শেষ পর্ব– ঋতায়তে রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ পর্ব– ঋতায়তে রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

আটের দশকের মফসসল শহরে বেড়ে উঠছিল একটি মেয়ে। ঋতি। এক অসুস্থ শৈশবে, ভিড়ের মধ্যেও নির্জনে তার বড়ো হয়ে ওঠা। একটু যত্ন, সামান্য ভালোবাসা না পাওয়া কাঙাল এই মেয়েটির বড়ো হয়ে ওঠা এই উপন্যাসের বিষয়। দমবদ্ধ এক পারিবারিক আবহে অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরা মেয়েটির জীবন, তার লড়াই! নারী হিসেবে, অসুন্দর হিসেবে, গরীব হিসেবে এই সমাজ মানসের সঙ্গে তার একার লড়াই। পাশে রয়েছে মা, নিরুপায়, অসহায়। তবু অদম্য জেদ ঋতিকে এগিয়ে দিয়েছে। যদিও এই উপন্যাস ঋতির ক্ষরণের ইতিহাস। তার নির্মল মন, তার নিখাদ ভালোবাসার ক্ষরণ। সমকাল, তার মনবদল, নববইয়ের বিচিত্র পট পরিবর্তন সবই ছুঁয়ে আছে এই উপন্যাসের শরীর! ঋতি কি শেষপর্যন্ত পৌঁছোতে পারবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে! আজ প্রকাশিত হল উপন্যাসের শেষ পর্ব।

 

 

১০১

মিতালীদি ঋতির সঙ্গে কলেজে পড়ায়। অবিবাহিত। কিন্তু একজন বিবাহিত মানুষের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। মিতালীদি একদিন ঋতিকে গল্প করে ওর কথা বলেছিল। এই কলেজে অ্যাপ্রুভাল না আসার পর থেকেই ঋতি সহ বাকি দুজন প্রিন্সিপাল স্যারের চোখে বিষ হয়ে উঠেছে। বিশেষত তারা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সহায়তায় এখন পুরো বছরটা কাজ করতে পারছে এটা প্রিন্সিপাল স্যার খুবই ইগোয় নিয়ে ফেলেছেন। তিনি জানেন ঋতি এদের নেতা। তাই ঋতির ওপর রাগটা বেশি। যখন তখন স্টাফ রুমে ঋতিকে অপমান করেন। যেমন সবাই বসে কথা বলছে। ঋতিও দু একটা কথা বলছে। প্রিন্সিপাল স্যার ওমনি ঋতির দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ধমকের স্বরে বলবেন, এই আস্তে কথা বলো! 

ঋতি একথার কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার রাগ হয়। সে একদৃষ্টে প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাতে কাজও হয়। প্রিন্সিপাল স্যার বাধ্য হন স্টাফরুম থেকে নিজের ঘরে চলে যেতে। ঋতি জানে এই কলেজে তার পজিশন অত্যন্ত নড়বড়ে। তাকে এখানে টিকে থাকতে হবে যতক্ষণ না একটা ফুলটাইম চাকরি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে পায়ের তলায় ঋতি পড়ে থাকবে না। মুখে কিছু না বললেও সে আচরণে বুঝিয়ে দেয় তাকে দমিয়ে রাখা সহজ হবে না। মিতালীদি এইসব পরিস্থিতিতে ঋতির পাশে দাঁড়ায়। ঋতিকে সাপোর্ট দেয়। কয়েকদিনের মধ্যেই ঋতি আর মিতালীর একটা ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। মিতালীদি সুতনুদার সঙ্গেও তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সুতনুদাও অধ্যাপক। মিতালীদি আর সুতনুদার সঙ্গ ঋতির ভালো লাগে। সুতনুদা মিতালীদিকে ভীষণ ভালোবাসে। মিতালীদির সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার আগে থেকেই সুতনুদার সঙ্গে ওর স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। মিতালীদি সুতনুদার জীবনে আসার পর সুতনুদা ডিভোর্স চেয়েছিল। কিন্তু পায়নি। ফলে সুতনুদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে থাকতে শুরু করে। সুতনুদার লেখালেখি করার অভ্যেস আছে। একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সেসব নিয়ে ওঁরা ব্যস্ত থাকেন। মিতালীদির জীবনের সবটুকু জুড়ে আছেন সুতনুদা। মিতালীদিকে আনন্দ দেওয়া, ভালো রাখাই সুতনুদার জীবনের একমাত্র চাওয়া। সুতনুদা মিতালীদিকে প্রচুর জামাকাপড় ও আনুষঙ্গিক বহু কিছু কিনে দেয়। পুজোর সময় মিতালীদির প্রায় শখানেক নতুন জামাকাপড় হয়। তাছাড়া দামি পার্লারে যাওয়া, দামি টেলরের কাছে জামা বানানো, দামি জুতো, ব্যাগ, গয়না কি নেই মিতালীদির। ঋতিকেও মিতালী কখনো কখনো এসব জায়গায় নিয়ে গেছে। ঋতি দেখেছে ওসব তার সাধ্যের বাইরে। তাছাড়া ওঁরা প্রায় রোজই কোনো না কোনো কফি ক্যাফে বা শপিং মলে আড্ডা মারে, খাওয়া দাওয়া করে। সেসবও ভীষণ এক্সপেনসিভ! ঋতি মিতালীদির কাছে গল্প শোনে। ভাবে স্নেহময়দা যদি তার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসত, কেমন হতো! খুব ভালো কিছু হতো না বোধহয়! সত্যিই তো মধুদিকে তো স্নেহময়দা ভালোবাসে! ঋতিকেও না হয় একটু ভালোবাসত! তার সঙ্গেও সপ্তাহে একদিন করে না হয় দেখা করত! তাকেও ভালোবেসে কিছু গিফ্ট করত! ঋতি তো এতো বই পড়তে ভালোবাসে! স্নেহময়দা বইয়ের মতো একটা নির্ভেজাল উপহারও কখনো ঋতিকে দেয়নি। ঋতি একবারই রাগ করে স্নেহময়দার সঙ্গে সুতনুদার তুলনা করেছিল। স্নেহময়দা রেগে গিয়ে বলেছিল, তুলনা করবিনা একদম। আমি যা পারবনা, তা পারবনা! 

ঋতি তারপরও স্নেহময়কে ভালোবাসে! আশ্চর্য কিন্তু! এতো অপমানিত হওয়ার পরও ভালোবাসা থাকে! ঋতির কি মাথার কোনো গোলমাল আছে! ঋতি একটা মানুষে আটকে গেছে! হাজার অপমানেও সেখান থেকে সরে আসছে না! এমন তো হয়, কারো কারো মস্তিষ্কে কোনো কোনো মানুষের ছবি এমনভাবে আটকে যায় যে সে সেই ছবিটাকে আর উপেক্ষা করতে পারেনা। ওই ছবিটার আইডিয়াটাকে আঁকড়ে বাঁচতে থাকে। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও ওই আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড থেকে সে বেরোতে পারে না। ঋতির মস্তিষ্কেও কি তেমন কিছু ঘটছে! 

যাই হোক, মিতালীর বাড়িতে এসে ঋতি থাকতে শুরু করল। একতলার একটা ঘরে ঋতির থাকার ব্যবস্থা। সে ঘরে টেবিল, আলমারি আর একটা ভীষণ সরু খাট আছে। খাটটা ছাড়া আর কোনো কিছুই ঋতি ব্যবহার করতে পারবে না। ওগুলোতে মিতালীদের জিনিসপত্র, বই ইত্যাদি রয়েছে। ঋতির বই রাখা হলো একতলার রান্নাঘরে তাকে। জামাকাপড় যে বড়ো সুটকেসে ভরে এনেছিল তার মধ্যেই থাকল। বাথরুম রয়েছে নিচের তলায় দুটো। একটা ঋতি ব্যবহার করবে, আর একটা মিতালীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য। খাওয়া- দাওয়া মিতালীদেরই দেওয়ার কথা। থাকা খাওয়া বাবদ মিতালী সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা চাইল। ঋতি দমদমের কলেজ থেকে পায় আট হাজার টাকা। সাড়ে পাঁচ হাজার মিতালীদিকে দিলে তার থাকবে আড়াই হাজার টাকা। সেই দিয়ে যাতায়াত থেকে শুরু করে প্যাড – সবটা চালাতে হবে। বনগাঁর কলেজটা থেকে সে যেটুকু টাকা পায় তা অনিয়মিত। বিপদের দিনের জন্য সেই টাকাটা রাখতে হবে। প্রথম দুদিন মিতালীদির মা খুব যত্ন করে খাওয়ালো। ঋতি এতো অল্প খায় বলে অভিযোগ করল। ঋতিকে দোতলার একটা ঘরে ঘুমোতে বলল। নিচের ঘরে কোনো আয়না নেই। ঋতি দোতলায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হয়ে কলেজে গেল। কিন্তু দুদিন পর থেকেই নানারকম অসুবিধে দেখা দিতে লাগল। মিতালীদির এক আত্মীয় ওদের বাড়িতে বেড়াতে এলে মিতালীদি তাকে নিচের তলায় ঘুমোতে বলল। ঋতি বোকার মতো বলে ফেলল, খাট নেই তো! 

ওমা! তোর ঘরে যে খাটটা আছে! 

ঋতি অবাক হয়ে ভাবল ওটা তো তোষক পাতা বেঞ্চি একটা। ওটায় ঘুমবো কি করে! 

ঋতি উত্তর দিচ্ছে না দেখে মিতালী বলল, ওই খাটটায় আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত একা ঘুমোতাম। 

ঋতির মনে হলো একবার বলে ক্লাস সেভেনের মেয়ে আর একটা আঠাশ বছরের মেয়ের শোয়ার জায়গাটা এক হতে পারে! ঋতিরা তিনজন একখাটে ঘুমতো। তবু তো একরকম ছিল! এই বেঞ্চিটা যাকে মিতালীদি খাট বলছে তাতে কেমন করে শোবে ঋতি! তারপর একতলায় তো আর কেউ থাকে না। একা একা একটা বাড়ির একতলায় ঘুমোতে ঋতির তো ভীষণ ভয় করবে! কি করবে ঋতি! কিন্তু যত ভয়ই লাগুক, উপায় নেই। এভাবেই ঘুমোতে হবে। প্রথমদিন রাতে ঋতি চোখ বন্ধ করে হাতড়ে লাইটটা নিভিয়ে মাথা মুড়িয়ে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুতেই চোখ খুলছে না। তার ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে ঘরের ভেতরে কে যেন দাঁড়িয়ে! কিন্তু এভাবে কতক্ষণ থাকবে! ঋতি দেখল এ ঘরের ফ্যানটা ভীষণ আস্তে চলে। গরমে সে ঘেমে যাচ্ছে! ফলে বাধ্য হলো ঢাকা সরিয়ে দিতে। তাকিয়ে দেখল রাস্তার আলোতে ঘরটা বেশ আবছা আলো হয়ে আছে। তার ভয়টা একটু কমল। কিন্তু ফ্যানটা ফুল স্পিডে দেওয়া সত্ত্বেও এতো আস্তে ঘুরছে কেন! ঋতির খুব গরম লাগছে। ঋতি উঠে লাইট জ্বালিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরোলো। দেখল ডাইনিং রুমে ফ্যান লাগানো নেই। পাশের ঘরটায় ফ্যান আছে। ঋতি পাশের ঘরে ঢুকে লাইট,ফ্যান জ্বালিয়ে দিল। এই ফ্যানটায় বেশ জোরে হাওয়া হচ্ছে। ঋতি খানিকক্ষণ ফ্যানের তলায় দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! ঘুমোতে হবে তো! ঋতি আবার গুটিগুটি তার জন্য বরাদ্দ ঘরটাতে ঘুমোতে গেল। কিন্তু ঘুম এলো না। গরমে ছটফট করে রাত কাটালো ঋতি।

পরদিন সকালে চা খাওয়ার জন্য ওপরে উঠে ঋতি মিতালীদিকে ফ্যানের ব্যাপারটা বলল। 

মিতালীদি বলল, ওই ফ্যানটা ওরকম আস্তেই চলে রে! হাওয়া কম হয়। 

ও, তাহলে! 

তাহলে তো কিছু করার নেই বল! 

ঋতি একটু উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল, মিতালীদি, তোমাদের পাশের ঘরের ফ্যানটা ভালো চলে। ওটা মিস্ত্রি ডেকে এই ঘরটায় লাগিয়ে দেবে? 

মিতালীদি মুখ ব্যাজার করে বলল, না রে, আমার ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে তো! ওদের অসুবিধে হবে। 

ঋতির মনে হলো একবার বলে, তোমার ছাত্রছাত্রীদের সপ্তাহে একদিন দু ঘণ্টার জন্য অসুবিধে হবে। আর আমার তো প্রতিটা দিন রাত, যতক্ষণ আমি বাড়ি থাকব অসুবিধে হবে। কিন্তু ঋতি কেমন করে যেন বুঝল ঋতির জন্য এটুকু মিতালীদি করবেনা। ঋতি চুপ করে গেল।

স্নান সেরে রেডি হতে ওপরে যেতেই মিতালীদির মা বলল, ঋতি, তুমি এবার একটা আয়না কিনে ফেল। যখন তখন ওপরে এসো না! 

ঋতি খুব অবাক হলো। তার মনে হলো মিতালীদি তো জানে ঋতি কি পরিস্থিতিতে এখানে এসেছে। বন্ধু হিসেবে পাশে থাকার বদলে এরা কেমন যেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাড়িওয়ালা হয়ে উঠেছে! তাও ঋতি শুরুতেই সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা হাতে দিয়েছে। মিতালীদিই বলেছে, মাসের শুরুতে সেই মাসের টাকাটা দিয়ে দিস। নইলে মার অসুবিধে হবে। ঋতি খুব অবাক হয়েছে। ঋতি এ বাড়িতে একবেলা খায়। টাকা না দিলে সেটাও অসুবিধে হয়ে যাবে! যাই হোক, সেদিন কলেজ সেরে ঋতি কাঁচের দোকানে গিয়ে আয়না কিনে আনল। দেওয়ালে একটা পেরেক মারাই ছিল। তাতে আয়নাটা লাগিয়ে দেখা গেল ঋতির মুখটা অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। ঋতি মিতালীদিকে বলল, আর একটা পেরেক একটু নিচু করে যদি লাগানো যেত! 

না রে দেওয়ালে অতো পেরেক লাগানো যাবে না।  দেখতে খারাপ লাগবে!

দরজার পিছনে তো মিতালীদি! দেখাই তো যাবে না!

না রে। হবে না। 

ঋতি খুব অবাক হলো, এরকম ব্যবহার করছে কেন এরা! ঋতি তো আর জোর করে ঢুকে পরেনি এদের বাড়িতে! বিনা পয়সায় আছে এমনটাও নয়! তাহলে! 

রবিবার সকাল থেকে মিতালীর পড়ানো থাকে। মিতালী ঋতির ঘরটাতেও ছাত্রছাত্রীদের বসায়। দু ঘরে দুটো ব্যাচের পড়া চলে। প্রায় দেড়টার সময় ওরা ঘর থেকে বেরলো। ঋতি স্নানে যাবে বলে তোড়জোড় করছে এমন সময় ওপর থেকে খেতে ডাকল। ঋতি বলল, কাকিমা, আমার তো এখনো স্নান হয়নি!

কেন! এতোক্ষণ কি করছিলে! 

এতোক্ষণ তো মিতালীদি পড়াচ্ছিল। 

তাতে কি হয়েছে! তুমি স্নান করে নাওনি কেন! 

আমি স্নান করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে জামাকাপড় পরব কোথায়!

বাথরুম থেকে জামাকাপড় পরে বেরোবে। 

ঋতি আর কথা বাড়ালো না। খুব ছোটো থেকেই স্নান করে গা মুছে ফ্যানের তলায় না দাঁড়ালে ঋতি দরদর করে ঘামতে থাকে। ওর চিরকালের অভ্যেস স্নান করে ভিজে গায়ে গামছা জড়িয়ে ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে জামাকাপড় পরে। একথা এদের বোঝানো যাবে না। ঋতি বলল, কাকিমা, তোমরা খেয়ে নাও। আমি পরে খাব। 

কাকিমা মুখটা গম্ভীর করে রাখল। উত্তর করল না। 

রবিবার বলে ঋতি সারা সপ্তাহের জামাকাপড় কাচবে বলে ভিজিয়ে রেখেছে। সেগুলো কাচতে খানিকটা সময় তো লাগবেই। কিন্তু দশ মিনিটও গেল না! কাকিমা ওপর থেকে চেঁচাতে শুরু করল, ঋতি, তোমার হলো! স্নান করতে কতক্ষণ লাগে! উপর্যুপরি এতো চিৎকার করছে যে ঋতি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। তার মনে পড়ছিল পিরিয়ডের সময় বাথরুমে দেরি হলে জ্যেঠু এভাবেই চিৎকার করত। ঋতি তাড়াহুড়ো করতে লাগল। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। কোনোরকমে জামাকাপড় কাচা শেষ করে জলটা কোমডে ফেলতে গিয়ে একটা জাঙিয়া জলের সঙ্গে কোমডে পড়ে গেল। ঋতি ঘেন্নাপিত্তির মাথা খেয়ে সেটা তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ওটা জলের তোড়ে অনেকটা ভেতরে চলে গেছে। ঋতি কোনোরকমে দু মগ জল মাথায় ঢেলে নিয়ে জামাকাপড় পরে ওপরে গেল। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিতালীদি বলল, ঋতি, আমাদের বাড়ির একটা নিয়ম আছে। দেড়টা মানে দেড়টাতেই সকলে খেতে বসে। এখন দুটো দশ বাজছে! 

ঋতি মুখটা কাচুমাচু করে বলল, তোমরা খাওনি এখনো!

আমরা খেয়ে নিয়েছি। কিন্তু মার পক্ষে এতোক্ষণ তোর জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। 

ঋতির তখন চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে! কথা বলতে পারছে না। কোনোরকমে দুটো খেয়ে ও নিচে নেমে গেল। 

সোমবার তিনটে অবধি কলেজ করে ঋতি চারটের মধ্যে ফিরে এসেছে। বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। প্রচণ্ড মশা ওকে ছেঁকে ধরেছে। ভ্যানভ্যান করছে একেবারে। ঋতি আবার বেল বাজালো। তারও কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলল কাকিমা। বলল, এতোবার বেল বাজাচ্ছো কেন! ওপর থেকে আসতে সময় লাগবে না! 

এখানে আসলে খুব মশা তো! 

তা তুমি এখন! কলেজ শেষ হয়ে গেল! 

হ্যাঁ, ঋতি ছোটো করে উত্তর দিল। 

ও, তার মানে তুমি রোজ এই সময়ই আসবে! আমি এইসময়টা একটু ঘুমোই। 

ঋতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। কলেজ শেষ হয়ে গেলে সে কি করবে তাহলে! বাড়ি ফিরবে না! 

রাতে মিতালীদি ফিরলে ঋতি বলল, তোমাদের একতলার গেটের চাবিটা আমাকে দিলে আমি নিজের মতো যাতায়াত করতে পারি। কাকিমাকে বারবার দরজা খুলতে নিচে নামতে হয় না। 

খেপেছিস না কি! বাড়ির চাবি কেউ কাউকে দেয়! 

আসলে মিতালীদি কাকিমা দুপুরে ঘুমোন তো। আমি এলে অসুবিধে হয়।

তুই তাহলে আরো কিছুক্ষণ কলেজে কাটিয়ে বা লাইব্রেরিতে কাটিয়ে বাড়ি ফিরিস। তাহলে আর অসুবিধে হবে না। আমি তো কোনোদিনই কলেজ থেকে বাড়ি আসিনা। সুতনুর সঙ্গে দেখা করা থাকে। 

ঋতি অসহায়ের মতো ভাবল, আমার যে কোনো সুতনু নেই মিতালীদি। আমি কোথায় যাব! কার কাছে যাব! 

বনগাঁর দিকের কলেজটার জন্য ঋতিকে সকাল ছটায় বেরোতে হয়। একটা বিস্কুট আর চা খেয়ে ঋতি বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় দশ টাকা দিয়ে একটা কেক কিনে নেয়। ওটাই ব্রেকফাস্টে খাবে! ফিরতে ফিরতে তিনটে বাজে। তিনটের সময় এসে যে ঋতি ভাত খাবে এটাই তো স্বাভাবিক! তবু ভোরবেলা ঋতি বেরোনোর সময় কাকিমা জিজ্ঞেস করবেই, তুমি কি দুপুরে খাবে? 

ঋতির মনে হয় এই উত্তর দেওয়া তো বাহুল্য! ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুপুরে ফিরে মানুষ তো খাবেই! রোজ জিজ্ঞেস করে কেন! ঋতি কোনোরকমে তাড়াতাড়ি করে হ্যাঁ বলে নিচে নেমে যায়! এ বাড়িতে খাওয়াটা যেন তার কাছে লজ্জাজনক হয়ে উঠেছে। খাওয়ায় কথা ছিল না, তবু খাচ্ছে, এমন একটা ভাব।নামতে নামতে ঋতি শোনে কাকিমা বলছে, দুবেলা হিসেব করে বাড়িতে খাবে! খুব হিসেবি মেয়ে যা হোক! 

ঋতি লজ্জায় আরো গুটিয়ে যায়। 

দেখতে দেখতে পরের রবিবার এসে গেছে। ঋতি পাঁচটার সময় উঠে জামাকাপড় ভিজিয়ে, কেচে, সাড়ে ছটার মধ্যে স্নান করে রেডি হয়ে নিল। এক তো সাতটা থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসবে! দ্বিতীয়ত, কোমডে সেদিন জাঙিয়া পড়ে যাওয়ায় কোমড দিয়ে জল যাচ্ছে না। ঋতি পরদিন কোমড ব্যবহার করেই বুঝেছে সমস্যা হয়েছে। জল ঢেলেও কিছুতেই কোমডের ময়লা যাচ্ছিল না। উল্টে উপচে আসছে। সে এক নরক যন্ত্রণা হয়েছিল ঋতির সেদিন! কোনোরকমে লম্বা একটা লোহার শিক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নোংরা পরিষ্কার করেছিল ঋতি। তারপর থেকে ঋতি লুকিয়ে লুকিয়ে পাশের বাথরুমটা ব্যবহার করছে। ওই বাথরুমে ইন্ডিয়ান সিস্টেম। মেঝে ভাঙা। তাই দিয়ে বিছে, পিঁপড়ে উঠে আসে। ঋতি কোনোরকমে কাজ মিটিয়ে উঠে আসে। যতক্ষণ বসে ততক্ষণ ভাবে এই বুঝি বিছে কামড়ে দিল! ফলে সে সকাল সকাল স্নান সেরে নিল। দুপুরে এদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজন বেড়াতে এলো। আজ অনেকরকম রান্নাবান্না করেছে কাকিমা। পোলাও, মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, পায়েস আরো কত কি! চারজন চারজন করে খেতে দেওয়া হচ্ছে। ঋতিকে সবার শেষে খেতে ডাকল। ঋতি দেখল তার জন্য সাদা ভাত বাড়া হয়েছে। কাকিমা বলল, ঋতি, শোনোনা, পোলাও, মাংস সব শেষ হয়ে গেছে। কালকের ডিমের তরকারি আছে। এই দিয়ে আজ খেয়ে নাও।

ঋতির তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে! তার মনে হচ্ছে এ বাড়িতে তার খাওয়ার বন্দোবস্ত না করলেই হতো। সে নিচে দুটো সেদ্ধ ফুটিয়ে নিয়ে খেয়ে নিত না হয়! এদের ভালো খাবারও তার চাইনা! এতো অপমানও আর সে নিতে পারছে না। 

 

১০২

ঋতির পিএইচডির জন্য লাইব্রেরির কাজ শেষ হয়ে গেছে। লেখাটাও ছোটো ছোটো করে ঋতি লিখে ফেলেছে। কিন্তু তারপর আর কাজ এগোয়নি। বাড়িতে শেষের দিকে এতো অশান্তি হচ্ছিল যে ঋতি মন দিয়ে আর পড়াশোনা করতে পারছিল না। এখানে এসেও সে বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। মা আর সে চলে আসার পর থেকে অশান্তি আরো বেড়েছে বই কমেনি। জ্যেঠু মাকে ফোন করে দেখা করতে বলেছিল। 

মা জানিয়ে দিয়েছে মা দেখা করতে পারবে না। 

জ্যেঠু তখন বলেছে, তোমার এতো স্পর্ধা! তুমি আমাকে না বলো! 

কেন! আপনি কি ভগবান যে আপনার মুখের ওপর কথা বলা যাবে না!

জ্যেঠু তার উত্তরে কি বলেছে ঋতি জানে না। তবে জ্যেঠু মাকে বলেছে, আমি নাকি তোমার সংসার ভেঙেছি! তুমি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছ! 

আমি কাউকেই কোনো কথা বলিনি। এসব আপনার মনগড়া! আর তাছাড়া এটাই সত্যি। আপনি দিনের পর দিন আপনার ভাইকে প্রশ্রয় দিয়েছেন! মেয়ে, বৌয়ের নামে নিন্দে করলে মজা পেয়েছেন। আপনি সৎ হলে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন! আমাদেরও কিছু বলার থাকতে পারে আপনার ভাইয়ের বিষয়ে। 

তা বেশ তো! তুমি তো কোনোদিন আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করে কিছু বলোনি! বললে নিশ্চয়ই শুনতাম! 

ওটাই চেয়েছিলেন বুঝি! ভাইয়ের বৌ আপনার পা ধরে কাঁদবে! আর আপনি অভিভাবকত্ব ফলাবেন! শুনুন, আমি আপনাকে দেখে আপনার ভাইকে বিয়ে করিনি। তাই আপনার কাছে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। বলে শ্রী ফোনটা কেটে দিয়েছে। 

একদিকে যখন এসব চলছে অন্যদিকে তখন শ্রীর আত্মীয় মহলেও খবরটা ছড়িয়ে গেছে। শ্রী অনন্তকে ছেড়ে চলে এসেছে। আত্মীয়রা শ্রীকে ফোন করছে। কেউ কেউ বেশ বিরক্ত। এই বয়সে এই নাটকটা না করলেই চলছিল না! মেয়ে না হয় ছোটো! তোর তো বয়স হয়েছে! 

শ্রী এসব কথার উত্তর দেয়নি। অনন্তকে যারা বাইরে থেকে দেখেছে তারা ভাবতেও পারবেনা অনন্তর মনের মধ্যে কি বিষ! সেই বিষের দংশন থেকে শ্রী তো ছেড়েই দাও, ঋতিও বাঁচতে পারেনি! 

বাড়ি ছেড়ে চলে আসার প্রায় দেড়মাস বাদে শ্রী আর ঋতি একবার ফ্ল্যাটে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তারা যখন চলে এসেছিল তখনও গরম ছিল। ফলে শীতের জামাকাপড়, কাঁথা কম্বল কোনোকিছুর কথাই মনে ছিল না ওদের। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে শীত পড়তে শুরু করেছে। তখন বাধ্য হয়েই শ্রী আর ঋতি একদিন ব্যারাকপুরে গেল। অনন্ত বাড়িতেই ছিল। শ্রী আর ঋতি ফ্ল্যাটে ঢুকে শীতের জামাকাপড় বের করল। একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছে তখন অনন্ত শুরু করল… হ্যাঁ, দেখে নাও, আমার সংসার থেকে আর কি কি নিয়ে যাওয়ার আছে! নিয়ে যাও! সব নিয়ে যাও! শালা আমি বুঝলামই না আমি কি অপরাধ করলাম যে একেবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো! এখন মেয়ের পয়সায় বসে খাচ্ছে! ভালোই! মায়ের আর কিছু না থাক জেদ আছে ষোলো আনা! আর মেয়েটা তো গাধা! আমি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই কোনোদিন সরকারি চাকরি পাবি না! আমি এই পৈতে ছুঁয়ে অভিশাপ দিলাম তোকে! 

ঋতি আর শ্রী কিন্তু এসব কথার কোনো উত্তর করেনি। যেমন চুপচাপ গেছিল, তেমন চুপচাপ চলে এসেছে। অনন্তর চিৎকারে পাড়ার লোক আবার একবার উঁকিঝুঁকি মারার সুযোগ পেয়ে গেছে এই আর কি! আসার পথে বাসে বসেই ঋতি কাঁদছিল। বাবা তাকে অভিশাপ দিল! বাবার চোখে এতো বিষ হয়ে উঠেছে তার একমাত্র সন্তান! ঋতির মতো বাধ্য মেয়ে হয়েও আজ এই দিনটা ঋতিকে দেখতে হলো! এতো কটু কথা শুনতে হলো! 

সেদিন দুপুরে ঋতি বনগাঁ স্টেশনে বসে আছে। একটা ট্রেন চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। ঋতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। ট্রেনে ওঠার চেষ্টাও করল না। ও এখন এই স্টেশনের একদম শেষ প্রান্তে বসে থাকবে দু ঘন্টা। সাড়ে চারটে নাগাদ যে ট্রেনটা আসবে সেটাতে করে মিতালীদির বাড়ি ফিরবে। ঋতির দুপুরের খাওয়া উঠে গেছে। এই স্টেশনেই দশটাকার মধ্যে সে কিছু একটা খেয়ে নেয়। বিকেলে ওদের বাড়িতে চা বিস্কুট খায়। যদিও ওইটুকু খেয়ে ঋতির পেট ভরে না। খিদেয় পেটের মধ্যে গোঁ গোঁ আওয়াজ হয়। জিভ দিয়ে নাল কাটে। মুখে বিশ্রী গন্ধ হয়। কিন্তু উপায় কি! কাকিমা ঘুমের অজুহাত দেখিয়ে ঋতির বাড়ি ফেরার রাস্তাটা বন্ধ করে দিয়েছে। খেতে না দিক, অন্তত বাড়ি ফিরে স্নান করে ঋতি একটু শুতে তো পারে! সেই উপায়টুকুও রাখেনি! স্টেশনের সিমেন্টের চেয়ারে পিঠটা হেলান দিয়ে ঋতি এসব ভাবছিল। ঋতি এখন যেখানে আছে তার খুব কাছেই স্নেহময়দাদের আদিবাড়ি। স্নেহময়দা প্রায়ই সেখানে যাতায়াত করে। কখনো ঋতির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেনি। বাড়ি থেকে চলে আসার পর স্নেহময়দা আরোই যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে! হয়তো ভাবছে ঋতি একা আছে! এই অবস্থায় দেখা করলে কোনো সমস্যা হতে পারে! স্নেহময়ের সম্মানহানি হতে পারে! ঋতিও আনডিউ কোনো অ্যাডভান্টেজ চাইতে পারে। স্নেহময়ের পক্ষে ঋতির কোনো কথা রাখা সম্ভব হবে না। বাড়ি থেকে নিজের দায়িত্বে বেরিয়ে এসেছে যখন নিজেই নিজেকে সামলাক! ঋতি এসব ভাবছিল বসে বসে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ঋতির গাইড ফোন করেছেন। শোনো সামনের সপ্তাহে তোমার প্রিসাবমিশন সেমিনার অ্যারেঞ্জ করছি! 

ঋতি চমকে উঠেছে! প্রিসাবমিশন! কিন্তু সে তো একেবারেই প্রস্তুত নয়! 

ঋতিকে চুপ করে থাকতে দেখে গাইড বললেন, কি! অসুবিধে নেই তো! 

দিদি, আমার তো কিছু রেডি হয়নি! 

রেডি হয়নি আবার কি! তোমার কাজ তো হয়ে গেছে! লিখেও ফেলেছ অনেকটা! এবার প্রিসাবটা করে নাও। 

দিদি, আমি পারব না! ঋতি কাতর হয়ে বলে উঠল।

পারবেনা মানে! পারবেনা কেন! পারতে তো তোমাকে হবেই ঋতি! গাইড খানিকটা রেগে উঠলেন। 

না, দিদি, আমাকে ছেড়ে দিন! আমি পারব না! 

গাইড এবার বেশ রেগে বলে উঠলেন, ঋতি, আজ শুক্রবার। আমি তোমাকে দুদিন সময় দিচ্ছি। তুমি সোমবার ইউনিভার্সিটিতে প্রিসাবের জন্য প্রিপারেশন নিয়ে আসবে। যেটা ওইদিন বলবে সেটা লিখে নিয়ে আসবে। আমি আর অন্য কোনো কথা শুনতে চাই না! ফোনটা কেটে গেল। 

ঋতি খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো বসে রইল। কি হবে এবার! দুদিনে সে কি করে রেডি করবে নিজেকে! ঋতির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ভীষণ টেনশন হচ্ছে তার। ইশ্, আজ যদি একটু আগে ফেরা যেত! আজ সন্ধেটা কাজে লাগানো যেত! ঋতি স্টেশনে বসে বসে ছটফট করতে লাগল। 

কোনোরকমে স্টেশন থেকে প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরে ঋতি বলল, কাকিমা, আমি চা খাব না। একেবারে রাতে ওপরে যাব। বলে সে নিজের ঘরে ঢুকে আগে ভালো করে স্নান করল। তারপর লিখতে বসল। সাড়ে নটানাগাদ একবার উঠে ওপর থেকে খেয়ে এসে আবারও লিখতে লাগল। পড়ার পাশাপাশি লেখার কাজটা চলছে। পরদিন শনিবার ঋতি ছুটি নিল। সারাদিনে স্নান -খাওয়ার সময়টুকু বাদে টানা পড়ালেখা করে গেল। রবিবার বিকেল নাগাদ প্রায় পাঁচ হাজার শব্দে তার প্রিসাবমিশনের পেপারটা রেডি হলো। ঋতি শুক্রবার দুপুরে বনগাঁ স্টেশনে বসেও ভাবতে পারেনি সে লেখাটা শেষপর্যন্ত তৈরি করতে পারবে! আজ লেখাটা হাতে নিয়ে বসে তার পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল! সে পেরেছে! সে এতোদিন বাদে আবার পড়াশোনা করে লিখতে পেরেছে! ঋতি আনন্দে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলো। তার মনে হচ্ছে এখনি এই প্রবন্ধটা কাউকে পড়ে শোনায়! ও দেখল সুতনুদা এসেছে। সুতনুদাকেই ঋতি অনুরোধ করল ওর লেখাটা শোনার জন্য। সুতনুদা অধ্যাপক! এতো ছেলেমেয়েকে পিএইচডি করায়! যদিও বিষয় আলাদা। কিন্তু সুতনুদা এতো ভালো কবিতা লেখে! ও নিশ্চয়ই বুঝবে লেখাটা কেমন হয়েছে! সুতনুদাও রাজি হয়ে গেলেন। ঋতি খুব যত্ন করে লেখাটা পড়তে শুরু করল। কিন্তু একপাতাও পড়া হয়নি, সুতনু ঋতিকে থামিয়ে দিলেন! বললেন, ঋতি এটা কি ভাষায় লিখেছ! এ তো একেবারে সেকেলে ভাষা! এই ভাষায় আজকাল কেউ লেখে না কি! তুমি আধুনিক লেখাপত্র পড়ো না! 

ঋতির ভেতরে যে আলোটা জ্বলে উঠেছিল সেই একশো পাওয়ারের বাল্বটাকে কেউ যেন ইঁট মেরে ভেঙে দিল। ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ল। ঋতি আর পড়ল না। সুতনুদা লেখাটা নিয়ে আরো নানা মন্তব্য করলেন। ঋতি কোনো উত্তর করল না। সুতনুদার কথা শুনে মাথা নেড়ে নিচে নেমে এলো। রাতেও কিছু খেলো না! কাল সোমবার! কালই তো যেতে হবে গাইডের কাছে! ওঁর ও নিশ্চয়ই অপছন্দ হবে বিষয়টা! কিন্তু ঋতি এখন কি করবে! নতুন করে লেখার তো সময় নেই! আর নতুন করে কি লিখবে সেটাই তো ঋতি বুঝতে পারছে না! 

পরদিন বেলার দিকে ঋতি যখন গাইডের কাছে পৌঁছোলো তখন ওর শরীরে আর একফোঁটা শক্তিও বেঁচে নেই। শরীরটাকে টেনে টেনে ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে পৌঁছে তার মনে হচ্ছিল সে পড়ে যাবে এবার! পা দুটো ভার হয়ে অবশ হয়ে গেছে। হাতদুটো সামনে ঝুঁকে পড়েছে। পিঠটা বেঁকে গেছে। ঋতি প্রায় টলতে টলতে ডিপার্টমেন্টে পৌঁছোলো। গাইডের চেম্বারে বসে গাইড লেখাটা দেখতে শুরু করলেন। ঋতি জানে লেখাটা হয়নি। উনি হয়তো লেখাটা ছুঁড়ে ফেলে দেবেন এখনি। ঋতির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখনি অজ্ঞান হয়ে যাবে ও। 

গাইড কিন্তু মন দিয়ে লেখাটা পড়ছেন। কোনো কথা বলছেন না। 

ঋতির মাথাটা ক্রমশ নিচু হয়ে যাচ্ছে। এবার বোধহয় টেবিলে মাথাটা ঠুকে যাবে! তাকে অপমানিত হতে হবে। কাল যেমন সুতনুদা বড্ড সেকেলে বলে এই লেখা রিজেক্ট করেছে, দিদিও তাইই করবেন! এতো অধঃপতন ঋতির। এই ক’বছরে ঋতি বছরে পাঁচটা ছটা করে সেমিনার প্রেজেন্টেশন করেছে। কোনোদিন কোথাও তার লেখা রিজেক্টেড হয়নি। উল্টে সেরার সেরা হিসেবে সে তাবড় তাবড় অধ্যাপকদের প্রশংসা পেয়েছে। আর আজ কি না তার নিজের কাজের ক্ষেত্রে সে এভাবে ফেল করল। ঋতি এসব ভাবছে আর তার চোখটা কালো হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছে সে! সব যেন ধোঁয়া ধোঁয়া! 

এমন সময় দিদি বলে উঠলেন, খুব ভালো কাজ হয়েছে তোমার! 

ঋতি একমুহূর্তে চমকে উঠেছে! বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সে গাইডের দিকে। 

গাইড আবার বললেন, খুব ভালো লেখা হয়েছে ঋতি! শুধু শুধু তুমি ভয় পাচ্ছিলে! এতো ভালো কাজ করেছ! এতো ভালো গবেষণা তোমার! গোটা বাংলা ডিসিপ্লিনে এ বিষয়ে এইটাই প্রথম ও এখনো পর্যন্ত একমাত্র কাজ হতে চলেছে! তুমি কোথায় কনফিডেন্টলি প্রিসাব দেবে, তা না! তুমি কিসব বলছিলে সেদিন! 

ঋতি অবাক হয়ে গাইডের কথা শুনছে! তার বিশ্বাস হচ্ছে না যা সে শুনছে সেটা সত্যি! 

গাইড আরো অনেক প্রশংসা করলেন ঋতির। 

ঋতি তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দিদি! এই লেখাটা কি খুব সেকেলে!

সেকেলে মানে!

মানে পুরনো দিনের ভাষা! এই ভাষায় এখন আর কেউ লেখে না, এমন? 

কে বলেছে তোমাকে এই কথাটা? 

ঋতি চুপ করে গেল। কি বলবে সে! 

গাইড কিন্তু ঋতিকে জোর করলেন, বলো ঋতি, একথা তোমায় কে বলেছে? 

সুতনু মিত্র।

মানে কবি সুতনু মিত্র? তাকে তুমি পেলে কোথায়? 

তার বন্ধুর বাড়িতেই তো আমি এখন থাকি! উনি বললেন, লেখাটা কিছু হয়নি! 

আমি তোমাকে এবার খুব বকব ঋতি। প্রথমত, তুমি তোমার অপ্রকাশিত গবেষণা নিয়ে গাইড ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথা বলেছ কেন! তুমি জানো তোমার কত বড়ো বিপদ হতে পারে! দ্বিতীয়ত, গবেষণাপত্র লেখার একটা নিজস্ব ভাষা বৈশিষ্ট্য থাকে। চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের ভাষায় কেউ গবেষণাপত্র লেখে না। আর সুতনু মিত্র! উনি আগে কবিতাটা লিখতে শিখুন! তারপর না হয় গবেষণাপত্রের ভাষা নিয়ে মন্তব্য করবেন। তুমি খুব অন্যায় করেছ তোমার লেখা ওঁকে পড়িয়ে। এইরকম ভুল আর কোনোদিন করো না। 

ঋতি গাইডের সবকথা শুনে এতোক্ষণ পর মনে মনে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠল। আগামী শুক্রবার তার প্রিসাবমিশন। ঋতি মনে মনে তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।

 

১০৩

প্রিসাবমিশনের দিন ঋতিকে খুবই আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। ঋতির উপস্থাপনা চমৎকার হয়েছে। পুরো বিষয়টিকে ইতিহাস ও যুক্তি পরম্পরার নিরিখে সে প্রেজেন্ট করেছে। ফলে অধ্যাপকরা খুবই খুশি হলেন। তারপর শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। ঋতিকে নানা বাঁকা প্রশ্ন করে যাচাই করে নিতে চাইলেন কেউ কেউ। ঋতি কিন্তু প্রত্যেকটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিল। তার কাজের খামতি নির্দেশ করতে চাইছিলেন কেউ কেউ। ঋতি নির্বাচিত অংশ গ্রহণ ও বর্জনের কারণ স্পষ্ট ভাষায় জানালো। গাইড বসেছিলেন তাঁর সঙ্গে। তাঁকে আলাদা করে ঋতির হয়ে কোনো কথা বলতে হলো না। আরো অনেকেই সেদিন প্রিসাবমিশন করলেন। কেউ কেউ ভালো করলেন, কারো কারো আবার রিসার্চ প্রায় ক্যানসেল হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো। ঋতির প্রশংসা করলেন সকলেই। 

রাতে মিতালীদির বাড়ি ফিরে ঋতি মাকে ফোনে সব জানালো। শ্রী খুশি হলো। মেয়েটাকে নিয়ে শ্রীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই! মিতালীর বাড়িতে মেয়েটার খুব অযত্ন হচ্ছে। নানা অসুবিধে মুখ বুঁজে সহ্য করছে। মেয়েটাকে যে নিজের কাছে এনে রাখবে তারও উপায় নেই! টুয়ার মেয়ে নানা অশান্তি করে। শ্রীর মা, কাকুকে সে বাইরের লোক বলে মনে করে। মনে করে নিনান, কাকু তার মায়ের ফ্ল্যাট দখল করে বসে আছে। টুয়া প্রথম থেকেই জানিয়ে দিয়েছে এই ফ্ল্যাট তাকে চঞ্চলদা কিনে দিয়েছে। এই ফ্ল্যাট তার। আত্মীয়দের কাছে অবশ্য বিষয়টা লুকিয়ে রাখা আছে। তবে আত্মীয় স্বজনকে বিশেষ বোকা ভাবার কারণ নেই। যাই হোক, টুয়ার মেয়ে বুড়োবুড়িদের সঙ্গে থাকতে খুবই বিরক্ত। তার মধ্যে আবার বড়ো মাসি এসে উঠেছে। ঋতিকেও নিয়ে এলে সে এতো অশান্তি করবে যে শ্রীও আর এখানে টিকতে পারবে না। ফলে কষ্ট করে ঋতিকে মিতালীদের বাড়িতে পড়ে থাকতে হচ্ছে। এসব নিয়ে শ্রী খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। 

ঋতি মাকে ফোন করে ওপরে খেতে এলো। আজ মিতালীদি নেই। বেড়াতে গেছে। ঋতি খেতে বসবে এমন সময় গাইড ফোন করলেন। ঋতি তাড়াতাড়ি ফোন ধরেছে। 

আজ আমি খুব খুশি হয়েছি ঋতি! তুমি যেভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছ, আমি ভাবতেই পারিনি! 

থ্যাঙ্কু দিদি। আপনি পাশে না থাকলে পারতাম না দিদি! ঋতির গলাটা ভারি হয়ে এলো। 

না ঋতি, আজকে যা হলো তার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ তোমার। ইউনিভার্সিটিতে তো নানারকম পলিটিক্স চলে! একজনের স্কলারকে অন্যজন আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। তোমাকেও বিষয় বহির্ভূত প্রশ্ন করে নাজেহাল করার চেষ্টা হলো। কিন্তু তুমি এতো গুছিয়ে উত্তর দিয়েছ যে আর কোনো কথা বলার সুযোগ পায়নি কেউ। 

ঋতি একথার উত্তর দিতে যাবে এমন সময় কাকিমা চেঁচিয়ে উঠলো, খেতে দিয়েছি ঋতি! খেয়ে যাও। 

ঋতি ইশারা করে ওকে আসছে বলল। তারপর উত্তর দিতে শুরু করল, দিদি, আমি তো খুব ভেঙে পড়েছি। আপনি সেদিন বকুনি দিয়ে আমার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই আজকের দিনটা হতে পারল! 

কিন্তু এই কথাগুলো ঋতি বলতেই পারছে না। ক্রমাগত কাকিমা বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে চলেছে। খেয়ে যাও ঋতি! আমি কতক্ষণ বসে থাকব। ঋতি! ঋতি! 

ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পেয়ে অবস্থা বুঝে গাইড বললেন, যাও তুমি খেয়ে নাও আগে। পরে কথা হবে। 

ঋতি তাড়াতাড়ি ফোনটা রেখে দিল। কাকিমাকে বলল, আমার গাইড ফোন করেছিলেন। দরকারি কথা বলছিলেন। 

আগে খেয়ে নাও। তারপর কথা বলো। আমি খাবার আগলে এতোক্ষণ বসে থাকতে পারব না! 

ঋতি আর কথা বাড়ালো না। খেয়ে দেয়ে থালা ধুয়ে রেখে নিচে চলে এলো।

মিতালীদি ফিরলে মিতালীদিকে এই ঘটনা জানালে মিতালীদি বলল, মা ভোরে ওঠে। রাতে বেশিক্ষণ জাগতে পারে না। 

মিতালীদি আমি গল্প করছিলাম না। গাইড ফোন করেছিলেন। দরকারি কথা বলছিলাম। 

কিছু করার নেই রে। আমাদের বাড়িতে থাকতে গেলে এগুলো মানিয়ে নিতে হবে। 

ঋতি গম্ভীর মুখে উঠে গেল ওখান থেকে। তার সেদিনের আনন্দটা আজ আর মনের মধ্যে কাজ করছে না। মনটা তেঁতো হয়ে গেছে। এখান থেকে কবে যে সে মুক্তি পাবে! আদৌ কি মুক্তি পাবে! 

সেদিন দমদমের কলেজের স্টাফরুমে ঋতি চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ ঢুকল। ঋতি খুলে দেখল অচেনা নম্বর থেকে একটা মেসেজ এসেছে। পড়তে গিয়ে দেখল মেসেজটা পুলু কাকু পাঠিয়েছে। লিখেছে, ম্যাডাম, তোমার কোনো খবর জানি না। কোথায় আছ, কেমন আছ তাও জানিনা। একবার দেখা করতে চাই। সম্ভব? পারলে আমাকে একটু সময় দিও। তলায় পুলক বরাট নাম লেখা। 

ঋতি মেসেজটা পেয়ে প্রথমে কি করবে ভেবে পেল না। মনে হলো পুলু কাকুর কাছে তো তার নম্বর থাকার কথা নয়। বাবা দিয়েছে! আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলু কাকুকে ফিট করেছে। বাবার ওপর রাগটা আরো বাড়ল ঋতির। পুলু কাকুকে চারটে কড়া কথা শোনাবার জন্য সরাসরি ফোন করে বসল ঋতি! 

বলো ম্যাডাম?

হ্যাঁ, কাকু বলো কি দরকার আছে? আমি এখন কলেজে। 

তুমি আমার সঙ্গে একদিন একটু দেখা করতে পারবে? 

হ্যাঁ, দেখা করতেই পারি। কিন্তু কেন? কোনো দরকার থাকলে ফোনেও বলতে পার!

না, ফোনে বলা যাবে না। তোমার ইচ্ছে হলে দেখা করো। 

ঋতি এবার সরাসরি বলল, বাবাকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইলে আমি শুনতে আগ্রহী নই। 

না গো ম্যাডাম। তোমাদের বাবা মেয়ের মধ্যে আমি ঢোকার কে বলো! 

ঋতির এবার একটু কৌতূহল হলো। বাবাকে নিয়ে কথা নয়! তাহলে পুলু কাকু দেখা করতে চাইছে কেন! ঋতি বলল, ঠিক আছে, কাল দেখা করতে পারি। 

তবে তুমি কাল কলেজ শেষ হলে শোভাবাজার মেট্রোস্টেশনে চলে এসো।

ঠিক আছে। 

পরদিন ঋতি শোভাবাজার মেট্রোস্টশনে পৌঁছে দেখল পুলু কাকু দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হেসে বলল, চলো ম্যাডাম! 

অনেকদিন পর পরিচিত মানুষ দেখে ঋতির মনটাও একমুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। 

ওরা অটো করে গিয়ে পৌঁছলো সল্টলেকের একটি শপিং মলে। ঋতি দু একবার মিতালীদির সঙ্গে এখানে এসেছে। এসব বড়োলোকেদের জায়গা! পুলু কাকু এখানে নিয়ে এলো কেন! 

ওরা ফুডকোর্টে এক জায়গায় বসল। পুলু কাকু দুটো কফি নিয়ে কথা শুরু করল। কী হয়েছিল ম্যাডাম? তোমরা এভাবে চলে এলে? 

ঋতির ভুরু কুঁচকে উঠেছে। ঋতি বলল, কাকু, তুমি কিন্তু বলেছিলে বাবার হয়ে কোনো কথা বলবে না! 

বলছিও না। আমি তোমার কথা জানতে চাইছি। 

ঋতি একটু চুপ করে থেকে বলতে শুরু করল। এতোদিন এসব কথা মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিল ঋতি। স্নেহময়দাও তাকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি ঠিক কি কারণে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো! অধ্যাপক চন্দ্র তার বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথায় খানিক আদরের প্রলেপ বুলিয়ে তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে আবারও সেই একই আচরণ করেছে। ঋতির ভালো লাগেনি। বিরক্ত লেগেছে। তার মনে হয়েছে স্বাভাবিক নারী পুরুষের সম্পর্কেও যদি অধ্যাপক চন্দ্র যেতেন তাহলেও বলার কিছুই ছিল না। কিন্তু এ তো বিকৃতি! একেবারে বস্তুর মতো তাকে ভোগ করা! এটা মেনে নেওয়া যায় না! ঋতি আর অধ্যাপক চন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। এতোদিন পরে এই প্রথম কেউ একজন তার কথা জানতে চাইছে। 

ঋতি বলতে শুরু করল। এযাবৎ যা যা হয়েছে সব গড়গড় করে বলে গেল ঋতি। বাবার জেদ, মার আর তার প্রতি বিদ্বেষ, জ্যেঠুর বাড়ির ইন্ধন, তাদের নামে মিথ্যে কথা বলে তাদের ছোটো করা, কালি পুজোর দিন জ্যেঠু, বম্মার আচরণ সব সে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল। তার মনে হলো তার ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো যা এতোদিন জমাট অন্ধকারের মতো তার মনকে কালো করে রেখেছিল সেসব বেরিয়ে গেল। ঋতির হালকা লাগছে অনেকটা। 

পুলু কাকু ঋতিকে একবারও থামায়নি। কথা বলতে দিয়েছে। ওর কথা শেষ হলে পুলু কাকু খানিকটা সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল তোমার বন্ধুর বাড়িতে তুমি কেমন আছ? ওখানে এখন একটু ভালো আছ? 

না, কাকু। ওখানে একদম ভালো নেই! 

কেন! কি অসুবিধে হয়েছে? 

ঋতি আবার বলতে শুরু করল। মিতালীদির বাড়িতে কি কি হয়েছে তার সঙ্গে সব সে বলে ফেলল। এমনকি কোমডে জাঙিয়া পড়ে যাওয়ার ঘটনাটাও বাদ গেল না। কথা বলতে বলতে ঋতির মনে হচ্ছিল পুলু কাকু যেন তার খুব কাছের জন! এতোটা আপন এই মুহূর্তে তার কাছে কেউ নেই! কেমন হতো, যদি পুলু কাকুকে জড়িয়ে ধরে ঋতি খানিকটা পাগলের মতো কাঁদতে পারত! সেই ছোটো থেকে পুলু কাকুকে দেখছে ঋতি! পুলু কাকু চিরকালই তাকে খুব স্নেহ করে এসেছে। বাবাও যদি পুলু কাকুর মতো তাকে বুঝতে চাইত! তাকে ভালোবাসত! 

সেদিনের মতো কথা শেষ করে পুলু কাকু ঋতিকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। ঠিক করা হলো সামনের রবিবার পুলু কাকু দমদম মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা করবে। তারপর দুজনে মিলে কোথাও বসে কথা বলা যাবে। ঋতি অনেকদিন পর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরল।

 

১০৪

সামনের রবিবারের আগেই পুলু কাকুর সঙ্গে একদিন অনেকক্ষণ ফোনে কথা হলো।‌ পুলু কাকু অফিস থেকে ফোন করেছিল। পুলু কাকুও সরকারি বড়ো পোস্টে চাকরি করে। তাও অফিস থেকে এতোক্ষণ কথা বলার সুযোগ পেল। আর স্নেহময়দা তাকে একটা মেসেজ করার সুযোগ পায় না! এতোই ব্যস্ত! ঋতি মনে মনে ভাবে স্নেহময়দা প্রথম যখন শুনেছিল যে সে এতো বছর ধরে স্নেহময়দাকে ভালোবেসে এসেছে নিঃশব্দে তখন স্নেহময়দার তার প্রতি একটা কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। সেই কৌতূহলের কারণে তৈরি হওয়া আগ্রহকে স্নেহময়দা ভালোবাসা ভেবেছিল। অনিবার্যত সেখানে শরীরও এসে পড়েছিল। কিন্তু বেশিদিন নয়, খুব তাড়াতাড়ি স্নেহময়দার কৌতূহল মিটে গেছে। আগ্রহের অবসান হয়েছে। সম্পর্কের মধ্যে কেবল পড়ে থেকেছে যৌনতা! অন্তত স্নেহময়দার দিক থেকে তাই পড়ে আছে। ফলে স্নেহময়দা এই সম্পর্ককে আর কোনোভাবেই নিজের ক্লিনড ইমেজের সঙ্গে মেলাতে পারে না! হয়তো ঋতির সঙ্গে তার সম্পর্ককে সে তার জীবনের একটা চূড়ান্ত ভুল বলে মনে করে! নিজের ওপরই হয়তো স্নেহময়দা তার জন্য বিরক্ত। সেই বিরক্তিটাই ঋতির ওপরও বর্তায়। ঋতি বোঝে। ঋতি ভাবে চাকরি নেই, ঘরবাড়ি নেই, অসহায়ের মতো অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকা – এভাবেই কাটবে তার জীবনটা! খুব অদ্ভুত না যে ঋতিকে কেউ কোনোদিন প্রেম নিবেদন করেনি! অধ্যাপক চন্দ্রের যে আকুলতাকে ঋতি প্রেম ভেবেছিল সে তো আসলে বিকৃত যৌন আকর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়! কিন্তু তাছাড়া! এই যে ঋতি তিনটে ইউনির্ভাসিটিতে নানা সময়ে পড়ছে, চাকরি করছে, গবেষণা করছে, এতো লাইব্রেরিতে যাচ্ছে, এতো লোকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে কই কারো চোখে তো কোনোদিন ঋতি নিজের জন্য অন্যরকম কোনো চাওয়া দেখতে পায়নি! ট্রেনে, বাসে যাতায়াত। এতো লোকের সঙ্গে চোখাচোখি। কই কেউ তো কোনোদিন কোনো মুগ্ধতা প্রকাশ করেনি ঋতিকে দেখে! ঋতির গাল ভর্তি ব্রনর দাগ, চোখের তলার কালি গাল বেয়ে নেমে এসেছে, ক্লান্ত, বিষণ্ন কালিমাখা চেহারা… ঋতি বোঝে তাকে দেখে কারো মুগ্ধ হওয়া সম্ভবই নয়! সে ঠিক প্রেম করার মেটিরিয়াল নয়। সেই যে জয় গোস্বামীর মিতালীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ও পরে পাড়ার সেলাই দিদিমণি! তার মতো ঋতির অবস্থা। 

রবিবার পুলু কাকু ফিটফাট হয়ে এসেছে। 

ঋতিও তার সাধ্যমতো একটা চুড়িদার পড়ে গেছে। মিতালীদিকে বলেছে মার কাছে যাচ্ছে।

পুলু কাকু প্রথমেই যেটা করল, বলল, ম্যাডাম, আজ তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। তবে তার আগে একটা কাজ আছে। 

কী কাজ? একটু আমার সঙ্গে শপার্স স্টপে যেতে হবে। 

শপার্স স্টপে? কেন? 

ওই যে বললাম কাজ আছে। 

ঋতি আর প্রশ্ন করল না। এগিয়ে গেল শপার্স স্টপের দিকে। পুলু কাকু নিজের জন্য দুটো জামা, প্যান্ট ইত্যাদি কিনল। বলল, ম্যাডাম একটু পছন্দ করে দাও। 

ঋতি অবাক হলো। বলল, আমি? 

হ্যাঁ, তুমি। বাবাকে কোনোদিন পছন্দ করে জামা কিনে দাওনি!

ঋতি একথার আর উত্তর দিল না। সত্যিই বাবাকে সে কোনোদিন পছন্দ করে জামা কিনে দেয়নি। কারণ বাবা প্রায় কোনোদিন নতুন জামাই কেনেনি। বিজুর পুরনো জামাগুলো বাবা সেলাই করে নিয়ে পরে। নতুন জামা বাবার জোটে না। ঋতিও অনেকসময় সম্রাজ্ঞীর পুরনো জামা আনন্দ করে পড়েছে। কখনো কিছু মনে হয়নি। তখনও ওদের ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল না ঋতির। 

যাই হোক, ঋতি পুলু কাকুর জন্য জামা প্যান্ট পছন্দ করে দিল। পুলু কাকুরও সেগুলো খুব পছন্দ হলো। এবার পুলু কাকু লেডিস সেকসনে এসে বলল, নাও এবার এখান থেকে পছন্দ করো।

ঋতি আবার অবাক! এখান থেকে কার জন্য পছন্দ করব? 

নিজের জন্য। 

ঋতি প্রায় ছিটকে সরে এসেছে। না না, কখ্খনো না! আমার জামাকাপড় আছে। এখন লাগবে না। 

পুলু কাকু বলল, তবে আমিও রেখে আসি এগুলো। আমারও লাগবে না।

তা কেন! তুমি কেনো! 

একযাত্রায় পৃথক ফল হয় কি করে! আমি নিলে তোমাকেও নিতে হবে। আমারটা তো তুমিই কিনে দিচ্ছ। 

মানে? আমার কাছে এতো টাকা তো নেই! ঋতির গলায় সংকোচ স্পষ্ট।

শুধু টাকা দিলেই কিনে দেওয়া হয়! টাকা তো যে কেউ দিতে পারে! পছন্দটাই তো আসল! 

ঋতি একথার সামনে বাক্যহারা হয়ে গেল। ছোটো থেকে তো সে সবকিছুকে টাকার অঙ্কেই মাপতে দেখেছে! আজ হঠাৎ পুলু কাকু একদম অন্য একটা কথা বলল। ঋতি আর আপত্তি করল না। পুলু কাকু পছন্দ করে তার জন্য জামা, ব্যাগ, ছাতা এসব কিনল। ঋতি প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই খুবই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকল। কিন্তু শেষপর্যন্ত জিনিসগুলো নিল। তার কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল! এতো দামি দামি জিনিসপত্র তার জন্য আনন্দ করে কেউ কিনে দিচ্ছে সে ভাবতেই পারছে না! 

কেনাকাটি হয়ে গেলে পুলু কাকু বলল, ম্যাডাম খুব খিদে পেয়েছে। এবার একটু খেতে হবে। 

ঋতি শুধু উত্তরে মাথা নাড়ল। ভাবল, এখানে তো খাবারেরও ভীষণ দাম! 

পুলু কাকু একটা বিখ্যাত চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকল। বাফেতে খাওয়া হবে। পুলু কাকু সব ব্যাগট্যাগ নিয়ে বসে বলল, ম্যাডাম, এবার আমাকে একটু ভালো কিছু খাওয়াও। 

ঋতি আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। 

পুলু কাকু হেসে বলল, ওখানে প্লেট রাখা আছে। আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো। আমি এই বসলাম। 

ঋতি ঘুরে ঘুরে পুলু কাকুর জন্য খাবার নিল। তার নিজের জন্যেও নিল। এতো দামি আর ভালো খাবার ঋতি আগে কখনো খায়নি। ঋতি বেশ তাড়াতাড়ি খেতে লাগল। অনেকটা খেল। 

তারপর আবার একটা জায়গায় বসে কথা শুরু হলো। ম্যাডাম তোমার কোন্ জায়গা সবচেয়ে পছন্দ? পাহাড় না সমুদ্র? 

ঋতি হালকা হেসে বলল, আমি কোনোটাই দেখিনি পুলু কাকু। 

আচ্ছা, সে ঠিক আছে। কোথায় যেতে ইচ্ছে করে বলো? 

আমার খুব শান্তিনিকেতন যেতে ইচ্ছে করে জানো! আমার বন্ধুরা সবাই গেছে। মিতালীদি তো দুমাস বাদে বাদেই যায়। আমি কোনোদিন যাইনি। এম এ ফাইনাল পরীক্ষার সময় খুব টেনশনে ছিলাম। পরীক্ষার পর বাবাকে বলেছিলাম আমাকে একদিনের জন্য নিয়ে যাবে শান্তিনিকেতনে? আমি রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে চাই! বাবা নিয়ে যায়নি। বলেছিল, নিজে রোজগার করে যেও। 

ঠিক আছে। তাই হবে। শান্তিনিকেতনেই যাব তোমাকে নিয়ে। 

ঋতি অবাক! 

আমি তোমাকে নিয়ে যাব। 

ঋতি এবার পুলু কাকুর হাতদুটো ধরে বলল, তুমি কেন করছ এসব? বাবা তোমাকে পাঠিয়েছে? বাবা বলেছে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে? বলো না, সত্যিটা বলো! 

পুলু কাকু হাসছে ঋতির দিকে তাকিয়ে। উত্তর দিচ্ছে না। 

ঋতির বিশ্বাস ততই দৃঢ় হচ্ছে। পুলু কাকু আর বাবা মিলে এসব করছে নিশ্চয়ই। ঋতি নিশ্চিত। 

পুলু কাকু বলল, ম্যাডাম, বৌদিকে জানানোর দরকার নেই। তুমি যেখানে আছ সেখানেও কিছু বলো না। শুধু আমি আর তুমি জানব। বলে এমন হাসল যে তার মধ্যে যেন খুব মজার কিছু আছে। 

ঋতির মনে হলো আসলে বাবা সবটাই জানে। তাই পুলু কাকু অন্য কাউকে বলতে বারণ করছে।

ঋতি মা আর মিতালীদিকে দুরকমের মিথ্যে বলে পুলু কাকুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দেখা গেল পুলু কাকু দুটোরুম বুক করেছে। একটা ঋতির, আর একটা নিজের জন্য। বাবাকে ঋতি কোথাও দেখতে পেল না। তাহলে কি বাবা আসেনি! 

পুলু কাকু ঋতিকে নিয়ে প্রথমেই হাটে গেল। সেখানে হরেকরকম জিনিস। প্রত্যেকটাই খুব মনকাড়া। ঋতি নানাকিছু দেখছে। কিনছে না কিছুই। পুলু কাকু ঋতির পেছন পেছন ঘুরছে। ঋতি যেটা হাতে নিয়ে দেখছে, পুলু কাকু সেটা পরে গিয়ে কিনে নিচ্ছে। হোটেলে ফেরার সময় ঋতি খেয়াল করল পুলু কাকুর হাতে অনেক প্যাকেট। এতো কি কিনেছ? 

হোটেলে চলো! দেখাচ্ছি। 

হোটেলে ফিরে ঋতির অবাক হওয়ার আর শেষ থাকল না। তার যা যা পছন্দ হচ্ছিল পুলু কাকু সব কিনে নিয়েছে! তাতে ডোকরার ঘর সাজানোর জিনিস থেকে গয়না, কাঁথা স্টিচের শাড়ি কি নেই! ঋতি আনন্দে পুলু কাকুকে জড়িয়ে ধরল। তুমি এসব কি করেছ! বলছে আর ঋতি হাসছে! এতো আনন্দ সে জীবনে কখনো পায়নি। 

 

১০৫

রাতে খেতে বসে ঋতি আর থাকতে না পেরে বলল, এবার বলো তো বাবা কোথায়? 

অনন্ত আবার কোথায় থাকবে! ব্যারাকপুরেই আছে। 

এখানে আসেনি? 

না তো! পুলু কাকুও অবাক। বলল, তুমি কি ভাবলে ম্যাডাম অনন্ত আমাকে পাঠিয়েছে! 

হ্যাঁ, আমি সেরকমই ভেবেছিলাম। ঋতির মুখটা ছোটো হয়ে গেছে। মাথাটাতেও একটা কেমন ঝটকা লাগল মনে হলো। যন্ত্রণা শুরু হলো। ঋতির মাথা ব্যথা হলে ঋতি খুব কষ্ট পায়। গা গোলায়, বমি হয়। ঋতি বলল, আমি আর কিছু খাব না। শরীর খারাপ লাগছে। পুলু কাকুর কাছ থেকে চাবি নিয়ে সে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল। 

কিছুক্ষণ বাদে পুলু কাকু দরজা ঠকঠক করছে। কি গো ম্যাডাম? কেমন লাগছে এখন? 

মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।

আচ্ছা, গ্যাস হয়ে গেছে হয়তো। তুমি এই কোল্ডড্রিংকটা খাও। 

ঋতি বিনা বাক্যে কোল্ডড্রিংকটা খেল। অনেকটাই খেল। 

তারপর ঋতির ঘরে বসেই পুলু কাকু কথা বলছিল। 

ঋতি ভালো শুনতে পাচ্ছে না কথাগুলো। তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কখন যে সে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানে না। 

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল সে উলঙ্গ হয়ে ঘুমোচ্ছিল। পাশে পুলু কাকুও উলঙ্গ। বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসতেই সামনের আয়নাটায় তার চোখ পড়ে গেল। তার বুকে বড়ো বড়ো কামড়ানোর দাগ। বুকে হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে সে দেখল বিছানাতে একজায়গায় লাল ছোপ ধরে গেছে। তার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। 

সে পুলু কাকুকে ঝাঁকিয়ে তুলে বলল, তুমি কি করেছ আমার সঙ্গে? কি করলে? কেন করলে? 

পুলু কাকু একটু ধাতস্থ হয়ে ঋতির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ঋতির উলঙ্গ শরীরটা দিনের আলোয় দেখছে! 

ঋতি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি একটা চাদর গায়ের ওপর টেনে নিল। 

পুলু কাকু তখন একটা ফিচেল হাসি হেসে বলল, তোমাকে ভালোবাসি সোনামণি। খুব ভালোবাসি। সেই যে সেদিন তুমি আমার ভুঁড়িতে হাত দিয়ে বলেছিলে, কাকু, ভুঁড়িটা বাড়ছে! সেদিন থেকেই আমি মরে গেছিলাম সোনামণি! 

কি যা তা বলছ! 

ঠিকই বলছি ম্যাডাম! আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। তোমার যা চাই সব দেব। তোমার ভালো ঘরে বিয়েও দেবো। শুধু আমাকে কখনো ভুলে যেও না। আমাকেও একটু ভালোবাসো! 

ঋতি তাকিয়ে আছে পুলু কাকুর দিকে। ও বিশ্বাস করতে পারছে না পুলু কাকু এই কথাগুলো বলছে ওকে! পুলু কাকু তাকে জন্মাতে দেখেছে। বাবার ছোটোবেলার বন্ধু! সে কি না…

পুলু কাকু কিছুই হয়নি এমন ভান করে বলল, এবার উঠে পড়ো। চট করে রেডি হয়ে নাও। আজ ইউনিভার্সিটির ভেতরে যাব। বিভিন্ন কিছু আছে। তোমাকে দেখাব। আর শোনোনা সোনামণি, আজ কাঁথা স্টিচের ওই লং স্কার্ট আর টপটা পড়বে? ওই যে গো কাল যেটা কিনে দিলাম! 

ঋতি কোনো কথা না বলে চাদরটা সামনে ঢাকা দিয়ে উঠল। পুলু কাকু হাত বাড়িয়ে ঋতির পেছনে একটা আলতো থাপ্পড় মারল! ঋতি বিদ্যুৎ চমকের মতো ঘুরে তাকাতেই আবার সেই ফিচেল হাসিটা হাসল।

ঋতি বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিজছে ও। আর ভাবছে, এসব তার সঙ্গে কি হচ্ছে! এতো বোকা সে! পুলু কাকুর আসল উদ্দেশ্য ধরতে পারল না! ঋতির মনে পড়ে যাচ্ছিল, স্নেহময়দাকে ও যেদিন পুলু কাকুর এতো জিনিস কিনে দেওয়ার কথা মেসেজ করে জানিয়েছিল স্নেহময়দা সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ফোন করেছিল অনেকদিন বাদে। অন্য কোনো কথা বলেনি স্নেহময়দা। কেবল পুলু কাকু সম্পর্কে সাবধান করেছিল ঋতিকে! বলেছিল, যারা জিনিস দিয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করে তারা ভালো লোক হয় না ঋ। ও তোকে ওর টাকা দেখাচ্ছে। লোভ দেখাচ্ছে তোকে। ও খুব ভালো করে জানে তুই একটা অসহায় অবস্থার মধ্যে আছিস। সেটার সুযোগ নিচ্ছে। তুই ওর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দে ঋ।

ঋতি এসব কথা শুনে ভয় পেয়েছিল। একসপ্তাহ মতো পুলু কাকুর ফোন ধরেনি। কথা বলেনি। তারপর একদিন পুলু কাকু তাকে দমদম স্টেশনে ধরেছিল। কি ব্যাপার ম্যাডাম? কী হয়েছে? তুমি ফোন ধরছ না? 

ঋতি দাঁড়িয়ে পড়েছিল, কিছু না। কিছু হয়নি। 

তাহলে! আরে ম্যাডাম একা একা আছ! চিন্তা হয় তো! ওখানে বাবাও তো একা! বাবা কত চিন্তা করে বলো তো! 

ঋতি তখনও ভেবেছিল বাবাই পুলু কাকুকে পাঠিয়েছে। বাবা নিজে আসতে পারছে না বা ফোন করতে পারছে না। তাই পুলু কাকুর মাধ্যমে খোঁজ খবর নিচ্ছে। তারপর পুলু কাকুর সঙ্গে আবার স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে শুরু করেছিল ঋতি।

আজ ঋতি বুঝতে পারছে স্নেহময়দাই ঠিক কথা বলেছিল। কিন্তু এখন আর ভেবে কি হবে! যা হবার তো হয়েই গেছে! ঋতির সতীচ্ছদ্দ ছিঁড়ে গেছে। বিছানায় রক্তের দাগ! ঋতির তো সব নষ্ট হয়ে গেল! ঋতি তো একটা নোংরা মেয়ে হয়ে গেল! ঋতি কি করবে এবার! 

তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল পুলু কাকুর সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকে তার কলেজ শেষ হয়ে গেলেই সে কোথাও না কোথাও পুলু কাকুর সঙ্গে দেখা করেছে। পুলু কাকু তাকে দুপুরে ভালো ভালো খাবার খাইয়েছে। একটা দশ টাকার কেক খেয়ে সারাদিন কাটাতে হয়নি। তার জামাগুলো পুরনো হয়ে গেছে। তবু সে ওগুলোই পরে পরে কলেজে যায়। পুলু কাকু তাকে নতুন জামা কিনে দিয়েছে। এতো দামি জামা পরার কথা ঋতি জীবনে কখনো ভাবেনি। আর কাল রাতে পুলুর সঙ্গে ঋতির প্রথম সঙ্গম হয়েছে! সেটা জ্ঞানত হোক আর অজ্ঞানত। হয়েছে তো! পুলু কাকু তো আসলে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে নিজের সঙ্গে। তার বেরোনোর কোনো পথ রাখেনি। আজ সে প্রথম রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন দেখতে যাবে। এই মুহূর্তটার জন্য সে কবে থেকে অপেক্ষা করছিল। পুলুকাকুর কথা ভেবে সে এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট হতে দেবে! তার চেয়ে যা হচ্ছে হোক! অধ্যাপক চন্দ্রের ঘটনাটা দিয়ে ঋতি বোঝে এই ধরনের পুরুষরা, যারা ঘরে বউ রেখে বাইরে অন্য সম্পর্কে জড়ায় তারা বেশিরভাগই যৌন আকর্ষণটাকেই বড়ো করে দেখে! কি করবে পুলু কাকু! ঋতির শরীরটা ভোগ করবে! করুক! বদলে ঋতি যদি একটু আনন্দে থাকতে পারে সেটা কম কি! ঋতি কি এই আঠাশ বছরের জীবনে কোনোদিন সত্যি আনন্দে থাকতে পেরেছে! কেউ ঋতিকে ভালো রাখতে চেয়েছে! ঋতির নিজের জনেরা! ঋতির ভালোবাসার মানুষ! কেউ ঋতিকে আনন্দ দিয়েছে! পুলুকাকু একমাত্র ঋতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। ঋতির পছন্দের সব কিছু করেছে। ঋতি যা বলছে তাই শুনছে! তাহলে ঋতি এতো ভাবছে কেন! সাদা কালো, ভালো মন্দের বাইরেও একটা পৃথিবী আছে। সেখানে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা নৈতিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ঋতির জীবনটাও তেমনই ধরে নেওয়া যাক! এই তো মিতালীদি আর সুতনুদাও তো আছে! চঞ্চল মেসো আর টুয়া মাসিও তো আছে! তাহলে! সে আর পুলু কাকুও থাকবে। আনন্দ করে থাকবে। ব্যস্…

 

১০৬

ঋতি আর পুলু কাকুর দুদিন থাকার কথা শান্তিনিকেতনে। এই দুদিনে পুলু যথেচ্ছ যৌনাচার করেছে ঋতির সঙ্গে। ঋতির স্তন মর্দন করতে করতে বলেছে খুবই তো ছোটো! তবে চিন্তা নেই! মাপ মতো করে নেব। বলে ঋতির দিকে তাকিয়ে চোখ মেরেছে! ঋতিও হেসেছে। এক এক দফায় চার পাঁচবার করে ইন্টারকোর্স করেছে। ঋতি অরাজি হয়নি। উপভোগ করেছে বরং। তার বারবার মনে হয়েছে এই জীবনে প্রথম তাকে, তার শরীরকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে, আদর দিচ্ছে শেষ অবধি। এবং সেই দেওয়ার মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই, অপরাধবোধের বোঝা নেই। উদ্দাম এই যৌনতা ঋতিকে আনন্দ দিচ্ছে। সেই যে স্নেহময় তার স্পর্শকে অপরিণত রেখে চলে গেছিল তা যেন পূর্ণতা পাচ্ছে। তাহলে! স্নেহময়ের প্রতি ভালোবাসা শেষ! আর কোনো উদ্বিগ্নতা, অভাববোধ ঋতিকে ছুঁতে পারবে না তো!

আজ বিকেলে ট্রেনে ওঠার আগে পুলু কাকু একটা ওষুধের দোকান থেকে আইপিল কিনে আনল। বলল ম্যাডাম, এটা এবার থেকে কাছে রাখবে। একটা খেয়ে নাও এখনি। আর একটা রেখে দাও। আবার পরে লাগবে! বলে ঋতির গালটায় আদর করে দিল। ঋতি জড়িয়ে ধরল পুলু কাকুকে। বলল, আজ থেকে আর কাকু বলব না। পুলু বলে ডাকব।

যা ইচ্ছে বলে ডাকবেন ম্যাডাম! কোনো আপত্তি নেই। বলে ঋতির ঠোঁটে চুমু খেল। 

আর একটা কথা, তোমাকে কখন ফোন করব বলে দাও। কাকিমা আছে। কাকিমার কাছে তো পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে! 

পুলু কাকু একথা শুনে ঋতিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, তোমাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। আমি রোজ ফোন করব তোমায়। 

ঋতি আর কিছু বলল না। 

ফেরার সময় যত মিতালীদির বাড়ির কাছাকাছি আসছে ততই ঋতির মুখটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও ঋতির ভেতরে ভেতরে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ খুব মন খারাপ লাগছে। এই তো সে এতো আনন্দ করে এলো। শরীর তৃপ্ত, আদরের ব্যথায় জর্জর। তাহলে আবার মন খারাপ করছে কেন! ঋতি বুঝতে পারছে না। বাড়ি ফিরে রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারল না ঋতি। স্নেহময়দার মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। এতোগুলো বছর সে তো স্নেহময়দার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ কয়েকটা জামাকাপড়, দামি রেস্টুরেন্ট, দামি হোটেল, শপিং মল এসব তার মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। সে স্নেহময়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল! স্নেহময়কে আর সে ভালোবাসে না! 

কিন্তু তাহলে সে ঘুমোতে পারছে না কেন! এতো কাঁদছে কেন সে! কে হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে! সে কি সত্যি কোনোদিন ছিল! ঋতি তো এতোবছর অপেক্ষা করে বসে আছে। স্নেহময় তাকে কি দিতে পেরেছে! ভালোবাসাটুকুও কি দিয়েছে! ঋতির বিপদে আপদে একটা মেসেজ পাঠানো ছাড়া স্নেহময় আর কি করেছে! ঋতির মনে হলো স্নেহময়দা যদি তাকে আঁকড়ে ধরে থাকত তাহলে ঋতির এই স্খলন ঘটত না! ঋতি তো একা একাই ছিল। কিন্তু তার থাকার মধ্যে যে শূন্যতা ছিল সেটা সামান্য হলেও ভরাট করার চেষ্টা কোনোদিন করেনি স্নেহময়দা! একা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, অবসন্ন ঋতি পুলু কাকু, অধ্যাপক চন্দ্রের মতো লোকের ফাঁদে পড়ে গেল! আসলে শুধু স্নেহময়ই বা কেন! বাবা! তার নিজের বাবা তার জন্য কি করতে পারল! টাকাপয়সা অনেক মানুষেরই কম থাকতে পারে। তার জন্য নিজের সন্তানের দিকে নির্ভরতার হাতটা বাড়িয়ে দিতে কোনো বাবার অসুবিধে হয় না। অথচ অনন্ত ঘোষাল নিজের দুর্ভাগ্যের বোঝা ঋতির ওপর চাপিয়ে সুদিনের দায়টাও ঋতির ঘাড়েই ফেলে দিল। বাবারা মেয়েদের সবচেয়ে বেশি নির্ভরতার জায়গা। ঋতির জীবনে কখনো তেমন কিছু ঘটলই না। পাঁচ বছরের কাঁধে পঁয়ত্রিশ বছরের বোঝা চাপিয়ে বাবা নিশ্চিন্ত হয়ে গেছিল। তারপর যে মেয়ের জন্য কিছু করতে হবে, হাওয়ায় ভেসে যে মেয়ে দারুন তাক লাগানো চাকরি পেয়ে যাবে না সেকথা একবারও ভাবেনি।  যদি বা ঋতি স্নেহময়কে পেয়ে একটা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল সেটাকেও সমূলে বিনাশ করে দিয়েছে বাবা। ষড়যন্ত্র! কত বড়ো ষড়যন্ত্র করেছিল বাবা! ঋতি ঝাঁকুনি দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তার মনে হলো তার আজকের এই পরিণতির জন্য বাবা দায়ি। হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবার জন্য ঋতি আজ একজনের রক্ষিতায় পরিণত! ঋতি হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। এই দুদিনে যা যা ঘটেছে তার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এসব কাণ্ড সে করল কোন রুচিতে! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার! অধ্যাপক চন্দ্রের বিকৃতি, পুলু কাকুর সঙ্গে সম্পর্ক… সে কি পাগল হয়ে গেছে! 

পরদিন দশটা বাজতে না বাজতেই সে স্নেহময়ের সঙ্গে যোগাযোগ করল, খুব দরকার। আজই ফোন করো। 

স্নেহময় হাতের কাজ মিটিয়ে দুপুরের দিকে ফোন করল, হ্যাঁ বল। 

তোমাকে একটা কথা জানাতে চাই। 

হ্যাঁ বল। 

আমি আর পুলু কাকু শান্তিনিকেতন গেছিলাম। 

মানে? কি বলছিস? 

হ্যাঁ।

মানে? আমি বুঝতে পারছি না ঋ। তোকে এতো করে বোঝালাম যে ওর মতো লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস না! আর তুই তার সঙ্গে বেড়াতে চলে গেলি! 

বাকিটা শোনো। 

আর কি শুনব! যা করেছিস ভালো করেছিস! আমার কথা তো তুই শুনবি না! আর কে গেছিল? শ্রী কাকিমা জানে? 

ঋতি গম্ভীর হয়ে বলল, ওখানে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে। 

ওপার থেকে স্নেহময় চিৎকার করে উঠল, কি যা তা বলছিস! ভেবে বলছিস তুই! 

ঋতি চুপ। 

স্নেহময় বলেই যাচ্ছে, এসব কি বলছিস! কি বলছিস ঋ! তারপর খানিকক্ষণ কোনো উত্তর না পেয়ে স্নেহময় এবার বলতে শুরু করল, তুই মিথ্যে বলছিস, না ঋ! মিথ্যে বলেছিস! আমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য মিথ্যে বলছিস! বল না! সত্যিটা বল না! 

ঋতি আরো গম্ভীর হয়ে বলল, সত্যিটাই বলছি। 

ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল। ঋতি ফোনটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। তার মনে হলো আর কোনোদিন এই নম্বর থেকে ফোন আসবে না। এই শেষ কথোপকথন! 

বিকেল বেলা কিন্তু স্নেহময় আবার ঋতিকে ফোন করল। ঋ, তুই মিথ্যে বলছিস মনা? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মিথ্যে বলছিস মনা! 

না, স্নেহময়দা।

কি করেছিস তোরা! ওই লোকটা তোকে… ঋ, ঋ, তোরা অনেকবার করেছিস! 

ঋতি চুপ করে থাকল। ঋতির বুকটা ভরে যাচ্ছে। স্নেহময় যত কাতর হয়ে এই কথাগুলো বলছে ঋতির ততোই চেতনা জুড়ে আরাম ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভালোবাসা, এই কাতরতা, এই আকুলতা, এইতো সে চেয়েছিল। আর তো কিছু সে চায়নি। সে তো চেয়েছিল স্নেহময় তার জন্য পাগল হয়ে থাকুক। সকালে অফিসে ঢুকেই কতক্ষণে তার ঋ এর গলার আওয়াজ শুনবে সেই নিয়ে পাগল হয়ে থাকুক। সারাদিনে বারংবার ফোন, মেসেজ… উত্তর দিতে দেরি হলে অভিমান! বাড়ি ফেরার সময় রোজ মন খারাপের কথা! রোজ বলবে, ফিরতে ইচ্ছে করছে না ঋ। আর ঋতি তাকে জোর করে বাড়ি পাঠাবে। বলবে লক্ষ্মীটি, তোমার দায়। সেটা অবহেলা করো না। শনি, রবিবারও বাড়ি থেকে লুকিয়ে মেসেজ করবে। অথবা আড্ডা মারতে যাওয়ার নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঋ এর সঙ্গে কথা বলবে! এইটুকু তো চেয়েছিল ঋতি। এইটুকু! পায়নি কোনোদিন! কোনোদিন স্নেহময়দা বুঝতে দেয়নি ভালোবাসে। আদরের সময়ও সাবধানের সীমা টেনে রেখেছে। আজ এই আঘাতের জন্য সেটা বেরিয়ে এলো! এক মুহূর্তের জন্য হলেও প্রকাশ হয়ে গেল ভেতরের টানটা! অবশ্য জমি আর নারী চিরকাল পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারের বিষয়। এ দুটো ভাগ করে নিতে পুরুষের প্রবৃত্তি পথ আটকে দাঁড়ায়। এমনটা হতেই পারে যার ওপর কেবল তারই অধিকার ছিল সেটা ভাগ হয়ে গেল বলে স্নেহময় এতো বিচলিত হয়ে পড়েছে! হতেই পারে! কোনো সম্ভাবনাই উপেক্ষণীয় নয়। 

 

১০৭

ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। এই ভর সন্ধেবেলায় কে ফোন করছে? শ্রী সন্ধে দিচ্ছিল। পুজো অসম্পূর্ণ রেখেই তাড়াহুড়ো করে ফোনটা ধরল শ্রী। দেখল একটা আননোন নাম্বার। হ্যাঁ, কে? গলার আওয়াজে বিরক্তিটা চাপা থাকল না। 

বৌদি, আমি রাম বলছি ঘোষালদার অফিস থেকে। 

শ্রী একটু অবাক হলো, হ্যাঁ বলুন।

বৌদি, ঘোষালদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। 

শ্রীর পিঠ দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেবে গেল। যদিও সেটা ওপাশের ছেলেটাকে বুঝতে না দিয়ে অত্যন্ত নিরুত্তাপ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? 

অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। মুখে চোখে জল দিয়ে এখন জ্ঞান ফিরেছে। 

ও।

বৌদি আপনি একবার আসবেন? আমরা ঠিক বুঝতে পারছিনা কি করা উচিত এখন। 

ওঁকে আপনারা ওঁর দাদার বাড়ি পৌঁছে দিন। ওঁর দাদাই যা ব্যবস্থা করার করবেন। 

উত্তরটা শুনে অপরপ্রান্তের গলার আওয়াজে হতাশা ফুটে উঠল, আপনি আসবেন না বৌদি? 

না, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। শ্রী ফোনটা কেটে দিল। শ্রীর বুঝতে বাকি থাকল না এটা আসলে একটা দুর্বল নাটকের ততোধিক দুর্বল স্ক্রিপ্ট। যেটা ধরে ফেলাটা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। অনন্ত ঘোষালকে যারা কাছ থেকে চেনে তারাই জানে। লোকটা চিরকাল আত্মহত্যা করার নাটক করেই জীবন কাটালো। পুরো ব্যাপারটায় শ্রীর প্রচণ্ড রাগ হলো। অন্যায় করে ক্ষমা চাইতে বাবুর ইগোয় লাগছে। আবার শ্রীকে ছাড়া চলছেও না! তাই এইভাবে মিথ্যে শরীর খারাপের নাটক করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তবু অন্যায় স্বীকার করব না। তবু বলবনা, ভুল হয়েছে, বাড়ি চলো। 

শ্রী রেগেমেগে মেয়েকে ফোন করল। ঋতি গত দুদিন খুব আনন্দে আছে। অনেকবছর পর সিএসসি বসেছে। গত দুদিন আগে ঋতির ইন্টারভিউয়ের ডেট পড়েছিল। খুব ভালো ইন্টারভিউ হয়েছে ঋতির। সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে সে। বোর্ডের সবাই বেশ খুশি তার ইন্টারভিউ নিয়ে। শুধু বেরিয়ে আসার সময় একজন প্রফেসর বললেন, পিএইচডি টা এখনো হয়নি। ওটা হয়ে গেলেই…

ঋতি বলল, স্যার আমার প্রিসাবমিশন হয়ে গেছে। আর এক দু মাসের মধ্যে থিসিস সাবমিশন হয়ে যাবে। 

ওই প্রফেসর আর কোনো উত্তর দিলেন না। বাকিরা ‘বাহ্ বাহ্ খুব ভালো’ বললেন। 

পুরো ব্যাপারটা ঋতির খুব পজিটিভ মনে হয়েছে। তার মনে হয়েছে এতোদিন সে ফুল টাইম চাকরি পায়নি ঠিকই। কিন্তু প্রথম যে সিএসসি সে ফেস করল তাতেই তার চাকরি হয়ে যাবে। প্রথম সিএসসিতে চাকরি এটা একটা রেকর্ড হয়ে থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে ঋতি এটাও ভেবেছে যে এই বাড়ি থেকে এবার তার পাট উঠল। সে চাকরি পেয়ে আগে অন্য একটা বাড়িভাড়া করবে। আর সেখানে মাকে নিয়ে একসঙ্গে থাকবে। মার ফোনটা পেয়ে ঋতি খুশি হলো। হ্যাঁ বলো।

শোন্ তোর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ অজ্ঞান হয়ে গেছিল। আমাকে অফিসের ছেলেরা ফোন করেছিল। যেতে বলছিল। আমি ওর দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিতে বলেছি। শ্রী ওদের কাছে যতই নিরুত্তাপ থাকুক না কেন মেয়েকে সব কথা জানানোর সময় টেনশনটা চেপে রাখতে পারল না। 

কি করব মা? কি হবে এবার? 

তোর বাবা তো দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খাচ্ছিল না। আমরা চলে আসার পর নিশ্চয়ই আরোই খায়নি। জানি না ঠিক কি অবস্থা হয়ে আছে ভেতরে। ডাক্তার দেখাতে হবে না কি! 

আমি ভাবছিলাম চাকরিটা পেয়ে একেবারে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াব।

দেরি হয়ে যাবে না তো বাবু! হাইপ্রেশারের রুগি। 

ঋতি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। ভাবল, মা মুখে যাই বলুক, এতো অন্যায়ের পরেও বাবাকে ভালোবাসে। 

বাবু? 

হ্যাঁ। ঠিক আছে। দুটো দিন যাক। আমি বাবাকে ফোন করব। 

ঠিক আছে। শ্রী ফোন রেখে দিল। 

ঋতির প্রথমেই মনে হলো তার মানে তো বাবার কাছে ফিরে যেতে হবে। নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবে ঋতি! এই নরক, এই অসভ্যতা থেকে মুক্তি! জীবনে এই প্রথম তাদের ওই স্যাঁতসেঁতে, ড্যাম্পধরা ঘুপচি ফ্ল্যাটটাতে ফেরার জন্য ঋতির মন আনচান করে উঠল। 

তার আগে আগামীকাল অবশ্য পুলু কাকুর সঙ্গে দেখা করার আছে। বনগাঁ থেকে দুপুরের ট্রেনে দমদমে নেমে মেট্রো করে ঋতি চলে যায় কোনো না কোনো শপিং মলে। কিছু খাওয়াদাওয়া করে ওরা সিনেমা দেখতে ঢোকে। পুলু কাকু কিন্তু সিনেমাটা দেখে না। পুলু কাকু ঋতির জামার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেয়। কখনো পাজামার ভেতর দিয়ে। তিন ঘণ্টার মধ্যে ব্রেকের সময়টুকু ছাড়া পুলু কাকু ক্রমাগত ঋতিকে খাবলাতে থাকে। প্রথম প্রথম ঋতির অস্বস্তি হতো। তারপর ঋতিও ব্যাপারটা এনজয় করতে শুরু করেছে। হলের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলেই ঋতি ব্রা এর হুঁক আলগা করে দেয়। পুলু তখন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঋতির ওপর। আশেপাশে কে দেখছে, কে দুটো কটু মন্তব্য করছে কিচ্ছু খেয়াল থাকে না ওদের। পুলু কাকুর সময়ের জ্ঞান মারাত্মক। ঠিক সিনেমা শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে সব গুছিয়ে নিতে বলে। হলের আলো জ্বলে উঠলে আশেপাশে দুএকজন ওদের দিকে তাকায়। তাদের চোখেমুখে ঘৃণার ভাব স্পষ্ট ফুটে ওঠে। ঋতি দেখেও না দেখার ভান করে। কেবল সিনেমা হলেই নয়, ফাঁকা ট্রেনে, অটোর অন্ধকারে এমনকি ভিড় ট্রেনেও পাশাপাশি বসে পুলু ঋতির স্তন টিপতে থাকে। আজকাল অবশ্য মাঝে মাঝে ঋতির ক্লান্ত লাগে। মনে হয় ভিড় ট্রেনে উঠে দাঁড়িয়ে পুলুকাকুকে ঠাস করে একটা চড় মারে। পারে না। হলের অন্ধকারে এক একদিন ঋতি করুণ মুখে বসে থাকে। অসহায় মনে হয় নিজেকে। তার ভালো না লাগলেও তাকে এলাউ করতেই হয়। এটা যেন পুলু কাকুর হকের পাওনা। এই যে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে, দামি জামাকাপড়, ব্যাগ, এদিক ওদিক কাছে পিঠে দুদিন তিনদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া – এসবের বদলে এগুলো তার প্রাপ্য। সে তার হকের পাওনা আদায় করে নেবেই। খুব বেশিদিন হয়নি পুরো ব্যাপারটা। তবু এর মধ্যে যে আসলে কোথাও ভালোবাসা নেই, পুরোটাই যে একটা লেনদেন এটা আবিষ্কার করে ঋতি সত্যিই নিজের চোখের দিকে আর তাকাতে পারেনা। দেহের শুচিতা বলে কিছু হয় না এটা যেমন সত্যি, তেমনি শরীর বেচে যারা খায় তারা আসলে বেশ্যা এটাও সত্যি। ঋতিও বেশ্যাই। রক্ষিতা। পুলুকাকুর রক্ষিতা। সে ভবিষ্যতে যতই পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক হয়ে উঠুক না কেন তার আজকের এই পরিচয়কে সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে! একটা দুঃস্বপ্ন মনে করে জীবনের এই এপিসোডটাকে সে কোনোদিন বাদ দিতে পারবে! কোনোদিন নয়। কিন্তু এমন হলো কেন! ঋতির মতো অসহায় অবস্থায় কত মেয়েই তো থাকে। তবু তারা লড়াই করে। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করে। ঋতিও তো তাই করছিল। তারপর! তারপর কি হলো! পুলুকাকুর বৈভব দেখে মাথা ঘুরে গেল! লোভ! এতো লোভ ঋতির! হঠাৎই ওর একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ছোটোবেলায় রুশি দিদির খুব সুন্দর একটা পুতুল ছিল। এত্তো বড়ো। সুন্দর রেশমি চুলে দুটো বড়ো বড়ো বিনুনি বাঁধা। চোখগুলো নীল, গালগুলো গোলাপি। ঋতির খুব ইচ্ছে করত ওই পুতুলটা নিয়ে একটু খেলে! কিন্তু রুশি দিদি পুতুলটা কোনোদিন হাতে নিতে দেয়নি। চাইতে গেলে চিৎকার করে কেঁদেছে। তার দরুণ কখনো জ্যেঠু, কখনো মা তাকে মেরেওছে। একদিন এমনি মার খাওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে ঋতি বাবাকে বলেছিল, আমাকে একটা পুতুল কিনে দেবে বাবা! 

অনন্ত সেদিন মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে শান্ত করার বদলে বলেছিল, তুমি বড়ো হও। নিজে রোজগার করে যত ইচ্ছে পুতুল কিনো। 

তখনকার মতো ঋতি কথাটায় খুব উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। অনেকদিন পর্যন্ত এই ঘটনাটাকে তার এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হিসেবে সে দেখেছে। কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পারে এই কথাটার মতো লোক ঠকানো কথা আর হয় না। ঋতি চব্বিশ বছর বয়সে চাকরি পেয়েছে। তারপর থেকে সংসারের জোয়াল টানতে টানতে শখ আহ্লাদের কথা মনেও পড়েনি। আগামীতে যদি সে পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক হতে পারে তখন তার অনেক পুতুল কেনার ক্ষমতা তৈরি হবে ঠিকই। কিন্তু সত্যিই কি সেদিন পুতুল কেনার আর কোনো দরকার থাকবে! ঋতি কি এই বয়সে পুতুল খেলতে বসবে! সেটা হয় কোনোদিন! হয় না। আসলে যে বয়সে যেটা মানায় সেটাই মানুষ করে। নিজের অপারগতা একটা বাচ্চার কাঁধে চাপিয়ে খেলার পুতুলটুকুও তাকে না দিয়ে পড়তে বলাটা আসলে তাকে ঠকানো। তার শৈশবকে বিষময় করে তোলা। এইটা মনে হওয়ার পর থেকে ঋতির মনে হয় তার তিরিশ বছর বয়স হতে চলল। কত কিই তো এমন না পাওয়া থেকে গেল! সেই অভাবগুলো জীবনে কখনো আর পূরণ হবে না। ‘সব পেলে নষ্ট জীবন’! কিচ্ছু না পেলেও জীবন নষ্টই। তাই পেতে হবে। তার দিদিরা, ভায়েরা, বোনেরা যেমন না চাইতেই সব পেয়েছে তাকে তো কেউ তেমন করে দেবে না! তাই এখন সে যেমন করে যা পাচ্ছে তেমন করেই নিতে হবে। যত ইচ্ছে নিতে হবে। একবারে গোগ্রাসে গিলে নিতে হবে সবকিছু। কোনো অভাববোধ যেন আর তাকে তাড়া করে না বেড়ায়! 

কিন্তু তাও তো হয় না। এতো এতো নতুন জামা, ব্যাগ এসব নিয়ে ঘরের মেঝেতে ফেলে রেখে ঋতি নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে থাকে! স্নেহময়ের জন্য তার কান্না ফুরোয় না। এই দেড় দু বছরে সে বুঝেছে শরীরের খিদে যেমন তেমন করে মিটিয়ে ফেলা যায়! মনের খিদে মেটে না! সেখানটায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সর্বংসহা একটি শান্ত মূর্তি অপেক্ষা করে থাকে তার প্রেমাস্পদর জন্য। স্নেহময়দা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ঋ, ভালোবাসিস পুলু কাকুকে? 

না। 

তাহলে কি করে তার সঙ্গে এভাবে… কি করে পারিস ঋ! 

ঋতি একথার উত্তরে চুপ করে থেকেছে। মনে মনে ভেবেছে, এই পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু অভাগার জন্ম হয়, যাদের শরীর আর মন এক তারে বাঁধা পড়ে না। মনের মানুষ দিনের পর দিন শরীরকে উপেক্ষা করে যায়। তাই শরীর আরেকটা শরীর খুঁজে নিতে বাধ্য হয়। আর স্নেহময়দা তো তার মন, শরীর কোনো চাওয়াকেই গুরুত্ব দিল না কোনোদিন। শুধু ব্যস্ততা আর কর্তব্যের দোহাই দিয়ে গেল। বাবাও তাকে কোনোদিন আশ্রয় দিতে পারল না। একলা অসহায় ঋতির হয়তো উচিত ছিল একা একাই লড়াইটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। ঋতি পারেনি। ক্লান্ত, অবসন্ন ঋতি একটা শক্তপোক্ত কাঁধে মাথা রাখতে চেয়েছে। সেখানে যে পুলুকাকুর মতো এক কামুক, নোংরা, অসৎ মানুষ দাঁড়িয়েছিল ঋতি বোঝেনি। বুঝলেও হয়তো তার কিছুই করার ছিল না। এই হয়তো তার ভবিতব্য! কোন্ মুখে সে আর টুয়া মাসি, মিতালীদি এদের সমালোচনা করবে! প্রত্যেকের অসহায়তা তার নিজের কাছে মৃত্যুসম। সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তাটাও তাদের নিজস্ব। এ নিয়ে নিন্দে চলে না।

 

১০৮

ঋতির বুকটা দুরুদুরু করছিল। হাত পাগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এতো বছর পর বাবাকে ফোন করতে হবে। বাবা কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে সেটাই ঋতি ভাবতে পারছে না। যদি মেজাজ দেখিয়ে বাঁকা বাঁকা কথা বলতে শুরু করে ঋতি কি করবে! আবারও ছিটকে সরে আসবে! কিন্তু বাবা তো অসুস্থ। এই অবস্থায় বাবার কাছে যাওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বাবা দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও জোর করে কাছে যেতে চাইবে! কিন্তু তাতে তো বাবার জেদকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে। চিরকাল মার সঙ্গে, এমনকি নিজের একমাত্র সন্তানের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে গেল! ভুল বুঝে গেল! অন্যের প্ররোচনায় নিজের লোকেদের নামে অকারণ নিন্দে করে গেল।‌ শ্বশুরবাড়ির লোকেদের থেকে হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে তাদের শত্রু করে তুলল। এগুলোর কোনোটারই প্রয়োজন ছিল না। ঋতি ভাবে তারা গরিব হতে পারে, অভাব থাকতে পারে তাদের, তবু তারা নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে পারত! জ্যেঠু একদিন বলেছিল, তোর বাবা দুখের ভাত সুখ করে খেতে চেয়েছিল। তোদের জন্য পারেনি। তোর আর তোর মায়ের জন্য। ঋতির হাসি পেয়েছিল কথাটা শুনে। আসলে বিষয়টা উল্টো। মায়ের শ্বশুরবাড়ির লোক তো মাকে কখনো চোখের জলের নোনতা স্বাদ ছাড়া ভাত খেতেই দেয়নি! বাবাও দেয়নি। বাবাই আসলে দুখের ভাত সুখ করে খেতে জানে না। নিজের জেদ, মেজাজ, অবুঝপনা দিয়ে সবটা নষ্ট করেছে… সবটা! 

বাবার নম্বরটা ডায়াল করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে ঋতি। কতদিন পর বাবা সম্বোধনটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে! কতদিন ঋতি ‘বাবা’ বলে ডাকেনি বাবাকে! 

হ্যালো?

ঋতি চমকে উঠে তাড়াতাড়ি ফোনটা কানে নিয়েছে। 

ওপার থেকে আবার বলে উঠল, হ্যালো? 

রুতু বলছি। 

হ্যাঁ, বল। 

কেমন আছ? জিজ্ঞেস করতেই ঋতির গলাটা ভারি হয়ে গেল। দমকে কান্না উঠে এলো। ঋতি তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্নাটাকে আটকাবার চেষ্টা করছে। শুনতে পেল ওপাশ থেকেও একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে! 

বাবা! ঋতির ডাকটা প্রায় আর্তনাদের মতো শোনালো। 

বল, বাবু বল! অনন্ত পাগলের মতো কাঁদছে। 

ঋতিও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সেই যে ছোটোবেলা থেকে বাবার আর তার গোপনে হাত ধরে থাকা, পৃথিবীর সকলকে লুকিয়ে সেই যে তাদের গোপন কথা, সেই ছোট্ট থেকে বাবার একমাত্র বন্ধু সে, আর তারও সবথেকে প্রিয়জন সেই বাবা…তার থেকে এতো বিচ্যুতি ঘটল কেন! বাবা কেন বুঝলনা ঋতিকে! ঋতি তো কতবার বাবাকে বলেছিল  যে সে যে কেরিয়ার অপশনই বেছে নিক না কেন এই সংসার সে ঠিক চালিয়ে দেবে! বাবা সেই ভরসাটুকু তাকে করতে পারল না কেন! কোথায় খামতি থেকে গেল! যেখান থেকে এই যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরি হলো! 

কান্না থামিয়ে ঋতি আবার জিজ্ঞেস করল, শরীর ভালো নেই তো বাবা! 

না রে রুতু, শরীরটা ভালো নেই। 

তাহলে তো ডাক্তার দেখাতে হবে। 

আর ওসব করে কি হবে বল! অনন্ত কিছুটা সামলে উঠেছে মনে হলো।

ডাক্তার না দেখালে তো আমি ফিরব না বাবা! তোমার আমার অশান্তি তো এই ওষুধ খাওয়া নিয়েই শুরু হয়েছিল। 

তুই আসবি রুতু! কবে আসবি বল? অনন্তর গলায় যেন আনন্দ ঝরে পড়ছে। 

আসব। কিন্তু তার আগে ডাক্তার দেখাতে হবে তোমাকে। কথা দিতে হবে যে নিয়মিত ওষুধ খাবে। 

আচ্ছা।

কথা দিচ্ছ তো!

আচ্ছা। 

ঠিক আছে তুমি পরশুদিন শ্যামবাজারে চলে এসো। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে রাখব। পুরনো প্রসেক্রিপশন নিয়ে আসবে। 

আচ্ছা। তুই আমার সঙ্গেই ফিরবি তো? 

আমাকে তো জিনিসপত্র নিয়ে ফিরতে হবে বাবা! দুটো দিন সময় দাও। 

তুই ফিরবি তো রুতু? অনন্তর গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।

হ্যাঁ বাবা। ফিরব।

ঋতি শ্যামবাজারের বাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অনন্তর জন্য। দূর থেকে অনন্তকে দেখে ওর চোখ আবার জলে ভরে গেল। সেই বাবা! প্যান্টের ভেতরে গুঁজে শার্টটা পরে, পায়ে জুতো… সেই তার চিরপরিচিত বাবা! 

অনন্ত ঋতির সামনে এসে ঋতিকে ছোটোবেলার মতো জড়িয়ে ধরল। রাস্তার ভিড়, গাড়ির হর্ন সবকিছু উপেক্ষা করে আবারও ওদের চোখ ভিজে গেল। 

ডাক্তার কিন্তু অনন্তকে খুব বকাবকি করলেন। একে তো অনন্ত প্রায় তিন বছর বাদে ডাক্তার দেখাতে এসেছে। তার ওপর নিয়মিত ওষুধ না খাওয়ার কারণে প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেছে। এবং এখনো পর্যন্ত বিড়ি ছাড়তে পারেনি। নতুন প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে উনি বারবার সাবধান করে দিলেন। কথা না শুনলে বিপদ হতে পারে। 

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অনন্ত বলল, তুই তোর মার কাছে ফিরবি তো? 

না তো, মার কাছে থাকি না তো! 

কোথায় থাকিস তাহলে? অনন্তর ভুরু কুঁচকে উঠেছে।

মিতালীদির বাড়ি পেইংগেস্ট থাকি। 

মানে? এতোগুলো দিন তুই তোর মার সঙ্গে থাকিস নি! 

না। 

রুতু, আর এক মুহূর্তও দেরি নয়। তুই শিগগিরি বাড়ি ফের। অনেক হয়েছে। 

বাবার তার প্রতি এই কনসার্ন দেখে ঋতির ভালো লাগল। দূরত্ব মানুষকে সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝায়। বাবা হয়তো এতোদিনে বুঝেছে নিজের মেয়ের কদর! সন্তানের চেয়ে আপন আর কেউ নয়! ঋতিও বুঝেছে, নিজের বাড়ি হলো নিজের বাড়ি। যেমনই হোক!  তবু নিজের বাড়ি। 

ঋতি দুদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ব্যারাকপুরে ফিরে চলল। গাড়িতে বই আর বাকি জিনিস গুছিয়ে নিয়ে ও কাকিমাকে গিয়ে বলল, আমি নিচের ঘর ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছি। বাথরুম গতকালই পরিষ্কার করেছি। বেরিয়ে যাচ্ছি আমি। 

তুমি এতো তাড়াহুড়ো করলে কেন ঋতি! এ মাস শেষ করে যেতে পারতে! কাকিমা টেনে টেনে বলল।

না, কাকিমা, বাবা অসুস্থ। আমাকে ফিরতে হবে। মিতালীদিকে বলে দিও। ঋতি আর পেছন ফিরে তাকালো না।

গাড়ি করে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল একযুগ জেলে বন্দি থেকে ফিরছে ঋতি। এইদিনগুলোর অভিজ্ঞতা ঋতি সারাজীবন মনে রাখবে! 

ফ্ল্যাটের সামনে গাড়িটা পৌঁছোতেই অনন্ত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে। ঋতি বাবাকে দেখে হাসছে। অনন্ত তাড়াতাড়ি করে জিনিসপত্র ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। ঋতি থামিয়ে দিল। বলল, তুমি ছেড়ে দাও। ওরা সব ভেতরে তুলে দেবে। 

বইপত্রে আবার ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা ভরাট হয়ে উঠল। ঋতি আর অনন্ত মিলে বইগুলো সাজিয়ে ফেলল। নইলে হাঁটাচলা যাচ্ছে না। ঋতি ঘর গুছিয়ে স্নান সেরে এসে দেখল বাবা সিঙারা, তার পছন্দের মিষ্টি সব আনিয়ে রেখেছে। ঋতি চা বানিয়ে নিয়ে গুছিয়ে বসল। অনন্ত প্রচুর কথা বলছে। এই না থাকার সময়টায় সে নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেয়েছে। সেইসব কথা।

কেন? ও বাড়িতে খাওনি? 

না রে, ওদের অসুবিধে হচ্ছিল। প্রথম দু একদিন রান্না করে টিফিন বক্সে দিয়েছিল। নিয়ে এসেছিলাম। তারপর একদিন রুচি বলল, এতো জনের রান্না করতে মার অসুবিধে হচ্ছে। একদিন এই নিয়ে অশান্তিও হয়েছে।

তোমাকে খারাপ কথা বলেছে? 

হ্যাঁ, আসলে ওরা ভাবছিল আমার দায়িত্ব ওদের ঘাড়ে পড়ল। 

ঋতি চুপ করে গেল। বাবা নিজেই তাহলে বুঝেছে সারাজীবন কাদের ওপর ভরসা করে এসেছে। 

এই ফ্ল্যাটটাও বিক্রির ব্যবস্থা করছিল। 

কেন? 

বলছিল, ফ্ল্যাট বিক্রি করে দাদার বাড়ির তেতলায় একটা ঘর করে নিতে। আর বাকি টাকা ওদের দিয়ে দিলে আর চাকরি বাকরি করতে হবে না! 

বাঃ, চমৎকার! আমি আর মা নেই বলে এই ফ্ল্যাটটা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা! ছিঃ 

 আগে হলে এই কথা নিয়ে অশান্তি শুরু হয়ে যেত। আজ কিন্তু অনন্ত কোনো প্রতিবাদ করল না। ঋতিও তার দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসল। মিতালীদিরা ঋতির সঙ্গে কতটা খারাপ ব্যবহার করেছে, বেঞ্চিতে শুতে দিয়েছে, খেতে দেয়নি ভালো করে সব সে বাবাকে বলল। এতোদিনের দমচাপা ব্যাপারটা খানিক কাটল। শুধু পুলু কাকুর কথা কিছুই বলল না। সেটা বলা সম্ভব নয়। 

 

১০৯

পরদিন ঋতি মায়ের ফোন পেল। মায়ের কাকুকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। মা আর টুয়া মাসি সঙ্গে গেছিল। ফেরার পথে কিভাবে যেন পা মচকে গিয়ে মায়ের গোড়ালির হাড়টা ভেঙে গেছে। হসপিটালেই অর্থোপেডিক দেখিয়েছে। প্লাস্টার হয়েছে। তিন মাস রেস্টে থাকতে হবে। 

খবরটা অনন্তও শুনল। কতটা বিশ্বাস করল মুখ দেখে বোঝা গেল না। 

ঋতি দেখল, এ বাড়িতে বাসনমাজার লোক পর্যন্ত নেই। রান্না করা, বাসনমাজা, ঘরমোছা সব নিজেকে করতে হবে। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। থিসিসটা একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ঋতি কাজে লেগে পড়ল। 

কিন্তু মাত্র কয়েকটা দিন! ঋতির ভালো থাকার মেয়াদ খুব অল্পদিনের! 

সেদিন রান্নাবান্না সেরে ঋতি সকালে বেরোতে যাবে এমন সময় বিষ্ণুপদ কাকু এসে হাজির। কি রে? কেমন আছিস? 

ভালো আছি কাকু। তোমরা ভালো? 

আমরা আছি একরকম। কিন্তু তোর বাবার যা হাল হয়েছিল! 

ঋতির ভুরু কুঁচকে উঠেছে। বিষ্ণুপদ কাকু তাদের পারিবারিক বিষয়ে কথা বলছে কেন!

তোর বাবা যে কতবার আমার কাছে গেছে ঋতি! তোদের ফিরিয়ে আনার জন্য কত চেষ্টা যে করেছে! তোরা এটা কি করলি বলতো! 

ঋতির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। ও তাকিয়ে আছে বিষ্ণুপদ কাকুর দিকে। ভাবছে লোকটা এতো সাহস পেল কোথা থেকে! 

যাক গে, বাদ দে, বৌদি কবে আসবে? 

স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইলে ঋতি হয়তো মায়ের পা ভাঙার বিষয়টা বলে আরো অনেক কথাই বলত। কিন্তু ঋতির মেজাজটাই খিঁচড়ে উঠল। বলল, যখন সময় হবে ঠিক আসবে! 

না, সেটা কবে! 

দেখা যাক। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ঋতি বেরিয়ে এলো। তার মনে হলো সে ফিরে এসেছে! এই অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারটা টানছে সেসব কিছু নয়। মার ফিরে আসাটাই বড়ো হলো বাবার কাছে। ইগো, আসলে পুরোটা ইগোর খেলা। ঋতির মাথা গরম হয়ে উঠল।

ওদিকে অনন্ত ভেবেছিল, ঋতি আর শ্রী একইসঙ্গে শ্রীর মায়ের কাছে আছে। কাজেই ঋতি ফিরলে শ্রীও ফিরবে! তারপর তো শুনল যে ও এতোদিন যা ভেবে এসেছে সেটা ভুল। শ্রী মেয়ের পয়সায় বসে খাচ্ছিলনা। দোকানে কাজ করেই খেতে হচ্ছিল। আর ঋতিকেও দুটো কলেজে পড়িয়ে… যাই হোক, তারপরও অনন্তর মনে হয়েছিল ঋতি ফিরে এলে ওর মাও ফিরে আসবে। কিন্তু ঋতি এসেছে কয়েক সপ্তাহ হলো। শ্রীর ফেরার নাম নেই। এখন আবার পা ভাঙার গল্প ফেঁদেছে। ব্যাপারটা কি! শ্রী কি আসবে না! অনন্ত অস্থির হয়ে উঠেছে। 

ঋতির বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। অনন্তর সঙ্গে এক দু কথায় অশান্তি লেগে গেল। ঋতির যে জায়গাগুলো দুর্বলতা অনন্ত বারংবার সেখানেই আঘাত করে। ঝগড়া করতে করতে অনন্ত বলে উঠল, থাকতে পারছিলি না তো ওদের বাড়িতে। বেঞ্চিতে শুয়ে না খেয়ে দিন কাটছিল। দাদুর বাড়িতেও তো জায়গা হয়নি! এখানে ছাড়া তো আর কোনো গতি ছিল না। 

ঋতি স্তম্ভিত হয়ে গেল বাবার মুখে একথা শুনে। সন্তানের কষ্ট পাওয়ার কথাকে এভাবে তুরুপের তাস করে ঝগড়ায় জেতবার জন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে ঋতি ভাবতেও পারেনি। তার সরল বিশ্বাসে বলা কষ্টের কথাগুলো অনন্ত এভাবে ব্যবহার করল ঋতিকে আঘাত করার জন্য ঋতি ভাবতেই পারছিল না। সেইসঙ্গে বাবা সেই পুরনো অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসেছে! শ্বশুরবাড়ির সকলে খারাপ! সকলের নামে আগের মতোই নিন্দে করতে শুরু করল অনন্ত। 

ঋতি ভাবল, এতোদিন একা থেকেও অনন্তর কোনো পরিবর্তন হলো না। জেদ করে সারাজীবন সেই এক মনোভাব বজায় রাখল। শুধু নিন্দে আর নিন্দে! বাবার পৃথিবীতে ঘোষাল বাড়ির গুটিকয় মানুষ ছাড়া আর সবাই নিন্দেযোগ্য। বাকি সবাইকে অপমান করা যায়! কটু কথা বলা যায়! এই অনাবশ্যক কটু কথার জন্যই বাবা জীবনে কখনো শান্তি পেল না। মায়ের মতো সহধর্মিনীকেও হারিয়ে ফেলল! 

যদিও এতোকিছুর পরেও আবার বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ঋতি ভাবতে পারল না। সংসারের সবটা, দুটো কলেজ সামলে, বাবার মেজাজ সামলে সে শেষপর্যন্ত থিসিস জমা দিল। ভাইভা ভোস এ এক্সটার্নাল অধ্যাপক যিনি এসেছিলেন তিনি খুবই খুশি হলেন ঋতির কাজ দেখে, ঋতির সঙ্গে বিষয় নিয়ে কথা বলে। আরো দুজন এক্সটার্নালের রিপোর্টও খুবই ভালো। ঋতি শেষপর্যন্ত পিএইচডি ডিগ্রি পেল। 

 কিন্তু সিএসসি তে ঋতির হলো না। সিএসসির যেদিন রেজাল্ট বেরোলো সেদিন প্রথমটায় ঋতি জানতে পারেনি। পরে জানতে পারল যে সেদিন দুপুর নাগাদ ওয়েবসাইটে একটা লিস্ট বেরিয়েছিল। কিন্তু সে লিস্ট আধঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে আবার একটা লিস্ট বেরোয়। পরের লিস্টের সঙ্গে আগের লিস্টের কোনো মিল নেই। ঋতি বুঝতে পারল সবটাই রাজনীতির খেলা। এই তো পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থানের বদল ঘটেছে। এর মধ্যেই কলেজগুলোতে ছাত্র পরিষদের হুজুদ্দি শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলে টোকাটুকি থেকে অধ্যাপকদের হেনস্থা নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে ঋতিকেও একদিন বনগাঁর কলেজে ঘণ্টা পাঁচেক ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল। স্থানীয় এক কাউন্সিলারের মেয়ে এই কলেজে পড়ে। সে পরীক্ষা দিতে এসে প্রথম থেকে টুকলি করার চেষ্টা করছিল। ঋতি ওর পকেট থেকে টুকলির কাগজগুলো বাজেয়াপ্ত করে। সেই নিয়ে ঋতিকে ঘেরাও করা হয়। দাবি হচ্ছে ওই মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। 

ঋতিও অনড়। সে কিছুতেই কোনো চাপের মুখেই মাথা নোয়াবে না। 

মেয়েটা ওদিকে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। কলেজের অন্যান্য প্রফেসররা বিরক্ত। ঋতি একজন গেস্ট ফ্যাকাল্টি। ওর এতো বাড়াবাড়ি করার দরকার কি ছিল! শেষপর্যন্ত প্রিন্সিপালের কাছ থেকেও ঋতির ওপর চাপ আসতে থাকে। ঋতি বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে বলে, অনেক তো হলো। এবার চুপ করো। 

এতো ইউনিয়নের ছেলেরা আরো ক্ষেপে যায়। ঋতিকে ঘেরাও মুক্ত করা হয় না। কিন্তু একটা সময় ঋতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে পড়েছিল ঋতি। তাড়াতাড়ি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বলে প্রেশার হাই। তার থেকেই মাথা ঘুরে গেছে। বাড়ি নিয়ে যান। রেস্টে থাকতে হবে। 

এই কলেজে খুব আনন্দ করে চাকরি করতে এসেছিল ঋতি। কিন্তু প্রথম গোলমালটা লাগে আরাধ্যাদির সঙ্গে। আরাধ্যাদি নিজে সময়মতো ক্লাসে যায় না কোনোদিনই। কিন্তু ঋতির দু মিনিট দেরি হলেই স্টাফরুমে সকলের সামনে ঋতিকে ক্লাসে যাওয়ার কথা বলে। ঋতি প্রথম প্রথম লজ্জা পেত। কিন্তু তারপরও দেরি করে ক্লাসে যেতে বাধ্য হতো। কারণ ফার্স্ট ক্লাসে কোনো স্টুডেন্টই সময়মতো ক্লাসে আসে না। ফলে দেখা যায় ক্লাসে এক দুজন বসে আছে। তাদের নিয়ে পড়াতে শুরু করাই যায়। কিন্তু পরে যারা আসে তারা আবার বিষয়টা রিপিট করতে বলে। এমনিতেই দেড়ঘন্টা করে এক একটা ক্লাস। তার ওপর এক্সট্রা পড়াতে গিয়ে ঋতির ক্লান্তি আসে। বিরক্ত লাগে। মনে হয় একই কাজ করে বাকিরা লক্ষ লক্ষ টাকা মাইনে পাচ্ছে। আর সে সমস্ত যোগ্যতা নিয়ে একশ টাকার জন্য লড়ে যাচ্ছে। 

একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আরাধ্যাদি ভোরবেলা ফোন করেছে। তুই আসছিস? 

হ্যাঁ। ঋতি জানে না গেলেই ক্লাস মিস। টাকাও কমে যায়। তাই মরে বেঁচে হলেও সে ভোরবেলা উঠে ছোটে। 

তাহলে আমি ছেলেমেয়েদের বলছি। বলে আরাধ্যাদি ফোন রেখে দিল। 

কলেজে গিয়ে দেখা গেল কোনো ডিপার্টমেন্টে কোনো ছাত্র আসেনি। ফলে বাকি গেস্ট ফ্যাকাল্টিরা বসে বসে সেদিনের ক্লাসের টাকাটা পেল। অথচ আরাধ্যাদি ফোন করে দিয়েছে বলে বাংলা বিভাগে দুটি মাত্র ছাত্র এসেছে। সেই দুজনকে নিয়েই ঋতিকে ক্লাস করাতে হলো। তারা একটা ক্লাস করে বলল, ম্যাম, আমরা আর থাকতে পারব না। জামাকাপড় ভিজে। ঋতি তাদের ছেড়ে দিল। এবং আর ক্লাস হলো না বলে ঋতি কিন্তু একটা ক্লাসের টাকাই পেল। 

এর সঙ্গে জুটেছে পোশাক বিধি! ঋতি কুর্তা আর পাজামা পরে কলেজে আসে। কখনো শাড়ি পরে। আরাধ্যাদির দাবি ওড়না নিতে হবে। এ দাবি কলেজের আর কেউ করে না। ফলে প্রথম প্রথম ঋতি ওড়না নিলেও পরে সকলকে দেখে আর ওড়না নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। হঠাৎ একদিন আরাধ্যাদি তাকে ডেকে আলাদা করে বলে ঋতি এই সাদা কালো দুটো ওড়না আমি নিয়ে এসেছি। তুই লকারে রেখে দে। ক্লাসে যাওয়ার সময় এই দুটো ব্যবহার করবি। 

ঋতি প্রচণ্ড বিরক্ত হয় এই ব্যাপারটায়। সে বলে, আরাধ্যাদি, আমি আমার শরীর নিয়ে এতোটুকুও লজ্জিত বা সংকুচিত নই যে জামার ওপর দিয়ে একখণ্ড কাপড় ব্যবহার করে সে লজ্জা ঢাকতে হবে। আমি অন প্রিন্সিপাল ওড়না ব্যবহার করি না। 

এটা একটা গ্রামের কলেজ ঋতি! এখানে মানুষজন শহরের মানুষদের মতো নয়। তাদের চোখে লাগে।

লাগুক। এই ধাক্কাটা তাদের দেওয়া প্রয়োজন। নইলে আজ ওড়নার কথা বলছে, কাল শাড়ি, পরশু গলা অবধি ঘোমটা টানা বা বোরখা পরার কথা বলবে। তারপর বলবে মেয়েরা পড়াশোনা করলে বিধবা হয়। আমরা সামনের দিকে এগোব না পিছনের দিকে এগোব আরাধ্যাদি! 

আরাধ্যাদি এরপর আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু বারবার ওড়না ধরিয়ে দিয়েছে ঋতির হাতে। ঋতির বিরক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। 

সেইসঙ্গে আছে এই কলেজের একজন মাতব্বর গোছের অধ্যাপক। অধ্যাপক বিশ্বাস। তার ঋতিকে খুবই পছন্দ। সে নানাভাবে সেটা বুঝিয়ে দেয়। এই নিয়ে আরাধ্যদিও সকলের সামনে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করতে ছাড়ে না। সেসব শুনে বাকিরা পেছনে পেছনে হাসে। ঋতি সব বুঝেও কিছু বলতে পারে না। এই অধ্যাপক বিশ্বাস আবার নিজের রাজনৈতিক যোগাযোগ খাটিয়ে ঋতির চোখের সামনে কলাটা মুলোটা ঝুলিয়ে রেখেছে। তার অঞ্চলেই একটা বিশ্ববিদ্যালয় সদ্য তৈরি হয়েছে। সে বলেছে ঋতিকে সে ওখানে চাকরি পাইয়ে দেবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের অ্যাডভারটাইসমেন্ট বেরোলে ঋতি নিজে গিয়ে ফর্ম জমা দিতে চেয়েছিল। সে বলেছে, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আমি জমা দিয়ে দিচ্ছি। ঘটা করে ডিমান্ড ড্রাফ্ট, ফর্ম সব সে নিল। তার জন্য একদিন ঋতিকে তার বাড়িতে যেতে হলো। বাড়িতে তখন কেউ নেই। সেই সুযোগে সে ঋতিকে চুমু খেতে চাইল। ঋতি কোনোরকমে ছিটকে সরে এসে পালিয়ে বাঁচল। আর অধ্যাপক বিশ্বাস নিজের উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় ঋতির ফর্মটা জায়গা মতো জমাই করল না। ওই ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারভিউতে ঋতি ডাকই পেল না। ঋতির কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। লোকটা এরপরও ঋতিকে লোভ দেখালো পরের সিএসসি পাইয়ে দেবে, যদি ঋতি তার সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে যায়। ঋতি সরাসরি না বলতে পারল না। কিন্তু যাওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখাল না। উল্টে তার মনে হলো এইসব সংসারি মতলাববাজ লোকে দুনিয়াটা ছেয়ে গেছে। বাড়িতে একটা বউ রেখে বাইরে এরা যা ইচ্ছে করে বেড়ায়। আর ঋতির মতো শিক্ষিত রুচিশীল মেয়েদের নিয়ে মস্তি করতে এরা একটু বেশিই আগ্রহী। আসলে এরা ভাবে যতো বড়ো শিক্ষিত হও না কেন শুতে হবে তো সেই আমার নিচেই… এটাই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং বিধেয়। পুলু কাকু, অধ্যাপক চন্দ্র, এই অধ্যাপক বিশ্বাস সব এক গোত্রের। এরা মেয়েদের শরীর ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। ঋতির মনে হয় একটা সার্বিক অবক্ষয় চলছে চারদিকে। লুম্পেনদের দেশ হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে গোটাটা!

 

১১০

তিন মাস পার করে শ্রী বাড়ি ফিরল। ঋতি গিয়ে শ্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। অনন্ত আর আগের মতো আবেগপ্রবণ হয়ে না পড়লেও শ্রীর পায়ের অবস্থা দেখে বুঝল ব্যাপারটা সত্যি। শ্রী এখনো ভালো করে হাঁটতে পারছে না। এর মধ্যেই দেশের একটি নামকরা কলেজ বাংলার পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক নেবে বলে অ্যাডভারটাইসমেন্ট করেছে। ঋতি তাড়াতাড়ি সেখানে অ্যাপ্লাই করে দিল। তার ফুল টাইম চাকরি চাই। যেমন করেই হোক, যেখানেই হোক একটা চাকরি চাই। এমনিতেই সেদিনের পর থেকে বনগাঁ কলেজে যাওয়া ঋতি বন্ধ করে দিয়েছে। দমদম কলেজে তার চাকরি তো নড়বড় করছেই।

 প্রথমদিন ওই কলেজে ঢুকতেই ঋতির কেমন ভয় ভয় করছিল। দেশের নামজাদা প্রথম সারির একটি কলেজ! বিরাট বড়ো তার আয়তন। গেট দিয়ে ঢুকতেই ঋতির বুক কাঁপছিল। ঋতি শুনেছে এখানে ডিসিপ্লিনের মারাত্মক কড়াকড়ি। সবসময় ডেকোরাম মেইনটেইন করে কথা বলতে হয়। এটিকেট মেনে চলতে হয়। ঋতি ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে অফিসে যোগাযোগ করল। ইংরেজিতে কথা বলছে এখানে সবাই। ঋতি ছোটো ছোটো করে উত্তর দিল। প্রথম দিন দশ মিনিট একটি বিষয় নিয়ে পড়াতে হবে। ঋতি ছন্দ পড়ালো। উপস্থিত অধ্যাপকরা সেখান থেকে নানারকম প্রশ্ন করল ঋতিকে। ঋতি উত্তর দিতে পারল। তার দশদিনের মধ্যে ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়ল। ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন ঋতির পরিচিত এক অধ্যাপক। দীর্ঘদিন তার বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ আছে। ঋতি বুঝল আজও তিনি নিজের পরিচিত কাউকেই ঢোকাবার চেষ্টা করবেন। ঋতি ভেতরে ভেতরে দমে গেল। বুঝল তার হবে না চাকরিটা। ফলে প্রথম থেকে তার ভেতরে যে ভয়টা কাজ করছিল সেটা কেটে গেল। দেখাই যাক না কি হয়! 

ইন্টারভিউ বোর্ডে স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যার বসে আছেন। আরো দুএকজন ঋতির পরিচিত অধ্যাপক। প্রিন্সিপাল স্যার প্রথমেই ঋতিকে পিএইচডির কথা জিজ্ঞেস করলেন। ঋতি অলরেডি ডিগ্রি পেয়ে গেছে শুনে তিনি সানন্দে নম্বর যোগ করতে লাগলেন। ঋতির প্রচুর পাবলিকেশন। প্রচুর সেমিনার অ্যাটেনডেন্স। সব নম্বরই যুক্ত হলো। সেই সঙ্গে ওর এক্সপিরিয়েন্সের নম্বর। যত এসব নম্বর যোগ হচ্ছে তত অধ্যাপকটির ভুরু কুঁচকে উঠছে। এবার প্রশ্ন করার পালা। তিনি প্রথমেই কুমারসম্ভবমের একটি শ্লোকের প্রথম চরণটি বলে একটি প্রশ্ন করলেন। 

ঋতি শ্লোকটি পুরোটা মুখস্থ বলে এই শ্লোকটি কি সূত্রে ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় তা গুছিয়ে বলল। 

এতে কিন্তু অধ্যাপক সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। 

ঋতি তখন বুঝে গেছে স্যার ইচ্ছে করে নানা অছিলায় ঋতিকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তার মানে উনিই ঠিক করেই রেখেছেন চাকরিটা ঋতিকে পেতে দেবেন না। কিন্তু ঋতি তখন ডেসপারেট হয়ে উঠেছে। ঋতি মুখের ওপর বলে দিল স্যার আপনি যে প্রশ্নটা করছেন ওটা একটা অবান্তর প্রশ্ন। ওর সঙ্গে এই শ্লোকের রসপ্রস্থানের কোনো যোগাযোগ নেই।

ব্যস্। অধ্যাপকটি মারাত্মক খেপে উঠলেন। প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখছেন অবস্থা। এই মেয়েটি আসলে কলেজে পড়াবারই যোগ্য নয়। 

ঋতির তখন রোখ চেপে গেছে। ঋতি গোঁজ হয়ে বসে আছে। ক্ষমা চাইছে না। 

প্রিন্সিপাল স্যার মিটিমিটি হাসছেন। 

পরিস্থিতি খারাপ বুঝে বাকি আরো দুএকজন অধ্যাপক ঋতিকে আরো কিছু প্রশ্ন করলেন। ঋতি সব প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারল। ইন্টারভিউ শেষ করে ঋতি বেরিয়ে এলো। কলেজের বাইরে এসে কিন্তু ঋতি আর তার মনের জোর বজায় রাখতে পারল না। মধ্য কলকাতার একটি আভিজাত্যপূর্ণ জায়গায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ঋতি হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। 

এই ঘটনার পর দু মাস কেটে গেছে। ঋতি খোঁজ নিয়ে জেনেছে ওখানে অন্য একজনের চাকরি হয়েছে। তাকে ঋতি চেনে না। ঋতি আবার পরের সিএসসির জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেছে। এদিকে বাড়িতে অশান্তি আরো চরমে উঠেছে। অনন্ত ধরেই নিয়েছে ঋতি কোনোদিনই ফুলটাইম চাকরি পাবে না। প্রায় দশ বছর হতে চলল ঋতি এম এ পাশ করেছে। শ্রীও হতাশ। এইভাবে ভগ্নীপতির দোকানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চোর অপবাদ নিয়ে তার বাকি জীবনটা কাটবে! আর ঋতি! ঋতি হয়ে থাকবে পুলু কাকুর রক্ষিতা! স্নেহময়দা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে জীবন থেকে! শুধু ওর প্রতি ভালোবাসাটা আজও অমলিন হয়ে ঋতির মনের মধ্যে জ্বলে আছে। যদিও ঋতি জানে বেশ্যার ভালোবাসায় আসলে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই! ঋতি আর আয়নার দিকে তাকাতে পারে না। আত্মীয়স্বজনের জমায়েতে যায় না। পুলুকাকুকে সঙ্গ দেওয়া, শরীর দেওয়া এই তার কাজ। পুলুকাকু বলেছে, চাকরি চলে গেলেও অসুবিধে নেই। আমি একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেব। পুলুকাকুও জানে ঋতি আর কোনোদিন চাকরি পাবে না। ফলে একেবারে হাতের মুঠোয় করে নেওয়া গেছে বত্রিশ বছরের এই শরীরটাকে। বাষট্টি বছরের কামুক পুরুষের কচি রক্ষিতা! ঋতি আস্তে আস্তে মোটা হয়ে যাচ্ছে। শরীরে পুরুষের জল পড়েছে। ক্রমাগত আইপিল খাচ্ছে। শরীরের আর দোষ কি! আজকাল পুলু ঋতিকে ভোগ করতে করতে বলে কেমন মাপ মতো করে নিয়েছি বল! তারপর একটা ফিচেল হাসি হাসে। ঋতি চুপ করে থাকে। তার আর কাউকে কিছু বলার নেই। সে যে কেন আত্মহত্যা করে না সেটাই আশ্চর্য! এই নোংরা পাঁকের গন্ধওঠা জীবনটা সে কেন বয়ে বেড়াচ্ছে! কিসের প্রত্যাশায়! 

এর মধ্যে ঋতি আর শ্রীর ওপর চাপ তৈরি হয়েছে এই বলে যে বিশ্বদেবের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে! এই যে তারা দুজন বিশ্বদেবের অনুমতির পরোয়া না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল এর তো একটা বিহিত হওয়া দরকার। ঋতি আর শ্রী দুজনেই যেতে অস্বীকার করেছে। অনন্তর সঙ্গে সেই নিয়ে অশান্তি আরো বেড়েছে। অনন্তর মনে হয়েছে দাদাকে শ্রী আর ঋতি একেবারেই পাত্তা দিচ্ছে না। দাদার অভিভাবকত্বকে প্রশ্নের মুখোমুখি ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বদেবও এদের মা মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে নিজেই একবার যাই বুধুর ফ্ল্যাটে। কথা বলি ওদের সঙ্গে। 

এইসব চলছিল যখন তখন একদিন দুপুরে আবার সেই কলেজ থেকে ঋতির কাছে ফোন এলো। আগামীকাল প্রিন্সিপাল স্যার দেখা করতে চেয়েছেন। ঋতি খুব অবাক হয়। ওদের তো নিয়োগ হয়ে গেছে। তাহলে! 

ঋতি পরদিন যথাসময়ে হাজির হয়। যদিও প্রিন্সিপাল স্যারের আগে অন্য দুই গণ্যমান্য অধ্যাপকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তারা ঋতিকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিশেষ কিছু দিক নিয়ে ঋতির দক্ষতা যাচাই করা হয়। তারা স্যাটিসফাই হয়ে শেষপর্যন্ত ঋতিকে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিয়ে যায়। প্রিন্সিপাল স্যার জানান তাঁদের কলেজের নতুন ক্যাম্পাসের জন্য পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক হিসেবে সামনের মাস থেকে ঋতিকে তারা নিয়োগ করতে চায়। 

ঋতির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। 

 

 

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes