
পর্ণশবরীর কথকতা ৭ প্রাপ্তি চক্রবর্তী
এই শীতল সাদা মেঝের ঘরে এক বোবা নারীর বাস; এই নারীর আত্মা পুড়ে গেছে কোনো এক বছর। আত্মাহীন এই নারী প্রেতিনী আর মানবীর দ্বান্দ্বিক রূপ পালা করে ধরে ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। শুধু ঘুরে বেড়ায়, আর কিছু নয়। শীতল শ্বেত-পাথরের মেঝে দিয়ে বোনা এই ঘরও পালা করে মর্গের মতো গন্ধ বয়ে বেড়ায়।
এই নারী স্বাধীন। সাদা-পাথরে বোনা নিশ্চুপ মেঝেতে নিশ্চুপতর হয়ে বুকে বালিশ আঁকড়ে পড়ে থাকে সে। লালরঙা ছাদে পায়চারি করতে করতে ঝুঁকে পড়ে কালোমাটি গোঁজা টবগুলোর দিকে। বুকের আঁচল সামলে মাটির গন্ধ বুক ভরে শুষে নেয়। ওর সমস্ত আগ্রহ এখন ঐ আগাছাগুলোর প্রতি, যারা সবেমাত্র দুটো শিশু হাত মেলে মাটির বুক থেকে উঠে এসে আড়মোড়া ভাঙতে চাইছে। যখন লেখা আসে না তখন এই নারী হেমন্তের আকাশ জুড়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। মহাশূন্য, আর কিছু নয়। ধীর পায়ে এগিয়ে পুরাতন কাঠের বাক্স খুলে আরও পুরাতন রূপোর কঙ্কন আর নূপুর বেঁধে রাখে। কালোপেড়ে শাড়ি শুকনো বাতাসে দুলে দুলে ফুলে ফুলে ওঠে,যেন হারিয়ে যাওয়া মাঝির পানসির পাল। এলোমেলো ভাবনাগুলো এই নারীর শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে জমে রয়েছে বছর বছর ধরে। সেই কালোপেড়ে শাড়ির ভাঁজে ভাবনাগুলো পাট করে রেখে পাথরে পাথর ঘষে সন্ধ্যের চায়ের জন্য সুগন্ধি মশলা বানাতে থাকে। কয়েক বছর আগে বর্ষার স্রোতের মুখে লচকা আর বালাসনের জল থেকে এই পাথর তুলে এনেছিল সে। ঘরময় তার পাথর। যেন সাদা হাড়ের খণ্ডের মতো দেখে তার চোখ। ফের ফিরে আসা এলোমেলো ভাবনারাশিকে আঁচলে গিঁট দিয়ে রেখে রোদ ফেরার আগেই ছোট গ্যাসে চায়ের জন্য একটিমাত্র কাপের জল আর সদ্য পেষা মশলা ফেলে সে অপেক্ষা করে নির্বাক। শূন্য চোখে দেখতে থাকে এলাচ, কালোমরিচ আর লবঙ্গ কীভাবে জলের টানে খেলে বেড়াচ্ছে, কীভাবে জলের রঙ সোনালি হয়ে আসছে। জল ঘুরে চলে ওপর থেকে নিচ আর নিচ থেকে ওপরে। বুলবুলি কাটা জলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই বোবা নারী ধীরে ধীরে ফুটন্ত জলের সঙ্গেই কথা কইতে শুরু করে যেন। তার সঙ্গেই সারা সন্ধ্যে ভাব বিনিময়ে নিজেকে নিঃশেষ করবে যে জল।
আঙুলে কোমর ছাপানো বদ্ধ বেণীর শেষপ্রান্ত পেঁচিয়ে ফের আনমনে ছাদময় পায়চারি করতে করতে অন্ধকার আকাশের দিকে চোখ তুলে খুঁজে নেয় তার প্রিয়তম নক্ষত্রটিকে। তার দীর্ঘ বোবা প্রবাসের একমাত্র সঙ্গী এই নক্ষত্র পুরুষটির আলো গায়ে মেখে সে ধীরে ধীরে তার বাঁধা চুল খুলে ফেলে।
এই নারী স্বাধীন। ভর-সন্ধ্যেতে খোলা চুলে ছাতের ‘পরে যেতে নিষেধ করার কেউ নেই তার। রাতের বাতাসে তার চুলের গন্ধ নিশি-রাগিনীর আলাপের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মাথার ওপর দিয়ে নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যায় আরও আঁধারের দিকে চোখ রেখে।