
বিসর্জন: দেবতার শূন্যতা, মানবতার আবিষ্কার সায়ন ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর নাটক নিয়ে আলোচনার আগে একটা বিষয় একটু স্পষ্ট করে নেওয়া যাক— আমি কোন রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছোতে চাইছি। বহুর মধ্যে দিয়ে অর্থাৎ ‘বহু’ ভাবনার রবীন্দ্রনাথ নয়, ‘বহুত্ব’-এর ভাবনার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আর সেই সঙ্গে ‘থিয়েটারের’ মানুষ রবীন্দ্রনাথকে দেখাই আমার প্রধান প্রতিপাদ্য বা বয়ান এই লেখার। মনের মধ্যে ‘বিসর্জন’ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা এলেই— প্রথম ও প্রাথমিক প্রশ্ন মাথায় আসে তা হল রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অভিনেতা রূপে এই নাটকে অবতীর্ণ হলেন কেন? শেক্সপীয়ারের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং ‘অভিনেতা’র ভূমিকায়। একজন ‘অভিনেতা’র মূল শিল্প-দর্শন বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব করা। আর তাছাড়া তিনি স্বয়ং স্বীকার করেছেন ‘শেক্সপীয়ারের নাটক আমাদের কাছে বরাবর নাটকের আদর্শ’।
মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর থেকে স্বাদেশিকতাবোধ সাহিত্যে প্রধান হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশের ইতিহাস চেতনামূলক নাটক লেখা শুরু করেন। তিনি বাংলা নাটককে খানিকটা সংস্কৃত প্রভাবমুক্ত করেছিলেন। তাঁর ভাষা ও পাত্রপাত্রীর আচরণ অনেকটাই বস্তুনিষ্ঠ ছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অন্যান্যi জমিদারী বাড়িগুলোর মতই, তখনকার রীতি অনুসারে নাটক অভিনীত হতো। গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় চৌধুরী, যদুনাথ মুখোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণবিহারী সেনের কমিটি অব ফাইভ-এর আগে থেকেই পারিবারিক পরিবেশে সৌখিন নাট্যপ্রচেষ্টার পরিচয় দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথের ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ। তিনি ‘বাবুবিলাস’ যাত্রা বা নাটকে বাড়ীর সবাইকে আসরে নামিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নাট্যগোষ্ঠী অভিনয় করেছিলো মাইকেলের ‘কৃষ্ণকুমারী’ এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা’। ঠাকুরবাড়ির আর একজন অন্যতম নাট্যকার, যাঁকে ঘিরে আজকে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস— তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বলছেন – ‘মানুষ যদি শুধু মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিত তবে লোকালয়ই মানুষের একমাত্র মিলনক্ষেত্র হইত। কিন্তু মানুষের জন্মতো কেবলমাত্র লোকালয়ে নহে। এই বিশাল বিশ্বে তাহার জন্ম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাহার প্রাণের গভীর সম্বন্ধ আছে। তাহার ইন্দ্রিয়বোধের তারে তারে প্রতিমুহূর্তে স্পন্দন নানা রূপে রসে জাগিয়ে উঠিতেছে’। যাঁর দার্প্রশনিক প্রতিভা এদেশের নাটককে কেবলমাত্র ব্যবসায়ী রঙ্গমঞ্চ অবলম্বন করে বিস্তার লাভের পথ থেকে সরিয়ে এনে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিল এবং বাংলা নাটককে সেই যুগে ব্যবসায়ী রঙ্গমঞ্চের অধীনতা থেকে মুক্ত করে আনে; শুধু নাটক লিখে নয়, অভিনয় রীতি এবং মঞ্চ সম্পর্কে তাঁর মৌলিক চিন্তাচেতনায়। ইউরোপীয়দের নকল না করে, সমস্ত রকম বাহুল্য বর্জন করে মঞ্চকে অভিনয়ের যোগ্য করাই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য।
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ নাটকে বরাবর এই দুটি ভাবের বিরোধ বেধেছে— প্রেম আর প্রতাপ। রঘুপতির প্রভুত্বের ইচ্ছার সঙ্গে গোবিন্দমাণিক্যের প্রেমের শক্তির দ্বন্দ্ব বেধেছিল। রাজা প্রেমকে জয়যুক্ত করতে চান, রাজপুরোহিত নিজের প্রভুত্বকে। নাটকের শেষে রঘুপতিকে হার মানতে হয়েছিল। তাঁর চৈতন্য হল, বোঝবার বাধা দূর হল, প্রেম হল জয়যুক্ত।” বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ এইভাবেই ‘বিসর্জন’ নাটকের পরিচয় তুলে ধরেছে। নাটকটির পাঠের অন্তর্বয়নে আমরা দেখতে পাব গোবিন্দমাণিক্যের প্রেম এবং রঘুপতির প্রতাপের দ্বন্দ্বের ভাবনাই এই নাটকের বিষয়বস্তু নয়। এই দ্বন্দ্ব প্রেম এবং প্রতাপের নয়, রাজার প্রতাপের সাথে রাজপুরোহিতের প্রতাপের দ্বন্দ্ব। ব্রাহ্মণ্যবাদ বনাম মানবতাবাদের যে চরম লক্ষ্য তার দিকেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি। কিন্তু প্রতাপের সঙ্গে প্রতাপের দ্বন্দ্ব-বিরোধ খোঁজার মাধ্যমে ‘বিসর্জন’ নাটকের প্লট হাতড়ানোই কেবল হবে। নাটকের শেষে জয়সিংহের প্রাণ বিসর্জনের ভেতর দিয়ে জীবিতদের মনে যে অসামান্য জীবনবোধনের আবিষ্কারপর্ব উদ্ভাসিত হয় তাকে নিতান্তই উপেক্ষা করা হবে। বরং এভাবে ‘বিসর্জনে’র পরিচয় তুলে ধরার মধ্যে নাটককে কেবল মানবদ্বন্দ্বের প্রতিরূপায়ণ বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু এর ফলে (‘বিসর্জন’) নাটক যে অবশেষে কবিতাও তাই অস্বীকার করা হয়। ‘বিসর্জনে’র অন্তরালবর্তী কবিত্বের আবহ খুঁজে পাওয়ার শর্তে এই লেখার শুরুতেই আমরা অনুমানরূপে প্রস্তাব করব এ আসলে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবনের জয়গান করার নাটক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবন দেবতাকে খুঁজে পেতে চান যে বারবার। গ্রীক ট্রাজেডির মতো করুন রাগিনী শুনিয়ে যায় মানুষের হৃদয়সংগীত। জয়সিংহের প্রাণ বিসর্জন অর্থাৎ তার স্বেচ্ছায় মৃত্যু-বরণ এর ভেতরের নাটক ঘনিয়ে তুলেছে। তাই এই লেখায় গোবিন্দমাণিক্যের প্রেম এবং রঘুপতির প্রতাপের দ্বন্দ্বের রেখায় ‘বিসর্জন’ পাঠ থেকে সরে গিয়ে বরং জয়সিংহের চরিত্র নির্মাণ, এই চরিত্রায়নের ধারণাগত কাঠামো ও পরিণতি নির্ধারণের কৌশলগত এবং ভাবগত প্রেক্ষিতগুলোর উন্মোচনে মনোনিবেশ করবো। মৃত্যুর মতো বেদনাময় সৌন্দর্য। প্রেমই তো মৃত্যুকে মহিমান্বিত করেছে।জয়সিংহ মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যু দিয়ে জীবিতের পক্ষে কী সুযোগ হাসিল করা সম্ভব? কিন্তু এই নাটকে ‘মৃত্যু একটা উপলক্ষ্য মাত্র’। এই উপলক্ষ্যের প্রকৃত লক্ষ্য নির্ণয় করতে শঙ্খ ঘোষ-এর ভাবনার দিকে চোখ পারি আমরা—
“তর্কে অথবা তত্ত্বে যেন অনেকটা অস্ফূট হয়ে আসে আমাদের জীবন, সহজ সম্পর্কের মাঝখানে একটা বাধা তৈরি হয় যেন। তেমন-কোনো তর্কের মধ্য দিয়ে নয়, সমগ্র সত্তার মধ্য দিয়ে জীবনকে পেতে চান একজন কবি, এ বিশ্বকে তিনি দেখতে চান তার সমগ্র স্বরূপে। এমন কবিস্বভাবের কয়েকটি মানুষকে প্রায়ই আমরা দেখতে পাব রবীন্দ্রনাথের নাটকে। কবি বলে তাদের কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি অবশ্য, তাদের পরিচয় আছে কেবল তাদের বেদনার গাঢ়তায়, অনুভবের সত্যে।”
গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য, হেঁয়ালিনাট্য, ঋতুনাট্য, তত্ত্বনাট্য, প্রহসন, রূপান্তর ও নামান্তর সব মিলিয়ে মোট সত্তরটির মতো নাটক বা নাটক জাতীয় রচনার এক বিশাল ভাণ্ডার সামনে রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একথা বলা ভুল হবে না রবীন্দ্রনাথ যা কিছু ‘Performed’ ( যার মূল parfornir অর্থ ‘কিছু করা, সম্পূর্ণ রূপে করার চেষ্টা) হবার জন্য লিখেছেন সবই নাটক। সেই অর্থে গীতিনাট্য বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা, নৃত্যনাট্য শাপমোচন, শ্যামা, ঋতুনাট্য নবীন, শ্রাবণগাথা সবই নাটক। বিচিত্র রসের বিচিত্র রূপের নাটক। তাই আমরা দেখতে পাই বাঙালির নাট্যচর্চায় হোক সে পেশাদার মঞ্চে, ঘরোয়া পরিবেশে, স্কুল কলেজের সংস্কৃতি চর্চার আসরে রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেন বারে বারে এবং সফল ভাবে। প্রত্যেক নাট্যকার তাঁর সমকালীন দর্শকদের তৃপ্ত করেই কালজয়ী নাটক রচনা করে থাকেন। এলিজাবেথীয় দর্শকদের ভালোলাগার এবং দৈনন্দিন জীবনের বিষয়বস্তু শেক্সপীয়র তার নাটকে যেমন তুলে এনেছিলেন, নরওয়ের ইবসেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথও। যদিও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভালোলাগা ও দৈনন্দিন জীবনের তারতম্য ব্যাপক। কিন্তু তার মধ্য থেকেই দুই নাট্যকারই স্বীয় প্রতিভায় মানব চরিত্রের জটিল দ্বন্দ্ব, অনন্ত জিজ্ঞাসা, অসীম উপলব্ধি ও অন্যান্য কাব্যিক রসকে তাঁদের বিশ্বসাহিত্যে বাঙ্ময় করে রেখেছেন। শুধু বাহ্য আড়ম্বর ও দৃশ্যময়তা এঁদের নাটককে বিশ্বজনীনই করে তোলেনি বরং সমকালকে তৃপ্ত করে তাঁরা শ্রেণী সীমানা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁদের রচনা কালোত্তীর্ণ। মলিয়ের, শেক্সপীয়র, ইবসেন এঁদের তুলনায় সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সর্ম্পক ছিল না। কিন্তু সাধারণ রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথ মোটেই অপরিচিত ছিলেন না। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বৌঠাকুরানীর হাট’, ‘বসন্ত রায়’ নামে অভিনীত হয় ১৮৮৬ সালের জুলাই মাসে এবং জনপ্রিয়তাও পায়। ১৯০১-এর এপ্রিলেও মিনার্ভায় তা অভিনীত হয়েছিলো। সাধারণ রঙ্গমঞ্চ আকস্মিক নতুন উদ্যমের আনুকূল্য লাভ করেছিল রবীন্দ্রনাথেরই নাটক থেকে। তিনি ১৮৮৯-তে লিখলেন ‘রাজা ও রানী’, এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক এবং শেক্সপীয়রীয় রীতিতে লেখা নাট্যকাব্য। তার এক বছর পরেই ‘বিসর্জন’। রবীন্দ্রনাথের এই দুটি নাটকই বাংলা নাটক সাহিত্যে সবচেয়ে শেক্সপীয়রনিষ্ঠ নাটক, যার চরিত্রের অন্তর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে বাইরের সংঘাতের মধ্য দিয়ে। দুটি নাটকেই, তুলনামূলকভাবে ‘বির্সজন’-এ বেশি, কাব্যের ছন্দোবদ্ধ বিন্যাস রয়েছে। সংলাপের গতিশীলতা এবং কাব্যিক গভীরতা— যা একান্তই শেক্সপীয়রীয়, বহুলাংশে রক্ষিত। সমগ্র বাংলা নাট্যসাহিত্যে একমাত্র ‘রাজা ও রানী’ এবং ‘বির্সজন’— এ দুটি নাটককে বিবেচনা করা হয় খাঁটি মহৎ ‘দৃশ্য-কাব্য’, যা দৃশ্য না হলেও কাব্য। যে দৃশ্যকাব্যের ব্যখায় (অৎরংঃড়ঃষব) বলেছেন ‘অভিনয় ছাড়াও যার আস্বাদ করা চলে। অভিনব গুপ্ত বলেছেন— অভিনয় ছাড়াই নাট্যের বাক্যাংশ থেকে রসের উপলব্ধি হয়। রবীন্দ্রনাথ থিয়েটার সর্ম্পকে সিদ্ধান্তে আসেন এই বলে ‘থিয়েটারকে হতে হবে এক ধরনের নাচ, যার গতিভঙ্গীর তাল মিল রেখে চলবে কবিতার তালের পরে। বাস্তব বা প্রাত্যহিক জীবনের কাছাকাছি অঙ্গভঙ্গী এর চলাফেরার উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমের নিয়মিত পদ্য-আবৃত্তি দেখার মতো কিম্ভুত আর কিছুই নেই’।
“রঘুপতি: রাজার ভাণ্ডারে এসেছি/বলির পশু সংগ্রহ করিতে।
গোবিন্দ: মন্দিরেতে জীববলি এ বৎসর হতে/হইল নিষেধ।
[…]
রঘুপতি: এ কি স্বপ্নে শুনি?
গোবিন্দ: স্বপ্ন নহে প্রভু! এতদিন স্বপ্নে ছিনু,/আজ জাগরণ। বালিকার মূর্তি ধ’রে/স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন,/জীবরক্ত সহে না তাঁহার।
রঘুপতি: এতদিন/সহিল কী করে? সহস্র বৎসর ধ’রে/রক্ত করেছেন পান, আজি এ অরুচি!
গোবিন্দ: করেন নি পান। মুখ ফিরাতেন দেবী/করিতে শোণিতপাত তোমরা যখন।
রঘুপতি: মহারাজ, কী করিছ ভালো করে ভেবে/ দেখো। শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নহে।
গোবিন্দ: সকল শাস্ত্রের বড়ো দেবীর আদেশ।
রঘুপতি: একে ভ্রান্তি, তাহে অহংকার! অজ্ঞ নর,/তুমি শুধু শুনিয়াছ দেবীর আদেশ,?আমি শুনি নাই?
[…]
গোবিন্দ: দেবী-আজ্ঞা নিত্যকাল ধ্বনিছে জগতে।/ সেই তো বধিরতম যেজন সে বাণী/ শুনেও শুনে না।”
এই সংলাপিকাগুলোয় দেখতে পাচ্ছি ব্রাহ্মণ রঘুপতি ও রাজা গোবিন্দমাণিক্যের পরস্পর নির্ভরশীল একটি সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক ব্রাহ্মণের দিক থেকে অর্থনৈতিক ও রাজার দিক থেকে সাংস্কৃতিক। ধর্মাচারের জন্য প্রথা অনুযায়ী বলিদান করতে ব্রাহ্মণকে রাজার উপরে নির্ভর করতে হয়, যা অর্থনৈতিক। আর শাস্ত্রবিধি জেনে ধর্মগত জীবনের জন্য পুরোহিতকে প্রভু সম্বোধন করে রাজাকেও নির্ভর করতে হয় ব্রাহ্মণের উপরে, রাজার এই নির্ভরশীলতা সাংস্কৃতিক। আকস্মিকভাবে, বলিদানে নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের সাংস্কৃতিক নির্ভরতা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন ব্রাহ্মণ রঘুপতির অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত আসে। শাস্ত্রবিধির প্রতি এই আঘাতকে রঘুপতি চিহ্নিত করে ‘রাজদর্প’ হিসেবে। প্রথাশাসিত রাজ্যে রাজা নিজের অস্তিত্বকে সংবিধিবদ্ধ করতে খোদ ধর্মকে নয়, নিষিদ্ধ করেন জীববলি। রাজা ধর্মাচারের প্রথাগত প্রণালী সংস্কার করতে চান। গোবিন্দমাণিক্যের এই সংস্কার-বাসনাকেই রঘুপতি ধর্মে প্রত্যাঘাত বিবেচনা করেন। এখানে দেখা যায় উভয়ই ধর্মরক্ষা করতে চান। এই বিরোধের তলে একটি প্রশ্নেরও অবতারণা ঘটে— ধর্মের রক্ষাকারী কে? যাজক না রাজন? সেই প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় ধর্মরক্ষার নামেই পরস্পরবিরোধী দুই শক্তির মধ্যে বিরোধ ঘটে। এই বিরোধের মূলে আমরা দেখছি ধর্মাচারের প্রণালী সংক্রান্ত রাজা ও ব্রাহ্মণের পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যার বিরোধ। আর ব্যাখ্যা যখন বিরোধ তৈরি করে তখন ক্ষমতার চর্চা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ফলে ব্যাখ্যার রাজনীতি পথ পায়। মৃত্যু নামের বেদনাময় সৌন্দর্যের এই নাটকের উপরিকাঠামো গড়ে ওঠে রঘুপতি ও গোবিন্দমাণিক্যের রাজনৈতিক বিরোধের ফলে। এটাই হলো জ্ঞানের রাজনীতি। রাতের আঁধারে বলি দিতে নিয়ে গেলেও রঘুপতির সাথে মদ্যপানে মেতে সকাল হলে রাজা খবর পেয়ে যান, তারপর রঘুপতির এবং নক্ষত্ররায়ের আট বছরের নির্বাসনদন্ড দেন। কিন্তু রঘুপতি দু’দিন সময় চেয়ে নেন রাজার কাছে। আসলে এই সেবক মানতে পারছিলেন না তার পরাজয়। এ জন্য যখন রাজা দেবীর স্বপ্নে প্রাপ্ত আদেশের কথা বলে বলি নিষিদ্ধ করেন তখন সে বলে উঠেছিল,
”একে ভ্রান্তি,তাহে অহংকার!অজ্ঞ নর,
তুমি শুধু শুনিয়াছো দেবীর আদেশ,
আমি শুনি নাই,”
বলির মতো একটি নৃশংস প্রথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভয়ের বাতাবরণ শুরু করে। মানুষের অজ্ঞতাই রাষ্ট্রের শাসন প্রণালী চালিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় পুঁজী। গোবিমাণিক্যের মধ্যে আদর্শ শাসকের স্বপ্ন বীজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম সহায়। গোবিন্দমানিক্যের সঙ্গে রঘুপতির দ্বন্দ্ব এক হিসেবে জাত শক্তির দ্বন্দ্ব বলা যায়। জাতিতে ব্রাহ্মণ রঘুপতি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবে ক্ষত্রিয় রাজার কাছে। তাই তার মেনে নিতে কষ্ট হয় রাজার নির্দেশ। সে তাই রাজহত্যার মতো পাপের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সবচেয়ে আপন স্নেহের জয়সিংহ যখন দেবীর রক্তলিপ্সা মেটাতে আত্মত্যাগ করে, নিজের রক্তে ভাসিয়ে দেয় মন্দির, রঘুপতি সেদিন বুঝতে পারে তার নিজের ভুল। নিজেকে ধিক্কার দিতে গিয়ে সে দেবীরূপী মাকেও ধিক্কার দেওয়া শুরু করে—
”শুনিতে কি
পাস?আছে কর্ণ?জানিস কি করেছিস?
কার রক্ত করেছিস পান?কোন পুণ্যজীবনের?কোন স্নেহদয়াপ্রীতি ভরা
মহাহৃদয়ের?”
অবশেষে রঘুপতি জগতের বুক হালকা করতে গোমতীর জলে প্রতিমা নিক্ষেপ করে।
গুণবতী পূজা নিয়ে আসে, সে তার রাজা, রাজ্য সব ছেড়েছে শুধু প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে। কিন্তু রঘুপতির মুখে তখন নতুন বুলি, দেবী কোথায় এর উত্তরে বলে—
”কোথাও সে
নাই।ঊর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও সে
নাই,কোথাও সে ছিলনা কখনো।”
গুণবতী। দেবী নাই!
রঘুপতি। দেবী নাই?
গুণবতী। দেবী নাই!তবে কে রয়েছে?
রঘুপতি। কেহ নাই কিছু নাই!
দেবী বল তারে?
পুণ্যরক্ত পান করে সে মহারাক্ষসী
ফেটে মরে গেছে।”
সব শেষে যে অপর্ণাকে রঘুপতি সহ্য করতে পারতোনা, জয়সিংহের মন ভোলাচ্ছে ভেবে, তার মুখে পিতা ডাক শুনে তার অশ্রু বয়ে যায়। জয়সিংহ তার নিজ রক্ত দিয়ে নিভিয়ে গেছে হিংসারক্তশিখা।
এখানে কৌতূহলের বিষয় হলো, গোবিন্দমাণিক্য আর রঘুপতি বিশ্বাসের যে রাজনীতিতে লিপ্ত থাকে সেখানে দেখা যায় ‘তাঁরা অহংকে বর্জন’ করতে পারেনি, যে অহং বিষয়ে আসক্ত। তাঁরা সেই আত্মাকেও অমান্য করেছে যে আত্মা সকল আত্মার সঙ্গে যোগে যুক্ত। কিন্তু বিপরীত দিকে জয়সিংহ— যে স্বাভাবিক জ্ঞানশক্তিকর্ম অন্তহীন দেশে কালে প্রকাশমান তাকেই প্রাণ বিসর্জনের ভিতর দিয়ে আমাদের কাছে উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। জয়সিংহের প্রাণ বিসর্জন তাই মৃত্যু নয়, অন্তহীন দেশকালের সমগ্রের সাথে খণ্ডিত অস্তিত্বের যোগেরই নামমাত্র। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্ম নিয়ে যা বলতে চেয়েছেন মানুষ হিসেবে জয়সিংহ যেন নিজের ধর্ম পালনে তাই করে দেখিয়েছেন। কারণ, ‘মানুষের ধর্ম’ বলতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে উচ্চারণ করেছেন, “আমার মন আর বিশ্বমন একই, এই কথাই সত্যসাধনার মূলে।” জয়সিংহ মানবসত্যের আদর্শ ধারণা দিয়ে রচিত এক চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ নিজেও যেমন ‘মানবসত্য’ রচনায় লিখেছেন মানুষের জন্মভূমি তিনটি— মানুষের প্রথম বাসস্থান পৃথিবী। দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। তার তৃতীয় বাসস্থান আত্মিকলোক। সেটাকে তিনি বলেছেন সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ। “অন্তরে অন্তরে সকল মানুষের যোগের ক্ষেত্র এই চিত্তলোক। কারো চিত্ত হয়তো বা সংকীর্ণ বেড়া দিয়ে ঘেরা, কারো বা বিকৃতির দ্বারা বিপরীত। কিন্তু, একটি ব্যাপক চিত্ত আছে যা ব্যক্তিগত নয়, বিশ্বগত। সেটির পরিচয় অকস্মাৎ পাই। একদিন আহ্বান আসে। অকস্মাৎ মানুষ সত্যের জন্যে প্রাণ দিতে উৎসুক হয়। […] তখন বুঝি মনের মধ্যে একটা দিক আছে যেটা সর্বমানবের চিত্তের দিকে।” ব্যক্তিগত চিত্তের সংকীর্ণ স্বার্থদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ যখন গোবিন্দমাণিক্য ও রঘুপতি, বিশ্বাসের সহজ সত্যের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তখন জয়সিংহ প্রমাণ করে যে এমন মৃত্যু আদতে সর্বমানবের চিত্তলোকের দিকে শুধু অভিযাত্রা নয়, গন্তব্যেরও নির্ধারক। আমরা যদি প্রশ্ন তুলি জয়সিংহ সত্যের জন্যে নিজের প্রাণ বিসর্জনের আত্মশক্তি সঞ্চয় করল কীভাবে? এই উত্তরের সপক্ষে আবারও রবীন্দ্রনাথকেই উচ্চারণ করব—
“কিসের জোরে মানুষ প্রাণকে করছে তুচ্ছ, দুঃখকে করছে বরণ, অন্যায়ের দুর্দান্ত প্রতাপকে উপেক্ষা করছে
বিনা উপকরণে, বুক পেতে নিচ্ছে অবিচারের দুঃসহ মৃত্যুশেল। তার কারণ, মানুষের মধ্যে শুধু কেবল তার প্রাণ নেই, আছে তার মহিমা।” প্রাণটুকু ফিজিক্যাল বা শারীরিক, কিন্তু মহিমা শরীর-উত্তীর্ণ মেটাফিজিক্যাল, আর সেই কারণেই তা স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক। এই পার্থিব সংসারে বিশ্বাসের রাজনীতি দিয়ে জর্জরিত প্রাণকে বিসর্জনের মাধ্যমে জয়সিংহ অবারিত জগতের সাথে নিজেকে স্থাপন করেছে বিশ্বাসেরই আধ্যাত্মিক নীতির প্রয়োগে।

