
বিশ্বজিৎ লায়েক-এর গল্প
কুয়াশার অনন্ত চাদর ও আলোর উৎসব
বিড়ি ধরাল রাকা। জোরে টান দিল। প্রাণটা চা চা করছে। খুচরো নেই। নিতাইদা শালা ধার-বাকিতেও দেবে না। ভাঙানিও না। রিন্টাদের পাড়া গেলে হয়। মোড়ের কাছে মাসিমার চায়ের দোকান। তোফা বানায়। মাসিমার মেয়ে তুলি। ক্লাস নাইনে পড়ে। রাকা ওকে হেবি লাইক করে। লাইক বলাটা ঠিক নয়। লাইক তো ফেসবুকে করতে হয়। তবে কি ভালবাসা বলবে! শব্দটা শুনলে হাসি পায়। এমন হাসি যে শালা কোনোদিন দম বন্ধ হয়ে নিজেই মরে যাবে। তা মরে গেলে চলবে! কে দেখবে মাকে! মাঝে মাঝে নিজের উপর রাগ হয়। কিসের জন্য রাগ কিছুই বোঝে না। রাগ হলে রাকা চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে যায়। দূর! এটাকে বাথরুম বলা যায় না। একপাশে দেওয়াল। অন্য তিনপাশে ছেঁড়া কালো পলিথিন শিট দিয়ে আড়াল করে কোনোমতে লজ্জা ঢেকে আরাম বোধ। লজ্জা আবার কী! ছাদ তো নেই। আকাশ দেখা যায়। সামনের ছাদে কোয়েল বউদি এলে দেখতে ইচ্ছে করে, হেবি দেখতে মাইরি। রুন্টা বলেছে হেবি দেখতে মানে সেক্সি। রুন্টার বন্ধুরা বলে ঘ্যামা মাল। রাকা কিছুই বলে না, শুধু দেখে। দেখে যে টুকু আনন্দ পায় তাতেও নাকি মাংসের ঝোলের মত স্বাদ।
ধ্যাৎ তেরি সাড়ে নটা বেজে গেল। এখনও পেটে চা পড়ল না। মায়ের জন্য রুটি, ঘুঘনি নিয়ে যেতে হবে। তুলি স্কুলে যাচ্ছে। ওকে দেখলে রাকার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। কতবার ভেবেছে প্রপোজ করবে। পারেনি। মোড়ের কালি মন্দিরে মা কালিকে বলেছে, ‘মা সাহস দাও।’ না, মা সাহস দেননি। এই তো কল্পতরু উৎসবে রামকৃষ্ণ মিশন গেছল। বিবেকানন্দকে জোড় হাত করে প্রণাম করল। রামকৃষ্ণকে জোড় হাত করে প্রণাম করল। কিন্তু একবারও বলতে পারল না, ঠাকুর আমাকে সাহস দাও; তুলিকে বলে দিই, আই লাভ ইউ। বলা যখন হলই না শেষে খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরল। মা তখনও জেগে। রাত করতে ইচ্ছে করে না। তবু দেরি হয়ে যায় মাঝে মাঝে। মা কিছু বলে না। চেপে রাখে। ভিতরের বাইরের সব যাতনা।
তুলি যখন স্কুলে যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে রাকা। দুজনেই দুজনকে দেখে। কথা বলে না কেউ। তুলি হাসে। রাকার বন্ধুরা বলে, ‘মালটা তো চিকনি চামেলি রে!’
-‘দেখ বাচ্চু মুখ খালি করবি না। শালা, ভেজা গরম করাস না। নয়তো এক লাথ মারবো পাছায় ড্রেনে মুখ থুবড়ে গিয়ে পড়বি।’ রাকা কটমট করে তাকায় বাচ্চুর দিকে।
বাচ্চু হাসে। ঝকঝকে দাঁতে তার খৈনির চুম্বন। বলে, ‘পিরিত যে উথলে উঠছে রে রাকা।
রাকা মুঠো শক্ত করে চোয়ালে চালিয়ে দেয়। বাচ্চু চোয়াল চেপে ছিটকে পড়ে রাস্তায়।
রাকার রাগ উঠছে শিরদাঁড়া বেয়ে। আর একটু আর একটু করে একেবারে মাথায়। রাগ হলে রাকা কিছু করতে পারে না। এমনকি কথাও বলতে পারবে না। একেবারে চুপচাপ হয়ে যাবে। বাথরুমে ঢুকতে ইচ্ছে করবে। হাইড্রেন বেয়ে তখন স্রোত। আত্মরতি জল আর একাকী শীৎকার।
রাকা পড়াশোনায় তেমন আহামরি না হলেও তেমন ফেলনা ছিল না। ক্লাস নাইন টপকে টেনে উঠল রাকা। বাবা সরকারি অফিসের গ্রুপ ডি কর্মচারী। সুখেই চলছিল দিনগুলি। কিন্তু সুখ কী আর সহ্য হয় রাকাদের জীবনে! বাপটা মরে গেল বাইক অ্যাক্সিডেন্টে। তারপর যা দেখল তাতে রাস্তায় বাটি ধরে দাঁড়ানোর অবস্থা, বাপটা রেখে যায়নি একটা টাকাও। ফ্যামিলি পেনশন ভরসা। তাও তো হল না। কোন একটা মহিলাকে নমিনি করে গেছে বাপ। সার্ভিস বুকে নাম নেই মায়ের। অফিসের বড়বাবু বললেন, ‘কোর্টে গেলে একটা উপায় হবে। অফিস আপনাকে সাহায্য করবে। আমরা সবাই আপনার পাশে আছি।’
-‘তার আর দরকার নেই বড়বাবু। যে লোকটাকে ভালবেসে বাড়ি ছাড়লাম। সংসার পাতলাম। সে যে এত ছোটোলোক কখনও টের পাইনি। ওর টাকায় বেঁচে থাকতে আমার দংশন হবে। বরং ওই মেয়েটিকেই সব দিয়ে দিন। আমার কোনো দাবী-দাওয়া নেই।’ মায়ের চোখে জল। মাকে এমন কঠিন হতে এর আগে কখনও দেখেনি রাকা।
ভাড়াবাড়ি ছেড়ে রাকারা উঠে এল বস্তিতে। বস্তির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াতে শুরু করলেন রাকার মা। কিন্তু এখানে সবার অবস্থা তো দিন আনি দিন খাই। ছয় সাত বছর হলেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাজে লাগিয়ে দেয় বাবুদের বাড়িতে। বাবুদের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। কেউ কেউ রেলস্টেশনে ভিক্ষা করে। সন্ধ্যা হলেই ডেনড্রাইট কিনে ডেরায় ফিরে আসে। রুমালে ঘষে ঘষে নেশায় বুঁদ। ঝলসে উঠে শৈশব। রাকা একবার পাড়ার দোকানে গিয়ে বলেছিল, ‘কাকু ওদেরকে ডেনড্রাইট বিক্রি করেন কেন? জানেন না ওরা এইসব কিনে নিয়ে গিয়ে নেশা করে! আপনার ছেলেটা যদি…’
মাঝখানে একজন ফুট কাটে, ‘রামকৃষ্ণ এসেছে রে আমাদের পাড়ায়। নতুন আমদানি। বাণী ঝাড়ছে। সরে দাঁড়া। সরে দাঁড়া।’
রাকা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ চাপে। বাঁঝা ঝামেলা পাকিয়ে লাভ নেই। চুপচাপ থাকা অনেক ভাল। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রতিবাদ না করলেও নিজেকে ফালতু ফালতু লাগে। ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হয় দিনগুলি, রাতগুলি। ভাত হজম হয় না।
টিউশনির পাশাপাশি মা ঠোঙা বানাত। সংসার চালাতে তো টাকা চাই। বাজারের এক মুদির দোকানদার সব ঠোঙা কিনে নিত। তাতে দুজনের পেট চলে যেত। একদিন কী হল কে জানে! সব ঠোঙা ফেরত এনে মা জ্বালিয়ে দিল। আগুনের শিখার মতো মা’রও মুখেও গোলাপী আভা। রাগে কথা সরছে না মুখে। রাকা যত বলছে, ‘মা বলবে তো কী হয়েছে! বলো!’
মা’র চোখে জল চিকচিক করছে। মা কাঁদলে রাকারও কান্না পায়। সে দিনের ঘটনা কোনোদিন ভুলবে না রাকা। মা তাকে কখনো বলেনি সেদিন কী ঘটেছিল। বস্তির ছেলেরা নাকি জানতে পেরেছিল। একটা হেস্ত নেস্ত হয়ে যেত মা চায়নি তাই। বড় লোকেরা তো অমনি হয়। নষ্ট বেড়ালের মতো!
আর কিছুদিন পরেই মাধ্যমিক। রাকা ঠিক করল মাধ্যমিক দেবে না। কটা লোক চাকরি পায় মাধ্যমিক পাশে। বাবা তো এইট পাশেই চাকরি পেয়েছিল। বাবার কথা মনে পড়ছে কেন বুঝতে পারল না রাকা। তবে কি সে বাবাকে ভুলে যায়নি! তার একটা কাজ দরকার। বড় কালিতলায় অর্ণবদার গ্যারেজ। ওরা একটা ছেলে চাইছে। সকালে উঠেই রাকা সাইকেল নিয়ে বেরোল। মা বলল, ‘কোথায় যাবি এত সকালে! তোর মামা আসবে।’
-‘এক্ষনি আসছি। চপ আনবো মা? মুড়ি মেখে খাবে। ধনে পাতা নেই মনে হয়! আচ্ছা ধনেপাতা, পেঁয়াজও নিয়ে আসব।’
অর্ণবদা কাজটা আমার চাই। সাইকেল স্ট্যান্ড করতে করতে বলল রাকা। টুকটুকে ফর্সা, হ্যাণ্ডসাম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে অর্ণব। বয়স চল্লিশের মতো। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। অর্ণবের মনে পড়ে যায় মোমবাতি মিছিলে এই ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার। অনেকক্ষণ কথাও হয়েছিল। তখনও জানিত না রাকা তার কাছে কাজ চাইতে আসবে।
– ‘তুই কি পারবি রাকা!’ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন অর্ণব।
– ‘আগে দিয়েই দেখো না! না পারলে ছাড়িয়ে দেবে।’
– ‘ঠিক আছে কাল থেকে চলে আয়।’ অর্ণবদা গ্যারেজের সব মিস্ত্রি, হেল্পারদের ডাকল। পরিচয় করিয়ে দিল। ওদের সঙ্গেই রাকা চা আর ওমলেট খেল।
অর্ণবদার গ্যারেজের দুজন হেল্পার হেড মিস্ত্রিকে মামু বলে ডাকে। আর মাঝে মাঝে সদ্য দেখা ফিলমি গান গায়। মামু হাসে।
তুলির কথা মনে পড়লেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। চুমু খেতে ইচ্ছে করে। নাভির নিচে জেগে ওঠে তার পুং দণ্ড। পাতলুনের গিট খোলে। ভাবে করবে। না, থাক। বেশি বেশি ঘুম পাবে। বিছানা থেকে উঠে রাকা পেচ্ছাব করে আসে। স্কুলে যাওয়ার পথে তুলির ছবি তুলে রেখেছিল রাকা। মোবাইলের ওয়ালপেপারে রেখেছে তুলির হাসি হাসি মুখ। স্ক্রিনে চুমু খেলেই বাতাসে আগুন লাগে। মাথার রক্ত নেমে আসে আঙুলে। রাকা ভাবে যদি সত্যি সত্যি চুমু খাওয়া যেত! কী রকম লাগতো তার। কাজ করতে করতেই আনমনা হয়ে যায় রাকা কোন কোন দিন।
অর্ণবদা ইয়ার্কি মারে।
– ‘কিরে প্রেমে পড়েছিস নাকি! হিসেব ভুলভাল করছিস। আমাকে যে ডোবাবি রে রাকা। তা মেয়েটি কে, জানতে পারি!’
রাকা লজ্জা পায়। লজ্জায় লাল হয়। না, না ভুল বললাম। হয়ত নীলও হয়।
অর্ণবদা অদ্ভুত ফুর্তিবাজ মানুষ। হৈ হৈ করে দিন কাটিয়ে দেয়। অথচ ওর জীবনে হেভি দুঃখ, যন্ত্রণা সব কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গোপনে। দুঃখ লুকিয়ে বেঁচে থাকা! আশ্চর্য লাগে। মাও তো অমনি। অর্ণবদার সঙ্গে মিল আছে। গ্যারেজ থেকে যা লাভ হয় অর্ণবদা পাঁচজনের মধ্যে ভাগ করে। নিজে একটাকাও বেশি নেয় না। বরং মাসের প্রথম দিন ফ্রিতে মুরগির ঝোল আর ভাত -অর্ণবদা নিজের ভাগের টাকায় খাওয়ায়।
একবার অনেক রাত হয়ে গেল। সেবার প্রথম মাল খেল রাকা। মাল নয়। বিয়ার। রাত হলেই মামু রামভক্ত হয়ে যায়। তারপর হনুমানের মতো জ্ঞান দেয়। -‘বুঝলি রাকা, ধোয়া তুলসিপাতা থাকলে এই লাইনে চলে না। যখন যেমন তখন তেমন। যেমন জল তেমন মাছ না হলে বাঁচবি না রাকা বুঝলি! পৃথিবী খুব কঠিন রেস্তোরা। মানিয়ে মানিয়ে খেতে হয়। দুঃখ ছেকে আনন্দে ডুবিয়ে দিতে হয় ইয়ে দো দিন কা জিন্দেগি!’
সেদিন রাকা শুয়েছিল অর্ণবের পাশে। হঠাৎ একি নাভির নিচে একটা শক্ত হাত ঘুরছে। পুং দণ্ড ঝাকাচ্ছে আঙুলের চাপে। ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে শরীর। এতো ভালো স্বপ্ন কখনও দেখেনি রাকা। স্বপ্নের মধ্যে উথালপাথাল সুখ। প্রথম আত্মপাতের আনন্দে উথলে উঠল রাকা। -‘অর্নবদা! জল খাবো।’
অর্ণবদাকে এইভাবে দেখে চমকে উঠল রাকা। কেঁদে ফেলল। মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকল। অর্ণবদার উপর রাগ হল। ঘেন্নায় থুতু ছেটাতে ইচ্ছে হল। এক্ষুণি পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল। অর্ণবদা নির্বিকার। গান গাইছে।
“তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ ওগো ঘুম ভাঙানিয়া।” গান শেষে বলছে, ‘আরে বোকা কাঁদছিস কেনো!’
রাকা চুপচাপ থাকতে চাইল। কিন্তু কীভাবে যেন মুখ পিছলে বেরিয়ে পড়ল, ‘অর্ণবদা তুমি বিয়ে করোনি কেন!’
শীত যা পড়েছে! ভোর ভোর উঠে ট্রেন ধরা খুব দুঃসহ। অভ্যেস নেই। অনেকেই তো রাত তিনটায় উঠে ট্রেন ধরে। কাজ বড় বালাই। পেট টানলে রাত তিনটাকেও মনে হবে সোনালি সকাল। এই ক-বছরে চুল পেকে মাথা পাকা হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশও উঁকি দিচ্ছে। এই চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছেও নিজেকে ভীষণ ভীষণ দামি আর জরুরি মিনে হয় অর্ণবের। জীবনে দুঃখ থাকলেও আনন্দও কম নেই।
চারটে দশ-এ ট্রেন। এখন তিনটা কুড়ি। একটু কফি খেয়ে নিলে হয়। দুধ সামান্য পড়ে আছে। তা দিয়েই আপাতত হয়ে যাবে। অর্ণব সময়ের হিসেব কষছে। বাইকে স্টেশন সাত মিনিট। টিকিট কাটতে পাঁচ মিনিট। যদি ভিড় থাকে! এতো ভোরে ভিড় তেমিন থাকবে বলে মনে হয় না। যদি বা থাকে আরো দশ মিনিট। তাহলেও ট্রেন মিশ হবে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। না তেমন বুড়ো বুড়ো লাগছে না। গ্যারেজের ধুলো কালিও লেগে নেই। এই বয়সেও বিয়ে করা যায়! কত লোক করে। অর্ণব করলেই দোষ। এতদিন বিয়ের কথা মনেই ছিল না। রাকা, হ্যাঁ রাকাই তো উস্কে দিল দেশলাই। হয় জ্বলে মর না হয় জ্বালিয়ে দে। অর্ণবের ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে এল গান, “দোষ কারো নয় গো মা স্বখাত সলিলে ডুবে মরি।”
ট্রেন চলছে। আধো অন্ধকার ছিঁড়ে দিচ্ছে অন্ধকার বাল্ব। ট্রেনের হেডলাইট। কল্পনাতে ভেবে নিচ্ছে অর্ণব। কারণ জানলা বন্ধ। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বন্ধুরা বলেছিল, ‘কলপ করে নে। এই রকম সাদা মাথায় কেউ পাত্রী দেখতে যায়! আরে আজকাল বাজারে কত রঙ! বুড়ো বুড়ো ভাবটা নিমেষে বদলে যাবে। ইয়াং লাগবে।’ অর্ণব শুনেছিল। মনে মনে হেসেও ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ছিঃ। নিজের সঙ্গে নিজের প্রতারণা। না, চুলে সে কিছুতেই রঙ করবে না।
আর চার-পাঁচটা স্টেশন। তারপরই আনন্দপুর। কী সুন্দর নাম! ওখানকার মানুষেরা সবাই কি সুখে থাকে। ধ্যাৎ ভুল হচ্ছে। বলো সবাই কি আনন্দেই থাকে। কথাটা কে বলল! কেউ তো নেই। নিজের মনের দ্বিখণ্ডিত একখণ্ড আরেকখণ্ডকে এইসব কথা বলে যায় অবিরাম-অবিরত।
‘দাদা টাকাটা দিন।’ গলা শুনেই সম্বিত ফিরল অর্ণবের। ঝালিমুড়ি খেয়েছে। তার টাকা চাইছে মুড়িওয়ালা। মুড়ি দিতে দিতে ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা। ফিরে এসেছে বকেয়া নিতে। পকেট থেকে দশ টাকার কয়েন বার করল অর্ণব। মুড়িওয়ালা ছোকরা, ‘দশ নয় কুড়ি দিন। দশ টাকার দিন শেষ হয়ে গেছে কাকু। জলদি করুন, সামনে নামব।’
ঝালমুড়ির ব্যবসা একটা দারুণ বিজনেস। কম পুঁজিতে বেশি লাভ। পাঁচশো টাকা খাটালে পাঁচশো লাভ। এই সব জেনেছে লাল্টুর কাছে। অর্ণবদের ক্লাসমেট। তখন নাইন কী টেন। মান্তুর সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে ফেঁসে গেল। ডাকসাইটে বস্তি সুন্দরী। ফাটাফাটি দেখতে। আটঘন্টা অন্তর অন্তর বয়ফ্রেন্ড পাল্টায়। তিন তিনটে ছেলেকে নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে। ছেলেরাও দু-চার পয়সা খরচ করে ফুর্তি মারছে। লাল্টু এইসব বুঝত না। বুঝত সাচ্চা প্রেম আর কবিতা। কবিতা আর মান্তু অথবা মান্তু আর কবিতা। কোনোটাই থাকল না। কপাল এমনই!
লাল্টুদের ফাঁকা ঘরে মান্তু একবার এসেছিল। লাল্টু চায়নি। কিন্তু মান্তু আসবেই। জেদ ধরল। এমন জেদ যে লাল্টু আর না করতে পারেনি।
শোবার ঘরে ঢুকে মান্তু অর্ডার করল, ‘লাল্টু একটু কফি বানা তো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।’ লাল্টু বানিয়ে দিয়েছিল। কেমন হয়েছিল জানে না। নিজে সে খেয়ে দেখেনি।
শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। তারপর হাত দুটো উপরে তুলে শরীর ভাঙল। উফ্ শব্দ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বলল, ‘আমি ঘুমোব এখন। তুই চাইলে আমার সঙ্গেই শুতে পারিস।’
– ‘পাগলামি ছাড় মান্তু! আমার পরীক্ষা আছে। পড়তে হবে। আর মা ফিরে এলে কী বলবে বল!’
– ‘ন্যাকামি করিস না লাল্টু। ছেলেদের ন্যাকামি আমার একদম সহ্য হয় না।’ বলেই লাল্টুর মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরল। লাল্টু নিজের মধ্যে আর নেই। কানে ঝিঝি পোকার ডাক। কিসের যেন একটা টান শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসছে নিচে। পিটুইটারির খেলা। কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘এইসব নোংরামি ছাড় মান্তু।! আমি তোকে ভালোবাসি মান্তু। কিন্তু এইসব কী করছিস বল!’
হেসে উঠল মান্তু। ভালোবাসি! এটা কি ভালোবাসা নয় নাকি! বলেই একে একে পোশাক খুলে উজাড় হতে লাগল। ন্যাড়া! আকাশ…
অসহ্য ক্ষেপে উঠে লাল্টু। সপাটে একচড় মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো লাল্টু। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াল। তারপর আর কিছু মনে নেই। গ্রীষ্মের দাবদাহে ঠাণ্ডা জলের স্রোতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
তারপরের গল্প। বাড়ি শুদ্ধ লুটপাট করে নিয়ে গেল কারা। কারা আগুন লাগিয়ে দিইয়ে গেল ঘরে। কেউ দেখল না পাড়ার সেই প্রিয় ছেলেটা এইসব করতে পারে না। নিজের নিজের হতাশা, ক্লান্তি, গ্লানি সবকিছু একত্রিত করে একজনের উপর প্রতিশোধ তুলল। এদেরই কাউকে জেঠু বলে ডাকত। কাউকে কাকু বলে। কাউকে দাদা। না, কোনো সম্পর্কের দামই নেই। সবই ধানের আগড়ার মতো ভেসে থাকা। মা সেই রাতেই চলে গেলেন। লজ্জায়, অপমানে, ঘেন্নায়।
আনন্দপুর স্টেশনে নেমে রিক্সা নিল অর্ণব। এখান থেকে দু-কিলোমিটার দূরে তন্ময়বাবুর বাড়ি। ওঁর বড় মেয়ে অনুস্মিতা। ইস্ ভুল হল। একটাই তো মেয়ে। তার আবার বড় ছোট কী! পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করেছিল। রাকার কথাটা খচ করে লেগেছিল বুকে। তাই। আজকেই আসতে বলেছেন।
– ‘আপনি আমার নাম জানেন। আমিও।’ মিষ্টি করে হাসল মেয়েটি।
মনটা উসখুস করছে। তবু জোর করে হাসল অর্ণব। কাঁচাপাকা চুলগুলো উঁকি দিচ্ছে। ধ্যাৎ, উঁকি নয় জানান দিচ্ছে। টুপিটা পরে থাকলে ভালো হত। এখন তো শীতকাল। ভালোই হতো।
মেয়েটির মা খাবারের দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। – ‘তোমরা গল্প করো। সংকোচ করো না। দুজন দুজনকে জেনে নাও। তারপর পাকা কথা হবে। বিয়ে অত সহজে হয় না বাপু। আজকাল কী আর সেই দিন আছে! একেবারে ছাদনাতলায় দেখা হবে দুজনের তাও আবার শুভ দৃষ্টির সময়। খাও বাবা খাও। সংকোচ করো না। তোমাদের বয়সে অনুর বাবা ষাটটা রসগোল্লা খেতেন। আর আজকালকার ছেলেরা চারটে খেতেই কুঁকড়ে যায়।’ এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলেন মেয়ের মা। অর্ণবের হাসি পেল। অনুস্মিতা বলল, ‘তুমি থামবে মা। তুমিই যদি সব কথা বলো, আমরা কী বলব!’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা বেরিয়ে গেলেন। অনুস্মিতা বলল, ‘আপনাকে তুমি করেই বলি। আজ আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মোবাইল নাম্বরটা দাও। আমি ফোন করব।’
অর্ণবের রাগ হচ্ছে। অত ভোর ভোর উঠে এতদূর আসা শুধু মোবাইল নাম্বর দিতে। মোবাইল নাম্বর তো ওর বাবার কাছেই ছিল। তবু নিজেকে সামলে নিল।
অর্ণব যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত নটা। কিছুই খাওয়া হয়নি। শরীরে ক্লান্তি নেমে আসছে না কিন্তু নামার তো কথা ছিল! ফ্রেস হয়ে টিভি চালাল।
বৃষ্টির জন্য ভারত পাক ম্যাচ হচ্ছে না। চ্যানেল পাল্টে পাল্টে যেতে লাগল। কফি খেলে হয়। রান্না ঘরে ঢুকল। না, দুধ নেই। লিকার চা বানাল। একটা সুপ বানালে হয়। আলু ফুলকফি, পালং, গাজর, মটরশুটি, ধনেপাতা, টম্যাটো আর বরবটি দিয়ে। মুড়ির সঙ্গে দারুন হবে। অনুস্মিতা কি রান্না করতে জানে! অ্যাই যা কোনো কথাই তো হয়নি।
মোবাইলে ভেসে উঠল একটা অজানা নাম্বার। রিসিভ করতেই।
– ‘আমি অনুস্মিতা বলছি। বাড়ি পৌঁছে গেছ।’
– ‘হ্যাঁ।’ যাক মেয়েটা কথা রেখেছে। মনে মনে স্ফূর্তি অনুভব করল অর্ণব।
– ‘অর্ণব আমার জীবনে একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা যাই বলো তা আছে। বড় জোর দু-তিন মিনিট লাগবে। তোমার সময় আছে! শুনবে!’ খুব ঠাণ্ডা শোনাল গলাটা।
– ‘বলো।’ উদ্বেল হল অর্ণব।
– ‘আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম। তা ধরো স্কুল বয়স থেকেই। ও আমার সহপাঠীও ছিল। সেও আমাকে ভালোবাসত। ভালবাসতে গিয়ে যা যা হয় ধরো আমাদের মধ্যেও বেশ অনেকবার সেসব হয়ে গেছে। ছেলেটা খুব ভালো। সদ্য সদ্য একটা চাকরিও পেয়েছিল। দাঁড়াও একটু জল খেয়েনি।’
অর্নব ভাবল যাক আমার ভাগ্যে বিয়ে বোধ হয় নেই। এটাও ফস্কে গেল। অনুস্মিতা বলল, ‘শুনছো!’
– ‘হ্যাঁ, বলো। আছি।’
– ‘আমি এখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। সামনের ফেব্রুয়ারিতেই আমরা বিয়ে করতাম। বাড়ির কেউ এইসব জানে না। মা, বাবা কেউ না। কিন্তু ছেলেটা চলে গেল।’
অর্নব বিস্মিত হয়। বলল, ‘কোথায় গেল!’ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার অনুস্মিতা বলল, ‘ও আর নেই। বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এর আগে যে দুজন আমাকে দেখতে এসেছিল তাদেরকে এই ঘটনাটা বলেছিলাম। ওরা নোংরা নোংরা কথা শুনিয়ে আমাকে ব্যাক লিস্টেড করেছিল। তুমিও হয়ত সেই রকমই কিছু বলবে এবার। বলো পুরোটা শুনি… আরে কিছুই বলছো না যে! কিন্তু দেখো এটা আমি গোপন করতেই পারতাম। এটা নষ্ট করে দেওয়া তেমন কিছু জটিল নয় আজকের দিনে। কিন্তু নিজেকে নিজের কাছে ছোটো করতে পারিনি।’
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কিছু কথা বলছে না। দুই পাশে দুই পৃথিবীতে একজন নারী আর একজন পুরুষ। মাঝখানে তৃতীয় আরেকজন। যে পৃথিবীতে এখনও আসেনি। দেখেনি পৃথিবীর আলো। দেখার অপেক্ষায় আছে।
নীরবতা ভেঙে অর্ণবই প্রথমে বলল, ‘অনুস্মিতা আমি তো তোমাকেই খুঁজছিলাম। সামনের ফেব্রুয়ারিতেই আমরা যদি বিয়েটা সেরে ফেলি তোমার কী কোনো আপত্তি আছে! একটু ধরো। সূপ বসিয়েছি। ওভেনটা একটু কমিয়ে দিই।’
ওভেনের আঁচ কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। শীত বাড়ছে। বাইরে তখন কুয়াশার অনন্ত চাদর। পৃথিবীকে মুড়ে রাখছে সযত্নে। ফোনের অন্যপাশে অন্য পৃথিবীতে এক নারী তখন কাঁদছে। আনন্দে। অশ্রুতে মিশে যাচ্ছে আলো। পৃথিবীতে এখনও এতো এতো আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন তিনি। ফোনের এইপাশে এই পৃথিবীতে এক পুরুষের চোখেও জল। ওই সন্তান তো আমারই! বাবা বলে ডাকছে। হামি খাচ্ছে গালে…