
পর্ণশবরীর কথকতা ৮ প্রাপ্তি চক্রবর্তী
গাছের কাছাকাছি এসে বসি আমি আজকাল। একাকিত্বের কথা কই ওদের সঙ্গে, ধীরে, ফিসফিসিয়ে.. জানালার কালো বেয়ে লতিয়ে ওঠা নীলকণ্ঠের নীলাভ সবুজ পাতা প্রতি সূর্যবেলায় আমার রক্তের ভেতরে ধীরে ধীরে ঢেলে দিতে থাকে সবুজ প্রাণ। আমি ভাষা বুঝতে থাকি ওদের। ওরাও আমার মতো স্থির, গম্ভীর, বিষন্নতার ভাষা খুঁজে পায়। বুঝি, আসলে গাছেদের সঙ্গে আমাদের অমিল নেই কোথাও। বুঝি কখন ওর শিকড়ের রসের রদবদলের জন্য গোড়ার মাটি আলাগা করে দেওয়া দরকার… তলার মাটি ওপরে আর ওপরের মাটি নিচের দিকে গেঁথে দিলে গাছের শেকড়ের রসে বদল আসে, গাছের প্রাণে আনন্দ হয়; তখন নিঃশ্বাস আর রস এমন ভাবে শুষে নিতে থাকে যেন ওর বহুদিনের জমিয়ে রাখা যন্ত্রণার বোঝা বুকের ওপর থেকে নেমে গেছে। শরীর আলগা হয়ে ধীরে ধীরে ওর পাতায় পাতায় যৌবন আসে।
আমাদের মনের মাটির গোড়ার কথাকেও মাঝে মধ্যে অমন আলগা, এলোমেলো করে দিতে হয়। একলা থেকে, গাছের সঙ্গে থেকে দীক্ষা নিতে হয় কীভাবে মনের মাটি আলগা করব, কীভাবে তলার দিকের অন্ধ পুরাতন কথার মধ্যে থেকে তারুণ্যের শ্বাস খুঁজে নেব… আসলে পুরাতন কথা, তলার মাটিই তো সম্বল।
গাছ যেমন করে স্তরের পর স্তর নেমে গিয়ে আরো তলার দিকের অন্ধকারে মুখ গুঁজে প্রাণ পায়, মানুষও তো তেমনই। আমরাও তো তেমনই স্মৃতিতে বাঁচি। মনের তলার কোণের ঘরে যা কিছু চাপা থাকে, চাপা পড়া সেই স্তরের পর স্তরে জমে থাকা ভিজে পলিমাটির মতো স্মৃতিই মানুষকে শীতল রাখে, স্থির রাখে, ধীর করে। কেউ কেউ সেই শীতল পলির পুষ্ট স্তরের তলকে খুঁজে পেয়ে যত্নে আগলে রাখি, কেউ সেই পলির পাঁকে বাঁধা পরি…মন তখন বর্তমানের খবর পায় না আর, রাখতেও চায় না বোধহয়।
যেমন বোঝেনি ওর দিদা, যেমন বোঝেনি ছেলেবেলায় বড় হয়ে ওঠার পুরাতন পাড়ার সোনা-পাগলা। মিশন ঘাটের সামনে মহানন্দার তীর ঘেঁষে ছিল ওর একচালার ঘর। মিশনের উঁচু দোরের পাশে বসে কত কথা বলে যেত স্মৃতির পলি ঘেঁটে, ছেনে… আমরা ওর ভাষা বুঝতাম না, শব্দ শুনতাম শুধু; যেমন বুঝি না গাছেদের ভাষা… সময় সময় ও ওর মাকে দেখেছে সোনা-পাগলাকে মুড়ি খাওয়ার টাকা দিতে… ফি বছরে নীল ঘর কাটা লুঙ্গি, যেমনটা পরতো ওর দাদু…
গাছের ফিস ফিস ভাষা শুনতে শুনতে এসব তলের কথা খুঁড়ে আনে ও, আজকাল এসবই ভাবতে ভালোলাগে। ঠান্ডা শীতল স্মৃতির মাটি সারা শরীরে মেখে রাখতে চায়। স্পষ্ট বুঝতে পারে ওর মেয়েবেলা পেরোনো উত্তর তারুণ্যের আলতো ছোঁয়া লাগা হাঁটু-ঊরু পেরিয়ে নাভির ঘূর্ণির কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে নরম ঠাণ্ডা স্মৃতির পলির স্তরের পর স্তর… ডুবে যাচ্ছে ও ধীরে ধীরে। সেই অনন্ত ঠাণ্ডা শীতল অন্ধকার এক তল, যেখানে পুরোপুরি ডুবে গেলেই আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায় কাঞ্চনমালার হারিয়ে যাওয়া জাদুর দেশের মণি…
আজকাল তাই গাছের সঙ্গেই সব কথা ওর। সব আদর ওর পাতার সনে। গাছেরা কানে কানে ওকে শিখিয়ে দেয় মাটির ভেতরের দিকে যেতে যেতে প্রাণের তল খুঁজে পাওয়ার রহস্য। সেই রহস্যকথা শুনতে শুনতে শিহরণ জাগে ওর… বন্ধ দরজার আড়ালে ধ্যানের মধ্যে থেকে সাধনা শুরু করে ও, যে সাধনা গাছেদের, পাতাদের, সবুজের…