অ্যাক্সিডেন্ট  <br />  সোমা দত্ত

অ্যাক্সিডেন্ট
সোমা দত্ত

আলো ফুরানোর আগেই অনেক সময় অন্ধকার নেমে আসে। বিপর্যয় একটি অন্যমনস্ক মুহূর্তের নাম। সবই চোখের পলক ফেলতে ফেলতে ঘটে যায় এবং ফুরিয়ে যায়। বর্তমান আসলে কি সেটাই সবথেকে বড় গূঢ় এবং গভীর রহস্য। প্রাণ দৃশ্যমান শুধুমাত্র অতীতে। বর্তমান সম্ভবত একটি ধারণা।

ঘটনাটা সেভাবেই ঘটে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি তো নতুন ঘটনা নয়। মৌ আর আমার মধ্যে তর্ক নিয়মিত ব্যাপার। অন্তত গত কয়েক বছর ধরে। গাড়িও যে নতুন চালাচ্ছি তা তো নয়। এর মধ্যেই কীভাবে যেন একসঙ্গে টিকে আছি এখনো। একসঙ্গে ঘুরতে যাই বছরে দু’বার। কেনাকাটা করতে বেরোই। মৌ-এর গাছ গাছালির শখ মেটাতে দূর দুরান্তের নার্সারিতে যাই। যেমন আজ গেছিলাম। কিন্তু ফেরত আসার সময় অঘটন যেভাবে ঘটল, সামাল দিতে পারলাম না।
গত কুড়ি বছর ধরে আমি গাড়ি চালাচ্ছি। দুই একটা ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু ভুলচুক কখনো হয়নি। এবার সেটাই হয়ে গেল। কলিশনটা সামলানো গেল না। মানুষ নয়। একটা ছাগল। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির সামনে এসে গেল হঠাৎ। পরিচিত এলাকা নয়। দুপাশে খুব বেশি বসতিও ছিল না থাকলেও হয়তো ভেতরের দিকে। ছাগলটা রাস্তার মধ্যে চলে এল হঠাৎ। শেষ মুহূর্তে যদি ব্রেক চাপতাম গাড়িটা সামলাতে পারতাম না। স্পিড আশি ছিল। সেই মুহূর্তে মনে হল না দাঁড়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্রেক না চেপেই সোজা বেরিয়ে গেলাম। পিছন থেকে কেউ একটা গাড়ি লক্ষ্য করে কিছু ছুড়লো, ঢিল বা পাথর গাড়ির কাছে লাগলো। মৌ প্রথম স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। এতক্ষণ যা চেঁচামেচি করছিল সেটা থেমে গেছিল। কয়েক সেকেন্ড পর। মুখ খুলল।
–কি করলে তুমি এটা। আমি চুপ করে থাকলাম কারণ আমার কাছে আসলে কোন উত্তর নেই। আমার ভেতরটা এখনো কাঁপছে। স্টিয়ারিংয়ে হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, নিজের বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি আমি। মৌ এর কথাগুলো অতিরিক্ত মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কিন্তু ওকে যদি এখন থামতে বলি তাহলে ও দ্বিগুণ পরিমাণ চিৎকার করবে। আমি অন্তত কিছুক্ষণ জাস্ট গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই এখন। বেশ খানিকটা দূরে না যাওয়া পর্যন্ত থামতে চাই না। গ্রামের লোক খুব বিপজ্জনক হয়। কিন্তু রাস্তাটা বোধহয় ভুল করেছি। খেই হারিয়েছি। লোকেশন দেখাচ্ছে না গুগল, নেটওয়ার্ক নেই। মৌ থেমে গেছে, থম মেরে বসে আছে এখন। কোথাও একটা থেমে কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। একটা চায়ের দোকান বা অন্য কোনো দোকান কোনোকিছুই চোখে পড়ছে না। লোকের সন্ধান করতে করতেই কতদূর চলে এলাম। দুজন লোক রাস্তার পাশে একটা ঢিবির উপরে বসে আছে। ওদের কাছে এসে থামতেই ওরাও কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকালো। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে একজন কাঁধের গামছাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
– কত্তা রাস্তা খুঁজতিছেন? দাঁত বার করে হাসছে লোকটা যেন সবই জানে।
– হ্যাঁ, মেন রাস্তায় উঠব কোথা দিয়ে? কল্যাণী হাইওয়ে?
– এই সিধে গিয়ে ডাইনে মোড় ঘুরলি সোজা রাস্তা পাবেন সড়কে ওঠার।
– সিধে মানে তাও কতদূর হবে
– এই মিনিট দুই
– মিনিট দুই মানে তো সামনে। সামনে তো কিছুই দেখছি না কাছাকাছি
– লোকটা একটু ভেবে ফের বলল, তবে মিনিট চারেক হবেক্ষণ। পায়ে হাঁটি গেলে ই তো কাছেই লাগে।

বলে কী লোকটা! পায়ে হাঁটি গেলে কাছে আর গাড়িতে গেলে দূর হবে? মৌ ততক্ষণে গাড়ির কাচ নামিয়ে মুখ বাড়িয়েছে।
– কাছাকাছি কোনো চায়ের দোকান টোকান আছে নাকি ভাই?
মৌ কে দেখে লোকটার হাসিটা কান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।
– চায়ের দুকান পাবেন গিয়ে দিদিমণি সিধে গিয়ে ডাইনে মোড় ঘুরলি সোজা
দিদিমণিও একই প্রশ্ন করলেন।
– সে কতদূর?
উত্তরও সেই একই এলো
– এই মিনিট দুয়েক
মৌ আমার দিকে তাকাল। প্রশ্নসূচক। পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনার এবং দুর্ঘটনার জন্য আমাকেই কৈফিয়ত তলব করতে হবে মৌ এরকম একটা ভাব ভঙ্গিমা সবসময় বজায় রাখে। এই দৃষ্টিতেও সেরকমই একটা ভাব। এসব বলছে কেন এরা? দেখো কী বলছে কেন বলছে।
যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গের লোকটি এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবারে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

– আপনেদের কি কিছু সমস্যা হৈচে?
সচেতনতা একটি রিফ্লেক্স। আমি সচেতন হলাম।
– কী হবে? রাস্তা গুলিয়ে গেছে এটাই হয়েছে।
– লোকটি কেমন সন্দেহজনকভাবে দেখতে লাগল।
এদের সঙ্গে বেশি সময় নষ্ট করে লাভ নেই বুঝে গাড়িতে উঠতে যাব, লোকটি ফের বলে,
– কিছু না হলি তো এ রাস্তায় কেউ ফাঁসে না তাই বললাম
ঘুরে তাকালাম। বলে কী লোকটা? চেপে ধরব লোকটাকে না ছেড়ে দেব? আচ্ছা পুরো ব্যাপারটা এদের তৈরি করা নয় তো? টাকা পয়সা নেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে ফাঁদ পেতে রেখেছে হয়তো। লোকটা এবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল গাড়ির বোনেটের দিকে। ওরকমভাবে তাকাচ্ছে কেন?
– কী হয়েছে কী?
লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে এসে দেখলাম গাড়ির বোনেটে রক্তের দাগ লেগে আছে। লোকটা সেদিকেই দেখছে। সিওর এদের কিছু মতলব আছে। এদেরই সাজানো ফাঁদ সমস্তটা। গাড়ির চাকার দিকে চোখ পড়তেও অবাক লাগল। ভেজা। পিছনের রাস্তায় ভেজা চাকার দাগ। কোথাও তো জল ছিল না। বৃষ্টি হয়নি। এখন রোদটা নিভু নিভু হলেও এতক্ষণ তীব্রভাবে জ্বলছিল। তাহলে চাকা ওরকম ভিজল কী করে। ধাক্কাটা লেগেছে তাও কয়েক কিলোমিটার আগের রাস্তায়। যদি রক্তের দাগও হয়ে থাকে সেটা এতক্ষণ থাকবে না। অসম্ভব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। আর একটিও কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম। সওয়া চারটে বাজে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। মৌ এতক্ষণ পরে নিজের স্বরূপ ধারণ করল।
প্রথম দফায় ইন্ট্রো দিয়ে শুরু করল।

– শুরুতেই জানতাম কিছু না কিছু একটা হবে। বিড়াল রাস্তা কাটল তুমি থামলে না। নিজেকে খুব যুক্তিবাদী ভাবো সবসময় অথচ বারবার ভুল প্রমাণিত হতে থাকো। তোমার আর শিক্ষা হবে না।
এবার ডিফেন্ড করার সময় দিল বোধহয় কিংবা প্যারাগ্রাফ ব্রেক নিল হয়তো।

দ্বিতীয় দফায় মৌ–

– ওই লোকটা কী দেখাল সামনে ডেকে? আরে তুমি আবার স্পিড বাড়াচ্ছ কেন? এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। গাড়িটা দাঁড় করালে না পর্যন্ত। আমরা অন্যদের বিবেক নিয়ে কথা বলি। একটা জন্তু বলে… আচ্ছা যদি মানুষ হতো, তাহলে পারতে? নাকি তাহলেও…
আমি ভুলে গেলাম মৌ কথা বললে, আমাকে চুপ করে থাকতে হবে।
–উফ্ মৌ, গাড়ি চালানোর সময় পাশে তোমার মতো কেউ যদি থাকে, অ্যাক্সিডেন্ট হতে বাধ্য জানোতো। কেউ আটকাতে পারবে না।

উত্তর পেলে মৌ উৎসাহিত বোধ করে। তৃতীয় দফা শুরু হল।
– তুমি আমার পোক করাটাকে হাইলাইট করছ, নিজের অন্যায়টাকে দেখছ না। অত বড় একটা জন্তুকে চাকায় পিষে দিয়ে চলে এলে নির্বিকার। নিরীহ গ্রামের লোকগুলো কী এমন করত? ক’টা ঘরই বা ছিল ওখানে। হাতে গোণা। ওরা তোমাকে মেরে ফেলত? একটা ন্যূনতম ক্ষতিপূরণের চেষ্টা পর্যন্ত করলে না?

মুখ খুলে গেল। ধৈর্য রাখতে পারলাম না। আজকাল প্রায়ই পারিনা।
– মৌ এই এতদূরে নার্সারী থেকে গাছ আনতে যাওয়ার বুদ্ধিটা কার ছিল। নাও তো আসতে পারতাম ওই অচেনা তেপান্তরের মাঠে। সেটা একবারও ভাববে না তো।

– আরে! রাস্তায় লোকে বেরোবে না? এদিক ওদিক যাবে না? তুমি ঠিক কী জাস্টিফাই করতে চাইছ বলবে আমায়?

আমি চাইছি তুমি একটু চুপ করো। আর নেটওয়ার্কটা পাওয়া যাচ্ছে কিনা দেখো।

– চুপ করিয়েই রাখতে চাও তুমি আমাকে আজীবন। একের পর এক প্রাণ পিষে দিয়ে চলে যাবে আর আমায় বলবে চুপ করে থাকো।

ব্রেক চাপতে বাধ্য হলাম। মাথায় হাতুড়ির ঘা দিল যেন কেউ

– মৌ তুমি আবার ওই কথা তুলছ?

– হ্যাঁ, উঠবেই। যতবার কারো প্রাণ যাবে তোমার হাতে ওই কথা উঠবে?

– যতবার প্রাণ যাবে মানে? আমি কি খুনি? কী বলছ জ্ঞান আছে?

– সাড়ে তিন মাসের ফেটাসকে নষ্ট করলে তাকে খুনই বলে
গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। যাই হোক না কেন। এখন দাঁড়ানো যাবে না মাঝপথে। চাকায় দাগটা কিসের ছিল। রক্তের? এত রক্ত?

– মৌ প্লিজ ডোন্ট স্টার্ট ইট এনি মোর। গাড়ি চালাচ্ছি। রাস্তাটা খুঁজে বার করতে দাও। জায়গাটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।

– তুমি একটা জ্বলজ্যান্ত প্রাণকে পিষে ফেললে। তোমার কোনো অনুতাপ নেই। আমার বাচ্চাটাকেও তুমি এভাবেই মেরে ফেলেছিলে।

– মৌ মিউচুয়াল ডিসিশন ছিল ভুলে যেও না। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ইউরোপ ট্যুর নিশ্চয় ক্যানসেল করা যেত না।

– ট্যুরের অজুহাত দিও না প্লিজ। তুমিও জানো সন্দেহের বশে তুমি এটা করিয়েছ।

– আচ্ছা। মানলাম। তুমি কি শিশু? আমি যা বলি তাই মেনে নাও?

– মেনে নিতে বাধ্য করেছ। ওই সন্তান জন্মালে তুমি আজীবন সন্দেহ করে যেতে ও তোমার নয়। শুধুমাত্র অনিন্দ্যর সন্তান ভেবে তুমি অ্যাবরশনটা করার জন্য বাধ্য করলে।

– তোমাকে এইমুহূর্তে চুপ করানোর জন্য কীভাবে বাধ্য করতে পারি বলে দেবে?

নেটওয়ার্ক ফিরেছে। ডানদিকে একটা রাস্তা গেছে। ওটাই দেখাচ্ছে। লোকটা তাহলে ঠিক রাস্তাই দেখিয়েছিল। মোড় ঘুরতেই একটা চায়ের দোকান। যাক। একটু গলাটা ভিজানো যাবে। এইটুকু আসতে প্রায় আধঘন্টা লাগল। লোকটা বলেছিল পায়ে হেঁটে মিনিট তিনেক। এদের সময়ের কাঁটা কীভাবে ঘোরে কে জানে।

একটা খুপরি চায়ের দোকান পুরো একা ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকটা পুরো ইটভাঁটা অঞ্চল। দু চারজন ওই ভাটারই লোক হয়তো দোকানের বাইরে পাতা বেঞ্চটাতে বসে আছে। মৌ এর দিকে তাকালাম। ওর মুখ থমথম করছে। গত একবছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ওকে ট্রমা থেকে বার করে আনার। পারছি না। অ্যাবরশনের মতো একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মৌ এত অবসেসড হয়ে পড়বে আমার ধারণার বাইরে ছিল। নাহলে হয়তো কখনোই…

– ভাই এই অঞ্চলে চায়ের দোকান টোকানও তেমন নেই দেখছি। লোকজন চা টা খায় না নাকি?
দোকানির উদ্দেশ্যে বললাম। বেশি বয়স নয় ছেলেটার। বছর তিরিশেক। একবার আপাদমস্তক আমাকে নিরীক্ষণ করে নিয়ে বলল,
– খাবে না কেন? দোকানও আছে লোকও আছে। মানুষজনের বাস যেদিকে আছে সেদিকে সবই আছে। এই ইটের ভাঁটার মধ্যি কেন থাকতি যাবে কেউ

– কেন? এই তুমি তাহলে দোকান দিয়েছ যে। দাও দুটো চা দাও।

এবার চোখ পড়ল দোকানের বাইরে পাতা বেঞ্চের উপরে। চমকে গেলাম কিছুটা। একটু আগে যে দুজনের সঙ্গে কথা বললাম ওরাই তো। এই লোক দুজনকে পিছনে ফেলে এতদূর চলে এলাম এর মধ্যে এরা এখানে কী করে পৌঁছল। ওরাও চিনতে পেরেছে। হাসছে নিজেদের মধ্যে।
প্রথমে যার সঙ্গে কথা হয়েছিল আগেরবার সে বলল,
– বাবু ভাবতিছেন এত তাড়াতাড়ি কী করি এলামক্ষণে। ভিতর ভিতরি পথ আছে বাবু।

উত্তর দিলাম না। এখানে না দাঁড়ালেই হতো। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেন এদের দেখলে। আরেকটু এগিয়ে মেন রাস্তার মুখে দোকান পেয়ে যেতাম নিশ্চই অনেক। কিন্তু ততক্ষণে মৌ বেরিয়ে এসে ওই বেঞ্চে এসে বসে পড়েছে। ঠিক আছে। চা-টা খাওয়া যাক। এদের সঙ্গে বেশি কথা বলার দরকার নেই। তখনই কী জানি কেন চাকার দিকে চোখ গেল ফের। কী আশ্চর্য! এখনও ভেজা। আর পিছনের রাস্তা জুড়ে সেই ভেজা চাকার দাগ। এ কী করে সম্ভব! রীতিমতো ভৌতিক ব্যাপার। খুব ঝুঁকে ভালো করে লক্ষ্য করব সে সাহস পাচ্ছি না। এদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নিজের জায়গায় থেকেই বুঝতে পারছি চাকাটা ভিজেছে রক্তে, জলে নয়।

– চা টা নিন বাবু
চমকে উঠলাম। দোকানি ছেলেটা হাসছে।

– বাবু ভয় খেয়ে গেছে। বেঞ্চে বসা লোকটা বলল,
– ভয় তো খাবেই। সেই তখন থিকি ঘোরাঘুরি করছে। ওই মাধবের দরগা হয়ে আসিছিল, যা হয় আর কী! ভুলভুলিয়ায় পড়ে লোকজনা পথ গুলায়।
চায়ের একটা ভাড় নিয়ে মৌ এর হাতে দিলাম। নিজেও নিলাম কিন্তু বেস্বাদ লাগল। লোকদুটো নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করে চলেছে। বারবার গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এরা কী ঘটনাটা জানে? কী একটা ভুলভুলাইয়া না কী যেন বলছিল। বেশি কিছু জানতে চাওয়াটা ঠিক হবে না। আমিই বা এত ভয় পাচ্ছি কেন। এরকম ঘটনা গাড়ি চালাতে গেলে হতেই পারে। আর আমার তো তেমন দোষ ছিল না। জাস্ট একটা ছাগল! মৌ শুনলে বলবে, – জাস্ট? জাস্ট একটা? তোমার কাছে যে কোনো মৃত্যুই হয়তো জাস্ট একটা…
ছাগলটা চাপা পড়ে যাওয়ার পর রাস্তাটা বোধহয় রক্তে ভিজে গিয়েছিল। এত রক্ত? এত রক্ত থাকে একটা ছাগলের শরীরে?
মৌ সবকিছুতেই ওই একই ঘটনা টেনে আনে। এত কাউন্সেলিং হল, এত সাইক্রিয়াটিক সলিউশন খোঁজার চেষ্টা হল, কোথায় কী! কোনো উন্নতি নেই। ভুল আমার ছিল ঠিকই কিন্তু একার ভুল ছিল না। আমার মুম্বই থাকাকালীন মৌ এর অনিন্দ্যর উপর নির্ভরতা খুব বেশি ছিল এটা তো ভুল নয়। কলেজ জীবন থেকেই অনিন্দ্যর দুর্বলতা ছিল মৌ এর প্রতি সেটাও তো ভুল নয়। ভুল যেটা ছিল আমি সেটা শুধরে নিতে চেয়েছিলাম। সেইসময় আমাদের মধ্যে সম্পর্ক যেরকম বিশ্রী পর্যায়ে গেছিল তার মধ্যে মা-বাবা হওয়ার কথা ভাবা যায় না। প্রেগনেন্সির একটা স্বচ্ছ সুন্দর পরিবেশ দরকার। একটা শিশুকে পৃথিবীতে আনার আগে বিবেচনা করা উচিত। জন্ম দিলেই তো আর হল না। অ্যাবরশন আমি করাতে বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু বাধ্য করেছি সেটা মৌ এর চাপানো। অনিন্দ্য-র সঙ্গে মৌ এর সম্পর্ক নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া তর্ক টানাপোড়েন সবই হয়েছে কিন্তু আমি কখনো মৌ এর প্রেগনেন্সিকে সেই সন্দেহের আওতায় আনিনি। মৌ ধরে নিয়েছে। নিজে থেকে একটা কাল্পনিক প্লট তৈরি করে আমাকে দোষারোপ করে গেছে। এখনো করছে।

– কী হল তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? চমকে উঠলাম মৌ এর গলায়। ওই লোকদুটো তখন গাড়ির পিছনে গিয়ে কী যেন দেখছে। সঙ্গে আরও দুটো লোক কোত্থেকে এসে জুটেছে যেন।
ওরা কি কিছু গন্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করছে নাকি। রক্তের দাগটা নিয়েই কি ওরা বলাবলি করছে? চায়ের দাম মিটিয়ে ঝটপট গাড়ি স্টার্ট করলাম। একটু একটু মেঘ জমেছে আকাশে। হালকা অন্ধকার লাগছে। যদিও এখনো সন্ধে হতে এক ঘন্টারও বেশি বাকি।

মৌ বলল,
– লোকদুটো জানে।
– কী?
– জানে যে তুমি একটা অবোধ প্রাণীকে পিষে দিয়ে চলে এসেছ
– ইচ্ছা করে করিনি
– অনুতাপ প্রকাশ করোনি। ক্ষতিপুরণ এড়িয়ে গেছ।
– গাড়ি ঘোরাব? ফিরে যাব অনুতাপ প্রকাশ করতে?
– এখন কী করে সম্ভব?
– কেন নয়? ক্ষতিপুরণ করে আসি
– এখন আর কোনো লাভ নেই গিয়ে।
– কেন নেই? নিশ্চই আছে।
গাড়ি ঘোরালাম। মন আর মাথা দুটোই ঘুরে গেছে আমার একইসঙ্গে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ না করলে মৌ এটাকে টানতেই থাকবে। বারবার ঘাতক সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে যাবে আমাকে।
বোন ওকে গল্প করেছিল,
– দাদার মধ্যে অদ্ভুত একটা নৃশংসতা ছিল জানো মৌ দি। ঠাস ঠাস করতে চড় মেরে যেত আমার গালে। পড়াতে বসলে, কিছু ভুল করলে দু আঙুলের ফাঁকে একটা চৌকো সরু লাঠি রেখে আঙুল ধরে চেপে দিত।
– ছিল ছিল তোর এলোমেলো রাগ ছিল বাবিন। তোর বাবার ধারা। মাথার দোষ। খুনে রাগ তোদের বংশের
মা কথাগুলো বললেই দেখতে পাই মায়ের হাতে বাবা জ্বলন্ত সিগারেটটা নিয়ে এসে চেপে ধরল।
অনিন্দ্য বলেছিল,
– সন্দেহ করে নিজের প্রথম সন্তানকে মেরে ফেলতে পারলে তুমি সৌগত। তোমাকে চিরদিনের জন্য ঘৃণা করলাম।

আমি কিন্তু এসব কিছুই সেভাবে করিনি অথচ। আমি প্রমাণ করতে পারিনি। প্রমাণ করতে পারিনি যে আসলে সবকিছু সাজিয়ে সুন্দর করে রাখতে চেয়েছিলাম। বোনকে সুন্দর গোছানো শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম, সন্তানকে সুস্থ পরিবেশ দিতে চেয়েছিলাম, মৌ-কে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম, অফুরন্ত স্পেস দিতে চেয়েছিলাম। প্রমাণ করতে পারিনি যে ব্রেক চাপলে গাড়িটা স্কিড করে যেতে পারত। অ্যাবরশনে অনেক রক্তপাত হয়? সাড়ে তিনমাসের ফেটাস। তার শরীরেও কি অনেক রক্ত? চাকায় কি সত্যিই রক্তের দাগ ছিল?

– কী করছ তুমি সৌগত। পাগল হয়ে গেছ? গাড়ি ঘোরাচ্ছ কেন?
– আমি ফিরে যাব
– কোথায় যাবে?
– ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিল। সরি বলে আসব। টাকা পয়সা যা লাগে দেব।
– তোমার সরি ওরা শুনবে? তাও এতক্ষণ পরে?
– টাকা দেব
– আরে এতক্ষণ পরে ফিরে গিয়ে এসব করতে গেলে কী হতে পারে ভেবে দেখেছ? অন্ধকার হয়ে আসছে। অচেনা রাস্তা।
– আমি চিনে নিয়েছি এখন
– সৌগত না। বাড়ি চলো। গাড়ি ঘোরাও।
– না সোনা। আর আমি এই বোঝা বয়ে বেড়াব না। এখানেই সব হিসেব মিটিয়ে ঘরে ফিরব।
– পাগলামি কোরো না। এরকম হবে জানলে আমি বেরোতাম না তোমার সঙ্গে। তুমি শুনবে না কিছুতেই না?
– না শুনব না। সারা জীবন খুনের অপবাদ নিয়ে বাঁচতে পারব না। প্রতিবার বলেছি আমি করতে চাইনি অমন, চাইনি করতে। আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম সুস্থ সুন্দর পরিবেশ ছাড়া সন্তান কেন জন্মাবে! তোমরা শুধুমাত্র অভিযোগ করে গেছ। ভেবেছ নোংরা সন্দেহের বশে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– শাক দিয়ে মাছ ঢেকো না সৌগত। ওভাবে নিজের থেকে পালানো যায় না। দশবার মিথ্যে বললে সেটা সত্যি হয়ে যায় না। আর এখন তুমি এসব কেন বলছ।
– এতক্ষণ তুমিও তো এসবই বলছিলে সোনা।
– সৌগত শেষবার বলছি ফিরে চলো। ওই জায়গায় আমরা আর ফিরে যাব না।
– দেখেছ সোনা তুমি কত দৃঢ়! কী সুন্দর ডমিনেট করতে পারো। অথচ অ্যাবরশনের জন্য আমাকে দায়ী করো। আমি বাধ্য করেছিলাম এই মেয়েকে? এই মেয়েকে আমি বাধ্য করতে পারি সোনা?
– সৌগত আমি কিন্তু গাড়ি থেকে ঝাঁপ দেব।
– মানে? আবার কেস খাওয়াবে? এবার কি অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের কেস দেবে সোনা?
সৌগত তুমি কিন্তু জানো আমি যা বলি তা করি। তুমি যদি না ফিরে চলো এরপর যা হবে তার সম্পূর্ণ দায় তোমার হবে কিন্তু।

মাথার ভিতরে উষ্ণ স্রোত বয়ে যাচ্ছিল যে গতিতে, গাড়ির স্পিডও সেভাবেই বেড়ে চলেছিল। নিয়ন্ত্রণ প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। উল্টো দিক থেকে ছ’চাকার মস্ত লরিটা দেখতেই পাইনি যেন। যখন দেখতে পেলাম তখন একদম শেষ মুহূর্ত। পাশ থেকে মৌ চেঁচিয়ে উঠল। –সৌগত…
মরার আগে মরব না। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব বাঁচাতে। আমি বাঁচতে এবং বাঁচাতেই চেয়েছি। সুন্দর সুস্থ নিরাপত্তার জীবন নিশ্চিত করতে চেয়েছি। হয়তো এটাই শেষ সুযোগ ছিল।

গাড়িটা বীভৎস ঝাঁকুনি দিয়ে কাত হয়ে উল্টে গেল। পা-টা কোথায় যেন আটকে গেল। উফ্ কী যন্ত্রণা। মৌ কোথায়, উফ্…
চোখের সামনে লরির হেডলাইটের আলোটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেল।

যে আলো ফোটার কথা ছিল না। সে আলো ফুটল। দিনের নয়, রাতের আলো, জীবন্ত মানুষের মুখে যে প্রাণের আলো থাকে, সেই আলো। কয়েকটা মুখ ঝুঁকে ছিল। শোনা গেল, অ্যাই তো জ্ঞান ফিরিছে। ওরে জল দে এক গিলাস।
শুনতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ জীবন এখনো সাড়া দিচ্ছে। বলছে বেঁচে আছো। ওঠো। বেঁচে আছো তুমি এখনো
মৌ কোথায়? এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাতেই একজন বলল, বৌদিমণি ঠিক আছে বাবু। কপালডা একটু ছড়ি গেছে। মেইয়ে মানুষ তো। ভয় খেইয়ে গেছে বড়। ওই দোকানের ভিতরি শুইয়ে আছেক্ষণ। উঠতে গিয়ে টের পেলাম পা খানা নড়াতে পারছি না। যন্ত্রণা টের পেলাম।
কেউ একজন বলল, বাবু অ্যামবুলেন্স এসে পড়বে আর একটুক্ষণের মধ্যি। বড় ব্যস্ত হবেন না। পা খান জখম হইছে বড়। ঠিক হয়ি যাবেন।

অবসন্ন হয়ে শুয়ে পড়লাম ফের। মাটিতে কিছু একটা পেতে শুইয়ে রেখেছে এরা। এর আগে কখনো কি পথে শুয়েছিলাম? প্রথম মাটির এত কাছাকাছি এলাম। মৌ কতটা সুস্থ আছে কে জানে। এরা হয়তো বলছেনা। কেন করলাম এমন? মৌ এর যদি কিছু হয়ে যায় আমি দায়ী থেকে যাব আজীবন।

আশপাশের গুঞ্জন কানে আসছে। একজন বলছেন, –মেইন রোড খুঁজতেছিল তো আবার এইপানে আসছিল কেনে?
– কী জানি তার। তবে বাবুরে কেমন একটু দেখতে আছিল। কী ভাবতেছিল আর যেন টেনশন চলছিল কিছুর।
– কলকেতার লোকগুলার এই এক টেনশনের ব্যারাম। এতিই সব মরে।
– গাড়িটা একদম গেছে গিয়ে দুমড়ে
– আরে গাড়ি গেছে যাক মানুষদুটো প্রাণে বাঁচি গেল এই কত ভালো।
– আরে এই রাস্তায় কিছু না কিছু লেগেই আছে গো। এই তো শুনলাম অরূপ হাঁসদার ছাগলটাকে গাড়ি কুচলে দিয়ে চলে গেছে গো।
সবে ছানা দিয়েছিল ক’টা।
চোখটা খুলে ঠাওর করার চেষ্টা করলাম কারা বলছে কথাগুলো। অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আচ্ছন্ন লাগছিল যেন কেমন। অ্যাম্বুলেন্স এলো। পুলিশের গাড়িও এলো কিনা কে জানে। স্ট্রেচার
এনেছে। ক’জন মিলে তুলছে আমাকে। মৌ এর নির্ঘাত তেমন কিছু হয়েছে। আমি মরে গেলাম না কেন? মৌ ঠিকই বলেছিল। ওর জীবনটা ছারখার করে দিলাম। খুনি বলে ঠিকই করে মৌ। খুনিই তো। কী জানি মৌকেও হয়তো মেরে ফেললাম এবারে।

অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর দেখলাম দুজন মৌ-কে ধরে নিয়ে আসছে। মৌ হাঁটতে পারছে তাহলে। মৌ বেঁচে আছে। ওই দুজনের সাহায্য নিয়ে মৌ উঠে বসল পাশে। অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ হল। মৌ ঝুঁকে আসল একটু। বুকের উপর হাত রাখল। কিছু একটা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল মনে হয়। সরে গেল। ফের হাতটা রাখল বুকে। ঘাড়টা নাড়ল অল্প। আমি ডানহাতটা তুলে মৌ-এর হাতটা ধরে ফিসফিস করে বললাম,
– ক্ষমা চেয়ে নেব মৌ। সব অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেব দেখো। মৌ শুনতে পেল কিনা জানিনা। চোখের সামনে ছাগলের ছোট ছোট কয়েকটা ছানার ছবি ফুটে উঠল। গাড়ির চাকায় সত্যিই কি ওদের মায়ের রক্তের দাগ লেগেছিল?

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes