
আলোকের সাধনা
(টমাস আলভা এডিসনের জীবন-কাহিনি)
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। অনুবাদক পরিচিতি- ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশত কুড়িটির ও বেশি।সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তেতাল্লিশটি।হোমেন বরগোহাঞির অসমিয়া উপন্যাস ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’(সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়) বাংলা অনুবাদের জন্য ২০২৪ সনের সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কারে সম্মানিত হন।
পূর্বে প্রকাশিত– প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
৪)
টমাস রেলগাড়ির ফেরিওয়ালা হল
এর আগের একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে টমাস বই পড়তে খুব ভালোবাসত, আর বারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই সে এডওয়ার্ড গিবনের ‘ডিক্লাইন এণ্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার ‘এবং রবার্ট বার্টনের’এনাটমি অফ মেলানকুলি’ নামে কেবল বয়স্ক মানুষ পড়তে পারা বইগুলি পড়ে শেষ করেছিল। কিন্তু যে ছেলেটি পরবর্তীকালে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক রূপে পরিচিতি লাভ করবে, সে বাল্যকালে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়াটা খুবই আশ্চর্যের এবং অস্বাভাবিক কথা নয় কি?
ওপরে উল্লেখ করা বই গুলির সঙ্গে সে আরও একটি বই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ে শেষ করেছিল।বইটির নাম ছিল Dictionary of Science,অর্থাৎ বিজ্ঞান অভিধান। কিন্তু বিজ্ঞানের কথাগুলি কেবল বইয়ের মধ্যে পড়ে টমাস সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে পারত না। প্রতিটি কথা নিজে পরীক্ষা করে তার সত্যাসত্য জানার জন্য বা তার রহস্য উদ্ঘাটণ করার জন্য তার মনে ছিল অন্তহীন কৌতূহল। টমাস বিজ্ঞানের অভিধানের বাইরে বিজ্ঞানের অন্যান্য বইপত্র পড়ে যে সমস্ত কথা শিখল সেগুলি নিজে পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাঁর ইচ্ছা হল। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন একটি গবেষণাগারের,সঙ্গে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি এবং বইপত্র এতগুলি জিনিস এবং বইপত্র কেনার মতো টাকা পাবে কোথা থেকে? অন্য ছেলে হলে মা-বাবাকে বলে বলে টাকা আদায় করার চেষ্টা করত। কিন্তু টমাসের মানসিকতা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক।ধনের প্রয়োজন অনুভব করা মাত্রই সে ধন রোজগার করার চিন্তা-ভাবনা করতে লাগল। অবশেষে সে ঠিক করল যে গবেষণাগার স্থাপনের জন্য প্রয়োজন হওয়া সম্পূর্ণ টাকাটা সে ব্যবসা করে অর্জন করবে।
তখন টমাসের বয়স ছিল মাত্র বারো বছর।
টমাসের পরিবার যখন ওহিও শহর ছেড়ে পোর্ট হুরনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এলেন,তখন টমাসের বয়স ছিল সাত বছর। সেই সময় পোর্ট হুরন থেকে ডেট্রয়েট নামক শহরে রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছিল।পোর্ট হুরনের রেলস্টেশনটা ছিল ছেলেমেয়েদের আকর্ষণের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।টমাস সময় পেলেই রেল স্টেশনে গিয়ে তার বিচিত্র কর্মব্যস্ততার দৃশ্য দেখতে খুব ভালোবাসত।কিন্তু তাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত রেলগাড়িটার টেলিগ্রাফ থাকা কেবিনটা।টমাসদের পরিবারটা পোর্ট হুরনে এসেছিল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। তার মাত্র ১০ বছর আগে,অর্থাৎ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে স্যামুমেল মার্ছ, উদ্ভাবন করা টেলিগ্রাফের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। টমাস ইতিমধ্যে বই পত্রে টেলিগ্রাফ বিষয়ের পড়াশোনা করেছিল এবং এই বিদ্যাটা শেখার জন্য তার মনের মধ্যে প্রবল আগ্রহ ছিল। সেই জন্য রেল স্টেশনে গিয়ে সে সবসময় টেলিগ্রাফ থাকা কেবিনটাতে উকি মেরে দেখত। কিন্তু টেলিগ্রাফের বিদ্যাটা শেখার জন্য সে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না।
টেলিগ্রাফ শেখার সুযোগ না পেলেও টমাস একদিন রেল স্টেশনে টাকা রোজগার করার একটা উপায় খুঁজে পেল। প্রায়ই যাবার মতো সেদিনও সে রেল স্টেশনে গিয়েছিল। স্টেশনে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে পড়ল স্টেশন মাস্টারের ঘরের দেওয়ালে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা একটি বিজ্ঞপ্তির প্রতি। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সে ঘরটার কাছে গিয়ে বিজ্ঞপ্তিটা পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে খুলে গেল জীবনের একটি নতুন পথ।
বিজ্ঞপ্তিটিতে লেখা ছিল ‘পোর্ট হুরন এবং ডেট্রয়টের মধ্যে চলাচল করা রেলগাড়িতে যাত্রীদের খাবার জিনিস বিক্রি করার জন্য মাত্র কয়েকটি নির্বাচিত লোককে অনুমতিপত্র দেওয়া হবে। ইচ্ছুক প্রার্থীরা প্রমাণপত্র সহ আবেদন করতে পারে।’
বারো বছরের টমাস ভাবল যে তার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করার এটা একটি সুবর্ণ সুযোগ। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে তখনই ফেরিওয়ালার অনুমতি পত্রের জন্য আবেদন করল। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা দেখা দিল।আবেদন পত্রিকায় তাকে নিজের বয়স উল্লেখ করতে হল।একটি বারো বছরের ছোটো ছেলেকে ভেন্ডরের অনুমতি পত্র দিতে রেলকর্তৃপক্ষ রাজি হল না। কিন্তু টমাসও এত সহজে হার মানার ছেলে নয়।সে নিজে গিয়ে অফিসারের সঙ্গে দেখা করল এবং এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এভাবে প্রভাবিত করল যে তারা অনুমতিপত্র দিতে বাধ্য হল।
এভাবে মাত্র বারো বছর বয়সে টমাস একজন ব্যবসায়ী হল। রেলগাড়িটা পোর্ট হুরন থেকে যাত্রা করে সকাল সাতটার সময়, ডেট্রয়েট থেকে হুরনে ফিরে যায় রাত সাড়ে নটায়। অর্থাৎ বারো বছরের ছোট্ট ছেলেটিকে সকাল সাতটা থেকে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত প্রায় ১৪ ঘণ্টা রেলগাড়িতে জিনিসপত্র ফেরি করার কাজে ব্যস্ত থাকতে হল। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষ্য করার বিষয় হল ছেলেটির খুব কষ্ট হবে ভেবে টমাসের মা-বাবা তাকে কাজটি করতে খুব একটা বাধা দেয়নি।এই সমস্ত দেশে ছেলেমেয়েদের শৈশব থেকেই পরিশ্রমী এবং স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। উন্নতির পথে সেই দেশগুলি অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার এটিও একটি বড়ো কারণ।
টমাস রেলগাড়ির যাত্রীদের শুধুমাত্র খাওয়ার জিনিস বিক্রি করত না। সঙ্গে সে খবরের কাগজও বিক্রি করত। কিছুদিন পরে দেখা গেল যে টমাস প্রতিদিন পাঁচ ডলার করে রোজগার করছে। তার থেকে এক ডলার মাকে দিত যাতে সংসার চালানোর কাজে মায়ের কিছুটা সাহায্য হয়। বাকি চার ডলারের একটি পয়সাও টমাস নিজের বিলাসিতা বা আমোদ প্রমোদের জন্য খরচ করত না। সম্পূর্ণ টাকাটাই খরচ করত গবেষণার যন্ত্রপাতি ,বইপত্র কেনার জন্য। টাকা কেবল রোজগার করলেই হয় না। টাকা রোজগার বা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সেই উপার্জিত অর্থ ভেবেচিন্তে সৎ উদ্দেশ্যে খরচ করতে শেখা, কষ্ট করে রোজগার করা ধন অপ্রয়োজনে খরচ না করার শিক্ষা। জীবনে উন্নতি করতে চাওয়া বা কৃতকার্যতা অর্জন করতে চাওয়া সমস্ত মানুষই টমাস আলভা এডিসনের জীবন থেকে এই শিক্ষা লাভ করতে পারে। তার জীবন থেকে গ্রহণ করতে পারা আরও একটি মূল্যবান শিক্ষা হল এই যে প্রতিটি মুহূর্ত অপচয় না করে যদি গঠনমূলক কাজে লাগানো যায় তাহলে উন্নতি না এসে পারেনা। মাত্র বারো বছর বয়সে টমাসকে রেলগাড়ির ফেরিওয়ালা হওয়ার জন্য সংকল্প নিতে দেখে মা-বাবা জোর করে বাধা না দিলেও মৃদু আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু টমাস নিজের সংকল্পের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে মা-বাবাকে বলেছিল–’আমি যদি রেলগাড়ির ফেরিওয়ালা হই তাহলে একসঙ্গে আমার দুটি লাভ হবে ।প্রথমে আমি নিজে কষ্ট করে ধন রোজগার করে স্বাবলম্বী হতে শিখব। দ্বিতীয়তঃ ডেট্রয়েট শহরের গ্রন্থাগারে থাকা প্রতিটি বই পড়তেও সুযোগ পাব। পোর্ট হুরনের গ্রন্থাগারে থাকা সবগুলি বই আমি পড়ে শেষ করেছি। পোর্ট হুরন থেকে ডেট্রয়েটের গাড়িটা সেখান থেকে ফিরে আসার আগে আমি সেখানে কয়েক ঘণ্টা থাকব। সেই সময়টুকু আমি গ্রন্থাগারে বই পড়ে কাটাব। রেলগাড়ির ফেরিওয়ালা হওয়ার ফলে এভাবে একসঙ্গে আমার দুটো লাভ হবে।’
রেলগাড়িতে ফেরি করে করে ক্লান্ত লাগার পরে অন্য অনেক ছেলেরাই হয়তো হাতে কিছুক্ষণ সময় পেলেই বিশ্রাম নিতে বা এদিক ওদিকে ঘোরাফেরা করে সময় কাটাতে চাইত কিন্তু টমাস সেই সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করেছিল গ্রন্থাগারে বসে পড়াশোনা করে।