
অরিত্র দ্বিবেদী-র গল্প
অনুরণন
১
কাচের গায়ে জল দাগ দিয়ে, দাগ দিয়ে কোনো একটা হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ে যেতে থাকা শহরের বা সাম্রাজ্যের ম্যাপ এঁকে দিচ্ছে। চোখের সামনে সমস্তটা দুলে দুলে উঠছে, ঘাট-মাঠ, লোকালয়, ছাতা, গাছপালা, মানুষজন, বাসরাস্তা, আমার সামনে স্থির লোহার বেঞ্চটাও দুলছে। আশেপাশে একেবারেই লোকজন নেই। শুধু অবিরাম বৃষ্টি, আমি ভিজছি না, কিন্তু জল গড়িয়েই যাচ্ছে, গড়িয়েই যাচ্ছে ভেতরে আর বাইরে। জুতো খুলে নিয়ে বাবু হয়ে বসলাম। বাইরে একটা বড় লেক। মুহূর্তের মধ্যে সেটা নেই, তার বদলে একটা ছোটোখাটো জঙ্গল। তারপর দুলুনি বন্ধ। পাথরের ওপর জলের দাগ, টুপ টুপ করে জল ঝরছে। নতুন একটা স্টেশন। এখানেও কেউ উঠল না ট্রেনে। আবার দুলুনি শুরু। আজ, দেখা করার দিন। সকালে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। বেশকিছুটা যেতে হবে এখনও। আমার হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো জেনে নিতে হবে না! মনে তো আছে বলতে কুচো মুহূর্তের চমক। একটা আধটা শব্দের উজাড় ভিটেবাড়ি, আবছা এক একটা মুখ। বাইরে একজন মহিলা হেঁটে গেলেন। বেশ আঁটশাঁট শরীর, একজন পুরুষ হিসেবে দেখলে আকর্ষণীয় বললেও বোধহয় পুরোটা বলা হবে না। কিন্তু সত্যি বলতে, আজকাল কিছুই ঠিক করে অনুভব করতে পারি না। কোনো প্রেম, কোনো কামনা জাগল না ওঁকে দেখে। যেন এক দলা মাংসকে এক দলা কাপড়ে কিছুটা ঢেকে কিছুটা রেখে তৈরী করা। তিনিই হেঁটে গেলেন চোখের সামনে দিয়ে ভিজতে ভিজতে। এরপরই শীত নামবে, সামনের ভিজে থাকা ক্ষেতের মধ্যে জমতে শুরু করবে বরফ! আশা আকাঙ্খা খসে খসে পড়বে তারাদের দেশ থেকে পৃথিবীর বুকের ওপর। দু’ধরনের কথা মনে রাখতে হচ্ছে এখন। ট্রেনের লাইনগুলোর মতন! একসাথেই চলছে, তবু মেলার ক্ষমতা নেই।
“বহুক্ষণ বসে থাকার চেয়ে গল্প করা অনেক ভালো। কত বিষয় সম্পর্কে জানা যায়, বুঝে নেওয়া যায় কত চেনা অচেনা কথাকে, সর্বোপরি জীবনকেই। এখনও অবধি যা মনে আছে তাই বলতে শুরু করি বরং…। সেটুকুই যথেষ্ট হবে।”
বাইরে দেখো বৃষ্টিটা কেমন একঘেয়ে, কেমন অশালীন! যাই হোক —
“তখন আমি বি.টেক শেষ করে বিভিন্ন কম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছি, যখন আমার সঙ্গে হিয়ার আলাপ। একদিন বিকেলে শহরের চক্কর কেটে বাড়ির ফেরার রাস্তা ধরেছি তখনই ফোনটা বেজে উঠল।
– হ্যালো? হ্যাঁ, আমি দীপ বলছি রে।
– হুম, বল।
– কোথায় আছিস? একবার আসতে পারবি অনন্যা?
– অনন্যা? এখন? কেন বল তো…
– আয় না ভাই, তোকে এক জায়গায় একটু যেতে হবে আমার সঙ্গে। আমার একা সাহস হচ্ছে না!
– কেন রে এই ভরদুপুরে আবার কী ব্যামো ধরল?
– আমি জানিনা। তুই আসছিস ব্যাস। আর হ্যাঁ অনন্যা নয়, টবিন রোড।
…
খানিকক্ষণ বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, আর কোনো কাজ নেই দেখে দমদমের বাস ধরলাম। পুজো আসছে। এই সময়টায় বি টি রোডের বিকেলগুলো ঠিক ভ্যান গঘের ছবিগুলোর মত লাগে, খানিকটা the siesta যেন ছড়িয়ে আছে, বাসের কাচে, রাস্তার পিচের ওপর। প্রথমে দীপের ওপর রেগে গেলেও এখন মন্দ লাগছে না। এমনিতেও বাড়ি ফিরে বিরাট কিছু যে কাজ আছে তাও নয়। আমার ফিরতে দেরী হচ্ছে বলে চিন্তা করারও কেউ নেই। বি টি রোডের গলদঘর্ম passengers, দু’চারটে খুলতে থাকা মদের দোকান, সস্তা জামাকাপড় কেনা বাড়ি ফেরতা আম আদমি, আর অন্তত পুজোর কেনাকাটিটা একটু বড়লোকের মত করতে চাওয়া লোক, এইসব হাতিঘোড়া টপকে টবিন রোডে নেমে যখন এদিক ওদিক খুঁজছি, তখন দীপের আবির্ভাব। খানিকটা তেল দিয়ে, খানিকটা মন জুগিয়ে একটা জলজ্যান্ত গোল্ড ফ্লেক নিয়ে এগিয়ে এল। ঠোঁটের ওপর আলতো ধরতেই আগুনটা বাড়িয়ে দিল। একরাশ ধোঁয়া ওর মুখের ওপরেই ছেড়ে, এই সামান্য পরিতৃপ্তিটুকু কাটিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বড় দাঁও মেরেছিস মনে হচ্ছে?
– তোর না এই এক স্বভাব, মাঝে মাঝে এমন কথা বলিস দুম করে মেজাজ বিগড়ে যায়! আবার কখনও কখনও এমন ব্যবহার করিস, যে তোর সঙ্গ না পেলে অস্বস্তি হয়!
– আরে ধুর! কী হয়েছে বল না!
– ইয়ে মানে হয়েছে কী জানিস তো! এই তো চ’ না হাঁটতে হাঁটতেই বলি। একটি মেয়ে। ভাই — আজকে প্রথম ডেট! মেয়েটাকে যে কী পছন্দ হয়েছে বলার নয়! কিন্তু সমস্যা ওই — কবিতা…!
– মানে?
– মানে, কবিতা ভালোবাসে, সরি, কবিতায় বাঁচে, কবিতায় মরে! আমি তো ভাঁড়ে মা ভবানী! আজ বলেছে শুরুই করবে কথা কবিতা দিয়ে! তুই একটু সামলে দে ভাই, বাকি আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি।
– ক্যাফেটা কোথায়?
– তুই কী করে জানলি যে ক্যাফেই… ওহ্…হুম স্বাভাবিক। ওই তো ঘোষপাড়ার আগে, যে ভুতুড়ে থিমে নতুন ক্যাফেটা হয়েছে ওটাই। বলেছে গোটাটাই রিজার্ভ করেছে আজকের জন্য। স্টাফও কম থাকবে তাই।
– বলিস কী!
হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথাই বকবক করে বকছিল দীপ। সব কথায় কান দিইনি। প্রয়োজনটুকুও বোধ করিনি। আমার মাথায় ঘুরছিল তিনটে কথা। এক, মেয়েটার টেস্ট সত্যি প্রশংসনীয়, আর টাকাও নিশ্চয়ই অঢেল, নইলে সামান্য কী এক ব্লাইণ্ড ডেটে কেউ এত টাকা ওড়ায়! দুই, এই একুশ বছরের অভিজ্ঞতায়, না পুরোটার নয়, অন্তত বছর চারেকের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, সামাল যদি আমি দিয়ে দিই, ও মেয়ের তবে দীপকে পছন্দ করা শক্ত, উল্টে আমাকেই না পছন্দ করে বসে! তখন বেচারা দীপের কী অবস্থা হবে কে জানে! আর সবচেয়ে বড় কথা, তিন, তার যেমন টেস্ট সে অনুযায়ী শরীরটুকুও যদি তেমনি হয়, তবে তো এ মেয়ে নয়, শাপভ্রষ্টা অপ্সরা। এঁর অর্চনায় আর যাই হোক আমি তো ত্রুটি রাখব না! তাতে দীপের যাই মনে হোক। না না, এসব কী ভাবছি আমি! এখন সময় কোথায়! তাছাড়া এটা ঠিক দেখাবে না! দীপের সাথে আমার পরিচয় বহুদিনের, সবসময় আপদে-বিপদে এ শহরে ওই আমাকে সাহায্য করে এসেছে।
– কী রে ওই!
শত শত গাড়ির হর্ন একসঙ্গে কানের ভেতর ঢুকে এল যেন এক মুহূর্তে! উফ্ কী অসহ্য! কী বিরক্তিকর!
– হুম, বল;
– এসে গেছি। কী যে ভাবিস এত! একটা কথাও শুনেছিস কি? এখন সামাল দিবি কী করে?
একটা কেমন উদ্দীপনা অনুভব করছি, হঠাৎ! ঘাড় নেড়ে আর হাত তুলে এক আর দু’ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দিলাম যথাক্রমে। পাশেই শুরু গলি। এ জায়গাটা এমনিতেই খালি খালি। ভেতরে ডিম ইয়োলো লাইটের একটা ওম্ তৈরী হয়েছে। বাইরে নিরন্তর ট্রাফিক। হাত ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে: পাঁচটা দশ। রিভলভিং ডোর আর তার মাথার ওপর বিরাট এক ইউরোপীয় রূপকথার অপদেবীর মূর্তি। মধ্যযুগীয় ইউরোপ যেন আধুনিক কোলকাতার ছোট্ট এক কোণে হঠাৎ একটু জায়গা করে নিয়ে। অস্ফুটে উচ্চারণ করলাম, “মেডুসা!”। দরজা ঠেলে পা বাড়ালাম ভেতরে।
– “আমি শ্লোক ভাসালাম জলে
ধ্রুব, সত্য, তুলেছে নোঙর
বলে জিহ্বা গুপ্তনাম বলে”…
বাইরে থেকে এসেছি বলে ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। যিনি বলছেন তাঁর মাথার কাছেই হলুদ আলোটা। চোখ সয়ে আসার আগে স্বগতোক্তি করলাম, “হৃৎপিণ্ড লাঠির ওপর”!
বলেই খেয়াল হলো, যাঁকে প্রত্যুত্তর দিলাম, তাঁর স্বর। পাহাড় থেকে ঝর্ণা নেমে আসার মত, বড্ড কাঁচা উদাহরণ মাথায় এল বলে খানিক অপ্রস্তুত হলাম, তবু সংযত হ’তে চাইলাম। আমি জানি, আমি ঠিক জানি, এমন স্বরের ক্ষমতা আছে, ছেলেদের খেয়ে ফেলার, আমিও তার ব্যতিক্রম নই, বাইরের মূর্তিটা মনে ভাসল এক ঝলক, “মেডুসা”। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম চোখ সয়ে আসা অবধি। তারপর চোখ সয়ে এল। চোখে এল। সে চোখে এল।
২
হিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা মিইয়ে এসেছে, যদিও জানি উঠে আসবে আবার, এ ঝড়ের পূর্বাভাস ছাড়া আর কিছুই নয়। দীপের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে যেদিন, সেদিন শীত নেমেছিল প্রথম। কোলকাতা শহরে গুপ্ত ঘাতকের মত ঢুকে এসেছিল নীলচে উত্তুরে হাওয়া। উষ্ণতা খুঁজে ফিরছিল মানুষ একে অপরের বুকে, একে অপরের শরীরে, মনে, চিন্তায়…। প্রায় প্রতিদিনের মতনই নিজের ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে বেরিয়েছিলাম বিকেলবেলা। বাবা-মা সেপারেট হওয়ার পর এবং আমাকেও নিজেদের থেকে ‘তাঁরা’ দূরে সরিয়ে রাখার পর এই ফ্ল্যাটটা আর যে কয়েকটি টাকার থোকা আমার জীবনে এসে জুটেছিল, বই কিনে, লিখে আর বিভিন্ন রকমের উষ্ণতা খুঁজে বেরিয়েও এ শহরে জীবন ধারণ ও তার ধারনা খুব অসুবিধার কাজ কিছু ছিল না। আমার মনে আছে, রেডিও-টিভিতে আগে থেকেই সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, বরফের মধ্যে জেগে উঠবে শহর, কিছুদিনের অপেক্ষায়। বরফ এবার তাড়াতাড়ি ছুঁয়ে দেখবে তিলোত্তমাকে।
সারাটা সকাল হিয়ার সঙ্গে গল্প করেছি, ফোনে। ও উত্তেজিত হয়ে পড়লে মাঝে মাঝে এমন একটা উঁচুস্বরে কথা বলে ওঠে, যে, যারা ওকে চেনে, তাদের পক্ষে এইটা অনুমান করতে খুব অসুবিধা হয়না যে, মেয়েটা কোনো কিছু নিয়ে প্রবল উত্তেজিত। আজকের বিষয় খুব খারাপ কিছু নয়, জোনাথান হার্কারের ভাগ্য বিপর্যয়, অসামান্য অভিজ্ঞতা আর সেই উঁচু নিচু পাহাড় শ্রেণীতে বরফের আগমন। ও জোনাথানকে ঈর্ষা করে। কারণ, অবশ্যই সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তবে ওর মতে, লেখক নিশ্চয়ই জানতেন না সেই অভাবনীয় ‘মুসিবত’ থেকে কী করে হার্কারকে বের করে আনতে হতো, তাই ডায়েরিতে ওরকম করে শেষ করেছেন। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন অপরাজেয় শক্তি হিসেবে। আমার কিছুটা ভিন্ন মত ছিল। কিন্তু ওকে তা বোঝায় কে!
সেই প্রথম আলাপের পর এক সপ্তাহ না দীপ, না আমি কারো সাথেই কোনোরকম বাক্যালাপ নিষ্প্রয়োজন মনে করেছিল হিয়া। তারপর ধীরে ধীরে হেমন্তের মাঝামাঝি আমার জীবনে ওর প্রবেশ। ওর চেয়ে সুন্দরী কোনো মহিলা যে আমার জীবনে আগে আসেনি তা নয়, বরং যাঁরা ছিলেন তাঁদের বেশিরভাগ ওর থেকে সুন্দরী, এমন যাঁরা পুরুষ শরীরে শিহরণ তুলতে পারেন। শিহরণ। ঠিক নিটোল একটা ঢেউ। a perfect sinusoidal wave; যার উৎপত্তি নেই, শেষ নেই। তবে আমি নিশ্চিত যে এক্ষেত্রে সেটি cosine, কারণ শুরুই হয় অত্যন্ত ওপরে। ম্যাথের ভাষায়, থুড়ি ছবিতে, অক্ষরেখার মাঝবরাবর, sine এর মতো নীচ থেকে নয়। কেউই আমার প্রেমিকা নন, কিন্তু তাঁদের সাথে একসঙ্গে বাস করতে আমি দ্বিতীয়বার ভাবিনি। কারণ, আমার যৌনস্পৃহা। আমার যৌনতা বোধ ও যৌনক্ষমতা সাধারণের চেয়ে কিঞ্চিত বেশি, এ বোধ আমার হয়েছে অনেক আগেই, সেই মত আমিও মানিয়ে নিয়েছি নিজেকে, কিন্তু কারোর সাথেই এত কথা বলিনি আমি, ভাগ করে নিইনি নিজের গূঢ় কিছু কথা। হিয়ার প্রতি আমি আকৃষ্ট, নিঃসন্দেহে, কিন্তু শুধুই শারীরিকভাবে নয়! ওর গলায়, ওর কথায় এমন কিছু আছে যা আমাকে তীব্রভাবে টানে। মিলন আমাদের হয়নি, আমি ওকে বিন্দুমাত্র আভাসও দিইনি আমার ইচ্ছের। যদিও, আমার বিশ্বাস, সেটা ও ভালো করেই জানে। প্রথম দিন থেকেই জানে।
আজ পর্যন্ত যত মহিলার কাছে আমি গেছি, তাঁরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে বিশেষ। তাঁদের সেই আলাদা ক্ষমতাই আমি জমিয়ে রেখেছি নিজের কাছে। কোনো কোনো মানুষের collection এর সখ থাকে, কেউ স্ট্যাম্প জমান, কেউ পুরোনো মিউজিক সি ডি, কেউ সেল্ফি, কেউ স্টক, কেউ সই জমান, তো আবার কেউ শুধু স্মৃতি জমিয়েই সুখী। আমার ক্ষেত্রে সখটা একটু বেয়াড়া রকমের। যে সমস্ত মহিলার সঙ্গে আমি সম্ভোগ করেছি, তাঁরা আলাদা ক্ষমতা এবং মিলনের সময় তাঁদের সেই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ আমি খুঁটিয়ে লক্ষ্য করি। সেই সমস্ত স্মৃতিই আমার প্রাপ্তি। জীবনে বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক হিসেবে উঠে দাঁড়াতে সে সমস্ত আমার কাজে আসবে। ওরাই তৈরী করবে আমাকে। তবু হিয়া আলাদা। আগের দিন কথা বলছিলাম আমরা একটা উপন্যাস নিয়ে, “The Time Travelers Wife”, ও বোঝাচ্ছিল প্রেমে অপেক্ষা কত সুদীর্ঘ, কেবল যৌনতা বা আশ্রয় নয়, একটা প্রশান্তি, একটা পরিশুদ্ধি! ওকে আমি এমনিই খুঁটিয়ে লক্ষ্য করি আমার ভালো লাগে। নাহ্ প্রেমে আমি পড়িনি। পড়তে পারিনা। সে শুধুই যৌনতা যা আমাকে সঙ্গ দেয়।
উত্তেজনার মুহূর্তে কখনওই বিচলিত হই না আমি, কারণ আবেগের ছিটে ফোঁটাও আমার মধ্যে নেই। ফুটবলে যেমন প্লেয়ার কোচ থাকে, আমার অবস্থাও খানিক তাই। একজন দক্ষ performer মাত্রেই একজন আরও দক্ষ দর্শক, এ বিষয়ে আমার মনে অন্তত কোনো দ্বিমত নেই। ফাঁকা ঘরে সিলিং এর দিকে চেয়ে এসব ভাবছি, কাচের জানালার বাইরে আবছা নীল আলো ঘুরছে শহর জুড়ে, শীত নামছে। আশ্রয় খুঁজছে প্রাণীরা। মনে পড়ে, ছোটোবেলায় বাড়ির পাশের পুকুরটাকে। এইরকমই শীতের দিনে লাগাতার স্কুল কামাই করতাম। বলার, বাধা দেবার কেউ নেই, অতএব…। সে পুকুরটা গাছপালায় ঘেরা ছিল, জল প্রায় জমে আসার মত অবস্থা হতো শীতে। কিন্তু আমার ঘরের জানালাটার ঠিক নীচে এক কোণে এক চিলতে রোদ ঘোরাফেরা করত, সারাদিন। সমস্ত ছোটো মাছগুলো, যারা মারা পড়বে চরম শীতে, কয়েকদিন পরেই, এসে জড়ো হতো ঠিক ওইখানটায়। আমার কেন যে ভালো লাগত এ দৃশ্য দেখতে, জানি না; সারাদিন ধরে, এই দেখে যেতাম। তাই বোধহয় রোদ্দুরের মত, মেয়েরাও আশ্রয় নিতে আসে আমাতে।
— কীরে! কোথায় গেলি! শালা নেমকহারাম!
— আরে দীপ! কী হয়েছে চেঁচাচ্ছিস কেন? ওপরে আয়!
— যাব না। যাব না তোর বাড়ি!
— রাস্তার মধ্যে চেঁচাস না!
— তোকে দেখে নেব রে শুয়োরের বাচ্চা!
— মুখ সামলে কথা বল!
— হয় তুই থাকবি নাহলে আমি হিয়ার…!
শেষাংশটা আমাকে থমকে দিল। হিয়া কি তবে দীপকে আমার নাম বলে না করে দিয়েছে? কী জানি! দীপ বলার মুডে নেই! হিয়া কোনোদিনই বলবে না কী হয়েছিল! এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি, কনকনে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে শেষ সূর্যের দিকে আমার ফ্ল্যাট পেরিয়ে, আমাদের সোসাইটি পেরিয়ে, ট্রাফিক পেরিয়ে, এই শহরটাকেই পেরিয়ে চলে যাচ্ছে দীপ। সেই ওকে আমার শেষ দেখা!
ফোনটা তুলতেই দেখলাম দীপের মেসেজ। অনেক অনেক গালাগালি, অভিশাপ পেরিয়ে এক টুকরো অনুযোগ। “শেষে তোর চোখ হিয়ার ওপর পড়ল! আমি কী ক্ষতি করেছিলাম রে তোর?” সকালে, হিয়ার সঙ্গে বলা কথাগুলো মনে পড়ল। মনে পড়ল ব্রাম স্টোকারের উপন্যাস। উত্তর দিলাম:
“I think you’re having a nightmare, Mr.Harker!”
আর পরের চ্যাট খুলে হিয়াকে লিখলাম, “আজ, এখন, এই মুহুর্তে, তোমাকে চুমু খেতে বড্ড ইচ্ছে করছে ‘লুসি’!”
সন্ধ্যে নামল ঝপ করে। নিজের অজান্তেই এক অদ্ভুত হাসি দেখা দিল আমার ঠোঁটে, আমি নিশ্চিত, আমার একমাত্র গজ দাঁতটা চকচক করে উঠেছিল তখন!
৩
আজ, হিয়া এসেছে আমার ফ্ল্যাটে, আমার বইগুলো গুছিয়ে রাখতে, একা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না! একতাল বই দু’জনে মিলে গুছিয়ে রাখছি সেই দুপুর থেকে। গরম পড়েছে সবে। বিকেলের রোদ এসে আমাদের চোখে, মুখে, গায়ে মাখামাখি করছে। শ্রান্ত ঘুঘু পাখি গরমের আলস্য বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও। এখনও কয়েকটা বই পড়ে আছে। আমি বিরক্ত হয়ে একটা টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলাম।
— আর পারছিনা! যা আছে থাক! কিছুক্ষণ পরে হবে। তুইও বসে পড়!
— দাঁড়া!
হিয়া এসে আমার টেবিলেই বসল। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে। হিয়া আমার কাঁধে নিজের মাথাটা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল!”
এর আগে ঠিক কী হয়েছে আমি জানিনা। আমার স্মৃতিতে সেসব নেই। বাইরে বৃষ্টির কমতি নেই। হাতে ধরা আছে ডায়েরিটা। আজকের এন্ট্রি করতে গিয়ে দেখি পাতা চল্লিশেক আগে স্টেবল করা। কিছু কিছু অংশে ছেঁড়া। যেন আগেও এই স্টেবল খোলা হয়েছে, এমন! এতক্ষণ সেসবই পড়েছি যা ওই ডায়েরিতে আছে! বেশকিছু কথা সত্যি। আমার অবস্থা, আমার মনের অবস্থা, দীপের সঙ্গে আমার বাদানুবাদ, হিয়ার সঙ্গে পরিচয়! যতটুকু আমার মনে আছে, বা আমার এখনকার এন্ট্রিতেও আছে, তা হ’ল, হিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় দীপের স্মৃতিতে, বন্ধুদের করা অনুষ্ঠানে! তার আগে দীপের মুখে হিয়ার কথা শুনেছি, কিন্তু…
“হিয়ার লাইট হোয়াইট পাতলা ড্রেসের ভেতর দিয়ে ওর বুকের অবয়ব খুব অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আমার নিজের বাঁ হাতটা ওর সুডোল থাই এর ওপর আলতো করে রাখা আছে। গায়ে ঘামের আবছা গন্ধ আস্তে আস্তে আমাকে আরও উত্তেজিত করে তুলছে। আমি জানি, হিয়া আমার প্রতি এ বিষয়ে একেবারেই নিস্পৃহ। তবু একটা বেয়াড়া ইচ্ছে আমার ওপর চেপে বসছে। “A Violent Desire”! সেই তীব্র ইচ্ছে, সেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, ধীরে ধীরে অথচ অতর্কিতে জেগে উঠছে আমার প্যান্টের ভেতর, শক্ত; পাথরের মত। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছে। ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি অবদমনের। কিন্তু তার তীব্রতা এতটাই বেশি, এতটাই শক্তিশালী যে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসার উপক্রম!
আমি আর পারলাম না।
হিয়াকে ধরে ঘুরিয়ে নিলাম নিজের দিকে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলাম ওর ঠোঁট, মুখ! তীব্র গতিতে প্রায় উপড়ে ফেলতে লাগলাম ওর সমস্ত বহিরাবরণ। হিয়া এমন আচমকা আক্রমণে বিমূঢ় হয়ে গেছে। মাথায় কে যেন বলে উঠল, “এটাই এটাই! এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে হবে!” বলা বাহুল্য লাগলামও…
যৌন ক্ষমতায় কম এমন অপবাদ তো আমার শত্রুও কোনোদিন দেবেনা আমায়, যে অপবাদ চিরকাল মায়ের মুখে শুনেছি বাবার প্রতি! আর গুম হয়ে থাকতে দেখেছি বাবাকে। প্রবেশ করলাম…। তবে হিয়া ছিটকে ফেলে দিল আমায়! স্থির হয়ে বসে থাকতে থাকতে আদেশ এল, এটুকু লিখে রাখার! লিখে রাখলাম। মোহাবিষ্টের মত। হিয়া ডাকছে। আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। আমি আর পারছি না লিখতে…”
শেষের দিকে লেখাগুলো কেঁপে গেছে! মনে হল খুব স্বাভাবিক। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না! এ লেখা পড়ে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা বোধ হল না শরীরে। আমার শরীর ঠাণ্ডা। আজ হিয়ার বাড়িতে আমার যাওয়ার কথা। আমি যাচ্ছি। আমাকে ও ডাকে। আমাকে যেতে হয় এতদূরই জানি। এ ডায়েরিও আমাকে নিয়ে যেতে হয়। আমি নিয়ে যাই।
ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ওর বাড়ির কলিং এ চাপ দেওয়া অবধি ভাবতে চাইলাম অনেক কিছু, বুঝতে চাইলাম। পারলাম না। পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেছে মাথাটা। পুরোটা খালি। কলিং এ চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। আবছায়া ঘরে হিয়ার গলা…
— ভেতরে আয়!
লাস্য ছলকে পড়ছে কাচের গা দিয়ে। হিমশীতল, তীব্র, ধূমায়িত! শুধু একখানা কুচো অন্তর্বাস হিয়ার শরীরে, চোখে মুখে খেলা করছে হাতছানি! ওর মাথার কাছে আলোটা, তার নীচে লেখা একটা কবিতার লাইন, দেয়ালে আটকানো, “শুধু প্রেম নয়, যুগপৎ ঘৃণা রেখো মনে!” ডায়েরিটা হাত থেকে নিয়ে সোফায় ফেলে পা দুটো প্রসারিত করে আমায় ডাকল:
— আয়!
প্রবেশ করলাম। মনে শুধু সন্দেহ, কৌতুহল, একফোঁটা যৌনতা বুঝি তখনও ছিল। শিউরে উঠলাম! তারপর, তারপর সব অন্ধকার…।
চোখ খুলতে দেখি, হিয়ার ঘরের আলোর মত নিস্তেজ আলো চারিদিকে। যেটায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা যে আদৌ কী আমি জানিনা। মাথার ওপরে, পায়ের নীচে, ডাঁয়ে, বাঁয়ে পুরোটাই শুধু সেই। আমি আসলে দাঁড়িয়ে কি, না ভাসছি? কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিনা শুধু সেই আলোটা বাদে। আমার চেতনা ধীরে ধীরে নিভে আসছে আবার। আমাকে কেউ যেন কোনো অতল কুয়োতে ঠেলে দিচ্ছে, সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে আমি পড়েই চলেছি, আমি নিভেই চলেছি, গোলাকার একটা ফাঁপা আংটির ভেতরে আটকে পড়েছি যেন। যেন কোটি কোটি মহাবিশ্বের কোনো একটা ফাঁকে আমার জায়গা। বিশ্বজরায়ুর ত্রুটিতে আমার জায়গা। আমার কোনো escape নেই, কোনো access নেই। আমি হারিয়ে গিয়েছি। এক মুহূর্তে flash memory ‘র মত মনে আসে কত নাম, কত সম্ভাবনা, পড়ে ফেলা কত কবিতা, কত গল্প! হিয়ার মুখটা ভেসে ওঠে। ওর ছোট্ট নাক, ওর পাতলা ঠোঁট, ওর নিখুঁত দুটো কান, যেন এই কেউ লাগিয়ে দিয়ে গেছে। অদ্ভুত একটা প্রশান্তি আসে। আমি কি মারা গেছি তবে? জানিনা। হিয়ার গলা কানে আসতে আসতে মিলিয়ে যায়…। হিয়া পড়ছে। না বোধহয় আমাকেই যেন পড়ে শোনাচ্ছে:
“In an instant it’s sucked back into the darkness behind and vanishes. But if you close your eyes, that point of light stays with you, just barely, for a few moments. ”