
উপন্যাসের অলিগলির রন্ধ্রে মধ্যবিত্ত সাধারণ নারী জীবনের জ্বালাময়ী দলিল: অসতী জীবন
সোনালী চন্দ
'অসতী জীবন ' পুস্তক মূল্য- ৩০০ টাকা মাত্র প্রচ্ছদ- নিমাই গরাই প্রকাশক- লালমাটি প্রকাশন ৩, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট যোগাযোগ- 9143229585 / 2257 3300 মেল- lalmatibooks@gmail.com ISBN- 978- 81- 19723-52-2 প্রথম প্রকাশ- কলকাতা বইমেলা ২০২৪
কোনও উপন্যাস যখন জীবনের রূঢ় অথচ বাস্তব চিত্র সামনে তুলে আনে, পাঠকের কাছে তখন আর তা উপন্যাসের নিছক গল্প থাকে না, তার হয়ে ওঠে জ্বলন্ত দলিল। ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সাহিত্যিক , অধ্যাপিকা অহনা বিশ্বাসের ‘অসতী জীবন’ সেইরকমই এক অভিনব উপন্যাস যাকে উপন্যাস না বলে জীবনলিপি বলা ভাল।
ঔপন্যাসিক অহনা বিশ্বাসের উপন্যাসের ধারা সম্পর্কে এর আগে আমি অবগত তাঁর ‘কাঁথাফোঁড়ের গ্রাম ‘ পড়ে। তাঁর প্রতিটা ছোট গল্প, উপন্যাস নারীজীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত নিয়ে লিখিত। কিন্ত সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও তাঁর লেখা ‘অসতী জীবন ‘ যেন পাঠক- মানসে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে তোলে। অব্যক্ত এক যন্ত্রণা, যা বুকে বয়ে নিয়ে চলা এক সাধারণ নারীজীবনের কাহিনী যাকে শুধুই উপন্যাস বলা কঠিন; বরং বলা ভাল এমন এক নারীজীবনের কথা আমাদের কাছে তিনি তুলে ধরেছেন যেন সেই জীবন কে পরতে পরতে যত জানা যায়, ততই মনে হয় এই নারী আমাদেরই বড় পরিচিত কেউ।
আমাদের পূর্বপুরুষের/পূর্বনারীদের মধ্যে যে চল ছিল গ্রামীণ কিছু সংস্কারের, তার চিত্র যেন কোনও ক্যানভাসে এঁকে চলেছেন ঔপন্যাসিক অহনা। বরাবরই তাঁর লেখার ধরন এবং চলন পাঠকের কাছে বহু আগে থেকেই সমাদৃত, তবু এমনই এক ভিন্ন আঙ্গিকের উপন্যাস ‘অসতী জীবন ‘ যা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, হয়ত আমাদেরই কারুর জীবন বৃত্তান্ত তিনি ভীষণ পরিমার্জিত ভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর পাঠকের কাছে।
গল্পের মূল চরিত্র যথারীতি এক নারী অণু। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর মৃত্যু সংবাদের একখানা কার্ড মেয়ে অণুর কাছে এসে পৌঁছয়। গল্পের শুরুতেই জানা গেল অণু রা চার বোন, এক ভাই, সকলেই এ বঙ্গ ও বঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে ( হয়ত দেশ ভাগের কারণে, যা অব্যক্ত) মায়ের শেষের দিনগুলো অণুর মামা অর্থাৎ তার মায়ের ভাইয়ের কাছে কেটেছিল এবং সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গল্প যত এগিয়েছে ততই ধীরে ধীরে জানা গেছে যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে এবং ফোনের ব্যবহার না থাকার কারণে একে অপরের সঙ্গে তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, এমনকি অণুর মনে পড়ে না তার মায়ের মুখ, তার ভাই দিদিদের মুখ।
বিবাহিত হওয়ার কারণে অণুকে তিনদিনে মায়ের আদ্যশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করতে হল। কিন্ত মায়ের কোনও ছবি তার কাছে ছিল না! যদিও সেই অর্থে তার বিয়ে সেভাবে হয়নি। কেন সেভাবে তার বিয়ে হয়নি তা গল্পের পরতে পরতে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে লাগল।
সেই অর্থে সে সুন্দর ছিল না তার নিজের বর্ণনায় তা প্রকাশিত। তাই তার মত উঁচু কপালি, চাপা ,সরু ঠোঁট, নরুনচেরা সরু চোখ, ছাইরঙ্গা বর্ণের মেয়েকে কোনও পাত্র বিয়ে করবে, সেই আশা তাদের ছিল না। গল্পের চলনে আমরা জানতে পারি, অণুর বড় দিদি বেশ সুন্দরী ছিল, কিন্ত তার বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে পুকুরে স্নান করতে গিয়ে সে আর ওঠেনি। আত্মহত্যা? নাকি দুর্ঘটনা?
প্রশ্ন ওঠে। বিয়েতে তার মায়ের প্রভূত খরচ হয়েছিল জানা যায়। শ্বশুরবাড়িতে রয়ে গেল বিয়েতে তার বড় দিদিকে দেওয়া কাঁসার প্রচুর বাসন। মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘরের ঘটনা, সাবলীল ভাবে লিখে যাওয়া আমাদেরই মত কোনও ঘরের বাস্তব জীবনের চিত্র লিখে চলেছেন অহনা বিশ্বাস।
অণুর বাবার মুদির দোকান, একেবারে ঘর লাগোয়া। রোজকার জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। অণু বাবা ঘরে খেতে এলে দোকান সামলাত অণু। পড়াশুনো না জানা অণুর দোকানে বসে হিসেব করতে অসুবিধা হত। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অত্যন্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘরের ঘটনার কথা অহনার কলমে উঠে এসেছে।
হিসেবে গণ্ডগোল করার জন্য বাবার কাছে অণুকে কম মার খেতে হয়নি। অণুর মেজ দিদি হিসাবে পাকা ছিল। অণুর মন পড়ে থাকত জলে জঙ্গলে কাদা জল ঘেঁটে শামুক, পোকামাকড়, সাপখোপের মধ্যে দিয়ে খালি পায়ে ধানক্ষেতের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। বেশীরভাগ সময় সে এই কাজ করে বেড়াত। প্রকৃতির নানা রূপ রঙের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। হরেক রঙের ফুল, পাতা, লতাপাতা দিয়ে গয়না তৈরি করে পরা— প্রকৃতির মেয়ে ছিল সে। কখনও কখনও কাদাজল ঘেঁটে মাছ ধরে জামার পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে ঘরে ফিরত।
মায়ের শ্রাদ্ধ করতে বসে তার সেই জীবনের কথা খুব মনে পড়ছিল। সেই তার গ্রামের মাঠ, কাদা জলে মাছ ধরা, বিভিন্ন ফুল, পাতার সাথে সময় কাটানোর জীবন যেন এক অন্য জন্ম তার।
‘ভাগ্য ‘ শব্দটা যেন তার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল কিভাবে। ভাগ্যের ফেরে আজ সে তার সেই দেশ ছেড়ে এই বাড়ির এক সদস্য যেখানে বড়জোর একখানা নিমগাছ, একখানা শিউলি গাছ আর একটা তুলসী মঞ্চ। গাছপালা বলতে এটুকুই এখানে অণুর গোচরে আসে।
গল্পের চলনে জানা যায় অণু এই বাড়ির ছোট বউ হিসেবে এখানে এসে পড়েছে। অণুর স্বামী সুধীর অণুর মায়ের আদ্যশ্রাদ্ধে পরিপাটি হয়ে ঘুরছে। পাড়ার দু চার ঘর নিমন্ত্রিত যার মধ্যে এক শিক্ষিকাও আছেন। অণুর বড় ভাসুর তাদের বাড়িতে প্রধান। তিনি সেই শিক্ষিকাকে সম্মান করেন। অণুর কথা বলার মানুষের মধ্যে এক এই শিক্ষিকাই আছেন যাঁর সাথে অণুর খানিক কথাবার্তা হয়। তার বড় ভাসুর রেলে চাকরি করেন। সবাই তাঁকে মান্য করে। অণু এই বাড়িতে তার সন্তানাদি নিয়ে এত বছর ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে, কারণ তিন কামরার এ বাড়ির ছোট পরিসরে সকলের নজরে সবাই থাকে।
তার মেজ ভাসুর কাজকর্ম করেন না, মাঝেমধ্যে কীর্তন গাইতে যান কোথাও কোথাও। এমনকি তার স্বামী সুধীরও কিছুই করে না। মেজো ভাসুরের সাথে তাঁর স্ত্রীও মাঝেমধ্যেই যান কীর্তনে। এভাবেই অণুর শ্বশুরবাড়ির সংসার কোনওভাবে চলে যায়।
অণুর শ্বশুরবাড়ির বউদের মধ্যে কোনও কলহ না হলেও তার ভাসুরদের এবং স্বামীর মধ্যে মাঝেমাঝে ঝগড়া ঝামেলা এমন চরমে উঠত যে অণুর ভয় যে কখন কেউ খুন না হয়ে যায়।
একেবারেই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক , এই উপন্যাসে সেই সাধারণ পরিবারের এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এমন একটা নারী জীবন কে অসতী বলে দাগিয়ে দেওয়া হল। কেন? তার এক সম্পর্কিত ভাসুর সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন, তিনি যখন ফিরে এলেন, তিনি তখন নিরামিষাশী সন্ন্যাসী, যাঁর মাছ খাওয়ার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা চাপা পড়ে গেছে দীর্ঘকাল। সমাজকে অর্থাৎ অণুর সংসারের গুরুজন এবং স্বামীর চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে সামান্য মাছ খাওয়ানোর জন্য তাকে অসতী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্ত কেন? তার অপরাধ কি এটাই হল যে একজন মানুষ, যাঁর দীর্ঘ বছরের মাছ খাওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য, তাঁর সেই দীর্ঘ সুপ্ত ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অণুকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল, তাকে তারই তথাকথিত পরিবারের কাছ থেকেই শুনতে হল! এই কি সেই সমাজ যাকে আমরা আমাদের বাসস্থান ভেবে দিনগত পাপক্ষয় করে যাচ্ছি?
জানতে হলে আমাদের ঢুকতে হবে অহনা বিশ্বাসের উপন্যাস ‘অসতী জীবন ‘ এর অন্ধকার গলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সাহিত্য শুধুই ইতিহাস কেন্দ্রিক বা সাহিত্য কেন্দ্রিক নয়, বাস্তব জীবনকে রং তুলিতে ক্যানভাসে শব্দে ফুটিয়ে তোলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কান্ড, যে মেরুদন্ড ছাড়া সাহিত্য নামক গাছ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হয়ত মাটির অনন্ত গভীরে প্রবেশ করে যাওয়া এমন এক পরিপুষ্ট শিকড় যা আঁকড়ে রেখেছে সাহিত্য নামক মহীরুহ কে।
বিশেষ ভাবে আমি সাহিত্যিক অহনা বিশ্বাসের কাছে কৃতজ্ঞ, আমার বিনম্র শ্রদ্ধা এমন একটা জ্বলন্ত দলিল, এমন একটা জীবন দর্শন কে তাঁর কলমে তুলে ধরার জন্য।
‘কাঁথাফোঁড়ের গ্রাম’ , ‘বেগুনী ঘোড়সওয়ার’ এবং আরও বহু উপন্যাস এবং অগণিত ছোট গল্পের স্বনামধন্য লেখিকা, অধ্যাপিকা অহনা বিশ্বাস ‘অসতী জীবন’ এর লেখিকা, যে উপন্যাস টি লালমাটি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত।
সোনালী চন্দ- অনুবাদক, লেখিকা, ভাষাতত্বের গবেষক,
ই এফ এল বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদ ক্যাম্পাস