
সৌমাল্য মুখোপাধ্যায়-এর গল্প
গর্তপুরাণ
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম মাটি পিছল খাচ্ছে আমার পায়ের তলায়, কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। নিজেকে যে আমি প্রশ্রয় দিয়েছি তা-ও নয়। এ অসুখ তো আর আজকে হঠাৎ শুরু নয়। গত সপ্তাহে ভোরের দিকে ঘুম-ভেঙে আচমকা যখন ধড়মড়িয়ে উঠলাম, কালো ভামের মতো স্বপ্নটা তখনো মাথার ভিতর এ-গলি ও-গলি ঘুরছে, মাথার দিকটা ভামটার আর দেখা যাচ্ছে না, টুকরো-টাকরা দেখতে পাচ্ছি খালি, স্বপ্নের কুৎসিত নীল গলিগুলোর ভিতর ওর পায়ের শব্দ, অন্তর্হিত হওয়ার আগে আবছা তরল অন্ধকারে পাছা ও পিছনের দু’টো পায়ের ঈষৎ ঝলক। ফলতঃ স্বপ্নের গোড়াটা মনে নেই, শেষটা ছিল মোটা-মোটা দুটো হাত দিয়ে দাদা আমার গলাটা চেপে ধরেছে, সে ধরতেই পারে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু যে-কারণে ভয় হাড়টাড় ঠান্ডা হয়ে গেছিল, তা হল গলা টিপে ধরার সময়ে দাদার চোখদুটো ছিল স্বাভাবিক অথচ মুখে ছিল একটা আশ্চর্য হাসি, থুতনি গলা সব ভিজে যাচ্ছিল হাসিটায়। মানুষকে খুন করা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই, মানুষ তো মানুষের গলা টিপে ধরবেই, কিন্তু খুন করার সময়ে ওরকম হাসবে কেন! বিশেষত যে-হাসির আগামাথা কিছুই বোঝা যায় না। এই ধরনের ডিস্টার্বিং স্বপ্নগুলোর বীজ সম্ভবত মানুষের জানা, খুব একটা খুঁজতেও হয় না, হাতের কাছেই থাকে, বরং যথেষ্ট শ্রমে ও যত্নে বীজগুলো সে নিজেই লুকিয়ে রেখে আসে এদিক-ওদিক, পাথরটাথর চাপা দিয়ে আসে, যাতে সচরাচর চোখে না পড়ে। এই স্বপ্নটার বীজও আমি জানতাম। ক্লাস সেভেনে পড়তে- দাদা তখন ইলেভেনে- কেমন বাড়িতে একটা মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে দাদাকে কোণঠাসা করেছিলাম, বাড়ির প্রায় সমস্ত লোক ওর সংগে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল, এবং কেমন আনন্দে রক্ত টানটান হয়েছিল আমার, এ তো আমি এখনো ভুলিনি, কেবল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। শেষপর্যন্ত দাদা আমার ডান হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে কেঁদে ফেলে, আমি বুঝতে পারছিলাম হাতের চামড়ার তলায়, ওর, দপদপ করছে রক্ত, উষ্ণ প্রবহমান রক্ত। আসলে আমি দাদা-কে ঘেন্না করতাম। কেবল দাদা-কে নয়, মা-কেও। মা যে সমরেশ আঙ্কলের সঙ্গে শুতো, আমি ও দাদা দুজনেই জানতে পেরেছিলাম। আমরা যে জানি তা মা-ও খানিকটা আন্দাজ করেছিল। মায়ের ভাবটা ছিল এমন, বাবার মতো অস্থিরপ্রকৃতির একটা লোকের সঙ্গে থাকতে-থাকতে মা ভীষণই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে, ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। এবং ঠিক এই কারণেই আমি মা-কে ঘেন্না করতাম। এখন বুঝতে পারি মা যদি সমরেশ আঙ্কলের মিস্ট্রেস্ অথবা প্রেমিকা হত, এমনকি নেহাত ফুর্তির জন্যেও যদি শুতো, মেনে নিতে আমার অসুবিধা হত না। তখনই আমি বুঝেছিলাম ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতা এসব অছিলা ছাড়া কিছুই নয়, এসব মা রোজ নিজেকে বুঝিয়ে চলেছে, ঠকাচ্ছে নিজেকে, দস্তয়েভস্কি তো সেই কোনকালে আমাদের দেখিয়ে গেছেন নিজেকে ঠকানোর চেয়ে বড়ো পাপ কিছু নেই আর। আসলে সমরেশ আঙ্কলের ব্যক্তিত্বে, কথা-বলায়, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিয়ারিং’, মায়ের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে, বাবাকে পানসে লাগছিল মায়ের সমরেশ আঙ্কলের পাশে, আঙ্কলের গুটিয়ে রাখা বলিষ্ঠ ও মরিয়া ডানাদুটো মা দেখতে পেয়েছিল, যে ডানাদুটো ছাড়াই বাবা জন্মেছিল পৃথিবীতে। নিজেকে, ঠারে-ঠোরে আমাদের-ও, বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখতো না মা, যে এই সাময়িক সামাজিক বিচ্যুতির আদত কারণ নিঃসঙ্গতাই, আর আমি থুতু ছিটিয়ে দিতাম মনে-মনে মায়ের মুখে। দাদা সবটাই জানতো, বুঝতোও, কিন্তু কখনোই, এমনকি আচরণে, অথবা হাবভাবেও, অপত্তি তোলেনি সামান্য। কারণ যে নিরাপদ সামাজিক গর্তটার মধ্যে দাদা থাকে, সম্ভাবনা ও সাফল্য দিয়ে ঘেরা, আপত্তি তুললে সেই গর্তের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারতো, কেবল শান্তি কেন, নির্লিপ্তিও। অর্থাৎ এক ধরনের সমঝোতা করে নিয়েছিল দাদা, নিরাপদ গর্তের বিনিময়ে স্তব্ধতা। ঠিক যেমন মা-ও করেছিল। উত্তেজনার চটকে টানটান একটা জীবনের বিনিময়ে- যে জীবন ঢেউহীন নিস্তরঙ্গ নয়, বরং উত্থান ও পতনে অস্থির- নিজেকে বুঝিয়ে ফেলা যে এর কারণ নিঃসঙ্গতাই, বিবাহিত জীবনের ক্লান্তিই, অথচ মা নিজেই সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে জানতো যে নিজেকে মিথ্যে বলছে সে, নিজেকে যুক্তিও দিত হয়তো যে মিথ্যে না-বলা ছাড়া উপায় নেই, অন্যথায় চটকদার জীবনটা হাতছাড়া হয়ে যাবে, আবার ঘেঁৎরে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে একঘেয়েমির পাঁকে! ফলতঃ মা-ও একটা নিরাপদ গর্ত নিজের জন্যে তৈরি করে ফেলেছিল। তখন থেকেই আমার অসুখটা শুরু হয়, কারুর মধ্যে নিজের সংগে এ ধরনের মাঝারি সমঝোতা দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে, শরীর রি-রি করে, রাগে রগের ভিতর রক্ত আছাড় খায়, বুকের নিচে একটা অস্বস্তি। এক কথায় মানুষের নিরাপদ গর্তবাস আমি সহ্য করতে পারি না, পরিচিত মানুষের গর্তে অকারণে ঢিল মারি, নুড়ি ছুঁড়ি, যাতে আচমকা গর্ত ফাটিয়ে সাপটা অন্তত একবার মাথা বার করে। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় সাপটা গর্তের ভিতরে থেঁতলে গেলেও মাটি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে নারাজ, শেষপর্যন্ত বার করে আনতে হয় তার রক্তাক্ত দেহটাকে।
এই কারণেই আমি আজ অবধি কারুর সংগে শুতে পারিনি। শেষ যে মেয়েটি আমার সংগে শুতে রাজি হয়েছিল সে ভেবেছে আমি যৌনভাবে অসাড়। প্রাথমিক আদরটুকু শেষ হতেই দেখি সে, তার হাত-মুখ-উরু-উপস্থ-পায়ু, সমস্ত অস্তিত্ব, তার শরীরের, এবং মেধার (যৌনমেধা?), তারিফ শুনতে চাইছে আমার কাছে। সে কতটা আকর্ষণীয়, তার দেহ ও ব্যবহার, শরীর ও শব্দ, কেমন উন্মাদ করে দিতে পারে সংযত বুদ্ধিমান পুরুষকেও, কামকলায় সে কতটা গভীর, আদরের সময়েও তার রুচি ও ব্যক্তিত্ব কেমন ঝলকে ওঠে, এইসব তারিফ, শংসা, সে নিঃশব্দে অথচ মরিয়া হয়ে প্রার্থনা করে চলেছে আমার কাছে, তার চোখ মুখ উদগ্র আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার অনুমোদনের জন্য। ঠিক যেন প্রাচীন ভারতীয় জনপদের বহুশ্রুত নগরবধূ, আদরের শেষে নিঃশব্দে তারিফ প্রার্থনা করছে ধনবান বণিকের কাছে। সুতরাং মেয়েটি নিজেকে একটি নগরবধূ হিসেবেই দেখতে পছন্দ করছে ওই সময়ে। নগরবধূ, গণিকা, বেশ্যা! অথচ সে অনবরত শব্দে ও আচরণে বলে চলেছে সে স্বাধীন সামাজিক স্বশাসিত স্বতন্ত্র সংযত, কিন্তু আদতে তো সে একটি বেশ্যা, অন্য কেউ নয়, সে নিজেই এই বিশ্বাসে স্বচ্ছন্দ, এই রতিদেবী পরম উৎসাহে রসগ্রাহীর কাছে শুনতে চায় প্রশংসা, রতি দানের তারিফ। এইটিই তার গর্ত। তার বিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে এই তফাতের কথা সে নিজেও জানে, কিন্তু স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হয়ে-থাকার সামাজিক সম্মানটুকু সে ছাড়তে নারাজ, এদিকে বেশ্যার মতো তারিফ চাওয়াটিও তার স্বভাব, এই তারিফ তাকে নিজের চোখেই ক্রমে আরও আকর্ষণীয়, আরও কমনীয় করে তুলবে, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে, এবং এই বিশ্বাসের জোরেই তো সে নিজেকে ক্ষমতাশালী ভেবে থাকে। ফলতঃ সে তৈরি করেছে স্বতন্ত্রতার এই সামাজিক গর্তটি, যার ভিতরে বেশ্যাটি ঘাপটি মেরে গা-ঢাকা দিয়ে নিরাপদে থাকতে পারবে। সমস্ত গর্তই সামাজিক। সমাজ নামের ভুখা হাঙরটির পেটে কোনভাবে একটা জায়গা করে নিতেই তো মানুষের এত ধরনের গর্তের প্রয়োজন, কোনভাবে হাঙরটির কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে। যথারীতি এই মেয়েটির গর্তেও আমি ঢিল ছুঁড়তে আরম্ভ করি, পাথর ছুঁড়ি একের পর এক, চেষ্টা করি কিছু-একটা-করে গর্তে ফাটল ধরাতে, মেয়েটিকে স্বীকার করাতে তার স্বতন্ত্রতা একটি আলগা সুবিধাকামী মুখোশ, আদতে মনেপ্রাণে সে একটি শংসাপ্রার্থী বেশ্যাই। শেষপর্যন্ত যা হওয়ার তাই হল, এই সাপটিও গর্তে ফাটল ধরার ভয়ে তার পেলব মসৃণ দেহ নিয়ে পালিয়ে গেল, যাওয়ার সময়ে বলে গেল আমি যৌনক্ষমতাহীন, অসাড়। এভাবেই যখনই যার সঙ্গে শুতে গেছি আমি, দেখেছি তারই রয়েছে একটি নিরাপদ গর্ত, স্বচ্ছন্দে সেই গর্তের ভিতর সে বেঁচে রয়েছে, নিজের সঙ্গে কোনও একটি মাঝারি মাপের সমঝোতা, সস্তায় কিছু পাওয়ার জন্যে, লাভের জন্যে, স্বার্থ ও মুনাফার জন্যেই তো এই গর্তবাস। গৃধ্নু লোভাতুর এইসব সাপের সংগে আমি শুতে রাজি নই। তার দ্বিখণ্ডিত জিভ নিয়ে যদি সে গর্ত ফাটিয়ে ফণা তোলে, আমি তার ফণার মুখে আমার প্রণাম রাখবো, আমি হয় স্বতন্ত্রের সঙ্গে শোবো, নাহলে বেশ্যার সঙ্গে। ক্রমে দেখলাম সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হল, সামান্য অসংগতি দেখলেই আমার নুড়ি ছোঁড়ার অভ্যাসে তারা স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হয়ে পড়েছিল, মুখেচোখে রক্ত নিয়ে কয়েকজন যদিও টিকে থাকার চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত কেউই পারেনি। চোখের সামনে, আমার, এই শহরটা জেগে থাকতো, এবং আমি, একজন সম্পূর্ণ নির্বান্ধব নিঃসঙ্গ হিংস্র মানুষ, মুঠোভর্তি পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম শহরটাকে। কেমন মানুষ রোজ গর্ত থেকে বেরিয়ে আহার্য সংগ্রহ করেই পুনরায় সড়াৎ করে ঢুকে পড়ছে গর্তে। এইসব সুস্থ নিরাপদ মানুষই অপরাধ করছে, আবার এরাই বিচার করছে অপরাধের। অপরাধী ও বিচারক, অধ্যাপক ও ছাত্র, খুনি ও সন্ত, বাবু ও বেশ্যা, ডাক্তার ও রোগী, শিকার ও শিকারী, কবি ও পাঠক, প্রত্যেকে গর্তজীবী। দু-একবার মাথা বার করলেও, নিরাপদ ও সামাজিক ডেরাটি ফাটিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে কেউ রাজি নয়। মানুষ যত সুচারুভাবে লোকায় নিজেকে, ততই হিংস্র হয়ে উঠি আমি। আস্তিনের কাছে লুকিয়ে রাখা ছুরি দিয়ে বারবার আক্রমণ করি বাড়ির লোকেদের, বন্ধুবান্ধবদের, সহকর্মী ও প্রতিবেশীদের। আমি কি এদের ঈর্ষা করি, এই গর্তজীবী মানুষদের? এদের নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবনটা কি আমিও চাই? কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকতে তো কেউ আমায় বাধা দেয়নি, বরং আমার চারপাশের মানুষজন খুবই সহজে সানন্দে মেনে নেবে আমার গর্তবাস। আমি নিজেই তো বাতিল হয়ে গেছি, ভিতরে-ভিতরে হিংসা লালন করেছি, ছুরিটি প্রত্যহ ধুয়েছি, শান দিয়েছি, গর্তরীতি শিখতে চাইনি, প্রত্যাখ্যান করেছি এই জীবনধারাকে, এর জন্যে তো দায়ী অন্য কেউ নয়, আমি নিজেই। গর্তজীবনের সুখ ও সফলতার ঢেউগুলির প্রতি কি আমার লোভ নেই? নিশ্চই আছে। কিন্তু গর্ত দেখলেই হাতের তালুর শিরাগুলো উসখুস করে ওঠে আমার, ঢিল তুলে নিতে চায়। এভাবে একা, সম্পূর্ণ একা বেঁচে থাকতে-থাকতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, গর্তরীতি আমি শিখবো একটু-একটু ক’রে। গর্তজীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেবো। প্রথমেই নিজে একটা গর্তে ঢুকতে না পারলেও, ঢিল-মারা থেকে কিছু-একটা-ভাবে নিজেকে আটকাবোই। ক্রমে হয়তো নিজেও রীতিটিতিগুলো শিখে নিলে তৈরি করে ফেলতে পারবো নিজের একটা গর্ত। মানুষের সঙ্গে নিয়ত এই মুখে-রক্ত-তোলা লড়াই আর আমি করতে পারছি না। একটা ক্লাবঘর কবিতাসভা অথবা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে আমিও তাস খেলতে চাই, সাহিত্যালোচনা করতে চাই, কিংবা আড্ডা মারতে চাই নিছক।
যে প্রকাশনা-সংস্থায় আমি চাকরি করি, সেখানে আমি ছাড়াও তিনজন সাব-এডিটর রয়েছেন। তাদেরই একজন দোয়েল বিশ্বাস। দোয়েল যে কেবল একজন সাব-এডিটর তা নয়, এই পাবলিশিং হাউসের অন্যতম মুখ-ও বটে। তার একমাত্র কারণ, দোয়েলের বদ্ধমূল বিশ্বাস, এবং এই বিশ্বাস মালিক এবং সম্পাদকের কাছে সমর্থন-ও যে পায়নি তা নয়, একটি প্রকাশনা সংস্থার কখনোই, কোনোভাবেই, চেনা ছক বা ফর্মুলার- যা বেশ কয়েকবার সাফল্য এনে দিয়েছে- বাইরে যেতে-চাওয়া নিছক ছেলেমানুষি। প্রকারান্তরে বলা যায় ব্যবসা নিয়ে সামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা দোয়েলের কাছে ঘোরতর অপরাধ, এবং ব্যবসা ছাড়া অন্য কোন কথা, দ্বিতীয় কোনো চিন্তা, শখ অথবা বক্তৃতার খাতিরে ভাবা যেতেই পারে, কিন্তু শখে অথবা বক্তৃতাতেই তাকে সীমায়িত রাখা উচিত। দোয়েলের কিন্তু কোনো গর্ত নেই, ব্যবসা ছাড়া যদি কেউ সাহিত্যটাহিত্য নিয়ে সামান্য চিন্তাও ক’রে ফেলে, ও মুখের ওপর হাসে। স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় আদর্শের এইসব ছটফটানি আদতে কতটা নিরর্থক, যা থেকে ফায়দা উঠে আসবে না সেই চিন্তা যে তোমায় কেবল হাস্যাস্পদ করবে, নিরুচ্চারে এ জিনিস দোয়েল অনেকবারই ঘোষণা করেছে। কেউ দোয়েলের এই নির্দ্বিধ অজ্ঞ দম্ভকে প্রশ্ন করার সাহস পায় না, কারণ সে সফল। দোয়েলের গর্ত না-থাকলেও, দোয়েলকে ঘিরে সংস্থায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য গর্ত। ঝাড়ুদার থেকে সাব-এডিটর, যাদের মুখে সর্বক্ষণ আদর্শের বুলি, সর্বদাই যারা বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় কাহিল, তারা প্রত্যেকে ভিতরে-ভিতরে দোয়েল হতে চায়। বস্তুতঃ দোয়েল ছাড়া তারা কিছুই হতে চায় না, এমন একটা ভাবনাও ভাবতে চায় না যা দোয়েলের কাছে অকিঞ্চিৎকর, অথচ মুখে সবসময়ই তাদের চিন্তার ছাপ, দিনরাত্রি ভাবছে কেন বাঙালি অমিয়ভূষণ পড়ছে না! আমি ঠিক করলাম, দোয়েলকে ঘিরে যেভাবে বেঁচে রয়েছে এই সংস্থাটি, আমিও নিজেকে আস্তে-আস্তে এই বেঁচে-থাকার অংশ করে নেবো, করে নিতেই হবে আমাকে। অমিয়ভূষণ ও সতীনাথ ভাদুড়ী নিয়ে দু-একটা কথা বলবো নিশ্চই, কিন্তু ভিতরে ভাববো না কিছুতেই, ততটুকুই বলবো যা আমার আত্মপ্রচারে কাজে লাগবে, ভিতরে ভাববো কেবলই নিজের উন্নতির কথা, গুছিয়ে-নেওয়ার কথা, সুবিধার কথা। এভাবেই গর্ত আমায় তৈরি করে নিতে হবে। আস্তে-আস্তে চারপাশের মানুষের কাছে নিঃশব্দে ও সন্তর্পণে তালিম নিতে শুরু করলাম, কেউ বুঝতেই পারলো না আমি সর্বক্ষণ তাদের লক্ষ্য করছি, নকল করছি তাদের, এ রীতিমতো প্রশিক্ষণ, যথেষ্ট শ্রম লাগে। যখনই গভীর কোনো চিন্তা মাথায় ঘাই মারে, যার সঙ্গে আত্মপ্রচার ও আত্মোন্নতির সরাসরি সংযোগ নেই, সঙ্গে-সঙ্গে নিজের গালে চড় বসাই, চুল ধরে ঝাঁকুনি দিই। পায়ে-পায়ে সাবধান করে দিই নিজেকে, মুঠোয় ধরা নুড়ি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলি, অন্যের গর্ত দেখলে চোখ ফিরিয়ে নিই। কী ভীষণ সংযম প্রয়োজন! যে যত বেশি সুবিধাবাদী, তার সঙ্গে তত ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করি, কৌশলে জেনে নিই গর্তের নির্মাণকৌশল। যার গর্ত নিরাপদ, নির্লিপ্ত ও নির্বিঘ্ন, তাকে ভিতর থেকে সম্মান করার চেষ্টা করি, মনে-মনে তারিফ করি তার। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেও এই একটা ভাবনাই কাজ করতো আমার মাথায়, কীভাবে সেইসব কথা বলায় নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলা যায়, কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায় সেসব কথা, যেসব কথার বিন্দুমাত্রও আমি নিজে বিশ্বাস করি না। রিপুগুলিকে কীভাবে মুড়ে ফেলা যায় চকচকে মিথ্যের রাঙতায়। কীভাবে মৃত শব্দের গ্যাঁজলা মুখে উঠে আসলেই গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে তা ঠোঁটে উচ্চারণ করতে হয়। এতে ফল হল দু’ রকম, নিরাপদ নিশ্চিন্ত সামাজিক জীবনটার প্রতি আমার লোভ বাড়তে থাকলো, ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এটাই সভ্য বেঁচে থাকা, একটা ভদ্র জীবন, পায়ের কাছে লুটিয়ে-থাকা নাগরিক জীবনের সুবিধাগুলো ভোগ না করাটাই অসভ্যতা, এমনকি এতদিন হিংস্র বর্বরের জীবন কাটিয়েছি ভাবতেই কেমন অস্বস্তি হল। কিন্তু এ তো গেল প্রথম ফলের কথা, সমস্যায় ফেললো দ্বিতীয় ফলটা। থেকে-থেকেই আচমকা, হঠাৎ, মাথার ভিতর একটা চুরমার-করা খুনে আনন্দ হতে থাকলো, আ ব্লাডি টেরিবল্ জয়। কী হচ্ছে বুঝতে পারতাম না, আচমকা শরীর, হাত-পা, ভারী হয়ে আসতো, গলার কাছে শ্বাসের গতি রোধ করে উঠে আসতো আধখানা ফলের মতো পাকানো আনন্দের দলা। হুড়মুড়িয়ে এই খুনে আনন্দের ঝাঁক যখন তখন নেমে আসতে পারে, রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে, প্রস্রাবখানায়, স্টেশনে। এবং এই গতি স্বভাবতই অপ্রতিরোধ্য, ঠেকানো অসম্ভব, সহ্য ক’রে নেওয়া ছাড়া, এর প্রচণ্ডতার কাছে মাথা-নিচু-করে বসা ছাড়া, উপায় কিছু নেই। ঠিক পিঠের মাঝ বরাবর আনন্দের ছুরিটা বসে, সারা শরীর ছটফট ছটফট করতে থাকে হুল্লোড়ে। মাথার ভিতর যেন জমতে শুরু করে রক্তস্রোত। তেমনই হল একদিন। দুপুরের দিকে ঘোর আলোচনা বসেছিল অফিসে। প্রখ্যাত এক লেখকের লেখা অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা নেহাতই চটুল ভাষায়, তরল কাঠামোয়, ছেপে থাকে আমাদের প্রকাশনা, এবং এই সবটাই করা হয় ইন্টালেকচ্যুয়াল্ ফ্রিডম তথা লেখক-স্বাধীনতার নামে, যুক্তিও দেওয়া হয়, বাঙালির ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে এ এক ঘোষণা। কিন্তু হঠাৎ সেদিন আদিনাথ, আমাদের চার জন সাব-এডিটরের একজন, আপত্তি তুললো, ওর বক্তব্য এতদিন এই চটুল ট্রাশ্ ছেপে-ছেপে যখন আমাদের বেশ খানিক পরিচিতি ও সংগতি হয়েছে, তখন তো আমরা এবার প্রোগ্রাম-প্ল্যান্ কিছুদিনের জন্যে বদলে কয়েকটা ভালো লেখা ছেপে দেখতে পারি, ফেল্ করলে নাহয় আবার এই ফর্মুলায় ফিরে আসা যাবে, ততদিন এই সস্তা পর্নোগ্রাফি ছাপা বন্ধ রাখা যেতে পারে। যথারীতি দোয়েল মাথা নিচু করে ফেলেছিল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায়, ঠোঁটেও লেগেছিল বিদ্রুপমাখা সামান্য হাসির টুকরো, যেন আদিনাথের এই বিরোধিতা বাড়তি সুপার্ফ্ল্যুয়াস্ উত্তেজনা ছাড়া কিছুই নয়, এমন অবান্তর কথার কোনো উত্তরও হতে পারে না, চেনা ফর্মুলা ছেড়ে অনিশ্চিত রাস্তায় পা বাড়ায় পাগলে! ঠিক তখনই আনন্দ ঝাপট মারলো আমার চোখেমুখে, সে কী প্রবল প্রবলতর বেগ! এক বলিষ্ঠ উন্মাদ যেন আমার রোগা হাড়ের কাঠামোটা নাড়িয়ে দিচ্ছে, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে অন্ধ ভিখিরি, শিরদাঁড়া ফুলে-ফুলে উঠছে। ধীরে চেয়ারটা ধরে উঠে দাঁড়ালাম। তখনও কেউ তেমনভাবে লক্ষ্য করেনি আমায়। দোয়েল তখন আর চুপ করে নেই, বিশদে বলতে শুরু করেছে কেন আদিনাথের প্রস্তাবে নজরে পড়ছে কেবলই হঠকারিতা, কেন এই প্রস্তাব অবান্তর। ঝুঁকি নেওয়া যে প্রকৃতপক্ষে বোকামি, কারণ তা লাভের হার কমিয়ে দিতে পারে, কমে যেতে পারে মুনাফা। ততক্ষণে আমার ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠেছে, কপালর হাড়ে ঝাপট মারছে রক্ত, হাত-পা কাঁপছে, যেন একটা ফুটো হয়ে যাওয়া জাহাজ। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার পায়ের তলায় মাটি পিছল খাচ্ছে, একটু পরেই তলিয়ে যাবো আমি, এই আমার শাস্তি, গর্তজীবন বেছে নেওয়ার শাস্তি, নিজের জন্যে নিরাপদ সামাজিক গর্ত খুঁড়তে চাওয়ার শাস্তি। ক্রমে পিছলে গেলাম, আমারই হাত থেকে, কাত হয়ে পড়লো জাহাজটা, চেয়ারের মাথাটা চেপে ধরে বিকৃত আওয়াজে চিৎকার করে উঠলাম, ‘জীবনে আধ মিনিটের জন্যেও কখনো ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছু ভেবেছিস মাগী!’। সমস্ত আলোচনা থেমে গিয়ে মুখগুলো হাঁ-করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, দোয়েল খানিকটা সিঁটিয়ে বসেছে চেয়ারে, আদিনাথ আর নির্মাল্য উঠে দাঁড়িয়েছে, সম্পাদক মহোদয় হাঁ-করে তাকিয়েই রয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম, আর ঢিল নয়, সমস্ত ঢিল নুড়ি দু’হাতের মুঠো থেকে খসে-খসে পড়ে গেছে আমার, এখন আমি, আমি নিক্ষিপ্ত হচ্ছি নুড়ির বদলে, নিজেই রোগাটে অভুক্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছি ওদের ওপর। দূর থেকে নিশ্চই ডোরাকাটা দেখাচ্ছে আমার চেহারাটা। গর্ত আমায় গ্রহণ করেনি। গর্ত আমায় নিক্ষেপ করেছে বাইরে।
—————————————————————

