
সেপিয়া রঙের গলি
একাদশ পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘…জানে আমার প্রথম সবকিছু’
ভিডিও ক্যামেরা চলছে। রোদের বিপরীতে ছায়ার মতো ছটফটে কিশোর-কিশোরীরা ঢুকে পড়ছে ভিডিওর মধ্যে। বেঁটেখাটো, ময়লা জিনস, আর অবিন্যস্ত দাড়ির ছেলেটি সাশা ব্যারন কোহেনের ভঙ্গিমায় ‘দ্য ডিক্টেটর’ ছবির সংলাপ বলে উঠল। আলাদিনকে নকল করে প্রিয় বন্ধুর মাথা কাটতে চাইল।
‘হোয়াট দ্য…!’ ক্যামেরাধারী তরুণ হেসে উঠল।
ফ্রেমের বাইরে দাঁড়ানো সবুজ রঙের কিশোরীটির হইচই স্বর ভাসছে হাওয়ায়। বিউগলবাদিনী পরী থেমে রয়েছে দূরে। বিকেল নামল শহরে।
কলকাতা শাসন করতে চেয়ে মফস্বলের বাস থেকে নামত ওরা। ওদের মধ্যে সাদা শার্টের ছেলেটি উচ্চবিত্তের সন্তান। ভিডিও ক্যামেরা তারই। যেকোনো মুহূর্তকে বন্দি রাখবার নেশা ছিল। আলাদিনকে নকলকারী ছেলেটি অস্থির, নিম্ন মধ্যবিত্ত, চাকরির খোঁজে হন্যে ও মুহূর্তদের ফাজলামি ভেবে উড়িয়ে দেয়। এবং রোগা কিশোরীটি এলোমেলো, উদ্দেশ্যহীন, কী যেন খোঁজে, মুহূর্তদের অন্যভাবে এঁকে রাখে। ময়দানের লাল চা, ধূসর ঘাসে ওরা সবাই মুহূর্তের হাতের পুতুল, ওরা তা জানত না।
এই বৃষ্টি-এই রোদ্দুরের দিনে দুপুরবেলার ঝুটো গয়নায় সাজা মহানগরে ওরা পথে পথে ঘুরত। টিটকিরির চোটে এলিয়ট পার্কের দর্মার আড়াল ভেঙে ফেলতে চাইত। কুণ্ঠাহীন হাঁসেদের মাঝে কিশোরী বৃষ্টি ভিজলে ওরা ভেবেছিল ভালবাসবে। ‘দ্য ডিক্টেটর’-এর দুনিয়ায় ওরা বেড়ে উঠছিল।
সুদিনের বিজ্ঞাপনে গোটা শহর ছেয়ে গিয়েছিল। সুদিনের সন্ধিক্ষণে ওরা তিনজন তর্ক তুলত ময়দানে। তিনজন তিন মতে চেঁচামেচি জুড়ে দিলে ক্রিকেট খেলোয়াড়ের দল এক-আধবার বুঝি বা ফিরে তাকাত।
ফরাসডাঙার তরুণেরা সুদিনের স্বপ্নে বিভোর ছিল। গঙ্গাপাড়ের কিশোরীটি সুদিন সম্পর্কে প্রবল সন্দিহান ছিল। ক্যামেরার হইহই স্তিমিত হলে, লাল চায়ের তলানিতে খিদে চাগাড় দিলে পর ওরা চুপ করে আকাশ দেখত। বিরাট শহরের ফুসফুসে সন্ধে আসার হাওয়া ঢেলে দিত কেউ। কিশোরীটি ভাবত, রেশম সুতোর গোবিন্দপুর একদিন লিখে ফেলবে ঠিক।
কিছু দূরে টিনের বাসের শব্দ, তার ওপারে জীবনদীপ, বন্ধ সাহারা ভবন, এপাশে নির্মীয়মান বিয়াল্লিশ নম্বর বহুতল, সবকিছু ছাপিয়ে উঠত ‘কলিকাতা’ প্রবাদ। ‘কিলকিলা নগরী’, ‘কোলখাতা’, ‘গলগাটা’, ‘কালকাট্টা’, ‘খালকাট্টা’, ‘কালীঘাটা’, ‘কালীকোটা’, এবং আলীনগর – বিভিন্ন নামের মতবাদ ও প্রবাদ ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসে। দূরে টাটা সেন্টারের আলো জ্বলে উঠত। বাবু গৌরদাস বসাকের বক্তৃতায় কোল শ্রেনির নিম্নবর্গীয় মানুষের কুটীর বা ‘খাতা’য় তৈরি এককালীন ‘কোলখাতা’ তিলোত্তমা হয়ে উঠত।
অন্য আরেকটি মতে, পুরাকালে কৈবর্তদের বাস ও তাদের উপাধি ‘কোলে’ থেকে এই স্থানের নাম হয় ‘কোলেকাতা’।
নিম্নচাপের সন্ধেয় অফিসযাত্রীরা ফিরছে। আরেকটু পরে চৌরঙ্গীর কাছে গাছ ভেঙে পড়বে। জল জমবে অল্প। আচমকা মেট্রো বন্ধ হয়ে যাবে। কপালের ঘাম মুছে ভিড়ে মিশে যাবে জলীয়বাষ্পের রাত। ফরাসডাঙার তরুণদের একটি মজার গল্প বলতে চায় কিশোরী। সাধারণ প্রবাদে বহুকাল আগে একদিন আক ঘাসুড়িয়া ঘাস কেটে রাখছিল। গোরা সাহেব এসে তার ছড়িগাছ দিয়ে কাটা ঘাসের আঁটির ওপর ধাক্কা দিয়ে স্থানের নাম জিজ্ঞাসা করলে ঘাসুড়িয়া ভাবল, কবেকার ঘাস জানতে চাইছে সাহেব। সে সহাস্য মুখে জবাব দিল, ‘কাল কাটা’, অর্থাৎ গতকালের কাটা ঘাস। সাহেব বুঝলেন স্থানের নাম ‘কাল কাটা’।
এসব গল্প সে মুখে মুখে বলতে চেয়েছে। বলা হয়নি। ‘বিকেলের নাম অ্যাল পাচিনো’ হয়ে আছে, ‘ডগ ডে আফটারনুন’-এ শহরের গল্পগুলো হাসিগুলো আর বলা হয়ে ওঠেনি। সময় পেরিয়ে গেছে বহুদূর।
শহরের নামকরণে যেমন সিরাজদৌল্লার ‘আলিনগর’ জড়িয়ে রয়েছে, তেমনই যীশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হবার শ্মশান ‘গলগথা’ নামটিও প্রবাদে জড়িয়ে রেখেছে কলকাতা। কর্নেল ইউলের মতে, ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব্বের সমস্ত পত্রাবলীতে শুধুমাত্র গোবিন্দপুর ও সুতানুটির নাম পাওয়া গেলেও ‘ডকুমেন্টারি মেমোয়ারস অফ জোব চার্নক’ পুস্তকে ১৬৮৬-র ৩১ ডিসেম্বরের পত্রে ‘কোলকাতা’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে ‘বাগুয়া, সুতালুটি, ও গোবিন্দপুর গ্রাম ইজারা পায়। আজকের শোভাবাজার স্ট্রিট সেকালে কেটো স্ট্রিট নামে পরিচিত ছিল। সুতালুটির উত্তরে ছিল বাগুয়া বাজার যা এখন বাগবাজার নামে পরিচিত। যুগের যে ভাবনা মস্তিষ্কে চালিত হয়, যুগ পাল্টানোর যে দৃশ্য কিশোরী দেখতে পেত, ফরাসডাঙার বন্ধুবান্ধবেরা সেই গল্প শুনতে চাইত না। মস্তিষ্কের ভিতরে হ্যান্ডিক্যাম চালানোর ঝকমারিতে যেতে চাইত না। তবে স্বপ্ন দেখত সবাই।
শ্রীপান্থ তাঁর ‘কলকাতা’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘আমরা ওঁর ইতিহাস জানি। জানি মানে, পুনর্নির্মাণ করতে পারি। ’ জোব চার্নকের প্রথম দেখা মেলে কাশিমবাজার কুঠির একটি খাতায়। সেখানে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১২-১৩ জানুয়ারি তারিখে লেখা ‘জোব চার্নক, ফোর্থ স্যালারি, টোয়েন্টি পাউন্ডস’। অর্থাৎ কাশিমবাজার কুঠির একজন জুনিয়র মেম্বার, সামান্য কর্মী হিসেবে চিহ্নিত ‘কোলকাতা পত্তনকারী’। সেকালে ভাগ্যান্বেষী বণিকের দল কলকাতার দিকেই নিজেদের পাল্লা ভারী রেখেছিল। সপ্তগ্রাম বন্দরের মৃত্যু, সরস্বতী নদীর ক্ষীণতর ধারা আবার হুগলীর মোহনা থেকে দূরত্ব মাথায় রেখেও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হুগলী থেকে কিঞ্চিৎ দুরত্বের সুযোগ-সুবিধা বেশি ছিল। রেশুম-তুলো উৎপাদনের স্বর্গ ছিল গোবিন্দপুরের শেঠ-বসাকদের হাতে। অদূরে সুতানুটির হাট ছিল স্বদেশি বণিকদের হাতে। ফলে ভাগ্যের পরিবর্তন যে কলকাতাতেই সম্ভব, তা বুঝতে বেশি দেরি করেনি গোরা বণিকের দল। তবু ইংরেজের শহর কলকাতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় জোব চার্নকের হাতেই, একথা অস্বীকার করা যায় না।
সন্ধে হয়ে এল। বৃষ্টি আসছে আবার। ভিডিও ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ওরা তিনজন ফেরার পথ ধরল। ঘোড়াদের মাঝে, ভেঙে আসা ক্রিকেট ম্যাচের ভিতর দিয়ে, সাদা পুলিশের পাশ দিয়ে, দামী জাগুয়ারের গায়ে হাত বুলিয়ে ওরা ফিরছে। এই ময়দানে তিনজন আসে, বসে, মুহূর্ত বন্দি করে, আলোচনা ঝগড়া করে, প্রেমের স্বপ্ন দ্যাখে, জীবন অনিশ্চিত তবু নিশ্চিন্ত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। কিশোরীটি ভাবে, ময়দানে এসে কত গল্প হয়, তবু ময়দানের গল্পটা বন্ধুদের বলা হয়ে ওঠে না। কেন যে শুনতে চায় না!
পলাশীর যুদ্ধে জয়ের পর পুরনো বিধ্বস্ত ফোর্ট উইলিয়ামে স্থানাভাব দেখা দেয়। গোবিন্দপুরের দক্ষিনে দ্বিতীয় দুর্গের প্রয়োজন পড়লে, দ্বিতীয় ফোর্ট উইলিয়াম গঠনের উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণের সময় ময়দানের সৃষ্টি হয়। ১৭৯১ বিঘার সুবিশাল জমির মধ্যে মাত্র ৫৭ বিঘা ছিল গোবিন্দপুরের অংশ। এই অংশেই রেশম-তুলার বাণিজ্য, শেঠ-বসাকদের বাস, এবং স্থানটি জনসংখ্যার নিরিখে ঘিঞ্জি। দ্বিতীয় ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির সময় গ্রামের অধিবাসীদের জমি ও অর্থ দ্বারা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, স্থান পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়, শেঠ-বসাকরা সুতানুটি হাটে (অধুনা বড়বাজার) স্থানে উঠে আসে। এবং ইংরেজ বণিকদের কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠার স্থানের পরিবর্তে সম্পূর্ণ মিলিটারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দ্বিতীয় অর্থাৎ আজকের ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেইসাথে গঙ্গা থেকে যে বিরাট জঙ্গলটি চৌরঙ্গী গ্রামটিকে আলাদা করে রাখত, সেই জঙ্গলটি কেটে আজকের ময়দানের সৃষ্টি হয়।
বছর দশেক আগের সেই ওরা তিনজন আজ আর নেই। সুদিনের অপেক্ষায় কেটে গেছে একটি দশক। কেউ গোঁড়া হয়েছে, কেউ ভেসে গেছে, আবার কেউ একইরকম এলোমেলো সন্দিহান রয়ে গেছে। শহরের কথা ভেবে দ্যাখেনি। মুহূর্তরা যন্ত্রবন্দি থেকে থেকে ডিলিটেড। ময়দানের লাল-চা দাদা এখনও আছেন। ক্রিকেটের দল, সাদা পুলিশ, ঘোড়সওয়ার, ভুলে গেছে কেউ কেউ ভুল স্বপ্নে বিভোর ছিল। কেউ কেউ গান্ধীমূর্তির কাছ থেকে পুরনো রেশম কুঠির কথা ভাবত, অথবা কেউ একটা চাকরি খুঁজে বেড়াত সারাদিন আর বিকেলে ময়দানে বসে ইয়ার্কি দিয়ে মুহূর্ত ওড়াত। ভুলে যাওয়া দল, ভেঙে যাওয়া প্রত্যয়, মাঝে হুগলী নদী বইছে। বয়ে যাবে।
ঋণ স্বীকারঃ
১) কলিকাতার ইতিবৃত্ত – প্রাণকৃষ্ণ দত্ত
২) কলকাতা – শ্রীপান্থ

