
শীলা বিশ্বাস-এর কবিতাগুচ্ছ
মুদ্রাঘরের মারুবেহাগ
১
চোখ ও চবুতরার ফাটলে করুণ তবক আলগোছে কে রেখে যায়। নুয়ে থাকা গাছের ছায়ায় শুনি হলুদ ফড়িং-এর মারু বেহাগ। সাঁতলানো বিরহভাঁজ স্তবকে বালিকার সাজফুল পরাগ । না থেকেও কেন যে প্রবল থেকে যাও নিরালার ঘোর ও ঘরে!
২
ফুলের কাছে প্রশ্ন রেখে ঘুমিয়ে পড়া ভ্রমর নীলের বৃতিতে । সেই সব সহিষ্ণু পাঠ থেকে যায় বসন্তের জলজাহাজে । শাখায় বসে থাকা প্লাবন পাখির কাছে। তুমি তখন ঠোঁটের মাউথ অরগ্যান… স্পর্শের অরিগ্যামি… আনন্দের আশনাই।
৩
সদ্যোজাত বইয়ের মতো শরীর নিচ্ছ ঘ্রাণে। নাম লিখেছি কোমল স্পাইনে… ডিস্কে। স্পাইরাল বিঁধে গেছি তোমার লাবডুবে। ব্লার্বে যে কথা লাজুক খরগোশ মধ্য বয়সে সে সাহসী ডানার ঈগল। ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ বলে যে কথা জানতে চাও… তা কেমন রবাহূত বাজছে সাদা পাতায়
৪
‘ডায়েরি ভেবে লিখে যাও’ । এক পঙক্তিও না লিখে কত ব্যথা পড়ে নেওয়া চোখের থিসিস। পড়ন্ত বেলার ফুটনোটে স্বল্প হয়ে আসে অক্ষর। রেফারেন্সে আসে জাতিকার গল্প। পৃষ্ঠা সংখ্যা না মেলা পুঁথি থেকে কেমন এলোমেলো পড়ে নিলে অসময়ে …
৫
এই তো সটান দাঁড়িয়ে আছ যেন নাগচম্পা গাছ। সাদা হয়ে গেছে মাথা। ডাল ভাঙলে সাদা দুঃখে ভেসে যাও আগের মতো ? চিকনকারি শার্টে রাখা ছিল চাবি হারানো বোতামঘর । আলগা সুতোয় ঝুলে গেছে কবে ভাঙা বোতাম ও হলুদ বয়ঃসন্ধি…
৬
থাকা আর না থাকার মাঝে ধূসর অঞ্চল। উঠে আসে কথা। নাকি থেকে যায় অগ্রন্থিত !
একেই কি শুদ্ধ বেদনা বলে ? একেই কি বলে জীবনবৃত্ত ? স্পর্শকে লেগে থাকা জলবিন্দু … ত্রুবাদুর গান… রতিশ্লোক … আয়না বসানো জামার না ভোলা আলোদাগের কুমারী সম্ভব …
৭
সুখ মরশুমের দোতারাটি… ‘প’ আর ম’ এর মাঝে বাঁধা ছিল ষড়জুড়ি দুটি তার … দৃশ্যরা মাদুর পেতে বসে হাতপাখা বাতাসে… হ্যারিকেন সন্ধ্যায় নিজেকে নিরক্ষরা জেনে তুলে রাখি গল্পের বীজধান … ফা-হিয়েন, মেগাস্থিনিস আর গোপন ভ্রমণলিপি …
৮
বিরহ বিরতি শেষে চরাচর ভেঙে নেমে এলে অপটু রন্ধনশালায়… অমীমাংসিত ধারণার মতো অনুপস্থিতির থিমে বাজিয়ে গেলে বন্দিশ… বিস্তারের লেখা ও শাখা বীরুৎ জাতীয় । অপরূপ ডুব ছিল তার… অপেক্ষা আগন্তব্য নগর…
৯
দহন দোহার গায়ে লেপ্টে নিয়েছ। তুমি কাহারো নও। কেউ কি তোমার? মনপুরায় তখনও নৌকার নহবত… ঝিলমের ঝিলমিল। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ… যন্ত্রণার জলঝাঁপ। সে লেখা বেঁচে থাকে আঁধারে একা… এবং একা…
১০
লেখা শেষে আখড়ায় ফিরে যায় নিজস্ব ট্রেকার। সহজ কবে এত সহজ বলো ? মশাল হাতে নক্ষত্রলোক পেরিয়ে আসা জীবন জ্যামিতি । লাস্য ভাঙানো সময় উবে যায় কবিতার বাজার থেকে।
এসো আমরা দুঃখ আঁকি; লিখি ফেলে আসা প্রেম।
১১
হাতঘড়ি থেকে ছিটকে আসছে সময়। সময় কি মায়া জানে ? জানে এখন দিবা দ্বিতীয় প্রহর। দুটি বিচ্ছেদ বিন্দু মধ্যে কতগুলি মীড় টানা থাকে। কটা মীড় মার্জিনের বাইরে পড়ে থাকে অনুচ্চারিত । কটা ঢেউ অনাস্বাদিত বালির পাহাড় । নিব আর ঠোঁটের তফাৎ আর না-তফাৎ !
১২
বিরহবিতস্তায় নিজেই নিজেকে ভাসাই…। শিরায় কুটুম পাখি। চোখ আবদ্ধ কড়িকাঠে । আকাশে তুলো মেঘের খবর বুড়ির চুল হয়ে ভাসে চোখে। তুমি স্বচ্ছতার কথা বলো। বলো গভীরতার কথা । কথার নোঙরে দ্রব হয়ে আসে নৌকা পথ।
১৩
সকালের কাপড় মেলা তার সন্ধ্যায় কাক-ক্যাফেটেরিয়া। জুবু হয়ে আছে গায়ে জল লাগা পিটুনিয়া। মৃত প্রেমের উপর বিছিয়ে রাখি কবোষ্ণ চাদর। ধর্মান্তরিত ঋতুর কাছে শিশিরও অধিক চাওয়া। খুলে বসে আছি শীতল আঘাতের দহন দেরাজ ।
১৪
অন্ধকার ছিঁড়ে পড়ছে। তোমার লেখার দিকে তাকিয়ে বসে আছি। গাঢ় ঢেউ-এ দ্বীপ ছোট হয়ে আসে। নিজের ভিতর অন্যকে দেখি । অন্যের ভিতর নিজেকে দেখি। নিজের ভিতর নিজেকে দেখা হয় না।