
কিঞ্চিৎ পরচর্চা-৯
বড়ো ক্ষমতা, ছোটো ক্ষমতা
রূপশ্রী ঘোষ
বড়ো ক্ষমতাকে ছোটো ক্ষমতা ভয় পেতে ভুলে গেছে
একটা সময় ছিল যখন আমরা অভিভাবকদের ভয় পেতাম। এখনো সন্তানের কাছ আমরা গর্ব করে সেকথা বলি। আমরা কিন্তু বড়োদের মুখে মুখে তর্ক করতাম না। মা বা বাবা একটু চোখ দেখালেই আমরা ভয়ে শিঁটিয়ে যেতাম। আর তোমরা বড়োদের ভয় পাওয়া তো দূর অস্ত তোয়াক্কাও করো না। প্রতিটা কথার জবার দেওয়া চাই-ই চাই। সে ঠিক হোক বা ভুল, যুক্তি যেন ঠোঁটের আগায়। তবুও চুলচেরা বিচার করলে দেখা যায় এই বাচ্চাদের মধ্যেও অনেক সঠিক যুক্তি থাকে যা থেকে বড়োরা অনায়াসে শিক্ষা নিতেই পারে তাদের সবসময় ছোটো না ভেবে। সব বাচ্চা সঠিক যুক্তি দিয়ে কথা বলে তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ ছোটো হওয়ার সুবিধাটাও নিয়ে থাকে।
আমাদের দেশজুড়েও ঠিক এটাই চলছে। ছোটো ক্ষমতারা বড়ো ক্ষমতাকে ভয়ই পাচ্ছে না। তাদের তোয়াক্কাও করছে না। করলে আরজি করের মতো ঘটনা ঘটত না। ছোটো ক্ষমতা যদি ভুল করেও ফেলে, বড়ো ক্ষমতা তাকে শাস্তি দিতে এত দেরি করে যে, অন্যান্য ছোটো ক্ষমতাগুলো সেই সুযোগে আস্ফালন দেখিয়ে আরও কিছু উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে নিচ্ছে। মাননীয় শাসক দলের কাছে এটাই অনুরোধ, সাধারণ মানুষ আপনাদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। কাজে তৎপরতা আনা দরকার। একটা ঘটনা নিয়ে মানুষ ব্যস্ত থাকতে গিয়ে এমন বহু ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে, যা আরজি করের থেকে কম কিছু না। বহু কর্মক্ষেত্রে মানুষ আজ ক্ষমতার কাছে অসহায়। সাধারণ মানুষ ক্ষমতাকে ভয় পাচ্ছে, ছোটো ক্ষমতারা তাদের ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখছে। কিন্তু ছোটো ক্ষমতারা বড়ো ক্ষমতাদের থেকে উপযুক্ত শাস্তির অভাবে তাদের মোটেই পরোয়া করছে না। কথায় আছে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু, ছেলেরা ছেলেদের। এসব ভুল কথা। আসলে যেকোনো অন্যায় করে মানুষ পার পেয়ে যাচ্ছে তাই মানুষই মানুষের শত্রু। কোনো মানুষ যদি ক্ষমতা পছন্দ করেন তাহলে সেই ক্ষমতাকে ধরে রাখতে তাঁকে অনেক বুদ্ধিমান ও মানবিক হতে হবে।
-
কারণ যিনি বা যাঁরা ক্ষমতায় বসান, ক্ষমতা থেকে নামানোর সুতোও তো তাঁদের হাতেই।
তাই এটায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমার বাড়ির কাজের মেয়েটা বলেছিল ভোট দেব তাকেই, যিনি আমাদের কিছু দেবেন। জানতে চেয়েছিলাম কেন? কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীশ্রী, জুতো, সাইকেল, বিধবা ভাতা, গ্রামের রাস্তাঘাটও ঝকঝকে করেছে। সামান্য কিছু টাকাও সাধারণ মানূষের কাছে অনেক। দরিদ্র মানুষের কাছে কোনটা অমূল্য, তা হয়তো আমরা সবসময় বুঝতেও পারব না। দেখাদেখি, কেন্দ্রও নানা কিছু করছে। কিন্তু আদৌ কতটা করছে কেউ জানে না। বিজ্ঞাপন করছে। তাহলে এই খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের যা যা প্রয়োজন সেদিকে যেমন খেয়াল রাখা সরকারের দায়িত্ব তেমনি রাজ্যের সমস্ত শিক্ষিত, মেধাবী মানুষের প্রতিও সমান নজর দেওয়ার প্রয়োজন আছে। শিক্ষিতদের চাকরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সম্মানের সঙ্গে যাতে নিরাপদে কাজ করে দিনের শেষে বাড়ি ফিরতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখার প্রয়োজন আছে। প্রাইভেট সেক্টর সরকারের নজরের আওতায় পড়ে কিনা জানা নেই কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলোয় একবার খোঁজ নিয়ে দেখার অনুরোধ, সেইসব কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতার নিচে মানুষ কতটা ভালো আছে। নাকি প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতার কাছে অপদস্থ হচ্ছে? এ দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে।
-
কারণ ছোটো ক্ষমতা বড়ো ক্ষমতাকে ভয় পাবে, সমীহ করবে, তাদের অধীনে থাকা কর্মচারীদের নয়। আপনাদের শীর্ষে বসানো হয় সবাইকে সমানভাবে সুবিচার দেওয়ার জন্য। ছোটো ক্ষমতাদের মদত পুষ্ট করার জন্য নয়। ছোটো ক্ষমতারা সমাজকে কলুষিত করছে। আপনাদেরই দলের বদনাম করছে। একটার পর একটা দলকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয় তাদের আস্ফালনের জন্যই। সাধারণ মানুষের প্রতি মুখ ফেরানোর জন্যই। পূর্ববর্তী দলগুলোর পরিণতি দেখে, সেখান থেকে শিক্ষা নিন, দম্ভ, হুমকি বা আস্ফালন নয়। তাই বিচারের গতিতে তৎপরতা আসুক। নাহলে মানুষ ভয় ভুলে অত্যাচারই বহাল রাখছে। সরকার তৎপর হলে, সরকার আশ্বাস দিলে এমন অনেক সাধারণ সরকারি কর্মচারি রাস্তায় নেমে রাত দখলের মতো তাদের ক্ষোভের কথা শোনাবে। তাদের ছোটো ক্ষমতার কাছে ভয়ে গুটিয়ে থাকতে হবে না। বড়ো ক্ষমতাই হোক আর ছোটো ক্ষমতাই সব আস্ফালনই তো কদিনের মামলা। মানুষ চাইলেই কেড়ে নিতে পারে। অতএব মানুষের দিকেই নজর থাক। মানুষ নামের দুর্বৃত্ত কিংবা দুর্নীতিবাজদের উপর নয়।
বিচারে তৎপরতা আসুক। ভুল মানুষে সমাজ ভরে গেলে ভবিষ্যৎ সমাজও ভুল হয়ে যাবে। ক্ষমতায় এমন অনেক মানুষ বহাল থাকছেন যাঁরা মিনিমম কাজের ক-টুকুও জানেন না। জানার চেষ্টা করেন না। ক্ষমতার অঙ্গুলি হেলনে সবাইকে দিয়ে খাটিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যক্ষেত্র ভেঙে পড়লে আর থাকে কী? আরজিকর কান্ড ঘটতে তো কত না জানা জিনিস সামনে এল। অনেক ডাক্তার, সাংসদ, বিধায়করাও মুখ খুললেন যে, ডাক্তারিতেও পয়সা দিয়ে প্রশ্ন জানা যাচ্ছে, অনার্স পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রের ছবি তো আগেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এরাই যদি আগামীর হাল ধরে তাহলে মানুষ মারার আর মানুষ না গড়ার পদ্ধতিই তো চালু হচ্ছে বলা যায়।
-
সমাজের নানা ক্ষেত্রে আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের জটিলতাটুকু বাদ দিন, তাঁরা সাধারণ নিয়মটুকুও জানেন না, অথবা জেনেও মানেন না। সবথেকে মজার বিষয় ক্ষমতায় এমন অনেক মানুষ আছেন যিনি বা যাঁরা হয়তো ইচ্ছে করেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা এই সন্দীপ ঘোষের কথাই বলতে পারি, যাঁর নামের আগে ডাক্তার শব্দটা বসাতেও খারাপ লাগছে। অবশ্য শুধু তিনি নন, সন্দীপ ঘোষ তো একটা নাম। এমন সন্দীপ ঘোষ সর্বত্র। তাঁদের থেকে কিছু জানতে চেয়ে পরীক্ষা করুন তাহলেই বুঝে যাবেন। সব অন্যরা জানেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় না থাকা মানুষগুলো বেশি ভালো জানেন। এক একজন এক একটা বিষয়ে দক্ষ। কেবল যাঁদের সবেতে দক্ষ হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা তাঁরাই শুধু একটা বিষয়েও দক্ষ নন। এখানে মেধার প্রশ্ন একেবারেই নেই, শুধু ক্ষমতার দম্ভে ‘আমার না জানলেও চলবে’ এমন ভাব দিয়েই চলছে। আর যে প্রতিবাদ করবে, হয় তার নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হবে, সেই কর্মক্ষেত্রে তার টিকে থাকা মুশকিল করে দেওয়া হবে আর নয় তো তার নাম করে মিথ্যে মিথ্যে কথা রটিয়ে দিয়ে তার মানহানি করা হবে। এ কি কোনও ভদ্র লোকেদের সংস্কৃতি?
সত্যি সত্যি কাজ জানা মানুষগুলিরই ক্ষমতায় আসা উচিত বলেই মনে হয়। নাহলে সব কাজ অন্যরা করে দেবে এবং তিনি কেবল চেয়ারে থেকে আস্ফালন করে যাবেন, এ চলতে পারে না। সব থেকে বড়ো কথা এই মানুষগুলো বড্ড বেশি নির্লজ্জ। এটা ভেবে তাঁদের লজ্জাও লাগে না যে, আমি নিজে কাজ না জেনে অন্যদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছি অথচ কিছু নীতি ফলাচ্ছি এটা চলবে না ওটা চলবে না বলে। ক্ষমতার দম্ভে, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কেউ কেউ গুন্ডা পুষে খুন করিয়ে দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ তাঁর চেয়ে উপরের ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যে কথা বলে প্রতিবাদ যে করছে, তার সম্মানহানি করছেন। এটাই তো এখন কর্মসংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা একবারও ভাবেন না যে, আমরা নিজেরা যে সমস্ত দায়িত্ব পালন করি না তা অন্যদের উপর ফলাই কীভাবে। কেউ যদি মুখের উপর তা স্পষ্ট করে দেয়, সেখানে ছোটো মুখে বড়ো কথা হয়ে যায় যে, ‘তাহলে তুমি এই চেয়ারে বসো’ বলে দেন। এই চেয়ারে তুমি না বসে তাহলে আমি কেন?
-
আসলে তাকে বলা উচিত, তুমি সত্যিই এই চেয়ারে বসার যোগ্য তো নও। ক্যাপ্টেন হতে গেলে, তাঁকে কাজ জানতে হয়। কিন্তু তুমি কাজ না জেনে ছড়ি ঘোরাতে জানো, কারণ তুমি ওই ছোটো ক্ষমতার রাজনীতি করে নিজেকে বড়ো প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছ। আসলে অসভ্য এবং নির্লজ্জ না হলে মনে হয় এখন আর কেউ ক্ষমতার শীর্ষে বসতে চান না। আর যিনি ক্ষমতার শীর্ষে বসেন, তিনি এমন না হলেও, ধীরে ধীরে অমন হয়ে যান। না হলে ক্ষমতা নামক বিষয়ের সঙ্গে তো ব্যাপারটা মানানসই হয় না। এই চেয়ার-নীতি দিয়ে কয়েকদিন, কয়েক মাস, কয়েক বছর চলতে পারে। আদতে কি নিজের উন্নতি হয়? জীবনের শেষে গিয়ে হলেও একবার নিজের প্রতি নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত যে, সারাজীবন সত্যিই তাঁরা কী করলেন। একবার অন্তত আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। নিজে যে নীতি পালন করি না সে নীতি অন্যদের পালন করতে বলি কীভাবে। যদিও অন্যরা অদৃশ্য ভয়ে নীতিতেই চলেন, তবুও। আরও একটা মজার ব্যাপার হল যাঁরা অন্যায় অনিয়ম করছেন তাঁরা নিজেরাই বড়ো ক্ষমতার কাছে ধরা দিচ্ছেন। তবুও বড়ো ক্ষমতা সব জেনেও কেন কোনো পদক্ষেপ নেন না সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না
এ বড়ো অদ্ভুত ব্যাপার। বড়ো ক্ষমতার কাছে অনুরোধ আপনারা এগিয়ে আসুন তবেই সমাজ বদলাবে নচেৎ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে বড়ো ক্ষমতাকে আস্ফালন ভুলে সঠিক পথটা চালু করতে হবে। আর সঠিক পথ জানা থাকলে, যাঁরা পথটা জানেন তাঁদের পরামর্শ নিন। দেখবেন কিছুটা হলেও সমাজে উপকার আসবে। মানুষ সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারলে মানসিক শান্তি পাবে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হলে কাজের মান কখনো উন্নত হতে পারে না। এটাই বেশিরভাগের বক্তব্য, বেশিরভাগ মানুষ তাই চায়। জঞ্জাল চিনুন, জঞ্জাল ছাঁটুন। ভালো ফসল ফলাতে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতেই হয়। কিন্তু এখানেই জটিলতা।
-
কারণ বড়ো ক্ষমতা তো জানেন, এই সব ছোটো ছোটো কম মেধাবী লোকেদের ক্ষমতাবান করে রাখলেই তাঁর চেয়ার সুরক্ষিত।
কারণ, অপেক্ষাকৃত মেধাবী মানুষেরা যদি পাশে আসেন, তাহলে তো তাঁর ক্ষমতাও বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে, তাই না। আসলে তো এটিই রাজনীতি। আমি নিজে ছোটো, তাই ছোটোদেরই দিয়ে ক্ষমতার বৃত্ত পূর্ণ করে রাখছি। যাতে কেউ আমাকে চ্যালেঞ্জ না করে, যাতে সকলে আমাকে জো হুজুর বলে ডাকে। কিন্তু কেউ থাকে যদি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাচ্চা ছেলেটির মতো? যদি সে বলে ওঠে- রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
তাহলে তো দিল্লি থেকে হিল্লি সর্বত্র আসন টলবে।