
গণতন্ত্রই গ্রেফতার
সোনম ওয়াংচুকের মুক্তি চাই
বেবী সাউ
শুধু লাদাখ নয়, সমগ্র দেশকেই বিক্রি করার পথে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রকৃতিকেও ধ্বংস করে, বিক্রি করছে এই সরকার। আর যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের হয় গ্রেফতার করা হচ্ছে, আর নয় তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশে ডক্টর কাফিল খানের উপর অত্যাচার কম হয়নি। ছত্তিশগড়েও প্রকৃতিকে বাঁচাতে লড়াই করা মানুষজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গুজরাতে প্রতিবাদের কোনও স্বর নেই। লাদাখের সোনম ওয়াংচুক বহুদিন ধরেই লাদাখের অধিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে লড়াই করছেন। একজন গান্ধীকে যেমন গ্রেফতার করলে হাজার হাজার গান্ধীর জন্ম হত, ঠিক তেমনই একজন সোনম ওয়াংচুককে বন্দি করলে জন্ম নেবে অনেক সোনম ওয়াংচুক। কিন্তু এই ঘটনা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই দেশে গণতন্ত্র এখন শুধুই কাগজেকলমে।
জাতীয় সড়ক ৩৩ (NH 33) এখন যেন এক নির্মম প্রতিযোগিতার পথ। ১০০-১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে গাড়ি ছুটছে, কিন্তু এই দ্রুতগতির পিছনে লুকিয়ে আছে এক হৃদয়বিদারক ধ্বংসলীলা। রাস্তার দুপাশে যে ঘন অরণ্য একদিন প্রাণের স্পন্দনে ভরপুর ছিল, তা আজ ধ্বংসের মুখে। পাহাড়গুলো যেন নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে, গালুডিহি আর ফুলডুংরির সেই সবুজ সৌন্দর্য এখন শুধুই স্মৃতি। বন্যপ্রাণীদের কণ্ঠ আর শোনা যায় না, দলমার হাতিদের সংখ্যা কমে গেছে এমনভাবে যে তাদের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে। সুবর্ণরেখা নদী, যে একদিন ঝাড়খণ্ডের জীবনরেখা ছিল, তা এখন শুকিয়ে মরুভূমির দিকে এগোচ্ছে। আর এই ধ্বংসের ছায়া পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের উপরেও, যেখানে প্রকৃতির হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
অযোধ্যা পাহাড় একদিন ছিল স্বপ্নের মতো। ঘন জঙ্গল, পাহাড়ের চূড়ায় সবুজের সমারোহ, ঝর্ণার কলধ্বনি, আর বুনো ফুলের মায়াবী সৌরভ—এই সবই যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব ক্যানভাস ছিল। কিন্তু আজ সেই পাহাড়ের বুক চিরে খননের যন্ত্রণা, বন উজাড়ের কষাঘাত, আর অপরিকল্পিত উন্নয়নের নির্মমতা। ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে গেছে, বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস হয়ে গেছে। আর স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যাদের জীবন এই পাহাড়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাদের জীবিকা ও সংস্কৃতি এখন বিপন্ন।
অযোধ্যা পাহাড়ের এই নিঃশব্দ কান্না কে শুনবে? এই ধ্বংসের জন্য কে দায়ী? এই প্রশ্নগুলো আমাদের বুকে ধাক্কা দেয়, কিন্তু উত্তর মেলে না। আজকাল আমরা যেন প্রশ্ন তুলতেও ভুলে গেছি। রিল নির্ভর জীবন উপহার দিয়েছে রাষ্ট্র আমাদের।
তেমনি ছত্তিসগড়ের বস্তার জঙ্গল ছিল প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি। ঘন অরণ্য, জৈববৈচিত্র্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার, আর আদিবাসী জনজাতিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য—এই সবই বস্তারকে বিশেষ করে তুলেছিল। কিন্তু খনিজ সম্পদের লোভে এই জঙ্গল আজ ধ্বংসের মুখে। বহুজাতিক সংস্থার খনন, নকশালবাদের সংঘাত, আর সরকারি নীতির উদাসীনতায় মারিয়া, গন্ড, ভিল, হালবার মতো জনজাতিদের জীবন বিপন্ন। তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাদের সংস্কৃতি মুছে ফেলা হচ্ছে, তাদের জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে। তাদের আর্তনাদ কে শুনবে?
ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের কথাও একই। মুণ্ডা, সাঁওতাল, ওরাঁও, হো—এই জনজাতিদের জীবন জঙ্গল, নদী, আর পাহাড়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু শিল্পায়নের নামে, খননের লোভে, আর অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে তাদের জীবনের ভিত্তি ভেঙে পড়ছে। সুবর্ণরেখা নদী, যে একদিন এই অঞ্চলের প্রাণ ছিল, তা এখন শুকিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। আদিবাসীদের জীবিকা, তাদের ঐতিহ্য, তাদের অস্তিত্ব—সবই এখন হুমকির মুখে। এই অবিচারের বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? কার হৃদয়ে সেই আগুন আছে যে এই নিপীড়িতদের হয়ে কথা বলবে?
এইসব প্রশ্ন যখন ভারতের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসছে তখনই আরেকটি নাম আমাদের মনে আশার আলো জ্বালাচ্ছিল। সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে উঠে আসে একটি নাম—সোনম ওয়াংচুক। লাদাখের হিমশৈলের কোলে ১৯৬৬ সালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি শুধু একজন প্রকৌশলবিদ নন, তিনি একজন গবেষক, সমাজকর্মী, পরিবেশবিদ, আর সত্যের পক্ষে নির্ভীক যোদ্ধা। তাঁর জীবন যেন এক জ্বলন্ত মশাল, যা অন্ধকারে পথ দেখায়। বলিউডের থ্রি ইডিয়টস-এর র্যাঞ্চো চরিত্র তাঁর জীবনেরই এক প্রতিচ্ছবি। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে সৃজনশীলতা, সাহস, আর মানবকল্যাণের অটুট প্রতিজ্ঞা।
১৯৮৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন SECMOL (Students’ Educational and Cultural Movement of Ladakh), যা লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন রূপ দিয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার শৃঙ্খল ভেঙে তিনি এমন এক শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তন করেন, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এই শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি জীবনমুখী, প্রকৃতিমুখী, আর সংস্কৃতিমুখী। SECMOL আজ লাদাখের তরুণদের কাছে এক জ্বলন্ত স্বপ্ন, যা তাদের জীবনে আলো ছড়াচ্ছে।
তাঁর আরেকটি অসাধারণ আবিষ্কার হল আইস স্তূপ। হিমালয়ের জলসংকটের মতো এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি এই অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। শীতকালে জমা জলকে কৃত্রিম হিমবাহে রূপান্তরিত করে তিনি গ্রীষ্মে কৃষি ও পানীয় জলের সমস্যা সমাধান করেছেন। এই উদ্ভাবন শুধু লাদাখের কৃষকদের জীবনে আশার আলো নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক পথপ্রদর্শক উদাহরণ। তাঁর এই কাজ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তাঁকে করে তুলেছে ‘লাদাখের আইস ম্যান’।
২০১৩ সালে তিনি শুরু করেন নিউ লাদাখ মুভমেন্ট, যা লাদাখের পরিবেশ, উন্নত অর্থনীতি, আর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার এক অদম্য প্রয়াস হিসেবে দেখা হয়। ২০২০ সালে তিনি চীনা পণ্য বয়কটের আহ্বান জানিয়ে ভারতের স্বনির্ভরতার পথে এক শক্তিশালী পদক্ষেপ নেন। আর সাম্প্রতিককালে, লাদাখের পূর্ণ রাজ্যত্ব ও ষষ্ঠ তফসিলের দাবিতে তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও অনশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর এই লড়াই লাদাখের জনগণের অধিকার, তাদের পরিবেশ, আর তাদের সংস্কৃতির জন্য এক নিরলস সংগ্রাম।
কিন্তু এই সংগ্রামের পথে এসেছে এক নির্মম ধাক্কা। ২০২৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সোনম ওয়াংচুককে NSA (National Security Act)-এর অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ কী? তিনি প্রকৃতির জন্য, জনগণের জন্য, আর তাঁর প্রিয় লাদাখের জন্য লড়েছেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে তার মাতৃভূমির অধিকারের কথা বলেছেন। এই গ্রেপ্তার শুধু একজন মানুষের উপর অবিচার নয়, এটি সত্য ও ন্যায়ের উপর এক নির্মম আঘাত। তাঁর কণ্ঠকে বন্ধ করার চেষ্টা বারবার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর সংগ্রামের আগুনকে বন্ধ করা সম্ভব হয় নি।
ঝাড়খণ্ডের শুকিয়ে যাওয়া নদী, বস্তারের ধ্বংসপ্রাপ্ত জঙ্গল, অযোধ্যা পাহাড়ের নিঃশব্দ কান্না, আর লাদাখের বিপন্ন প্রকৃতি—এই সব ধ্বংসের জন্য দায়ী কে? কেন সোনম ওয়াংচুকের মতো মানুষ, যারা প্রকৃতি ও জনগণের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, তাঁদেরই শাস্তি ভোগ করতে হয়? এই প্রশ্নগুলো আমাদের হৃদয়ে ধাক্কা দেয়, আমাদের ঘুম ভাঙায়। আমরা কি শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকব? নাকি সোনম ওয়াংচুকের মতো সাহসী কণ্ঠের পাশে দাঁড়িয়ে আমরাও প্রকৃতি ও ন্যায়ের জন্য লড়ব?
এই সময় আমাদের সকলের কাছে একটি প্রশ্ন ঘুরছে—আমরা কি প্রকৃতির এই কান্না শুনতে পাচ্ছি? আমরা কি সোনম ওয়াংচুকের পাশে দাঁড়াতে এখনও প্রস্তুত নই?