রিনি গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস ঋতায়তে     ( সপ্তম পর্ব ও অষ্টম পর্ব)

রিনি গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস ঋতায়তে  ( সপ্তম পর্ব ও অষ্টম পর্ব)

আটের দশকের মফসসল শহরে বেড়ে উঠছিল একটি মেয়ে। ঋতি। এক অসুস্থ শৈশবে, ভিড়ের মধ্যেও নির্জনে তার বড়ো হয়ে ওঠা। একটু যত্ন, সামান্য ভালোবাসা না পাওয়া কাঙাল এই মেয়েটির বড়ো হয়ে ওঠা এই উপন্যাসের বিষয়। দমবদ্ধ এক পারিবারিক আবহে অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরা মেয়েটির জীবন, তার লড়াই! নারী হিসেবে, অসুন্দর হিসেবে, গরীব হিসেবে এই সমাজ মানসের সঙ্গে তার একার লড়াই। পাশে রয়েছে মা, নিরুপায়, অসহায়। তবু অদম্য জেদ ঋতিকে এগিয়ে দিয়েছে। যদিও এই উপন্যাস ঋতির ক্ষরণের ইতিহাস। তার নির্মল মন, তার নিখাদ ভালোবাসার ক্ষরণ। সমকাল, তার মনবদল, নববইয়ের বিচিত্র পট পরিবর্তন সবই ছুঁয়ে আছে এই উপন্যাসের শরীর! ঋতি কি শেষপর্যন্ত পৌঁছোতে পারবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে! আজ প্রকাশিত হল উৎসব পরবর্তী দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সপ্তম ও অষ্টম পর্ব।

 

৬১

মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ঋতির পরীক্ষা শুরু হলো। শিয়ালদার কাছাকাছি একটি কলেজে সিট পড়েছে ওদের। শ্রী ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে পরীক্ষা দিতে। আগেরদিন রান্নাবান্না করে শ্রী গুছিয়ে রাখল। অনন্তকে শ্রী বলেছিল, একটু বেশি করে মাছ এনো। একসঙ্গে দুদিনের রান্না করে রাখব। অনন্তর মিল বন্ধ। ফলে বাজারে যাওয়ারই তার ইচ্ছে নেই। শ্রীর আক্কেল দেখে সে বিরক্তই হলো। বাজার থেকে ফিরে মাছের প্যাকেটটা ছুঁড়ে কলের তলায় ফেলে দিয়ে সে বলল, এনাও তোমার বেশি করে মাছ এনে দিয়েছি। শ্রী বিরক্ত হলো অনন্তর কথা শুনে। কিন্তু কোনো উত্তর করল না। মেয়েটার পরীক্ষা। এমনিতেই ঋতি কোনোকারণে মনমরা হয়ে রয়েছে আজ বেশ কয়েক মাস। চোখের তলায় একপর্দা করে কালি পড়ে গেছে। পিরিয়ডের সমস্যাটাও বেড়েছে। পনেরো দিনের মাথায় পিরিয়ড হয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পেটে ব্যথা। তাই নিয়েই পাগলের মতো পড়াশোনা করেছে মেয়েটা। পরীক্ষার আগের দিন বাড়িতে অশান্তি করে ওর কনসেন্ট্রেশন নষ্ট করতে চায় না শ্রী। 

প্রচণ্ড গরমে পরীক্ষা শুরু হলো। ঋতি এক বোতল গ্লুকন্ডি নিয়ে বসেছে। লিখছে আর একটু একটু করে গ্লুকন্ডি খাচ্ছে। এই প্রথম সে চার ঘণ্টা টানা পরীক্ষা দেবে। বাড়িতে ঋতি লেখা প্র্যাকটিস করেছে একসঙ্গে চার ঘণ্টা। কিন্তু এখানে খানিকটা লিখতে না লিখতেই ঋতি দেখল তার ডান হাতের জয়েন্টটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। জোর করে ওভাবে লিখতে গিয়ে হাতটা অবশ হয়ে গেল। হাতের লেখা খারাপ হয়ে গেল। কি করবে বুঝতে না পেরে ঋতি ওভাবেই দাঁতে দাঁত চেপে লিখতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তখন কাঠ বোর্ডটাকে কোলের ওপর নামিয়ে নিয়ে পিঠ ভাঁজ করে লিখতে শুরু করল। এবার দেখল আস্তে আস্তে জয়েন্টটের ব্যথাটা কমে যাচ্ছে। সব প্রশ্ন তার কমন এসেছে। প্রত্যেকটা উত্তর লেখার জন্য চল্লিশ মিনিট সময়। ঋতি প্রাণপণ লিখছে। 

লিখতে লিখতে হঠাৎই সে খেয়াল করল একজন ইনভিজিলেটর এসে তার আপার বেঞ্চে রাখা প্রশ্নপত্র, রুমাল সমস্ত চেক করছে। ঋতি তাকিয়ে আছে দেখে তিনি বললেন, দেখি তোমার বোর্ডটা। ঋতি খাতাটা আপার বেঞ্চে রেখে বোর্ডটা দেখাল। তিনি এবার ঋতির খাতাটাও খুলে খুলে দেখতে লাগলেন। তারপর বললেন, আপার বেঞ্চে সোজা হয়ে বসে লেখো। ঋতি বলল, ম্যাম, আমার হাতটা খুব যন্ত্রণা করছে। লিখতে পারছি না। তাই কোলে রেখে লিখছি। ভদ্রমহিলা বললেন, ওভাবে লেখার নিয়ম নেই। সোজা হয়ে বসে লেখো। ঋতি বাধ্য হয়ে আবার আপার বেঞ্চে খাতা রেখে লিখতে শুরু করল। আবারও তার হাতে ব্যথা শুরু হলো। ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। হাতের স্পিড কমে যাচ্ছে। ঋতির চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ও লেখা শেষ করল। হাতে তখনও মিনিট তিনেক বাকি। পুরো খাতাটা একবার ভালো করে দেখতে গিয়ে ঋতি দেখলো শেষের দিকে হাতের লেখা খারাপ হয়ে গেছে। মন খারাপ হয়ে গেল তার। বরাবরই ঋতির পরীক্ষার খাতা থাকে ছবির মতো। ভেবে চিন্তে উত্তর লেখে ও। যাতে কাটাকুটি না হয়। কিন্তু আজকের খাতাটা ঋতির মনের মতো হলো না। ঋতির চোখে জল ভরে এলো। কোনোরকমে খাতা জমা করে বাইরে এসে মাকে সব বলল ঋতি। শ্রী অবাক হয়ে গেছে ঋতির হাতে ব্যথা হয়েছে শুনে। এমন তো কোনোদিন হয়নি তোর! ঋতিও বুঝতে পারছে না কারণটা। সেকেন্ড পেপার পরীক্ষায় খুব কিছু অসুবিধে যদিও হলো না। থার্ড পেপার কথাসাহিত্য। ঋতি দেখল অনেকগুলো প্রশ্নই তাকে হলে বসে তৈরি হয়ে লিখতে হবে। প্রশ্ন বেশ জটিল হয়েছে। ঋতি খাতার পেছনে রাফ ওয়ার্ক করতে শুরু করল। ওর তৈরি করা উত্তরগুলো একদিকে লিখছে। আরেকদিকে জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর কিভাবে লিখবে তার পয়েন্ট সাজাচ্ছে রাফ অংশে। আজকে যিনি ইনভিজিলেশনে ছিলেন তিনি কি বুঝলেন জানা নেই, ঋতির খাতার পেছনে ওই পয়েন্টগুলো কোথা থেকে এলো সেই নিয়ে ঋতিকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। ঋতি কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে ওটা সে এখানে বসে বসেই লিখেছে। রাফ করছে খাতার পিছনে। ঋতিকে একজন ফিমেল টিচার এসে চেক করলেন। কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু রাফ ওয়ার্কটা কাটতে ঋতিকে বাধ্য করা হলো। ঋতি আর কথা না বাড়িয়ে কেটে দিল। বাকি পরীক্ষাটায় তার মনটা খিঁচড়ে থাকল। সেইসঙ্গে আজও ঋতির হাতে ব্যথা করছে। সেকথা যে বলে লাভ নেই সেটা বুঝে ঋতি কষ্ট করে লিখে পরীক্ষাটা শেষ করল। বাড়ি ফিরে শ্রীকে সবকিছু বলাতে শ্রী ঠিক করল আগামী পরীক্ষার দিন গিয়ে শ্রী কথা বলবে ঋতির ব্যাপারে। কার সঙ্গে কথা বলতে হবে শ্রীর জানা নেই। তবে কিছু একটা ব্যবস্থা তো শ্রীকে করতেই হবে। পরেরদিন পরীক্ষা শুরুর আগে শ্রী দারোয়ানকে বলল, প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। দারোয়ান কারণ জিজ্ঞেস করায় বলল, একজন পরীক্ষার্থী সম্পর্কে কথা বলব। দারোয়ান বলল , তবে পরীক্ষার ইনচার্জে যিনি আছেন তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। একজন প্রফেসরের কাছে শ্রীকে নিয়ে যাওয়া হলো। শ্রী ঋতির পরিচয় দিয়ে গত দুদিনের ঘটনা জানাল। অনুরোধ করল, ওর হাতে সমস্যা হচ্ছে। ওকে একটু ওর সুবিধে মতো লিখতে দিন দয়া করে। ভদ্রলোক বোধহয় বুঝলেন কিছু। ঋতি দেখল তার পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর দুজন প্রফেসর তার কাছে এসে তার নাম জিজ্ঞেস করল। 

ঋতি ঘোষাল।

তোমার হাতে কী সমস্যা হয়েছে? 

ঋতি বলল। 

ঠিক আছে, তুমি তোমার সুবিধে মতো লেখো। কোনো অসুবিধে হলে বলবে। বসো। 

বাকি পরীক্ষাগুলো ঋতি নির্বিঘ্নেই দিতে পারল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে পার্ট টু এর ক্লাস শুরু হয়ে গেল। ঋতি আবার কলেজ যাচ্ছে। পড়াশোনা করছে। কিন্তু ওকে দেখলে মনে হয় ওর ভেতরে কোনো প্রাণ নেই। কেমন মরা মানুষের মতো। ওর ওই উজ্জ্বল চোখদুটো কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে স্নেহময়দার কোনো খবর নেই। ঋতির জন্মদিনেও স্নেহময়দা কোনো যোগাযোগ করেনি। ঋতি জ্যেঠু, বম্মাকে প্রণাম করতে গিয়ে রুশিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল, স্নেহময়দা ফোন করেছিল? 

না তো। কেন? তোকে ফোন করবে বলেছিল?

এমনভাবে রুশি প্রশ্নটা করল যে ঋতির উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। ঋতি পাগলের মতো ভেবে চলেছে কী হয়েছে যে স্নেহময়দা একবারও এলো না! যোগাযোগ করল না! স্নেহময়দা তুমি ঋতিকে ভুলে গেছ এ তো কিছুতেই সম্ভব নয়। কিছুতেই নয়। তবে কী হয়েছে! স্নেহময়দা তুমি কোথায়! ঋতির আর কোনো ভাবনা নেই। আর কোনো দিকে মন নেই। ঋতি কেবলই ভাবছে! কেবলই ভাবছে স্নেহময়ের কথা! কেমন যেন একটা অভিমান জন্মাচ্ছে ঋতির মনে। তুমি এতোগুলো মাস আমাকে না দেখে থাকতে পারছ স্নেহময়দা! 

 

৬২

কলেজ খুলতেই ঋতির কয়েকজন স্যার, ম্যাডাম তার পরীক্ষার খোঁজ নিলেন। ঋতি যেভাবে উত্তর লিখে এসেছে তাতে তার ভালো নম্বরই পাওয়ার কথা। এবছর প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। ঋতির ক্লাসের সেই অহংকারী মেয়েটি যে কখনো ঋতির সঙ্গে কথা বলে না সে হঠাৎ ঋতিকে জিজ্ঞেস করে বসল, কি রে! ফার্স্ট ক্লাস পাবি তো! বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে ঠোঁট টিপে হাসল। ঋতি ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনো উত্তর করল না। ঋতির আসলে এসব কোনো কথাই ভালো লাগছে না। কোনো কিছুতেই সে আর উৎসাহ পাচ্ছে না। পার্ট টুর সিলেবাসের টেক্সট তো তার সেই কবে পড়া হয়ে গেছে। এখন শুধু ক্লাস ফলো করার পালা! কিন্তু মন দিয়ে ক্লাসের পড়া শোনার মতো অবস্থায় ঋতি নেই। কলেজের বিরাট বিরাট ঘর, কড়িবড়গা, পেল্লায় সব থাম তাকে যেন গিলে খেতে আসছে। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। ঋতি বাইরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে। স্নেহময়দা যেদিন চলে গেল সেদিনও এমনিই বৃষ্টি হয়েছিল। ঋতির মনে পড়ে যাচ্ছিল একা মেঝেতে পড়ে তার সেই বুকফাটা কান্নার কথা! ওই কান্নাটাই তবে শেষ সত্য হয়ে থাকবে! তার জীবনে আর ভালো কিছু ঘটবে না! ঋতি চিরকাল মাকে পুজো করতে দেখেছে। কিন্তু কোনোদিন ঈশ্বর নিয়ে আলাদা করে কোনো ভাবনা তার মাথায় আসেনি। আজকাল তার ভাবনার মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা উঠে আসে। মনে হয়, তুমি তো সব জানো ঈশ্বর! তুমি বলে দাও আমি কি করব! কিভাবে খুঁজে পাব আবার স্নেহময়দাকে! স্নেহময়ের নামটা উচ্চারণ করলেই ঋতি আজকাল ঘামতে থাকে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসে। একটা অজানা আশঙ্কা তাকে যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরোনোর দিন এগিয়ে আসে। পুজোও চলে এসেছে। একবছর হতে চলল স্নেহময়দার খোঁজ নেই। পঞ্চমীর দিন ঋতিদের রেজাল্ট বেরোবে। ঋতি ঠিক করল এটাই সুযোগ। ঋতির রেজাল্ট জানানোর জন্যই ঋতি ফোন করবে স্নেহময়দার বাড়িতে। শুধু রেজাল্ট জানিয়ে স্নেহময় ভালো আছে কি না জেনে ঋতি ফোন রেখে দেবে। আর কোনো কথা বলবে না! অভিমান! অভিমান ঋতির কথা খেয়ে নিয়েছে। ঋতি কথা বলবে না। শুধু জানিয়ে দেবে সে আছে। মরে যায়নি। কিন্তু ঋতির সব ভাবনায় জল ঢেলে দিল ঋতির রেজাল্ট। ঋতি ফার্স্ট ক্লাস তো পায়নিই… এমনকি তার ধারে কাছেও তার নম্বর নয়। ঋতি মাত্র পঞ্চান্ন শতাংশ নম্বর পেয়েছে। রেজাল্ট দেখে ঋতি হতবাক। এতো কম নম্বর আসার তো কথা নয়! ওই অহংকারী মেয়েটি ঋতির থেকে ভালো নম্বর পেয়েছে। তবে কি ঋতি কলেজে ঢুকেই যেসব কথা শুনেছিল সেসব সত্যি! বিশেষ কোনো প্রফেসরের কাছে পড়লে তবেই ভালো নম্বর পাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। ঋতির পক্ষে তো সেসব সম্ভব নয়। ঋতিকে নিজের মতো করে লড়াইটা করতে হবে। টাকা দিয়ে ভালো রেজাল্ট কেনার টাকা ঋতির নেই আর সেই মতিও ঋতির নয়। এখন টাকা দিয়ে রেজাল্ট ভালো হলেও একদিন না একদিন এই ফাঁকির ফাঁদে পড়তেই হবে বলে ঋতি বিশ্বাস করে। তখন আর কেঁদে কুল কিনারা পাওয়া যাবে না। ঋতি তাই লড়াইটা চালাবে। খারাপ রেজাল্ট একমুহূর্তের মধ্যে ঋতির মনটাকে অন্য দিকে ঠেলে দিল। সামনের বুথটার দিকে তাকিয়ে ঋতির চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। এখনকার মতো স্নেহময়দাকে আর ফোন করা হলো না। এই খারাপ রেজাল্টের খবর তো আর দেওয়া যায় না! ঋতি বাড়ি ফিরে এলো। পুজোটা কোনোক্রমে মিটল। বিজয়ার দিন ঋতি এক বছর আগের কথা ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে কখন যে মগ্ন হয়ে গেছে জানে না। ঋতির যেন টের পাচ্ছে সেই গন্ধটা! সেই যে ঘামে ভেজা অদ্ভুত মাদকতাভরা একটা গন্ধ। ঋতির হঠাৎই মনে হলো শুভবিজয়া জানানোর জন্যেও তো একটা ফোন করা যায়। বাবা এইসময় বাড়িতে নেই। ঋতি খুব ভেবেচিন্তে আস্তে আস্তে মাকে গিয়ে বলল, মা স্নেহময়দাকে একটা ফোন করব? শুভ বিজয়া জানাব?

শ্রী রান্নাঘরে বাসন মাজছিল। এক সেকেন্ডের জন্য হাতটা যেন থামল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন করে বলল, স্নেহময়ের বাবা মারা গেছেন।

ঋতি কথাটা ভালো শুনতে পায়নি যেন। মার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। 

মে মাসে মারা গেছেন। তোর পরীক্ষা চলছিল বলে তোর বাবা বলতে বারণ করেছিল। 

ঋতির বিস্ময় যেন শেষ হচ্ছে না। স্নেহময়দা ফোন করেছিল! এতো বড়ো একটা খবর জানিয়েছিল! আর বাবা ঋতিকে জানতে দেয়নি! মাও সেটা মেনে নিল! 

ঋতি খানিকক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সরে গেল ওখান থেকে। কী করবে এবার সে? এখনই ছুটে গিয়ে স্নেহময়দাকে ফোন করবে? কিন্তু স্নেহময়দা তো ঋতির ওপর অভিমান করেছে হয়তো! এমন একটা বিপর্যয়ে স্নেহময়দার পাশে ঋতি থাকল না। মে মাস! আর এটা অক্টোবর মাস! এতোগুলো মাস! কী বলবে সে স্নেহময়দাকে! ঋতি অস্থির হয়ে উঠেছে। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ভয় করছে তার! ভীষণ ভয় করছে। মনে হচ্ছে একটা সর্বনাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। না কি সর্বনাশ ঘটেই গেছে! সে টের পায়নি। তাকে জানতে দেওয়া হয়নি। বাবা! বাবা তার সঙ্গে এই প্রতারণা করল! বাবা মা তো সবই বুঝেছিল। এভাবে তবে স্নেহময়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল কেন! ঋতির কানে ভাসছিল বাবার কথাটা, ‘ও ওর জাতটা চিনিয়ে দিয়েছে!’ জাত ! তবে জাতের কারণে বাবা এই সম্পর্ক মেনে নিল না! আর মা সেটাকে সমর্থন করল! এই ২০০২ সালে দাঁড়িয়ে জাত নিয়ে ভাবছে তার বাবা মা! ঋতির মনে হচ্ছে সে বোবা হয়ে গেছে। শ্রী হাত ধুয়ে এসে ঋতির সামনে দাঁড়িয়েছে। শ্রী যেন কিসব বলছে! ঋতি কি কানে শুনতে পাচ্ছে না। ঋতি বোকার মতো তাকিয়ে আছে মার দিকে। কিছু শুনছে না, বলছেও না। 

 

৬৩

শ্রীর শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে। দশদিনও বাদ থাকছে না। আবার হচ্ছে। এতো হচ্ছে যে কাপড় বেশিক্ষণ পড়ে থাকা যাচ্ছে না। বারবার পাল্টাতে হচ্ছে। তার মধ্যে বাপী -মায়ের জন্য নতুন ভাড়া বাড়ি দেখতে হবে। এই বাড়িওলা সময় দিয়ে দিয়েছে। নতুন বাড়ি খুঁজতে ব্যারাকপুরের এ মাথা থেকে ও মাথা দুপুর রোদে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে হয় শ্রীকে। দালাল দিয়ে খোঁজ নেওয়া সম্ভব নয়। দালালির টাকা দেওয়ার সঙ্গতি নেই শ্রীর বাপীর। ওই কটা টাকা পেনশন পান। তাই দিয়ে তিনজনের সংসার চালানো, ওষুধের খরচ, তিন মেয়ে জামাই সবই তো আছে! অস্মির ছেলের প্রায় অনেকটা খরচই টানতে হয় শ্রীর বাপীকে। ভাড়া বাড়িতে থেকে আর কোথা থেকেই বা পারবেন! শ্রী আয়ত্তের মধ্যে ভদ্রস্থ পাড়ায় বাড়ি খোঁজে। সকালে এক প্রস্ত বাড়ির কাজ করে বেরোয়। ফিরে আবার এক প্রস্ত করে। এর মধ্যে সপ্তাহে একদিন করে মায়ের বাড়ির জামাকাপড় কেচে, বাথরুম পরিষ্কার করে দিয়ে আসে। তারওপর মায়ের বাড়ির কাজের লোক না এলে বাপী বা কাকু শ্রীকে ডাকতে আসে। শ্রী গিয়ে বাসনমেজে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে আসে। সেইসঙ্গে চলে উলের মেশিনের কাজ। শ্রী যেন আর পেরে উঠছে না। ঋতি কদিন খেয়াল করেছে মার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সেদিন নিনানও ঋতিকে ডেকে বলল, মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে তো রে! মার এই অবস্থা! এতো শরীর খারাপ! 

ঋতি পরদিনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার ইউ এস জি করতে দিলেন। কিছু ওষুধপত্র দিলেন। কিন্তু সামনে ঋতির ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। শ্রী ঠিক করল ঋতির পরীক্ষা হয়ে গেলে তারপর টেস্ট করাবে। ঋতি আপত্তি করেছিল। কিন্তু শ্রী কোনো কথাই শুনল না। এবারে বিধাননগরের একটি কলেজে ঋতির সিট পড়েছে। প্রথমদিন গিয়েই শ্রী প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করে ঋতির হাতের সমস্যার কথা জানাল। স্যার শ্রীকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, আমি দেখে নিচ্ছি। এবার আর পরীক্ষার সময় ঋতিকে কেউ বিরক্ত করল না। ঋতির প্রিপারেশন এবারেও বেশ ভালো। গতবারের রেজাল্টের পর ঋতি রিভিউ করতে দিয়েছিল। তাতে বেশ অনেকটা নম্বর বেড়েছে। কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস হয়নি। ওদিকে ঋতি খবর পেয়েছে কলকাতার নামকরা ঐতিহ্যবাহী একটি কলেজ থেকে দশজন ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। সেই কলেজ যেখানে ঋতি চান্স পায়নি। অথবা অন্য কাউকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ঋতিকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ওখানে যারা ভর্তি হয়েছিল তাদেরকে ঋতি চেনে। কারো কারো নামও জানে। কলেজ স্ট্রিটে কখনো কখনো ওদের দেখতে পায় ঋতি। যতবার দেখতে পায় ততবারই ঋতির মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের পাশে বসে ঋতি ক্লাস করবে। ঋতি দেখিয়ে দেবে তার কোনো সুপারিশের প্রয়োজন নেই। সে নিজের যোগ্যতায় নিজের জায়গাটা অর্জন করে নিতে পারে। ঋতি তাই এবারে কোনো খামতি রাখেনি। সবরকম সম্ভাবনার কথা ভেবে প্রিপারেশন নিয়েছে। ঋতির পরীক্ষা তাই খুবই ভালো হলো। পরীক্ষা শেষে মাকে নিয়ে টেস্ট করানোর সুযোগ কিন্তু হলো না। বিজয়দেব ছেলের পৈতে দেবে বলে হাজির হলো। তার সব দায়িত্ব নিতে হলো অনন্ত আর শ্রীকে। বিশ্বদেব টাকাপয়সার ব্যাপারটা দেখছে। বিজয়দেব টাকা দিয়েই খালাস। টাকার হিসেব নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না। সম্পূর্ণা কিন্তু সব দিকে খেয়াল করে। বিশ্বদেব কাকে কখন কত টাকা দিচ্ছে সবই সে হিসেব রাখছে তার মতো করে। শ্রীর এসব দেখার সময় নেই। গায়ে গতরে খেটে কাজটা তুলে দিতে হবে তাকে আর অনন্তকে। ওদিকে মাধুরী অত্যন্ত বিরক্ত। একে তো তার বাড়িতে এসব ঝামেলা করা হচ্ছে। সম্পূর্ণা ওর বাপের বাড়িতে ছেলের পৈতের ব্যবস্থা করলেই পারত। তার ওপর যত সম্পূর্ণা নানাকিছু নিয়ে বিশ্বদেবের সঙ্গে কথা বলছে তত মাধুরী চোখ গোলগোল করে ওদের দেখছে আর ততই তার মেজাজ চড়ছে। সেইসঙ্গে রুচি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে সে নিয়ে বিজয়দেব রীতিমতো ক্ষুব্ধ। রুচির শাশুড়িও নানাসময়ে সম্পূর্ণাকে নানাভাবে অপমান করে বুঝিয়ে দিয়েছে রুচির এই কাকা কাকিমার সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখতে চায় না। ফলে পৈতে বাড়িতে রুচিদের নিমন্ত্রণ করতে আপত্তি জানিয়েছে বিজয়দেব ও সম্পূর্ণা। এ নিয়ে বেশ খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছে বিশ্বদেবের সঙ্গে। সম্পূর্ণা একমাথা চুল এলো করে দাদাভাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার স্বামীর টাকায় যে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে রুচির বাড়ির কারোর জায়গা হবে না। রুচি ওদের ছেড়ে একলা আসতে চাইলে আসতে পারে। বলা বাহুল্য রুচি আসতে চায়নি। ফলে মাধুরীর সম্পূর্ণার ওপর বিরক্তি আরো বেড়েছে।

সম্পূর্ণা ভেবেছিল চন্দননগরে তার বাপের বাড়ি থেকেই সব ব্যবস্থা করে ছেলের পৈতে দেবে। কিন্তু বাধ সেধেছে বিজয়দেব। দাদাভাইয়ের বাড়ি থাকতে অন্য কোথাও থেকে ঘোষাল বাড়ির ছেলের পৈতে হবে না। সম্পূর্ণা তারপর থেকেই দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছে। সামান্য নিয়ম আচারে খুঁত পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তার মুখে লেগেই আছে, আমাদের চন্দননগরে এসব আচার অনুষ্ঠান অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। ওখানে থাকলে কোনো ভুলই হতো না! এই কথা শুনতে শুনতে বিজয়দেবেরও রাগ চড়ছে। সে অকারণে ছেলেমেয়েকে বকছে, ঋতিকে বকাবকি করছে। ঋতি পারতপক্ষে বিজয়দেবের সামনে যাচ্ছে না। অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পর সম্পূর্ণা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিল বিশ্বদেবকে যে ভাইয়ের ছেলের পৈতে দিতে গিয়ে বিশ্বদেব যে বিভিন্ন জায়গা থেকে কমিশন খেয়েছে সেটা সম্পূর্ণা ভালোই বুঝেছে। কারণ অনুষ্ঠানের মান, বিশেষত খাবারদাবারের মান অত্যন্ত খারাপ। চন্দননগরের যে কোনো ক্যাটারার এর থেকে ভালো কাজ করে। বিজয়দেব সবই শুনল। কিন্তু সম্পূর্ণার কথার কোনো প্রতিবাদ করল না। চোয়াল শক্ত করে বসে রইল। দাদাভাইয়ের সঙ্গেও আর বিশেষ কথা বার্তায় গেল না। 

ওদিকে শ্রীও আর পেরে উঠছে না। তার পেটের যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে। ওষুধ খেয়ে ব্লিডিং একটু কমলেও পেটের যন্ত্রণা কমছে না। কোনোরকমে অনুষ্ঠান মিটতেই ঋতি মাকে নিয়ে ইউ এস জি করাতে ছুটল। রিপোর্টে দেখা গেল শ্রীর ওভারিতে সিস্ট হয়েছে। যেটা আকারে বেড়ে গিয়ে বেশ ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে। ইমিডিয়েট অপারেশন করাতে হবে। নইলে বড়ো বিপদের আশঙ্কা আছে। কিন্তু কোথায় করাবে অপারেশন শ্রী? প্রাইভেট নার্সিংহোমে অপারেশন করাবার মতো অবস্থা শ্রীদের নয়। সরকারি হাসপাতালে করাতে হবে। কিন্তু সেখানে বেড পাওয়াই মুশকিল। দালাল চক্রের হাতে পড়তে হবে। তাহলে উপায়! উপায়ের সন্ধান দিলেন চক্রবর্তীদা। তার ছোটো ভাইঝি আর জি কর মেডিকেল কলেজের ইনটার্ন। সে সমস্ত ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। হলোও তাই। শ্রীকে আর জি করে ভর্তি করা হলো। অপারেশনের দিন ভোরবেলা থেকে অনন্ত, ঋতি আর টুয়া অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে। একসঙ্গে আটজনকে ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। একজন একজন করে রুগি অপারেশন করে বার করা হচ্ছে। ঋতি আর টুয়া প্রত্যেকবার এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শ্রী নয়। যত দেরি হচ্ছে ওদের টেনশন বাড়ছে। সকাল আটটা থেকে এখন প্রায় আড়াইটে বাজতে চলল। রুগিদের অচৈতন্য অবস্থায় বার করে ওয়ার্ডে দেওয়া হচ্ছে। তারপর একসময় শ্রীকে বার করা হলো। শ্রী কিন্তু সজাগ একেবারে। মেয়ে, বোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। অনন্তও ছুটে এসেছে। শ্রীকে ওয়ার্ডে দেওয়া হলো। একটু পর থেকে শ্রীর ব্যথা শুরু হলো। শ্রী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর বলছে ডাক্তার আমাকে ক্যাম্পোস দাও। টুয়া আর ঋতি ভেতরে যেতে পারছেনা। ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে টুয়া কাঁদছে। আর ঋতি ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে। শেষপর্যন্ত একজন ডাক্তার এসে টুয়া আর ঋতিকে চলে যেতে বললেন। ওরা দুজনে অনেককিছু বলতে যাচ্ছিল। ডাক্তার ভদ্রলোক ওদের থামিয়ে দিলেন, বললেন, নিচে চলে যান। দরকার পড়লে ডাকা হবে। ওরা বাধ্য হলো চলে আসতে। সেই রাতটা অনন্ত হসপিটালে থেকে গেল।

 

৬৪

অপারেশনের পর শ্রী কোথায় থাকবে এ নিয়ে একপ্রস্থ অশান্তি হয়ে গেল বাড়িতে। ঋতির ইচ্ছে মা ফ্ল্যাটে তার কাছেই থাকুক।তার এখন দুমাস মতো ছুটি আছে। সে নিজে হাতে মায়ের সেবা করবে। টুকটাক রান্না তো ঋতি আগেই করত। এখন পুরো দমে রান্নাবান্না শুরু করল। শ্রী কিন্তু যেদিন সন্ধেবেলা বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকে মেয়েটাকে মুখঝামটা দিয়ে চলেছে। তার ইচ্ছে ছিল সে হসপিটাল থেকে সরাসরি মায়ের কাছে যাবে। কিন্তু ঋতির জোরাজুরিতে তাকে ফ্ল্যাটে আসতে হয়েছে। শ্রী যেন ঋতিকেই সহ্য করতে পাচ্ছে না। ঋতি সবই বুঝতে পারছে। সে জানে, বাবা কোনোদিন মায়ের কোনো অসুস্থতার দায় নেয়নি। মা অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানো থেকে ওষুধপত্র, সেবা শুশ্রূষা সবই দাদু নিনান করেছে। তাই এবারে সে নিজের হাতে মায়ের সেবা করতে চায়। তাছাড়া দাদু নিনানের বয়স হয়েছে। হঠাৎ কোনো মেডিকেল এমার্জেন্সি হলে ওরা সামলাতে পারবে না। আর একটা কথাও ঋতির মনে হয়েছে। দাদুর বাড়ি গেলে মায়ের রেস্ট হবে না। নিনানকে কাজ করতে দেখে মা ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করতে যাবে। এখানে ঋতির কাছে ঋতি শ্রীকে কড়া শাসনে রাখবে। বিছানা থেকে নামতে দেবে না। শ্রী এতো কথা জানে না। তার মনে হয়েছে ঋতির পক্ষে তার সেবা করা সম্ভব নয়। অথচ ঋতি তাকে বাপের বাড়ি যেতে দিচ্ছে না। শ্রী যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলো ঋতির ওপর। ঋতি সকাল থেকে উঠে সবজি কাটে, মাছ ধোয়, রান্না করে। ডালে কতটা জল থাকবে বুঝতে না পেরে গরম কড়াই সাঁড়াশি দিয়ে ধরে মার সামনে হাজির করে। শ্রীর বুকটা ভয়ে দমে যায়। একটা বিপদ না বাঁধিয়ে মেয়েটা ছাড়বে না! 

এর মধ্যে একদিন বিশ্বদেব এসে হাজির। বিশ্বদেব নিজের বাড়িতে খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। জুতো সিঁড়ির তলায় খুলে পাপোশে পা মুছে তবে হলে ঢোকে। কিন্তু এ বাড়িতে এলে বেশিরভাগ দিনই বুট পরেই শ্রীর ছোটো ফ্ল্যাটের বেডরুম অবধি ঢুকে আসে। কোনোদিন ভিতরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কোনোদিন বেডরুমের আলমারিতে লাগানো আয়না দেখে চুল ঠিক করে। শ্রী বহুবারই খেয়াল করেছে। কোনোদিন কিছু বলতে পারেনি। মনে মনে ভেবেছে, নিজের বাড়িটা বাড়ি। আর ভায়ের বাড়িটা আস্তাকুঁড়। জুতো পরেই চলে আসা যায়। যাই হোক, সে আজও জুতো পরেই ঘরে ঢুকল। তারপর পাঁচ হাজার টাকার একটা বান্ডিল শ্রীর বিছানার পাশে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, এনাও, তোমার ছোটো দেওর পাঠিয়েছে। তোমার তো আবার যা হয় বড়োসড়ো হয়। ছোটোখাটো কিছু হয় না। সেই জন্য বিজু পাঠিয়েছে। শ্রীর তখন কথা বলার মতো অবস্থা নয়। একে দুর্বল শরীর। তারওপর এভাবে টাকাটা মুখের ওপর ছুঁড়ে অপমান করছে দাদা! শ্রী চুপ করে থাকল। যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছিল, আপনার ভাই বিজুর কাছ থেকে টাকা চেয়েছে কি না আমি জানি না। তবে আমি চাইনি। সরকারি হাসপাতালে যেটুকু খরচা লেগেছে আমার নিজের উপার্জনের টাকায় মিটিয়েছি। কিন্তু ভেবেও কোনো কথা বলা হলো না। গলার কাছে দলা পাকিয়ে কান্না উঠে এলো। এতো বড়ো ফাঁড়া গেল তার। আর অল্প দেরি হলেই বিপদ ছিল। ম্যালিগনেন্ট হয়ে যেতে পারত বিষয়টা। এতোদিন কোনো ট্রিটমেন্ট না করে ফেলে রেখে দিয়েছিল অনন্ত। সামান্য চিন্তিতও তাকে মনে হয়নি। মা আর ঋতি উদ্যোগ না নিলে হয়তো এ যাত্রায় আর ফেরাই হতো না। ভাইয়ের এতো বড়ো অপদার্থতা নিয়ে দাদা হিসেবে তার কোনো বক্তব্য নেই। ছোটো ভাইকে টাকা দিতে হয়েছে তাতেই গায়ে জ্বালা ধরে গেছে। 

সেদিন সন্ধেবেলা ঋতি কয়েকটা জিনিস কিনতে বেরিয়েছে। এখন বর্ষাকাল। বাইরে একটা জোলো হাওয়া বইছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো! ‘দূরে কোথাও দূরে দূরে’…  ঋতির কানে ভেসে এলো গানটা। চারপাশের গাড়ির হর্ন, রিক্সার প্যাঁ পোঁ, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, পথচলতি মানুষজন, দোকানের কর্মচারীদের অনর্গল প্রলাপ সব – সব কেমন মুছে গেল তার কানের দুপাশ থেকে! কানটা ধাপা ধরে গেছে যেন! শুধু একটা ডাক কোন্ সুদূর থেকে ভেসে আসছে! সে যেন ডাকছে – রুতু! রুতু!ঋতি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে কখন জানে না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তাও জানে না। হঠাৎ একটা বাইকের বীভৎস হর্নের আওয়াজে ওর হুঁশ ফিরল। কিন্তু হুঁশ ফিরতেই ঋতির মনে হলো, আর একমুহূর্ত দেরি নয়। এখনি ফোন করবে সে স্নেহময়দাকে। আজ, এখনই। স্নেহময়দা অভিমান করে আছে। স্নেহময়দা তাকে হয়তো ভুল বুঝেছে। স্নেহময়দা হয়তো তার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে চাইবে না। সব সে মেনে নেবে। সে স্নেহময়দাকে সব বলবে। বাবা এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ঋতি বলবে। স্নেহময়দা না বুঝতে চাইলে ঋতি বারবার বোঝাবে! কিন্তু আজ এই মুহূর্তে… আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ঋতি আজ ফোন করবেই। ঋতি ভিড়টা থেকে একটু এগিয়ে গেল। ওদিকে একটু ফাঁকায় একটা টেলিফোন বুথ আছে। ঋতি বুথের ছোট্ট চেম্বারটায় ঢুকে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিল। তারপর নম্বরটা ডায়াল করল। ঋতির হাত পা কাঁপছে। প্রচণ্ড ঘামছে ঋতি। বুকের মধ্যে যেন ঝড় হচ্ছে তার…

হ্যালো? একটি মেয়ের গলা। ঋতির মনে হলো স্নেহময়দার বোন হয়তো।

হ্যালো, স্নেহময়দা আছে? 

না, দাদা তো নেই। আলিপুরদুয়ারে আছে। আপনি? 

আমি রুতু বলছি। 

ও, দাদা তো নেই, শুক্রবার ফিরবে। 

আচ্ছা, আমি তবে পরে ফোন করব।

দাদা তো বিয়ে করল। মেয়েটি নিজে থেকেই বলল। 

ঋতি শুনল। তার পায়ের তলা থেকে বুথের মেঝেটা সরে যাচ্ছে। ভূমিকম্প হচ্ছে! ঋতির পা দুটো অসম্ভব কাঁপছে! ঋতি আর টাল সামলাতে না পেরে চেম্বারের মধ্যে পড়ে গেল। একটা টুল রাখা ছিল ভেতরে। ঋতির বুকে সজোরে টুলের কোনাটা লাগল। কিন্তু ঋতি কিছু বুঝতে পারছে না। সব আওয়াজ থেমে গেছে। কানের ভেতরটা নিস্তব্ধ। ঘুরে ঘুরে শুধু কে যেন বলছে ‘দাদা তো বিয়ে করল’। রিসিভারটা হাত থেকে পড়ে গেছে কখন! বাইরে যে ছেলেটা বসে থাকে সে ছুটে এসেছে। তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে ঋতিকে টেনে বার করছে। ঋতি বোকার মতো তাকিয়ে আছে। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তার চোখের সামনেটায় একটা কালো পর্দা কে যেন টাঙিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা ঋতিকে জল খেতে দিচ্ছে। পাশের মেয়েদের চায়ের দোকানটা থেকে একটা মেয়ে ছুটে এসেছে। মাথায় ঘাড়ে জল দিচ্ছে ঋতির। ঋতি কেবল তাকিয়ে আছে। মাছের চোখের মতো নিষ্প্রাণ তার চোখদুটো। ঋতি খানিকক্ষণ ওই বুথেই বসে রইল। তারপর চোখমুখ ভালো করে মুছে কোনোক্রমে টলতে টলতে বাড়ি ফিরল। শ্রী বসে টিভি দেখছে। ঋতি এসে বাথরুমে ঢুকেছে। হাতমুখ ধুয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। শ্রী উত্তর দিচ্ছে। ঋতি শুনছে। তার মনে হচ্ছে সে নয়, অন্য কেউ যেন তার শরীরটাকে চালাচ্ছে। কথা বলছে। সে ওই বুথের মধ্যে এখনো পড়ে আছে। পড়ে আছে। পড়েই আছে। 

রাতের রান্না করাই ছিল। ঋতি শুধু ভাতটা বসাল। তারপর অন্ধকার ঘরে শ্রীর পাশে গিয়ে বসল। শ্রী টিভি দেখছে। ঋতি পা ঝুলিয়ে চুপ করে বসে আছে। এ’কদিন শ্রী খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে ঋতির সঙ্গে। আজ মেয়ের দিকে তাকিয়ে শ্রীর মনে হলো, মেয়েটাকে ঝড়ে ভাঙা গাছের মতো লাগছে! মাকে যত্ন করবে বলে মেয়েটার এতো পরিশ্রম হচ্ছে। সংসারের সবটা একা হাতে সামলাচ্ছে এইটুকু মেয়ে। শ্রী ঋতির পিঠে একটা হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগল। শ্রী বুঝতে পারছে ঋতির পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। ঋতি কি কাঁদছে? ঋতি! ঋতি! শ্রী ডেকে উঠেছে ঋতিকে। ঋতি ঘুরে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। শ্রী ঋতির মুখটা দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু বুঝতে পারছে ঋতি পাগলের মতো কাঁদছে। কী হয়েছে ঋতি? কাঁদছিস কেন? ঋতি? 

ঋতি কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা, স্নেহময়দা বিয়ে করেছে। 

শ্রী মেয়েটাকে বুকের মধ্যে চেপে নিল। কোনো কথা বলল না। ওর বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

 

৬৫

পরের কয়েকটা দিন কিভাবে কাটল ঋতির মনে নেই। তার মাথার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছুই সে ভাবছে না। শুধু থেকে থেকে একটাই কথা তার কানের মধ্যে রেকর্ডের মতো বাজছে – দাদা তো বিয়ে করল! ঋতি তাকিয়ে আছে। কিন্তু দেখছে না। ঋতিকে শ্রী কিছু বলছে। শব্দগুলো ঋতির কানের মধ্যে ঢুকছে। কিন্তু মস্তিষ্কে পৌঁছচ্ছে না। ঋতি কিছু বুঝতে পারছে না। ঋতি বারান্দায় বসে আছে। সামনের ধোপার ঘরের বড়ো ছেলেটা ঋতিকে কি যেন বলছে। ঋতি তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না। ঋতি যেন থম মেরে গেছে। কোনো শব্দ, কোনো স্পর্শ, কোনো দৃশ্য কোনোকিছুই তাকে ছুঁতে পারছে না। দুধ ফুটতে দিয়ে ঋতি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুধ উথলে যাচ্ছে। ঋতি দেখতে পাচ্ছে না। অনন্ত দৌড়ে গিয়ে গ্যাস অফ করছে। সবজি কাটতে গিয়ে ঋতি হাত কেটে ফেলেছে। রক্তারক্তি হচ্ছে। গরম প্রেশার কুকারের ঢাকনা খুলতে গিয়ে ঋতি হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। পায়ের ওপর হাত ফসকে সাঁড়াশি পড়ে গেছে। পায়ের একটা আঙুল থেঁতলে গেছে। এতোকিছু হয়ে গেছে ঋতির চোখে জল নেই। কোনো ব্যথা তাকে আর স্পর্শ করছে না। অথবা এতোবড়ো ধাক্কা ঋতি পেয়েছে যে আর কোনোকিছুই তাকে বিদ্ধ করতে পারছে না। শ্রী খেয়াল করেছে ঋতি আজ চার পাঁচদিন হলো ঘুমোচ্ছে না। সারারাত হয় বসে আছে। নয়তো আড়ষ্ঠ হয়ে শুয়ে আছে। শ্রীর মনে হলো মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। এর মধ্যে আমার জন্য মেয়েটাকে রান্নাবান্না সবই করতে হচ্ছে। তার থেকে আমার বাপের বাড়ি চলে যাওয়া ভালো। শ্রী অনন্তকে বলে বাপের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করল। ঋতি একবারও মাকে আটকাবার চেষ্টা করল না। যেমন রান্নাবান্না, ঘরের কাজ করছিল, তেমনই করতে লাগল তার আর অনন্তর জন্য। 

অনন্ত শ্রীর অপরাশেনের পর থেকে এ’কদিন বাড়িতেই ছিল। মিলে যায়নি। বলেছে, ঋতি একা শ্রীর দেখাশোনা করতে পারবে না। আমি থাকি। কিন্তু শ্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পরও তার মিলে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না। সে সকাল বেলা উঠে দাদার বাড়ি যায়। দুপুরে ফিরে আসে। বিকেলে আবার যায়। রাতে ফেরে। ঋতি ফ্ল্যাটে সারাদিন একাই থাকে। বোবার মতো বারান্দায় বসে থাকে ঋতি। বই হাতে নেয় না, গান শোনে না। কি অসম্ভব নিস্পৃহ মনে হয় ওকে। যেন পৃথিবীর কোনো কিছুর প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই ওর। মা চলে যাওয়ার পর থেকে মায়ের কাছে একবারও যায়নি ঋতি। অনন্ত এর মধ্যে দুদিন গিয়ে দেখা করে এসেছে শ্রীর সঙ্গে। ঋতি যায়নি। সেদিন তাই শ্রী বাপীদের বাড়িওয়ালার ঘর থেকে লীলাদির বাড়িতে ফোন করল। লীলাদি, আমি শ্রী বলছি। ঋতিকে একটু ডেকে দেবে গো! এতোদিন হয়ে গেল, ঋতি একবারও আসেনি। 

লীলাদি ঋতিকে ডেকে দিল। 

হ্যাঁ বলো। 

কি রে! ঋতি! এতোদিন হয়ে গেল। একবারও এলি না তো! 

ঋতি চুপ।

কী হয়েছে ঋতি! কথা বলছিস না কেন! 

ঋতি তাও চুপ। 

হ্যালো! হ্যালো! ঋতি? 

হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। বলো। 

আজ একবার আসবি ঋতি! আয় না রে! নিনান বোয়াল মাছ রান্না করেছে। তুই তো খেতে ভালোবাসিস! আসবি? 

দুপুরের রান্না হয়ে গেছে। না খেলে নষ্ট হবে। বিকেলে যাব। 

শ্রী একটু দমে গেল। মুখে বলল, আচ্ছা। 

ঋতি বিকেলে দাদুর বাড়ি পৌঁছোলো। অনেকটা রাস্তা। ঋতি হেঁটে হেঁটে এসেছে। ঋতিকে দেখে শ্রী চমকে উঠল। এই কদিনেই ঋতির চেহারা একেবারে ভেঙে গেছে। চোখগুলো গর্তে ঢুকে গেছে। গাল বেয়ে কালি নেমে এসেছে। কণ্ঠার হাড় দেখা যাচ্ছে! শ্রী সবই বুঝতে পারছে। কিন্তু কী করা উচিত সেটা ঠিক করতে পারছে না। এদিকে অন্য একটা ব্যাপারে শ্রী নিজেও খুব বিভ্রান্ত হয়ে রয়েছে। দুদিন আগে সেজ পিসে এসেছিল শ্রীকে দেখতে। সে জানিয়েছে, অনন্তকে মিল থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে। এরকম কথা সে একবছর আগেও বলেছিল শ্রীর কাকুকে। কাকু শ্রীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে অনন্ত রোজই মিলে যাচ্ছে। শ্রী এমন ভুল খবর দেওয়ার জন্য পিসের ওপর বিরক্তই হয়েছিল। আবার একবছর পর সেই একই খবর পিসে এসে বলেছে। পিসে কেলভিন জুটমিলের ইউনিয়নের বড়ো নেতা। সে জানিয়েছে অনন্তর ষাট বছর বয়স হয়ে গেছে। তাই রিটায়ার করে গেছে। শ্রী যারপরনাই অবাক হয়েছে একথা শুনে। অনন্তর এখন চুয়ান্ন বছর বয়স। ষাট হতে যাবে কেন! এ ব্যাপারে কথা বলার জন্যই শ্রী ঋতিকে ডেকেছে। কিন্তু ঋতির চেহারা দেখে সে কি বলবে ভেবে পেল না। শ্রীর কাকুই কথা শুরু করলেন। 

বাবা মিলে যাচ্ছে? 

না।

কেন যাচ্ছে না জিজ্ঞেস করেছ?

প্রশ্নটা শুনেই ঋতির ভুঁরু কুঁচকে উঠেছে। একে তো তার এই আত্তাদাদুকে সে একেবারে পছন্দ করে না। বাবার সঙ্গে এর সমস্যার কথা নিয়ে অবশ্য ঋতি ভাবে না। সেসব সত্যি মিথ্যের হিসেব করা ঋতির পক্ষে সম্ভব নয়। ঋতি একে পছন্দ করে না অন্য কারণে। এই লোকটি ঘোর হিন্দুত্ববাদী। বিভিন্ন সময়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের ভুল বুঝিয়ে তাদের গরম কয়লার ওপর হাঁটিয়ে তাদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে। সেসব ছবি খবরের কাগজে বেরিয়েছে। ঋতি দেখেছে। এই লোকটা মনে করে হিন্দু ব্রাহ্মণরা খাঁটি আর্য। আর এস এসের সংগঠক ছিল এক সময় এই লোকটা। এখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ করে। এরা খাঁটি হিন্দুত্ববাদের তকমাধারী। ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি এদের চূড়ান্ত বিদ্বেষ। নারীকে এরা মানুষ মনে করে না। নারী নরকের দ্বার। পুরুষের পায়ের তলায় থাকার যোগ্য। এরা পর্দা প্রথায় বিশ্বাস করে। এসব কথা ঋতি আগে জানত না। একদিন ঋতি অস্মির ছেলেকে ইতিহাস পড়াচ্ছিল। সেখানে আর্যদের আগমন, এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, মিশ্র জাতি হিসেবে ভারতীয়দের বিকাশ, এদেশের অধিকাংশ মুসলিম আসলে নিম্নবর্ণের হিন্দু ছিল ইত্যাদি বোঝাচ্ছিল। এই আত্তাদাদু সেসব শুনতে পেয়ে ঋতিকে বলতে আরম্ভ করেন যে ঋতি ভুল পড়াচ্ছে। আসলে ব্রাহ্মণরা খাঁটি আর্য। ঋতি নানাভাবে প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায় ধরে দেখাবার চেষ্টা করে আসল ইতিহাস। কিন্তু তারপরও যখন তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে আত্তাদাদু তখন সে বিরক্ত হয়। শ্রী ততক্ষণে এসে পড়েছে। শ্রী বুঝতে পারছে বিরোধটা কোথায়! শ্রী এসে ঋতিকে চুপ করাবার চেষ্টা করলে ঋতি খেপে যায়। বলে আত্তাদাদু তো ভুল ইতিহাস পড়াচ্ছে ভাইকে। জাতি বিদ্বেষ তৈরি করছে ওর মনে। তখনকার মতো ঋতিকে শ্রী চুপ করিয়ে দিলেও কিছুদিন পর দিল্লি ঘুরতে গিয়ে অস্মির ছেলে কোনো মুসলিম স্থাপত্য দেখতে অস্বীকার করে। ঋতি সেকথা জানতে পেরে মাকে বোঝায়, দেখো আত্তাদাদু ভুল ইতিহাস পড়িয়ে কেমন করে ঘৃণার জন্ম দিয়েছে ওইটুকু ছেলের মনে। শ্রী সবই বোঝে। কাকুকে বলে, ঋতি ঠিকটা পড়ে বড়ো হয়েছে কাকু। তুমি আসলে হিন্দুধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মুসলমানদের খারাপ বলছ। এটা তোমার পার্টির বা সংঘের এজেন্ডা হতে পারে। কিন্তু ঋতি যে ইতিহাস পড়েছে সেটাই প্রকৃত ইতিহাস। বলা বাহুল্য এ সমস্যার মীমাংসা হয়নি। শুধু ঋতি আরো বেশি সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে আত্তাদাদুকে। সেই আত্তাদাদু বাবার মিলে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করছে দেখে ঋতি একটু সোজা হয়ে বসল। কিন্তু উত্তর দিল সংক্ষেপে – না। 

শ্রী জানে ঋতি কাকুকে একেবারেই পছন্দ করে না। কাকু কথা বললে ঋতি যে কথা বলতে চাইবে না সেটাও শ্রী বুঝতে পারছে। তাই এবারে শ্রীই বলতে শুরু করল। 

বাবু, সেজ পিসে এসেছিল। বলল, তোর বাবাকে মিল থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে। 

ঋতি কথাটা শুনে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যতদূর জানে, মিলগুলোতে ক্ল্যারিকাল পোস্টে এখন আর নতুন রিক্রুটমেন্ট হয় না। পুরনো যারা আছে তাদের দিয়েই কম পয়সায় কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। অনন্তর মুখে ঋতি একথাই শুনেছে। বাবা মাঝে মাঝেই অহংকার করে বলে, আমার শালা কাউকে দরকার নেই। সারাজীবন আমি নিজের রোজগারেই খাব। 

এসব কথা অনন্ত বলে ওই ভরসাতেই যে ওদের মিল থেকে কোনো কেরানির চাকরি যায় না। কম পয়সা দিয়ে রেখে দেয়। সেটাই যদি সত্যি হয়, তবে বাবার চাকরি চলে যায় কি করে! 

আত্তাদাদু বলে উঠল, একটা ব্যাপার দেখো শ্রী, প্রতাপের কিন্তু চাকরি যায়নি। প্রতাপের তো সেই কবেই ষাট বছর বয়স হয়ে গেছে। অথচ অনন্তর ষাট বছর না হতেই চাকরি চলে গেল! খুব অদ্ভুত কিন্তু! 

ঋতি আত্তাদাদুর কথা শুনল। তার এখন মনে হচ্ছে কতক্ষণে সে বাড়ি পৌঁছোবে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাবার চাকরি চলে গেল মানে তো তাদের পরিবারের রোজগার নেই। তাহলে! তারা এবার কি করবে! উলের চাদর বুনেও আর তেমন রোজগার বাবার হয় না। মায়ের এই অপারেশনের পর মেশিন চালানো একেবারে বন্ধ করে দিতে বলেছে ডাক্তার। নয়তো হার্নিয়া হয়ে যেতে পারে। ফলে মায়ের সোয়েটার বোনা বন্ধ। তাহলে! ঋতির হাত পাগুলো আবার কাঁপতে শুরু করেছে। সে আর সময় নষ্ট না করে দাদুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। তখন সন্ধে আটটা বাজছে। এই অঞ্চলটা একটু শুনশান। রাস্তায় আলো নেই তেমন। ঋতি সেই অন্ধকারে ছুটতে শুরু করল। 

 

৬৬

ঋতি বাড়ি ফিরে দেখল বাবা জ্যেঠুর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। ডাইনিং টেবিলে চুপ করে বসে আছে। ঋতি ধীরে সুস্থে হাত মুখ ধুয়ে দু কাপ চা নিয়ে বাবার কাছে বসল। অনন্ত শ্রীর কথা জিজ্ঞেস করছে। টুকটাক অন্য কথা বলছে। ঋতি এরপর কী করবে ভাবছে সেসব জানতে চাইছে। ঋতি মাথা ঠাণ্ডা রেখে উত্তর দিচ্ছে। এই মুহূর্তে ঋতিকে দেখে বোঝার উপায় নেই ঋতির জীবনে একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। আর ঋতি সেই বিপর্যয়ের জন্য অনন্তকেই দায়ী করে। এটা ওটা কথার পর ঋতি বলল, বাবা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? সত্যি কথা বলবে? 

অনন্ত গম্ভীর হয়ে ছিল। এবার একটু চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল। মুখে বলল, বল।

কোনো ভণিতা না করে ঋতি সরাসরি বলল, তোমার চাকরিটা চলে গেছে? 

অনন্ত এই কথাটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। চমকে মেয়ের দিকে তাকিয়েছে। ঋতির মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও সব জানে। অনন্ত আর লুকনোর চেষ্টা করল না। স্পষ্ট করে কোনো উত্তর না দিয়ে অনন্ত মাথা নিচু করে অ্যাস্ট্রেতে ঘষে ঘষে বিড়িটা নেভাতে লাগল। 

কী হয়েছে বাবা? আমাকে বলো। ঋতি অনন্তর হাতের ওপর হাত রাখল। 

অনন্ত কথা বলতে পারছে না। নিঃশব্দে কাঁদছে। 

ঋতি উঠে গিয়ে বাবার পিঠে হাত রেখে বলল, কেঁদো না বাবা! কী হয়েছে একটু বলো! প্লিজ।

তুই কী করে জানলি? 

মায়ের সেজ পিসে জানিয়েছে। 

হ্যাঁ, ও শালা তো জানাবেই! দালাল শালা! আমার চাকরিটা খেলো! 

সেজ পিসে? কী করেছে? 

অনন্ত যা বলল, তার মর্ম এই, অনন্ত জুটমিলে কাজে ঢোকার সময় যে জন্মসাল লিখেছিল তা ভুল ছিল। সেখানে বিশ্বদেব আর অনন্তর বয়সে চার মাসের তফাৎ। ওই ভুল সাল দেখিয়ে এক বছর আগেই ম্যানেজমেন্ট অনন্তকে রিটায়ার করিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেদিন খবরটা পেয়ে অনন্ত নিজের টেবিলে বসে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু তারপর মন শক্ত করে অনন্ত ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করে তার চাকরিটা এক্সটেন করার জন্য। ম্যানেজার শেষপর্যন্ত এক বছরের জন্য চাকরির মেয়াদ বাড়ায়। সেই একবছর শেষ হয়ে গেছে। তাই অনন্তর আর চাকরি নেই। 

কিন্তু তুমি তো বলেছিলে এতো কম পয়সায় লোক পাওয়া যায় না বলে ওরা তোমাকে কাজে বহাল রাখবে? 

হ্যাঁ, তাই হওয়ার কথা। আমার কাজটা ছিল কোন্ মেশিনে কত ইউনিট চট বোনা হচ্ছে তার হিসেব রাখা। প্রতাপদাদের একটা দালাল চক্র মিলের মধ্যে অনেকদিন ধরেই লুকিয়ে মাল পাচার করে। ও ইউনিয়নের নেতা বলে ওকে কেউ সন্দেহ করে না। ওরা আমার কাছে বেশ কিছু বছর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল মেশিন প্রতি প্রোডাকশন কম দেখাতে। আমি সেটাতে রাজি হইনি। ওরা নানাভাবে চাপ তৈরি করছিল। তুই তো জানিস বাবু, আমি আর যাই করি, অসততা করতে পারি না। করিওনি। ওদের সেইজন্য খুব অসুবিধে হচ্ছিল। ওরা অনেকদিন ধরেই আমাকে সরানোর চেষ্টা করছিল। শেষপর্যন্ত আমার ওই ভুল জন্মসালটাকে কাজে লাগালো।

ঋতি সব শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তার মন বলছে, এই মুহূর্তে বাবার সামনে হাহুতাশ করতে শুরু করলে বাবা আরো ভেঙে পড়বে। তার থেকে বাবাকে বুস্ট আপ করা প্রয়োজন। বাবা কি করতে পারবে না পারবে ঋতির জানা নেই! এই বয়সে নতুন করে কি করা সম্ভব তাও ঋতি জানে না। কিন্তু বাবাকে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না। ঋতি অনন্তর হাতে আবার হাতটা রেখে বলল, বাবা, আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। 

কি? 

যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি তো সারাজীবন এই মিলের কাজটার ভরসায় থেকেছ! অথচ এই চাকরিটা আসলে ভরসা করার মতো নয়ই। বছরে ছ মাস করে তোমার মিল বন্ধ থেকেছে। যখন খোলা থেকেছে তখনও চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের দিন কেটেছে। এই অনিশ্চয়তা, এই উদ্বেগ থেকে তোমার মুক্তি ঘটে গেছে। তুমি এখন স্বাধীন। তোমার সঙ্গে যা খারাপ হওয়ার হয়ে গেছে। এর চেয়ে বেশি খারাপ আর কিছু হওয়ার নেই। এবার তোমার নতুন করে এগোনোর পালা। সামনের দিকে তাকানোর পালা। সারাজীবন তুমি একটা কেন্দ্রের চারপাশে অনিবার্য ভাবে ঘুরে মরেছ। নিজেকে ক্ষয় করে ফেলেছ। আর তোমাকে সেটা করতে হবে না। এবার তুমি নিজেকে নিয়ে কনস্ট্রাকটিভ কিছু ভাবো। নতুন করে জীবনটা শুরু করো।

অনন্ত মন দিয়ে ঋতির কথাগুলো শুনছিল। অনন্ত এক বছর ধরে একটা প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। তার কেবলই মনে হয়েছে বাড়িতে তার চাকরি চলে যাওয়ার কথা বললেই কান্নার রোল পড়ে যাবে। এমনিতেই শ্রী তাকে অপদার্থ ভাবে। সেটাই আরো বেশি করে ভাববে। নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার জন্য তাকেই দোষারোপ করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঋতির কথা শুনে অনন্তর চোখ দুটো আবার জলে ভরে এলো। ঋতি তার একমাত্র সন্তান। যার ওপর তার সমস্ত আশা ভরসা! অনন্ত স্বপ্ন দেখে ঋতি একদিন বড়ো চাকরি করবে। মাথা উঁচু করে সমাজের বুকে দাঁড়াবে। বাবা মা শুধু নয়, গোটা ঘোষাল পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। ওর দাদুর বাড়ি নিয়ে ওর সঙ্গে যতই মতবিরোধ হোক না কেন আজ ঋতি বুঝিয়ে দিল, ও বড়ো হয়ে গেছে। বাবার পাশে ও দাঁড়াবে। অনন্তর বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে। অনন্তর ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। অনন্ত বলল, জানিস রুতু, বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। দাদা তখন সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। আমি আর বিজু পড়ছি। দাদা মিলে চাকরি করতে ঢোকে। প্রথমে কুলির কাজ করত। আমি কোনোরকমে আরো দুবছর পড়াশোনা করে শেষে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। বাবা চলে যাওয়ায় আমাদের টিটাগড়ের বাবু’স কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ভাড়া বাড়িতে থেকে পাঁচজনের পেট চালানো সহজ ছিল না। দাদা একা পারছিল না। আমিও দাদার সঙ্গে ওয়েভারলি জুটমিলে কাজে লেগে গেলাম। 

তারপর? 

তারপর পিউ পরীক্ষার তিন মাস আগে মা হেড মাস্টারমশাই সুশীল বাবুর কাছে যায়। মা আসলে মেনে নিতে পারছিল না আমি পড়াশোনা ছেড়ে দেব। আমি প্রত্যেক বছর ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। তাই সুশীল বাবু আমাকে খুব ভালো করে চিনতেন। মা অনুরোধ করেছিল, আমাকে যেন পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়। আর সুশীল বাবু যদি আমাকে একটু পড়া দেখিয়ে দেন। 

সুশীল বাবু রাজি হয়েছিলেন?

সুশীল বাবু বলেছিলেন, ও ছেলে তো খাঁটি সোনা। একটু ঘষা মাজা করলেই চকচক করে উঠবে! আমার কানে কথাটা এখনো বাজে। 

তারপর? সুশীল বাবুর কাছে পড়তে গেলে? 

সুশীল বাবু, সারাদিন স্কুল করতেন। আর সকাল,সন্ধে ছাত্র পড়াতেন। আমি তো আর পয়সা দিয়ে পড়তে পারব না। তাই আমাকে রাত ন’টা থেকে পড়াতে শুরু করতেন। এগারোটা বাজলে শুয়ে পড়তেন। আবার ভোরবেলা চারটের সময় আমাকে তুলে দিতেন। পড়াতেন দু -তিন ঘণ্টা। তারপর আবার ওঁর ছাত্ররা পড়তে চলে আসত। একদিন কি হয়েছে জানিস তো, পেটে ব্যথা করছে বলে সুশীল বাবু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছেন। তারপর খানিকক্ষণ বাদে দেখি জামাকাপড়, বিছানা সব পায়খানা করে মাখামাখি করে ফেলেছেন। আমি তাড়াতাড়ি ওষুধ দিলাম। উনিই দেখিয়ে দিলেন কোন্ ওষুধটা দিতে হবে! তারপর চাদর, তোষক, জামাকাপড় সব ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম। উনি খুব খুশি হয়ে বারবার আশীর্বাদ করেছিলেন।

তারপর? পরীক্ষা দিলে? 

হ্যাঁ পরীক্ষা দিলাম। স্কুলের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিলাম। যেদিন রেজাল্ট বেরলো সুশীল বাবু কেঁদে ফেলেছিলেন। 

তারপর কলেজে ভর্তি হলে? 

হ্যাঁ, দাদা কলেজে ভর্তি করে দিল। কিন্তু বইপত্র নেই। এমনকি কলেজে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়াও নেই। তখন টিউশন করতে শুরু করলাম। খড়দায় তখন বেশ নামডাক হয়েছে। ছাত্র জুটেছিল বেশ কিছু। আর শান্তিদার দোকান ছিল। শান্তিদার দোকানে জামাকাপড়ের কাটিং করে দিতাম। শান্তিদাই শিখিয়ে দিয়েছিল। শান্তিদা যাতায়াত ভাড়াটা দিত। 

তারপর? কলেজ পাশ করলে? 

হ্যাঁ, কলেজ থেকে বেরিয়ে তারপর চাকরির চেষ্টা করছিলাম। ব্যাঙ্কে, ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে। ওখানে পরীক্ষা দিতেও গেছিলাম। সুকু মানে সুকুমারের বাবা ওখানে চাকরি করত। বলল, পরীক্ষাটা দে। তারপর আমি দেখে নিচ্ছি। পরীক্ষা দিতে বসে দেখি একটা জটিল মেশিনের ছবি আঁকতে দিয়েছে। কিন্তু স্কেল আর ইরেজার ব্যবহার করা যাবে না। সুকু পারছে না। আমি নিজেরটা এঁকে তারপর সুকুরটাও এঁকে দিলাম। 

তারপর? চাকরিটা হলো? 

না রে। সুকুর চাকরি হলো। আমার হলো না। 

তারপর আর চেষ্টা করনি? 

হ্যাঁ রে, তখন মন খারাপ করে বসে থাকার মতো ছেলেই ছিলাম না।টিউশন করতে গিয়ে বেশ কিছু পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। সেই সূত্রে নানা চাকরির কথাবার্তা চলছিল। চাকরির পরীক্ষাও দিচ্ছিলাম। তারপর তো…বলে অনন্ত চুপ করে গেল। 

তারপর কী বাবা? 

নাহ্ কিছু না। 

তারপর তোমার জেল হয়ে গেল। তাই তো! 

অনন্তর আজ পরপর কেবল অবাক হওয়ার পালা। ঋতি জানে আমার জেল হয়েছিল। কীভাবে জানল? কে বলল ওকে? এতোদিন কখনো বলেনি তো?

অনন্তকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঋতি বলে বম্মা বলেছিল একদিন। তোমার নকশাল আমলে জেল হয়েছিল। তুমি নকশাল করতে গেছিলে বাবা? 

না রে। আমি নকশাল করিনি। অনন্ত যেন আজ অতীতের ঝাঁপি খুলে বসেছে। একের পর এক ঘটনা সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে। অনন্ত বলে চলেছে সেসব। আমি তো তখন চুটিয়ে টিউশন করি আর গান গেয়ে বেড়াই। দাদা আর বিজু নকশাল করত। বিজুকে তো একদিন সিপিএমের ছেলেরা ঘেড়াও করেছিল ভোজালি নিয়ে মারবে বলে। বিজু কোনোরকমে পালিয়ে কৃষ্ণনগরে মামার কাছে চলে যায়। আমি মাকে বলতাম, ওরা এসব করছে। নিজেরা তো বাড়িতে থাকে না। কোনদিন পুলিশ এসে ওদের না পেয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে! আর হলোও তাই। তাও ভালো যে তার দুদিন আগেই বাড়ি থেকে বইপত্র, লিফলেট, চেম্বার যা ছিল সব সরিয়ে দিয়েছিলাম। পুলিশ এসে কিছু পায়নি।

পুলিশ খুব অত্যাচার করেছিল না বাবা? 

বীভৎস মেরেছিল। উল্টো করে টাঙিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন। আরো যা করেছিল… যাক বাদ দে। সহ্য করতে পারবি না। কিন্তু হ্যাঁ, কথা বার করতে পারেনি আমার মুখ থেকে। কারো নাম বলিনি। 

তারপর ছ’মাস বাদে ছাড়া পেলে? 

হ্যাঁ, ছ’মাস বাদে জামিনে ছাড়া পেয়েছিলাম। 

তারপর আর চাকরির চেষ্টা করনি? 

আর তো সরকারি চাকরি হবে না। জেলখাটা আসামী তখন। তাছাড়া যোগাযোগগুলোও নষ্ট হয়ে গেছিল। কেউ তখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায়নি। বন্ধুবান্ধবরা দূর থেকে দেখে সরে যেত। একলা হয়ে গেছিলাম একদম। গানও গাইতাম না। গাইতে পারতাম না। শুধু কাঁদতাম। খালি ভেতর থেকে কান্না আসত। বাড়িতে বসে থাকতাম। তারপর তো দাদা নিয়ে গিয়ে জুটমিলে ঢুকিয়ে দিল। 

ঋতি আর প্রশ্ন করল না। তার মনে পড়ছিল বাবা একদিন স্নেহময়দার কাছে গল্প করছিল, বাবার দুই বন্ধুকে সিপিএমের ছেলেরা রাস্তা দিয়ে ভোজালিতে কোপাতে কোপাতে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল। সেদিন স্নেহময়দার চোখ ছলছল করে উঠেছিল। আর বলতে বলতে বাবার মুখটা লাল হয়ে গেছিল। সত্যি কি অদ্ভুত না! একটা মানুষ সে তো টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত। খাওয়া পরার চিন্তায় ব্যস্ত। আন্দোলন টান্দোলনের ধার দিয়েও যায়নি। অথচ কেবল ভায়েদের জন্য তার জীবনে কি বিপর্যয় নেমে এলো! তার কেরিয়ারটারই বারোটা বেজে গেল। ঋতি ভাবছিল, ও বাড়িতে থাকতে জ্যেঠু কতদিন বাবার অনুপস্থিতিতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, অপদার্থ একটা ছেলে! কারো দায়িত্ব নেওয়ার মুরোদ নেই। এক নম্বরের কুঁড়ে। রাগে গড়গড় করত জ্যেঠু। বিজু তো বাবার সম্পর্কে কথা বলতে গেলেই বাবাকে জেদী, একরোখা এসব বলে। অথচ বাবা যে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল একথা তো কোনোদিন বলেনি। বাবা যে ওদের জন্য এতোটা সাফার করেছে এবং এখনো করে চলেছে সেকথা তো কখনো বলেনি। বাবা ভীতু। সবেতে ভয় পায়। এ নিয়ে হাসাহাসি করেছে। অথচ বাবার জীবনে যে এতোবড়ো একটা ট্রমা আছে সেকথা তো কোনোদিন বলেনি! ঋতির বাবার কথা ভেবে চোখ ভরে যাচ্ছে। ঋতি বাবাকে আড়াল করে কোনোক্রমে উঠে ঘরে চলে গেল। আকাশ ভেঙে পড়েছে তার মাথার ওপর! কি হবে এবার! সংসার চলবে কি করে! তার পড়াশোনারই বা কি হবে! ঋতি অন্ধকারে ঘরের মধ্যে বসে দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল।

 

৬৭

ঋতিকে ইতিহাস পড়াতেন ব্যারাকপুরের ভটচায পরিবারের বড়ো বউ। এই পরিবারটি কয়েকবছরে হলো প্রমোটিং এর ব্যবসায় বেশ নাম করেছে। অর্থোডক্স পরিবার। তবে ঋতির প্রিয় দিদি আর তার বর ঋতিকে খুব পছন্দ করে। ঋতির এই বিপদের দিনে সবার আগে তৃষাদির কথাই মনে পড়ল। ঋতি অনন্তকে নিয়ে তৃষাদির বাড়িতে হাজির হলো। তৃষাদি আর ওর বর সব শুনে বলল, প্রোমোটিং এর ব্যবসায় একটা লবি কাজ করে। বালি, সিমেন্ট,স্টোনচিপস বা লেবার যে কোনো সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রেই লবির মাধ্যমে আসতে হয়। বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে পারে না। তাছাড়া এখানে আগে ইনভেস্ট করতে হয়। লাভ পেতে সময় লাগে। অনন্তর ইনভেস্ট করার মতো টাকা নেই। ফলে এখান থেকে অনন্তদের বিফল মনোরথ হয়েই ফিরতে হলো। ফেরার সময় ঋতি বাবাকে বোঝাতে লাগল, যেখানে যাব সেখানেই কাজের ব্যবস্থা হবে এমন তো আর হবে না। চার জায়গায় চেষ্টা করে তবে এক জায়গায় সুবিধে হবে। কিন্তু চেষ্টাটা করতে হবে। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। হাল ছেড়ে দিলে খাব কি! ঋতিদের বাড়ির খাওয়া দাওয়া কোনোদিনই তেমন ভালো কিছু ছিল না। এখন অনন্ত বাজারেই যেতে চায় না। দুটো ডিম দিয়ে একবেলা ভাত আর একবেলা রুটির ব্যবস্থা করে। অনন্ত কিন্তু ঋতির উৎসাহ দেখে বেশ সতেজ হয়ে উঠেছে। ঝিমিয়ে পড়া ভাবটা একদম চলে গেছে। নানা জায়গায় নিজেই যেতে শুরু করেছে কাজের সন্ধানে। টুকটাক যোগাযোগও যে হচ্ছে না তা নয়! শ্রী এর মধ্যে ফিরে এসেছে। বাপের বাড়িতে থাকার ভাগ্য বিয়ের পর থেকে তার জীবনে ঘটেনি। আর এখন তো মেয়েটার মন ভালো নেই। স্বামীর চাকরি নেই। শ্রী তাই চলে এসেছে। দেখতে দেখতে ঋতির রেজাল্ট বেরোনোর দিনও এসে পড়ল। ঋতির সব মিলিয়ে ৫৬% নম্বর হয়েছে। ফার্স্ট ক্লাস হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছর ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে মাত্র চার জন। তার মধ্যে দুজন কলকাতার সেই স্বনামধন্য কলেজের, যে কলেজে ঋতি চান্স পায়নি। তার মধ্যে আবার একজন কলকাতার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের ছেলে। রেজাল্ট দেখে ঋতি বলল, আবার রিভিউ করতে দিতে হবে। নম্বর আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। বিশ্বদেব তখন বসে আছে ঋতিদের ফ্ল্যাটে। সে হঠাৎ বলে উঠল বাংলা অনার্স নিয়ে কত নম্বর পেয়েছিস সেটা কোথাও কাজে লাগবে না। আর নম্বরের পেছনে না ছুটে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নে। মেজ বৌ ওকে রুশির ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দাও। কাল থেকে চাকরির চেষ্টা করো। 

ঋতি বলে উঠেছে, আমি এম এ পড়ব তো! 

ওসব এম এ পড়ে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। চাকরির চেষ্টা করো। বাড়ির পরিস্থিতি বুঝতে পারছ তো! 

ঋতির মুখটা ছোটো হয়ে গেছে। ও শ্রীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, মা এম এ পড়ব না? 

শ্রী বলল, তুই আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে দেখা। চান্স পেলে অবশ্যই পড়বি। 

বিশ্বদেব আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল। 

ঋতির নাম ফার্স্ট লিস্টের প্রথমদিকেই আছে। শ্রী আর অনন্ত দুজনেই সিদ্ধান্ত নিল মেয়েকে তারা পড়াবে। অনন্ত উলের চাদরের কাজটা আবার শুরু করেছে। তাই থেকেই ঋতির ভর্তির টাকাটা জোগাড় হয়ে গেল। ঋতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দেখল কেউ কেউ তার চেনা। ব্যারাকপুরের সেই কলেজের কয়েকজন বন্ধুও সুযোগ পেয়েছে এখানে পড়াশোনা করার। তারা এমনকি ঋতির থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে। একটি মেয়ে ঋতিকে বলল, সেই তো একজায়গাতেই এসে পড়লাম সবাই। বরং তোর থেকে বেশি নম্বর পেয়েই এলাম। কি লাভ হলো শুধু শুধু কলকাতার কলেজে পড়তে এসে! ঋতি ওদের রাগের কারণটা বুঝল। কিন্তু ওদের কথায় কিছু মনে করল না। ও জানে কলকাতার এই কলেজটি তাকে যা শিখিয়েছে তা ব্যারাকপুরের ওই কলেজে শেখার সুযোগ ছিল না। আজ হয়তো সে কম নম্বর পেয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তার শেখাগুলো অনেকক্ষেত্রেই তাকে এগিয়ে রাখবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সে জানল নির্দিষ্ট আটটি পেপারের পড়েও নাইনথ পেপার বলে একটি পেপার হয়। সেটা হচ্ছে যোগাযোগ আর ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার শর্ট কাট পেপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত দুজন অধ্যাপক এর সঙ্গে যুক্ত। তারা প্রাইভেটে বিরাট টাকার বিনিময়ে পড়ান। কিন্তু এতো কিছু জেনে ঋতির লাভ নেই। ঋতির বই কেনার টাকাই নেই। গোটা মেঘনাদবধ কাব্য ঋতি লাইব্রেরি থেকে বই তুলে শিয়ালদা থেকে কম পয়সায় জেরক্স করিয়েছে। সব টেক্সটই একে একে সে এভাবে জোগাড় করছে। তাকে পরিশ্রম করে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। কোনো শর্ট কাটের কোনো জায়গা নেই তার জীবনে। ঋতি মন দিয়ে ক্লাস ফলো করা শুরু করল। স্যারেরা যা পড়াচ্ছেন দাঁড়ি কমা সমেত লিখে নেওয়ার মতো হাতের স্পিড তার। তারপর স্যারেদের বলে দেওয়া বই ফলো করে, লাইব্রেরিতে নতুন কোনো বই দেখতে পেলে সেটা থেকে প্রয়োজনীয় অংশ লিখে নিয়ে ঋতি উত্তর তৈরি করতে লাগল। প্রায় প্রত্যেক স্যার,ম্যাডামকেই সে উত্তর লিখে লিখে দেখাতে শুরু করল। দু একজন স্যার ঋতির খুবই প্রশংসা করতে লাগলেন। অধ্যাপক দে বললেন, এমন লিখলে তোমার কলেজ সার্ভিস কমিশন আটকায় কে! ঋতির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কলেজ সার্ভিস কমিশন! সেকথা তো ঋতি কোনোদিন ভাবেইনি! সে তো স্কুলে পড়াবার কথাই ভেবেছে। কলেজে পড়ানো তো খুব কঠিন কাজ! সেটা সে পারবে! তার সে ক্ষমতা আছে! স্যার নিজে যখন বলছেন! অধ্যাপক ব্যানার্জী আবার একদিন ভরা ক্লাসে ঋতিকে দেখিয়ে বললেন, এ মেয়েটা একদিন অনেকদূর যাবে। এ কে চিনে রাখো। অধ্যাপক ব্যানার্জীকেও ঋতি উত্তর লিখে দেখতে দিয়েছিল। কিন্তু সেই উত্তরের ভালো মন্দ কিছুই না বলে একঘর ছেলেমেয়ের মাঝখানে একথা বলাতে ঋতি বিরক্ত হলো। ইনিই সেই অধ্যাপক যিনি প্রাইভেট টিউশন করেন গোপনে। তার কাছে পড়তে ঢুকলে ফার্স্ট ক্লাস বাঁধা। হাটের মাঝে একথা বলাতে ঋতির আশেপাশে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করল। সংহিতা বলে একটি মেয়ে ঋতির সঙ্গে ভাব জমালো। তার বাবা মা দুজনেই প্রফেসর। মেয়েটি গাড়িতে যাতায়াত করে। মেয়েটি ঋতিকে নিয়ে প্রথমদিনই রেস্টুরেন্টে যেতে চাইল। ঋতি এককথায় না বলে দিল। তার বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। তারপর থেকে ঋতি দেখল, প্রত্যেকদিন ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি ঋতির খাতা চেয়ে নেয়। আর ঋতির লেখা নোটগুলো জেরক্স করে নেয়। ঋতি দু একদিন বিষয়টা দেখার পর সরাসরি মেয়েটিকে না বলতে বাধ্য হলো। সবাই নিজের নিজের ক্ষমতা মতো ক্লাস নোটস নেয়। একজন কষ্ট করে সারাদিন পাঁচটা ক্লাস বসে বসে লিখবে, আর আরেকজন কেবলই জেরক্স করে নেবে এটা হয় না। সংহিতা তাতে খুবই বিরক্ত হলো। কিন্তু ঋতির পেছন ছাড়ল না। ঋতিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল অধ্যাপক ব্যানার্জীকে ঋতি কতটা চেনে! ঋতি প্রাইভেটে কার কাছে পড়ছে? ঋতি যখন জানাল সে নিজে পড়ে, প্রাইভেটে পড়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার নেই তখন সংহিতা সেকথা বিশ্বাস তো করলই না, বরং ঋতিকে মিথ্যেবাদী ভাবল। যাই হোক ঋতি  বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট বেঞ্চে বসা উজ্জ্বল ছাত্রী হয়ে উঠল দিনে দিনে। রোজ শিয়ালদা থেকে নেমে কলেজ স্ট্রিটে হেঁটে যাতায়াত করে ঋতি। রোদ জল বৃষ্টিতে রাস্তাটা পেরোতে থাকে। কিন্তু রাস্তার কোনো কিছুই সে তাকিয়ে দেখে না। সে শুধু ভাবে স্নেহময়ের কথা। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই রাস্তাতেই তার সঙ্গে একদিন স্নেহময়দার দেখা হয়ে যাবে। স্নেহময়দা পিছন থেকে এসে ডাকবে, রুতু! ঋতি অবাক হয়ে যাবে। অথবা এমনও হতে পারে স্নেহময়দা রোজ তাকে দেখছে। তার পেছনে পেছনে হাঁটছে। কিন্তু তাকে ডাকতে পারছে না। নিরন্তর স্নেহময়দা কেবলই ঋতির পিছনে হাঁটছে। ঋতিকে ডাকছে না। ঋতিও কোনোদিন পেছন ফিরে দেখছে না। দেখলে যদি স্নেহময়দা লুকিয়ে পড়ে! যদি সংকোচবশত আর না আসে। ঋতি তাই ভুলেও পেছনে তাকায় না। ঋতি সামনে এগোয়। জানে পেছনে স্নেহময়দা আছে।

এক একদিন রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে ঋতি তন্ময় হয়ে যায়। কেমন করে যে অদ্ভুত সব দৃশ্য তার চোখের সামনে তৈরি হয় সে বুঝতে পারে না। সে দেখে স্নেহময় ঘুমোচ্ছে। ঋতি তাকে আলতো করে ডাকছে। স্নেহময় ঘুম চোখে হাত বাড়িয়ে ঋতিকে জড়িয়ে নিচ্ছে। ঋতি তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। ছেলেকে দুধ খাওয়াতে হবে। ঋতির ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। ওদিকে মা ডাকছে। স্নেহময়ের মা। ঋতি কাজে ভুল করেছে বলে বকছে। ঋতি মুখ ভার করে ঘরে ফিরে এলে স্নেহময় আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে ওকে। বলছে, মা একটু বকে। কিন্তু ভালোবাসে তোমাকে। ঋতি মাথা নাড়ছে। তার চোখের কোণে অশ্রু বিন্দু। ভাবতে ভাবতেই ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করে ঋতি। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে তার কোথায় আছে বুঝতে। তারপর একরোখা একটা মেয়ে মাথাটা নিচু করে কোনোদিকে না তাকিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ে। ভাবে তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। স্নেহময়দাকে সে ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা আজীবন সে বুকের মধ্যে লালন করবে। বাঁচিয়ে রাখবে তার নিখাদ অনুভূতিকে। আর সেটা করতে গেলে চাকরি তাকে করতেই হবে। সারাজীবনে ঋতি আর বিয়ে করবে না। ঋতি স্নেহময়ের হয়ে গেছে এ জীবনের মতো। তার আর কোনো ব্যত্যয় হবে না। তাছাড়া বাড়ির এই পরিস্থিতি। মা সারাটা জীবন কেবল কষ্টই করে গেছে। আরো কত যে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে তা ঈশ্বরই জানেন। মাকে এই যন্ত্রণার জীবন থেকে মুক্তি দিতে হবে। চাকরি তাকে করতেই হবে। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য চাকরি তাকে পেতেই হবে। 

 

৬৮

সেদিন ঋতি ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে দেখলো টুয়া মাসি, মৃন্ময়ী মাসি আর চঞ্চল মেসোকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে। মৃন্ময়ী মাসি শ্রীর মাসতুতো বোন হয়। ওদের এক বছরের ছোট্ট একটা ছেলে আছে। টুয়া মাসি নিজের মেয়েকেও নিয়ে এসেছে। ঋতি ওর এই বোনটাকে খুব ভালোবাসে। ঋতির থেকে প্রায় পনেরো বছরের ছোটো কুর্চি। ঋতির মনে হয় ও তো ঋতির সন্তানের মতো। আগেকার কাল হলে তো ওই বয়সের ঋতির সন্তান থাকত।ঋতি খুব খুশি হলো ওদের দেখে। এই চঞ্চল মেসোর সঙ্গে অনন্তরও বেশ কয়েকবছর পরিচয়।‌ পরিচয়ের একটি বড়ো সূত্র হলো চঞ্চলও পিয়ারলেস করত। বিশ্বদেবকে খুব ভালো করে চেনে। ইদানিং চঞ্চল বিজয়দেবের মতোই ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসা করছে। ওদের একটা টিম আছে। মূলত আসাম আর পশ্চিমবঙ্গে ওদের কাজ হয়। ইদানিং চঞ্চল বেশ উন্নতি করেছে। টাকা পয়সাও ভালোই হয়েছে। ওরা আর দক্ষিণ দিনাজপুরে থাকতে চায় না। ব্যারাকপুরেই ফ্ল্যাট কিনবে ঠিক করেছে। সেই জন্যই অনন্তদের এখানে এসেছে। অনন্তর সঙ্গে আলোচনা করবে কোথায় ফ্ল্যাট কিনলে ঠিক হবে। পারস্কোয়ারফিট কিরকম রেট চলছে! অনন্ত ওর জানা বোঝা মতো কথা বলছিল। টুয়া খুবই উচ্ছ্বসিত চঞ্চলদাকে নিয়ে। চঞ্চলদা যেমন সুন্দর দেখতে তেমন অমায়িক ব্যবহার। আর মৃন্ময়ীদি তো তার প্রাণের জন। খানিকক্ষণ থেকে ওরা বেরিয়ে পড়ল। অনন্তও দাদার বাড়ি গেল। অনন্ত নিজের স্বভাব ছেড়ে কিছুতেই বেরোতে পারে না। এ বাড়িতে কি ঘটছে না ঘটছে, কে আসছে না আসছে সব তার রিপোর্টে করা চাই দাদার কাছে। বিশ্বদেব সেসব শোনে। অনন্তকে দরকার মতো নানা পরামর্শ দেয়। যদিও সেগুলো কোনোটাই সুপরামর্শ বলা যায় না। বিশ্বদেব অনন্তর রোজগারপাতি নিয়ে খুবই চিন্তিত। একেই তো সে মনে করে তার এই ভাইটা একটা অকর্মণ্য। তার ওপর চাকরি চলে গিয়েছে। এখনো হাত পাতেনি, কিন্তু চাইতে কতক্ষণ! বিজয়দেব মুম্বাইতে বিরাট অবস্থা করে ফেলেছে। প্রায়ই সে নিজের কৃতিত্বের কথা জাহির করতে ভালোবাসে। তার সম্পত্তির পরিমাণ দেড়শো কোটি। সেকথাও সে গর্ব করে বলে ফেলেছে। কিন্তু বলে ফেলে সে বুঝেছে সে কি ভুল করেছে। দাদাভাই রিটায়ার করেছে তো সেই কবেই। তাই ছোটো ভাইকে প্রাণ দিয়ে বড়ো করার বিনিময়ে দাদাভাই ভাইয়ের ওপর বেশ কিছু দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। বিজয়দেব তাই মাস গেলে একটা ভালো অ্যামাউন্ট বিশ্বদেবের একাউন্টে পাঠায়। সম্পূর্ণা প্রবল আপত্তি করেছিল। বিজয়দেব তার বাধ্যতা বুঝিয়ে সম্পূর্ণাকে শান্ত করেছে। এবার বিশ্বদেব দাবি জানিয়েছে, অনন্তর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে বিজয়দেবকে। ওর কোম্পানিতে অনেক ক্ল্যারিকাল কাজ থাকে। তেমনই কোনো একটা পোস্টে অনন্তকে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তবে অনন্ত যা মাইনে পাবে মুম্বাইয়ের মতো জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে একা থাকা তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তাই বিজয়দেবদের সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু শোনামাত্রই এ প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে সম্পূর্ণা। সে তার সংসারে বাইরের কাউকে এলাও করবে না। তাদের বৈভব দেখে এমনিতেই লোকের চোখ টাটায়। সামনাসামনি থাকলে আরো বেশি হিংসে হবে। আর মেজদার তো চিরকেলে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা। বাঙালকে শাকের খেত দেখিয়ে আর কাজ নেই। ফলে বিজয়দেব নানা অজুহাত দেখিয়ে দাদাভাইয়ের এই প্রস্তাবে জল ঢেলে দিয়েছে। তখন বিশ্বদেব অনন্তর জন্য মাসকাবারি সামান্য টাকার বন্দোবস্ত করতে বলেছে বিজয়দেবকে। বিজয়দেব সম্পূর্ণার বুদ্ধির জোরে সেটাকেও কাটিয়ে দিতে পেরেছে। বিশ্বদেবকে বলেছে, দাদাভাই তোকে যে টাকাটা পাঠাই ওটা থেকেই তুই সামান্য টাকা মেজদাকে দিস। আলাদা করে পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ বিজয়দেব মনে করে গরিবকে কখনো দিয়ে শেষ করা যায় না। অভাবের লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে বসে থাকে এরা। ফলে বিশ্বদেব বাধ্য হয়েছে নিজের ভাগের টাকা অনন্তকে দিতে। প্রথমে অবশ্য বিশ্বদেব ছোটোভাইয়ের নাম করতে চায়নি। এমনভাবে অনন্তর হাতে টাকাটা দিচ্ছিল যেন বিশ্বদেব নিজে থেকেই দিচ্ছে। বিজয়দেব একদিন ফোনে অনন্তর কাছে টাকার খোঁজ করাতে অনন্ত বিষয়টা বুঝেছে। যাই হোক, বিশ্বদেব অনন্তকে নানা সময়ে নানা কুপরামর্শ দিয়ে থাকে। যেমন চঞ্চল ফ্ল্যাট কিনবে জানতে পেরেই বিশ্বদেব অনন্তর মাথায় কমিশন নেওয়ার কথাটা কায়দা করে ঢুকিয়ে দিল। অনন্তদের ফ্ল্যাটের পাম্প খারাপ হয়ে গেছে। মিস্ত্রি ঠিক করল অনন্ত। কারণ ও সেক্রেটারি। বিশ্বদেব বুদ্ধি দিল তুই তোর কমিশনটা রেখে বিল করতে বল মিস্ত্রিকে। ছোটোখাটো এই কমিশনগুলো নিতে নিতে অনন্তরও কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে এখন। সততার কথা বলত যে মানুষ সে এইসব উপরি পাওনাতে কোনো অন্যায় দেখে না আর। যারা তাকে বিশ্বাস করে সেক্রেটারি বানিয়েছে তাদের যে সে ঠকাচ্ছে একথা তার মনে হয় না। অভাবে স্বভাব নষ্ট বোধহয় একেই বলে। এই অল্পস্বল্প করতে করতে একটা বড়ো দাঁও মারার বুদ্ধি দিল বিশ্বদেব অনন্তকে।  দুটো বড়ো বিল্ডিং নিয়ে অনন্তদের কমপ্লেক্স। রঙ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাসিন্দারা। সেই মতো অনন্ত সব ব্যবস্থা করতে শুরু করল। টেন্ডার ডাকা হলো। অনন্ত একজন রঙের মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে তাকে কম অ্যামাউন্ট লিখিয়ে টেন্ডার পাইয়ে দিল।শর্ত একটাই – কমিশন দিতে হবে। মিস্ত্রিটি তাতে রাজি হলো বটে কিন্তু কথাটা চাপা রাখল না। অনন্তদের ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকারকে সবই বলে বসল। কেয়ারটেকার মাধবদার সঙ্গে অনন্তর সম্পর্ক ভালো নয়। মাধব ঠিক মতো কাজ করে না। পাম্প চালিয়ে এদিক ওদিক চলে যায়। জল নষ্ট হতে থাকে। রাতে দরকার পড়লে ওকে যাতে ডেকে পাওয়া যায় তাই একটা কলিংবেল ওর ঘরে লাগানো ছিল। সেটা মাধবদা ইচ্ছে করে বারবার খারাপ করে দেয়। যাতে ওকে কেউ না ডাকতে পারে। মাধবদা সেলাইয়ের কাজ করে। ওর একটা সেলাই মেশিন আছে। সে করুক। তাতে অনন্তদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু এখানে ঠিকেকাজ করতে আসা কয়েকজন বৌয়ের সঙ্গে ওর একটু বেশিই ভাব। ওর ঘরে দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় একদিন দেখা গেছে। এই সব মিলিয়ে অনন্ত মাধবদার ওপর বিরক্ত। মাধব সেটা জানে। অনন্তকে সেও পছন্দ করে না। ফলে মাধবের কানে যখন কমিশন নেওয়ার কথাটা গেল মাধব এই ফ্ল্যাটের বিশেষ কয়েকটি পরিবারের কাছে সেটা ফাঁস করে দিল। এই ফ্ল্যাটের পুরুষরা সব বড়ো বড়ো চাকরি করে। তাদের পক্ষে সেক্রেটারির দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকজন মহিলা এগিয়ে এলেন। মিটিং বসল। মেয়েরা জানাল তারা এবার থেকে সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, ক্যাশিয়ারের কাজটা করবে। অনন্তদা অনেকদিন সামলেছেন। ওঁর একার ওপর এতোদিন ধরে দায়িত্ব চাপিয়ে রাখা উচিত হয়নি। অনন্ত সবই বুঝল। কিন্তু লজ্জা হওয়ার বদলে তার রাগ হলো। অবশ্য রাগের অন্য কারণ ছিল। মেয়েরা দায়িত্ব নিয়েই ফ্ল্যাটের নামে যে টাকাটা এতো বছর ধরে অনন্ত জমিয়েছিল সেই টাকার দিকে হাত বাড়ালো। দুটো বিল্ডিংয়ের ছাদ দুটো জুড়ে দেওয়া হবে। ছাদ জুড়ে গেলে তিন তলার বিশেষ দুটি পরিবারের সুবিধে ছাড়া আর কারো কোনো উপকার হবে না। জমানো টাকা খরচ করে এই কাজ করার কোনো মানেই নেই। অনন্ত এর প্রতিবাদ করল। কিন্তু প্রমাণ না পেলেও অনন্ত তখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তার কথা কেউ কানে তুলল না। দুই ছাদ জুড়ে দেওয়া হলো। এখানে সবার সিমেন্টের ট্যাঙ্ক। সবে বারো তেরো বছর হয়েছে ফ্ল্যাটের বয়স। ট্যাঙ্কগুলো যথেষ্ট মজবুত আছে। তবু সেগুলো ভেঙে সিনটেক্সের ট্যাঙ্ক বসানো হলো। তাতে কম জল ধরে। ফলে বেশিবার পাম্প চালানো শুরু হলো। এইসব নানা কাজে জমানো টাকা সব শেষ হয়ে গেল। ব্যাঙ্কে যখন আর মাত্র এক দু হাজার টাকা পড়ে আছে সেইসময় দেখা গেল পাম্প খারাপ হয়েছে। পাম্পটাকে বদলাতে হবে। ফলে নতুন সেক্রেটারি পরিবারপিছু একটা বড়ো অ্যামাউন্ট চেয়ে বসল। অনন্ত ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। তার পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেকথা তো সে স্বীকার করবে না! সে এই নতুন কমিটির অদূরদর্শিতার কথা বলতে আরম্ভ করল। অনন্তর বারান্দার সামনে দিয়ে কমিটির কেউ যাতায়াত করলেই অনন্ত চেঁচিয়ে বলতে শুরু করত, বেড়াল দিয়ে কি হালচাষ হয়! সব খবরই আছে। শালা এতোগুলো টাকা ফুসকি মেরে উড়িয়ে দিল। 

মাধব দা বেঁটে। মাধবদার ভালোই ভুঁড়ি আছে। বয়সও হয়েছে ভালোই। মাধবদা একটু ঝিমিয়ে থাকে। নেশাভাঙও কিছু করে। মাধবদাকে দেখলেই অনন্ত বলত, ওই যে দশ মাসের পোয়াতিটা এলো। কিম্বা বলত ঢ্যামনা শালা! মাধব একদিন শ্রীকে ডেকে বলেছিল, বৌদি, আপনারা ভদ্রলোক। আপনাদের কাছ থেকেই তো আমরা শিখব। সেই আপনারাই যদি এতো খারাপ খারাপ কথা বলেন, গালাগালি করেন, তখন তো আমাদের মুখ দিয়েও দু চারকথা বেরিয়ে যাবে। তাতে দাদার সম্মানটা থাকবে! শ্রীর এতো লজ্জা করেছিল সেদিন। কিন্তু অনন্তকে থামানো যায়নি। 

 একথা সত্যি যে নতুন কমিটিও কমিশন খাচ্ছিল মিস্ত্রিদের কাছ থেকে। সে খবর অনন্তর কাছে পৌঁছেছিল। কিন্তু অনন্তর বিরুদ্ধে যেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, ওদের বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ নেই। অনন্ত তাই ফ্ল্যাটের মান্থলি মেইনটেনেন্সের টাকাটা সেক্রেটারির হাতে না দিয়ে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে ফেলতে লাগল। ছ’ মাস হয়ে যায়। সেক্রেটারি টাকা পায়নি এই ফ্ল্যাট থেকে। একদিন সবাই মিলে অনন্তর ফ্ল্যাটের সামনে এসে ঝামেলা শুরু করল। শ্রী না থাকলে সেদিন বিষয়টা বাড়াবাড়ির দিকে যেতে পারত। শ্রী অনন্তকে অনেক করে বোঝাল, এই সমস্যাটা তো তুমিই শুরু করলে। তোমার দাদার বুদ্ধি নিয়ে লোক ঠকাতে গেলে কেন! সৎ পথে চেষ্টা করলেই তো পারতে। কিন্তু অনন্তর তখন এসব কথা ভালো লাগছে না। তার ক্ষমতা, সুযোগ দুটোই হাতছাড়া হয়ে গিয়ে সে উন্মাদের মতো হয়ে উঠল। সেইসঙ্গে একটি নতুন উপসর্গ অনন্তর জীবনে দেখা গেল। এখানে একটি ফ্ল্যাটে থাকে পারমিতা। ওর স্বামী, এক ছেলে আর শাশুড়ি। এরা বনেদী পরিবার। অবস্থাপন্ন। প্রত্যেক বছর পুজো, পয়লা বৈশাখ, ছোটাখাটো অনুষ্ঠানে প্রচুর শাড়ি কেনে শাশুড়ি বৌমা মিলে। তারপর পালা করে সেগুলো শ্রীকে দেখাতে নিয়ে আসে। শ্রীর সঙ্গে সকলের সম্পর্ক খুব ভালো। শ্রীর কাছেও ওরা পুজোর শাড়ি দেখতে চায়। শ্রীর একটা শাড়ি হয় কি হয় না। শ্রী বলে, মাসিমা শাড়িগুলো ফল পিকো করতে গেছে। এলে দেখাব। এভাবে কাটিয়ে দেয়। হঠাৎ দেখা গেল অনন্ত এই পারমিতার সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলতে আরম্ভ করেছে। গরমকাল। শ্রী রান্নাঘরে রুটি করছে। তার প্রায় গলদঘর্ম অবস্থা। হাঁসফাঁস করছে গরমে। এমন সময় পারমিতা রান্নাঘরের জানলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কথা বলতে দাঁড়িয়ে গেছে। শ্রী রুটি করছে আর কথা বলছে। অনন্ত ডাইনিং টেবিলে বসে ছিল। সে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীর ওপর। শ্রীর ঘাড়ের ওপর দিয়ে পারমিতার সঙ্গে কথা বলেই চলেছে। পারমিতার যে পাড়ায় বাপের বাড়ি সেখানে একসময় অনন্ত গানবাজনা করতে যেত। কার কার সঙ্গে পরিচয় ছিল, বন্ধুত্ব ছিল সেসব অনন্ত গল্প করতে শুরু করেছে। পারমিতা নামগুলো শুনে বলছে, এদের তো আমরা কাকু বলতাম। বলে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে। অনন্ত তাও বুঝতে পারছে না। কথা বলে চলেছে। ওদিকে শ্রী রুটি করা থামিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে। লক্ষ্মীপুজোর দিন পারমিতা এসে প্রসাদ দিয়ে গেছে। অনন্ত তাও বলছে, আমি একটু পরে যাচ্ছি তোমাদের ফ্ল্যাটে। পারমিতা বলছে, আমরা থাকব না। মামারবাড়ি যাব। অনন্ত তারপরও বলছে, আমি একটু সময় দেখা করেই চলে আসব। শ্রী জানত সুন্দর, ফর্সা এসবের প্রতি বিশ্বদেবের বিশেষ মোহ আছে। সম্পূর্ণাকে নিয়ে বিশ্বদেব চিরকাল বাড়াবাড়ি করে গেল। আর সেই জন্যই মাধুরী পারলে সম্পূর্ণাকে নখে টিপে মারে। তাছাড়াও বিশ্বদেবের সঙ্গে নানা সময়ে নানা মেয়ের সম্পর্ক হয়েছে। মাসতুতো বোন, পিয়ারলেসের জুনিয়ারের বোন নানাজন। চিঠি চালাচালিও হতো। সেসব নিয়ে বিশ্বদেব আর মাধুরীর অশান্তি হয়েছে। কিন্তু মাধুরী মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে। এখন ব্যাপারগুলো অনেকটাই ঢাকা চাপা পড়ে গেছে। বিজয়দেবেরও এই রোগ আছে। কোনো মেয়ে বিজয়দেবকে বেশি পাত্তা দিলে বিজয়দেব গলে পড়ে। সম্পূর্ণা তখন সামলায়। কিন্তু শ্রী মনে করত অনন্ত এমন নয়। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সুযোগ পেলে অনন্তও কম যায় না। এই নিয়ে একদিন শ্রী আর অনন্তর কথাকাটাকাটি হয়ে গেল। ঋতি শুনল সবই। ভাবল, বাবার চাকরি চলে যাওয়ার পর বাবাকে যে এভাবে মোটিভেট করেছিলাম, বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, টিউশনি করে নিজের খরচটুকু চালিয়ে নিচ্ছি – এগুলো কোনোটাই আসলে বাবার মন পরিবর্তনে কোনো কাজে লাগেনি। বাবা এতোটুকুও উদ্যোমী হতে পারেনি। উল্টে অসৎ পথ বেছে নিয়েছে। ঋতি পুরো ব্যাপারটায় অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ল। এখন এই পরিবারটার একমাত্র ভরসা সে। তাকেই লড়াইটা চালাতে হবে। ঋতি চোখ কান বন্ধ করে পড়াশোনায় মন দিল।

 

৬৯

ঋতির পার্ট ওয়ান পরীক্ষা চলছে। প্রথমদিন ভাষাতত্ত্বের পরীক্ষা দিয়ে এসে ঋতির জ্বর এলো। রাতের মধ্যে জ্বর প্রায় ১০৩ উঠে গেল। ক্যালপল খেয়ে ওই রাতটা কাটলেও ভোরবেলা থেকে আবার জ্বর। মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছে ঋতির। অনন্ত বলল, আমি ওষুধের দোকান থেকে বলে ওষুধ নিয়ে আসছি। শ্রী কিন্তু ওভাবে বলে ওষুধ নিয়ে আসার ব্যাপারটায় ভরসা করতে পারল না। বলল, ডাক্তার দেখাতে হবে। এখনো তিনটে পরীক্ষা বাকি। ও বেরিয়ে গেল ডাক্তার ডাকতে। অনন্তর মনে হলো সামান্য জ্বর নিয়ে এতো বাড়াবাড়ির কি আছে! ঋতি ওদিকে চোখ খুলতেই পারছে না। উঠে বসার মতো অবস্থা নেই ওর। টেম্পারেচার ক্রমশ বাড়ছে। ডাক্তার দেখে বললেন, প্রচণ্ড স্ট্রেস নিয়ে ফেলেছে। তার থেকে জ্বর এসেছে। আপনারা কি পরীক্ষা নিয়ে ওকে কোনোরকম প্রেশার দিয়েছিলেন? 

না, ডাক্তারবাবু। ও নিজে থেকেই বারবার বলছিল ভালো রেজাল্ট করতে হবে।

হুম। খুব টেনশন করে ফেলেছে। ওকে কোনোরকম মানসিক চাপ দেবেন না। এই ওষুধগুলো চলুক। সাতদিন বাদে একবার রিপোর্ট করবেন। 

বিকেলের দিকে ঋতি একটু উঠে বসতে পারল। ওর চোখে মুখে অসহায়তা। কাল থেকে কিছু পড়তে পারেনি। 

শ্রী বলল, কিছু পড়তে হবে না। তুই রেস্ট নে। 

মা, কাল কি পরীক্ষা দেব! কিছুই তো পারব না।

সব পারবি। তোর তো সবই রেডি আছে। আজ একবার চোখ বোলাতিস। ঠিক আছে। দরকার নেই। কাল পরীক্ষার হলে বসে দেখবি সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ঋতি দুরুদুরু বুকে পরীক্ষা দিতে গেল। কিন্তু সত্যিই তার কোথাও খুব একটা আটকালো না। সবই তার মনে পড়ে গেল। বাকি দুটো পরীক্ষা নির্বিঘ্নেই কাটল। পার্ট টু এর ক্লাস শুরু হবে এবার। তার আগে ভর্তির ব্যাপার আছে। ঋতি অনন্তকে জানাল, বাবা ভর্তি হতে চার হাজার টাকা লাগবে। ওর মধ্যেই পরের পরীক্ষার ফি ধরা আছে। অনন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার পক্ষে আর তোমাকে পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। আমার কাছে টাকা নেই। 

ঋতি বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। অবিশ্বাস্য লাগছে এই কথাটা। 

ঋতিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনন্ত বলল, আমার কিছু করার নেই রুতু! 

ঋতি তাও চুপ করে আছে। সারাবছর বইপত্র, যাতায়াত আর যা যা খরচ লাগে সবই সে টিউশন করে জোগাড় করে নেয়। কিন্তু ভর্তির টাকাটা তো অনেকটা টাকা। বাবা যদি আগেও বলত! সে তবে আরো কটা টিউশন বেশি করত। এই শেষমুহূর্তে কি করে জোগাড় করবে সে টাকাটা! বাবার দিকে আবার একবার তাকালো ঋতি। বাবাকে অত্যন্ত নিস্পৃহ মনে হলো। তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে চলেছে। আর বাবা বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে। এই একবছরে বাবা টুকটাক লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারল না। বিজু টাকা পাঠাচ্ছে। মাত্র আড়াই হাজার টাকা। তাই দিয়ে টেনেটুনে কয়েকটা খরচ চালাচ্ছে। মার অপারেশনের পর ডাক্তার মাকে ক্যালসিয়ামের ওষুধটা টানা খেতে বলেছিল। বাবা এনে দেয়নি। ডাক্তার মাকে ভারি জিনিস টানতে, ভারি কাজ করতে বারণ করেছিল। মাকে কিন্তু সেই চারতলার ছাদ থেকে টেনে টেনে খাবার জলটা আনতে হয়। ঘর মুছতে হয়। বাবা মুড হলে এক আধদিন সাহায্য করে। নয়তো ফিরেও তাকায় না। এসব ভাবতে ভাবতে বাবাকে অকর্মণ্য অপদার্থ ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না ঋতির। বাবা তার দায়িত্ব তো নিলই না, উপরন্তু তার জীবনটা শেষ করে দিল। স্নেহময়দাকে হারিয়ে ফেলল ঋতি। সব কিছুর জন্য বাবা দায়ী। তীব্র একটা ঘৃণাবোধ ঋতির অন্তরটাকে কালো করে দিচ্ছে যেন। ঋতি আর ওখানে দাঁড়াল না। 

সন্ধেবেলা অনন্ত বেরিয়ে যাওয়ার পর শ্রী বসল মেয়ের কাছে। বাবু, তোর বাবা বিজুকে ফোন করতে বলছে। 

কেন? 

বিজু যদি এই বছরটা তোর পড়ার খরচটা চালিয়ে দেয়। 

ঋতি ছিটকে উঠল কথাটা শুনে। আমি ভিক্ষে চাইতে পারব না মা! 

হ্যাঁ জানি, বাবু। তোর ভালো লাগবে না। কিন্তু এখন তো উপায়ও নেই রে! 

ঋতি চুপ করে গেল। একবার তার মনে হলো বলে যে, আমি আর পড়াশোনা করব না। পরক্ষণেই তার মনে হলো এতোদূর এসে শেষে কি না তীরে এসে তরী ডুববে! আর পড়াশোনা না করলে সে চাকরিই বা পাবে কোথায়! তার নিজের জীবন, এই সংসার এসব চলবে কেমন করে! চিরকাল বিজুর দয়ায় থাকতে হবে? 

শ্রী বলল, বাবু, বিজুর কাছ থেকে এখন টাকাটা নিয়ে তুই চাকরি পেয়ে যদি ফেরৎ দিয়ে দিতে পারিস! 

মা ফেরৎ দিতে চাইলেই বিজু যদি নিতে না চায়! সারাজীবন এই ঋণের বোঝা কাঁধে করে বয়ে বেড়াতে হবে। 

শ্রীও এবার চুপ করে যায়। একসপ্তাহ সময় আছে ভর্তির জন্য। একসপ্তাহে কোনোভাবেই টাকাটা জোগাড় হবে না। তাহলে? 

সেদিন রাতে ঋতির আর ঘুম এলো না। দুশ্চিন্তায় তার মাথার যন্ত্রণা করছে। এই এক উপসর্গ শুরু হয়েছে। পান থেকে চুন খসলে মাথা ব্যথা, বমি। অনন্তরও এই রোগ ছিল। ঋতিরও ধরেছে। ভোরের দিকে বমি হয়ে যন্ত্রণাটা একটু কমল। ঋতি সিদ্ধান্ত নিল সে বিজুকে ফোন করবে। একটা বড়ো লড়াই লড়তে লড়তে সাময়িক ভাবে যদি কখনো মাথাটা নোয়াতেও হয় সেটা হেরে যাওয়া নয়। শেষপর্যন্ত লড়াইটা লড়ে যাওয়া আর জিতে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। তাকে এই লড়াইটা লড়তেই হবে। সেই ছোটোবেলা থেকে সে দেখে এসেছে একই পরিবারের ছেলেমেয়ে হয়েও তার তিনদিদি, ভাই একরকম করে মানুষ হয়েছে। জীবনে কোনোদিন অভাব কি জিনিস তারা জানতে শেখেনি। রাবড়ি মুখে দিয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে। আর সে! তার দুবেলা ভাতটুকুও জোটেনি। মাছ তো ছেড়েই দাও। আধখানা ডিম খেয়ে সে বড়ো হয়ে গেল। জ্যেঠু আর বিজুর বিত্ত, ঐশ্বর্য ওদের ছেলেমেয়েদের সুখের, শান্তির জীবন দিয়েছে। আর তার বাবার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে ওদের জন্য। ছোটোবেলা থেকে ঋতি শুনত, লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে! লেখাপড়ায় পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সেই তো সবথেকে ভালো। তাহলে তার একটু ভালো থাকার অধিকার নেই! ভালো থাকার কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। অন্তত পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়ার অধিকারটুকু তো আছে! না কি তাও নেই! যদি না থাকে সে অধিকার ঋতি ছিনিয়ে নেবে। আর এই একটা বছর! এম এ টা পাশ করেই চাকরি একটা তাকে পেতেই হবে। আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না তাকে। 

পরদিন সন্ধেবেলা ঋতি টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করল বিজুকে। শ্রী সঙ্গে ছিল। অনন্ত বাড়িতে। ঋতি কোনো ভণিতা না করে সরাসরিই বলল, বিজু, আমার পার্ট টুর ভর্তির জন্য চার হাজার টাকা লাগবে। বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভর্তিটা আটকে যাচ্ছে। 

শুনে বিজু বলল, ঋতি, মা গো, তোমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে এ কখনো তোমার বিজু হতে দিতে পারে? কোনো চিন্তা করো না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

শ্রীও কথা বলল বিজুর সঙ্গে। 

মেজ বৌ, আমি টাকাটা পাঠিয়ে দেব। তুমি চিন্তা করো না। শুধু এই কথাটা কেউ যেন জানতে না পারে। দাদাভাই, সম্পূর্ণা কাউকে বলো না। আমি মেজদার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেব। 

শ্রী তখন কাঁদছে। কথা বলতে পারছে না। 

বিজু বলল, তারকনাথ আছে মেজ বৌ। বাবা আমাকে দিয়ে এই কাজটা করিয়ে নিচ্ছে। তুমি ভেবো না। 

ঋতি আর শ্রী ধসে যাওয়া পাহাড়ের মতো বাড়ি ফিরল। জীবনে তো এতো কষ্ট গেছে। তবু কোনোদিন কারো কাছে শ্রী হাত পাতেনি। মেয়েকেও সেই শিক্ষা দেয়নি। আজ সমস্ত মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে হাত পেতে দাঁড়াতেই হলো। 

দুদিন কেটে গেল। অনন্তর অ্যাকাউন্টে টাকা আসেনি। শ্রী আর ঋতি অপেক্ষা করছে। এমন সময় লীলাদির বাড়িতে বিজু ফোন করল। শ্রী তড়িঘড়ি গিয়ে ফোন ধরেছে। 

মেজ বৌ, আমি সম্পূর্ণার ভাইয়ের হাত দিয়ে টাকাটা পাঠাচ্ছি। 

শ্রী শুনেই দমে গেল। এই যে বিজু বলল, কাউকে না জানাতে। সম্পূর্ণা তো তবে সব জেনেই গেল! শ্রীর মুখটা কালো হয়ে উঠল। 

যাই হোক, এক সপ্তাহের মধ্যে ঋতি ভর্তি হলো। কিন্তু ঋতির পাগলামি আরো বেড়ে গেল। তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। পাশ করে যা হোক একটা চাকরি তাকে পেতেই হবে। নিজের কাছেই নিজেই সে চ্যালেঞ্জ করে বসল। 

 

৭০

দুবছর হলো রুচি এস এস সি দিয়ে চাকরি পেয়েছে। বনগাঁর কাছাকাছি একটি অঞ্চলের অজো গাঁয়ের একটি স্কুল। রোজ রুচিকে অনেকটা রাস্তা ট্রেন, অটো, ভ্যানে যাতায়াত করতে হয়। ভোরবেলা উঠে রুচি বাড়ির সবার জন্য রান্না করে। নিজের টিফিন রেডি করে। তারপর সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরোয়। তার একটি দুবছরের মেয়ে আছে। মেয়ে তখন ঘুমোয়। রুচি মেয়েকে আদর করে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধেবেলা প্রায় আটটা বাজে তার বাড়ি ফিরতে। ফিরে এসে বেশিরভাগ দিনই দেখে মেয়ে কান্নাকাটি করছে। রুচি তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে মেয়েকে সামলায়। রুচি জানে এ বাড়িতে তার মেয়েকে কেউ পছন্দ করে না। শাশুড়ি, বর সবাই ছেলে চেয়েছিল। মেয়ে হয়েছে বলে রাগ দেখায়। বলে, ও তো আর নিজেদের কেউ নয়! পরের ঘর আলো করবে বলেই এসেছে। মায়া না বাড়ানোই ভালো! 

বলে, রাজা, ওকে পাড়ার স্কুলে ভর্তি করে দিবি। মেয়ের পেছনে বেশি খরচ করার দরকার নেই।

রুচি এসব শোনে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ও ভালো স্কুলে, বড়ো স্কুলে পড়বে।

আর তার খরচটা কে দেবে! তোর বাবা! বড়ো স্কুলে পড়বে! বলে শাশুড়ি ভেঙায়। 

বাবা দেবে কেন! আমার মেয়েকে আমিই পড়াব। 

হ্যাঁ, সারাদিন সংসারে থাকা নেই,কাজ নেই! ড্যাং ড্যাং করে ব্যাগ ঝুলিয়ে চাকরি করছিস। তারপর আবার সেই টাকা দিয়ে মেয়েকে পড়াবি! আমাদের খাবে পড়বে, অথচ এক পয়সা ঠেকাবে না! অমন চাকরির কাঁথায় আগুন! 

রুচি একথার আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। 

তখন আসরে নামে রাজা। শোনো, তোমার চাকরির জন্য আমাদের কোনো সুবিধে হচ্ছে না। উল্টে তোমার মেয়েকে দেখতে হচ্ছে সারাদিন ধরে মাকে। ওই তো চাকরি! কটা টাকাই বা পাও! ছেড়ে দাও। 

রুচি এবার মেয়েকে কোলে করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। 

শাশুড়ি বলে ওঠে, ওকে তুই চাকরি ছাড়াতে পারবি ভেবেছিস! কোনোদিন পারবি না। অন্য মধু আছে বুঝেছ! অন্য মধু আছে! 

রুচি এবার ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। কি যা তা বলছ! 

ঠিকই বলছি! রোজ রোজ অতো খাবার গুছিয়ে নিয়ে সেজেগুজে স্কুলে যাওয়া কিসের! কোথায় কি করে বেড়াচ্ছিস আমরা খবর রাখি না, না কি! 

কি করে বেড়াচ্ছি! বলো! কি প্রমাণ আছে! বলো! 

রাজা বলে প্রমাণ ঠিক একদিন দেখিয়ে দেব। তারপর হাত পা বেঁধে ঘরে ফেলে রাখব! 

রুচি আর কথা বাড়ায় না। ঘরে চলে যায়। সত্যি কথা বলতে রুচির রাজার ওপর থেকে মন উঠে গেছে। রাজা যে এতটা দুশ্চরিত্র একটা ছেলে রুচি আগে বোঝেনি। ওর চেম্বারে প্রচুর মেয়েরা হাত দেখাতে আসে। চেম্বারের দরজা বন্ধ করে তাদের সঙ্গে চার দেওয়ালের আড়ালে রাজা কি করে সে আর বুঝতে বাকি নেই রুচির। এই নিয়ে প্রথম প্রথম রুচি উষ্মা প্রকাশ করেছে। শেষপর্যন্ত রেগে গিয়েছে। ঘৃণা করেছে রাজাকে। কিন্তু ওকে ফেরাতে পারেনি। ওদিকে স্কুলে সৌরেন্দ্রর সঙ্গে ওর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। শুধু বন্ধুত্ব বলা বোধহয় ভুল হলো। তার বেশিই কিছু। সৌরেন্দ্র বরানগরে থাকে। একসঙ্গেই ওরা দুজন যাতায়াত করে। একই স্কুলে পড়ায়। রুচি সৌরেন্দ্রর হাতটা ধরতে চায়। বড়ো অসহায় লাগে আজকাল তার নিজেকে। 

সেদিন স্কুলে ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎই হেডমাস্টারমশাই ডেকে পাঠালেন। আর্জেন্ট । রুচি ক্লাসের মাঝপথেই বেরিয়ে এলো। হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘর থেকে তখন একটা গণ্ডগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। রুচি তাড়াতাড়ি ওই ঘরে ঢুকে দেখল সৌরেন্দ্রর কলার চেপে ধরে আছে রাজা। পাশে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি একনাগাড়ে কি সব বলে যাচ্ছে। রুচিকে দেখে সবাই একমুহূর্তের জন্য থমকালো। তারপর রাজাই শুরু করল, এই যে এলেন! কি এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন! কতজনের সঙ্গে শুয়ে বেড়াচ্ছেন! কি মনে হয়েছিল! আমি কিছু খবর পাব না! 

ততক্ষণে স্কুলের সমস্ত টিচাররা ওই ঘরে জমা হয়েছে। তারা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। কেউ কেউ ঠোঁট টিপে হাসছে। 

রুচি তখন অপমানে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কোনো কিছু বলার অবস্থা নেই তার! 

হেডমাস্টার মশাই বলতে শুরু করলেন। দেখুন ম্যাডাম, এটা একটা গ্রামের স্কুল। এখানে লোকজনের মানসিকতা আপনাদের শহরের মানুষের মতো নয়। এসব জায়গায় কাজ করতে হলে একটু বুঝে চলতে হতো। আপনার স্বামী যে অভিযোগ করছেন তাতে আপনি আর সৌরেন্দ্র অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছেন। আপনি শিক্ষক। কোথায় আপনি ছেলেমেয়েদের পথ দেখাবেন! আদর্শবান হতে শেখাবেন! সেখানে আপনি নিজেই যদি অসৎ হন! 

রুচি কিছু বলতে যাচ্ছিল। হেডমাস্টারমশাই থামিয়ে দিলেন। রাজা রুচিকে সঙ্গে করে নিয়ে সোজা চলে এলো ঘোষাল বাড়িতে। রুচিকে রাস্তায় শাসালো, তোমাকে বাপের বাড়ি রেখে আসব। মেয়ের সঙ্গে আর তোমার কোনোদিন দেখা হবে না। ঘোষাল বাড়িতে এসেও বিশ্বদেবের সামনে একইভাবে শাসাতে লাগল রুচিকে। বিশ্বদেব সব শুনে আর রাজার আচরণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। রাগে, অপমানে বলে ফেলল, রুচি, তোমার আর ও বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। তুমি মনে করো, তোমার কখনো বিয়েই হয়নি। এই জানোয়ারটা তোমার কেউ হয় না। 

রাজা সঙ্গে সঙ্গে ওর মাকে নিয়ে ঘোষাল বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। 

রুচি ওদের আটকাতে ওদের পেছনে যেতে যেতে বলল, বাবা তুমি কি বললে! আমার মেয়েটা ওদের কাছে আছে তো! ওকে ওরা বাঁচতে দেবে না! 

ততক্ষণে অবশ্য রাজা আর ওর মা গলির মাঝামাঝি চলে গেছে। রুচি দৌড়ে ওদের আটকাতে গেল। রাজা রুচির হাত থেকে জোর করে শাঁখা পলা লোহা খুলে মাটিতে ফেলে ভেঙে দিল। তারপর আবার এগোতে চাইল। রুচি তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার সন্তানকে ওরা কেড়ে নেবে। রুচি রাজার পা ধরে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার বাচ্চাটার কাছ থেকে আমাকে আলাদা করে দিও না! 

ততক্ষণে বেশ কিছু পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গেছে। মাধুরী, রুশি, বিশ্বদেব ছুটে এসেছে। অনন্তও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে। মাধুরী কান্নাকাটি করছে। রুশি দিদিভাইকে সামলাবার চেষ্টা করছে। রুচি রাজার হাতে পায়ে ধরে কাঁদছে। 

রাজা বলল, কেন! কাঁদছ কেন! তোমার বড়লোক বাপ আছে তো! যাও তার কোলে গিয়ে বসে থাক! 

বিশ্বদেব আরো খেপে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। অনন্ত আটকালো। 

বেশ খানিকক্ষণ বাদানুবাদ চলার পর রাজা বলল , ঠিক আছে। তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। তুমি এখানে সকলের সামনে দোষ স্বীকার করো। কান ধরে ওঠবোস করো দশবার। তারপর আমি ভেবে দেখব। 

কি বলছ রাজা! এভাবে আমাকে অপমান করতে পার না তুমি ! 

মান অপমানের কথা আগে মনে ছিল না। নষ্টামি করছিলে যখন তখন মনে পড়েনি। হয় কান ধরে ওঠবোস করবে, নয়তো এখানেই থেকে যাবে! 

পাড়ার এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে এখানে! তোমাকে এতো সাহস কে দিয়েছে যে তুমি ওকে এভাবে অপমান করছ! 

মাধুরী তাড়াতাড়ি ওই ভদ্রমহিলার কাছে গিয়ে বলল, বলবেন না বৌদি। আমার নাতনিটা ওদের কাছে আছে! 

ভদ্রমহিলা রাগে গড়গড় করতে লাগলেন! 

রুচি আর উপায় না পেয়ে শেষপর্যন্ত বাধ্য হলো কান ধরে ওঠবোস করতে। বিশ্বদেব আর দাঁড়াল না ওখানে। রুচিকে নিয়ে রাজা আর ওর মা চলে গেল। 

 

অষ্টম পর্ব 

 

৭১

অনেক চেষ্টা করেও রুচির সংসারটা শেষপর্যন্ত টিকল না। রুচি রাজার অসভ্যতা, বেলেল্লাপনা সব মেনে নিয়েও ও বাড়িতে টিকতে পারল না। তাকে টিকতে দেওয়া হলো না।

সেদিন সন্ধেবেলা রুচি স্কুল থেকে ফিরে দেখল গলির মোড়ে পাড়ার এক ভদ্রলোকের কোলে তার মেয়ে। রুচিকে দেখেই ওইটুকু মেয়ে জোরে কেঁদে উঠেছে। রুচি তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখে মেয়ের মুখ ফুলে উঠেছে। সামনের তিনটে দাঁত ভেঙে গেছে। ঠোঁট ফেটে গেছে। হাতে পায়ে কালশিটের দাগ। রুচি তাড়াতাড়ি মেয়েকে কোলে করে বাড়ি ফিরে সামনে শাশুড়িকে পেয়ে জিজ্ঞেস করে রাইয়ের কী হয়েছে? 

শাশুড়ি অত্যন্ত নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দেয়, পড়ে গেছিল। 

পড়ে গেছিল! কী করে পড়ে গেল? 

সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে। 

রুচি আকাশ থেকে পড়ে। ওইটুকু বাচ্চা একা একা সিঁড়িতে কি করছিল! কেউ দেখেনি! । এতো কালশিটে সারাগায়ে! রুচি আর মাথার ঠিক রাখতে পারে না। চিৎকার করে বলে ওঠে, রাই কী করে পড়ে গেল! ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে? 

রাজা সঙ্গে সঙ্গে এসে রুচির চুলের মুঠি চেপে ধরে। আমার মায়ের ওপর চেঁচাচ্ছ! এতো সাহস তোমার! খানকি মাগী শালা! 

রুচি কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে রাজাকে ঠাস করে একটা চড় মারে। 

ব্যাস্, রাজা আর ওর মা দুজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রুচি আর রাইয়ের ওপর। রাইকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। রুচির শাড়ি টানাটানিতে ছিঁড়ে যায়। রুচি চিৎকার করতে থাকে। রাই পরিত্রাহি কাঁদছে। 

রাজার মা বলে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি! জ্বালিয়ে দে। নইলে তোর ঘাড় থেকে নামবে না। মা মেয়ে দুটোকেই জ্বালিয়ে দে একসঙ্গে। 

রাজা তখন কেরোসিন তেল খুঁজছে। ওর চোখমুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে। 

রুচি কোনোরকমে বিশ্বদেবকে ফোন করে, বাবা ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। জ্বালিয়ে দেবে বলছে। 

বিশ্বদেব বোধহয় এই দিনটার জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল। বিশ্বদেব একটাই কথা বলে, তুই যে অবস্থায় আছিস মেয়েকে নিয়ে চলে আয়। 

রুচি আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রাজা তখন সদর দরজায় কেরোসিনের জার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গেছে। রুচি কোনোরকমে দৌড়ে স্টেশনে আসে। তার ছেঁড়া শাড়িটা কোনোরকমে গায়ে জড়িয়ে নেয়। রাই তখনও কাঁদছে। রুচিও কাঁদছে। ট্রেনের লোকেরা ওদের দেখছে। কেউ কেউ নানা প্রশ্ন করছে। রুচি তাদের এড়িয়ে কোনোরকমে ব্যারাকপুরে পৌঁছোয়। অনন্ত আগেই স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল। একটা রিক্সা ডেকে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। রাই তখনও ফোঁপাচ্ছে। বিশ্বদেব দরজায় দাঁড়িয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে রুচিকে জড়িয়ে ধরে। রুচি কাঁদতে থাকে। 

সেদিন অনন্ত অনেক রাতে বাড়ি ফিরল। শ্রী আর ঋতি অপেক্ষা করছিল। অনন্ত বাড়ি ফিরে সব ঘটনা জানাতে মা আর মেয়ে দুজনে কেঁদে ফেলল। শ্রী কোনোদিন রাইকে চোখের দেখাটুকুও দেখতে পায়নি। সেই যে হসপিটালে রুচির অপারেশনের সময় শ্রী আর ওর শাশুড়ির কথা কাটাকাটি হয়েছিল তারপর থেকে রুচির শাশুড়ি আর শ্রীদের সঙ্গে রুচিকে যোগাযোগ রাখতে দেয়নি। রুচি নিজেও চায়নি। কাকিমা তাকে কোনোদিনই সহ্য করতে পারে না। তাই সুযোগ বুঝে ইচ্ছে করে তার সংসার ভাঙার চেষ্টা করেছে। ঋতি তার দিদিভাইকে খুবই ভালোবাসে। এতোকিছুর পরও দিদিভাই প্রেগন্যান্ট শুনে ঋতি দেখা করতে এসেছিল রুচির সঙ্গে। রুচি যাচ্ছেতাই বলে ঋতিকে অপমান করে। শ্রীর সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলে। 

ঋতি এসবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কেঁদে ফেলে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে শুধু এটুকু বলে, আমার মায়ের সম্পর্কে একটাও খারাপ কথা বলবি না দিদিভাই। বলে সে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অনন্ত পুরো বিষয়টা জেনে রুচির ওপর বিরক্তই হয়। মুখে কিছু বলে না। সেই শেষ। তারপর রুচির মেয়ে হয়েছে। ওর অন্নপ্রাশন, মামাভাত সবই এলাহি করে করেছে বিশ্বদেব। কিন্তু অনন্তদের সেখানে ডাকার উপায় রাখেনি রাজা আর ওর মা। তবু আজ রুচির এই পরিণতি দেখে শ্রী আর ঋতি কেঁদে ফেলল। 

ঋতি আর শ্রী পরদিনই ছুটল রুচির সঙ্গে দেখা করতে। রুচি তখন স্কুল থেকে ফিরেছে সবে। ঋতি দিদিভাইকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখ ছলছল করছে। রুচি কিন্তু কাঁদল না। শ্রীর সঙ্গে অনেক কথা হলো। কী কী হয়েছে এই ক’বছরে রুচি একে একে শ্রীকে বলতে লাগল। স্কুলেও সে প্রায় একঘরে হয়ে গেছে। সৌরেন্দ্র চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। রুচির সে উপায় নেই। কিন্তু স্কুলে কোনো শিক্ষক তার সঙ্গে কথা বলে না। তার পাশে চেয়ারে বসে না। বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কথা বলে। তার চরিত্র তুলে তাকে অপমান করে। তার সাজগোজ, চাল – চলন, কথাবার্তা সবকিছুই এখন হাসির খোরাক। রুচিকে উদ্দেশ্য করে বলে, দিদিমণির কি রাতে ঘুম হয়নি! চোখের তলায় মনে হচ্ছে কালি পড়ে গেছে! 

অবিশ্যি না হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা একজনকে নিয়েই সামলাতে পারি না। দিদিমণির তো আবার দুজন! 

অন্য একজন তখন বলে, দুজনই যে আপনি জানলেন কি করে! বেশিও তো হতে পারে! সকলকে খুশি করতে গিয়ে হয়তো… কথাটা শেষ না করে সে অন্যজনের দিকে তাকিয়ে চোখ মারে। 

রুচি বসে বসে হজম করে এসব কথা। তবু তাকে স্কুলে যেতেই হয়। না গিয়ে তার উপায় নেই। এখন তো সে একা! মেয়ের দায়িত্বও তার ওপর। তার তো মাঠ ছেড়ে চলে এলে হবে না। 

শ্রী এসব শুনে রুচিকে সাহস জোগায়। বলে তোর বাবা আছে। আমরা আছি। ভয় পাস না রুচি। তুই যে সুস্থ ভাবে চলে আসতে পেরেছিস এই আমরা অনেক মনে করব। 

শ্রী এই প্রথম রাইকে দেখল। রাইয়ের জ্বর এসেছে। কাল খুব ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু শ্রীর সঙ্গে তার ভাব হতে দু মিনিটও লাগল না। রাইয়ের আধো আধো কথায় ও বাড়ির গুমোট ভাবটা একটু হলেও কমল।

পরদিন মাধুরী আর রাইকে নিয়ে রুচি হাজির হলো শ্রীর কাছে। কাকিমা, আমাকে কয়েকটা শাড়ি দাও তো। সবই তো রেখে এসেছি ও বাড়িতে। যতক্ষণ না ফেরত পাচ্ছি…

মাধুরী বলল, দেখো না শ্রী, আমারই তো কত শাড়ি আছে। সেগুলোই পরতে পারত। তা না! শুধু শুধু…

ধুর! মায়ের শাড়িগুলো ভালো না… তাছাড়া…

কেউই ওরা কথা শেষ করতে পারছে না দেখে শ্রীর পুরো ব্যাপারটা বুঝতে একটুও সময় লাগল না। মাধুরীর সব দামি দামি শাড়ি। বিশ্বদেব চায় না সেসব শাড়ি মাধুরী কাউকে পড়তে দিক। শাড়ি বিশ্বদেবের কাছে অ্যাসেট। শ্রীর হাসি পায় এসব শুনে। শাড়ি না কি অ্যাসেট! সেইজন্যই ঋতি একবার স্কুলের একটা ফাংশানের জন্য একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি চাইতে গেলে মাধুরী আলনা থেকে সবথেকে পুরনো ময়লা একটা শাড়ি নামিয়ে দিয়েছিল। ঋতি ওটা আর নিয়ে আসেনি। মনখারাপ হয়েছিল ওর। আর সেই যে যখন শাড়ির ব্যবসা হতো, তখন কালো একটা জামদানি শাড়ি নিয়ে রাতবিরেতে কি অসভ্যতাই না রুচি করেছিল। আজ সেই কাকিমার কাছেই শাড়ি চাইতে আসতে হলো তাহলে! তবে তার কারণটা অন্য। মাধুরীর দামি দামি শাড়ি পরে বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করলে ও শাড়ির আর কিছু থাকবে না। নষ্টই যখন করব, কাকিমার শাড়িই করি – এই হলো ভেতরের কথাটা! যাই হোক শ্রী আলমারিটা খুলে দিয়ে রুচিকেই শাড়ি বেছে নিতে বলল। ওই কটা তো শাড়ি! যা নেবে নিক! 

রুচি অম্লান বদনে শ্রীর দু চারটে যে ভালো শাড়ি আছে সেগুলো বেছে নিয়ে চলে গেল। ওগুলো যে কাকিমার শখের শাড়ি, রোজ ওগুলো পরে যাতায়াত করলে কাকিমার পক্ষে আর ওগুলো কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে পরা সম্ভব হবে না একথা তার একবারও মনে হলো না। 

শ্রী রুচির কাণ্ড দেখে মনে মনে হাসল। মেয়েটা চিরকাল কাকিমাকে শত্রুই ভেবে গেল! 

 

৭২

টুয়ার বাড়িতে অশান্তিটা এখন খানিক অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। অর্জুন দুই ছেলেমেয়ের মা টুয়াকে আজও মারে। তাকে নানাভাবে নির্যাতন করে। শীতকালে গরম জলে স্নান করতে দেয় না। খাবার সময় এমন অশান্তি করে যে টুয়ার আর খাওয়া হয় না। টুয়া কোনোদিনই সামলে চলার মেয়ে নয়। অর্জুন চিৎকার করলে সেও চিৎকার করে। এর মধ্যে এসে পড়ে টুয়ার ছেলে। মাকে বাবা মারলে সেও ব্যাট দিয়ে বাবাকে খানিকটা পিটিয়ে নেয়। বড়ো কোনো সমস্যায় টুয়ার ছেলের কথা বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।মেয়েটা ছোটো থেকেই ঝগড়াঝাটিকে ভয় পায়। কান্নাকাটি করে। শ্রীকে ছুটে যেতে হয়। রাগের মাথায় শ্রীও অর্জুনকে একদিন চড় মেরে দিয়েছিল। তাতে অর্জুনের কতটা লেগেছে শ্রী জানে না। কিন্তু শ্রীর ডানহাতের কড়ে আঙুলটা ভেঙে গেছে। তার অবশ্য কোনো চিকিৎসা হয়নি। আঙুলটা চিরকালের মতো বেঁকে গেছে। 

এই যখন পরিস্থিতি তখন এসে উপস্থিত হয়েছে মৃন্ময়ী আর চঞ্চল। ওরা শেষপর্যন্ত সোদপুরে ফ্ল্যাট কিনেছে। টুয়া ওদের ফ্ল্যাট পছন্দ করে দেওয়া থেকে ফ্ল্যাট সাজিয়ে দেওয়া সবটাই করেছে। টুয়া দেখেছে চঞ্চলদা ব্রিফ কেস ভর্তি করে করে টাকা আনে। সবটাই ব্ল্যাক মানি। সবটা ব্যাঙ্কে নিজের নামে রাখা যায় না। আত্মীয় স্বজনের নামে নামে রাখে। চঞ্চল টাকা ইনভেস্ট করতে চায় কোনো সাইড বিজনেসে। সেই নিয়ে আলোচনা হয়। টুয়াই বুদ্ধি দেয়। চঞ্চলদা, সোদপুরে কোথাও হলদিরামসের কোনো দোকান নেই। তুমি হলদিরামের ফ্র্যাঞ্চাইজি নেবে? এখানে খুব ভালো চলবে। চঞ্চলের এ প্রস্তাব পছন্দ হয়। তবু মৃন্ময়ীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে চঞ্চল নেমে পড়ে। টুয়াকেও সঙ্গে নেয়। টুয়াকে চঞ্চল ল্যাংটো বয়স থেকে চেনে। ছটফটে, সুন্দর, করিৎকর্মা এই মেয়েটাকে চঞ্চল স্নেহ করে। আর এখন তো ওর ওপর মায়া পড়ে গেছে। প্রায় দিনই টুয়া কাঁদতে কাঁদতে চঞ্চলদার কাছেই আসে। অর্জুন মারধোর করেছে। জানায়। মৃন্ময়ী আর চঞ্চল ওকে যত্ন করে খাওয়ায়। ওর দুঃখে চঞ্চলের প্রাণ কাঁদে। এতো ভালো মেয়েটা এভাবে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। তাই টুয়া যখন বলে তুমি হলদিরামের দোকানটা খোলো। আমি সব সামলে দেব। তুমি আমাকে মাস মাইনে দিয়ে রাখবে? টুয়ার প্রশ্ন শুনে চঞ্চলের চোখে জল এসে গেছিল। চঞ্চল সব দায়িত্ব টুয়াকে দিল। টুয়া ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে দশটার মধ্যে দোকানে চলে আসে। দুটো অবধি দোকান সামলে বাড়ি ফেরে। বেশিরভাগ দিনই চঞ্চল ওকে বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে আসে। ফাঁকা ফ্ল্যাটে এক একদিন চঞ্চলের ইচ্ছে করে টুয়াকে একবার জড়িয়ে ধরে। টুয়ারও মনে হয় তার জীবনটা কি শেষপর্যন্ত মার খেতে খেতেই শেষ হয়ে যাবে! হ্যাঁ, অর্জুন তাকে অনেক দিয়েছে। শাড়ি, গয়না, বেড়াতে যাওয়া কোনোটা বাদ রাখেনি। কিন্তু প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অশান্তি করেছে সামান্য সামান্য ব্যাপার নিয়ে। মারধোর করেছে। এইভাবে কি জীবন কাটানো সম্ভব? দিদি, বাবু কেউই তো তার দায়িত্ব নিতে পারল না। টুয়া ভাবে একমাত্র চঞ্চলদাই পারে তাকে এই নরক থেকে মুক্তি দিতে। চঞ্চলদার হাতটা শক্ত করে ধরতে পারলে আর কোনো কষ্ট টুয়াকে ছুঁতে পারবে না। চঞ্চলদার অনেক টাকা। এইসব ভাবতে ভাবতেই একদিন দুপুরে চঞ্চলের কাছে নিজেকে মেলে ধরল টুয়া। চঞ্চল এতোটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেলে যেমন মরিয়া হয়ে ওঠে, চঞ্চলও তেমনই মরিয়া হয়ে উঠল। আর অর্জুনের সঙ্গে টুয়াকে ভাগ করে নিতে তার মন চাইল না। এবার তার টুয়াকে নিজের করে পেতে হবে। নিজের কাছাকাছি রাখতে হবে। এই নরকে আর নয়। 

চঞ্চল আর টুয়া সোদপুরেই ফ্ল্যাট দেখতে শুরু করল। সকলকে জানানো হলো শ্রীর বাপী ফ্ল্যাট কিনছে। সেই মতো বাপী মাকেও বোঝানো হলো। বাপীর বয়স আরো খানিকটা বেড়েছে। ভাড়া বাড়িতে থাকাটাকেই ভবিতব্য মনে করেছিলেন। কিন্তু চঞ্চল খুব ভালো ছেলে। বিপদে আপদে, অসুস্থতার সময়ে সর্বক্ষণ টুয়া আর শ্রীর পাশে থেকেছে। নিজের জামাইরা তো আর কেউ দেখল না। চঞ্চল তবু পাশে আছে। বাপী রাজি হয়ে গেল। চঞ্চল দামি দামি সেগুন কাঠের আসবাবপত্র দিয়ে ফ্ল্যাট সাজিয়ে দিল।বাপী মা কাকু সবাই থাকতে শুরু করল। টুয়াও সুযোগ বুঝে চলে আসবে। কিন্তু বেঁকে বসল টুয়ার মেয়ে। সে তার বন্ধুদের ছেড়ে, তার স্কুল ছেড়ে এখানে থাকতে আসবে না। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন অশান্তি চলল। ওদিকে অর্জুনও চঞ্চলের সঙ্গে টুয়ার একটা সম্পর্কের আঁচ পেয়ে মারধোর করা আরো বাড়িয়ে দিল। শেষপর্যন্ত টুয়ার মেয়ে পুরনো স্কুলেই পড়বে, সোদপুর থেকে দমদম যাতায়াত করবে এই শর্তে টুয়া পার্মানেন্টলি চলে এলো সোদপুরে। ছেলে রয়ে গেল অর্জুনের কাছে। টুয়াই তাকে বলল, নইলে তোর বাবার ফ্ল্যাটটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। অর্জুন তো বহুদিন হলো চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেকে পড়ানোর ক্ষমতা তার নেই। উপরন্তু বাড়িতে কাবুলিওয়ালা হানা দেয়। খুনের হুমকি দেয়। টুয়ার ছেলে উপায়ান্তর না দেখে টিউশন করতে শুরু করল। সায়েন্স নিয়ে সে আইএসসি পাশ করেছে। ফলে স্টুডেন্ট পেতে তার অসুবিধে হলো না। সেইসঙ্গে সে টিউশনির টাকা দিয়েই কলেজে ভর্তি হলো। স্কুলবেলা থেকেই তার একজন প্রিয় বান্ধবী আছে। খানিকটা তাকে দেখে, খানিকটা তার বাবা মায়ের উদ্যোগে টুয়ার ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল। আর টুয়া এতো বছর পর আকাশে ডানা মেলল। চঞ্চলদা তার প্রেমিক। কোনো জিনিস চাওয়ার আগেই চঞ্চল এনে হাজির করে। পোশাক আশাক, গয়নাগাটি, বেড়াতে যাওয়া কোনোকিছুরই অভাব নেই। এতোদিন পর স্বাধীনতা পেয়ে টুয়া ধরাকে সরা জ্ঞান করল। বৈভব তার উপচে পড়তে লাগল। কিন্তু দীর্ঘদিন খাঁচা বন্দি পাখি যেমন আকাশে উড়লে হাওয়ার গতি বুঝতে পারে না টুয়ারও সেই অবস্থাই হলো। তার পায়ের তলার মাটিটা যে আর শক্ত নেই সেকথা তার মনে হলো না। চঞ্চলের টাকায় সে যেন গোটা দুনিয়াটাই জয় করে ফেলবে! সে এবার তার পুরনো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ করতে শুরু করল। তাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ পুরুষ বন্ধুর একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ সে। তাদের সঙ্গে তার বেড়াতে যাওয়া, পার্টি করা নানাকিছু এগেঞ্জমেন্ট থাকতে শুরু করল। বাড়িতে তার মন টেকে না। দোকানের কাজটাও তার সেকেন্ডারি ইমপর্টেন্স হয়ে দাঁড়াল। চঞ্চল প্রথম প্রথম মেনে নিচ্ছিল। কিন্তু এতো পুরুষ বন্ধু ও তাদের সঙ্গে টুয়ার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা চঞ্চলের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হলো না। সে বাধা দিতে চাইল। তাতে টুয়া দমে না গিয়ে আরো দ্বিগুণ হয়ে উঠল। শুরু হলো অশান্তি।

 

৭৩

ওদিকে শ্রীর সংসার আর চলছে না। বিজু বিশ্বদেবের হাত দিয়ে যে আড়াই হাজার টাকা পাঠায় ওটুকুই সম্বল শ্রীদের। ঋতি যে টিউশনগুলো করে তার টাকায় ওর পড়াশোনাটা কোনোরকমে চলছে। সারাদিন ইউনির্ভাসিটিতে ক্লাস করে, নিজের পড়াশোনা সামলে খুব বেশি টিউশনিও তো ও করতে পারে না। বিজু অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু ঋতির পড়াশোনা বাবদ একবারই টাকা পাঠিয়েছিল। তাতে ঋতি পার্ট টুতে ভর্তি হতে পেরেছে। বইপত্র কেনাও সম্ভব হয়নি। ঋতি টিউশনির টাকা দিয়ে বাকিটা সামলাচ্ছে। ইতিমধ্যে ঋতির পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরোলো। ঋতি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। স্যার, ম্যাডামরা তার খুবই প্রশংসা করল। সেইসঙ্গে একথাও বলল, পার্ট টুতে এই রেজাল্ট ধরে রাখতে হবে। ঋতি আপ্রাণ সেই চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু তার জন্য এখনো কয়েকটা মাস বাকি। সংসার যে আর চলছে না। অনন্ত এই দেড় বছরে কিছুই করে উঠতে পারেনি। খুব যে সে চেষ্টা করেছে তাও নয়। সে যেন হার মেনে নিয়েছে ভাগ্যের কাছে। তার অকারণ জেলখাটা জীবন! তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা কর্মজীবন – এসব তাকে ক্রমশ পেছনে টানছে। তার এখন একটাই অপেক্ষা। ঋতি কবে চাকরি পাবে। রুচি তো তেমন ভালো করে পড়াশোনা করেনি। তবু ও এস এস সি তে চাকরি পেয়ে গেল। ঋতি সেখানে এতো ভালো পড়াশোনায়। ওর কাছে চাকরি পাওয়াটা কোনো ব্যাপার হবে না। ঋতি চাকরি পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনন্ত যে এসব কথা শুধু নিজে ভাবত তা নয়, ঋতিকেও বলত। শুনতে শুনতে ঋতির মুখটা কালো হয়ে যেত।তার চাকরি পাওয়ার ওপর এই পুরো পরিবারটা দাঁড়িয়ে আছে। সে পারবে তো এদের আশা ভরসা পূরণ করতে! ঋতি আরো পাগলামি আরম্ভ করত পড়াশোনা নিয়ে। দিনরাত সে পড়ে চলেছে। কতটা বেশি জানা যায়! আরো কত ভালো লেখা যায়! লাইব্রেরি থেকে কবে কোন্ বইটা তুলে আনবে! যে বই পাওয়া যাচ্ছে না সেটা কীভাবে জোগাড় করবে! এই ছিল ঋতির সারাদিনের ভাবনা। আর এসব ভাবতে ভাবতে যখন তার চোখ জ্বালা করে ঘুম পেত তখন বিছানায় পিঠটা ঠেকিয়ে চোখ বুজলেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠত স্নেহময়দার মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। ঘুমতে পারত না ঋতি। কতগুলো প্রশ্ন যেন তাকে তাড়া করে ফিরছে। সারারাত পাগলের মতো কাঁদত ঋতি। পরদিন চোখদুটো ফুলে যেত। অসুস্থ মনে হতো ঋতিকে দেখে।  তাই নিয়েই ঋতি ছুটত ইউনিভার্সিটিতে। 

শ্রী কিন্তু বুঝতে পারছিল মেয়েটার ওপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে ফেলছে অনন্ত। হয়তো নিজের অজান্তেই। মেয়েটা কেমন পাগল পাগল করছে। ওর পাশে থাকতে হবে। কিন্তু শ্রী কি করতে পারে! কি ক্ষমতা আছে ওর! এই পরিস্থিতিতে টুয়াই কিন্তু দিদির জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করল। টুয়া হলদিরামের দোকানটা সকালবেলাটা সামলায়। বিকেলে কর্মচারীটা ছাড়া আর কেউ থাকে না। মালিক পক্ষের কেউ না থাকার সুযোগ নিয়ে ও টাকা সরাচ্ছে। মালের হিসেব মিলছে না। টুয়াই চঞ্চলদাকে বলল, বিকেলবেলাটা দিদিকে বসতে বলবে দোকানে। তাহলে অন্তত একটা হিসেব থাকবে। চঞ্চল রাজি হলো। শ্রী যেন হাতে স্বর্গ পেল। দু হাজার টাকা। তাই বা কম কি সে। তার সংসারে একটু তো সুরাহা হবে! কিন্তু বেঁকে বসল ঋতি। মা এতদিন বাড়িতে যা করেছে করেছে, রোজ রোজ ট্রেনে যাতায়াত করে মার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। মার শরীর ভালো নয়। আর তাছাড়া এতো দূরের আত্মীয়! তার বদান্যতা নেব কেন! 

বদান্যতা কেন বলছিস ঋতি! কাজ করে টাকা পাব! 

না, আত্মীয়ের দোকানের কর্মচারী এটা কি খুব সম্মানের হবে আমাদের পক্ষে! 

সৎ পথের কোনো কাজেই অসম্মানের কিছু নেই ঋতি! 

না, তুমি যাবে না। ঋতি চেঁচিয়ে ওঠে। পরক্ষণেই কাকুতি মিনতি করে বলতে থাকে, মা আর কটা মাস। একটু কষ্ট করে নাও। আমি এম এ টা পাশ করেই কিছু না কিছু পেয়ে যাবই। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি মা। আমার কথাটা একবার শোনো! 

শ্রী চুপ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না। 

ঋতি মায়ের চুপ করে থাকা দেখে আরো খানিকটা খেপে যায়। এবার তার রাগটা গিয়ে পড়ে অনন্তর ওপর। তুমি কি করে এটা হতে দিচ্ছ বাবা! মা এই বয়সে বাইরে কাজ করতে যাবে! তুমি তোমার অপদার্থতা কীভাবে মায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ বুঝতে পারছ! 

অনন্ত চুপ। 

ঋতি আরো চেঁচাতে থাকে। তুমি বিয়ে করেছিলে কেন বাবা! মায়ের জীবনটা এভাবে নষ্ট করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে! 

তাতেও অনন্ত চুপ। বসে বসে বিড়ি টেনে চলেছে। ঋতি আর সহ্য করতে পারে না। মাটিতে বসে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। 

পরদিন থেকে শ্রী হলদিরামে বসতে শুরু করে। 

ঋতি কদিন মায়ের সঙ্গে কথা বলছে না। ভালো করে খাচ্ছে না। ঘুমোচ্ছে না। শ্রী সব বুঝতে পারছে। কিন্তু ঋতিকে কিছুই বোঝাতে যাচ্ছে না। থাক, ও নিজেই ঠিক বুঝতে পারবে। এখন হাজার বোঝাতে চাইলেও ঋতি শুনবে না। 

ঋতি কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুমরোচ্ছিল। বুঝতে পারছিল মা বাবা কাউকেই কোনো কথা বলে লাভ হবে না। কিন্তু জ্যেঠু আছে তো! জ্যেঠু তো তাদের বাড়ির কর্তা, অভিভাবক। ছোটো থেকে ঋতি জেনে এসেছে জ্যেঠুর সিদ্ধান্তই এ বাড়িতে শেষ কথা। জ্যেঠুর সঙ্গেই কথা বলবে ঋতি। বিকেলে ঋতি হাজির হলো জ্যেঠুর বাড়িতে। জ্যেঠুকে সব কথা খুলে বলল। ঋতির আশা জ্যেঠু তো অবশ্যই মাকে বাইরে কাজে বেরোতে বারণ করবে। আর মা সেটা শুনতে বাধ্য হবে। 

বিশ্বদেব বলল, ঋতি, তোর মা বিয়ের পর থেকে এমন একদিনও যায়নি যেদিন এ বাড়িতে অশান্তি করেনি। বাপের বাড়ি নিয়ে অশান্তি, বাড়ির কাজকম্ম করা নিয়ে অশান্তি, রুচিকে নিয়ে অশান্তি! এমন হেন কিছু নেই যে তোর মা যা নিয়ে ঝামেলা, ঝগড়া করেনি। এগুলো প্রচণ্ড এফেক্ট করেছে তোর বাবাকে। সারাজীবন তোর বাবা কোনোদিন শান্তি পায়নি। 

এই অবধি শুনেই ঋতি বুঝতে পেরেছে জ্যেঠু কি বলতে চলেছে। ঋতির আর বাকি কথা শোনার প্রবৃত্তি হচ্ছিল না। কিন্তু জ্যেঠুর সামনে থেকে তো ওভাবে উঠে আসা যায় না। তাই বসে আছে। একে একে সেখানে জড়ো হয়েছে রুচি, রুশি। মাধুরী বিশ্বদেবের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বদেবের কথা শুনছে। 

বিশ্বদেব আবার বলতে শুরু করল, প্রত্যেকটি পুরুষের উন্নতির পেছনে একজন নারীর ভূমিকা থাকে। তোর বম্মা না থাকলে আমি এতো কিছু করতে পারতাম! তোর বম্মা আমাকে সাপোর্ট করেছে বলেই না পেরেছি। ওদিকে বিজু আর সম্পূর্ণাকে দেখ! ওরা বম্বের মতো জায়গায় কত কষ্ট করে আজ দেড়শো কোটির মালিক হতে পেরেছে। তুই বলতে পারবি তোর মা এমন কি করেছে তোর বাবার জন্য! 

ঋতি ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিল। তবু ভদ্রতা বজায় রেখেই বলল, তুমি আর বিজু আজ এই পজিশনে পৌঁছেছ কারণ তোমরা হার্ড ওয়ার্ক করেছ বলে! তাতে বম্মা বা ছোটো কাকিমার আলাদা কোনো অবদান নেই। তারা যেটুকু কষ্ট করেছে তার চারগুণ ফেরৎ পেয়েছে। আমার বাবা একে তো জেলখাটা আসামী। তারওপর অকর্মণ্য। তাই তার দ্বারা জীবনে কিছু হয়নি। আর নারীর অনুপ্রেরণার কথা বলছ! এ বাড়ির কাপড়ের ব্যবসা থেকে ও বাড়ির উলের ব্যবসা – কোনটা মা করেনি। মায়ের জন্যই তোমার শাড়ির ব্যবসা অতো ভালো চলেছিল। মা চলে যাওয়ার পর তুমি আর বম্মা ব্যবসা চালাতে পারনি। বাবার মিল বন্ধের সময়টা মা যোগাযোগ করিয়ে না দিলে বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল উলের চাদরের ব্যবসাটা করা! ঘোষাল বাড়ির আর কোনো বউকে কোনোদিন এতো পরিশ্রম করতে হয়েছে, এতো লড়াই করতে হয়েছে যতটা আমার মাকে করতে হচ্ছে! অথচ মায়ের গুণ কি কম! সেলাই ফোঁড়াই থেকে রান্না কোনটায় মার খামতি আছে! মা একটু ভালো থাকা ডিসার্ভ করে না! কিন্তু ঘোষাল বাড়ির কারো পক্ষেই সম্ভব হলো না আমার মাকে তার যোগ্য সম্মান দেয়! এটা আসলে ঘোষাল বাড়ির লজ্জা। আমাদের সকলের লজ্জা। বলতে বলতে ঋতির গলা কেঁপে গেল।

মাধুরী বিশ্বদেবের চেয়ারের পেছন থেকে অনেকক্ষণ ধরেই হাত নেড়ে ইশারা করে ঋতিকে থামতে বলছে। রুচি, রুশি দুজনেই বারবার বলছে ঋতি চুপ কর। বাবার শরীর ভালো না। চুপ কর। কিন্তু আজ ঋতি কিছুতেই নিজের ক্ষোভটাকে দমিয়ে ফেলতে পারল না। এই কথাগুলো তার অনেকদিন থেকেই মনে হয়েছে। কোনোদিন কাউকে বলেনি। আজ জ্যেঠুর কথাগুলো শুনে আর চুপ করে থাকতে পারল না।

বিশ্বদেব ঋতির কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। উঠে ঘরে চলে গেল।

ঋতিও আর দাঁড়াল না। বেরিয়ে এলো ও বাড়ি থেকে।

 

৭৪

একটা প্রচণ্ড মানসিক টানাপোড়েন চলতে চলতেই ঋতির পরীক্ষা এসে গেল। শেষ যেদিন ক্লাস ছিল সবাই সবাইকে গুড লাক উইশ করছিল। ঋতিও সবার সঙ্গে কথা বলছিল। কেকা সবার সামনেই ঋতিকে বলল, ঋতি, তোর ফোন নম্বরটা দে তো! কোথাও আটকে গেলে ফোন করব।

আমার ফোন নেই রে।

না না, মোবাইলের কথা বলছি না। ল্যান্ডলাইনের নম্বরটা দে। 

ঋতি গলা নামিয়ে বলল, আমাদের বাড়িতে ফোন নেই।

কেকা মুখটা হাঁ করে বলল, ল্যান্ড লাইনটাও নেই! 

কেকার বলার ধরন আর মুখভঙ্গি দেখে কয়েকজন হেসে ফেলল। 

ঋতি মাথাটা নিচু করে নিল। বাড়ি ফেরার পথে ঋতির মনে পড়ল এর আগেও একদিন কেকা ঋতিকে অপমান করেছিল। সেদিন সব বন্ধুরা মিলে খেতে যাবে ঠিক করেছিল। ঋতি না বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। কবিতা ওকে জোড় করে আটকে দিল। ফাইনালি যখন ওরা রেস্টুরেন্টে ঢুকছে তখন কেকা ঋতির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুই ভালো করে ভেবে এসেছিস তো এখানে? টাকা আছে তো তোর কাছে? নিজের ভাগেরটা দিতে পারবি তো! 

ঋতির কানদুটো গরম হয়ে উঠেছিল। ঋতি কোনো উত্তর দিতে পারেনি। শুধু আস্তে করে মাথা নেড়েছিল। আজও ঋতি কোনো উত্তর দিতে পারল না। কেকার নিজের দরকারেই কেকা ফোন নম্বরটা চাইছিল। তারপর এই অপমানের কি খুব প্রয়োজন ছিল! ঋতিকে শ্রী শিখিয়েছে কেউ অপমান করলে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে যেও না। নিজের কাজটা মন দিয়ে করে যাও। একদিন না একদিন সে নিজেই নিজের অপমানের উত্তর পেয়ে যাবে। ঋতির মনে হলো চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করতে হবে তাকে। কোনো দ্বিতীয় অপশন নেই তার কাছে। এভাবেই উত্তর দেওয়া হবে। 

 কিন্তু প্রথম পরীক্ষাটা দিয়ে এসে ঠিক আগেরবারের মতোই ঋতির জ্বর এলো। ইদানিং ঋতি বাড়িতে কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলছিল না। জ্বরের কথাও সে কাউকে জানাল না। পুরনো প্রেসক্রিপশন বের করে নিজেই ওষুধ কিনতে যাচ্ছিল। অনন্ত আটকালো। শ্রী বাড়িতে নেই। কাজে গেছে। ঋতি এখন কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ঋতির হাতে প্রেসক্রিপশন দেখে অনন্ত অবাক হলো। গায়ে হাত দিয়ে দেখল ঋতির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ঋতির হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা কেড়ে নিয়ে অনন্ত ওষুধ এনে দিল। ঋতি অসুস্থ শরীরে বাকি পরীক্ষাগুলো দিল। 

পরীক্ষা শেষ হতেই ঋতি নানা জায়গায় যোগাযোগ করে বেশ কয়েকটা টিউশন করতে শুরু করল। রেজাল্ট বেরোতে দুমাস সময় লাগবে। ততক্ষণ চুপ করে বসে থাকা যাবে না! এই দুমাস ঋতি মনে মনে খুবই অস্থির হয়ে আছে। রেজাল্ট বেরোলেই তাকে একটা চাকরি খুঁজতে হবে। এই দুবছরে ঋতি কিন্তু আরো খানিকটা উচ্চাশা করে ফেলেছে। তবে কেবলই নিজের ভাবনা চিন্তার জোরে নয়। ঋতির পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরোনোর পর ঋতি সব স্যার, ম্যাডামদের কাছেই মার্কশিট নিয়ে দেখিয়েছে। অধ্যাপক চ্যাটার্জী ঋতির রেজাল্ট দেখে একটিও প্রশ্ন না করেই বলেছে, তোমার পাশে বসে ওই যে ফর্সা করে মেয়েটি, ওর রেজাল্ট কেমন হয়েছে? 

কবিতার কথা বলছেন স্যার? 

হ্যাঁ হ্যাঁ, কবিতা। ওর কত নম্বর হয়েছে? 

ও পঞ্চান্ন শতাংশ নম্বর পেয়েছে। 

আচ্ছা। অধ্যাপক চ্যাটার্জী ঋতির হাতে মার্কশিটটা ফেরৎ দিয়ে দিয়েছেন। ঋতি বুঝেছে, তার নম্বর নিয়ে অধ্যাপক চ্যাটার্জীর কোনো মাথাব্যথা নেই। সে কালো, অসুন্দর। কবিতা ফর্সা, কবিতা সুন্দর। তাই ওর নম্বর নিয়ে খোঁজ খবর করলেন। 

অথচ ঋতি যখন অধ্যাপক দে’র কাছে গেল, তিনি ভালো করে ঋতির মার্কশিট দেখে জিজ্ঞেস করলেন ফাইনালটা ভালো করে দাও। 

হ্যাঁ স্যার।

তারপর কি করবে ভাবছ? 

স্যার, চাকরি করব। এস এস সি দেব। 

ঋতি, তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার মধ্যে কিন্তু কলেজে পড়াবার পোটেনশিয়ালিটি আছে। তুমি নেট পরীক্ষা দেবে না? 

নেট? ঋতি একটু থমকায়। 

হ্যাঁ নেট। কলেজের জন্য চেষ্টা করো ঋতি। একটু হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু যদি ডিটার্মিনেশন থাকে, নিশ্চয়ই পারবে। 

ঋতির চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল স্যারের কথা শুনে। সে কলেজে পড়াবে। সেই যোগ্যতা তার আছে! স্যার এর আগেও একবার একথা বলেছিলেন। ঋতি ভেবেছিল তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য স্যার এমন বলছেন। কিন্তু আজও যখন স্যার একই কথা বললেন তখন ঋতি বিষয়টা নিয়ে না ভেবে পারল না। কলেজে পড়ানোর ভূতটা ঋতির মাথায় তখন থেকেই চেপেছে। ফলে রেজাল্টের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ঋতি। 

যেদিন রেজাল্ট বেরোলো ঋতি দেখল সে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। সাড়ে পাঁচশ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আটজন ফার্স্ট ক্লাস। তারা বেশিরভাগই কলকাতার নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল। এরা অনার্সেও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। এম এ তেও পেল। ঋতি ৫৮.৮৭% নম্বর পেয়েছে। ঋতি খানিকক্ষণ চুপচাপ লিস্টটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। তার মনে পড়ল নাইনথ পেপারের কথা। ওই পেপারটাতেই ঋতি কোনোদিন নম্বর পেল না। একটা বাঁকা হাসি ঋতির ঠোঁটে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। মার্কশিট পেয়ে ঋতি দেখল একটি পেপারে তার অস্বাভাবিক ভাবে কম নম্বর এসেছে। ওই পেপারটা পড়ান অধ্যাপক ব্যানার্জি। ঋতি ওঁর কাছে মার্কশিটটা দেখাল। উনি বাকি পেপারের নম্বর দেখে বললেন, আমার পেপারটা তুই ভালো করে পড়িসনি বুঝলি! তাই এতো কম পেয়েছিস! বলে অদ্ভুত হাসলেন। ঋতির তখন বুঝতে বাকি নেই আর কিছু। এইসব অধ্যাপকরা নিজেদের পছন্দের ছাত্রদের বেশি করে নম্বর দেন। পছন্দের ছাত্র কেবল ভালো পড়াশোনা করলেই হয় না। তার অন্য ক্রাইটিরিয়া আছে। অন্য যোগাযোগ আছে। সেসব ঋতি কোনোদিনই করেনি। তাই ইচ্ছে করে একটা পেপারে নম্বর কমিয়ে দিয়ে তার ফার্স্ট ক্লাসটা আটকে দেওয়া হলো। কিন্তু ঋতির এখন কি করা উচিত! ফার্স্ট ক্লাস পাইনি বলে হাহুতাশ করার সময় তার আছে! তাকে তো চাকরি পেতে হবে। ঋতি পরদিনই সকালবেলা প্রায় পনেরোটা অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর আশেপাশে যতগুলো কলেজ আছে সব জায়গায় ফোর্স অ্যাপ্লিকেশন দেবে পার্ট টাইম লেকচারারের জন্য। অনন্ত ওর সঙ্গে গেল। সারাদিন ধরে ঋতি আর অনন্ত প্রায় বারোটা কলেজ ঘুরল। কোথাও অ্যাপ্লিকেশন জমা নিল। কোথাও বলা হলো অ্যাডভার্টাইসমেন্ট বেরোলে অ্যাপ্লাই করো। একজন প্রিন্সিপাল স্যার জানালেন এ মাসেই তাঁর কলেজে পার্ট টাইম লেকচারারের জন্য অ্যাডভার্টাইসমেন্ট বেরোবে। সামনের মাসের শুরুতে ইন্টারভিউ। ঋতি এসব শুনে অনেকটা আশা নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপর কাগজে অ্যাড দেখে অ্যাপ্লাই করে নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউ দিতে গেল। অনন্তও এসেছে ওর সঙ্গে। একজন বয়স্ক অধ্যাপক এসেছেন ইন্টারভিউ নিতে। তিনি প্রথমেই ঋতিকে ছন্দ, অলংকার নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। ঋতি ছন্দ, অলংকার খুবই পছন্দ করে। ওর এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে কোনো অসুবিধেই হলো না। তারপর তিনি রসপ্রস্থান বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করলেন। ঋতির এগুলো তৈরি আছে। ঋতি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল। অধ্যাপক তখন আরেকজন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে। 

অধ্যাপিকা ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি তো গত মাসেই এম এ পাশ করেছ দেখছি। বয়স খুবই অল্প। তুমি ক্লাস ম্যানেজ করতে পারবে? 

আমি চেষ্টা করব ম্যাম। 

এখানে কিন্তু চুড়িদার পরে আসা যাবে না। শাড়ি পরে আসতে হবে। পারবে? 

হ্যাঁ ম্যাম, পারব। 

ঋতি বেরিয়ে এলো। কিছু ফর্মালিটিস কমপ্লিট করে যতক্ষণে ও অনন্তর কাছে পৌছোলো ততক্ষণে অনন্ত উত্তেজনায় ফুটছে। রুতু, জানিস এখানে অনেকেই কি বলছে?

ঋতি কথাটা বুঝতে পারেনি। বাবা কেন এতো উত্তেজিত তাও ঋতি বুঝতে পারছে না। 

তোর ইন্টারভিউ খুব ভালো হয়েছে রুতু? 

হ্যাঁ, ভালো হয়েছে। 

এখানে সবাই বলছে তোরই চাকরিটা হবে। তোকেই নেবে। তুই দারুণ ইন্টারভিউ দিয়েছিস। 

ঋতি বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। এরম আবার বলে দেওয়া যায় না কি! কত ক্যান্ডিডেট এসেছে এখানে! আরো অনেকেই নিশ্চয়ই ভালো ইন্টারভিউ দিয়েছে!

কিন্তু অনন্তর কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো। একসপ্তাহ পর ঋতির বাড়িতে চিঠি এলো। ঋতি সিলেক্টেড। 

 

৭৫

ঋতি যে উচ্চাশা মনে মনে পোষণ করছে সেকথা সে কাউকেই জানতে দেয়নি। গোপীচন্দ্রদাস কলেজে তার চাকরি পাওয়াটা তার সেই উচ্চাশাকে অনেকটাই এগিয়ে দিল। প্রথমদিন কলেজে জয়েন করে ঋতি দেখল যে ম্যাডাম ইন্টারভিউ নিতে বসেছিলেন তিনিই এখানে বাংলা বিভাগের প্রধান। তিনি ঋতিকে সিলেবাসের কোন্ কোন্ অংশ পড়াতে হবে বলে দিলেন। ঋতি দেখল সেখানে ছন্দ, অলংকার আছে, রসতত্ত্ব আছে, পুতুল নাচের ইতিকথা আছে… আরো বেশ কিছু। অনার্সের ক্লাসই তাকে বেশি দেওয়া হয়েছে। বিভাগের অপর একজন অধ্যাপকের সঙ্গেও তার আলাপ হলো। অধ্যাপক হোসেন। এই স্টাফরুমে ঋতিই বয়সে সবচেয়ে ছোটো। সেই নিয়ে সকলেই নানা কথা বললেন। যিনি ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন তাকে ঋতি আগে থেকে চেনে কি না জিজ্ঞেস করলেন একজন অধ্যাপক। তপতী ম্যাডাম তখন নিজে থেকেই বলে উঠলেন, ও দুর্দান্ত ইন্টারভিউ দিয়েছিল। আমি ছিলাম। আমি দেখেছি। ঋতির অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না এরা কি বোঝাতে চাইছে। কিন্তু ঋতি সে নিয়ে মাথা ঘামালো না। যেটা ঋতিকে চিন্তায় ফেলল তা হলো তার ডেসিগনেশন। এখানে অ্যাডভার্টাইসমেন্ট বেরিয়েছিল পার্ট টাইম লেকচারার পোস্টের জন্য। অথচ এখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে লেখা আছে গেস্ট লেকচারার। তপতী ম্যাডাম বললেন, তোমাকে ক্লাস বেসিসে টাকা দেওয়া হবে। পার ক্লাস ষাট টাকা। ঋতি হিসেব করে দেখল সবদিন ক্লাস হলে ঋতি চারহাজার টাকা মতো পাবে। বাবা যখন মিল থেকে রিটায়ার করেছিল তখন এই টাকা মাইনে পেত। মা দুহাজার টাকা পায়। এতোদিন আড়াই হাজার টাকায় তাদের সংসার চলে এসেছে। চার হাজার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। এবার তবে ঋতি মার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে। মাকে বলবে সে তার কথা রেখেছে। মা আর ওই দোকানের চাকরিটা করবে না। 

শ্রী কিন্তু একথায় একেবারেই রাজি হলো না। না বাবু, তোর ওপর এতো চাপ আমি দিতে পারব না। তুই চাকরি পেয়েছিস – খুব ভালো কথা। কিন্তু এটা পার্মানেন্ট চাকরি নয়। পার্মানেন্ট চাকরি পেতে হলে তোকে এখনো অনেক পড়াশোনা করতে হবে। আরো এগোতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। এখন থেকে সংসারের জোয়াল আমি তোর কাঁধে চাপাতে পারব না। 

শ্রী বললেও ঋতির কাঁধে সংসারের ভার ঠিকই এসে পড়ল। ঋতি চাকরি পেয়েছে খবর পেয়ে বিজু টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিল। অবশ্য বিজু বন্ধ করল না কি বিশ্বদেব নিজের টাকা থেকে ভাগ দেওয়া বন্ধ করে দিল তা পরিষ্কার হলো না। ঋতি আর শ্রী মিলে সংসার চালাতে শুরু করল। 

সেদিন বিকেলে শ্রী বেরিয়ে গেছে। অনন্ত ঋতির সঙ্গে কথা বলতে বসল। রুতু এবার কি করবি ভাবছিস? 

ঋতি বলল, নেট পরীক্ষা দেব। 

সেটা দিয়ে কি হবে? 

কলেজ সার্ভিস কমিশনে চাকরি পাওয়া যাবে। 

কলেজে? অনন্ত একবার ঢোক গিলল। ঠিক আছে। তুই কলেজের জন্য চেষ্টা করতে চাইছিস যখন সেটা কর। কিন্তু তার মধ্যে মধ্যে এস এস সি টা দে। দ্যাখ দিদিভাই কি সুন্দর চাকরি পেয়ে গেছে। তুই তো আরো সহজে পেয়ে যাবি। 

ঋতি ইতিমধ্যেই এস এস সি, সি এস সি এসব নিয়ে নানা খোঁজখবর করেছে। সিনিয়র দাদা দিদিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সে বলল, বাবা এস এস সি তে এখন বি এড ছাড়া চাকরি হচ্ছে না পিজি লেবেলে। 

তাহলে তুই বি এডটা কর।

সরকারি জায়গায় বি এডে চান্স পাওয়া খুব কঠিন। আর তাছাড়া সেখানে রেগুলার ক্লাস করতে হয়। চাকরিটা তাহলে করব কি করে। 

আর বেসরকারি? 

বেসরকারিতে বি এড করতে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। কোথা থেকে আসবে! আর তাছাড়া সেখানেও তো রেগুলার ক্লাস করতে হবে। চাকরিটার কি হবে! 

তুই তাহলে একটা কাজ কর পিজি স্কেলের জন্য পরীক্ষা না দিয়ে পাশ স্কেলে পরীক্ষা দে। 

কেন বাবা! আমি এম এ পাশ করে নিচু স্কেলের জন্য পরীক্ষা দেব কেন! আর সেখানে তো মাইনেও কম। 

না না, তুই বুঝতে পারছিস না। এখন তুই নিচু স্কেলে ঢুকে যা। তারপর বি এড করে পিজি স্কেলে পরীক্ষা দিবি। 

আর আমার কলেজে পড়ানোর কি হবে! 

তার জন্য তো তুই পরেও চেষ্টা করতে পারবি। 

না বাবা! একবার একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকে গেলে তারপর সুইচ ওভার করা খুব কঠিন। নেট একটা অলইন্ডিয়া বেসিস পরীক্ষা। তার জন্য খুবই কঠিন প্রস্তুতি নিতে হয়। স্কুলে চাকরি করে সেসব সম্ভব নয়। 

অনন্ত একটু দমে গেল। তাও জিজ্ঞেস করল, কলেজে চাকরি পেতে তোর কত সময় লাগবে? 

ঋতি চট করে একথার উত্তর দিল না। তার মনে পড়ল অধ্যাপক দের কথা। উনি বলেছিলেন সময় লাগবে। তবু চেষ্টা করো। ঋতি ভেবে চিন্তে একটু বাড়িয়েই সময়টা বলল। মুখে বলল, তিরিশ বত্রিশ বছর তো লাগবেই। যদিও মনে মনে সে ভাবল নেটটা ছ মাসের চেষ্টায় পাশ করলেই আগামী এক দু বছরের মধ্যে সি এস সি তে পেয়ে যাব। তখন বাবা একেবারে অবাক হয়ে যাবে। 

অনন্তকে কিন্তু এবার বেশ চিন্তিত দেখাল। 

ঋতি অনন্তর চিন্তার কারণটা অনুমান করে বলল, ততদিন আমি বসে থাকব না। যদি জেআরএফ পেয়ে যাই তাহলে তো একটা ভালো এমাউন্ট স্কলারশিপ পাব। যদি জেআরএফ নাও পাই পার্ট টাইম, গেস্ট লেকচারার হয়ে কাজ করব। সংসার চালিয়ে দিতে পারব। তুমি চিন্তা করো না। 

অনন্ত কিন্তু ঋতির কথায় মোটেই নিশ্চিন্ত হতে পারল না। উল্টে ভাবল এস এস সির বিজ্ঞাপন বেরোলে ঋতির জন্য ফর্ম তুলে আনবে। ঋতি তখন ঠিকই পরীক্ষা দেবে আর চাকরিও পাবে। ওসব কলেজে পড়ানো টড়ানো খুবই কঠিন ব্যাপার। সময়সাপেক্ষও বটে। ওসবের দরকার নেই। রুচি কেমন চট করে চাকরি পেয়ে গেছে। ঋতিও পাবে। অনন্ত আর কিছু ঋতিকে বলল না। 

ঋতিও চুপ করে গেল। সে এ’কদিন ক্লাস নিয়ে বুঝেছে তার পড়ানো ছেলেমেয়েরা খুবই পছন্দ করছে। ক্লাস ম্যানেজ করতেও তার কোনো সমস্যা হয়নি। তপতীদি সেদিন হোসেন স্যারকে বলছিলেন, ওর বয়সটা কম হলে কি হবে। যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব রয়েছে। ছেলেমেয়েরা চুপ করে ওর পড়া শোনে। ঋতি এসব কথা শুনে আরো উৎসাহ পায়। তার মাথার মধ্যে ঘোরে অধ্যাপক দের কথাগুলো। সে তার ক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ পদ অর্জন করার জন্যই লড়বে। তাকে জবাব দিতে হবে সকলকে। যারা তার মাকে এতো কষ্ট দিয়েছে, তাকে এতো যন্ত্রণা দিয়েছে তাদের সবাইকে সে দেখিয়ে দেবে টাকা থাকলেই উচ্চশিক্ষিতও হওয়া যায় না আর কলেজে পড়ানোর মতো এতো সম্মানের একটি দায়িত্বও পাওয়া যায় না। সেটা অর্জন করতে হয়। 

 

৭৬

নেটের প্রিপারেশন শুরু করার আগেই ইউ জি সি থেকে একটি নতুন নিয়ম চালু করা হলো। নেট না থাকলেও এম ফিল পাশ করে সি এস সি তে অ্যাপিয়ার করা যাবে। ঋতির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকদিনের মধ্যেই এম ফিলের ফর্ম বেরোলো। এতো ছেলেমেয়ে এবছর অ্যাপ্লাই করেছে যে ইউনিভার্সিটি থেকে এন্ট্রাস টেস্টের ব্যবস্থা করা হলো। ঋতি পরীক্ষা দিল এবং মাত্র তিরিশ জনের মধ্যে চান্সও পেয়ে গেল। এম ফিলের ক্লাস হয় সপ্তাহে তিনদিন। সেই মতো গোপীচন্দ্রদাস কলেজে তপতীদির সঙ্গে কথা বলে দিন অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া গেল। আবার একবার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে ঋতির খুব আনন্দ হলো। তার ব্যাচের কেউই এখানে নেই। বেশিরভাগই তার চেয়ে বড়ো দাদাদিদিদের সঙ্গে ক্লাস শুরু হলো। অধ্যাপক দে ঋতিকে ক্লাসে দেখে খুবই খুশি হলেন। এখানে অনেকের সঙ্গে ঋতির আলাপ হলো। সন্তোষদা বেশ কয়েকবছর ধরে এস এস সি তে চেষ্টা করেও পাচ্ছে না। রানিদি এস সি কোটায় এস এস সি দিয়েছে। পায়নি। চেষ্টা করছে। তার স্ট্রং বক্তব্য কোটার ছেলেমেয়েদের মাত্র কয়েকটা সিটে কম্পিটিশনের সুযোগ থাকে। একদিন এসব নিয়ে আলোচনা হতে ঋতি বলল, এটা তুমি ঠিক বলছ না রানিদি। কোটার ক্যন্ডিডেট যদি জেনারেলের সমান নম্বর পায় তবে তাকে জেনারেল ক্যান্ডিডেট হিসেবেই সুযোগ দেওয়া হয়। জেনারেলের একটা সিট কমে যায়। তার জায়গায় কোটায় একজনকে বেশি নেওয়া হয়। 

তাহলে কি বলতে চাইছিস সংরক্ষণ তুলে দেওয়া উচিত? 

না একেবারেই নয়। অনেক পিছিয়ে পড়া জনজাতি রয়েছে যাদের সমাজে উচ্চবর্ণের পাশে বসতে দেওয়া হয় না। ছায়া মারায় না ব্রাহ্মণরা। তারা আর্থিক ভাবেও দুর্বল, বঞ্চিত। অত্যন্ত কষ্ট করে তারা পড়াশোনা করে। তাদের জন্য অবশ্যই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু শহরে যারা দোতলা বাড়িতে আছে, যাদের অভিভাবকরা সরকারি ভালো চাকরি করে তাদের তো সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। তারা এই ধরনের সুবিধে না নিয়ে জেনারেলদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যোগ দিক। 

শোন, তুই তার মানে ইতিহাসটা কিছুই পড়িসনি। ব্রাহ্মণরা কত অত্যাচার করেছে জানিস? 

হ্যাঁ জানি, রানি দি। জানি বলেই বলছি যারা আজও বঞ্চিত তাদের অবশ্যই বিশেষ সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু সকলের পরিস্থিতি তেমন নয়। 

শোন্ একটা সিস্টেম চললে তাতে কিছু মানুষ প্রয়োজন না থাকলেও সুবিধে পায়। এটা মেনে নিতে হয়। 

উঁহু। একদমই না। ভুল সিস্টেম চালালে এই অনাবশ্যক সুবিধে গ্রহণের সংখ্যাটা বাড়ে। কাস্ট সিস্টেমকে সরিয়ে ফ্যামিলি ইনকামের ভিত্তিতে কোটা চালু হলে সত্যিকারের যাদের প্রয়োজন তারাই চাকরিটা পাবে। 

তাহলে তুই বলতে চাস আম্বেদকর ভুল করেছিলেন? 

না, তাঁর সময়ে তিনি যেটা করেছিলেন সেটা একেবারে সঠিক। কিন্তু তারপর ভারতবর্ষের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোটা সিস্টেমেরও পরিবর্তন করা উচিত বলে আমি মনে করি। 

সন্তোষ এই পুরো কথোপকথনটা শুনছিল। একটাও কথা বলেনি। ঋতি ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোবার সময় সন্তোষ ঋতিকে ধরল। ঋতি একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কিছু মনে করবি না তো? 

ঋতি এখন আর খুব একটা সংকুচিত হয়ে থাকে না। কলেজের চাকরিটা তাকে একটা জোর দিয়েছে। পরিচিতি দিয়েছে। সে এখন সহজভাবে নিজের কথা বলতে পারে। সে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই উত্তর দিল, হ্যাঁ বলো। 

তোর বাবা কি করেন? 

কিছু না গো। রিটায়ার করেছেন। 

ও। কোথায় চাকরি করতেন? 

জুটমিলের ক্লার্ক ছিলেন। কেন? 

ঋতি আমি তোকে যতটুকু চিনেছি, তোর একটা চাকরি খুব দরকার না রে। 

হ্যাঁ সে তো বটেই। চাকরি কার না দরকার সন্তোষদা! 

আমি তোকে একটা সুযোগ করে দিতে পারি। 

ঋতি একটু থমকেছে। হঠাৎ সন্তোষদা তাকে চাকরির সুযোগ করে দেবে কেন! কিরকম সেই সুযোগ? 

ঋতি কিছু বলছে না দেখে সন্তোষ বলল, আমার বন্ধু এস এস সির জন্য তৈরি করে দেয়। ওর কাছে পড়লে চাকরি বাঁধা। ওকে মাসে চার হাজার টাকা দিতে হবে। 

ঋতি একটু হেসে বলে, না গো সন্তোষদা। চারহাজার টাকা দিয়ে কারো কাছে পড়ার সাধ্য আমার নেই। তাছাড়া এস এস সি নিয়ে আমি আগ্রহী নই। 

সন্তোষ আর কথা বাড়াল না। কিন্তু ঋতির পিছন ছাড়ল না। বারবারই ঋতিকে জোর করতে লাগল তার বন্ধুর সঙ্গে একবার কথা বলার জন্য। এতো জোরাজুরিতে ঋতি বাধ্য হয়ে রাজি হলো। কিন্তু সন্তোষদার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ঋতির একেবারেই ভালো লাগল না। ছেলেটি ওপর চালাক। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে বারবার। ঋতি ইতিমধ্যেই স্বজন পোষণ শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু তারপরও তো কেউ কেউ থাকে যারা সৎভাবে চাকরি পায়। ঋতি সেই গুটিকয় জনের একজন হতে চায়। নইলে সারাজীবন সে নিজের চোখের দিকে নিজেই তাকাতে পারবে না। ঋতি তাই ওদের একরকম না করে দিয়েই বাড়ি ফিরল। কিন্তু সন্তোষের সঙ্গে তার সপ্তাহে তিনদিন দেখা হয়। সন্তোষ ঋতিকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। এই সুযোগ হাতছাড়া করিসনা ঋতি। ভুল করছিস তুই। শুনতে শুনতে একদিন ঋতি বিরক্ত হয়ে বলল, এতোই যখন চাকরি পাওয়ার গ্যারান্টি তোমার বন্ধু দিচ্ছে তখন তোমার চাকরিটা আজও হয়নি কেন সন্তোষদা! আর আমি চাকরি পেলাম কি পেলাম না তা নিয়ে তোমার এতো ইন্টারেস্ট কেন! ওই টাকায় তোমারও কোনো ভাগ আছে না কি! 

সন্তোষ একথা শুনে রেগে গিয়ে বলল, তুই যদি আমার নিজের বোন হতিস তোকে আমি এখনই একটা চড় মারতাম! 

আমি তোমার নিজের বোন, পরের বোন কেউ নই। সহপাঠী মাত্র। তাই এতো স্পর্ধা দেখানোর চেষ্টাও করো না। 

ক্লাসে সন্তোষ আর ঋতির গোলমালের কথা সকলের কানেই পৌঁছোলো। রানিদি বলল, তুই একদম ঠিক করেছিস। আমারও বিশ্বাস হয়নি। 

বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপারই নয় রানিদি। আমি কোনো অসৎ পথ নেব না। কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করব না। তাতে একটু বেশি সময় কষ্ট করতে হলে আমি রাজি আছি। 

রানিদি আর  ঋতির মধ্যে একটা সুসম্পর্ক এই কদিনেই গড়ে উঠল। রানিদি আবার গোপীচন্দ্রদাস কলেজের কাছেই থাকে। ফলে যোগাযোগটা বেশ নিবিড় হলো। রানগদিই ঋতিকে একদিন দক্ষিণাপণে নিয়ে গেল। ঋতি বহুবছর পর একটা প্যান্ট কিনল। ঋতির দুনিয়াটা একটু একটু করে বদলাচ্ছে। 

 

৭৭

ঋতি এম ফিল পড়তে পড়তেই নেট এর প্রিপারেশন নিতে শুরু করল। নেটের জন্য প্রচুর টেক্সট পড়তে হয়। সব কেনা সম্ভব নয়। তাই ঋতি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে টেক্সটগুলো ইস্যু করিয়ে জেরক্স করে নিতে শুরু করল। একদিন হঠাৎই শ্যামশ্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কলেজ স্ট্রিটে। শ্যামশ্রী ইউনিভার্সিটিতে ঋতির সঙ্গে পড়ত। শ্যামশ্রী এস এস সি আর নেটের প্রিপারেশন নিচ্ছে একসঙ্গে। যেটা হয়ে যায়! শ্যামশ্রী ঋতিকে প্রস্তাব দিল, ঋতি নেটের পড়াটা একসঙ্গে পড়বি। তাহলে তৈরি হতে সুবিধে হবে। 

ঋতি যদিও কোনোদিনই কারো সঙ্গে একসাথে পড়াশোনা করতে অভ্যস্ত নয়। তবু শ্যামশ্রীর কথায় রাজি হয়ে গেল। শ্যামশ্রী এম এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। 

শুরু হলো ঋতির নেটের পড়াশোনা। ঋতি আগে টেক্সটগুলো ভালো করে পড়তে শুরু করল। অবজেক্টিভ প্রশ্নের জন্য টেক্সট পড়াটা জরুরি। সেইসঙ্গে কবিতা, উপন্যাস থেকে যতরকমের মাঝারি মানের প্রশ্ন হতে পারে খাতায় তার উত্তর লিখে রাখতে শুরু করল। সপ্তাহে দুদিন করে কলেজ স্ট্রিটে ওদের দেখা হয়। শ্যামশ্রী ঋতির তৈরি করা উত্তর দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়। বলে, আমার মাস্টারমশাইকে একবার দেখিয়ে নেব ঋতি। 

ঋতি আপত্তি করে না। 

শ্যামশ্রী কয়েকদিন পর খাতাটা ফেরৎ দিয়ে বলে মাস্টারমশাই খুবই প্রশংসা করেছে। এমন উত্তর লিখলে নেট পাশ করা কঠিন হবে না। 

ঋতি জানে শ্যামশ্রী এই নোটগুলো সব জেরক্স করে নিচ্ছে। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না। নেটের পরীক্ষার ব্যাপারটা অনেক বড়ো। গোটা দেশের সমস্ত বাংলা পড়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই পরীক্ষা। এখানে সামান্য নোটস শেয়ার করলে কিছুই আসে যায় না। কারণ অবজেক্টিভ, বড়ো প্রবন্ধ সবই আনসিন আসবে পরীক্ষায়। ওগুলো কেমন লিখতে পারছে তারওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। সেইসঙ্গে আছে জেনারেল পেপার। সেখানে অঙ্ক, ফ্যালাসি, কমপ্রিহেনসন সবই আছে। ওই পেপারটা পাশ না করলে সাবজেক্টের খাতা দেখাই হবে না। ঋতি প্রায় দিন রাত এক করে পড়াশোনা করছে। একদিকে কলেজ। তার নানা দায়িত্ব। তপতীদি হাতে ধরে ওকে কাজ শেখাচ্ছে। প্রশ্ন করা, খাতা দেখা। উত্তর চব্বিশ পরগণার কলেজগুলো নিয়ে একটা নতুন ইউনিভার্সিটি হচ্ছে। তপতীদি সেখানে কিছু দায়িত্ব পেয়েছেন। সেসব কাজ করার সময় তিনি ঋতিকে ডেকে নেন। ফলে কলেজে অনেকটা সময় দিতে হয়। তার সঙ্গে এম ফিলের পড়াশোনা, তার সঙ্গে নেট। ঋতির মাথা তোলার সময় নেই। 

এর মধ্যেই একদিন অনন্ত এস এস সির ফর্ম তুলে নিয়ে এলো। 

ঋতি খুবই বিরক্ত হলো। আমি যে তোমাকে বললাম বাবা, আমি এস এস সি দেব না। 

অনন্ত মনে মনে এই বিরোধিতার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। বলল, তোকে তো আলাদা করে কিছু পড়তে হবে না। তুই যা জানিস তাই দিয়েই হবে। 

অতো সোজা নয় ব্যাপারটা বাবা। আমি যে পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি তার সঙ্গে এস এস সির কোনো যোগাযোগ নেই। ওভাবে হয় না। 

তুই চেষ্টা করলেই হবে রুতু। 

এটা চেষ্টা করা না করার ব্যাপারই নয়। দুটো পরীক্ষার প্রিপারেশন সম্পূর্ণ আলাদা। 

অনন্ত হঠাৎ রেগে উঠল। বলল, আসলে নিজেকে জাহির করতে চাইছিস তাই তো! রুচি, রুশি এস এস সি দিয়েছে, তুই তো ওদের থেকে বেশি ভালো, সেটা তোকে জাহির করতে হবে, তাই তো! ওই পরীক্ষা তাই তুই দিবি না। ওরা স্কুলে পড়াবে। তাই তোকে কলেজে পড়াতে হবে, তাই তো! না পারলেও সেটাই করতে হবে! কে এসব মাথায় ঢোকাচ্ছে তোর! বলে অনন্ত শ্রীর দিকে একবার কটাক্ষে তাকালো। 

ঋতি গম্ভীর হয়ে বাবার কথা শুনছিল। মুখটা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে। একদম ঠিক বলেছ বাবা। ওদের সঙ্গে আমার তুলনা করতে যেও না। আমি সত্যিই ওদের মতো নই। আমার যা ক্ষমতা আমি সেই অনুযায়ী আমার কেরিয়ার তৈরি করব!  ওরা স্কুলে পড়াবে না কোথায় পড়াবে তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু আমারটুকু জানি। 

হ্যাঁ, তুই শুধু নিজেরটুকুই তো জানবি! সংসারটা যে ভেসে যাবে সে খেয়াল নেই! 

সংসার তো আমাদের চিরকাল ভেসেই আছে বাবা! কোনোদিন বা এই সংসার ভালো ভাবে চলল। এই সংসারটা ভালো ভাবে চালানোর কথা ছিল তোমার! তুমি সারাজীবনে এই সংসারটার জন্য কি করতে পারলে! একমাত্র মেয়েকে পড়াতেও তো পারলে না! তোমার দায় তুমি আমার ওপর চাপাচ্ছ কেন! 

অনন্ত আর কথা খুঁজে না পেয়ে সেই পুরনো ট্রিকই অ্যাপ্লাই করল। ধুর শালা, আমার আর বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করে না। চললাম আমি। লাশ হয়ে ফিরব যখন তখন বুঝবি! 

ঋতির মনে পড়ে গেল সেই দুপুরের দৃশ্য। বাবা ফ্যান থেকে কাপড় ঝোলাচ্ছে গলায় দড়ি দেবে বলে! সারাজীবনে কত অসংখ্যবার যে বাবা ট্রেনে কাটা পড়তে গেল, গলায় দড়ি দিতে গেল! কাপুরুষ। ঋতি যত এসব কথা ভাবছে তত ওর মুখটা কঠিন হয়ে উঠছে। একটা কথাও ও আর অনন্তর জন্য খরচ করল না। বারান্দায় গিয়ে বসে থাকল। এইসব সময়ে ঋতির মনে হয় ও যেন জলের তলায় চলে যাচ্ছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় কেউ যদি একবার হাতটা ধরতে! স্নেহময়দা তুমি কোথায়! তুমি চলে গেলে স্নেহময়দা! 

বাড়িতে এখন এমন অশান্তি লেগেই থাকে। রোজ রোজ ঝগড়া হয়। শ্রী বলে, ও যেটা চাইছে ওকে করতে দাও। 

হ্যাঁ, তুমি তো একথা বলবেই! তুমিই তো ওর মাথাটা খেয়েছ! দিদিদের হিংসে করতে শিখিয়েছ! 

আর যাই হোক ঋতি কাউকে কখনো হিংসে করেনি। ও ওর স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছে। ওকে সেটা করতে দাও। ও তো আর বসে নেই। কাজ করছে তো। তোমার সংসার তো ওই চালাচ্ছে। 

অনন্ত একথার কোনো উত্তর দেয় না। রাগে গজগজ করতে থাকে। দাঁতে কটকট আওয়াজ করে। 

ঋতি কিন্তু শেষপর্যন্ত বাবার এই চাপটাকে অস্বীকার করতে পারে না। পরীক্ষা দিতে যায়। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসের অংশগুলো পারলেও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের টেক্সট বই থেকে যে প্রশ্নগুলো এসেছে সেগুলো পারে না। কারণ টেক্সটগুলো তার পড়া নেই। 

অনন্ত তারপরও আশা করে ঋতি যেটুকু পেরেছে তাতেই ওর চাকরি হয়ে যাবে। অনন্ত জানেই না পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়ের সংখ্যা কত! সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা বাংলা নিয়েই। অনন্ত আসলে যেমন করে হোক সব দায় ঝেড়ে ফেলে মুক্ত হতে চায়। তার জন্য ঋতির স্বপ্নপূরণ না হলেও তার কিছু আসে যায় না। সে মনেই করে না ঋতি কোনোদিন কলেজে চাকরি পাবে! অতো যোগ্যতা ওর নেই। রুচিই চেষ্টা করেনি কোনোদিন। আর ঋতি পারবে! 

সেদিন ঋতি টিউশন পড়িয়ে জ্যেঠুর বাড়িতে গেল। অনেকদিন দিদিভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়না। রাইকেও দেখেনি কতদিন! রাই খুব ঋতির ন্যাওটা হয়েছে। ঋতি ওকে নানারকম গল্প বলে, ওর সঙ্গে খেলা করে। রাই খুশি হয়। সেদিন কিন্তু জ্যেঠুর বাড়িতে গিয়ে ঋতি অদ্ভুত ব্যবহার পেল। জ্যেঠু তার সঙ্গে কথাই বলল না। আর রুচি তাকে দেখেও নিজের কাজ নিয়ে বসে থাকল। ঋতি প্রথমে ব্যাপারটা বোঝেনি। দিদিভাইয়ের পাশে বসে কথা বলছিল। হঠাৎ তার মনে হলো দিদিভাই হুঁ/ হাঁ ছাড়া কোনো উত্তর দিচ্ছে না। ঋতি বুঝল কিছু একটা হয়েছে! কী হয়েছে দিদিভাই? তোর মন খারাপ? 

নাহ্।

তাহলে?

তাহলে কি! আমি ব্যস্ত আছি। তুই কোনো দরকারে এসেছিস? 

না, এমনিই এলাম। কথা বলব বলে! ঋতি থতমত খায়। 

বাবা! আমাদের আবার তুই কথা বলার যোগ্য মনে করিস না কি! আমরা সব পাতি স্কুলে পড়াই! 

একথা আমি কখন বললাম রে! এসব বলছিস কেন! 

কেন বলছি তুইই ভালো জানিস। ঠিক আছে রে। আমি একটু ব্যস্ত এখন। 

ঋতির কানটা গরম হয়ে ওঠে। কোনোরকমে বাড়ি ফিরে ও অনন্তকে চার্জ করতে শুরু করে। বাবা, তুমি ও বাড়িতে কী বলেছ! 

অনন্ত অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি এস এস সি দেব না বলেছি বলে কী বলেছ ও বাড়িতে! 

অনন্ত চুপ। 

তুমিই কিছু বলেছ বাবা, আমি জানি। ওই জন্য ওরা এরকম ব্যবহার করল আমার সঙ্গে। কেন বলেছ বাবা! কেন করছ এরকম! ঋতি কাঁদতে থাকে। তারপর একসময় উঠে বাথরুমে চলে যায়। তার মনে তার আর বেঁচে থাকার দরকার নেই। কেন বেঁচে আছে সে! এতো লড়াই করে বেঁচে থাকার কি মানে! স্নেহময়দা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সেই যে সে গেয়েছিল, ‘যদি আর কারে ভালোবাসা

যদি আর ফিরে নাহি আস 

তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও 

আমি যত দুখ পাই গো’… এই গানটাই তো সত্যি হয়ে গেল। দুঃখ! পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ ঋতির ভাগ্যে এসে জড়ো হয়েছে। এতো যন্ত্রণা নিয়ে জীবনাকে বয়ে বেড়িয়ে কি লাভ! ঋতির কানে হঠাৎ ধাপা ধরে গেল। ঋতি কিছু শুনছে না। বাথরুমে দাঁড়িয়ে কখন যে সে বাবার দাড়ি কামানোর ব্লেডটা বার করেছে কখন যে হাতে চালিয়েছে সে নিজেই জানে না। তারপর রক্ত পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা করে। ঋতি দেখছিল। এইমুহূর্তে তার মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। দাঁড়িয়ে আছে ঋতি। 

অনন্ত বোধহয় কিছু সন্দেহ করেছিল। ও খানিকক্ষণ পর থেকে বাথরুমের দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। ঋতি প্রথমটায় শুনতে পায়নি। তারপর একসময় সে চমকে ওঠে। বাবার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। তখনও তার হাত থেকে রক্ত পড়ছে। অনন্ত তাড়াতাড়ি ঋতির হাতটা কলের জলে ধুইয়ে দিয়ে গজ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়। ঋতি কিন্তু নির্বিকার। তার কোনো ব্যথার অনুভব হচ্ছে না। সে আস্তে আস্তে ঘরে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। অনন্ত শ্রীকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলে। শ্রী বাড়িতে এসে সব শুনে ঋতিকে ঠাস করে একটা চড় মারে। মায়ের হাতে চড় খেয়ে ঋতির সম্বিত ফেরে। বাকিরাতটা ঋতি হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে।

এই ঘটনার পর শ্রী ঋতিকে নিয়ে কটাদিন মায়ের কাছে গিয়ে উঠল। ঋতির একটু চেঞ্জ হবে। মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি কোনোদিন। ওইটুকু ঘরে, ওই বিষাক্ত পরিবেশে থাকতে থাকতে মেয়েটা হাঁপিয়ে উঠেছে। শ্রী নিজেও যেন আর পারছে না। মার কাছে তবু সাতটাদিন একটু অন্যরকম কাটবে। বাপী, কাকু ঋতিকে নিয়ে রীতিমতো গর্ব করে। নাতনি কলেজে পড়াচ্ছে! ঋতি দাদু নিনানের সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসে। পুরনো দিনের গল্প, দাদু, নিনানের ছোটোবেলার গল্প, মার ছোটোবেলার গল্প এসব মন দিয়ে শোনে। ওদের মাঝখানে এসে ঋতির মনের সামান্য হলেও শুশ্রূষা হলো। ওরা সাতদিন পর আবার ব্যারাকপুরে ফিরে এলো। ওদের ফেরার দুদিন পর অনন্ত একটা লুঙ্গি একটা ছোটো প্লাস্টিকে ভরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল, কেন গেল কিছুই বলে গেল না! ঋতি আর শ্রী সন্ধে অবধি অপেক্ষা করল। অনন্ত ফিরল না। ঋতির খুব টেনশন হচ্ছে, মা, বাবা কিছু করে বসল না তো! 

শ্রী আস্তে করে মাথা নাড়ল। বলল, তোর বাবা ও বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। আমাদের জব্দ করছে। তুই সেদিন ওই কাণ্ড করলি! তারপর তোর বাবার সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে। 

কী হয়েছে মা? 

কিছু না। তোর বাবার তো ধারণা আমি তোকে তোর জ্যেঠুর বাড়ির বিরুদ্ধে চালনা করি। আমি তোকে বাকি ভাইবোনদের হিংসে করতে শিখিয়েছি! এসবই বলছিল। 

ও। 

তাই আমি বললাম, ঋতির কি চোখ কান নেই! ও কি নিজে বুঝতে পারছে না সবটা! সেই নিয়ে চেঁচামেচি করল তোর বাবা।

ও, তাই আজ এভাবে চলে গেল। মা বাবা কি আত্মহত্যা করতে পারে! 

শ্রী ঋতির দিকে তাকালো। মেয়েটার কালো পাঁশুটে একটা চেহারা হয়েছে। মনে হয় যেন খেতে পায় না! চোখের তলায় কালি! চোখ দুটো সবসময় উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। ওকে দেখে শ্রীর কষ্ট হলো। অনন্ত একবার মেয়েটার কথা ভাবল না! মুখে বলল, আজ তো রাত হয়ে গেছে। কাল তোর জ্যেঠুকে ফোন করব। 

পরদিন ফোনে বিশ্বদেব আকাশ থেকে পড়ল। বুধু চলে গেছে! কোথায় চলে গেছে! তোমাকে বলে যায়নি! তুমি জিজ্ঞেস করোনি! 

জিজ্ঞেস করার সুযোগ দেয়নি আপনার মেজো ভাই। একটা লুঙ্গি নিয়ে সাইকেলে করে গতকাল সকালে বেরিয়ে পড়েছে। 

সে কি! আর তুমি সেটা এতোক্ষণে জানাচ্ছ! থানায় খবর দেব না কি! ফোন করেছিলে? 

ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। নট রিচেবল বলছে। 

ও। এতো চিন্তার কথা! বাড়িতে অশান্তি হয়েছিল নিশ্চয়ই! আহ্, শান্তি দিলে না তোমরা মেজ বৌ। 

শ্রী বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি তাহলে কিছু জানেন না আপনার ভাই কোথায় গেছে! 

না, আমি জানব কি করে! 

আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি দেখে নিচ্ছি। বলে শ্রী ফোনটা রেখে দিল। 

কিন্তু মুখে যাই বলুক শ্রী কিন্তু বিচলিত হয়ে পড়ল। কোথায় গেছে কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও তো খবর আসত! ওরা মা মেয়ে দুজনের খাওয়া দাওয়া, ঘুম মাথায় উঠল। অনন্ত চলে যাওয়ার তিনদিনের দিন বিজু শ্রীকে ফোন করল। জানা গেল অনন্ত বিজুর কাছে মুম্বাইতে গেছে। 

শ্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল একটা লুঙ্গি নিয়ে মুম্বাই? আর সাইকেলটা! 

শুধু লুঙ্গি কেন! ও তো একটা বড়ো সুটকেস নিয়ে এসেছে। সাইকেল বোধহয় দাদাভাইয়ের বাড়িতে আছে। 

দাদার বাড়িতে! দাদা জানত সব! অথচ আমাকে… শ্রী আর কথা বাড়াল না। আলমারি খুলে দেখল অনন্ত বেশ কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে গেছে। মাসের শেষ। বাড়িতে টাকা পয়সা নেই। চাল বাড়ন্ত। কোনোকিছুর ব্যবস্থা না করে সবটা শ্রীর ঘাড়ে ফেলে দিয়ে অনন্ত চলে গেছে। শ্রী আর অনন্তর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করল না। 

কিন্তু সম্পূর্ণা তো বেশিদিন কাউকেই তার বাড়িতে থাকতে দেবে না। তাদের বৈভব আত্মীয়দের চোখ টানবে। তাতে তাদের ক্ষতি হবে! এই ভয় সে সবসময় পায়। সম্পূর্ণা তাই মেজদাকে বুঝিয়ে শ্রীর সঙ্গে কথা বলতে রাজি করালো। তাতে বরফ গলল না। উল্টে তিক্ততা বাড়ল। দুমাস বাদে অনন্ত আবার নিজে থেকেই ফিরে এলো। 

বাড়িতে এই অশান্তি। বাইরে যে একটু শান্তি পাবে ঋতি তাও যেন মরীচিকার মতো হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। সেদিন কলেজে পৌঁছতেই তপতীদি ডেকে বললেন, ঋতি তোমাদের সই করার খাতাটা নিয়ে এসো তো। 

ঋতি বুঝতে পারেনি। খাতাটা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। স্টাফরুমে তখন অনেক প্রফেসরই রয়েছে। সবাই চুপ করে যেন কিসের অপেক্ষা করছে। সবার মুখ থমথম করছে। 

তপতীদি বললেন, তোমার গতমাসের পাতাটা খোলো। 

ঋতি খুলল। 

কটা ক্লাস নিয়েছ? 

ঋতি গুণে বলল, চল্লিশটা। 

তপতীদি লাফিয়ে উঠলেন, দেখেছ, দেখেছ তোমরা! আমি কি বলেছিলাম! ও মিথ্যে বলা, জালিয়াতি করার মেয়েই নয়। আর রামপ্রসাদদা আমার সঙ্গে শুধু শুধু তর্ক করে গেল। 

ঋতি বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে। কী হয়েছে দিদি? 

আর বলো না। ইংরেজির দেবলীনা এই মাসে পঁচাত্তরটা ক্লাস দেখিয়েছে। যেটা প্র্যাকটিক্যালি সম্ভবই নয়। ওর প্রচুর টাকা বিল হয়েছে। রামপ্রসাদদা তোমাকে চেনে না। তোমার নামটাও জানে না। আমাকে এসে তোমার বর্ণনা দিয়ে যা তা বলছে। আমি বলেছি, ঋতি যদি পঁচাত্তরটা ক্লাস লিখে থাকে তাহলে ও অতগুলো ক্লাসই নিয়েছে। ও জালিয়াতি করার মেয়ে নয়। কিন্তু রামপ্রসাদদা শুনলে তো। প্রিন্সিপালকে গিয়ে লাগিয়েছে। চলো তো তোমাকে নিয়েই আমি প্রিন্সিপালের কাছে যাব। 

ঋতির তখন আর কানে কোনো কথা ঢুকছে না। তার মনে হচ্ছে এরা এতোক্ষণ ধরে তাকে চোর ভাবছিল! এই অপবাদও তাকে শুনতে হলো! এমনিতেই বাবা বাড়িতে সারাক্ষণ তাকে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কথা বলে চলেছে। এখানে যে একটু ভালো ভাবে থাকব তারও উপায় নেই। শেষপর্যন্ত তাকে চোর ভাবল। 

ঋতি চুপ করে আছে দেখে তপতীদি বোধহয় কিছু বুঝলেন। বললেন, তুমি কিছু মনে করোনা ঋতি। রামপ্রসাদদা অত্যন্ত অসভ্য একটি লোক। ক্যাশ সামলায় তো! মনে করে ওই আমাদের মাইনে দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই ওর গোলমাল লাগে। তুমি ওর কথায় কিছু মনে করো না।

ঋতি শুধু মাথা নাড়ল। কোনো উত্তর করল না। দেবলীনাদিকে ও কয়েকমাস হলো চেনে। দেবলীনাদিরা খুব বড়লোক। বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা। খুব বড়ো বড়ো কথা বলে। দামি দামি রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। গাড়ি ছাড়া চলে না। তার আসল রূপটা তাহলে এই। সত্যিই তো সপ্তাহে তিনদিন এসে পাঁচটা করে ক্লাস নিলেও কোনোভাবেই পঁচাত্তরটা ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। এটা তো অন্যায়। আর অন্যায়টা করল দেবলীনা। দোষ হলো তার। অপমানিত হতে হলো তাকে। ঋতি ঘটনাটা ভুলতে পারছে না।

 

৭৮

ঋতির এম ফিলের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। এখন ডিসার্টেশনের কাজ চলছে। অধ্যাপক সরখেলের কাছে ঋতি ডিসার্টেশনের কাজ করছে। বিষয়টা ঋতি নিজেই ভেবেছে। খোঁজ করে দেখেছে এই বিষয়ের ওপর কোনো গবেষণার কাজ নেই। অথচ বিষয়টা সব ইউনিভার্সিটিতেও পড়ানো হয়। ঋতি নিজেই প্রস্তাবনা লিখে জমা করেছিল। অধ্যাপক সরখেল কাজটা করাতে চান। বিষয়টার মধ্যে একটা বড়ো অংশ বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক সাহিত্যিক প্রসঙ্গ আছে। অধ্যাপক সরখেল ঋতিকে বাংলাদেশের হাইকমিশনের লাইব্রেরিটায় যেতে বলল। মূলত সাহিত্য পরিষৎ, গোলপার্কের লাইব্রেরি আর হাইকমিশনের লাব্রেরি ব্যবহার করে ঋতি কাজটা করছে। সেদিন অধ্যাপক সরখেলের সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখলেন উনি এখনো আসেননি। ইউনিভার্সিটিও ফাঁকা। স্টাডি লিভ চলছে। ঋতি ওদের এম এ স্পেশালের ক্লাসরুমটায় গিয়ে বসল। ফাঁকা ঘর। সারি সারি বেঞ্চ পাতা। সামনের ছোট্ট বারান্দাটায় একটা কাক বসে ডাকছে! কাউকে খুঁজছে বোধহয়! ওর সঙ্গীকে কি! ঋতির মনে পড়ল সুমিতার কথা। সুমিতা আর ঋতি স্পেশালের ক্লাসে পাশাপাশি বসত। ঋতি চুপচাপ থাকত। চোখের তলায় কালি। চোখদুটো কেমন ম্রিয়মাণ! সুমিতা একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ঋতি, তুই এতো চুপচাপ থাকিস কেন! 

এমনিই। ঋতি প্রশ্নটা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল। নিজেকে আড়াল করে গুটিয়ে রাখাটা ঋতির স্বভাব। 

সুমিতা বলেছিল, ঋতি, তোর কোনো কষ্ট থাকলে আমাকে বলতে পারিস! আমি হয়তো সমাধান করতে পারব না। কিন্তু পাশে থাকব। 

ঋতি তাও চুপ করেছিল। কি বলবে সে! তার মনগড়া একটা সম্পর্কের কথা! যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। না কি তার বাড়ির অশান্তির কথা! না কি তারা গরিব সে কথা! কোনটা! 

সুমিতাই আবার বলে উঠেছিল, ঋতি দেখ একটা কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে মানসিক সমস্যায় পরিণত হয়। আমার মনে হচ্ছে তোর কিছু মানসিক সমস্যা হচ্ছে। তুই কথা বল ঋতি। 

ঋতি সেদিন কোনোরকমে সুমিতার হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু বেশিদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। সুমিতাকে একদিন সে তার আর স্নেহময়দার কথা বলেছিল। তার মনে আছে এই ঘরটায় এই বেঞ্চে বসে সে পাগলের মতো কেঁদেছিল। সুমিতা সেদিন অনেক কথা বলেছিল। যার মূল জায়গাটা হলো, সব ভুলে যা। নতুন করে জীবনটা শুরু কর। ঋতির আজ আবার নতুন করে সেসব মনে পড়ছিল। জীবনে একবার তার স্নেহময়দার সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কিচ্ছু বোঝনি? কিচ্ছু না? ঋতির চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। প্রায় ছ’বছর হতে চলল। কোনো যোগাযোগ নেই। কতদিন স্নেহময়দার গলার স্বরটা শোনেনি ঋতি। নিজের অজান্তেই ঋতি হাত কচলাচ্ছিল। পাদুটো হাঁটুর কাছ থেকে নেড়ে চলেছে। এই মুহূর্তে ডিসার্টেশন, নেট, কেরিয়ার সব মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে ঋতির। স্নেহময়দার মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। স্নেহময়দা যেন তাকে ডাকছে। ঋতির মনে হচ্ছে ঋতি অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছে। এখনই ছুটে তার স্নেহময়দার কাছে যাওয়া দরকার। ঋতির মাথার ভিতরটা হঠাৎ কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। রইল পড়ে তার ইউনিভার্সিটি। রইল পড়ে অধ্যাপক সরখেল! ঋতি হঠাৎ উঠে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। 

ঋতিকে হঠাৎ ফিরে আসতে দেখে শ্রী অবাক হলো। কি রে! এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি! 

হ্যাঁ। 

কিছু হয়েছে বাবু? সরখেল কিছু বলেছে? 

অধ্যাপক সরখেল আসলে ঋতিকে নানারকম কথাবার্তা বলছেন আজকাল। কলকাতার ফ্ল্যাটে তিনি একা থাকেন। একা থাকতে ভালো লাগে না। রাতে ঘুম হয় না। একদিন রানিদি ঋতির সঙ্গে ছিল। রানিদিও অধ্যাপক সরখেলের কাছেই কাজ করছে। রানিদি হাসতে হাসতে বলেছিল, কেন স্যার! ঘুম হয় না কেন! ভূতের ভয় পান? 

অধ্যাপক সরখেল হেসে হেসে নানা কথা বলছিল। ঋতি কিন্তু ক্রমশ সচেতন হয়ে যাচ্ছিল। অধ্যাপক সরখেল কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন। উনি সরাসরি কিছু বলার আগেই কাজটা শেষ করে সরে যেতে হবে। ঋতি কোনো প্ররোচনা, কোনো নোংরা ফাঁদ, কোনো প্রলোভনে পা দেবে না। শ্রী এসব কথা জানে। তাই ঋতিকে ফিরে আসতে দেখে সে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

ঋতি অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, না। 

তাহলে? 

কিছু না। 

শ্রী বুঝল মেয়ের মন ভালো নেই। আর কথা বাড়ালো না। 

ঋতি অপেক্ষা করতে লাগল কখন মা আর বাবা বেরোবে। বিকেল,সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফাঁকা হতে ঋতি তার সদ্য পাওয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসল। ঋতি কলেজে চাকরি পাওয়ার পর এই ছোট্ট মোবাইটা চক্রবর্তী জ্যেঠু দিয়েছে। শ্রী খুবই আপত্তি করেছিল। কিন্তু চক্রবর্তী জ্যেঠু বলেছে, ওর এবার এটা দরকার। তুমি না করো না। সত্যিই তো, ঋতি এখন কলেজে পড়ায়। কত ছাত্রছাত্রী ঋতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্থায়ী হলেও সে অধ্যাপক তো! সবথেকে কম বয়সের অধ্যাপক। তার বন্ধুরা এখনো কেউই চাকরি পায়নি। সে পেয়েছে। তার পায়ের তলায় মাটি পড়েছে। সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এই কথাটা স্নেহময়দাকে তো জানানোই যায়। কত মানুষ তো এমন আছে পুরনো পরিচিতদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে দেখা করতে আসে! দাদুর বাড়িতেই এমন কতজনকে আসতে দেখেছে ঋতি। তাহলে সে ই বা স্নেহময়দার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারবে না কেন! এমনটাও তো হতে পারে ঋতি একটা অনুভুতির চারপাশে অনিবার্য কক্ষপথে ঘুরে মরছে। হয়তো স্নেহময়দার সঙ্গে কথা হলে সেই অনিবার্যতা কেটে যাবে! ঋতি নিজের জীবনটাকে নিয়ে অন্যরকম ভাবে ভাবতে পারবে। ঋতি মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্নেহময়দার বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল। 

হ্যালো? স্নেহময়দা ফোন ধরেছে। ঋতির মনে হলো গরমের দুপুরে ঠাঠা রোদে অনেকটা হেঁটে এসে ও কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেল। জীবনানন্দ যেন নাটোরের বন্দরে দাঁড়িয়ে উদাসী গলায় বলে উঠলেন, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’…আবারও ওপাশ থেকে ভেসে এলো, হ্যালো? 

ঋতি এবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করল, বলো তো আমি কে বলছি! 

কে? 

বুঝতে পারছ না। 

স্নেহময়দা বোকার মতো হেসে বলল, না ঠিক বুঝতে পারছি না। 

ঋতি হেসে উত্তর দিল, আমি রুতু বলছি। 

ওওওওও, রুতু! আরে! কেমন আছিস! 

ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? 

আমি বিয়ে করেছি জানিস তো! 

হ্যাঁ জানি। তোমার বউয়ের নাম কী গো? 

স্নেহময়দা একটু থতমত খেয়ে বলল, মধুমালতী। ডাক নাম মধু। তোর কী খবর বল? 

আমি বড়ো হয়ে গেছি স্নেহময়দা। কলেজে পড়াচ্ছি। যদিও পার্ট টাইম।

অ্যাঁ! বলিস কি রে! 

হ্যাঁ। এই তো দুবছর হলো। তুমি আমার নম্বরটা রাখবে? 

তোর নম্বর মানে? মোবাইলের নম্বর? 

হ্যাঁ।

ওহ্! রুতু তুই সত্যি বড়ো হয়ে গেছিস। 

ঋতি হাসল। মোবাইল নম্বরটা বলল। তারপর পরে কথা হবে বলে ফোনটা রেখে দিল। রেখে দিতে ইচ্ছে করছিল না যদিও। মনে হচ্ছে অনেক কথা হোক! অনেক! এতোদিনের সব কথা আজ এইমুহূর্তে বলে ফেলে ঋতি হালকা হয়ে যেতে পারে।

 

৭৯

ঋতি আশা করেছিল এতোদিন পর যোগাযোগ। স্নেহময়দা হয়তো খুব তাড়াতাড়ি ফোন করবে! কথা বলতে চাইবে ঋতির সঙ্গে! কিন্তু দুসপ্তাহ হয়ে গেছে স্নেহময়দার কোনো ফোন আসেনি। এই দু সপ্তাহে ঋতি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছে এই ভেবে যে আজ নিশ্চয়ই স্নেহময়দা ফোন করবে। সারাদিনে বারবার মোবাইল ফোনে আনরিড ম্যাসেজ খুঁজেছে। মিসড কল আছে কি না দেখেছে! তারপর রাতে শুতে গেছে এইভেবে যে কাল নিশ্চয়ই স্নেহময়দা ফোন করবে! রোজের কাজ তার নিয়মিতই চলছে। কিন্তু মনটা তার খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফট করে মরেছে। তারপর সে আস্তে আস্তে ভাবতে শুরু করেছে স্নেহময়দা হয়তো যোগাযোগ করতে চায় না। ওর জীবনে চূড়ান্ত ক্রাইসিসের একটা সময়ে ঋতি তো ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই হয়তো… আবার স্নেহময়দা বিয়ে করেছে বলেও এড়িয়ে যেতে চাইছে ঋতিকে তাও হতে পারে! তাহলে! স্নেহময়দার সঙ্গে আর কোনোদিন কথা হবে না! আর কোনোদিন দেখাও হবে না! ঋতি এইসব ভাবছিল। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এখন দুপুরবেলা। প্রায় সাড়ে তিনটে বাজছে। আজ ঋতি লাইব্রেরি যায়নি। অনন্ত, শ্রী আর ঋতি শুয়ে আছে। ওরা এখনো একটা খাটেই তিনজনে মিলে শোয়। দুটো ফ্যান চললে ইলেকট্রিক বিল বেশি আসবে। ঋতির গুটিসুটি মেরে শোয়া অভ্যেস হয়ে গেছে। ও দেওয়ালের দিকে মুখ করে নিঃশব্দে কাঁদছিল। হঠাৎ মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠল। ঋতি দেখল একটা অচেনা ল্যান্ড লাইন নম্বর থেকে ফোন এসেছে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ঋতির মাথায় স্নেহময়ের মুখটা উঁকি দিয়ে গেল। ঋতি তাড়াতাড়ি উঠে বাইরের বারান্দায় গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল, হ্যাঁ, বলছি। 

বল্ তো আমি কে বলছি! 

স্নেহময়দা। ঋতি শান্ত স্বরে উত্তর দিল। 

বাবা! তুই তো একবারেই চিনে গেলি! 

ঋতি হালকা হাসল। তার এতো বছরের জমা অভিমান যেন তার জিভ আড়ষ্ঠ করে দিয়েছে। তার বলতে ইচ্ছে করছে তোমার কথাই তো ভেবেছি এতোগুলো বছর ধরে! তোমার গলার স্বর শোনার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা আমার! সেই স্বর ভুলে যাব কেমন করে! কিন্তু এতো কথা কিছুই ঋতি বলতে পারল না।কোনোমতে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ? 

এই চলছে! তোর তো দারুণ খবর! প্রফেসর ঋতি ঘোষাল, তাই তো! 

ধুর! ও তো পার্ট টাইম। 

তবুও… কাকিমা,কাকু সবাই কেমন আছে? তোর জ্যেঠুর বাড়ির সবাই? 

ভালো আছে। তোমরা সবাই? 

বাবা তো মারা গেছেন, জানিস বোধহয়!

অনেক পরে জেনেছি। 

ও, বোন বিয়ে করেছে। এই আর কি! 

আচ্ছা।

শোন্ না, তুই আমার মোবাইল নম্বরটা নিয়ে রাখ। মোবাইলে যোগাযোগ করবি। 

ঋতি তাড়াতাড়ি নম্বরটা লিখে নিল। 

তুই কি জানিস আমি আবার কলকাতায় ফিরে এসেছি?

না তো। 

কলকাতার অফিস থেকেই তো ফোন করছি। 

ও, তাহলে একদিন এসো না আমাদের বাড়িতে! এই রাস্তা দিয়েই তো যাতায়াত করো। 

হ্যাঁ, যাব। মধুকেও নিয়ে যাব। ও তোদের অনেক গল্প শুনেছে। ওর খুব ইচ্ছে তোদের বাড়ি যাবে। 

হ্যাঁ, নিয়ে এসো। ঋতির গলার স্বরটা একটু ম্লান শোনালো। আরো দু একটা কথার পর ফোনটা কেটে গেল। 

ঋতির একটা অদ্ভুত কথা মনে হলো। এতো বছর পর স্নেহময়দার সঙ্গে কথা হচ্ছে। ওর গলায় কোনো অভিমান নেই তো! ওর কথা শুনে বোঝার উপায় নেই যে ও কোনোদিন ঋতির পথ চেয়ে বসেছিল। তাহলে! ঋতি এতোকাল যা ভেবে এসেছে সব ভুল! যে ইঙ্গিত তার মন প্রাণ জুড়ে ছাপ ফেলে গেছে সে সব মিথ্যে! বানানো! তার মনগড়া! ঋতির মনে হলো তখনই একবার স্নেহময়দাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, সব ভুল ছিল স্নেহময়দা! তুমি মনে মনে আমায় চাওনি? ডেকে পাঠাওনি? কিন্তু এখনই এভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। অপেক্ষা করতে হবে তাকে। কথা বলতে বলতে একদিন হয়তো সব জানা যাবে! ঋতি চুপ করে বারান্দায় বসে থাকল। আকাশটা মেঘ করে আছে। হয়তো কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। একটা মন খারাপি আলগা হাওয়া ঋতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। গলিটা শান্ত। ‌সমস্ত আকাশ বাতাস যেন কিসের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে! দূরের কনকচূড়া গাছটায় কোনো এক বিরহী পাখি আকুল হয়ে ডাকছে। ঋতি চুপ করে আছে। ভিতরটা তার ভেঙে পড়তে চাইছে! ধসে যাবে যেন সে। প্রচণ্ড ঝড়ে যেন সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে! অথচ বাইরে ঋতি শান্ত। 

সেদিনের পর থেকে ঋতি আবার অপেক্ষা করতে শুরু করেছে। অন্তত একটা সপ্তাহ যাক। সে আবার ফোন করবে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার কাছে এক একটা যুগের মতো মনে হচ্ছে। তবু শান্ত থেকে সে নিজের কাজগুলো করে যাচ্ছে। অধীরতা তাকে যেন তার অস্তিত্ব শুদ্ধু নাড়িয়ে দিচ্ছে। তবু তার মরণপণ অপেক্ষা। 

এক সপ্তাহ পরে দুপুরের দিকে ঋতি এই প্রথম স্নেহময়দার মোবাইলে ফোন করল। 

বল।

ব্যস্ত? 

নাহ্, বল। 

ও, আমি এমনি ফোন করলাম। 

আচ্ছা, ভালো করেছিস। তারপর তোর খবর বল।প্রেম ট্রেম করছিস? 

প্রেম করছি কি না জানি না! তবে একজনকে ভালোবাসি। 

বাবা! সে তো জটিল ব্যাপার রে! তা কে সে! 

তুমি চেনো। 

ও, তাকে আবার আমিও চিনি! বিরাট রহস্য তো রে।

ঋতি হাসছে। 

স্নেহময় একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, এই শোন না, আমাকে একটু ডাকছে। পরে কথা বলছি। 

হ্যাঁ হ্যাঁ। 

ঋতির মনে হলো স্নেহময়দাকে কেউ ডাকছিল না। স্নেহময়দা তাকে এড়িয়ে গেল। হয়তো স্নেহময়দা সব বুঝেছিল। তবু অন্য কাউকে বিয়ে করেছিল! হয়তো স্নেহময়দার ঋতিকে পছন্দ হয়নি! স্নেহময়দা তো ঋতিকে ছ’বছর দেখেনি। তার মধ্যে ঋতির কত পরিবর্তন হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো যে পরিবর্তনটা হয়েছে সেটা হলো ঋতির মুখের আঁচিলগুলো রিমুভ করা গেছে। ঋতি খোঁজ খবর করে শ্রীকে নিয়ে ট্রপিকালে গেছিল। যদি আঁচিলগুলো নিয়ে কিছু করা যায়? ডাক্তার বললেন, আমাদের এক জুনিয়র একটি নতুন মেশিন কিনেছে। আপনিই তার প্রথম পেশেন্ট হতে চলেছেন। সেই অনুযায়ী একদিন সামান্য একটা সেশন করে ঋতির মুখের বড়ো ছোটো সমস্ত আঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছে। ঋতি তারপর আইভ্রু করিয়েছে। এখন ওর মুখটা অনেক পরিষ্কার দেখতে লাগে। চোখের তলায় কালিটা এখনো আছে। তবে কিছুটা কমেছে। এখন একবার স্নেহময়দার সঙ্গে দেখা করা যায় না! স্নেহময়দা তাকে সেই অসুন্দর জেনে থাকবে! এখনকার ঋতিকে স্নেহময়দা একবার আবিষ্কার করতে চায় না! ঋতি বুঝতে পারছে আজকের কথোপকথন স্নেহময়দার কাছে হয়তো একটা ধাক্কা! ও কি আর যোগাযোগ করতে চাইবে! তবু ঋতি যে তার কথাটা আভাসে বলতে পেরেছে এটুকুও তো সে কোনোদিন ভাবেনি। কাউকে ভালোবাসি! অথচ তাকে কোনোদিন জানানোই হলো না এই আফশোস সামলানোর শক্তি নেই ঋতির। তার থেকে সে বলে ভালোই করেছে। দেখা যাক এরপর কি হয়! 

 

৮০

ঋতি কয়েকটা দিন তো দূরের থাক। কয়েকটা মুহূর্তও শান্ত থাকতে পারল না। তার প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে। কেন যে সে এতো টেনশন করছে নিজেকে প্রশ্ন করে তারও কোনো সদুত্তর সে পাচ্ছে না। শুধু তার মনে হচ্ছে সে হারিয়ে ফেলবে তার স্নেহময়দাকে! তার সেই সব পেয়েছির দেশ, যেখানে সে আছে, স্নেহময় আছে, আর আছে তনুময়, তাদের সন্তান! সেই সব হারিয়ে যাবে! আর এসবের জন্য সে দায়ি। তার তো কোনো দরকার ছিল না এতোবছর পর যোগাযোগ করার। সে তার ইউটোপিয়া নিয়ে থাকতে পারত! কিন্তু না, তাকে সত্যিটা জানতে হবে! জানতে হবে যাকে সে এতোবছর ধরে মনে মনে ভালোবেসে গেছে সে তাকে কখনো, কোনো এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবেসেছিল কি না! এই যে ‘জানিবার গাঢ় বেদনার ভার’ , এ সহ্য করার মতো মানসিক জোর তার আছে! নেই। এই কদিনেই ঋতি যেন ধুঁকছে! কোনো কাজ করার কোনো শক্তি যেন তার মধ্যে বেঁচে নেই। সে আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কোনোদিন না। 

সেদিন সকালে শ্রী ঘুম থেকে উঠে দেখল ঋতির মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। গোটা মুখে দানা দানা কি সব যেন বেরিয়েছে। শ্রীর সন্দেহ হওয়াতে ঋতির পিঠটা ভালো করে দেখল। যা ভেবেছিল তাই! ঋতি হাম হয়েছে। কিন্তু এই বয়সে হাম! মেয়েটা এতো দুর্বল! ইমিউনিটি পাওয়ার বলতে কিচ্ছু নেই! ডাক্তার এলো বাড়িতে। বলল, ওকে একটু প্রোটিন খাওয়ান। খুব দুর্বল। 

ঋতির গায়ে জ্বর এসেছে। সারাগায়ে রাশ বেরিয়ে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা গোটা শরীর জুড়ে। মুখে কিছু তুলতে পারছে না। কিন্তু এসব শারীরিক সমস্যার চেয়েও তার মনের মধ্যে যে ঝড় চলছে তাকে সামলাতে পারছে না ঋতি। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল স্নেহময়দা যোগাযোগ করেনি। সেদিনের পর থেকে একটা ম্যাসেজও নেই। ঋতি দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার বারবার মনে হচ্ছে সে কি ভুল করল! স্নেহময়দাকে তার মনের কথা না জানালেই ভালো হতো! সারাজীবন নিজেকে লুকিয়ে রেখে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল! গুমরে গুমরে মরে যাচ্ছিল সে! এখনও গুমরোচ্ছে। তবে! কি করা উচিত ছিল তার! ভাবতে ভাবতেই ঋতি কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। এই কদিনেই তার কয়েককিলো ওজন কমে গেছে। খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। অথচ কড়া কড়া ওষুধ চলছে। 

প্রায় কুড়ি বাইশ দিন পর ঋতি বাইরে বেরোতে পারল। কোনোরকমে আবার কলেজ, লাইব্রেরি, ইউনিভার্সিটি যাতায়াত শুরু হলো। ঋতিকে দেখে মনে হচ্ছে ও যাই করছে জোর করে করছে। এতোটুকুও এনার্জি নেই। যে দেখছে সেই চমকে উঠছে ওকে দেখে! এতো রোগা হয়ে গেছে ঋতি! 

ঋতির কিন্তু এসব কোনো কিছুর দিকে খেয়াল নেই। সে শুধু দিন হিসেব করে চলেছে। প্রায় এক মাস হয়ে গেল। স্নেহময়দা যোগাযোগ করেনি। সেদিন কলেজ শেষে প্রায় মরিয়া হয়ে ঋতি স্নেহময়কে ফোন করল। স্নেহময় ফোনটা ধরেই বলল, আমি তোকে সন্ধের দিকে ফোন করব। 

ঋতি ফোনটা কেটে দিল। তার বুক দুরুদুরু করছে। স্নেহময়দা কি খুব বকবে! অপমান করবে! বলবে আমার সঙ্গে আর কোনোদিন যোগাযোগ করবি না! কি বলবে স্নেহময়দা? 

স্নেহময় প্রায় আটটা নাগাদ ফোন করল। দুপুর থেকে দুশ্চিন্তা করে করে ঋতির তখন গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। এমনিতেই তার দুর্বল শরীর! সে যেন কথা বলার জোর পাচ্ছে না। সে শুধু বলল, হ্যাঁ বলো। গলাটা এতো দুর্বল শোনাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে তোর? 

হ্যাঁ, হাম হয়েছিল।

ও এখন কেমন আছিস? 

আছি। তুমি বলো। কি বলবে বলছিলে? 

স্নেহময় একটু থেমে বলল, শোন্ তুই সেদিন যেটা বলতে চেয়েছিস আমি সবটাই বুঝেছি। তুই যে আমার সম্পর্কে এমন কিছু ভেবে বসে আছিস, আমি সত্যিই জানতাম না। আমি নিজে থেকে কখনো তোর সম্পর্কে এমন কিছু ভাবিনি। আর এখনও কোনোকিছু ভাবার মতো জায়গায় আমি নেই। আমি হ্যাপিলি ম্যারেড। সুতরাং বুঝতেই পারছিস! 

ঋতি দম বন্ধ করে স্নেহময়দার কথাগুলো শুনল। এই কথার তো কোনো উত্তর হয় না। ঋতি চুপ করে আছে। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ওর বুক থেকে উঠে এলো। এই তাহলে তার ভালোবাসার পরিণতি। এই পাগলের মতো অপেক্ষার উত্তর হ্যাপিলি ম্যারেড! ঋতির চোখদুটো ছলছল করে উঠল। ওদিকে স্নেহময়ও চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না। কিন্তু ফোনটা কেটেও দিচ্ছে না। এদিকে ঋতি নিঃশব্দে মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদছে! 

কয়েক মিনিট বাদে স্নেহময় ডেকে উঠল, রুতু? সেই ডাক! সেই যে, যে ডাকে আদর, আবদার, স্নেহ, একান্ত নিজেরজন হওয়ার অনুভব ঝরে পড়ত আপনা থেকেই! সেই ডাক। 

ঋতি একটু সময় নিয়ে কান্না গিলে কোনোরকমে একটা হুঁ বলতে পারল। কিন্তু গলাটা তার কেঁপে গেল। 

রুতু তুই কাঁদছিস? 

ঋতি চুপ।

কষ্ট হচ্ছে রুতু! 

আমি তো সেই কবে থেকেই কষ্ট পাচ্ছি স্নেহময়দা! তোমার আজ মনে হলো! 

আচ্ছা, তুই কি চাইছিস বল! আমার তো তোকে কিছু দেওয়ার নেই রুতু! সেটুকু বোঝ! 

কিছু চাই না আমার স্নেহময়দা! কিচ্ছু না। শুধু একটা অনুরোধ করব। রাখবে? 

বল। 

একদিন দেখা করবে? আমি শুধু একবার তোমাকে দেখব! আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব না। 

হ্যাঁ করব। স্নেহময় হঠাৎই খুব জোরের সঙ্গে বলে উঠল। আমাকে এদিকটা একটু সামলে নিতে দে! আমি তোকে ফোন করব। আর যোগাযোগ করবি না কেন! তুই তো কোনো অপরাধ করিসনি যে শাস্তি পেতে হবে। আমি আছি। আমি আছি তোর সঙ্গে। তুই যা যা পড়াশোনা করার কর। একটা ভালো চাকরি পা। তাহলেই আমি খুশি। কাঁদিস না। রুতু কাঁদিস না। চোখ মোছ। 

হুঁ।

হুঁ না, চোখটা ভালো করো মোছ রুতু। 

মুছেছি। 

কাঁদবি না একদম। তুই মন দিয়ে তোর কাজগুলো কর। আমি ঠিক দেখা করব। কেমন! চিন্তা করিস না। আচ্ছা। 

ফোনটা কেটে গেল। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলার পর্দাগুলো হাওয়ায় এতোলবেতোল হচ্ছে। ঋতির মনে পড়ছে আঙুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে দেওয়ার সেই মুহূর্তটা! ঋতি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টির ছাট আসছে। লোডশেডিং। চারপাশে নিকষ কালো অন্ধকার। বৃষ্টির ছাটে ঋতি ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে…

(ক্রমশ)

 

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes