
অর্ণব সামন্ত -র গল্প
কাজলনয়নের কিসসা
(১)
কাবেরী জ্বালানি কুড়াতে কুড়াতে কাজলের কাছে গিয়ে একটু রাগার্ত গলায় বলল , ” বৌ মানুষ অত রুখা সুখা হয়ে থাকলে চলে না। সংসারে কাজে কম্মে মন দাও । ”
কাজল অন্য সময় হলে কাবেরীর কথার ভুল ধরত। বলত , ” বৌ মানুষ কখনও হয় না মা , মানুষী হয়। ”
কিন্তু তার এখন মানসিক অবস্থা সঙ্গীন। মরদ গ্যাছে বারগাঙে মাছ ধরতে। তাই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে হিজল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকল। শাশুড়ির কথার কোনো উত্তর দিল না।
” যাদের সংসার তাদেরই সাড় নেই। মাঝখান থেকে আমি চিৎকার করে জ্বলে পুড়ে মরি। কথায় বলে যার বিয়ে তার সাড় নেই পাড়াপড়শির ঘুম নেই। ” কাবেরী জ্বালানি সংগ্রহ করতে বাগানের অন্য দিকে চলে গেল।
কাজলের আজকে কথা বলতে একদম ভালো লাগছে না। মনের মানুষটা এখন ঢেউয়ের সঙ্গে সংসার করছে। এক সপ্তা হল তাকে ছেড়ে চলে গেছে বারগাঙে। বারদরিয়ায় মাছের সন্ধানে। মাছ কাঁকড়া ঝুড়ি ঝুড়ি আনবে। অশৌচ আচাটায় আছে সে। মানুষ মারা গেলে যে সমস্ত রিচ্যুয়াল করতে হয় সেই সব করে যাচ্ছে। তেল মাখা বন্ধ। সিঁদুর পরা বন্ধ।
কেন এই সব নিয়ম তাকে মানতে হবে ? না যদি মরদকে বাঘে খায় বা তার সলিল সমাধি ঘটে।
কাবেরী আবার ঘুরে ফিরে কাজলের কাছে এল। না এতটা কড়া কড়া কথা মেয়েটাকে না শোনালেই হত ।
তার মনের অবস্থা তো ভালো নয়। কিন্তু তাকে তো স্বাভাবিক করতে হবে। তাই ইচ্ছে করেই কাবেরী বলল , ” তা’ এবেলা কি রান্না করবি রে বৌমা। ”
” পুঁই বিটুলির চচ্চড়ি আর ডাল ” , কাজল নীচু স্বরে উত্তর দিল।
” তো একটু চিংড়ি মাছ দিবি তো ? ” , এই বলে উত্তরের আশায় কাজলের মুখের দিকে তাকাল কাবেরী।
” হ্যাঁ , মা চাক জাল দিয়ে পুকুর থেকে ঘুষো চিংড়ি ধরেছিলাম সেগুলো দিয়ে দেব ।”
” আমি তোর দুঃখ বুঝি রে , কাজল। ব্যাটাকে তো বললাম আর যাস না বার গাঙে। যা টাকা জমেছে তা’ দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করে দে। তো শোনো কে কার কথা। ” কাবেরীর গলায় মৃদু অনুযোগ , অভিযোগ।
” ক’ টাকা আসে মা মাছ কাঁকড়া বিক্রি করে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় মা।”
” কই গেলি রে নয়নের মা। তুই কি ডুমুরের ফুল হয়ে গেলি একদম। তোর আর দ্যাখা সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। ” সুমিত্রা এই কথাগুলো বলতে বলতে সদর দরজায় এসে দাঁড়াল।সে এই পাড়ারই প্রতিবেশী মহিলা আরও কয়েকজন মহিলাদের সঙ্গে করে হইহই করে এসে হাজির।
এবার পরনিন্দা পরচর্চার হাট বসে গেল। পাড়ার যাবতীয় খবরের আদান প্রদান শুরু হয়ে গেল।
কাজল বলল , ” মা আমি রান্না করতে গেলাম।”
কাবেরী সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বলল , ” তাই যাও বৌমা। তবে অন্যমনস্ক হয়ে রান্না বান্না কোরো না হাত পা পুড়বে। ”
কাজল রান্না ঘরে গিয়ে শুনতে পাচ্ছে গল্প চলছে ফুলদমে। কখনও হাসির হিল্লোল , কখনও কান্নার রোল। কখনও সংলাপ , কখনও বিলাপ। হাওয়ায় ভেসে সেই গল্পগুলো পরিস্কারভাবে শোনা যাচ্ছিল কাজলের কানে । কখনও বা হাওয়ার দিক পরিবর্তনে সেই সব গল্প ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তাদের অদূরেই রান্না করছিল কাজল। সে সবেমাত্র মনে করেছে নয়নের কথা অমনি ওদিকে তার শাশুড়ি কাবেরীর বিলাপ শুনতে পেল। কাবেরী চেঁচিয়ে বলছিল , ” ঐ গাঙ আমার সব কেড়েছে গো । নয়নের বাপকে খেয়েছে। নয়নের বাপের বাপকে খেয়েছে। তার জন্য তো আমি ছেলেকে জলে জঙ্গলে পাঠাতে চাই না । কিন্তু নিয়তি। জঙ্গলে বারগাঙে না গেলে খাব কি ? ”
” একদম ঠিক বলেছো গো । ঝন্টুর বাপটা ঐ করে ম’লো। ” সুমিত্রা সায় দিল।
” আমাদের বিধবা পল্লীর নিয়তি তাই গো । ঘরে থাকলে খিদেয় মরা। বাইরে গেলে বাঘের আক্রমণে মরা । বারদরিয়ায় সলিল সমাধিতে মরা। কারুর হাত থেকে রক্ষা নেই গো। ” কাবেরীর সোজাসাপটা কথা।
” সেবার যখন নয়নের বাপ গেল জঙ্গলে দুগ্গাপূজার আগে ভাগে। বলে গেল , ‘ নয়নকে চোখে চোখে রাখিস্ , নিজেও সাবধানে থাকিস্ । ‘ শেষমেষ আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। বলেছিল জঙ্গল থেকে ঘুরে এসে বালুচরী শাড়ি কিনে দেবে । গয়না গড়িয়ে দেবে। সব মিথ্যে। সব ফাঁকি। ”
” শান্ত হও গো নয়নের মা। অত উতলা হোয়ো না। তুমি ভেঙে পড়লে সংসার ধরে রাখবে কে। ” অপর্ণা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল।
” না আমার তো উতলা হবার তো কিছু নাই গো । ছেলেটার জন্যে অনেক চিন্তা হয় , ভাবনা হয় । বৌমাকে বকি ওকে স্বাভাবিক করার জন্যে। ওর মনের মধ্যে যে কি চলে আমি কি বুঝি না। সমস্ত বুঝি কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাদের বাঁচার জন্য আমার ছেলেটাকে বারবার মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেই গো। কেমন মা আমি। মা না রাক্ষসী । রাক্ষসীরা বোধহয় এত নিষ্ঠুর আর কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ছিল না। ” এই বলে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল কাবেরী।
” কতদিন না তোমাকে এই সমস্ত কথাবার্তা বলতে বারণ করেছি আমি। আর কখনও এরকম বলবে না।” কাবেরীকে জড়িয়ে তার কপালে , মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল কাজল। মৃদু স্নেহের ধমক দিয়ে বলল , ” আর একদিন এরকম কথা শুনি তখন দেখবে আমার একদিন কি তোমার একদিন। ”
সুমিত্রা বলল , ” আসি গো কাবেরী এখানকার মতো। বেলা যে পড়ে এল গো । ঘরের সবাই আবার আমার জন্য অপেক্ষা করবে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। ” সুমিত্রাসহ মহিলা দল একসঙ্গে প্রস্থান করল কাবেরীর ঘর থেকে।
(২)
সকাল না হতে হতেই খবরটা হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল মহামারীর মতো। তিনটে গ্রুপ গিয়েছিল বারগাঙে মাছ ধরতে। তার মধ্যে দু’টো গ্রুপ ফিরে এসেছে কোনো ক্রমে । একটা গ্রুপের চার জনের মধ্যে তিনজনই নাকি মারা গেছে। একজন নিখোঁজ। খবরটা বিধবা পল্লীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে। পাঁচ থেকে পঁচানব্বই সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছে। খুব ভোরের দিকে কে একজন নাকি কাছেই বাজারের দিকে যাচ্ছিল সেই খবরটা দিয়েছে। শেষমেষ খবর পাওয়া গেল নয়নের দলেই এই ঘটনাটা ঘটেছে। নয়নের মা কপাল চাপড়ে , বুক চাপড়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
” আমি জানতাম এরকম কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ছেলেটাকে বললাম অল্পস্বল্প পুঁজি যা আছে তা’ দিয়ে ব্যবসা কর। শুনল আমার কথা। সেই বাপের পথেই গেল। ” কাবেরী বিলাপ করতে করতে বলল।
” মা এই রকম অলক্ষুণে কথা কেউ বলে। তুমি না মা। মা হয়ে সন্তানের নামে এই সমস্ত কথা কেউ বলে । ” পাড়ার এক বৃদ্ধা মহিলা দুর্গাময়ী দেবী কাবেরীকে বিলাপ করতে বারণ করল ।
” তুমি জেনেশুনে এই কথা বললে , পারলে কথাগুলো বলতে।” কাবেরী ফোঁস করে উঠল।
” হ্যাঁ , এই কথাগুলো বলতে পারলাম। এই জঙ্গল , এই বারদরিয়া আমার সমস্ত কেড়ে নিয়েছে। আমাকে অনাথ করে দিয়েছে। তবুও আমি বলছি আগে সঠিক খবরটা শোন তারপর বিচার কর ।” দুর্গাময়ী জোর দিয়ে বলল।
এই দুঃখের মধ্যেও একটা কথা হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো খেলে গেল কাবেরীর মাথায় । সে সবাইকে অনুনয় বিনয় করে বলল , তোমাদের সবাইকে আমার একটাই অনুরোধ এই কথাটা কোনোক্রমে যেন আমার বৌমার কানে না ওঠে। তাহলে একদম মরে যাবে সে । ” সবাইকে সে আস্তে আস্তে সেখান থেকে চলে যেতে বলল আর নিজেও কান্না থামিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগল।
তবুও কি এক মুহূর্তে ভিড় কমে । আলোচনা সমালোচনা চলতেই থাকল।
” এরকম বিপদ যেখানে সেখানে তো মানুষ না গেলেই
পারে। ” সরমা জোর সওয়াল করল।
” হ্যাঁ পারে বইকি । কিন্তু লোভ সম্বরণ করতে ক’জন পারে । খাঁড়িতে খাঁড়িতে যা মাছের আমদানি চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। জাল টানার পর যেরকম ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ওঠে তেমনি মাছের ভিড় সেখানে। ” শর্মিলা সওয়ালের নিরসন করে উত্তর দিল।
” তবু কি নিজেকে একদম সামলাতে পারে না মানুষ ?। ” সরমার কথায় আবার জিজ্ঞাসা।
” আরে ও তো ড্রাগের নেশার থেকেও সাংঘাতিক। মরে যাবে জেনেও ঐ মাছ ধরার নেশা ছাড়তে পারে না। ” শর্মিলা বোঝাতে চেষ্টা করল।
” বারগাঙ বা বারদরিয়ায় যায় কেন ? ” সরমার আবারও প্রশ্ন করল।
” সব ঐ মাছের নেশায় রে সব ঐ মাছের নেশায় ” , শর্মিলা সুনিশ্চিত করতে চাইল , ” তারপর যা হয় লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। এটাই এই বিধবাপল্লীর নিয়তি। ঘরে থাকলেও খিদেতে মৃত্যু আবার জঙ্গলে , বারদরিয়ায় গেলেও মৃত্যুর হাতছানি। সুন্দরবনের এই বিধবাপল্লীর ছেলেদের এই নিয়তি। তাদের বাঁচার পথ নেই। ”
সদ্য গ্রাজুয়েশন পাশ করা সরমা বলে উঠল , ” একদম সেই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দি ওল্ড ম্যান ইন দ্য সি -এর মতো সিচুয়েশন। ”
” তা’ বলতে পারিস ” , শর্মিলা সরমার সঙ্গে একমত হয়ে বলল।
এমন সময় ঝড়ের বেগে ছুটে আসল কাজল। উদভ্রান্ত , আলুথালু কেশ , অসম্বৃত আঁচলে তাকে পাগলির মতো লাগছিল।
কাবেরীকে উদ্দেশ্য করে কাজল উচ্চৈঃস্বরে আর্তনাদ করে উঠল , ” মা কি শুনছি এসব , তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানো ? ”
কাবেরী যে আশঙ্কা করছিল সেটাই ঠিক হল। এই ভিড়ভাট্টা , কোলাহল কাজলকে টেনে এনেছে ঘরের ভিতর থেকে। সে কি বিপদের সমস্তটা জেনে গিয়েছিল ?। পইপই করে দেওয়ার পরও পাড়ার লোকজন শোনেনি তার কথা।
সামাল দেওয়ার জন্য নিজের শোক চেপে রেখে কাবেরী বলল , ” খবরটা কতখানি ঠিক যারা গিয়েছিল তাদের কারুর সঙ্গে দেখা না হলে বোঝা যাচ্ছে না। ” এখনও আশায় বুক বাঁধতে ইচ্ছা করছিল কাবেরী। তবু মনে সংশয় কি হবে কে জানে।
ইতিমধ্যে ছিদাম এসে হাজির। সে অন্য নৌকার দলের সঙ্গে গিয়েছিল।
” নয়নের দলের সুদীপ্তকে বাঘে খেয়ে ফেলেছিল। তখন ওদের দলে ছিল প্রশান্ত সুকান্ত আর নয়ন। ঐ তিনজনের লাস্ট দ্যাখা হয়েছিল অপূর্বদের দলের সঙ্গে।” প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলেছিল ছিদাম। ছিদাম তখন সোস্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটির মতো। হাজার লোকের হাজার প্রশ্ন তাকে ঘিরে।
ভিড়ের সবাই উৎসুক হয়েছিল ছিদাম আর কি কি খবর দেয় তার জন্য।
ভিড়ের মধ্য থেকে শ্যামল বলে উঠল , ” তো তোমার সঙ্গে যখন নয়নের দলের লোকজনের সঙ্গে দ্যাখা হয় তখন জিজ্ঞেস করনি কিভাবে মারা গেল সুদীপ্ত।
” হ্যাঁ , জিজ্ঞেস করেছিলাম বই কি। তাতে ওরা যা বলল সেটা হল নয়ন নৌকাতে ছিল। সুকান্ত প্রশান্ত সুদীপ্ত খাঁড়ির জলে নেমেছিল মাছ ধরতে । নয়ন ওদের বারণ করেছিল। ” ছিদাম কথা বলতে বলতে একটু থামল।
নয়ন বলল , ” এই তোরা এখানে নামিস্ না। দেখছিস্ না কালো পতাকা পোতা আছে এখানে। ”
সুদীপ্ত একনিমেষে তার কথা উড়িয়ে দিয়েছিল , ” তোর যত রাজ্যের কুসংস্কার। আদৌ এখানে বাঘের আনাগোনা আছে কিনা তার কোনো প্রমাণ আছে ? ওতো জাস্ট সতর্কীকরণের জন্য করেছে।এক আঁচলায় কেজি কেজি মাছ। আমি এ জায়গা ছেড়ে এখন যাচ্ছিই না। ”
বেগতিক দেখে নয়ন আর কিছু বলেনি।
প্রশান্ত একবার ফিরে যাবার কথা তুলেছিল , ” এই নয়ন যখন অত করে বলছে চল না অন্য খাঁড়িতে যাই । ”
” তুই থাম তো। নয়ন ভীতু কোথাকার একটা। আমাদের উদ্দেশ্য মাছ ধরা আর মাছের ঘনত্ব যখন এখানে বেশি তখন এখান ছেড়ে যাব কেন ? ” , কারুর কথার তোয়াক্কা না করে সুদীপ্ত আরও খাঁড়ির ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।
তারপরই ঘটে বিপত্তি। কিছু বোঝার আগেই মুহূর্তের মধ্যে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার এসে সুদীপ্তর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে তাকে নিয়ে দ্রুতই সেখান থেকে প্রস্থান করে। কার্যত সবাই হতভম্ব , কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিল। হুঁশ ফিরলে পালিয়ে গেছিল সেখান থেকে ।
” এরপরে কি ঘটেছিল ? ” , উৎসুক জনতার মধ্যে অমল চিৎকার করে বলেছিল।
” এরপরের ঘটনাটা আমি জানি না। অপূর্বদের দলের কেউ বলতে পারবে। ” ছিদাম স্বীকার করে নিয়েছিল।
” আমি জানি এরপরের ঘটনা ” , ভিড়ের থেকে অনতিদূর থেকে কেউ চিৎকার করে বলে উঠল। কাছে আসতে চেনা গেল যে সে অপূর্ব।
” বারদরিয়ায় যখন আমরা মাছ ধরতে যাই তখন আমাদের নৌকা থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ছিল নয়নদের নৌকা। যদিও তাদের মুখ স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না আমরা যেখানে ছিলাম সেই দূরত্ব থেকে। হঠাৎ দেখি নয়নদের নৌকা উঁচু ঢেউয়ের ঢাক্কা সামলাতে না পেরে জলের তলায় তলিয়ে গেল। ” অপূর্ব এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল। আবেগপ্রবণ ও উত্তেজিত হয়ে অপূর্ব হাঁপাতে শুরু করল। যেন এইমাত্র চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটল।
অপূর্ব যখন এই ঘটনাটি বর্ণনা করছিল তখন কাবেরী , কাজল দু’জনের কেউই সেখানে ছিল না। কয়েকজন প্রতিবেশিনী মহিলা তাদেরকে নিয়ে ঘরের ভিতরে গিয়েছিল চোখে মুখে জল দিতে ও জল খাওয়াতে। সমবেত জনতার বয়স্ক লোকেরা অপূর্বকে বারণ করল এই সব ঘটনা কাবেরী ও কাজলকে জানাতে।
” যে গেছে সে গেছে। যারা বেঁচে রয়েছে তাদেরকে মিথ্যে বলে যদি বাঁচিয়ে রাখা যায় তা’ কিন্তু সত্যের অধিক। তখন মঙ্গলকারী মিথ্যে সত্যের অধিক বলে প্রতিপন্ন হয়। ” , নীলোৎপল তার অভিমত ব্যক্ত করল।
তরুণদের মধ্য থেকে মৈনাক বলল , ” কিন্তু সত্যিটা তো একদিন জানবেই তখন কি হবে ? আমার মনে হয় এখনই ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়া ভালো।”
” যখন জানবে তখন জানবে । তখন বেশ কিছুদিন চলে যাবে। পরিস্থিতি সামলে ওঠার মানসিক শক্তি ফিরে পাবে ” , নীলোৎপল বয়স্কদের প্রতিনিধি হয়ে এই কথাগুলো বলল। সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
” তবে তাই হোক ” , মৈনাক সব শ্রোতাদের প্রতিনিধি হয়ে মেনে নিল।
(৩)
না জানালে জানবে না ব্যাপারটা তেমন নয়। কাবেরী , কাজল দু’জনেই টের পেয়ে যায় দুর্ঘটনার। আর মেয়েদের পেটে কথা থাকে না। তাই একদিন নয়ন ও তার দুই সঙ্গীর মৃত্যুর কথা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এছাড়াও আর একজন সঙ্গী যে বাঘের শিকার হয়েছে সেটা প্রকাশ্যে প্রথমে সবাই জেনেছে।
এবার সত্যি সত্যি সব রিচ্যুয়াল মেনে কাজল বিধবার
জীবন কাটাচ্ছে। তবুও কাবেরী এই সত্যটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি যে নয়ন আর বেঁচে নেই। কাজল একদমই মেনে নিতে পারেনি। সে সবসময় অন্যমনস্ক থাকে আর ভাবে এই বুঝি নয়ন এল। আগে দু’বার এরকম ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রথমবার যখন নয়ন ঘরে ফিরেছিল তখন ছিল রাত। বাইরে মাটির উনুনে রান্না করছিল কাজল। পেছন থেকে নয়ন পা টিপে টিপে এসে ওর দু’টো চোখ চেপে ধরে বলেছিল ” ওগো কাজলনয়না ” ।
কাজল সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল , ” ” হরিণী।”
” হরিণী নয় বাঘিনী ” , নয়ন হাসতে হাসতে বলেছিল , ” বাইরে বনের বাঘিনীকে সামলানো সোজা ঘরের মনের বাঘিনীর চেয়ে। ”
” তুমি বাঘ বাঘিনী নিয়ে এরকম ঠাট্টা করছো , কোরো না একদম ” , কাজল নয়নকে ভয় দেখানোর ছলে বলেছিল।
” সত্যি বিশ্বাস করো কাজু বাঘিনী অনেক হিংস্র কম হয় বাঘের থেকে। বাঘিনী যখন বাচ্চা প্রসবের জন্য লোকালয়ে ধানক্ষেতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু তারা লোকের তেমন ক্ষতি করতে চায় না। হয়তো খিদের জ্বালায় দু’ চারটে ছাগল গরু মেরে ফেলে। মানুষের অত্যাচারে অসহ্য হয়ে তারা মানুষকে আক্রমণ করে। ” নয়ন বাঘিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল।
” আর সাফাই গেয়ো না বাঘিনীর হয়ে। বাঘ যা হিংস্র বাঘিনীও তাই ” , কাজল প্রসঙ্গান্তরে যেতে চেয়েছিল ,
” সুযোগ পেলেই দু’টোই মানুষের প্রাণনাশ করে।”
দ্বিতীয়বার যখন ফেরে মরে যাবার খবর রটে যাবার পর তখন সত্যি সত্যিই নয়নের আশা ছেড়ে দিয়েছিল কাজল ও কাবেরী। এক ঝড়ের রাতে সে ফিরেছিল দিশেহারা নাবিকের মতো। ফিরেই সদর দরজায় টোকা দিয়ে বলেছিল , ” কাজু , দরজা খোলো “।
কাজলের খোচায় কাবেরী জেগে গিয়ে বলেছিল , ” বৌমা দরজা খুলিস্ না। অনেক সময় নিশিতে ডাকে। একদম চেনা মানুষের চেনা সুর নকল করে।”
” মা আবার ডাকছে ” , কাজল ভয়ে জড়সড় হয়ে বলেছিল।
” ডাকুক। আগে তিনবার ডাকুক। তারপর সাড়া দিবি , দরজা খুলবি ” , কাবেরী কাজলকে সতর্ক করে বলেছিল , ” আমাদের পাড়ায় অনেকেই এরকম নিশির ডাক হামেশাই শোনে।
তিনবার কাজলকে ডাকার পর কাজল দরজা খুলে যখন নয়নকে আবিষ্কার করেছিল তখন তাকে সত্যি সত্যিই ভুতের মতো লাগছিল। এত কিছুর পরেও কাজলের মন , কাবেরীর মন কিছুতেই মানতে চাইছিল না যে নয়ন বেঁচে নেই।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। প্রতিবেশিনী সুমিত্রা বুঝিয়েছিল , ” শোন কাজল ভবিতব্যকে , নিয়তিকে মেনে নিতে হয় । তার জন্যে হাহুতাশ , শোক , বিলাপ করে লাভ নেই । ”
কাবেরী বলেছিল , ” আমি তো বুঝেছি কাজলকে বোঝা। ওর মুখের দিকে আজকাল আর তাকাতে পারি না। কচি বয়েস ওর কি আর সহ্য করার সেই ক্ষমতা হয়েছে। ”
সুমিত্রা কাজলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল , ” বৌমা মন খারাপ করিস্ না। আমরা তো আছি। তোর দুঃখ কষ্ট শোক ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে পারবি না।”
” সবই আমার কপাল গো মাসি সবই আমার কপাল ” , কাজল অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল।
নয়নের মরার খবর আসার পর চারদিন হয়ে গেল। এদিকে আবার নিম্নচাপ শুরু হয়ে গেছে। আকাশটা হয়েছে ছিঁচকাদুনে। প্রত্যেক মাসকে বর্ষাকাল বললেও বলা যায়। যখন তখন নিম্নচাপ। আর ঝড় বৃষ্টি। সন্ধ্যে সন্ধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়েছিল কাবেরী ও কাজল । ঘুম আসবে আসবে করছে এমন সময় বাজখাঁই গলায় কেউ , ” নয়নের মা ঘরে আছিস্।
নয়নের মা .. । নয়নের মা দরজা খোল। ”
ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে গেছিল কাবেরী , কাজল। আবার সেই বাজখাঁই গলা চিৎকার করে বলে উঠল , ” আমি সুজন নয়নের মা। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। নয়নকে নিয়ে এসেছি।”
ধড়ফড় করে উঠে বসল দু’জনে । দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল কাজল। দেখল নয়ন ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুজন কাকুর কাঁধে। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না কাবেরী ও কাজল। কি করে এরকম সম্ভব হল।
” আমার নয়নকে কোথায় পেলি সুজন ” , বলে সুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল কাবেরী। কাজলও দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল।
” তোমরা কি শুধুই কান্না কাটি করবে নাকি ছেলেটাকে নিয়ে একটু ঘরের মধ্যে বসাবে। তার ভেজা জামা কাপড় চেঞ্জ করে শুকনো জামা পরাও। তাকে রেস্ট নিতে দাও। খাবার দাবার কিছু খেতে দাও।” সুজন দৃঢ় স্বরেই কথাগুলো বলল।
তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আস্তে আস্তে সুজন বলতে শুরু করল , ” আমরা ছিলাম অন্য নৌকায় অন্য দলে। অপূর্বর মুখে শুনলাম নয়নদের নৌকাটা কলার মোচার মতো ডুবে গিয়েছিল। আমরা অন্য দিকে ছিলাম। অপূর্বদের নৌকা আমাদের ছেড়ে অন্য দিকে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে আশ্চর্যজনকভাবে
আমি দেখতে পেলাম দূরেই একটা নৌকা উল্টো ভাসছে। আর তার উপরে কেউ শুয়ে আছে লেপ্টে।”
” তারপর কি হল গো সুজনকাকু। ” কাজল আগ্রহ ভরে বলে উঠল।
” শোনো বৌমা , মাছধরা ছেড়ে আমরা ছুটলাম সেই নৌকার দিকে। দেখি অজ্ঞান হয়ে নৌকার উপরে লেপ্টে শুয়ে আছে নয়ন। ওর সঙ্গের দু’জন জলে তলিয়ে গেছে। তারপরে ওর সেবা শুশ্রূষা করে আমাদের কাজ গুছিয়ে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল। ” সুজন একটু ক্লান্ত স্বরে বলল।
” সে যাই হোক কোলের ছেলেকে কোলে ফিরে পেয়েছি । ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে বড়ো পাওনা আর কি আছে ! ” , কাবেরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
” আসি তাহলে নয়নের মা ” , সুজন বলল , ” নয়নকে সাবধানে রাখবে কিছুদিন। ”
” ঠিক আছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। ভগবানের অশেষ করুনা আমাদের উপর। তোমার এ ঋণ জীবনে শোধ করতে পারব না। ” কাবেরী খুব আবেগপ্রবণ হয়ে বলল। সুজন বিদায় নিয়ে চলে গেল।
কাবেরী ও কাজল নয়নের দু’হাত ধরে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে তাকে বিছানায় বসাল।
নয়ন ক্ষীণ স্বরে ভীষণ ক্লান্ত ও আচ্ছন্নভাবে বলল , ” তোমরা আমাকে কিছু খেতে দাও। আমি এবার একটু ঘুমোব , আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ”
কাজল দ্রুত পায়ে খাবার আনতে গেল। কাবেরী নয়নের পাশে বসে নয়নের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল ।
কাবেরী নয়নকে উদ্দেশ্য করে স্নেহপ্রবণ গলায় বলে উঠল , ” কিছু চিন্তা করিস্ না নয়ন সব ঠিক হয়ে যাবে। ক’টা দিন ভালো করে বিশ্রাম নে , খাওয়া দাওয়া কর , ঘুমো , দেখবি তুই সুস্থ হয়ে উঠবি। যা ঘটার ঘটে গেছে ওসব নিয়ে আর ভাবিস্ না। ”
নয়ন শুধু মাথা নেড়ে বলল , ” হুঁ , মা।”
কাবেরী একটু চেঁচিয়ে ডাকল কাজলকে , ” কই রে বৌমা কোথায় গেলি ? খাবার নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। ”
কাজল উত্তর দিল , ” হ্যাঁ , মা এখুনি যাচ্ছি খাবার নিয়ে। ”
বাইরে এতক্ষন ঝড়বৃষ্টি মৃদুভাবাপন্ন হয়ে ছিল। আবার মুষলধারে বৃষ্টি ও ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়ে গেল।