
রবীন্দ্রই ঠাকুর
রূপশ্রী ঘোষ
রবীন্দ্র বিষয় বা তাঁর দর্শন নিয়ে কোনোকিছু পড়াতে বা কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা করতে খুব ভয় করে। কারণ খুব গভীরে গিয়ে আলোচনা করার মতো ক্ষমতা বা ধৃষ্টতা কোনোটাই আমার নেই। আমার মাস্টারমশাইদের বই পড়েই আমি গভীর তত্ত্ব খুঁজি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে এক অনুভূতি। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর রচনা আসলে আমাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বলেই আমার মনে হয়। তাঁকে ছাড়া এক পাও যেন চলা সম্ভব নয়। ছোটোবেলায় ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ বিষয়ে রচনা লিখতে গেলে যেমনটা লিখতে হত আর কী। বিজ্ঞান ছাড়া আমরা এক পাও চলতে পারব না। ঠিক তেমনি আমাদের প্রতিটা অনুভূতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া যেন কিছু ভাবা যায় না। বলা ভালো অন্যকোনো ভাবনা আসে না। সকালের ব্রাশ করা দিয়ে বিজ্ঞান শুরু। তেমনভাবেই রবীন্দ্র গান দিয়ে সকাল হতে পারে, ‘ওঠো ওঠো রে – বিফলে প্রভাত বহে যায় যে’। এ গান শুনলেই তো আর বিছানা আঁকড়ে থাকা যায় না। হাসি, আনন্দ, কান্না, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা সবকিছুর উপশম আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীতেই প্রকাশ করতে পারি। যাঁরা বলেন প্যানপ্যান করে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে ভালো লাগে না তাঁদের অনেককেই দেখা যায় তাঁরা তাঁদের ঠিক ঠিক মনের ভাবটা প্রকাশ করতে সেই রবীন্দ্র গানেরই শরণাপন্ন হন। রবীন্দ্র বিরোধী ঝড় উঠেছিল ঠিকই, কবিতা, গল্প সাহিত্যে কিন্তু সে ঝড় তো থেমেও গিয়েছিল। ক্ষণিকের হয়ে থাকা খুব সহজ, চিরকালীন হওয়া কঠিন ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিরকালীন কবি এ নিয়ে কারোর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যাঁরা বলেন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কী অন্য কোনো কবির কবিতা বা কোনো কবি চিরকালীন হতে পারে না? পারেন তো। হচ্ছেন কোথায়? ধরা যাক কবি জীবনানন্দের কথা। তিনি তো হতে তো পারেন বাঙালির তথা বাংলার চিরকালীন কবি। এক অর্থে চিরকালীন তিনিও, কিন্তু তা গুটিকয় মানুষের কাছে। তাঁর জন্মদিনে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা রবীন্দ্র বিরোধীদের কোনো ঘটা করতে দেখা যায় না। জীবনানন্দের জন্মদিন কজনের মনে আছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করি। আসলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একজন একটা গোটা প্রতিষ্ঠান। এবং তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে যে স্পর্ধা দেখিয়েছেন তা আর দ্বিতীয় কোনো কবির মধ্যে আমরা দেখতে পাই না। তিনি নিজেই তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতার মধ্য দিয়ে সে স্পর্ধা স্পষ্ট করেছেন। পাঠকদের প্রতি অফুরন্ত আশাও প্রকাশ করেছেন বলা যায়। ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় কবি বলছেন –
“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে—
আজি হতে শতবর্ষ পরে”।
শতবর্ষ পরে তাঁর কবিতা কেউ কৌতূহল ভরে পড়বে এ আশা তিনি করেছেন। এবং যদি পড়েও তাদের জন্যও তিনি বার্তা দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয় তা তিনি কবিতায় স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন।
“আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ–
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে”।
শতবর্ষ আগের নববসন্ত, ফুল, বিহঙ্গের গান অনুরাগে সিক্ত করে পাঠাতে পারবেন না ঠিকই, কিন্তু তারপরেও তিনি কী রেখে যাচ্ছেন সেটাই বড়ো করে দেখালেন। একবার দক্ষিণ দ্বার খুলে বাতায়নে বসে কল্পনায় অবগাহন করলেই সে খনির খোঁজ পাওয়া যাবে। মনে মনে ভেবে দেখার কথাও বললেন কবি। আগামী প্রজন্ম, আগামী পাঠকদের প্রতি তাঁর এই আস্থা দেখে বারেবারে অবাক হতে হয়।
“তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে–
একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে–
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
উন্মত্ত অধীর–
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর”—
তিনি শতবর্ষ আগে এসে যৌবনের রাগে কীভাবে ধরাকে রাঙিয়ে দিয়েছেন পাঠক তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকেই প্রতিনিয়ত মুঠো মুঠো করে কুড়িয়ে নেয়। তারপরেও কবি নিজেই আরও স্পষ্ট করে, বলা যায় আরও জোরের সঙ্গে যেন উচ্চারণ করেছেন –
“সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ আগে।সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
কবি এক জাগে–
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ আগে।
আজি হতে শতবর্ষ পরে”
কবির বিস্ময়, এখন কোন নতুন কবি তোমাদের ঘরে বসন্তের গান করছেন? তাঁর জন্যও তিনি অভিবাদন পাঠালেন। শতবর্ষ পরে তা একবার ধ্বনিত হোক।
“এখন করিছে গান সে কোন্ নূতন কবি
তোমাদের ঘরে?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে”।
কবির এই যে উচ্চারণ, এই যে স্পর্ধা বলা ভালো এত যে ভরসা এ আর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোনো কবির থেকে পাওয়া কি সম্ভব? তাঁর গান ‘তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাক’ এটিও তাঁর নিজের প্রতি আস্থা বা স্পর্ধার গান। এরকম অজস্র গান, কবিতার মধ্যে তিনি নিজেই নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিজস্ব ভালোলাগা থেকে কিছু সাহিত্যিক, কিছু কবি বা কিছু মরমী পাঠক বা কিছু অধ্যাপক জীবনানন্দ চর্চা করেন ঠিকই, বা তাঁর কবিতা স্কুল কলেজের সিলেবাসেও অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু কবি জীবনানন্দকে কজন মনে রেখেছেন? তাঁর কতগুলো উপন্যাস বা আর কী কী পাণ্ডুলিপি আছে তা কজনেরই বা জানা। প্রশ্ন একটাই রবীন্দ্রবিরোধীরা সঠিক তথ্য জানেন তো? শুধু জীবনানন্দ একজন উদাহরণ, আসলে বহু প্রখ্যাত বাঙালি কবি নিয়েই একই বক্তব্য খাটে।
বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ বা আগামীদিনে বাংলা ভাষার হাল কী হতে চলেছে, বাংলা ভাষা নিয়ে আদৌ আর চর্চা হবে তো? এই যে গেল গেল রব, যা লেখক সাহিত্যিকদের ভাবায় যে, এত বাংলা সাহিত্য লিখে কী হবে। আগামী প্রজন্ম তো ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ইংরেজই তৈরি হচ্ছে। তাহলে বাংলায় এত লিখে লাভ কী? মজার বিষয় হল, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিন্তু এত হাহাকার শোনা যায় না। তিনি নিজেই একটা ব্র্যান্ড বলা যায়। তাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালি যাবে কোথায়। পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে, মোড়ে মোড়ে, বিভিন্ন কমপ্লেক্সে কবি পক্ষর অনুষ্ঠান কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। কবির জন্মদিন ঘটা করে পালন না করলে বাঙালিদের পাপ হবে। বাড়িতে যতই নিয়ম করে হিন্দি বা ইংরেজি গান চলুক না কেন। এমনই একটা মিথ যেন চালু হয়ে গেছে। বয়স্ক কিছু মানুষ, বাংলা মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি আমাদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েগুলোও কিন্তু নাচবে, গাইবে, আবৃত্তি করবে। কিন্তু সেটা কতদিন? এই নতুন প্রজন্ম যখন অভিভাবক হবেন তখন তাঁরা কী করবেন সে উত্তর কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জানতেন না ১৪৩১ সালে এসে তাঁর কবিতা, গান নিয়ে চর্চা হবে। তবুও তিনি পাঠকদের উপর আস্থা রেখেই লিখে গেছেন। আগামী প্রজন্মের উপর আমাদেরও আস্থাই রাখতে হবে। তাদের মধ্যেই অনেকে হয়তো তাদের ব্যক্তি ইচ্ছা থেকেই এই বাঙালি কবিকে বহন করে নিয়ে যাবে। এখনো যাঁরা করছেন তাঁরা ব্যক্তি ইচ্ছা থেকেই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করছেন। কেউ আড়ম্বর করে কেউবা নিভৃতে। নিভৃত যতনে কবিকে ভালোবেসেই কবির নাম মনের মন্দিরে যতন করে রেখেছেন। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো ছাড়া বাঙালির মনে হয় আর কোনো উপায় নেই।
যাহোক, আমার ঠাকুর একজনই। যাঁর জন্ম মৃত্যু আছে বলে জানি। তাঁকে রোজ ধূপ ধুনো মালা দিয়ে পুজো করি না বটে। কিন্তু নিয়ম করে তাঁর গান, কবিতা বা গদ্য না পড়ে, না শুনে দিন অতিবাহিত হয় বলে মনে পড়ছে না। আমি আমার মতো যতন করি।
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক, গদ্যকার, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।