতিথি বক্তা।
দেবব্রত – এত তাড়াতাড়ি উনি আসবেন না। অন্য কেউ । ( কলিংবেল বাজে) এই তো…
মিতালী—হ্যাঁ।
খুবই নার্ভাস অবস্থায় দেবব্রত এবং মিতালী বন্ধ দরজার দিকে যায়।
দেবব্রত—দেখি কে
মিতালী—এই আমার চুলটা ঠিক করে নি… এক মিনিট
(জামা আর চুল ঠিক ঠাক করে নেয়। )
দেবব্রত—তোমার তো আগেই রেডি হওয়া উচিত ছিল। অনেক সময় পেয়েছিলে।
মিতালী—জামাকাপড়গুলো এত বাজে… পুরোনো হয়ে গেছে
দেবব্রত—একটু ইস্ত্রী করলেই তো হত। তাড়াতাড়ি করো। অতিথি দোরে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না।
( দেবব্রত এবং অতি বিরক্ত মিতালী দরজার কাছে যায়। আমরা কিছু সময়ের জন্য তাদের কাউকেই দেখতে পাই না। দরজা খোলার শব্দ পাই। তার পর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা গলার স্বর শুনি)
দেবব্রতর স্বর—শুভ সন্ধ্যা। ভিতরে আসুন, ভিতরে আসুন। কী সৌভাগ্য। ইনি হলেন আমার স্ত্রী।
মিতালীর স্বর—আসুন আসুন। আপনি এসেছেন খুব আনন্দ পেয়েছি। দেখে আসবেন। ছাতাটা ওদিকে রাখুন। কেউ নেবে না চিন্তা নেই। ব্যাগটাও এখানে রাখতে পারেন। ও মা কী সুন্দর আপনার শাড়িটা। আবার মিষ্টি কেন…
দেবব্রতর স্বর—আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।
দেবব্রত-র পিঠ দেখা যায়।
দেবব্রত- আসুন আসুন।
(দেবব্রত এবং মিতালী প্রবেশ করে এমন ভাবে যে তাঁদের মধ্যে একজন চরিত্র আছে। সেই মহিলাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই দুজন সেই অদৃশ্য মহিলার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে, যিনি তাদের মধ্যে আছেন।)
দেবব্রত ( মহিলাটিকে) রাস্তায় জ্যাম ছিল?
মিতালী ( মহিলাটিকে) আপনি ক্লান্ত হননি—হ্যাঁ একটু তো হয়েছেন।
দেবব্রত ( মহিলাকে) আমাদের বাড়িটা এমন জায়গায় এখান থেকেই ভেরিটা শুরু।
মিতালী ( মহিলাকে) না না, আপনি খুব ভদ্র সজ্জন তাই এমন বলছেন।
দেবব্রত ( মহিলাকে) দাঁড়ান আসুন আসুন, আপনার জন্য একটি চেয়ার এনে দিই।
( দেবব্রত বাঁদিকে গিয়ে ৬ নং দরজা খুলে বেরিয়ে যান)
সেই অদৃশ্য মহিলাকে দুটি চেয়ারের একটিতে বসার জন্য দেখিয়ে দিয়ে নিজে একটিতে বসলেন মিতালী।
মিতালী – বসুন বসুন। এখানে বসে আরাম লাগছে না? ভেরিটার ঠিক ধারে এই বাড়িটা দিয়েছিলেন ওই আপনারই ফ্যান আমার স্বামী। তখন নকশাল পিরিয়ড। এই ভেরির নীচে নাকি লাশ পোঁতা থাকত। অনেক লাশ আমরা দেখেওছি ভেসে উঠতে
( এই সময় ৭ নং দরজা দিয়ে দেবব্রত প্রবেশ করে একটি চেয়ার নিয়ে) আমার জন্মদিনের দিন এই বাড়িটায় আমরা আসি। ভালো না?
8
মাঝে একটা ফাঁকা চেয়ার রেখে দুজনেই সেই চেয়ারের দিকে মুখ করে বসেন মিতালী ও দেবব্রত। কথা বলছেন এমন ভাবে যেন সেই মহিলাও কথা বলছেন। কিন্তু আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।)
দেবব্রত- আর বলবেন না সময় এত দ্রুত বদলে গেল
মিতালী- ঠিকই বলেছেন। মানুষ অনেক বেশি স্বার্থপর হয়ে গেছে। এই নব্বই দশক থেকেই শুরু হয়েছে। হ্যাঁ। বাবরি মসজিদ রাম জন্মভূমি। ঠিকই। গুজরাত দাঙ্গা। এত ধর্ম ধর্ম কি ছিল বলুন? ঢুকে পড়েছে। পেটে রুটি না থাকলে ধর্ম নিয়ে করবে কী? হ্যাঁ।
দেবব্রত- চুপ চুপ। এখন এসব বিষয়ে কথা এভাবে না বলাই ভালো।
(এবার মহিলার দিকে) ম্যাডাম, বুঝতেই তো পারছেন, মধ্যবিত্ত মানুষ। যতই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাক। কী দরকার…
( কিছু একটা উত্তরে বলছেন সেই মহিলা। মিতালী ও দেবব্রত মুচকি হাসছেন, মাথা নোয়াচ্ছেন, নানারকম শোনার অঙ্গভঙ্গি করছেন। মুখ থেকে সব হাসি উধাও হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে)
দেবব্রত ( মহিলার দিকে) ঠিকই বলেছেন।
মিতালী- একদম।
দেবব্রত- হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ—না না, পুরোটা কি তাই?
মিতালী—না না
দেবব্রত- সত্যিই?
মিতালী- কী বলছেন!
দেবব্রত- অসম্ভব!
মিতালী- হতেই পারে না।
দেবব্রত (হাসতে হাসতে) এভাবে! সে কী!
মিতালী (হাসতে হাসতে) আচ্ছা আচ্ছা ( দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে) সেন্স অফ হিউমর অসাধারণ
দেবব্রত—যাই বলুন, আপনার মনে কিন্তু জোর আছে।
মিতালী—এমনটা দেখাই যায় না আজকের যুগে
দেবব্রত—কী একটা পড়ে আছে ( এই বলে নীচু হয়ে তোলে) আহ…। না না, আমি তুলছি। আপনার থেকে আমি ছোটোই হব।
মিতালী—কী বলছ উনি তোমার চেয়ে ছোটো?
দেবব্রত—বার্ধক্য একটা ভার। আমি আপনার চিরযৌবন কামনা করি।
মিতালী- না না, উনি একদম হৃদয় থেকেই বলছেন।
( বেশ কিছু সময় ধরে দেবব্রত এবং মিতালী সেই অদৃশ্য মহিলাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। একবার দর্শকদের দিকে তাকায়। তার পর নিজেরা চোখাচোখি করে। )
মিতালী—যাই বলুন না কেন, আমাদের সঙ্গে যে এত দুর্যোগেও দেখা করতে এলেন, তা আমাদের কাছে পরম সৌভাগ্যের।
দেবব্রত- আমরা হলাম রিটায়ার্ড মানুষ।
মিতালী- উনি আবার চান নিরিবিলিতেই থাকতে।
দেবব্রত- এখানে কিন্তু সবই আসে। জি বাংলা, স্টার জলসা। সিরিয়াল টিরিয়াল দেখি। আর কী! খেলা দেখি। বিজ্ঞাপন দেখি।
মিতালী—রোববারগুলোয় সারাদিন রিয়ালিটি শো। সন্ধ্যা হলেই সিরিয়াল। এখন খেলাও দেখে না। সিরিয়াল দেখে। রাতেও দেখে। যখন ঘুম আসে না।
দেবব্রত- যখন ঘুম আসে না তখন চাঁদ ওঠে।
মিতালী—এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু বাজার করতে ভোলে না। বাজার সরকার। বাজার করা হল ব্যস্ত থাকার একটা রাস্তা।
দেবব্রত ( মহিলাকে) আরে বাবা মরে গেলে তো প্রচুর সময় পা।।
মিতালী—এসব বোল না। জানেন, আমার পরিবার ( মানে যারা যারা বেঁচে আছেন এখনো)…ওর বন্ধুরা মাঝেমাঝেই আসত দশ বছর আগে…
দেবব্রত ( মহিলাকে) শিটে, একটা ভালো বই, হিটার আর সারাজীবনের স্মৃতি… এই তো জীবন
মিতালী – একটা পরিপূর্ণ জীবন… একটা গোটা জীবন ও খরচ করেছে শুধু আজকের কথাটি পৌঁছে দিতে…
SCENE 10
দরজায় আবার বেলের শব্দ। আমরা শুনি আরেকটা রিক্সা চলে গেল।
মিতালী- কেউ এসেছেন হয়তো। দেখো না একটু
দেবব্রত ( মহিলাকে) একটু বসুন। আসছি। ( মিতালীকে) এই চেয়ার নিয়ে এসো
বাঁ দিকে বন্ধ একটা দরজার দিকে চলে গেলেন মিতালী এবং দেবব্রত চললেন নং ২ দরজার দিকে। আবহে প্রচুর পুলিশি হল্টের আওয়াজ। তাতে বোঝা গেল একজন অদৃশ্য প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর প্রবেশ করলেন।
দেবব্রত- আরে পুলিশবাবু। ( তিনি নিজের কপালে স্যালুট করলেন) শুভ সন্ধ্যা। আমি এক্সপেক্টই করিনি। শোনো, দেখে যাও, কী সৌভাগ্য আমাদের…ভাবতেই পারিনি আপনি আসবেন। আমাদের ছোট্ট কুটিরে আপনার পা পড়ল এ যে কী খুশির খবর
মিতালী একটি চেয়ার নিয়ে হাজির ডানদিক থেকে।
মিতালী—কী স্মার্ট লাগছে! ইনি কে?
দেবব্রত—আরে দেখতে পাচ্ছ না, আমাদের সেই ডিএসপি।
মিতালী- আহ
আরে দেখো দেখো। কী জাঁদরেল অফিসার। এই হলেন আমার স্ত্রী মিতালী।
(মিতালীর দিকে ঘুরে) আরে এসো এদিকে, যাতে তোমায় আলাপ করিয়ে দিতে পারি।
(মিতালী এগিয়ে আসে এক হাতে চেয়ার নিয়ে)
মিতালী—কেমন আছেন আপনি? আপনি তো বিখ্যাত মানুষ। উনিও আপনাদের প্রফেশনেই ছিলেন
দেবব্রত—গোয়েন্দা গোয়েন্দা। পিঁপড়ে মারার মতো করে নকশালদের মারতাম।
মিতালী—ধুর এভাবে বোল না। তুমি তো ডিউটি করেছ। তোমার চেয়ে উনি কত বড় মাপের দেখো। নিন বসুন প্লিজ । (চেয়ার এগিয়ে দেয়)
দেবব্রত- একজন আগেই এসেছে। আশা করি আরও কয়েকজন আসবেন।
SCENE 11
মিতালী বসতে ইঙ্গিত করলেন।
দেবব্রত— ইনি আছেন, বয়স কম।
মিতালী- আমাদের খুবই বন্ধু।
দেবব্রত—আর ইনি হলেন এক বিখ্যাত পুলিশ অফিসার।
মিতালী- এখানে বসুন
দেবব্রত- না না উনি দেখছ না, মেয়েটির পাশেই বসতে চাইছেন।
( মহিলার চেয়ারের পাশেই পুলিশ অফিসার বসলেন। দেবব্রত এবং মিতালী চেয়ারের পিছনে দাঁড়ালেন।)
মিতালী ( দুই অতিথির কথা শুনে, দেবব্রতকে) এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
দেবব্রত (একইরকম ভাবে) ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। (একটু গলা চরিয়ে) হ্যাঁ স্যার, ওরা এসে পড়লেন বলে। আমার হয়ে বক্তাই বলবেন। তিনিই আমার বক্তব্য বুঝিয়ে দেবেন। এঁর স্বামীও এসে পড়লেন বলে।
মিতালী—আচ্ছা, এই ভদ্রলোক কে?
দেবব্রত- বললাম যে, ইনি অফিসার। পুলিশ অফিসার ( অদৃশ্য লোকগুলির মধ্যে কিছু একটা অস্বস্তিজনক ব্যাপার হল)
মিতালী- জানতাম, জানতাম।
দেবব্রত- তাহলে জিজ্ঞেস করলে কেন?
মিতালী—তথ্যটা পাওয়ার জন্য। জানা আর তথ্য পাওয়া এক না। এই দেখবেন স্যার, সিগারেটটা মেঝেতে ফেলবেন না।
অফিসারকে দেবব্রত – স্যর, আমি জাস্ট ভুলে গেছিলাম, আপনি ঠিক কটা এনকাউন্টার করেছেন?
মিতালী ( মহিলাকে) কিন্তু আপনি এটা হতে দেবেন না যেন।।।
দেবব্রত- আমার দিকে তাকান। আমাকে কি একটা বাজে গোয়েন্দার মতো দেখতে? একবার হয়েছিল কী…
মিতালী—নানা উনি এবার বাড়াবাড়ি করছেন। ( এই বলে মিতালী অদৃশ্য অফিসারের হাত ধরে টানছেন।
দ্যাখো না, আরে তুমি ওকে থামাচ্ছ না কেন।।
দেবব্রত ( বলেই যাচ্ছে) আর সবথেকে বড় কথা খোচর। খোচরদের সাহায্যে আমি যে কজনকে ধরিয়ে দিয়েছি, তার কোনও ঠিক আছে? বিখ্যাত সব স্পাই মুভিতে যেমন দেখা যায়, কিন্তু… না, আমি জেমস বন্ডের মতো চরিত্রহীন নই তাই বলে…
মিতালী—আমার বর একবারও মিথ্যা কথা বলে না। আমরা বুড়ো হয়েছি বটে। কিন্তু এখনও লোকে আমাদের রেস্পেক্ট করে।
দেবব্রত ( এবার হিংস্র ভাবে অফিসারের দিকে) যে হিরো হয়, তাকে ভদ্রও হতে হয়, যদি সে পুরোপুরি ভাবে একজন হিরো হতে চায়।
মিতালী—আপনাকে বহু বছর ধরে চিনি, কিন্তু কখনো মনে হয়নি আপনি এসবও করতে পারেন। (মহিলার দিকে) আমি বুঝতেই পারিনি উনি এমন অসভ্য, বিশ্বাস করুন। আমাদের একটা সেলফ রেস্পকেট আছে।
দেবব্রত – আমিও মরে যাইনি এখনো। ( কলিংবেল বাজে) দরজা খুলতে হবে। ( যেতে গিয়ে মহিলাটির চেয়ারে গোত্তা খায়) ওহ ক্ষমা করবেন।
মিতালী ( দৌড়ে এসে) লাগল ?
( দেবব্রত এবং মিতালী অদৃশ্য মহিলাটিকে ধরে ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে) আপনারা সকলেই নোংরা। নোংরা। ধুলো। আবর্জনা। ( অদৃশ্য মহিলাটির গা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে) ( কলিংবেল আবার বাজে)
SCENE 12
দেবব্রত ( নতুন অদৃশ্য অতিথির প্রতি) একটু দাঁড়ান। সরি। দেরি হল। (মিতালীকে) একটা চেয়ার নিয়ে এসো।
মিতালী- এক মিনিট আসছি।
চিরকাল এরা মানুষকে শোষণ করেই গেছে। ( দরজা খুলে ( দরজা খুলে) ওহ ম্যাডাম আপনি এখানে! বিশ্বাসই করতে পারছি না। ভাবতেই পারিনি আপনি আসবেন। সারাজীবন ধরে আপনাকে নিয়েই ভেবে গেলাম। ম্যাডাম আপনি হলেন আমাদের মেরিলিন মনরো। একবিন্দু পালটে যাননি আপনি। সেই একই সৌন্দর্য। আপনার নাকটা একটু উঁচু হয়ে গেছে। একটু ফুলেও আছে। আপনি নিজে সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। আহা নিজে নিশ্চয় এমনটা করেননি। একটু একটু করে হয়েছে। আপনি এ জন্য দায়ি নন। ওহো আসুন আসুন ( অন্য আরেকজনও এসেছে, তিনি পুরুষ) আরে দাদা আপনি এসেছেন কী সৌভাগ্য। আপনাকে আমি দাদা বলতে পারি তো? আমি আপনার স্ত্রীকে বহুদিন আগে চিনতাম। কিন্তু ওর নাকটা অন্যরকম ছিল কিন্তু এখন নাকটা পালটে গেছে। ওহ এই শুনছ আমাদের আরও একটা চেয়ার লাগবে। ( দুটি চেয়ার নিয়ে মিতালীর প্রবেশ) আসুন আসুন এইদিকে আসুন। আরো কয়েকজন অতিথি এসেছেন। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
আপনি অনুমতি দেবেন আপনাকে ‘প্রিয় বন্ধু’ বলার, আমি আপনার স্ত্রী’কে আপনার বহু আগে থেকেই চিনি…তিনি একইরকম ছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা একটি নাক ছিল।
… আপনারা বোধহয় একে-অপরকে খুব ভালোবাসেন। [বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা ৮নং দরজা দিয়ে একটি চেয়ার নিয়ে আবার প্রবেশ করলেন]
সেমিরামিস, দু’জন অতিথি এসেছেন, আমাদের আরও একটি চেয়ার লাগবে। [বৃদ্ধা চেয়ারটি চারজনের পেছনে রাখলেন, তারপর ৮নং দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন এবং ৫নং দরজা দিয়ে পুনঃপ্রবেশ, কিছুসময় পরে আরেকটি চেয়ার নিয়ে এবং সেটি আগের আনা চেয়ারটির পাশে রাখলেন। এই সময়ের মধ্যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং অতিথি দু’জন বৃদ্ধার কাছে এসে দাঁড়ালেন]
দয়া করে এই দিকে আসুন, আরও অতিথি এসে পৌঁছেছেন।
আমি আলাপ করিয়ে দিচ্ছি আপনাদের, তাহলে ম্যাডাম।
…ওহ! মধুবালা্ সুচিত্রা, এই সব নামেই, ওরা ডাকত।
এখন আপনারা বদলে গেছেন।
…ওহ! স্যার, উনি এখনও আমার কাছে তেমনই সুন্দরী
চশমার আড়ালে, ওঁর সুন্দর চোখদু’টো এখনও আছে;
ওঁর চুল সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু যে কেউ দেখতে পাবে বনলতা সেনের মতো চুল, আমি নিশ্চিত।একটু কাছে আসুন, কাছে।
…এটা কী স্যার, উপহার, আমার স্ত্রী’র জন্য? [ মিতালীকে, যিনি এইমাত্র চেয়ার নিয়ে এসেছেন:]
দেখেছ মিতালী, এই হলো সেই মধুবালা
..[অফিসার এবং অদৃশ্য মহিলাকে:] ইনি হলেন সেই সুন্দরী, হেসো না।
…এবং ওঁর স্বামী।
..[মিতালীর প্রতি:] ছেলেবেলার বন্ধু, আমি ওঁর কথা তোমায় বহুবার বলেছি।…এবং ওঁর স্বামী।
[আবার অফিসার এবং অদৃশ্য মহিলার দিকে:] এবং ওঁর স্বামী…
মিতালী [ছোট্ট করে সম্মান দেখিয়ে]: হ্যাঁ আলাপ হলো। খুবই ভদ্র।
গুড ইভনিং, ম্যাডাম, গুড ইভনিং স্যার।
( সমস্তটাই ঘটছে শূন্যতায়)
[তিনি প্রথম দু’জন অতিথিকে সদ্য এসে পৌঁছোনো যুগলকে দেখান:]আমাদের পরিচিত, বন্ধু।
দেবব্রত– উনি তোমার জন্য উপহার এনেছেন।
[মিতালী উপহারটি নেন]
মিতালী এটা কি ফুল স্যার? নাকি দোলনা? গাছ, না বন্দুক?
দেবব্রত- না, না, দেখতে পাচ্ছ না এটা পেইন্টিং?
্মিতালী: ওহ! কী সুন্দর!
দেবব্রত ( অফিসারের প্রতি]: আপনি কি একবার চেক করবেন নাকি?
মিতালী [মধুবালার স্বামীকে]:
ডক্টর, ডক্টর, আমার বিরক্ত লাগছে, আমার হট ফ্ল্যাশ হচ্ছে, অসুস্থবোধ হচ্ছে, ব্যথা ও বেদনা আছে, আমার পায়ের পাতায় সাড় নেই, চোখে ঠান্ডা লেগেছে, আমার আঙুল ঠান্ডায় অসাড়, আমি লিভারের সমস্যায় ভুগছি, ডক্টর, ডক্টর!…
দেবব্রত [মিতালীকে]: এই ভদ্রলোক ডক্টর নন, উনি একজন ছবি আঁকিয়ে।
মিতালী[প্রথম অদৃশ্য মহিলাকে]: দেখা হয়ে গেলে ওই দেওয়ালে একটু টাঙিয়ে দেবেন?
(দেবব্রতকে:]
: তাতে যায় আসে না, উনি এমনিও চার্মিং, আকর্ষণীয়।
(এবার সেই ভদ্রলোকের প্রতি)
আপনাকে অস্বস্তিতে না ফেলেই…
[দেবব্রত এবং মিতালী চেয়ারগুলোর পেছনে চলে যান, একে অপরের কাছে, প্রায় ছুঁয়ে, কিন্তু পিঠোপিঠি দাঁড়ান; কথা বলেন: সুন্দরী মহিলার সঙ্গে, বৃদ্ধা ছবি খোদাইকারীর সঙ্গে; সময়ে সময়ে তাঁদের উত্তর দেবার ধরনে, তাঁরা যেভাবে মাথাটা ঘোরান, বোঝা যায় প্রথম দু’জন অতিথির কোনও একজনের সঙ্গে কথা বলছেন।]
দেবব্রত: হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে …প্রায় একশো বছর আগে আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম।…কিন্তু এখন একটা পরিবর্তন হয়েছে।…না, আপনি একদম বদলাননি।…আপনি আপনাকে ভালোবাসতাম, আমি আপনাকে ভালোবাসি…
মিতালী (চিত্রশিল্পীকে]: ওহ! স্যার, স্যার, স্যার…
দেবব্রত ( অফিসারের প্রতি) : আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত।
বৃদ্ধা [চিত্রশিল্পীকে]: ওহ! অবশ্যই, স্যার, অবশ্যই, স্যার, অবশ্যই।…[প্রথম মহিলার প্রতি:] এটা টাঙিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ…ক্ষমা করবেন যদি আপনাকে বিরক্ত করে থাকি।
[আলোটা তীব্রভাবে জ্বলে উঠল। একে একে যত অদৃশ্য অতিথি এসে পৌঁছোতে থাকবেন আলোটাও বাড়তে থাকবে।]
দেবব্রত [প্রায় ফুঁপিয়ে বেলকে]: আমাদের সেই আষাঢ়ের প্রথম দিনের বৃষ্টি কই?
মিতালী ( চিত্রশিল্পীকে) – কী মহান শিল্পী
দেবব্রত [প্রথম ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে মধুবালাকে]: ইনি আমাদের তরুণ বন্ধু। কী মিষ্টি
মিতালী [অফিসারকে দেখিয়ে]: হ্যাঁ, উনি একজন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার …আমার স্বামীর একদা সহকর্মী …একজন সাব অল্টার্ন, ইন্টেলেকচুয়াল, ঔপন্যাসিক, আবার কবিতাও লেখেন… বর্তমানে মন্ত্রীর লেখা কবিতা বদলে টদলে দেন…
বৃদ্ধ [মধুবালাকে]: আপনার কান সবসময় এমন খাড়া ছিল না!…
মিতালী ( নানান ভাবে নাচের ভঙ্গিমা করেন। ঠিক সেই চেয়ারটির সামনে যে চেয়ারে চিত্রশিল্পী বসে আছেন। তার পর নানান নাচের মুদ্রায় তাকে খুশি না করতে পেরে চেয়ারের কাছে গিয়ে বলেন) বয়স হয়ে গেছে তাই না? এমন মডেল হতে পারব না আমি।।
বৃদ্ধ [মধুবালার দিকে ]: আমাদের যেদিন গেছে ভেসে। মনে পড়ে? (বিহ্বল হয়ে) [অফিসারের প্রতি] : আমি একজন পুলিশ, আপনিও তাই,, পুলিশরা সবসময় তরুণ, গোয়েন্দারা দেবতার মতো…[মধুবালাকে]: আমাদের জীবন উত্তম সুচিত্রার মতো হওয়ার কথা ছিল। হ্যাপি এন্ডিং। হারানো সুর। নীড় ছোটো ক্ষতি নেই। আমরা সব হারিয়ে ফেললাম। কত সুখী হতে পারতাম, আমি নিশ্চিত, আমরা পারতাম, আমরা পারতাম; আমাদের খালেও তো পদ্মফুল ফোটে। ধ্বংসস্তূপেও নতুন গাছ হয়।
মিতালী [চিত্রশিল্পীকে]: মিথ্যেবাদী। মেয়েবাজ! আহ! আহ! আমাকে নিজের বয়সের তুলনায় তরুণী দেখায়? যতসব ভুলভাল প্রবঞ্চক শঠ।।
দেবব্রত [মধুবালাকে ]: আপনি আমার সুচিত্রা হবেন, আমি উত্তম। বলুন পারব না। আহ কী রোমান্টিক জুটি। চাঁদের আলোর নীচে আমরা বাতাসের বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনব। একটু একটু করে গাছের পাতা ঝরে পড়বে আর আমরা নিজেদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। কোথা থেকে একটা সুর ভেসে আসবে। সব সব সব হারিয়ে গেল। কিছুই পেলাম না। মহানায়কও নেই, মহানায়িকাও নেই। পড়ে আছে হারানো সুর।
মিতালী [চিত্রশিল্পীকে]: ওহ না, ওহ! না, ওহ! লা লা, আপনি আমায় সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। আপনিও, আপনার কাতুকুতু আছে? সুড়সুড়ি দিতে না পেতে? আমার লজ্জা লাগছে।…[তিনি হাসতে থাকেন] আমার শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?
নাকি আমায়?
দেবব্রত [্মধুবালাকে]: একজন সাধারণ কর্মচারীর জীবন দারিদ্রের!
্মিতালী [প্রথম অদৃশ্য মহিলার দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে]: মানুষের মাথা খাওয়ার জন্য মাথা দিয়ে মাথার ঝোল রাঁধতে তো হবে। কী কী লাগবে জানেন? গাজর, গোলমরিচ, ধনে পাতা, হলুদ, একটু নুন আর মানুষের মাথা
দেবব্রত [্মধুবালার দিকে]: আমার উপযুক্ত সহকারী, সেমিরামিস, আমার মায়ের জায়গা নিয়েছে। [তিনি অফিসারের দিকে ফিরলেন:] আচ্ছা, ডিয়ার ওয়াটসন, আমি প্রায়ই আপনাকে লক্ষ্য করি, সত্যিটা খুঁজে পেলে তাকে গ্রহণ করাই উচিত।
[মধুবালার দিকে ফিরলেন তিনি।]
মিতালী : আপনি মনে করেন যে কোনও বয়সেই সন্তানধারণ করা যায়? যে কোনও বয়সে সন্তান? এই ধরুন এখন আমি মা হতে পারি?
দেবব্রত : আমাকে শুধু এটাই বাঁচিয়ে রেখেছে: ভেতরের জীবন, মনের শান্তি, সংযম, আমার বৈজ্ঞানিক তদন্তসমূহ, দর্শন, আমার বার্তা…
মিতালী : আমি আমার স্বামীকে এখনও পর্যন্ত ঠকাইনি, মানে এই গোয়েন্দাকে …কিন্তু আজ আপনি আমাকে বাধ্য করছেন।…আমি শুধু ওঁর মা![তিনি কাঁদেন] ভালো, ভালো [তিনি ধাক্কা মারেন], ভালো…মা। আমার বিবেক এই চোখের জলের কারণ। আমার জন্য নিম গাছের ডালখানা ভেঙে গেছে। অন্য কাউকে খুঁজে নিন…আমি আর কাউকে গোলাপ দেব না
দেবব্রত – সব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়
[দুজন এবার অন্য দুই অদৃশ্য অতিথির কাছে নিয়ে যান ও বসান।
13
SCENE 14
দেবব্রত ও মিতালী : বসুন, দয়া করে বসুন।
[বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাও বসেন, বৃদ্ধ বাঁদিকে, বৃদ্ধা ডানদিকে, মাঝে চারটে ফাঁকা চেয়ার। একটা লম্বা নিশ্চুপ দৃশ্য, মাঝে মাঝে ‘না’, ‘হ্যাঁ’, ‘হ্যাঁ’-র ছেদ। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা অদৃশ্য অতিথিদের কথোপকথন শোনেন।]
মিতালী চিত্রশিল্পীকে- আমাদের একটি ছেলে আছে…অবশ্যই বেঁচে আছে।…সে চলে গেছে…এটা একই গল্প…অথবা, একটু আলাদা…সে বাবা-মা’কে ত্যাগ করেছে…ওর হৃদয়টা সোনার মতো ছিল…সে বহুকাল আগে…আমরা ওকে খুব ভালোবাসতাম…ও দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল…আমার স্বামী আর আমি ধরে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম সবকিছু দিয়ে…ওর বয়স ছিল সাত বছর, এজ অফ রিজন, আমি ডেকেছি ওকে:”বাবা আমার , সোনা আমার, “…সে ফিরেও তাকায়নি…
দেবব্রত : না…না, আমাদের সন্তান ছিল না…আমার ইচ্ছে ছিল ছেলের…ওরও …আমরা সব করেছিলাম… হয়তো এটা ভালোর জন্যেই হয়েছে।…আমি নিজেই তো এক অকৃতজ্ঞ সন্তান…আহ!…দুঃখ, অনুতাপ, অনুশোচনা, এগুলোই আমাদের আছে।…আমরা এগুলো নিয়েই আছি।
মিতালী : ও আমাকে বলেছিল:”তোমরা পাখি মারো! কেন পাখিদের মারো?”…কিন্তু আমরা পাখি মারি না…আমরা একটা মাছিরও ক্ষতি করিনি…ওর চোখে বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা ছিল। আমাদের কখনও ওই জল শুকোতে দেয়নি। আমাকে কাছেই যেতে দিত না। ও বলত:”হ্যাঁ, তোমরা সব পাখি মারো, সব পাখি মেরে ফেলো”। বলেছিল, “তোমরা মিথ্যে বলছ, আমাকে ঠকিয়েছ! রাস্তাগুলো মরা পাখিতে ভরে গেছে, বাচ্চা পাখিরা মরে যাচ্ছে” এটা পাখিদের গান! “না এটা ওদের মৃত্যুযন্ত্রণার চিৎকার। আকাশটা রক্তে লাল হয়ে গেছে।”…না সোনা, ওটা নীল। ও আবার চিৎকার করল “তোমরা ঠকিয়েছ, আমি তোমাদের ভালোবাসতাম, বিশ্বাস করতাম তোমরা ভালো।… রাস্তাটা মরা পাখিতে ভরে আছে, তোমরা ওদের চোখ খুবলে নিয়েছ।…বাবা…মা…তোমরা ভয়ংকর!…এ পৃথিবীটা ভয়ংকর… পাখিরা মরে যাচ্ছে…আমরা মাংস খাচ্ছি… আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না।” আমি ওর পায়ে পড়েছিলাম, ওর বাবা কেঁদেছিল। আমরা আটকাতে পারিনি। ও চলে যাওয়ার পরে আমরা এখনও শুনতে পাই “তোমরাই দায়ী”…এর মানে কি “দায়ী”?
বৃদ্ধ: আমি আমার মা’কে একটা পুকুরের জলে ডুবে যেতে দিয়েছি। মা আমায় ডেকেছে, আস্তে করে কেঁদে:”সোনা আমায় টেনে তোল। আমি কাদার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। আমায় একা মরার জন্য ফেলে যাস না…আমার সঙ্গে থাক। আমার হাতে বেশি সময় নেই।” চিন্তা করো না মা, আমি বলেছিলাম, আমি এক্ষুণি আসছি…আমি তাড়াহুড়ো করছিলাম…আমি দুর্গাপুজোর ভাসানে যাচ্ছিলাম। বলেছিলাম, আমি আসছি এক্ষুণি। কিন্তু যখন আমি ফিরলাম, সে চলে গেছে, এবং ওরা পোড়াতে নিয়ে গেছে, আমি খুঁজি…আমি খুঁজে পাই না…আমি জানি, আমি জানি, ছেলেরা মা’কে সবসময় ছেড়ে যায়, এবং তারা বাবাকে কোনও না কোনওভাবে মেরে ফেলে…জীবন এরকমই…কিন্তু আমি এতে কষ্ট পাই…অন্যেরা পায় না।
মিতালী : ও বলেছিল :”বাবা, মা, আমি আর কোনওদিন তোমাদের দেখতে চাই না।”
দেবব্রত: আমি এতে কষ্ট পাই, হ্যাঁ, অন্যেরা পায় না…
্মিতালী : ওর কথা আমার স্বামীর সামনে বলবেন না। ও বাবা-মা’কে খুব ভালোবাসত। ও এক মুহূর্তের জন্যেও তাঁদের ছাড়েনি।
ও তাঁদের যত্ন নিত, চোখে চোখে রাখত…এবং তাঁরা ওর হাতের ওপরেই মারা যান।
দেবব্রত : আমি তাকে এখনও জলের উপর ভেসে থাকতে দেখি, পুকুরের তলার কচুরিপানাগুলো তখনও মুঠোর মধ্যে ধরা। , চোখদুটো বলছে “আমায় ভুলে যেও না, আমায় ভুলে যেও না”। কিছু না বলারও বলা আছে। সে যন্ত্রণার অনুবাদ হয় না কোনও।
মিতালী [চিত্রশিল্পীকে]: ও কোনওদিন আমাদের চিঠি লেখেনি। সময়ে সময়ে আমাদের বন্ধু বলেছে ও এখানে আছে, ওখানে আছে, ও ভালো আছে, ও খুব ভালো স্বামী…
দেবব্রত- ওহ, হ্যাঁ। ওহ! হ্যাঁ, ম্যাডাম, আমাদের বাড়িতে হোম থিয়েটার, রেস্তোরাঁ, বাথরুম সব আছে…
মিতালী, অফিসারের দিকে : হ্যাঁ, , এর কারণ সে…
দেবব্রত—আর কিছু বলার নেই [অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন, আটকে যেতে থাকে।]
মিতালী : এমন করেই সব শেষ হয় যদি!
বৃদ্ধ: এইভাবে, আমি শেষ করিনি…আমি, এটা…অবশ্যই…
শবৃদ্ধা [ এলোমেলো দীর্ঘশ্বাস]: সবই এমন
দেবব্রত- সকলেরই।
মিতালী—পুরুষের?
দেবব্রত- নারীর।
মিতালী- পুরুষ এবং নারীর।
দেবব্রত- নারী এবং পুরুষের।
দেবব্রত [প্রথম অদৃশ্য মহিলাকে]: কী বলছেন ম্যাডাম?
[লম্বা নৈঃশব্দ, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তাঁদের চেয়ারের ওপর স্থির। দরজার ঘন্টা বাজল।]
SCENE 15
দেবব্রত [বাড়তে থাকা নার্ভাসনেস নিয়ে]: কেউ এসেছে। মানুষ। ্মানুষ। মানুষ।
মিতালী: আমি ভাবলাম আমি গাড়ির আওয়াজ।
দেবব্রত: আমি দেখছি দরজাটা। যাও কিছু চেয়ার নিয়ে এসো। এক্সকীউজ মী, আসছি। [৭ নং দরজার দিকে এগোন।]
্মিতালী [অদৃশ্য অতিথিদের যাঁরা ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন]: দয়া করে একটু উঠে দাঁড়ান। বক্তা এখনই চলে আসবেন। আমরা ঘরটাকে মিটিং-এর জন্য গোছাই। [বৃদ্ধা চেয়ারগুলো সাজাতে থাকেন, দর্শকের দিকে সেগুলো পেছন ফিরিয়ে বসান।] আমার একটু সাহায্য করুন, ধন্যবাদ।
দেবব্রত [৭নং দরজা খুলে]: শুভ সন্ধ্যা দয়া করে ভেতরে আসুন।
[সে তিন-চারজন অদৃশ্য ব্যক্তি এসেছেন তাঁরা খুব লম্বা, এবং বৃদ্ধকে পায়ের পাতার ওপর ভর করে দাঁড়াতে হচ্ছে তাঁদের সাথে হাত মেলানোর জন্য। বৃদ্ধা, চেয়ারগুলো সাজানোর পর বৃদ্ধের কাছে এলেন।]
দেবব্রত [পরিচয় দিচ্ছেন]: আমার স্ত্রী…মিস্টার…মিসেস…আমার স্ত্রী…মিস্টার…মিসেস…আমার স্ত্রী…
মিতালী : এঁরা কারা, ডার্লিং?
দেবব্রত: যাও, ডিয়ার, কিছু চেয়ার নিয়ে এসো।
্মিতালী – আমি সবকিছু একা পারব না!…
[তিনি বেরিয়ে যান, গজগজ করতে করতে, ৬নং দরজা দিয়ে এবং ৭নং দরজা দিয়ে ফের ঢোকেন, তখন বৃদ্ধ, নতুন আসা অতিথিদের নিয়ে ডাউনস্টেজের দিকে এগোন।]
দেবব্রত : আপনাদের মুভি ক্যামেরা বন্ধ করবেন না। এঁরা খবরের কাগজ আর চ্যানেলের লোক, এঁরাও বক্তৃতা শুনতে এসেছেন, উনি যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়বেন।…অধৈর্য হবেন না…আপনারা বিরক্ত বোধ করবেন না…সবাই একসঙ্গে এবার… [বৃদ্ধার ৭নং দরজা দিয়ে পুনঃপ্রবেশ, দু’টি চেয়ার নিয়ে] এসো এসো, চেয়ারগুলো তাড়াতাড়ি আনো।
…একটা কম পড়ে গেল।
[বৃদ্ধা আরেকটা চেয়ার আনতে গেলেন, এখনও গজগজ করতে করতে, ৩নং দরজা দিয়ে বেরিয়ে, আবার ৮নং দরজা দিয়ে ঢুকলেন।]
মিতালী : ঠিক আছে, আর…আমি যতটুকু পারছি করছি…আমি তো যন্ত্র নই, তুমি জানো…এঁরা কারা?[তিনি বেরিয়ে যান]
দেবব্রত : বসুন, বসুন, মহিলারা মহিলাদের সঙ্গে, পুরুষরা পুরুষদের সঙ্গে, অথবা উল্টো, যদি আপনাদের ইচ্ছে থাকে…আমাদের আর ভালো চেয়ার নেই…যা আছে তাই দিয়েই কাজ চালাতে হবে…ক্ষমা করবেন…ওই মাঝখানের একটা নিন…কারও কি ফাউন্টেন পেন লাগবে?
15
… আমার রেডিও নেই…আমি খবরের কাগজ নিই…সবই তো বানানো খবর… সত্য তো এরাই হেহেহে নির্মাণ নির্মান… আমি বাড়ির দেখভাল করি, কিন্তু সাহায্য পাই না…আমাদের অর্থনৈতিক দিকটা দেখতে হবে…না সাক্ষাৎকার নয়, দয়া করে এখন নয়…পরে, আমরা দেখব…আপনি শীঘ্রই বসার জায়গা পাবেন…এতক্ষণ ধরে কী করছে ও?
[বৃদ্ধা ৮ নং দরজা দিয়ে চেয়ার নিয়ে ঢোকেন।]
দেবব্রত- তাড়াতাড়ি,
মিতালী : আমি চেষ্টা করছি…এঁরা কারা?
দেবব্রত: আমি তোমায় পরে বুঝিয়ে বলব।
্মিতালী—আর ওই মেয়েটা কে?
দেবব্রত : অফিসার, দুঃখ পেও না, জার্নালিজমও গোয়েন্দাগিরির মতোই। জীবিকা…
[দরজার ঘন্টা বাজল। দেবব্রত ৮নং দরজার দিকে তাড়াতাড়ি এগোলেন।]
একটু দাঁড়াও…[্মিতালীকে]
চেয়ার আনো!
মিতালী ৩নং দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, ২নং দরজা দিয়ে ফের ঢুকলেন, দেবব্রত ৯নং বন্ধ দরজাটা খুলতে গেলেন এবং ্মিতালী ২নং দরজা দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।]
SCENE 16
বৃদ্ধ [দৃশ্যের বাইরে]: ভেতরে আসুন… ভেতরে আসুন… ভেতরে আসুন…[ফের দেখা দিলেন, আরও অদৃশ্য লোকজনকে রাস্তা দেখিয়ে, তাদের মধ্যে একটি ছোটো বাচ্চা, যার হাত তিনি ধরে আছেন।] সায়েন্টিফিক লেকচারে বাচ্চাদের আনা উচিত নয়…ছোট্ট মানুষ বিরক্ত হয়ে যাবে…যদি সে কাঁদতে শুরু করে বা মহিলাদের জামার তলায় উঁকি মারতে শুরু করে তাহলে হবে গন্ডগোল![মঞ্চের মাঝখানে তাদের নিয়ে আসেন, বৃদ্ধা দু’খানা চেয়ার নিয়ে আসেন।] আমার স্ত্রী’র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, মিতালী ; এবং এরা হচ্ছে এদের ছেলেমেয়ে।
মিতালী : ওমা কী মিষ্টি!
দেবব্রত : এ হচ্ছে সবচেয়ে ছোটো।
মিতালী : ওহ, কী মিষ্টি। কী মিষ্টি…কী মিষ্টি!
দেবব্রত : যথেষ্ট চেয়ার নেই।
[ মিতালী বেরিয়ে যান, অন্য চেয়ারের সন্ধানে, এবার ব্যবহার করেন ২নং দরজা বেরোনোর জন্য এবং ৩নং দরজা ঢোকার জন্য।]
দেবব্রত : ছোটো ছেলেটিকে কোলে নিন…যমজ দু’জন একটা চেয়ারে বসতে পারে। সাবধানে এগুলো শক্তপোক্ত না…এগুলো বাড়ির সাথে আছে, বাড়িওলার সম্পত্তি। হ্যাঁ আমার ছেলেমেয়ে, সে আমাদের জন্য সমস্যা, বাজে ছেলে…সে চায় আমরা এগুলো কিনে নিই, এই বেকার চেয়ারগুলো। [বৃদ্ধা যত তাড়াতাড়ি পারেন চেয়ার নিয়ে ঢোকেন।] তোমরা একে অপরকে চেনো না, প্রথমবার দেখছ…খালি নামে চেনো…[বৃদ্ধাকে:] মিতালী, পরিচয় করিয়ে দাও
মিতালী : কারা এঁরা?…আমি পরিচয় করাব আপনাদের, এক্সকীউজ মী…আপনাদের পরিচয় করাব…কিন্তু এঁরা কারা?
দেবব্রত : আমি পরিচয় দিচ্ছি। পরিচয় করাতে দিন আমায়।…পরিচয় করাতে অনুমতি দিন…মিস্টার, মিসেস, মিস…মিস্টার…মিসেস…মিসেস…মিস্টার…
মিতালী [দেবব্রতকে ]: তুমি তোমার সোয়েটারটা পরেছ? [অদৃশ্য অতিথিদের] মিস্টার, মিসেস, মিস্টার…
[দরজার ঘন্টা বাজল আবার]
দেবব্রত : আরও লোক!
[আরেকটা ঘন্টা বাজল।]
মিতালী : আরও লোক!
16
SCENE 17
[দরজার ঘন্টা বাজল আবার একবার। তারপর বেশ কয়েকবার, এবং বারবার। বৃদ্ধ লোকটি তার পাশে; চেয়ারগুলো ডায়াসের দিকে ফেরানো, দর্শকদের দিকে পেছন করা; সাধারণ ভাবে রো’তে বসানো, থিয়েটারে যেমন লম্বা করা থাকে; বৃদ্ধ অস্থিরভাবে নিজের ভুরুতে হাত দিচ্ছেন, এক দরজা থেকে দ্রুত আরেক দরজায় যাচ্ছেন, অদৃশ্য লোকজনকে বসাচ্ছেন, সঙ্গে বৃদ্ধাও তড়িঘড়ি যাচ্ছেন, যদিও খুব দ্রুত চলতে পারছেন না, যতটা সম্ভব দ্রুততার সাথে এক দরজা থেকে আরেক দরজায় যাচ্ছেন, চেয়ারের খোঁজে আর সেগুলো নিয়ে আসছেন। এখন মঞ্চে অনেক অদৃশ্য লোকজন, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা চেষ্টা করছেন যাতে তাঁদের সঙ্গে ধাক্কা না লাগে, পথ করে নিচ্ছেন চেয়ারের রো’র মধ্য দিয়ে। তাঁদের চলাচল অনেকটা এমন: বৃদ্ধ ৪নং দরজায় যাচ্ছেন, বৃদ্ধা ৩নং দরজা দিয়ে বেরোচ্ছেন, ২নং দরজা দিয়ে ঢুকছেন; বৃদ্ধ ৭নং দরজা খুলতে যাচ্ছেন, বৃদ্ধা ৮নং দরজা দিয়ে বেরোচ্ছেন, ৬নং দরজা দিয়ে চেয়ার ইত্যাদি নিয়ে ঢুকছেন, এভাবে মঞ্চের সবক’টা দরজা ব্যবহার করে চলাফেরা করছেন।]
মিতালী [আরও চেয়ার নিয়ে]: …অনেক জন…সত্যিই অনেক লোকজন…
[আমরা শুনতে পাচ্ছি বাইরে, আরও জোরে, আরও কাছে, গাড়ি আসার শব্দ; রিক্সা আসার শব্দ। সব শব্দ আসছে উইংসের মধ্য থেকে। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ওপরের আউটলাইন করা কাজটাই করে চলেছেন; দরজাগুলো খুলছেন, চেয়ারগুলো আনছেন। দরজার ঘন্টা বেজে চলেছে।]
দেবব্রত: এই টেবিলটা একেবারে মাঝখানে। [তিনি টেবিল সরাচ্ছেন, অথবা সরানোর ভঙ্গি করছেন, নিজের গতি না কমিয়ে, বৃদ্ধার সাহায্য নিয়ে।] এখানে জায়গাই নেই আর
মিতালী : [টেবিল পরিষ্কার করার ভঙ্গি করে]: তুমি তোমার সোয়েটারটা পরেছ?
[দরজার ঘন্টা বাজছে।]
্দেবব্রত : আরও লোক! আরও চেয়ার! আরও লোক! আরও চেয়ার! আসুন, আসুন ভেতরে, আসুন, বাইরে কেন
মিতালী : ক্ষমা করবেন…ক্ষমা করবেন…শুভ সন্ধ্যা, মিসেস…মিসেস…মিস্টার…মিস্টার…হ্যাঁ, হ্যাঁ, চেয়ার…
[দরজার ঘন্টা আরও জোরে জোরে বাজছে এবং আমরা শুনতে পাচ্ছি রিক্সা আর গাড়ির শব্দ প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ চেয়ারের মধ্যে দিশেহারা; তাঁর সময় হচ্ছে আর এক দরজা থেকে আরেক দরজায় যাওয়ার, সুতরাং দরজার ঘন্টা ঘন ঘন বেজে যাচ্ছে।]
বৃদ্ধ: হ্যাঁ, এইতো…তুমি তোমার সোয়েটার পরেছ তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ…এখনি, দাঁড়াও, হ্যাঁ, হ্যাঁ…দাঁড়াও…
বৃদ্ধা: তোমার সোয়েটার? আমার সোয়েটার?…ক্ষমা করবেন, ক্ষমা করবেন।
দেবব্রত : এইদিকে, , আমি অনুরোধ করছি…অনুরোধ করছি আপনাদের…ক্ষমা…অনু…রোধ…আসুন, আসুন…দেখিয়ে দিচ্ছি…ওই তো ওখানে, বসার জায়গা…প্রিয় বন্ধু…ওখানে নয়…দেখে…আপনি, বন্ধু?
[একটা দীর্ঘ মুহূর্ত কথা ছাড়াই। আমরা শুনতে পাচ্ছি গাড়ি, রিক্সা এবং দরজার ঘন্টার ক্রমশ বেজে যাওয়া। গোটা মুভমেন্ট এইসময় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়। দরজাগুলো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে নিজেদের মতো। খালি মাঝখানের মূল দরজাটা বন্ধ থাকে। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা কোনও কথা না বলে এক দরজা থেকে আরেক দরজায় যেতে থাকেন, দেখে মনে হয় তাঁরা রোলার স্কেটস পরে আছেন। বৃদ্ধ লোকজনকে আমন্ত্রণ জানান, সঙ্গে আসেন, কিন্তু খুব বেশিদূর না, দু’তিন পা এসে তাঁদের বসার জায়গা দেখিয়ে দেন; তাঁর বেশি সময় নেই। বৃদ্ধা চেয়ার আনতে থাকেন। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা নিজেদের গতি বজায় রেখেই মাঝপথে এক দু’বার একে অপরের সাথে ধাক্কা খান। এরপর বৃদ্ধ মঞ্চের ওপরে মাঝের একটি জায়গা নেন, আর ডানদিক থেকে বাঁদিক, ও বাঁদিক থেকে ডানদিক যেতে থাকেন, সব দরজার কাছে এবং হাত দিয়ে বসার জায়গা দেখাতে থাকেন। তাঁর হাতগুলো খুব দ্রুত এদিক-ওদিক যাচ্ছে। এরপর, বৃদ্ধা শেষপর্যন্ত থামেন, হাতে একটা চেয়ার নিয়ে, ওটা রাখেন, আবার তোলেন, রাখেন, দেখে মনে হয় তিনিও এক দরজা থেকে অন্য দরজায় যেতে চাইছেন, ডানদিক থেকে বাঁদিকে, আবার বাঁদিক থেকে ডানদিকে, মাথা ও ঘাড় দ্রুত নাড়াতে নাড়াতে। এতে ছন্দ যেন না নষ্ট হয়; বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখে মনে হবে তাঁরা থামছেন না, যদি তাঁরা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন; তাঁদের হাত, তাঁদের বুক, তাঁদের মাথা, চোখগুলো অধীর, সম্ভবত ছোটো বৃত্তের মধ্যে ঘুরছে। শেষপর্যন্ত মুভমেন্টে একটা আশাপ্রদ পরিবর্তন আসে, প্রথম দেখায় মনে হয় গতি কমছে: দরজার ঘন্টা বেজে ওঠা কমতে থাকে, আওয়াজ কম মনে হয়, দরজাগুলো খোলা-বন্ধ হওয়ার লয় কমে আসে, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার ভঙ্গিতে শৈথিল্য আসতে থাকে ক্রমাগত- যখন দরজাগুলোর একসঙ্গে খোলা-বন্ধ হওয়া থেমে গেল; এবং দরজার ঘন্টার আওয়াজ যখন আর শোনা যাচ্ছে না, আমরা বুঝতে পারি মঞ্চটা লোকে ভর্তি হয়ে গেছে।]
SCENE 18
.
দেবব্রত: আমি আপনা্দের জন্য একটা জায়গা খুঁজে নেব…
্মিতালী [হাত খালি বড়োসড়ো ভঙ্গি করে]: আর চেয়ার প্রোগ্রাম চাই প্রোগ্রাম, গরম গরম অনুষ্ঠান, সারেগামাপাধানিসা, সঙ্গীতের মোচ্ছব, গান্ধীগিরি কোনটা নেবেন বলুন। জীবন এখন রিয়েলিটি শো। প্রোগ্রাম কিনুন, প্রোগ্রাম দেখুন, টিআরপি বাড়ান।
দেবব্রত : কিছু মনে করবেন না, আপনারা সকলেই গ্র্যান্ড ফিনালেতে যাবেন।
মিতালী : প্রোগ্রাম কিনুন! দাঁড়ান ম্যাডাম, আমি একসঙ্গে সবার খেয়াল করতে পারছি না, আমার তেত্রিশটা হাত নেই, আপনি জানেন, আমি গোরু নই।…মিস্টার, দয়া করে আপনার পাশের ভদ্রমহিলাকে প্রোগ্রামটা দিন, ধন্যবাদ…আমার খুচরো, আমার খুচরো…
দেবব্রত : সবার জায়গা আছে প্রিয় বন্ধুরা,
মিতালী:…প্রোগ্রামস…প্রোগ্রামস নিন…গ্রামস…
দেবব্রত : হ্যাঁ ডিয়ার, উনি ওদিকে, আরেকটু ওদিকে, উনি প্রোগ্রাম বেচছেন…কোনও কাজ ছোটো নয়…ওটাই উনি…দেখতে পাচ্ছেন?…আপনার সেকেন্ড রো’তে বসার জায়গা আছে…ডানদিকে…না, বাঁদিকে…ওই তো!…
বৃদ্ধা: গ্রাম…গ্রাম…প্রোগ্রাম…প্রোগ্রাম নিন…
বৃদ্ধ: আপনি কী চান আমার কাছে? আমি চেষ্টা করছি! [অদৃশ্য লোকজন বসে আছেন যারা তাদের প্রতি:] একটু চেপে বসুন, যদি পারেন তো…অল্পই জায়গা আছে, আপনার জন্য ওতেই হবে, না, মিসেস…এদিকে আসুন। [তিনি ডায়াসের ওপর ওঠেন, লোকজনের ধাক্কায়।] জোরদার তালিয়া। জীবন এখন রিয়ালিটি শো। চলো পাল্টাই
মিতালী [যিনি এখন মঞ্চে বৃদ্ধের একেবারে বিপরীতে আছেন, ৩নং দরজা আর জানালার মাঝখানে]: প্রোগ্রাম নিন…প্রোগ্রাম কার চাই? এসকিমো পাই, ক্যারামেলস…ফ্রুট ড্রপস…[নড়াচড়ার জায়গা না পেয়ে, বৃদ্ধা, ভিড়ের মধ্যে সেঁটে গিয়ে, প্রোগ্রাম আর ক্যান্ডিগুলো ছুঁড়ে দিলেন, অদৃশ্য মাথাগুলোর ওপরে।] এই যে এখানে! ওই ওখানে!
দেবব্রত [ডায়াসের ওপরে দাঁড়িয়ে, খুব উদ্দীপ্ত হয়ে; ডায়াসের থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধাক্কাধাক্কিতে চেপে যান, আবার ওঠেন, আবার নামেন, কাউকে মুখে মারেন, কারও কুনুইতে গুঁতো খান, বলেন]: [ধাক্কা খান, টলতে থাকেন, তাঁর ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয়, কাঁধ খিমচে ধরেন।]
বৃদ্ধা: এত লোকজন কেন? প্রোগ্রামস, প্রোগ্রাম নিন।
বৃদ্ধ: ভদ্রমহোদয়া, মেয়েরা, ভদ্রমহোদয়রা, একটু চুপ করুন, অনুরোধ করছি…চুপ…এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ…যাঁদের বসার জায়গা নেই রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান…ব্যাস…চেয়ারের মাঝখানে দাঁড়াবেন না।
মিতালী [বৃদ্ধকে, প্রায় চিৎকার করে]: এরা কারা ডার্লিং? এখানে কী করছে?
বৃদ্ধ: রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ান, ভদ্রমহোদয়া ও মহোদয়রা। যাঁদের বসার জায়গা নেই তাঁরা সবার সুবিধার জন্য দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ান, এইতো, ডানদিকে অথবা বাঁদিকে…আপনারা সব শুনতে পাবেন, সব দেখতে পাবেন, চিন্তা নেই, কিছু বাদ যাবে না, সব জায়গাই ভালো!
[একটা ভালোমতো গন্ডগোল চলছে। ভিড়ের ধাক্কায় বৃদ্ধ প্রায় চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যান)
18
গোটা মঞ্চটা ঘুরে ফেলেন এবং ডানদিকে, টুলের কাছের জানালার সামনে উপস্থিত হন। বৃদ্ধাও উল্টোদিকে একইভাবে বাঁদিকে টুলের কাছে জানালায় পৌঁছোন।]
দেবব্রত [এইভাবে চলতে চলতে]: ঠেলবেন না, ঠেলবেন না।
মিতালী [একই ভাবে]: ঠেলবেন না, ঠেলবেন না।
দেবব্রত [একভাবে]: ঠেলবেন না, ঠেলবেন না।
বৃদ্ধা [একভাবে]: ভদ্রমহোদয়ারা, ঠেলবেন না, ভদ্রমহোদয়রা, ঠেলবেন না।
বৃদ্ধ [একভাবে]: আস্তে…ধীরে…শান্ত থাকুন…কী হচ্ছে এখানে?
বৃদ্ধা [একভাবে]: এমন অসভ্যের মতো করার দরকার নেই, কোনও কারণেই।
[শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের ফাইনাল জায়গায় পৌঁছোন। প্রত্যেকে একটা জানালার পাশে। বৃদ্ধ, বাঁদিকের জানালায় যা ডায়াসের কাছে। বৃদ্ধা ডানদিকের। তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই জায়গা ছেড়ে নড়বেন না।]
SCENE 19
দেবব্রত [মিতালীকে ডাকতে ডাকতে]: ডার্লিং…আমি তোমাকে আর দেখতে পাচ্ছি না…কোথায় তুমি? এরা কারা? এরা কী চায়? ওই লোকটি কে?
্মিতালি : তুমি কোথায়?
দেবব্রত : এখানে, জানালার পাশে…তুমি শুনতে পাচ্ছ?
মিতালী : হ্যাঁ, আমি শুনতে পাচ্ছি!…অনেক আওয়াজ…কিন্তু তোমার কথা চিনে নিতে পারি…
দেবব্রত : তুমি, তুমি কোথায় আছ?
মিতালী : আমিও জানালার পাশেই!… আমার ভয় করছে, প্রচুর মানুষ…আমরা একে-অপরের থেকে অনেক দূরে…আমাদের বয়সে সাবধানে থাকতে হবে…নয়তো আমরা হারিয়ে যাব…আমাদের কাছাকাছি থাকতে হবে, কেউ জানে না, রিয়ালিটি শো-এর মধ্যে ঢুকলে আর বেরোনো যায় না।
দেবব্রত- আহ!…আমি তোমাকে দেখতে পেলাম…ওহ!…আমরা নিজেদের খুঁজে নেব, ভয় পেও না…আমি বন্ধুদের সঙ্গেই আছি। [বন্ধুদের প্রতি:] আমার আনন্দ হচ্ছে আপনাদের সাথে হাত মেলাতে পেরে…
মিতালী : কী খারাপ আবহাওয়া।![পাশে:] আমার ভয় করছে, তবুও…এখানে কী করছি আমি?…[তিনি চিৎকার করেন:] কী করছি কী করছিটা কী?
[বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তাঁদের কাছে থাকা অতিথিদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কথা চালাতে থাকেন।]
বৃদ্ধ: মানুষের হাতে মানুষের শোষণ আটকাতে আমাদের চাই টাকা, টাকা এবং আরও টাকা!
মিতালী :শোনো-
[তারপরে বন্ধুদের মাঝে আটকা পড়ে:]
হ্যাঁ, আমার স্বামী এখানে আছেন, উনি সব ঠিক করছেন…ওদিকে…ওহ! আপনি ওদিকে যেতে পারবেন না…আপনাকে ঘুরে যেতে হবে, উনি বন্ধুদের সঙ্গে আছেন…
দেবব্রত: অবশ্যই নয়…আমি সবসময় যেমন বলে এসেছি…পিওর লজিক বলে কিছু নেই…যা আছে তা শুধু অনুকরণ।
মিতালী : কিন্তু আপনি জানেন, সুখী মানুষ রয়েছে। সকালে তারা ফ্লুরিজে ব্রেকফাস্ট খায়, দুপুরে গ্র্যান্ডে লাঞ্চ খায়, এবং রাতে নাইটক্লাবে নাচে। রাতে তারা গাড়িতে সেক্স করে আর গাড়িটা চলতে থাকে, চলতে থাকে, চলতে থাকে…
দেবব্রত : মানুষের সম্ভ্রমবোধ নিয়ে কথা বলুন! অন্তত মুখটা রক্ষার চেষ্টা করুন। সম্ভ্রম ভেতরের ব্যাপার।
মিতালী: ছায়ার মধ্যে লুকিও না…[কথার মাঝে তিনি হাসিতে ফেটে পড়েন]
দেবব্রত : আপনাদের দেশের লোক আমার কথা জিজ্ঞাসা করে।
মিতালী : অবশ্যই…আমাকে সব বলুন।
দেবব্রত : আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি…আপনাকে বোঝানোর জন্য…যে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি ও মানুষ এক ও অভিন্ন।
মিতালী: ওঁর কেমন একটা অনুকরণ করে বানানো চেহারা। উনি আমাদের অনেক টাকা ধার করে রেখেছেন।
দেবব্রত : আমি নিজের মধ্যে নেই। আমি অন্য কেউ। আমিই অন্যের মধ্যে এক।
মিতালী : আমার সন্তানরা অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে বারণ করে।
19
দেবব্রত : কখনও কখনও আমি পুরো নৈঃশব্দের মধ্যে জেগে উঠি। এটা সঠিক একটা জায়গা । কিছুর অভাব নেই। কিন্তু সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। এর আকার অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। এখানে ছিদ্র আছে যা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারো।
মিতালী : ভূত, আপনি জানেন কল্পনা, আর কিছুই নয়…আমার স্বামীর যা ডিউটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, মহৎ।
দেবব্রত : এক্সকীউজ মী…এটা আমার মতামত নয়! ঠিক সময়ে আমি এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব…এখন বলার মতো কিছু নেই!…আমরা বক্তার জন্য অপেক্ষা করছি, সে বলবে আপনাকে, সে আমার হয়ে বলবে, এবং সব বোঝাবে আমরা যা ভালোবেসে ধরে রাখি…সব আপনাদের বোঝাবে…কখন?…যখন সময় আসবে…সময় শীঘ্র আসবে…
মিতালী [তাঁর বন্ধুদের দিকে]: যত তাড়াতাড়ি তত মঙ্গল…এটা বুঝেছি। [পাশে:] এরা আমাদের একা থাকতে দেবে না। এদের যেতে দাও, কেন এরা যাচ্ছে না?…বেচারা ডার্লিং, কোথায় সে? আমি তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না…
দেবব্রত [একভাবে]: অধৈর্য হয়ো না। তুমি আমার বার্তা শুনবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই।
্মিতালী [পাশে]: আহ!…আমি ওর গলা শুনছি!…[বন্ধুদের:] আপনারা জানেন, আমার স্বামী কখনও বোঝেননি। কিন্তু অবশেষে তার সময় এসেছে।
দেবব্রত : আমার কথা শুনুন, আমার জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা আছে। জীবনের সব পথে, সবরকম ভাবনায়…আমি ইগোটিস্ট নই: মনুষ্যপ্রজাতি উপকৃত হবে আমি যা জানি তা থেকে।
মিতালী ও! আপনি আমার পা মাড়িয়ে দিয়েছেন?…আমার শীতের ফোসকা আছে!
দেবব্রত : আমি একটা সত্যিকারের পদ্ধতি ঠিক করেছি। [পাশে:] বক্তার এখানে আসা উচিত। [জোরে:] জীবনে আমি কম কষ্ট পাইনি।
মিতালী : আমরা কত কষ্ট পেয়েছি। [পাশে:] বক্তার এখানে পৌঁছোনো উচিত। সময় হয়েছে নিশ্চয়ই।
দেবব্রত : অনেক কষ্ট পেয়েছি, অনেক শিখেছি।
মিতালী [প্রতিধ্বনির মতো]: অনেক কষ্ট পেয়েছি, অনেক শিখেছি।
দেবব্রত : আপনারা নিজেরাই দেখবেন, আমার পদ্ধতি সঠিক।
মিতালী [প্রতিধ্বনির মতো]: আপনারা নিজেরাই দেখবেন, ওর পদ্ধতি সঠিক।
দেবব্রত : যদি আমার নির্দেশ পালিত হয়।
মিতালী [প্রতিধ্বনির মতো]: যদি ওর নির্দেশ পালিত হয়।
দেবব্রত : আমরা পৃথিবীকে বাঁচাব!
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: ওর আত্মাকে বাঁচাব পৃথিবীকে বাঁচিয়ে!
দেবব্রত : সবার জন্য একটিই সত্য!
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: সবার জন্য একটিই সত্য!
দেবব্রত- আমাকে অনুসরণ করুন!…
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: ওকে অনুসরণ করুন!…
দেবব্রত: আমার নিশ্চিত বিশ্বাস
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: ওর নিশ্চিত বিশ্বাস আছে!
দেবব্রত: কখনোই না।।
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: কোনওদিন এবং কখনও না
[হঠাৎ উইংসে অনুষ্ঠানের আওয়াজ শোনা যায়।]
মিতালী কী আবার হচ্ছে?
SCENE 20
[আওয়াজ বাড়তে থাকে, তারপর মূল দরজা হাট করে খুলে যায়, একটা দড়াম শব্দ করে; খোলা দরজা দিয়ে খালি জোরালো একটা আলো মঞ্চ আর জানালাগুলো ভাসিয়ে দেয়, যাতে সম্রাটের প্রবেশটা আলোকিত হয়।]
20
বৃদ্ধ: আমি জানি না…বিশ্বাস হচ্ছে না…এও সম্ভব…কিন্তু হ্যাঁ…কিন্তু হ্যাঁ…অসাধারণ…এবং সত্যি…হ্যাঁ…যদি…হ্যাঁ…এ তো প্রধানমন্ত্রী! অবিশ্বাস্য!
[আলোর তীব্রতা সীমা পেরিয়ে গেছে, খোলা দরজা আর জানালা দিয়ে; কিন্তু আলোটা খালি, ঠান্ডা; আরও আওয়াজ বন্ধ হয়ে আসে ক্রমশ।]
বৃদ্ধ: উঠে দাঁড়ান!…ইনি মহামান্য প্রধানমন্ত্রী । আমার বাড়িতে এসেছেন, আমাদের বাড়িতে…শূনছ …তুমি বুঝতে পারছ এর মানে?
মিতালী [না বুঝে]: প্রধানমন্ত্রী ? মানে প্রধানমন্ত্রী! মন কী বাত!
[তারপর হঠাৎ তিনি বুঝতে পারেন।] আহ, হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী ! মহামান্য মন্ত্রী ! মহামান্য প্রধান! [তিনি অদ্ভুত সব সম্মানপ্রদর্শন করতে থাকেন।] আমাদের বাড়িতে! আমাদের বাড়িতে!
দেবব্রত [আবেগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে]: প্রধানমন্ত্রী !…ওহ! শ্রী শ্রী রাম রাম !…আমরা ক্ষুদ্র, আপনার বিশাল দেশ !…ওহ! কী স্বপ্ন দেখছি ! এ কী অপূর্ব স্বপ্ন
মিতালী [প্রতিধ্বনির মতো]: অসাধারণ স্বপ্ন…অসাধারণ…
দেবব্রত [অদৃশ্য জনতাকে]: উঠে দাঁড়ান,উঠে দাঁড়ান। বলুন জয় শ্রী রাম। আমাদের প্রিয় শাসক, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী , আমাদের মাঝে এসেছেন! হুররে! হুররে!
[তিনি টুলের ওপর উঠে দাঁড়ান; পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে মন্ত্রীকে দেখতে; বৃদ্ধাও ওধারে একই কাজ করেন।]
মিতালী : হুররে! হুররে!
[পায়ের ওপর পা রেখে।]
বৃদ্ধ: মহামান্য শাসক!…আমি এদিকে!…মহামান্য সম্রাট! আপনি শুনতে পাচ্ছেন? দেখতে পাচ্ছেন?
দয়া করে ওঁকে বলুন আমি এখানে! মাননীয় মন্ত্রী! মাননীয় প্রধান!!! আমি এখানে, আপনার বাধ্য সেবক…
মিতালী [এখনও প্রতিধ্বনির মতো]: আপনার বাধ্য সেবক, হেরররর প্রধানমন্ত্রী!
দেবব্রত: আপনার সেবক, আপনার দাস, আপনার কুকুর, ভৌ, ভৌ, আপনার কুকুর আপনার ভৌ ভৌ।
্মিতালী [কুকুরের মতো জোরে ডেকে]: ভৌ…ভৌ…ভৌ…
দেবব্রত [হাত নাড়িয়ে]: আপনি দেখতে পাচ্ছেন?…উত্তর দিন, স্যার!…আহ, আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি, আমি আপনার পবিত্র মুখের একটু দেখতে পেয়েছি…আপনার দেবতার মতো কপাল…আমি দেখেছি আপনাকে, হ্যাঁ, পার্লামেন্টের সদস্যরা থাকতেও।।
মিতালী : সদস্যরা থাকলেও…আমরা এখানে, হে প্রধান !
বৃদ্ধ: মহামান্য সম্রাট! মহামান্য প্রধান ! ওঁকে আটকাবেন না- সম্রাট দাঁড়িয়ে আছেন…দেখছেন মহামান্য শাসক, আমিই আসলে আপনার খেয়াল রাখছি, আপনার স্বাস্থ্যের, আমি সেবকদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত…
মিতালী [প্রতিধ্বনি করে]: আপনার প্রজাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত!
দেবব্রত : আমাকে যেতে দিন, এখন, …আমি এই ভিড়ের মধ্যে কীভাবে যাব?…আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সম্মান জানাতে যেতেই হবে, …যেতে দিন আমায়…
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: যেতে দিন ওকে…যেতে দিন…যেতে দিন ওকে…
দেবব্রত : যেতে দিন আমাকে দয়া করে, যেতে দিন। [গুরুতর চেষ্টা] আহ! আমি কী ওঁর কাছে পৌঁছোতে পারব?
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: পৌঁছোতে পারব…পৌঁছোতে পারব…
দেবব্রত : যাই হোক, আমার হৃদয় আর আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ওঁর পায়ে, লোকসভার ভিড় তাঁকে ঘিরে রেখেছে, আহ! আহ! ওরা আমাকে ওঁর কাছে পৌঁছোতে আটকাচ্ছে…ওরা জানে ভালো করে যে…ওহ! আমি বুঝেছি, আমি বুঝেছি… গণতন্ত্রের কারসাজি, আমি সব জানি…বলছে মানুষ রাজা আসলে রাজা তো একজনই। গণতন্ত্রের মধ্যে রাজতন্ত্র। আমি রাজার কাছে যাব।
বৃদ্ধা: শান্ত হও…মহামান্য প্রধানমন্ত্রী তোমায় দেখেছেন, তাকিয়ে আছেন…আমাকে চোখ মেরেছেন…উনি তোমার দিকে আসবেন… উনি মন কী বাত বোঝেন।।
দেবব্রত : ওরা যেন প্রধানকে ভালো বসার জায়গা দেয়…ডায়াসের কাছে…যাতে উনি বক্তার সব কথা শুনতে পান।
বৃদ্ধা [টুলের ওপর নিজেকে দাঁড় করাতে করাতে, পায়ের পাতায় ভর দিয়ে, চিবুক যত সম্ভব ওপরে তুলে যাতে ভালো দেখা যায়]: অবশেষে তারা মন্ত্রীর খেয়াল রাখছে।
দেবব্রত : হে ভগবান কী সৌভাগ্, স্যার…আপনি ওঁর ওপর ভরসা করতে পারেন। উনি আমার বন্ধু, আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ যিনি তাঁর পাশে আছেন। [পায়ের পাতায় ভর দিয়ে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে:]
ভদ্রমহোদয়, মহোদয়ারা, মেয়েরা, ছোটোরা, আমি তোমাদের অনুনয় করছি।
্মিতালী [প্রতিধ্বনি]: অনুনয়…অনুনয়…
দেবব্রত:…আমি দেখতে চাই…সরে যান…আমি চাই…ওই দৈবী তাকানো, মহান মুখ, ওই মুকুট, রাজার ছটা…স্যার, আপনার সম্মানিত মুখ আমার দিকে ফেরান! আমার দিকে, আপনার বিনীত ভৃত্যের দিকে…বিনীত…ওহ! আমি ওঁর মুখ এবার পরিষ্কার দেখেছি…আমি দেখেছি…
মিতালী [প্রতিধ্বনি]: আমি তাঁকে সে সময় দেখেছি…তাঁকে দেখেছি…তাঁকে…দেখেছি…
SCENE 21
দেবব্রত—আমার ঘরে য্বে আপনি পা রেখেছেন এর জন্য কোনও ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল। আমি একজন খুব সাধারণ মাপের গোয়েন্দা অফিসার ছিলাম। কিন্তু আপনার রাষ্ট্রের জন্য আমি যা বলেছেন তাই করেছি। ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছি। পাড়া আটকে রেখে লোক ঢুকিয়ে দিয়েছি। লোকে বলেছে দাঙ্গা। আমি জানি এগুলো দরকার। রাষ্ট্রের দরকার।
মিতালী—আমরা গর্বিত
দেবব্রত- আমিও গর্বিত। গর্ব সে বলেছি আমি আপনার সেবক। আমার কর মজুত রেখেছি আপনার সেবায়। আমি গোয়েন্দা আগে আপনার পরে দেশের। হে প্রধান, আপনি মন কী বাত পড়তে পারেন।। আপনি জানেন অনেককিছুই। আমার আবেগকে আপনি ক্ষমা করে দিন।
মিতালী—এভাবে বোল না। লুকিয়ে বল। থার্ড পার্সনের নামে বলো।
দেবব্রত—আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি এখানে পা রেখেছেন। আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। অপমানিত হয়েছিলাম
মিতালী – ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছিল দিল্লির রাস্তায়
দেবব্রত—জীবনে কত কষ্টই না সহ্য করেছি। আমি অন্য কিছু হতে পারতাম। আপনার সাপোর্ট পেলে কত কিছু করতে পারতাম। আপনি যদি আজ না আসতেন, তাহলে আরও কত দেরি হয়ে যেত
মিতালী—আপনি ছিলেন আমাদের শেষ ভরসা
দেবব্রত—আমাদের তো আসলে কিছু করার নেই। আমাদের দাম নেই
মিতালী—আমাদের সব টাকা আদানিরা নিয়ে নিল। আপনি ছাড়া আমাদের কে দেখবে
দেবব্রত- নিশ্চয় আমাদের এত খারাপ দশার জন্য দায়ি আমরাই। আপনাকে বিরাট দেশ চালাতে হয়। আদানির কত বড় সাম্রাজ্য
মিতালী- না এটা সত্যি নয়। ওদের অনেক আছে। অনেক বেশি আছে।
দেবব্রত- দেশের সমস্ত শত্রুরা পুরস্কার পেয়ে গেল।
মিতালী আমাদের বিট্রে করা হয়েছে
দেবব্রত—আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আমাদের ভয় দেখানো হয়েছে। আমি কিন্তু ভুল কোনও অভিযোগ করিনি। আপনিই বলুন, মাথায় ফেট্টি বেঁধে হাতে ত্রিশূল নিয়ে লোকেরা এসে বলে যাবে কী বলব কী বলব না, বলুন, এটা জুলুম নয়? বলুন আমার ফোনের মধ্যে দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখা হবে, বলুন জুলুম নয়? বলুন এগুলো আমি বলতে পারব না। ওরা এসে আমাকে জেরা করবে মাওবাদী বলে? বলবে আমি গোয়েন্দা ছিলাম, এখন আমি ওদের ইনফর্মার। কারণ আমি মুখ খুলেছি। বলুন তবে কী বলব
মিতালী- উনি সব জানেন। সব বোঝেন।
দেবব্রত—আমিই হেরে গেছি মন্ত্রীমশাই।
মিতালী—বোকা। তুমি একটি বোকা। উনি সব জানেন। মন কী বাত পড়তে পারেন।
দেবব্রত—সে তো ওনার নিজের। ওনার মতো অন্যেরও তো মন কী বাত আছে। তা বলতে গেলেই তো বিপদ।
মিতালী—কিছু বিপদ নেই। হাতাখুন্তি দিয়ে তো আর পার্লামেন্ট ওড়ানো যায় না। তুমি টেররিস্ট নও। দেশদ্রোহী নও। দেশপ্রেমের দিনমজুর।
দেবব্রত—আমার আর কিছুই ওরা রাখেনি। ঘরবন্দি করে রেখেছে দীর্ঘদিন। রোজ হুমকি। চারিদিকে অবিচার। চুরি। রাহাজানি। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। আর চ্যানেলে চ্যানেলে হাহাহিহি করে কী অপূর্ব ভালো আমরা আছি। কোনও চাপ নেই শুধু দুটো করে বিয়ে করা ছাড়া।।।
মিতালী— চোখরাঙানি… হুঁশিয়ারি…
22
দেবব্রত—ভুলতে চেয়েছি হে প্রধানমন্ত্রী। আমি তাই শুধু খেলা দেখতাম তার পর। আপনার বিশাল বড় স্টেডিয়াম এল। বড় বড় মূর্তি এল… আমি আরও দূরে পালিয়ে গেলাম। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতাম।। একটার পর একটা বাঁধ। ধস। বন্যা। প্রকৃতিও যেন মানুষকে আর সহ্য করতে পারল না। আমি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইলাম। আমায় পাসপোর্ট দেওয়া হল না। খবরে কাগজে লিখতে চাইলাম। পাঠিয়ে দেওয়া হল কলবুর্গী গৌরী লঙ্কেশের মৃতদেহের ছবি।
মিতালী—পুড়িয়ে দেওয়া সব মৃতদেহ
দেবব্রত—আমি ভগবানের কাছে যেতে চাইলাম। দেখলাম সোনার মন্দির। কোটি কোটি টাকা। দেখলাম না খেতে পেয়ে মানুষের সারি সারি মৃতদেহ। দেখলাম ইতিহাসের পোড়া পোড়া বই।
মিতালী—সবই কর্তার ইচ্ছে। সবই দেশের স্বার্থে।
দেবব্রত—দেশ মানে কী, জানতাম না। দেশ মানে আপনার পার্টি। দেশ মানে আপনার ধর্ম। দেশ মানে বড় বড় কোম্পানির বড়লোক মালিক। দেশ মানে পুরোহিত। দেশ মানে চুপ করে থাকা। দেশ মানে শুধু সহ্য করা। দেশ মানে মেরা ভারত মহান।।।
মিতালী—এইজন্য তোমায় কথা বলতে বারণ করেছিলাম। তুমি কথা বলতে জানো না। এখুনি বক্তা এসে পড়বেন। প্রধানমন্ত্রী আছেন। তোমার এত হতাশার কোনও কারণ নেই। তোমায় কিছু কথা বলতে হবে না। যা বলবেন ওঁরাই বলবেন। আর একটিও কথা বললে তুমি আর্বান নকশাল হয়ে যাবে। এখানে অফিসার আছেন। তখন…
দেবব্রত—ক্ষমতা তো দয়াও করে নাকি! আমার এতদিনের সব যন্ত্রণা তা কি আমি না বলেই মরে যাব!
মিতালী—অবনত হতে শেখো। মাথা নীচু করতে শেখো। মেনে নিতে শেখো।
দেবব্রত—আমাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোথায় যাব। বড় শাসক, তার নীচে ছোটো শাসক। তার নীচে আরও ছোটো শাসক। আর তার নীচে জনগণ। ১৪০ কোটির দেশ। চুপ। সাইলেন্স। শ্মশান। কবর।
মিতালী—চুপ চুপ চুপ চুপ চুপ
দেবব্রত- স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আমার কথা শুনতে এসেছেন। আমার বার্তা শুনতে এসেছেন। কিন্তু বক্তা এখনো আসেননি। তাই একটু অপেক্ষা করতে হবে মাননীয় মন্ত্রীকে।
মিতালী- মন্ত্রীমশাই নিশ্চয় ক্ষমা করে দেবেন আমাদের। বক্তা চলে আসছেন। একটু আগে হোয়াটস আপে তিনি তা জানিয়েছেন। আপনাদের আইটিসেল তা দেখেও নিতে পারেন। মিথা বলছি না।
দেবব্রত—প্রধানমন্ত্রী দয়ালু। ভারতবর্ষে আছি এখন। নিজেকে কেমন ইহুদী ইহুদী মনে হয়। তিনি সব শুনছেন। সব দেখছেন। সব জানছেন।
মিতালী—আগেই জেনেছেন। আগেই শুনেছেন। সব।
দেবব্রত—বক্তা সব বলবেন। আমি নই। বক্তা দোষী। আমি কিন্তু কিছুই বলছি না জাঁহাপনা।
মিতালী—তাঁর কাছেই তো সব ডকুমেন্টস রয়েছে।
দেবব্রত—আমি কিন্তু কিছুই বলছি না।
মিতালী—কিন্তু তোমার কথাই তো বলবে।
দেবব্রত- কিন্তু তা আমার গল্প। আমি নই। মহামান্য মন্ত্রীমশাইয়ের রাম যেমন তাঁর গল্প। বাল্মীকির নয়।
মিতালী—আর হিন্দুত্ব?
দেবব্রত- তাঁর হিন্দুত্বের গল্প। আমার নয়।
মিতালী—আর ইতিহাস?
দেবব্রত- তাঁর তৈরি করা ইতিহাস। আমার নয়।
মিতালী- চুপ চুপ চুপ
দেবব্রত—হে মহামান্য মন্ত্রী, আমি জানি আমার নাক নেই কান নেই মুখ নেই
গলা নেই, আমার আত্মসম্মান নেই। আমার লেজ আছে, আমি নাড়াই। ভৌ ভৌ করি। আপনি খেতে দেন তাই খাই। যেটুকু দেন, তাই খাই। তার চেয়ে বেশি খিদে পায় না। আমি কোনও খবর জানি না। কারণ খবর যাঁরা লেখেন তাঁদের মতো করে জানতে হয়। আমার কোনও ধর্ম নেই, কারণ আমার একটিই ধর্ম। রাষ্ট্রের সেবা করা। রাষ্ট্রের ধর্মই আমার নয়।
মিতালী—তালিয়া। তালিয়া। গোল্ডেন গিটার।
দেবব্রত—আমি মজা করছি না, আমি আগেও ওদের বলেছিলাম, আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতাম। বাবার জন্য রাত জেগে বসে থাকতাম। একদিন বাবা আর এলো না। শুনলাম কারা যেন টেনে নিয়ে গেছে। মা বলল, বাবাকে শকুন টেনে নিয়েছে। পরদিন আমি শকুনদের দেখতে গিয়েছিলাম। সে কী হাড় বের করা পচা গলা দেখতে। ঠিক আমাদের মতো। আপনার মতো। আমার মতো। শকুন।
মিতালী—আবার বাজে কথা। শকুনরা মরা মানুষের মাংস খায়। তুমি তো জ্যান্ত মানুষকে মেরেছ।
দেবব্রত- তুমি কি নিশ্চিত তুমি জ্যান্ত?
মিতালী—না নই।
দেবব্রত—গ্যাসচেম্বারে জীবন্ত লোকেদের যখন পুড়িয়ে মারা হত, যারা মারত, তারা মানুষ না ফ্যাসিস্ট? তুমি জানো?
মিতালী- ফ্যাসিস্টরা শকুন, না শকুনরা ফ্যাসিস্ট?
দেবব্রত- শকুনরাও ফ্যাসিস্টকে ভয় পায়।
মিতালী—আরে বাবা ওসব জার্মানির ব্যাপার। এখানে আমরা সবাই হিন্দু।
দেবব্রত- সবাই হিন্দু?
মিতালী- হ্য্যাঁ মুসলমানরাও হিন্দু, খ্রীষ্টানরাও হিন্দু, শিক্ষকরাও হিন্দু, অধ্যাপকরাও হিন্দু, লেখকরাও হিন্দু, কবিরাও হিন্দু, মিলিটারিও হিন্দু, মায় গোটা রাষ্ট্রই হিন্দু। হিন্দু হিন্দু।
দেবব্রত- মৃতেরাও হিন্দু, খুনিরাও হিন্দু, মন্ত্রীরাও হিন্দু, বন্দুক হিন্দু, টাকা হিন্দু।
মিতালী- এবার মনে হয় বক্তার আসার সময় এসেছে। চুপ করো। চুপ চুপ। উনি অস্থির হয়ে উঠেছেন।
দেবব্রত- বক্তা আসবেন।
মিতালী- আসবেন তিনি।
দেবব্রত- তিনি আসবেন।
মিতালী- আসবেন আসবেন আসবেন।
দেবব্রত- আসতেই হবে।
মিতালী- একদিন না একদিন আসবেন।
দেবব্রত- উই শ্যাল ওভারকাম।
মিতালী- আসবেন আসবেন আসবেন
দেবব্রত- তিনি আসছেন।
মিতালী- উই আর নট অ্যাফরেড।
দেবব্রত- তিনি আসছেন।
মিতালী- ডিপ ইন মাই হার্ট আই ডু বিলিভ
দেবব্রত- তিনি আসছেন
মিতালী- উই শ্যাল ওভারকাম
দেবব্রত- আজকেই
মিতালী- এসে পড়েছেন। অবশেষে।
SCENE 22
স্তুব্ধতা। সবাই থেমে গেছে। বিস্মিত। মর্মাহত। সকলে ৫ নং দরজার দিকে তাকিয়ে। সবাই অপেক্ষায়। সাসপেন্স। তিরিশ সেকেন্ড পর খুব ধীরে খুবই ধীরে নীরব ভাবে দরজা খুলল। তার পর বক্তা প্রবেশ করলেন। টিপিকাল কবির মতো চেহারা। পাঞ্জাবি। জিন্স। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। অতি সাধারণ দেখতে। দরজা দিয়ে ঢুকে দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়েন। মিতালী তার দিকে চেয়ে আঙুল তুলে বলেন- অবশেষে। )
দেবব্রত- এই তো এসে গেছেন।
মিতালী—সত্যি সত্যি তিনি এসে গেছেন। রক্তমাংসের মানুষ, যিনি কথা বলতে ভয় পান না। খুব একটা হিরো হিরো ব্যাপার নেই তো। বচ্চন বা সানি দেওল না। আক্রমণ করলেই মরে যাবে। অক্ষয়কুমার হলে টিকে থাকত।
দেবব্রত – আরে তাহলেও তিনি আছেন। তিনি আছেন। এ স্বপ্ন নয়।
মিতালী—হ্যাঁ স্বপ্ন নয়। তাকে দেখতে অনেকটা এ দেশের সাধারণ নাগরিকদের মতো। তিনি কথা বলতে এসেছেন। ভাবা যাচ্ছে না।
( দেবব্রত তাঁর প্রতি গিয়ে তাঁকে আপ্যায়ন জানাচ্ছেন। এতে এগিয়ে আসছেন গুটি গুটি পায়ে সেই ভদ্রলোক। বক্তা। এসে প্রতি নমস্কার জানাচ্ছেন দেবব্রতকে।)
24
দেবব্রত—মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, এই হলেন আমাদের বক্তা।
মিতালী- ইনিই। ইনিই তিনি।
এর পর সেই বক্তা মঞ্চে উপস্থিত অদৃশ্য মানুষগুলিকেও নমস্কার জানালেন। আর ক্রমশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
দেবব্রত ( অদৃশ্য দর্শকদের উদ্দেশ্যে) আপনারা এঁর অটোগ্রাফ নিতে পারেন। কারণ ইনি কতদিন জীবিত থাকবেন তা ইনিও জানেন না।
মিতালী—হ্যাঁ , এঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অল্পই।
SCENE 2।
দেবব্রত- ( অদৃশ্য ক্রাউডের প্রতি) এবার, মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আমি নিজের কথা সকলকে বলার জন্য , দেশবাসীকে বলার জন্য, প্রধানমন্ত্রীকে বলার জন্য, আর্বান নকশালদের বলার জন্য, গেরুয়াবাহিনীকে বলার জন্য, নকশাল বাহিনীকে বলার জন্য , সাংবাদিকদের বলার জন্য, চ্যানেলগুলোকে বলার জন্য…
মিতালী—ঝুপড়িবাসী, কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিক, আম্বানি, আদানিদের বলার জন্য
দেবব্রত- বাচ্চা বুড়ো যুবতী তরুণী, উকিল ডাক্তার মন্ত্রী সবাইকে বলার জন্য
মিতালী—নিজেকে বলার জন্য
দেবব্রত- ধন্যবাদ জানাই আমাদের প্রিয় বক্তাকে। সকলের সামনে তাঁর বক্তব্য আসুক, এটাই প্রার্থনা।
মিতালী—মোবাইল ফোনগুলো বন্ধ রাখুন। আর প্লিজ সাইলেন্স
দেবব্রত—আমি সকলকে আমার অভিবাদন জানাই।
মিতালী—জয় হোক।
( এর মধ্যে বক্তা অদৃশ্য লোকেদের অটোগ্রাফ বিলোচ্ছেন)
দেবব্রত—দেশের মালিক, দেশের প্রভু, দেশের বিধাতাদের প্রতি… সব দেওয়াল ভেঙে যাক
মিতালী—সব দেওয়াল ভেঙে যাক।।
দেবব্রত—সাইলেন্স লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, সাইলেন্স বন্ধুগণ, যারা যারা দেশের এ অবস্থার জন্য দায়ী।।
মিতালী—বন্ধুগণ বন্ধুগণ…
দেবব্রত—লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট—যাদের জন্য এই অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে, সেই চেয়ারপ্রস্তুতকারকেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই…
মিতালী—চেয়ার চেয়ার চেয়ার… চেয়ারের জন্যই সব
দেবব্রত— প্রধানমন্ত্রীর জন্য কে যে এই অসামান্য আর্মচেয়ার তৈরি করেছেন তার কথা কেউ জানে না। কে এই ঘরে এত চেয়ারের জোগান দিয়েছেন তারাও বিস্মৃত… কে এই বাড়ি তৈরি করেছেন, মন্ত্রীর পোশাক, এমনকি মন্ত্রীর জাঙিয়াও কে তৈরি করেছেন তাও কেউ জানে না। সেই সব তাঁতি, ড্রাইভার, কার্পেন্টার সবাইকে আমার অভিবাদন
মিতালী—আলো, শব্দ, ধ্বনি, লাইটম্যান
দেবব্রত—লিফলেট তৈরি করেছেন যারা, প্রিন্টার, প্রুফরিডার, সম্পাদক, খুন হয়ে যাওয়া লোক, খুনি, মেক আপ শিল্পী, পুলিশ, ব্যাটন, বন্দুক, গ্যাস, তরোয়াল, মশাল, পার্টি, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা
মিতালী—যারা মারলেন যারা মরলেন
দেবব্রত—যারা খাবার সাপ্লাই দিলেন, যারা গন্ধ
মিতালী—যারা রিয়ালিটি শো, যারা সিরিয়াল
দেবব্রত—আমার স্ত্রী, আমার প্রাক্তন প্রেমিকারা
মিতালী—মিস ডার্লিং বনলতা নীরা লাবণ্য সুরঞ্জনা
দেবব্রত—ধন্যবাদ জানাই যাঁরা আমার এই বকবকানি সহ্য করে এতদিন ধরে আমাকে সাহায্য করে এসেছেন। যাঁরা এসেছেন বলেই আজকের এই সন্ধ্যা হয়ে উঠেছে এত মনোরম, আর ধন্যবাদ জানাই আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, যিনি না এলে এত কিছু সব বৃথা হত
মিতালী—প্রধানমন্ত্রীর জয় হোক
দেবব্রত—( স্তব্ধতা ) তার পর ফিসফিস করে—প্রধানমন্ত্রীর
মিতালী—(ফিসফিস করে) জয় হোক
দেবব্রত—এই চুপ চুপ প্রধানমন্ত্রীর
মিতালী – শশশশশশশশ জয় হোক
SCENE 24
দেবব্রত– হে মন্ত্রীমশাই, আমার স্ত্রী এবং আমার জীবন থেকে খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। স্বাভাবিক নিয়মে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। লম্বা একটা জীবন কাটানোর জন্য ভগবানের চেয়েও বেশি আপনার কাছে ঋণী। কারণ আপনিই আমাদের বাঁচতে দিয়েছেন। আমাদের পাশের বাড়ির দীনবন্ধুবাবু ও তার পরিবার তো সব হারিয়ে আত্মহত্যাই করলেন। সুইসাইড নোটে নাকি লেখা ছিল, আরবান নকশাল হওয়ার কারণে এই আত্মহত্যা। কী আর করব বলুন, জানলা দরজা বন্ধ রেখে নিজেদের আরবান নকশাল নামক ভাইরাস থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আজ আমার মিশন পরিপূর্ণ হয়েছে বলা যায়। আমার জীবন ব্যর্থ গেল না। কারণ আমার বার্তা শোনানোর জন্যই উপস্থিত হয়েছেন এই সুবিখ্যাত বক্তা।
(বক্তার দিকে ইশারা করবেন, বক্তা যদিও কী বলা হল তা ঠিক বুঝতে পারবেন না। ) তিনি বিশ্ববাসীকে জানাবেন আমার মতো অতিসাধারণ এক মানুষের বক্তব্য। মানুষের জীবন থেকে আত্মসম্মান সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। মানুষকে কেউ সম্মানটিও দিতে চায় না। যে কয়েকজন মানুষের এখনো আত্মসম্মানটুকু আছে, যে কয়েকজন মানুষ এখনো মানুষ আছেন, তারা যেন একটু একটু গরম ভাত ডাল আর মাঝের ঝোল খেতে পারেন।
বক্তা, আমার বন্ধু। ( বক্তা অন্য একটা দিকে তখন তাকিয়ে আছেন) যদি আমি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত আছি বলে আমার বন্ধুরা অভিযোগ করেন, তো জানবেন তা আমি নিজের ইচ্ছেতে করিনি। আমাকে করতে হয়েছে। ( মিতালী কেঁদে ওঠেন অস্ফূট) কিন্তু এখন আপনি আমার কথা বলুন, আমি এখান থেকে চলে যাব।
(বক্তা আর অটোগ্রাফ দেওয়ার অনুরোধ খারিজ করে নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। চারিদিকে তাকাতে থাকেন।)
নিস্পৃহভাবে আমার কথাগুলিকে বলে যাওয়াই আপনার কাজ। সত্য মিথ্যা বিচার করতে যাবেন না। আমার ভাবনা বলার জন্যই আপনাকে অনুরোধ করেছি। সবাইকে আমার ভাবনা জানানোর জন্যই। হতে পারে তা সত্য নয়। সত্য কেই বা দেখেছে? সত্য কী তা কেই বা জানে? আমার ব্যক্তিগত জীবনের কোনও খুঁটিনাটিই বাদ দেবেন না। কিছু কিছু শুনলে সকলের হাসি পাবে। কিছু কিছু শুনলে খারাপ লাগবে। কেউ কেউ কাঁদতেও পারেন, যদি এখনো না চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে থাকে।
আমি কতটা পেটুক ছিলাম, কবিতা ভালোবাসতাম, কবি হতে চাইতাম, গরুর মাংস পছন্দ করতাম, চিংড়িও। মাছ ভাজা খেতে ভালো লাগত আমার। এসবও বলবেন। যদিও সব খাওয়া আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।
( ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তার স্ত্রী মিতালী) ওহ! মিতালী যে কী সুন্দর বিফস্টেক রাঁধতে পারত! ওহ সঙ্গে আলুপোস্তর কথাও ভুলবেন না। আর হ্যাঁ আমি নাস্তিক ছিলাম। যদিও মন্দির বানানোর জন্য কর দিয়েছি। কিন্তু জীবনে ভগবানে বিশ্বাস করিনি মন্ত্রীমশাই। বক্তা সে সব বলবে।
( বক্তা তখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।)
আর হ্যাঁ,আমার পেট ছিল আলগা। মুখ চলতে শুরু করলে থামাতে পারতাম না নিজেকে। আমার বউ আমাকে শেখাত সব জায়গায় মুখ না খুলতে। কিন্তু নিজেকে চুপ করিয়ে রাখতে পারিনি। কারণ কী জানেন, কারণ আমার দুঃখ হত। আমার কষ্ট হত। আমি যে এককালে একজন নৃশংস গোয়েন্দা অফিসার ছিলাম, তা আমাকে পীড়া দিত। আমি হজমশক্তি হারিয়েছিলাম। সব গিলতে গিলতে সব কথা সব দুঃখ গিলতে গিলতে আমার হজমশক্তি কমে যায়।
মিতালী—হ্যাঁ হ্যাঁ, এত অপমানের পর শেষমেশ যেন একটু সম্মান নিয়ে মরতে পারি। আমাদের যেন গ্যাসচেম্বারে ঢোকানো না হয়। আমাদের জন্য যেন একটা রাস্তা হয়। আমরা তো মানুষ। সাধারণ মানুষ।
দেবব্রত—আমার প্রতি সারাজীবন বিশ্বাস রেখেছ তুমি। মিতালী। আমাকে কখনো ছেড়ে যাওনি। বিপদে আপদে কষ্টে যন্ত্রণায়
সবার থেকে আলাদা, একা
সবার থেকে ছিন্নভিন্ন
তবুও আমি আশাবাদী
একসঙ্গে যেন মরতে পারি
একসঙ্গে যেন আমাদের চিতাভস্ম
মিশে যায় পঞ্চভূতে
একই কীট যেন আমাদের কুড়ে কুড়ে খায়
যেন গুমখুন না হতে হয়
যেন পচে মরলেও মিশে যায় আমাদের দেহ
মিতালী—একসঙ্গে পচে
দেবব্রত- একসঙ্গে পোড়ে
যে বাতাসে মিশে যায় সে বাতাস যেন শুঁকে নেয় মানুষ
দেবব্রত—আমাদের দেহ যেন অন্ধকারে অন্ধকার আর আলোয় আলো হয়ে থাকে
মিতালী—যা হবার তা হবে
26
দেবব্রত- আমাদের কেউ ভুলে যাবে না। প্রধান যে রাজা সে মনে রাখবে
মিতালী- সবসময়
দেবব্রত- আমরা ইতিহাসের কাছে রেখে যাব কিছু না কিছু। আগামী দিনের মানুষের জন্য।
মিতালী—ইতিহাস রেখে যাব।
দেবব্রত ও মিতালী—আমাদের নামে একটা মেট্রোস্টেশন হবে। রাস্তা হবে।
দেবব্রত—এসো আমরা এক হয়ে যাই। অনন্তের কাছে আমরা একসঙ্গে যাই। এই জীবনের শুরুতে আমরা হয়তো একসঙ্গে ছিলাম না। কিন্তু মরতে তো পারি একসঙ্গে। শেষ বার ( বক্তার দিকে ইঙ্গিত, বক্তা নিশ্চল) আমার তোমার প্রতি বিশ্বাস আছে। তোমাকে ভরসা করি আমি। আমার সব বার্তা তুমি সবাইকে দেবে। ( এবার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ) আপনি যদি আমাদের অনুমতি দেন, তাহলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা চলে যাব।
মিতালী—সবাইকে বিদায়
দেবব্রত—প্রধানমন্ত্রীর জয় হোক
তিনি একগুচ্ছ কালিপটকা ছুঁড়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে।
সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর দিকে একগুচ্ছ আলোর ঝিলিক দেখা যায়। আলোর যে সব ফোয়ারা আছে সেগুলো জ্বলে ওঠে। উপর থেকে কুচি কুচি কাগজ বৃষ্টি হতে থাকে।
মিতালী—প্রধানমন্ত্রীর জয় হোক।
( বোমার শব্দ হতে থাকে। আর কুচি কুচি কাগজগুলো রঙিন কাগজ গুলো ফাঁকা চেয়ার মঞ্চ সর্বত্র পড়তে থাকে এমনকি মঞ্চের বাইরে থাকা দর্শকদের উপরেও)
দেবব্রত—প্রধানমন্ত্রী জিন্দাবাদ
মিতালী—প্রধানমন্ত্রী জিন্দাবাদ
এইসব বলতে বলতে একটা জানলা খুলে দুজন লাফ দেয় মঞ্চের বাইরে।
স্তব্ধতা। কোনও বাজির শব্দ নেই। মূল দরজা দিয়ে আলো এসে পড়ে। প্রথম সিনের মতো একটা হালকা আলো থাকে। ম্যাড়ম্যাড়ে। জানলাগুলো খোলা থাকে। তাদের পর্দারা হাওয়ায় উড়ছে।
SCENE 25
বক্তা বেশ কিছুক্ষণ নিজেকে নিশ্চল করে রাআখার পর এবং দুটি সুইসাইড দেখার পর বেশ কিছুক্ষণ পর স্থির করে কিছু বলার। কিন্তু তার সামনে পড়ে আছে কিছু ফাঁকা চেয়ার। অদৃশ্য অতিথিদের সে বোঝানোর চেষ্টা করে যে মূক বধির। তাদের মতো করে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বলার চেষ্টা করে। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে বলার চেষ্টা করে সে কথা বলতে পারে না, শুনতেও পারে না। গলা দিয়ে শুধু গোঙানির আওয়াজ আসে। যেন খুব চেষ্টা করে আওয়াজ বের করছে।
বক্তা ( অতি কষ্ট করে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ সহ) গোঁ গোঁ আম ম ম
হাল ছেড়ে দিয়ে সে দুটি হাত দুপাশে রেখে নিস্ফল হয়ে যায়। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তার পর তার মুখে আলো এসে প্পড়ে। তার একটা আইডিয়া এসেছে। সে পাশে রাখা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকায়। সেখানে একটা চক নিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখে
লজ্জা
তার পর আবার
গলা দিয়ে আওয়াজ বের করে
নানাভাবে
বক্তা হুম হুম মুম হুম ওঃ আআহ
চক দিয়ে লেখে
বিদায় বিদায় বিদায়
( মূল নাটকটি শেষ হয়ে যায় ব্ল্যাকবোর্ডে বিদায় লেখার আগেই।)