ফাল্গুনী  ফাগুন  ঘোষ- এর গল্প

ফাল্গুনী ফাগুন ঘোষ- এর গল্প

সেতু

সেতুটা দুলছে না স্থির একচোখ তাকিয়ে তা বোঝা যায় না। হতে পারে দুলছে, অথবা জঙ্গমহীন এক পাষাণ। এ পাষাণ রঙ বদলায়। ক্ষণে ক্ষণে না হলেও সময়ের উথালে এবং পাথালে। কখনও দুলতে দুলতে ডুবন্ত নাওয়ের মত দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। কখনও আবার চোখের সামনে ঝুলে থাকে প্রবল বিচ্ছু ছেলে হয়ে। সবাই দেখতেও পায় না সে সেতু। কেউ দেখে সেতুর এপারে তার চেনা আবহ। থাকতে পারে নীল আকাশ, মাঠ, বনজ গাছ গাছড়া থেকে ঝুলে থাকা আলো ছায়ার খুনসুটি— চোখে পড়তে পারে এসব কিছুই।

আবার কোনো চোখ আবিল হয়ে দেখে সুদূর গহ্বরে রূপোর টিকলি পরে বনদেবী এলিয়ে আছেন। রুক্ষ্ম পাহাড়ের একটুকরো পাথরের মত ঝুলতে থাকা আবহে কেউ হয়ত নড়বড়ে ঝুলন্ত সেতুর শুরুয়াতে পা ছোঁয়ায় এক দূর্নিবার অবশ মোহে। আকাশে তখন বৃদ্ধ সূর্যের করুণামাখা রঙ। আবার অন্য আকাশে চাঁদের পানপাতা জ্যোৎস্নায় বনদেবী নাইতে নামছেন। সে এক কুহকিনীর ডাক। অতীত- ভবিষ্যৎ লুপ্ত হয়ে শুধু বর্তমানের পায়ে পা মিলিয়ে ঝুলন্ত, আ-পলকা, নড়বড়ে সেতু ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রবল ভরসার হাঁটি হাঁটি পা টলোমলো নতুন শিশু হেন একটু একটু করে এগিয়ে এগিয়ে মাঝ বরাবর পৌঁছে যায়।

আর ঠিক তখনই তার প্রয়োজন হয় একবার এদিক ওদিক ফিরে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার। এদিক ওদিক বলতে অবশ্য শুধুই সামনে। কারণ ডানে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ভারসাম্যহীন হওয়ার বাসনা কারো থাকবে না সেই স্বাভাবিক। এদিকে এতটা এগিয়ে গেলে আর পিছু ফেরা ডাকও তাকে ফেরাতে পারে না। একমাত্র গত্যন্তর থাকে সামনে তাকানোয়। যে সেতুটায় প্রথম পা রাখার সময় আশা আশঙ্কার দোলা ছিল, সেটি হাজার হলেও উপভোগ্য– সে উপভোগ ক্ষীণ হয়ে আশঙ্কার অন্তমিলে হারিয়ে যায়। হয়ত তখন ঝাঁক বেঁধে কুয়াশার দল চরতে নেমেছে। আরপার ধোঁয়া জীবনের কুন্ডলী। সেতুর অপর পারটি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে বা আদৌ ঠেকেছে নাকি মাঝপথেই তার অসম্পূর্ণ অবলুপ্তি এসব ভাবতে ভাবতে প্রবল শীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম কাউকে ভিজিয়ে দেয় অথবা গরমের আবহে ঝেঁপে নামা বৃষ্টিতে ঠকঠকিয়ে ওঠে হাড়। নিজের যাত্রাপথের ভবিষ্যৎ কল্পনায় কেঁপে ওঠে সে কেউকেটা। হয়ত পা যায় হড়কে।

সে হড়কানোর মুহুর্তে নিজেকে আবিষ্কার করা যায় বিছানা চাদর বালিশের সঙ্গে তালগোল পাকানো মানুষ হিসেবে। এটি একটি স্বপ্ন মাত্র ভেবে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে কারো কারো আবার পল্লবের মত মানুষ ঘুম থেকে চোখ মেলে বিছানায় বসে প্রথমে কয়েকটা হাই তোলে। তারপর চোখ মুছে জানলার দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকায়। ভাবে তার সেতুর রাস্তাটি জানলা থেকে শুরু কি না! গতকাল রাত্রে খেতে বসে মায়ের মুখে শুনেছিল অনেকদিন আগে বিদেশে পড়তে যাওয়া পাড়ার মেয়েটি বাড়ি ফিরছে– তখনই মনে মনে হেসেছিল সে এই ভেবে, হয়ত তার অতি পরিচিত আজনমের সেতুটি স্বপ্নে আসবে। নতুন কোনো মানুষের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেই এ স্বপ্নদর্শন তার বাঁধাধরা।

কিন্তু আর যে দেরী করা যায় না। বসে বসে হাই তোলারও যো নেই। স্বপ্ন, ঘুম, জানলা বা সেতু এমনকি নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এ সব আপাতত মুলতুবী রেখে পল্লবকে মাটিতে পা দিতে হয়। চটাস চটাস চপ্পলের আওয়াজ তুলে ডাইনিং-এ এসে দাঁড়ালেই মায়ের গলা আসে, সঙ্গে আসে চা–

– হবে তোর সময় চা খাওয়ার মত!

ছেলে যুগপৎ হাসে ও মাথা নাড়ে—

দাও এক চুমুক তো মেরে দিই, ঘোরটা কাটুক!

ছেলের কথার কি ছিরি! …… বিড়বিড় করে মা। এক হাত তুলে থাপ্পড়ের ভঙ্গীমায় শাসায় ছেলেকে আদরের শাসানি।

মা ছেলের সকালবেলার শাসন ভালোবাসার অধ্যায়টি প্রায় দৈনন্দিন। কেননা বেলা গড়িয়ে ঘুম ভাঙবার অভ্যেসটি পল্লবের সুপ্রাচীন। এ সুপ্রাচীন ঘুমের অন্দরমহলে কোন নড়বড়ে ঝুলন্ত সেতু ক্রিয়াশীল সে খবর মায়ের আঁচলে থাকে না অবশ্য। মা শুধু আঁচল স্নেহে রাঁধা ভাতটুকু ছেলের মুখের সামনে সাজিয়ে দেন। আজকের দিনও তার ব্যতিক্রম নয়। খেতে বসে সচরাচর ছেলে মুখে আওয়াজ করে না। এক্ষেত্রে আজ ব্যতিক্রম হল–

আচ্ছা মা, যে মেয়েটির বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে ফিরে আসার কথা তুমি বলছিলে…

যে মেয়েটি কি রে! ও তো টুসি! সেই ছোট্টতে দুদিকে লাল ফুলতোলা গার্ডার দিয়ে চুল বাঁধত! তোর মনে পড়ে না!

পল্লবের তখন টুসি বা তার লাল গার্ডারে বাঁধা চুল – এ দুটোর কোনোটা নিয়েই অতিভাবিত হওয়ার মত সময় অবশেষ ছিল না। এ সময়টা যাকে বলে নাকে মুখে চাট্টি গুঁজে দৌড়ানোর সময়। তবুও জিজ্ঞেস করল কারণ কালকের মায়ের বলা কথা আর তার অতি পরিচিত স্বপ্ন সেতুর সহাবস্থান।

তা সে টুসি হোক বা যেই হোক! তারা কি এসে গেছে!

আজকে এসে যাওয়ার কথা ছিল রে…… কিন্তু তোরই বা এই মুহুর্তে এত খোঁজে কি দরকার…!

ঠিক তাই। পল্লব কথা বাড়ায় না আর। আপাতত হন্তদন্ত হয়ে পাড়ার বাসস্টপে পৌঁছে যায় , সেখান থেকে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস।

পল্লব একটি সরকারী অফিসের মেজবাবু। অল্প বয়সেই সে মেজবাবু হয়ে উঠেছে বুদ্ধিবৃত্তির গুণে ও কাজের নিষ্ঠায়। এসব নিষ্ঠা বজায় রাখতে অবশ্য পল্লবকে গাম্ভীর্যের মুখোশ পড়তে হয়। অফিসের কোন্দল সামলায় বিজ্ঞের ভঙ্গীমায়। এ ওর নামে কান ভাঙানো, কাজ ফাঁকি দিয়ে আড্ডাবাজি এসব চলে তার চোখ এড়িয়ে। পল্লবের খুব ইচ্ছে হয় আড্ডায় যোগ দেয়, যদিও কাজ ফাঁকি দেওয়া তার অপছন্দের।

অফিসে বড়বাবুর আলাদা কেবিন আছে। বড়বাবুর কেবিন পিছনে রেখে লম্বা সার বাঁধা টেবিল চেয়ার । পর পর সার বাঁধা আসনের আকৃতি রঙ এক হলেও প্রকৃতি ও ঢঙ গড়ে উঠেছে চেয়ারের মালিকের মাপে। সেসব চেয়ারের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে গন্ধ পায় পল্লব। গোটা সাত আটেক মানুষ জুড়ে জুড়ে যে সমান্তরাল রেখা , সে রেখার কেন্দ্রবিন্দুতে বসেন এক বয়স্কা। অফিসের একমাত্র মহিলা। সে কেন্দ্রে পল্লব পায় স্নেহের গন্ধ। চর পরে যাওয়া পৃথুলা নদীর মত কাঁচা পাকা চুল আর উঠে যাওয়া চুলের ভূমিজ সন্নিবেশে মহিলার মুখ চোখ হাসির গোলাপি আভায় মায়াময় হয়ে থাকে সবসময়।

কথাবার্তা যাওয়া আসা করে উভয়ের মধ্যে। দু চারটে টুকরো টাকরা সামাজিকতার বিনিময়ে কেমন টান অনুভব করে পল্লব মহিলার প্রতি । দুপুরে টিফিন টাইমে মহিলার হাসি আর চাউনি একটু স্নেহের আশ্রয় দেয় তাকে। যদিও জানা হয়নি একে অপরের বাস্তু পরিচয়, ব্যক্তিগত গোপনের খবর। সেসব নিয়ে চিন্তিত নয় ও। সমান্তরালের বিন্দুতে যারা মিটমিট করে তাদের বিচিত্র রঙ ঢঙ। কিন্তু রঙ ঢঙে কোনো সেতু চোখে পরে না পল্লবের।

আরেক বিচিত্র মানুষ সাধনদা। পল্লবের পাশেই তার বসার চেয়ার। সাধনদা স্বপ্ন নিয়ে কারবার করেন। স্বপ্ন দেখার কারণ ও সম্ভাব্য ফলাফলের অনুবাদক। খুব একটা ভাবুক নয় মানুষটা বরং বলা যায় বাকপটু। বাকপটুত্বের প্রকাশ চোখেই বেশি। সঙ্গে আন্তরিকতার চটক। পল্লব কথায় কথায় সাধনদাকে বলেই ফেলেছে নিজের অদ্ভুত স্বপ্ন কথাটি। পল্লবের মুখে সাধনদা যেদিন প্রথম শুনেছিল তখন প্রশ্ন ছিল নানান। কাঁধে হাত দিয়ে ঝুঁকে এসে ফিশফিশিয়ে বলেছিল,

ভাই কোনো প্রেমের কেস নেই তো তোমার মনে…

আরে সাধনদা , না না…

মাথা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করে । অত তীব্র প্রতিবাদ দেখে হেসে ফেলে সাধনদা। আশ্বস্ত করে তাকে–

আস্তে আস্তে! ধীরে! তুমি দোদুল্যমান সেতুর মাঝখানে পৌঁছে যাচ্ছ । কিন্তু অন্যপারের খবর জানা নেই!

না দাদা, সেতুটি অন্যপার অবধি সম্পূর্ণ কি না তাই তো জানা নেই!

বিজ্ঞের মত নিজের মাথায় টোকা মারে সাধনদা। এটি সাধনদার চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বের একটি জোরালো লক্ষণ। সেসময় কপালে গম্ভীর গভীর ভাঁজ পড়ে একটি।

তাহলে হতে পারে তোমার শৈশবে কোনো নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ক ঠিকভাবে কাজ করেনি… অথবা খুব প্রিয়জনের সম্পর্ক বিচ্ছেদ দেখেছ!

বিরক্ত হয়ে পল্লব জবাব দিয়েছিল, অসম্পূর্ণ সেতুতে হাঁটছি মানেই কি দুটি মানুষের সম্পর্ক সংক্রান্ত কিছু হতে হবে! এমনও হতে পারে হয়ত বীভৎস সুন্দর জায়গা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে!

সে তর্ক বিতর্কের পর একটি অলিখিত ফায়শালা হয়েছিল । সাধনদার মত অনুসারে যে রাত্রে স্বপ্ন আসে তারপরেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে কি কি ঘটনা ঘটে খেয়াল রাখা দরকার! পল্লব লক্ষ্য করে দেখেছে স্বপ্ন সেতুর দোলায় যেদিন সে দোলে তারপরেই নতুন মানুষদের সঙ্গে পরিচয় হয়। আজও তাই মাকে জিজ্ঞেস করছিল বারবার অন্তত পাড়ায় নতুন কেউ এল কি না!

ঘটনাটি ঘটল অফিসের দ্বিতীয়ার্ধে । কয়েকদিন থেকে শুনছিল নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট হবে। চাকরিতে যোগ দেবে এক নতুন মানুষ! কিন্তু সে ঘটনা যে আজকেই ঘটবে সেকথা পল্লবকে আবার সেতুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল!

পল্লবের কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস এরকম অসম্পূর্ণ সেতু পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই হোক না কেন, নিশ্চয়ই থাকবে। যে সেতুর সূচনাটি দৃশ্যজগতের আর কোন এক অতিন্দ্রীয় কুন্ডলীকৃত কুয়াশার হৃদয়ে সে প্রবেশ করেছে চলতে চলতে। যার সমাপ্তি নিজেই নিজের কাছে রহস্য। দৃশ্যজগতের মানুষের কাছে যে সেতুর সম্পূর্ণতা প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে দোদুল্যমান– এরকম গা ছমছমে অথচ দূর্নিবার আকর্ষণে টেনে রাখা সেতু সমগ্র নীল গ্রহে কোনো এক বিন্দুতে তার অস্তিত্ব নিয়ে জানান দেবে না এ হতেই পারে না। পল্লব দেখেছে সাদা চোখে যা রঙিন লাগে ক্যামেরার লেন্সের ওপারে তাই কেমন ছায়া ছায়া। বোদ্ধারা নাম দেয় সিল্যুট। আবার জীবনহীন বা সমান্তরাল শান্ত জীবনে গল্প এসে তোলপাড়িয়ে দেয় জীবনের ঘরবাড়ি , দরজা জানলা। সেরকম অ্যাঙ্গেলে লেন্স ঘুরিয়ে খুব মজা পায় পল্লব। ফটোগ্রাফি তার নেশা। জীবন, প্রকৃতি, গল্প কত বিচিত্র কৌণিকে যে লেন্সে ধরা পড়ে।

এসব কারণেই নিজের উপর দৃঢ় বিশ্বাস তার স্বপ্নের সেতু একদিন সামনে আসবেই। সেতুর খোঁজে সে পাহাড়ে সমুদ্রে কম ঘোরে নি। একবার কোনো এক সমুদ্রতট থেকে বাঁশের নড়বড়ে সেতু অগভীর জলে গিয়ে মুখ লুকিয়েছিল– দূর থেকে তার ভ্রম হয়েছিল এই বুঝি সেই রহস্যময় সেতু। লেন্সে চোখ রাখতেই রহস্যময়তার অন্ত্যমিলে শক্তপোক্ত খুঁটিযুক্ত মাছ ধরার ব্যবস্থা দেখা দিল। মনে মনে নিজের পাগলামিতে খুব হেসেছিল সেদিন সে। এসব কথা নিজের মনেই গুঞ্জন করে ফেরে। সাধনদাকে বলা যায় না। স্বপ্নের কার্যকারণের ভাবনায় সাধনদা আর পল্লবের বিস্তর ফারাক।

পরদিন মেজবাবু অফিসে গিয়ে দেখলেন, তাদের বসার সজ্জার সমান্তরাল রেখাটি বড়বাবুর কেবিনের পাশ থেকে বেঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে । নতুন যে অফিসে যোগদান করেছে তার বসার ব্যবস্থা অদৃশ্য বাঁকের ওপারে। কয়েকদিন পরেও চাপা স্বভাব পল্লবের আলাপচারিতা এগোয়নি। নামটিও জানা হয়নি এখনও। শুধু দূর দূরান্তর থেকে যেন চোখ মেলে দেখেছে, কালো, ধূসর আর সাদা আলোর চক্রব্যুহে একটি অবয়ব। কখনও স্পষ্ট কখনও বা মরিচীকা ভ্রমে অস্পষ্ট। যেন পূর্ণাঙ্গ শুন্যস্থান – কুয়াশাঘেরা যার শরীর। পল্লবের মনে হয় এ তার স্বপ্নে দেখা সেতুর মতন! সূচনার প্রান্তে দাঁড়িয়ে পল্লব কী জানি কার অপেক্ষা করছে। অথচ সমাপ্তির প্রান্তটি চির রহস্যের আবর্তে ঘূর্ণায়মান। আশ্চর্য হয়ে পল্লব ভাবে তাহলে কি তার অফিসে বসার টেবিলেই নড়বড়ে দুলন্ত সেতুর জন্মভূমি! পায়ে পায়ে এগিয়েও গেছে সে একদিন। কিন্তু কেন্দ্রবিন্দুর পর পথ গেছে হারিয়ে। বাঁক ফিরতে গিয়ে টলোমলো পায়ে নিজেকে সামলে নিয়ে আবিষ্কার করেছে নিজের টেবিলে! আরো দেখেছে সেতুর অপরপ্রান্তের সাদা কালো ধূসর আলোর চক্রব্যুহে একটি ছায়াছায়া অবয়ব।

সাধনদা সেদিন ফচকেমি করে শুধু বলেছিল, আরে ভায়া দূর থেকে দেখলে হবে! সবাই কাছে গিয়ে আলাপ করে এল। এখন তো লাইন পড়ে গেছে। দেখ, তোমার নাম্বার কখন আসে!

পল্লব হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। মুখে বলেছে, এসব ফটোগ্রাফির অ্যাঙ্গেল। আপনি বুঝবেন না!

পরদিন দুটো ঘটনা ঘটল অফিস ও বাড়িতে । অফিসে লাঞ্চের সময় ডোর ক্লোজড ঝুলিয়ে দেওয়ার পর মিনি রেস্টুরেন্টে পরিণত হয় টেবিলগুলো। হৈ হল্লার হাট বসে। গল্পগাছা হয়। একতলার অফিস স্টাফেরাও এসে জোটে। অ্যাকোয়াগার্ড আর বেসিনের সামনে লাইন পড়ে। এসব জটলা হালকা হালকা ছুঁয়ে পল্লব নিজের মত টেবিলের এক কোণে বসে খাবারটি খেয়ে নেয়। সেদিনও খাওয়া সেরে অ্যাকোয়াগার্ডের সুইচ অন করে পাইপের নীচে জলের বোতলটি রাখতে যাবে ঠিক তখনই অন্য প্রান্ত থেকে আরেকটি বোতল এগিয়ে এল। ফলত বাধ্য হয়ে তাকাল পল্লব। খুব স্বল্প সাজসজ্জা– অথচ এক অদ্ভুত আলো ঘিরে রেখেছে মেয়েটিকে। লম্বা মজবুত মোটা গুছির বিনুনি কাঁধের দুদিক থেকে শিকলের মত পেঁচিয়ে নেমে গেছে। দুধসাদা গায়ের রঙে একটি ধূসর সবুজাভ বসন সে অবয়বকে ঘিরে রেখেছে। বিষাদমাখা মুখে এক কৌতূকী দৃষ্টি পল্লবকে বলে–

আপনিই আগে নিন পল্লববাবু!

অপরিচিত মহিলার মুখে অতি সহজ তরলতায় নিজের নাম উচ্চারিত হতে দেখে যারপরনাই হতচকিত হয়ে যায় পল্লব। দ্রুত জল নিয়ে নিজের টেবিলে ফিরে আসে।

পরের ঘটনাটি ঘটল রাত্তিরে, যা অনেকাংশেই অবধারিত ছিল। বিদেশফেরত টুসিরা এসেছে। মা বারংবার মনে করালেও পল্লব মনে করার কোনো চেষ্টাই করেনি। চার পাঁচ বছরের একটি মেয়ের মুখ আঠার উনিশ বছর পরে একই রয়ে যাওয়া বড়ই বিস্ময়ের। নীচ থেকে মায়ের ক্রমাগত ডাকাডাকিতে একটু বিরক্তই হয় সে। সামনেই তার আলোকচিত্রের প্রদর্শনী আছে। ছবির এডিটিং, ঝাড়াই, বাছাই , ওয়াটার মার্ক বসানো এসব প্রচুর বাকি। তাও ভদ্রতার খাতিরে নীচে নেমে আসে সে। ডাইনিং হলে নেমে দেখে শান্ত সমুদ্র স্রোতের মত একটি মেয়ে বসে আছে। দূর্দান্ত উচ্ছ্বাস নেই তার। অথচ পারে বসে নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ক্যামেরার লেন্স তখন ভর করেছে পল্লবের মস্তিষ্কে। মেয়েটির চোখের মণি কী গভীর নীল! বাঙালি মেয়ের চোখ অত নীল কিকরে হয়! নাকি বিদেশে বসবাসের সূত্রে সে আবহাওয়ায় এই পরিবর্তন । পল্লবের যাবতীয় ভাবনাকে বিচ্ছিন্ন করে একটি রিনরিনে কণ্ঠস্বর –

পল্লবদা আমায় চিনতে পারছ?

পরের ঘটনাক্রমে পল্লব, সাধনদা, টুসি বা পল্লবের অফিসে আসা নতুন মেয়েটি , সমান্তরাল কেন্দ্রবিন্দুর স্নেহময়ী নারী প্রত্যেকে ঘুরতে থাকে নিজের নিজের আবর্তে। টুসির সঙ্গে ফটোগ্রাফির গল্প দিয়ে গল্পের সূচনা হয়ে গল্পে সেতুপথটি পল্লবের স্বপ্নে এসে সমাপ্তির বীজ বোনে। যে বীজ পল্লবিত হয়ে জন্ম দেয় নতুন গল্পকথার। কথায় কথায় টুসি এখন জানে পল্লবের স্বপ্নের গল্প। আর পল্লব আজকাল অদ্ভূত খুশিতেই আছে– এখন সে জানে তার স্বপ্নের বাস্তবতা আছে। টুসির মুখে শুনেছে, টুসিরা আমেরিকায় যেখানে থাকত সে অবস্থান থেকে এ অসম্পূর্ণ সেতু বেশি দূরের পথ না।

জানো পল্লবদা, লোকমুখে প্রচলিত যুবক যুবতীর অসম্পূর্ণ প্রেমের উপাখ্যান এই অসম্পূর্ণ সেতু। অপর পারে প্রেমিকা অপেক্ষায় আছে জেনেও প্রবল বর্ষণে যেতে পারে না প্রেমিক। অগত্যা শয়তানের সাহায্যে একটি একটি পা ফেলে আর পাথর ছুঁতেই তা সেতু হয়ে যায় , কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগে অন্যপারে যেতে না পারলেই প্রেমিকের মৃত্যু হবে। মৃত্যুভয়ে চিন্তিত দেখে দয়ালু ভগবান সময়ের আগেই ভোরের আলো ফুটিয়ে দেয়। কিন্তু তখনও সে সেতু সম্পূর্ণ হয় নি। সেই থেকে ঐ সেতু নড়বড়ে হয়ে দুলছে। …

শুনতে শুনতে নিজেকে খাদের এপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ মনে হচ্ছিল পল্লবের

আচ্ছা টুসি! অসম্পূর্ণ সেতুর ওপারে কি দেখলে তোমরা?

সেতু এত বিস্তৃত যে আরপার চোখে ঠেকে না।

অসম্পূর্ণ সেতু পল্লবকে বারবার টুসির কাছে টেনে নিয়ে যায়। পল্লব হন্যে হয়ে খোঁজে সেতুর আরপারে কি কিছুই নেই! ওদিকে দুই বাড়ির বাবা মা এদের ঘন ঘন মিল দেখে চার হাত এক করে দেওয়ার স্বপ্ন বোনে। বিয়ের প্রসঙ্গ সামনে এলে পল্লব গম্ভীর মুখে টুসিকে বলে,

তুমি আর আমাদের বাড়ি এখন এস না। বিয়ের আগে লোকজনে পাঁচকথা বলবে। তাছাড়া তোমার বাবা মাকে একটু বোঝানো দরকার, অসম্পূর্ণ সেতুর ওপারের ছবিটা সম্পূর্ণ হবে না নইলে। সে ছবি সম্পূর্ণ না হলে কিভাবেই বা বিয়ে হয়!

পল্লবদাকে টুসির খুব ভালো লাগে। কিন্তু তার মনে অদ্ভুত এক দোলাচল পল্লবদা কি তাকে ভালোবাসে? ভালোবেসে তার কাছে আসে! না কি অসম্পূর্ণ সেতুর গল্পেই এত টান! নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে টুসি। পল্লবও নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলার দিকে তাকায় । তার জানলা থেকে যদি সেতুর এ প্রান্ত শুরু হয় তো অন্য প্রান্ত টুসির বাড়ির জানলায় শেষ হবে— শান্ত সমুদ্র চোখ নিয়ে যেখানে এক নারী বসে আছে। খুব স্বস্তির এক ছবি। কিন্তু কোথায় সে কুয়াশাঘেরা দূর্নিবার ঘোর! প্রবল অনিশ্চিত জেনেও যার চুম্বকে ছুটে যাবে জীবন। এ তো তার স্বপ্নের সেতু নয়! অসম্পূর্ণ অনিশ্চিতের সঙ্গে টান দেওয়াদেওয়ির খেলা কি তবে পল্লব উপভোগ করে!

একটু অন্যরকম করে ভাবতে শুরু করে সে। যদি একাই ঐ অসম্পূর্ণ সেতুর দেশ থেকে ঘুরে আসতে পারে! যেতে না পারলেও টেকস্যাভি পল্লব গুগলে সে সেতু খুঁজে নেয়। সেতুর গল্প একই। সেতুর আরপারে নাকি ধূ ধূ প্রান্তর জুড়ে টুসটুসে নরম আলতো গোলাপি রঙের ঢেউ চোখে পড়ে কচ্চিৎ। লোকে বলে ওগুলো একরকমের ফুল। তবু মাঝে মধ্যে পল্লবের মনে হয় যদি নিজে চোখে দেখতে পেত! সে একাই ঐ অসম্পূর্ণ সেতুর দেশ থেকে যদি ঘুরে আসতে পারত! অসম্পূর্ণতার শেষ সীমায় পৌঁছে যদি অন্য পারের অদ্ভূত আশ্চর্য ফুলের ছবি তুলে আনতে পারে! দুনিয়া জুড়ে হৈ চৈ পড়ে যাবে। মনে মনে ভেবেই তৃপ্তি পায় সে। আরো আনন্দ হয় এই ভেবে যে তার ঘুমের জগতে আসা স্বপ্নটি প্রতিষ্ঠা পায় তাহলে।

পরের দিন পল্লব অফিসে গিয়ে বসে। এখানে চোখ তুললেই কালো ধূসর আর সাদা আলোর ঘোরলাগা বৃত্তে ছায়াছায়া অবয়ব নড়াচড়া করে। এ এক আশ্চর্য মায়া জগতের ঘোর! দৃষ্টিপথরেখায় কিছু যেন উপস্থিত অথচ তা অবগুণ্ঠন খোলে না। স্পষ্ট শরীর না সে ছায়া। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে পল্লব। তার অফিসের টেবিল থেকে যে নড়বড়ে সেতুর পাথর একটি একটি করে চারিয়ে গেছে সামনের দিকে, চারিয়ে যাওয়া সে পাথরে পা মেপে মেপে এগোয়, আরো এগোয় পল্লব। আজ কেন্দ্রবিন্দু ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে যায় অসম্পূর্ণতার অভিমুখে। আলোর কুয়াশার ইন্দ্রজাল ভেদ করে একটি লালচে আভা ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়।

চমকে ওঠে পল্লব! ঐ মেয়েটা ! কি যেন নাম! টুসি! হ্যাঁ ঐ মেয়েটা বলেছিল, কারা যেন বলে সেতুর ওপারে গোলাপি আভার ফুলেরা খেলা করে। কিন্তু তারা বড় বিষণ্ণ। অসম্পূর্ণ সেতু পেরিয়ে কেউ তাদের কাছে আসতে পারে না! কোনো দেবদূতের দৈববাণী জাদু ঘটাতে পারে না! এ যে শয়তানের অভিশাপ! পল্লব দেখে, এই তো একটি মাত্র পাথর নেই সেতুতে! এ ফাঁকটুকু টপকে যেতে পারলেই বিষণ্ণ কুয়াশার পর্দা তুলে টুসটুসে গোলাপী উজ্জ্বল ফুলের কাছে পৌঁছে যাবে! ঐ তো স্বপ্ন তার!

হতচকিত পল্লবকে ঠেলা দিয়ে সাধনদা চাপা গলায় বলে,

লেন্সে তোমার স্বপ্নকে বন্দি কর! তোমার লাইন এসে গেছে যে ভাই! হ্যাঁ ঐ নতুন মেয়েটাই…

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes