
সুবর্ণকান্তি উত্থাসনীর একটি দীর্ঘ কবিতা
তুমি ঘোরো বায়ুকল ঘোরে
আমাকে আবর্তে রেখেছ। রেখেছ কি তুমুল অন্তঃক্ষরায় যখন
বিপন্ন কচ্ছপ আড়ালের ব্যবধানে অবগাহন করে। বৃক্ষের
লাজুক প্রতিশ্রুতির গল্প একদিন এইদেশে মুখরিত ছিল আজ
শুধুই আবিল দীর্ঘশ্বাসে। প্রতিবর্তমগ্ন থেকে অনুমানে তীক্ষ্ণ ও
ধারালো স্রোতের পাশে আমরা আমাদের লৌহযুগের শরীর থেকে
অলৌকিক পাপগুলি লুকিয়ে ফেলতে দীর্ঘ সন্ধানের পর কিছু শিলা
পেয়েছি কুড়িয়ে। ওদের বুকপকেটে কোনো অজানা কীটের খোদাই
করা চক্র দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলাম বন্দরের চুরাশি প্রেত
বসে আছে বাতিল নগরতলির ভাঙাচোরা মিনারচূড়ায় অথচ
এমন কিছু দুঃখ আছে খালিগায়ে জমতে জমতে ঢেকে দেয় স্পন্দন।
ধুলোমলিন বিকল জাহাজের বক্ষ ছুঁয়ে ভাবি জ্যান্ত নক্ষত্রের
পাঁজর খসে কীভাবে মৃৎজন্ম পেলাম। এটুকুই তো তোমার ভয়।
কৃপণ ঠান্ডা হাত ছুঁয়ে দিলে তুমি যেন বোবা পাথর হয়ে যাও।
কৃষ্ণাতিথির ধীরলয়ে জেগে ওঠা চাঁদের হরিদ্রাভ শিখার স্পর্শে
জানলাম দেহই শিব স্বতন্ত্র ও অবিনশ্বর। আত্মার আয়না ভেঙে
দেখি বিস্ময়ের ভাসমান শিকড়গুলি বিভ্রান্তির ভিতর কেমন
প্রশস্ত হতে হতে ষড়যন্ত্রে জারিত হয়ে চাতাল কে সম্মোহন
করে। বহুদিন হাইড্রোলিক মানুষের সঙ্গে বেঁচে থেকে পতনে ও
পীড়নে এইসব বৃক্ষেরা পরশ্রীকাতর তাই পল্লবিত ডালপালা
বুননের মনলোভা উর্ণাজালে পরস্পরকে বেড় দিয়ে ঢেকে দেয়
বায়ুপথ তবুও প্রবাহের নিজস্ব তৃষ্ণায় বায়ু উৎসের খোঁজে
স্তূপাকারে জমে ওঠে ডানার পালকে আর ঝরে পড়ে নবজন্মে
সীমান্ত সারসের পাখসাট থেকে বহুদূর সমুদ্রে অন্তরীণ।
কিংবা পটলচেরা চোখের রুপালি রুপালি মাছ ঝরে পড়ে তরল
বাঁশপাতা ও গুগলির ক্ষণিক আড়ালে দুপুরের গূঢ় নির্জনতায়।
দৃশ্যের লঘুতা থেকে এইভাবে ঝরে পড়ে নাকি তামাদি বিস্মরণ।
অবচেতনের ভিতর পিতার রমণেচ্ছা প্রবাহের জরাকল্পে
পেয়েছে পুরুষ। পরস্ত্রী সম্ভোগের দায়ে তপোক্লিষ্ট সুখ আচ্ছন্ন
ব্যাধিগ্রাসে অথচ মানুষের মতো নয় আচমকা কাছাকাছি এসে
রোজকার সঙ্গমে শীৎকারের অসীম তৃপ্তি ছড়িয়ে দেওয়া তারাদের
মৈথুনরশ্মি ফেটে গিয়ে তপ্ত শুক্ররস আছড়ে পড়ছে পৃথিবীর কোলে।
ডানার পালক জ্বলে গেলে পাখিরাও ফিরে গেছে আঁশজন্মের খোঁজে
সমুদ্রের তলদেশে আর বাতাস খুলে ফেলে দিচ্ছে তার পেলব ও
উত্তেজক তুষারযুগের গাউন। ফলত কেবলই অস্থির লু বয়ে
আসছে স্থলভাগে। উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করে আমাদের মেদও লঘু
হয়ে এসেছে ঢের আত্মক্ষয়ে। অনুতাপে দগ্ধ হতে হতে আমরাও
ফিরে যাবো নাকি নক্ষত্রজন্মের একঘেয়ে রতিখেলায় বিভোর।
ঝরে পড়া পাতা ক্ষেতের শুকনো নাড়াগুলি থেকে যেকোনো মুহূর্তেই
আগুন ছড়িয়ে পড়ার সতর্কবার্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে আন্তর্জালের
ফিসফাসে। এঁটো থালাবাসন মাড়িয়ে সদর দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলো
তৎপর সেনারা তারপর গৃহস্থালীর যা কিছু দাহ্যসামগ্রী টেনে
হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেল কবরখানার দিকে। তাদের ক্ষুরে লেগে থাকা
যোনির আঁশটে গন্ধে গলে যাচ্ছে পিচের সড়ক। এই দাবদাহের
মধ্যে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে গণতান্ত্রিক সভ্যতার মেয়র
ঘোষণা করলেন অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার আগে পর্যন্ত সমস্ত
জনসাধারণ কে পরিত্যক্ত নগরতলি তে সরিয়ে আনার। ফলে
এই আসবাবহীন মানুষেরা এখন আরও মুমূর্ষু আরও একা। রুমে
ফিরতে গিয়ে ভোররাতে বুকে এসে ধাক্কা খায় পাগলী মেয়েটা। কাল তাকে
উলঙ্গ দেখে জড়িয়ে ধরেছিল কোন তরুণ কবি অবসাদের
নিরাময়ে। দেখি শরীরের ফাটলে তার যৌনতার অবাধ কান্না
জমাট বেঁধেছে। এইসব উন্মাদনা পাগলামির মতো কোনো বিশুদ্ধ
দশা নয় আয়ুক্ষয় নয় প্রতিচ্ছবির ভিড়ে উদ্ভাসিত গোধূলিমুখ।
এইসব অবিমিশ্র নরক ডিঙিয়ে দেখছি ক্রমশ বায়ুকল ঘুরে
যাচ্ছে ঋতুবদলের দিকে আর তোমার গলায় হাওয়ামোরগের
দাঁত ফুটে আছে খুব অস্পষ্ট খুব ক্ষীণ। পশমের উলগুলো আজ
তারিয়ে তারিয়ে দেখছে তোমার আঙুলগুলি নিশপিশ করছে কতখানি।
ঘন হয়ে আসা মেঘেদের ছায়া এসে পড়ছে ফ্যাকাশে দেওয়ালে। তুমি
গ্রীষ্মকালের ঘুম মাড়িয়ে চলে যেতে পারো কাকভেজা লেবুপাতার
গন্ধে অনায়াসে। গেছিলে কি চলে কোনোদিন। বিধুর মুখের থেকে
স্বীকারোক্তির ভার নেমে গেলে দেখেছি তাকে সূর্যকরোজ্জল লাগে
তবু এই ভালোলাগা নত ও শান্ত নয় যেন খুব দুর্বিনীত হয়ে
ওঠা যৌবন বিছানায় আছাড়িপাছাড়ি খাচ্ছে নিষ্ঠুর অপচয়ে।
বরং চলে যাওয়াই ভালো। ভালো গুমরে গুমরে ওঠা নিরালার চেয়ে
গৃহকোণের একাকীত্বে কিছু প্রকৃত বিষাদ বয়ে বেড়ানো। দেখো
আমাদের বাতিল টিনের চালায় পল্লীমায়ের নাভি বেয়ে ঝরে
পড়ছে বৃষ্টির করুণ ও মিহি কান্নার মুগ্ধকর হাউই। জরাজীর্ণ
চাতালের পেটে ভাস্কর্যে লীন হয়ে গেছে উইপোকা অথচ এখানে
একদিন পায়েসের বাটি হাতে পড়েছিল ধরা সনাতনী পুরুষ
এক নীড় ও শস্যের মাঝে আদিগন্তে পেতে রাখা ঝাঁকিজালে মায়াবী
ধীবরের। এইসব দিনে মনে পড়ে তোমার বুকে বড়ো যত্নে তুলে
রাখা আমার ব্যক্তিগত সুখচিঠির অক্ষরজন্ম। নিত্যব্যবহারের
ফতুয়া ছিঁড়ে গেলে যেভাবে তাপ্পি মেরে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখে কবি
ও কাঙাল। বৃষ্টিছাঁটের মধ্যে প্রকাশ্য রাস্তায় কুকুর কুকুরীর
আনকাট বন্যমিলন থেকে গড়িয়ে পড়ছে স্বমৈথুনের অন্ধকার।
ত্রিসন্ধ্যাবন্দনার পরে চুপিচুপি এসেছি উঠে মায়ের নিকটে।
প্রবল কামে ভেসে যেতে যেতে পাথরে চামড়া ঘষে কী সুখ পেয়েছে
তরুণ কবিটি তাই ভাবি সারারাত। করাল মুখে রক্তের রেখা
ফুটে না উঠলে মাকে পাগলী মেয়েটার মতো উচ্ছ্বল মনে হয় ঢের।
মনে হয় রমণের ঘ্রাণ না জোটা তরুণ কবির সাধনসঙ্গিনী।
মাংসগলনের পর এমন পিনোন্নত স্তন কারই বা আছে আর
বেঁচে। তোমার ফেলে যাওয়া সংসার কুরে খাচ্ছে ঘুণে। দাঁড়হারা নৌকার
টালমাটালে বসে থেকে বুঝেছি সাতটি নেকড়ের উদ্যত থাবার মুখে
খেলা করা বালিকার মাথার ভিতরেই নড়েচড়ে উইপোকা আর
জুয়ার আসরে দলবেঁধে কুরে খায় অমায়িক যৌবন পুরুষের।
বাইরে অঝোর বৃষ্টি আজই কি নামলো হঠাৎ। সুমিষ্ট যন্ত্রণার হুল
পতঙ্গের বিঁধছে শরীরে। উত্তাপ কমে এলে অনুপস্থিত বৃক্ষের
জন্য হাহাকার বাড়ছে ক্রমাগত। তোমার স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়ার
এতদিন পরেও নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসে আমি আমার দু স্তন
বহু মর্দনেও তৃপ্ত হওয়ার কৌশল শিখে উঠতে পারিনি। এখনও
কি সংযত রাখবে নিজেকে নীরব অভিমানে। এই গ্লানিবোধ নিয়ে
কোথায় দাঁড়াবো। দেখো ফুটপাত দখল করে চুরাশিটি পথশিশু
অভুক্ত হাঁ মুখে। স্তন গজানোর মন্ত্র ভুলে গেছি কিছুকাল হলো।