
জীবনানন্দ ক্রোড়পত্র- সা বি না ই য়া স মি ন
অবারিত হৃদয় ও তার প্রতিধ্বনির প্রতিলিপি
ধানসিরি
পাল তোলা নৌকার গায়ে ঠিকরে পড়েছে চাঁদের আলো,
নতজানু হৃদয়ের কাছে হার মেনে
যে অবোধ দূরের হাতছানি মেখে নিরুদ্দেশ হওয়ার
বাসনা আঁকছে আনমনে,
সেখানে স্বপ্নের ধু ধু বালিয়াড়ি।
ভালবাসি কথাটি আটকে আছে দুই ভ্রুর মাঝখানে।
ঠোঁটেও আঁকা হয়নি শেষ প্রহরের চুম্বন।
উজানে বয়ে চলে ধানসিরি।
বুনো হাঁস
পলাতক মন, রাতের চাদরে মুখ ঢেকে
কী কথা দিয়েছিল তারা একে অপরকে ?
হাতের মধ্যে ছিল হাত, বুকের মধ্যে বেতালে বাজছিল যুদ্ধ দামামা,
খুব সন্তর্পণে নীরবে অলক্ষ্যে কারা যেন ভাসিয়ে দিচ্ছিল
আমাদের অস্তিত্ব।
আমাদের অস্তিত্বের গায়ে বিপন্নতার ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে এখনো।
কার কাছে কোথায় কখন কীভাবে আমরা লুণ্ঠিত হয়েছি
সে কথাও লেখা হচ্ছিল ইতিহাসের পাতায়।
নক্ষত্র
নক্ষত্ররা জেগে থাকে, জেগে থাকে স্বপ্ন,
স্বপ্নরা নক্ষত্র হতে চায়,
আমাদের ঘুম নেই চোখে বহুদিন।
নাবিক
তুমি তো গৃহহীন, অকুল দরিয়া
ঘরে ঘরে গৃহবধূ খুঁজে পেতে মরিয়া
ফিরে ফিরে আসা আর অবুঝের সমাহার
আমি তো মেনেই নিয়েছি নিয়তির আভিসার।
রূপসী বাংলা
আমি যেদিন মুখ বলতে তোমার মুখ বুঝেছিলাম
সে মুখে যে এত রক্ত লেগে ছিল বুঝতে পারিনি,
রক্তকে সন্দেহ করা সহজ, কিন্তু ঘৃণা?
এত ঘৃণা জন্ম নিল কোথা থেকে?
এত ক্ষোভ উঠে এলো কোথা থেকে?
কারা আলাদা করে দিল তোমাকে আমাকে?
কাদের হাতের পুতুল হয়ে উঠলাম আমরা?
কারা আমাদের চোখ বেঁধে রাখে হাত পা মুখ বেঁধে রাখে
আর আমরা খুঁটে খেতে থাকি উচ্ছিষ্ট?
জানো,
আমি অনেকদিন তোমার মুখ বলতে শালিখ পাখি বুঝতাম।
পায়রার পায়ে আটকে থাকা ঘুঙুর বুঝতাম,
রাতের কোলাহল থামিয়ে হঠাৎ বিসমিল্লা বেজে উঠবে বুঝতাম,
শুধু বুঝতে পারিনি, তুমি আমি বলে আদৌ আসলে কিছুই নেই কোথাও।
হেমন্ত
এখানেই শেষ বিকেলের আলো এসে পড়বে
সমাধির কোলে ঢলে পড়বে কান্না
সফল কারাবাসের অন্তর্জলি যাত্রা শেষে
বেজে যাবে বাঁশী, আশকারা পেয়ে যাবে বাঁচা।
অনন্ত জীবন
যে জীবন অনন্তের অসীমের অপরাঙ্মুখ
যে জীবন চৈত্রের আষাঢ়ের শস্যের ক্ষেতের পেঁচা আর ইঁদুরের
যে জীবন নৈঃশব্দের হাড়-হাভাতের অসমাপ্তের
যে জীবন সংকল্পের বিকল্পের কল্পনার জল্পনার
যে জীবন ব্যথার বেদনার ভালবাসার খিদের মৃত্যুর,
সে জীবনের তরে আমার সখেদ স্বগতোক্তি – সমর্পণ বরাবর।।