“তামসী আমার গৌরী, তাকে দাও আলোর শুশ্রূষা”
: বেবী সাউ

” …
এর চেয়ে নির্বাণের দ্বীপে
মুক্তি যদি নেওয়া যেত, সান্ত্বনার সমুদ্রবলয়ে!
তার ঢের দেরি আছে, তিয়াত্তর অতিক্রান্ত, তবু
অতৃপ্ত বাসনা। বলো, পৌত্রের বিবাহ দেখে যেতে
কে না চায়?” ( অন্ধ বাউল)
তাই দেখা যায় অভিমান বশতঃ বারবার বিচ্ছেদ তৈরি হয় আমাদের। বারবার আমরা বিপরীত মুখে হেঁটেও কোথাও যেন মিলেমিশে যাই। ভাবি, পথ কখনোই সরলরেখা নয়। তার গতি আছে, বেগ আছে। ভালোবাসাবাসি আছে, আর আছে দৃশ্যের কাছে নত হয়ে ভালোলাগা, মন্দলাগাটুকু শেয়ার করা, তার সাথে। তাই বোধহয় বারবার মিশে যায় পথ… হাঁটা… তারচেয়ে বলা ভালো ফেরা। আমাদের। বারবার। যদিও সবসময়ই এর জন্য দায়ী করা হয়, পৃথিবীর গোলাকার আকৃতিকে। কিন্তু, আমি বহু ভেবে দেখেছি, বেচারা পৃথিবীর এতে কোনও দোষ নেই! নাকি তার আকৃতি গোল, নাকি সে ইচ্ছে করে কাউকে মুখোমুখি হোঁচট খাওয়াতে চায়! আর তাই যদি চাইত তবে কী এই বিপুল গ্রহরাজির মাঝে নিজেই প্রথমে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত না! আসলে, এই ফেরা ইচ্ছের ফেরা। এই ফেরা মনের। ফিরতে চাই বলেই ফেরা হয়ত বা। কিন্তু তারপর?
দেখেছিলাম, বহুদূরে তাঁর ঘর। তাঁর পথ। সবকিছু ছেড়ে, শীতের আগেই তাঁকে পৌঁছে যেতে হয় এই বাংলার সাধারণ, ছোট্ট একটা গ্রামে। সাধারণ কিছু পশমের ওম নিয়ে… শুধু কি এই সামান্যতম কারণে হেঁটে আসা এতটা পথের শুরু ? সামান্য ক্ষুধাই কি এর কারণ ? গাছের পাতায় যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রোদ, শিশিরের মৃদু হালকা উদাসী স্বর… আলপথে মেলে থাকা বিস্তারিত সবুজ… মাটিভেজা ঘ্রাণ… সেই কাশ্মীরি উপত্যকা থেকে তাঁকে টেনে আনেনি এই সামান্য গ্রামের উঠোনে! তাঁকে বুঝি বেঁধে ফেলেনি এই গ্রাম্যহৃদয়ের স্নেহ, ভালোবাসা… উত্তাপ! শীতের কাঠিন্য ভেঙে, দূরত্বের জড়ত্ব ভেঙে সেও কি খুঁজে নিতে সক্ষম হয়নি এই অপরিচিত পৃথিবীর একটা কোণায় সুললিত চিত্রকে! আর তাই মায়া! ভালোবাসা! আত্মীয়তা! তাই যখন সে, এখানকার কেনাবেচা শেষ করে, ফিরে যেতে চাইত তাঁর সেই জন্মভূমির কাছে, পরিচিতির কাছে, আত্মীয় স্বজনের কাছে… তখন তাঁর মনে বিষাদ খেলা করত এখানকার এই ছোট্ট দিঘির জন্য, ধান্যশিষে নুয়ে পড়া আলপথের জন্য… আমার ঠাকুমার সামান্য চিঁড়ে গুড়ের জন্য! অথচ, সে তো ফিরতেও চাইত তার প্রেমের কাছে, সন্তানস্নেহের কাছে, বৃদ্ধ পিতামাতার কাছে! তবে? বেদনা তো নির্মম ভাবে মৃত্যুর দোসর। যদিও ‘ জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু’– কিন্তু ক্ষতের কাছে কবি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন সেই প্রকৃত দর্শনকে। তখন তাঁর কাছে ‘ ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ’। আলো আছে, আলো আছে— চিৎকার করে উঠছে তাঁর ষোড়শী সত্ত্বা। এই চিরন্তন সত্যের কাছে থেকে তিনি আবৃত্তি করে ওঠেন–
” Into this universe, and why not knowing
Not whence, like Water willy- nilly flowing:
And out of it, as Wind along the Waste ,
I know not whither, willy-nilly blowing.”(29)— ফিটজেরাল্ড
মানুষের প্রয়োজনে তৈরি হয় পথ। পথ পেরোনোর জন্য গড়ে নিতে হয় রাস্তা। তখন, ঘর ভেঙে চিরাচরিত হাসিকান্না সুখ দুঃখ ভেঙে হাঁটা শুরু হয় গন্তব্যের দিকে। যেতে চাইলে যেতে হয় সেই পথে, আবার না চাইলেও যেতে হবে তাকে! সেই পথ সুন্দর, কারুকার্য মণ্ডিত, সেই পথ দৃশ্যের কাছে নত… সেই পথ বিরহের, দুঃখের, বিচ্ছেদের । কাহিনির পর কাহিনি সাজিয়ে হেঁটে যাওয়া পথের স্বপ্ন ঘিরেই যেন মানুষের যাত্রা শুরু। তাকে যেতেই হবে; থেমে থাকার, বসে থাকার কোনও উপায় নেই!
আর এই পথ তাঁকে তৈরি করে নিতে হয় জীবনের শুরুতে। যৌবন প্রারম্ভে! সাজিয়ে নিতে হয় ক্যানভাসের রঙে… অক্ষরের উত্তাপে… এলোমেলো অথচ সুসংগত অপেক্ষার পথে। শুরুর এই পথ শেষের পথে এসে জড়িয়ে ধরে মায়া… আরোহণের দৃশ্য, অভিমানের গন্ধ, রঙ, স্নেহ, প্রীতি… ভালোবাসা। যেতে হবে তাকে কিন্তু মন সায় দেয় না যে… ফিরতে হবে সেই জানা অথচ অজানা গন্তব্যে কিন্তু ততদিনে সেই ‘অন্ধ বাউল ‘ জেগে উঠে জানান দেয় আসল সত্য… আসল সারমর্ম কে। তাই যৌবন প্রারম্ভ কথা শুরু করে ঠাকুমার হাত ধরে… উপলব্ধি নিয়ে দেখে ফেলতে চায় সেই পৌত্রের বিবাহ! নতুন এক প্রেমের আস্বাদন কে? অথচ, এই প্রেম, এই পথ তো বহু পরিচিত তাঁর কাছে… বহুবার দেখা হয়ে গেছে এই দৃশ্য, পাওয়া হয়ে গেছে বহুদিন তাঁর ছোঁয়া! এই বিকেল উপান্তে এসে তবে কি নতুন করে খোঁজা সেই প্রভুত প্রত্যয়কে! তাই কেঁপে ওঠা কুপী নিয়ে… একা বড় একা হয়ে যায় পথ! রাস্তা! হেঁটে যাওয়া!
“থির বিজুরি, বদন গৌরী,
পেখনু ঘাটের কূলে।
কানড়া ছাঁদে, কবরী বান্ধে,
নবমল্লিকার মালে।।
সই মরম কহিনু তোরে।
আড় নয়নে, ঈষৎ হাসিয়া,
আকুল করিল মোরে।।” ( চণ্ডীদাস)
‘জানো এটা কার বাড়ি?’ নরম উঠোন আছে তার! স্নিগ্ধ মাটির ঘ্রাণ! শ্যাওলা ছেড়ে গেছে যাকে… শ্যাওলা মুছে দিয়েছে যে হাঁটাপথের দাগ… অথচ ছিল সেই বাড়ি… আজ যদিও বুধুয়া খুঁজে নিতে পারে তার মাঝখান থেকে অসীম নীলাভ রঙ… ক্যানভাসে ভরে দিতে পারে যদি বিরাট পাখির বাসা… পথের কলসে হেঁটে যেতে পারি আমিও… একাকী নির্ভার… আর এখানেই কবির সঙ্গে প্রকৃতি, কবিতা, শব্দ সংযোগ গড়ে তোলে। একাত্ম হয় পাঠক। কারণ অলোকরঞ্জন জানেন, এই মহাজগতের প্রতিটি বিন্দুই সূচিত করে কেন্দ্রকে। এই কলম, শব্দ শুধুমাত্র আধার ছাড়া কিছুই নয়! তাই এই সামান্য মাটির ঘর যেমন মহাবিশ্বের অংশ, তেমনই মহাকালের অংশও বটে… পথের হদিস পেতে পেতে সেও খুঁজে নিতে সক্ষম পাহাড়ের নীলাভ বলয়… অসীম শূন্যতা!
সমন্বয়ের কবি অলোকরঞ্জন। দুটো আলাদা দেশ, মহাসময়ের বিরাট একটা প্রান্তর, ঈশ্বরচেতনা এবং মানবচেতনার দুই ভিন্ন অভিমুখ অন্য এক বোধের ধারা মিশে যায় তাঁর মধ্যে – ব্রেসট এবং চণ্ডীদাস এক সঙ্গে কথা বলেন তাঁর বিশ্বে, কখনও হয়ত খ্রীস্টপূর্বাব্দের রচনার সঙ্গেই সহবাস করে তাঁর অক্ষর। শব্দ। কথা। আবার কখনও বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ক্ষতবিক্ষত দিনগুলোর সঙ্গে স্মৃতিবিদ্ধ হয় তাঁর রচনা। একদিকে জার্মান কবি পাউল সেলানের রচনা, মেধার সঙ্গে মিশে যায় তখন ভারতীয় মায়ের মায়া, স্নেহ। এবং এই কাজটি নিপুণ ভাবে করে দেখান, আজকের দিনে বসেই অনায়াসে তিনি অপৌরুষেয় সৃষ্টির দায় বহন করার কথাও ভাবেন।
এখানে শহর নেই। শহরের কংক্রিট নেই… তাই ধূসর নয় প্রাত্যহিক জীবন… চলন। কিন্তু শূন্যতা আছে, হারানোর ভয় আছে… দুর্দম পথের বাসনা ফুরানোর চিন্তাও আছে। ‘আশ্চর্য আমার চিন্তা তবু অন্তহীন’— অজানা, অচেনা সেই ভবিষ্যৎ কি তবে আমাকে নাগরিক করে তুলবে। করে তুলতে পারে রোমাঞ্চহীন এক অতিবাস্তব পথের পথিক। যে পথে, শুধু ঔদাস্য হেঁটে যাওয়া আছে। আসলে এই যৌবন বাউল পড়তে গিয়ে আমার কাছে বারবার ফিরে আসছে একটা পথে দৃশ্য… পথের দু’ধারে ভেসে ওঠা বিভিন্ন দৃশ্য। তাই বোধহয়, আমার মনে হচ্ছে জীবনের বোধগম্য পথের প্রকৃত প্রারম্ভ এই যৌবন কাল-ই। শিশু কৈশোর অবস্থার হাঁটা শুধু রোমাঞ্চ, শিহরণের। ওখানে নিজেকে আবিষ্কারের নেশা পেয়ে বসে না। উদ্দাম হেঁটে যাওয়া তাই তখন। ” অথচ এখানে ছোটো পুকুরের পাড়ে/ একটি প্রশান্ত হাঁস মাথা নাড়ে,যারে/ ছুঁয়েছে জলের প্রেম বহুবার; আলোর চন্দন/ মেখেছে অনেক, তবু তবু ওর নিরাসক্ত মন-/ যতোবার জল বাড়ে আলো তারে মিনতি জানায়,/ সবার গ্রাহক হয়ে স্থির আছে নিস্পৃহ ডানায়/ সারা মুখে লেগে আছে হাসি/ একটি হাঁসের রাজ্যে হবো আমি প্রসন্নউদাসী।।”
কিন্তু কোথায়? কোথায় ফেরা যেতে পারে এই মূহুর্তে? কালো যমের মত ধেয়ে আসছে পাগলা হাতি। অসংখ্য মৃত্যু চিৎকার করে উঠছে চারপাশে। কাকে কাকে অবহেলা করা যায়! অবহেলা করে কি শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে সেই নির্ভরযোগ্য অবস্থানের কাছে! কবি অলোকরঞ্জন শুধু ওই বিপ বিপ সাইরেনের শব্দ শুনেছেন। আর তাতেই ফেরার ইচ্ছে থেকে, পালানোর স্পৃহা জাগরিত হয়েছে তাঁর মনে। কিন্তু সাইরেন শব্দ কি বিপ বিপ! উঁহু! এই সাইরেন বিশ্বায়নের করাল গ্রাসের শব্দ নয়ত! সারা পৃথিবীর কাছে আজকে প্রমাণ দেওয়া আমি আছি… এই আমি…
আত্মঘোষণা?– যা কি না অপরের কাছ থেকে শুনতেই হবে? যা কি না “লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়” গোছের। আত্মতুষ্ঠি। সমাজের কাছে তুলে ধরা ব্যক্তি “আমি”কে! “Our Pagan Times” এর ওই লাইনগুলোর মতো! আইসিসের ঘোষণার মতো! আমি সব পারি– তোমার দেখো এই তার কার্ড। ঠিক বার্থ সার্টিফিকেটের মতো। জন্মেছি এটাই সত্য। এই সময়, এই স্থানে। এই যে বর্তমান এটা মিথ্যে? আবার শ্মশানে চলে যাওয়া শোক, চিতা সব মিথ্যে হয়ে যায়– মৃত্যু প্রণাম পত্রের অভাবে! আশ্চর্য! কিন্তু আশ্চর্য নয়। সত্যি অথচ মিথ্যেও নয়। তেতো একটা জীবন নয়?
এইযে আমি… আমার কায়া ছায়া… আমার আমিত্ব নিয়ে একটা চিরন্তন ভাবের উদয় হচ্ছে আর আমি এই বিশাল বিস্ময় এর কাছে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছি, মিলিয়ে নিচ্ছি মহা প্রকৃতির অংশ হিসেবে— তার মধ্যেই চলছে চিরজায়মান ধ্যানীর ঘুম ভাঙাচ্ছে অবিনশ্বর সেই চৈতন্য! তখন কে বা আধার, কে যে আধেয়! এই প্রবহমান ধারায় ভেসে যাচ্ছে যে নৌকো, নৌকোর মাঝি অনন্ত জীবন প্রবাহপথে ভেসে যাওয়া মোহানার দিকে শব্দ দিয়ে কবি যেন ধরে রাখতে চাইছেন সেই অসীম ক্ষমতাময়ী ‘ আমাকে বলাও সেই কথা, যেকথার প্রতিধ্বনি / বৈকুণ্ঠবাসীরে করে আমার একান্ত প্রতিরূপ’। আর সেই সুন্দরের দিকে হেঁটে যাওয়াটাই ঈশ্বর সাধনা! প্রকৃতির উপাসনা! আর এখানে কবিকে বলা যেতে পারে ঈশ্বর উপাসক; সৌন্দর্য উপাসক। তা তো কবি মাত্রই! মহাকালের নিগূঢ় তত্ত্বের প্রতিফলন তো তাঁর কলমের নিব দিয়েই প্রস্ফুটিত হতে চায়! হয়ও। তাই শতকের জতুগৃহদাহ থেকে বেরিয়ে, অন্ধকার রাতের মধ্য থেকে খোঁজ চালান হৈমবতী গৌরীর। জীবনের অন্ধকার ভেদ করে সেই আলোময়ী নারী তাঁকে দিতে পারেন করোজ্জ্বল আলোর সম্ভাবনাময় পথের হদিস। এই যে আলো এবং অন্ধকারের খেলায় মেতে উঠছেন কবি, কবির সত্ত্বা ; তবে কি এই “যৌবন বাউল” সুরে মন্দরিত হয়ে! তাই খেলা সাঙ্গ হলেই তিনি নিঃসঙ্গ নটরাজ! যেন সেই অমোঘ বার্তার কাছে, সৃষ্টি ও ধ্বংসের খেলায় এঁকে নিচ্ছেন তাঁর পথ। তাঁর অক্ষরের মালা। একের পর এক সাজিয়ে তুলছেন চিরজাগ্রত সত্যকে! সুদীর্ঘ একুশ বছর পরে, এই যৌবন প্রারম্ভে তিনি যেন ফিরে যেতে চাইছেন, তাঁর শিশু অবস্থাকে। বসুমতী মাকে। ঠিক এই আলোর খোঁজ চলছে তাঁর পরবর্তী কবিতায়, ” তোমার মনের গভীর অরণ্যে / গোপন ব্যথার অঞ্জলি আজ আনম্রঅঙ্কুর/ এখনো তার ইচ্ছা নামঞ্জুর / জানাও তারে; ‘ তুই এবার আলোর শরণ নে”। তাই বুঝি জেগে প্রসন্ন প্রদীপ জ্বালিয়ে জেগে থাকে কল্যাণেশ্বরীর হাট? প্রগাঢ় নিষ্ঠায় বসে অপেক্ষার পথ গুণছে!
ঠিক এখানেই বাংলা কবিতার জয়যাত্রায় সূচনা হয়। অক্ষরে এসে বসে আলোময় পথ। তীক্ষ্ণ, তীব্র অথচ সিগ্ধ আলো রেখা বলে ওঠে ‘ অহম অস্মি’! আর আমরা চিরঋণী হয়ে থাকি কবি অলোকরঞ্জনের কাছে। তাঁর কবিতার আলো পথ দেখায় বাংলার শাশ্বত নীতির সঙ্গে সহবস্থানের। তাঁর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় অনন্তকালীন সেই সত্ত্বার কাছে, এক চিরকালীন অভিযানের সঙ্গী করে। তাই তাঁর কবিতা সঙ্গে থাকলে আমারও মনে হয়ে যেন সেই সুদূর রহস্যময় পথ, আলোক বর্তিকা নিয়ে ডাক পাঠাচ্ছে আমার দিকে… আর তাতেই আমিও হয়ে উঠছি চির পথিক। নিঁখুত ভাবে চয়ন করে নিতে চাইছি আমার রাস্তা, পথ। কিন্তু এই পথ শুধু নির্মোহ ভাবে ছুটে যাওয়া আলোর দিকের পথ নয়… হাঁটতে হাঁটতে পথের দুধারের অসংখ্য দৃশ্য, দৃশ্যের কারণ, ছোট ছোট বিভিন্ন ঘটনা, রাস্তার দুধারের বসতি, স্নেহ, প্রেম, প্রীতি ; হিংসা- দ্বেষ— বৈরীতা সব তাঁর সঙ্গী হয়েছে। রাতের অন্ধকার নিয়ে তাই ভরে উঠছে নটরাজের ভোর। আকাশের পায়ে পা মেলাচ্ছেন ‘জননী পবন’! অক্সিজেন! জীবন বায়ু! তিনি নিশ্চেষ্ট, তিনি নির্মোহ এবং উদাসীন দ্রষ্টা। শুধু দেখে যাচ্ছেন, শুধু অনুভব করে যাচ্ছেন এই পথের সুরম্যতা। নিজেকে মিলিয়ে নিচ্ছেন মহাজগতের সঙ্গে। তাই এই যৌবন বাউল আসলে যেন সেই অনুসন্ধানী পথের নাবিক। কোনও পথ তাঁর কাছে মিথ্যা নয়, বরং এই অন্ধকার মিথ্যার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পাচ্ছে অনন্ত আলোর, সত্যের। তাই এই যৌবন বাউল এক অনুসন্ধানকারী পথিক, যিনি জানেন অনুসন্ধানের নানা পথ আছে, আছে নানা মত। সেই প্রকৃত পথটিকে খূঁজে পাওয়ার জন্য তিনি রচনা করেন পুজো পদ্ধতির। রিসার্চ করেন রূপের মধ্যে অরূপের। তাই যৌবনের অসংযমী আত্মা এখানে স্থির, সংযমী, সহিষ্ণু, স্থিরপ্রতিজ্ঞ। তার সঙ্গে এসে মিশেছে তাঁর অভিযাত্রা। মেধা, মনন এবং দার্শনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে।
” সুগত, এ-জন্মে আমি কেউ না তোমার।
আজ তবু সন্ধ্যায় যখন
জাতিস্মর জ্যোৎস্নার ঝালরে
তোমার হাসির মন্ত্র নীরব ঝর্ণায় ঝরে পড়ে,
আমারও নির্বেদ ঘিরে পূর্ণিমার তিলপর্ণিকার
অগুরু গন্ধের বৃষ্টি — মনে হল এখানে আবার
তোমার সময় থেকে বহুদূর শতাব্দীর তীরে
জয়শ্রীজীবন পাব ফিরে,
ফিরে পাব পরশরতন। ” ( বুদ্ধপূর্ণিমার রাত্রে)
তাঁর এই উচ্ছ্বাস প্রকৃত বাউলের। তাঁর এই খোঁজ প্রাজ্ঞ নির্জনতার। স্পষ্ট এক আলোর হাতছানি তাঁকে পথে নামিয়েছে। হাঁটার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আর তিনি এখানে সংশয়াচ্ছন্ন নন। নাকি, বিভ্রান্ত। এই পথটিকে তিনি তাই প্রকৃত জীবন মনে করেন। তিনি প্রবল প্রেমিক হয়ে শুরু করেন তাঁর জার্নি। তাই সহজেই আস্বাদ করতে পারেন স্পর্শ, গন্ধ, লয়কে। মাত্রাতিরিক্ত ভাবে যৌবনের উচ্ছ্বাস তার মধ্যে নেই। কিন্তু খোঁজ আছে। যৌবনের খোঁজ। রহস্যের, রোমাঞ্চের। তাই সহজ, অথচ নির্লিপ্তভাবে উচ্চারিত হয়, ” এ-জন্মে জানি না— তবু আর – জন্মে সুজাতা ছিলাম।’ আর এই অদৃশ্য বোধের খোঁজ পেতেই যেন কবির মনের মধ্যে বসতকরা বাউলের উদ্দেশ্য। তাঁর কবিতার এবং কাব্যব্যক্তিত্বের পথ চলা শুরু। যে পূর্ণ, অখণ্ড আলোক বর্তিকার খোঁজে তাঁর পথ চলা শুরু অক্ষরের মাধ্যমে। চিরজায়মান সেই সূর্যমুখী নারী কোন অতল গহ্বরে লুকিয়ে আছেন তাঁকে খুঁজে বের করাই কবির কাজ— বিভিন্ন রূপে বা অরূপে। সেকি আলো! নারী! দেবী! নাকি চির শ্বাশত সত্য সেই? এলিয়ট যাকে তুলনা করেছিলেন স্বচ্ছ হীরকখণ্ডের সঙ্গে! তাই কবির চেতন, অচেতনে কাজ করে চলেছে সেই খোঁজের প্রয়াস। ইচ্ছে। আমরা তাঁর ‘তমসো মা’ কবিতাটিতে দেখে নেব সেই খোঁজের অদমনীয় ইচ্ছেকে—
” দেখেছি সে- এক অন্ধ ধানক্ষেতে সারারাত্রি ঘুরে
সূর্যকে জাগাবে বলে বিষন্ন বাঁশির সুরে সুরে
একা একা জ্বলে ওঠে, আবার বিদীর্ণ আলে- আলে
বিধাতার মতো বুঝি স্বরচিত সে- আগুন জ্বালে!
তার দিব্য দুই হাতে আমাকে ছুঁয়েছে কালরাতে,
স্পর্শের অনলে কেঁপে পুণ্য হল আমার শরীর ;
অগ্নিদেব শুধালেন; ‘ হাত রাখ আমার দুহাতে,
মানুষের নামে বল এই গাঢ় শীতশর্বরীর
আড়াল যে- প্রাণজ্যোতি, তুমি তাঁর বিতন্ত্রিত বীণা
তোমার জীবনে নিয়ে এ বিশ্বে বিকীর্ণ হবে কিনা?
রাগিনীর বৃষ্টি হয়ে খরশর জৈষ্ঠের জ্বালায়
প্রান্তরে ছড়াবে নাকি প্রাণভরা পুবালিদখিনা,
রূপান্তর দেবে তাকে হেমন্তের হিরণ্যথালায়”….
দেখা যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রথম বই, যৌবন বাউল কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলি তিন পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম ভাগের কবিতাগুলি যেন নিজেকে প্রস্তুত করা হয়েছে পুজোর জন্য, এক্ষেত্রে অক্ষর পূজা বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় পর্বে পুজোর মন্ত্র, জাগরণ, প্রার্থনা, খোঁজের আকুতি আর শেষ পর্বে কবিতাগুলিতে থাকছে, নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার স্পৃহা। প্রথম পর্বে এসে বসেছে আলোর আকুতি। আলো রূপী সেই মহা প্রকৃতির প্রতি কবির বোধ এবং ইচ্ছে প্রকাশ হতে দেখা যায়… দ্বিতীয় পর্বে সেই আলো দেবী রূপে ধরা দিয়েছেন কবিকে… আবার শাশ্বত আলোর কাছে নিজেকে নত করে তোলা!
” দুহাতে অঞ্জলি করে আমারই আকাশে দিই, তুমি যার উদ্ভাসিত ঊষা / তামসী আমার গৌরী, তাকে দাও আলোর শুশ্রূষা।।”
এক একটা সময় আসে, একেকটা যুগ পেরিয়ে হেঁটে আসেন কবি, সঙ্গে তাঁর অক্ষর, অনুভব, দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনার অনুভূতি মালা। তারপর তিনি স্থির; তিনি সাধকের মতো ক্ষয়হীন। শোক মেলে ধরেছেন সুন্দরের বেশে, আলো রূপে ছড়িয়ে দিচ্ছেন রক্তাভ সূর্যোদয়ের ছবি আর সমস্ত প্রাচীর ভেঙে সেদিন সমস্ত সূর্যাস্ত একটা কালের ঘোষনায় উন্মুখ হয়ে বসে আছে। অলীক বলয়ের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে হতাহতদের গল্প। ছোটোখাটো অন্ধকারগুলিকে সূচের ডগায় গেঁথে জন্ম নিচ্ছে কবিতা। কবি হাততালি দিয়ে উঠছেন? উঁহু! তিনি আরও শান্ত, আরও নিবার্ক– নিবিষ্ট। কান পেতে ধরছেন শব্দ! অনুভব! উড়ানের গল্প। আর তখনই নেচে উঠছে কবিতা। ময়ূরের মতো বিস্তৃত তার পেখম। ডানা। আর মৃদু অথচ দৃঢ় ঢঙে কবি অলোকরঞ্জন সূচনা করছেন এক নতুন দিকের… নতুন পথের… শব্দের…
এরপরের কবিতা ‘ নির্জন দিনপঞ্জী’ থেকেই বলা যেতে পারে, কবিতার মোড় অন্যদিকে বাঁক নিয়েছে। পালটে গেছে কবিতার ভাষা, চলন। বৈশাখের সকালে তাই কবি উচ্চারণ করেন, ” আকাশ জেনেছে, মাটিও শুনেছে, আমি যে করেছি আত্মগোপন”।
তাঁর কাব্য আসলে ভিড়ের মধ্যে নির্জনতার কথা বলে চলা এক বাউলের মতোই উদাসীন অথচ আসক্ত, মায়াবী। যে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে, অথচ, থেকে যাওয়াটাও প্রবল তাঁর কাছে। প্রেমে উদারতায় বিশ্বাসী আবার উপেক্ষা করতে পারে না প্রেমিকার অভিমান… চাওয়া। তাই হয় বারবার চেষ্টা করেও তাঁর প্রকৃত বাউল আর সাজা হয়ে ওঠে না। একতারাতে সুরে বিশ্বের সাথে মিলনের আর্তি বেজে ওঠে তখন। উদাসীনতার সঙ্গে আসক্তি সম্পর্ক তৈরি করে! তাই, তাঁর কবিতা বলে ওঠে ” সারাদিন আমি দুর্বিষহ রহস্যের পাশে/ দাঁড়িয়ে রয়েছি একা। যে আমাকে দূরের প্রবাসে/ নির্বাসন দিয়ে সুখী, দীপ্ত সেই রহস্যময়ীর/ চেয়ে বুঝি এ-রহস্য আর গাঢ় অতল গভীর,/ এবার আমাকে তাই কিছুতেই মুক্তি দেবে না সে” কিন্তু সম্পর্ক তো আছেই। সম্পর্ক থাকেই। একজন শিল্পী ততই বাহ্যিক উদাসীন হয়ে পড়েন, যত তিনি প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর এই উদাসীনতা আসলে নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ ঢুকে পড়ার সাধনার মতোই প্রসারিত, একান্ত। তখন সমস্ত দৃশ্য, রঙ, রূপ নিয়ে দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গের সাথে বসবাস শুরু হয় তাঁর। তখন তাঁর সঙ্গে বসবাস করে বিরহের অক্ষর, ইতিহাসের ঝরা পাতা, বাস্তবের অক্ষরমালা — ক্রমে দেখা যায় তাঁর সেই অন্ধ কুঠুরি ভরে ওঠে সুদীর্ঘ অভিযাত্রায়। সেখানকার নিরঙ্কুশ নাবিক তখন তিনি নিজেই। কখনও বা পর্যটক। তাই হয় দৃশ্যের সঙ্গে ভাব করতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৃত বাউল— কখনও বা সামান্য গ্রাম্য যুবক।আর এই পথচলার মধ্যে, এই উদাসীনতার মধ্যেই ঢুকে পড়ে মৃত্যুচেতনা, প্রেম ও সৌন্দর্যচেতনার মতো বিষয়, তখন কবি নিজেই কবিতার সঙ্গে মিলেয়ে নেন নিজেকে, তৈরি করে ফেলেন বসতবাড়ি… আনন্দের।
” বন্ধুরা বিদ্রূপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে;
তোমার চেয়েও তারা বিশ্বাসের উপযোগী হলে
আমি কি তোমার কাছে আসতাম ভুলেও কখনো?
চারিদিকে অন্ধকার, দেখতেও চায়না ওরা কিছু,
কী-যেন দূরের শব্দে মাঝে-মাঝে সামনে গিয়ে পিছু
ফিরে এসে বলে ওরা শোনেনি দূরের শব্দ কোনো!
ওরা কেউ কারো নয়, ওরা ঘরে-ঘরে
মৃত্যুর অপেক্ষা নিয়ে প্রতিদিন মরে।
আমি যে কোথায় যাব, কখন… কোথায়…
এই ভেবে আমারো বেলা অবেলায় যায় ডুবে যায়।
এখনো তোমাকে যদি বাহুডোরে বুকের ভিতরে
না পাই, আমাকে যদি অবিশ্বাসে দুই পায়ে দলে
চলে যাও, তাহলে ঈশ্বর
বন্ধুরা তোমায় যেন ব্যঙ্গ করে নিরীশ্বর বলে।। ” ( বন্ধুরা বিদ্রূপ করে)
এই কবিতাটিকে কি একটি জার্নি বলা যায়? একটা পথ থেকে হেঁটে যাওয়া আরেকটা পথ বলা উচিত! গাঢ়তর এই বিশ্বাসে মিলে যেতে পারে অদ্ভুত সেই আলোক। বিশ্বাস! হ্যাঁ! পরিপূর্ণ বিশ্বাস! শুধু কি ঈশ্বর সাধনার ক্ষেত্রে! নাকি সমস্ত পথের স্মৃতির উপাচার নিয়ে ঘর বাঁধা তাঁর সাথে! চার্বাক দর্শন বলছে- ‘ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ’— একবার মৃত্যু হলে ফেরা যায়না কখনও। নেগেটিভ মুহূর্তের প্রতিফলন। যেখানে ফেরা নেই, সেখানে মায়াও নেই। আমি আছি কিন্তু আংশিকভাবে। তাই ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ……”। গ্রীক দর্শনও তাই বলে– ইন্দ্রিয় সুখভোগই শেষ কথা। কিন্তু কবি এখানে স্থির। ক্ষতের কাছে, বেদনার কাছে থেকে তিনি উপলব্ধি করছেন কবিতা রূপী আত্মাকে। সত্যকে। আলোকিত পথের দিকে হাঁটাপথ খুঁজে চলেছেন তিনি। বিসর্জন শেখেননি তিনি; বরং সৃজনের কাছে তুলে ধরছেন তাঁর মর্ম স্পর্শী অক্ষরমালাকে। মায়াকে ভালোবাসেন তিনি। সংসার সত্য। জীবন সত্য। তাই তাঁর কাছে সমস্ত কষ্ট সন্ধের উপপ্রান্তে এসে হাজির হয়। যার একটু পরেই ভোর। আলো। কিন্তু সম্ভাব্য কিছু ভাবনা নিয়ে তো আর নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না। তবু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র এই কবিতাটি অন্তত এমন এক সত্যের কাছে নিয়ে আসে, যেখানে প্রাকৃতিক নিরভিসন্ধিকেই এক আশ্চর্য মেধা ও হৃদয়ের যুগলবন্দিতে দেখতে পাই আমরা, আর সেখানে এসে মেশে ঈশ্বর চেতনা। প্রেম এখানে এক জার্নি। যে পথ বিশ্বাস দেয়, আলো দেয়… আশ্বাসে ভরিয়ে আলো করে তোলে নেগেটিভ পৃথিবীর প্ররোচনাকে! তখন, এখানেই কবিকে সাহসী হতে দেখি! দেখি তিনি নত নন কিছু সারভূতিশূন্য বাক্যের কাছে। বরং আরও বেশি করে আকড়ে ধরেন তাঁকে… সেই, যাঁর প্রেম আছে, প্রীতি আছে আর আছে বিরাট বিশাল বড় একটি হৃদয়! বন্ধুদের মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অপমান, তাচ্ছিল্য নেই বরং এক সহবস্থান আছে, আশ্রয় আছে তাঁর কাছে। তখন মনে হয়, প্রকৃত পরাজয় কী! যদি ধরে নিই মানুষ যখন নিজের সামনে নিজে এসে দাঁড়ায়, দেখে তারপর ভাবে আর সেই আয়নার প্রতিবিম্ব-এ প্রস্ফুটিত ছায়াকে দেখে নিজেই নিজের মনে কুঁকড়ে যায়, ঘৃণায় লাল হয়ে ওঠে চোখ মুখ– তখন কি তার পরাজয় ঘটে? নাকি শত্রু পক্ষ যখন তাকে অজস্র আঘাতের পরে ফেলে যায় ফুটপাত কিংবা কোন নির্জন এক প্রান্তরের ছায়ায় তখন? নাকি সমস্ত সমাজ, প্রিয়জন যখন তাকে আঙুল তুলে বলে– তুমি ভুল, তোমার এই পথ আসলে কোনও সঠিক মাত্রাকে তুলে ধরতে পারে না, তুমি হেরে গেছ, তুমি মুছে গেছ এই মন থেকে, দৃশ্য থেকে। তখন? আসলে এ সবই পরাজয়ের একটি অনুমাপন, যাকে আমরা ইচ্ছে মত সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে ভাঙি, অপরকে ভেঙে ফেলার তোড়জোড় শুরু করি। তখন সামনে এসে দাঁড়ায় বিরাট এক ছায়া, কালো এবং ভয়ার্ত। যার আনাচে কানাচে কোথাও আলোর রেশ নেই।
“একোবেশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি।
তমাত্মস্থংযেহনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং সুখং শাশ্বতং নেতরেষাম।।” (কঠোপনিষদ 2/2/12)
” এক মুহুর্ত থেকে আরেক মুহূর্ত স্বতন্ত্র ;
এক পাহাড়ের চূড়া আবার আর পাহাড়ের চূড়া,
টাল খেয়ে যাও পথিক, তবু থেম না একবারও।
দেবতাদের অনড় আসন নক্ষত্রের উপর।
বিপর্যয়ী হাওয়া তোমার নশ্বরতার সুনাম
রক্ষা করে। দেবতারা অপরিবর্তিত,
সঠিক অর্থে মৃত।
সদ্যোমৃত আমি, এখন প্রেতের অরূপ শরীর
আমার, আমি এখন তোমায় মহুয়াডাল থেকে
দেখতে পাচ্ছি। একি, তুমি পাহাড়ের টাল খেয়ে
কাঁদছ, একি, মানুষ হবার সুদীপ্র দায়িত্ব
ভুলে গিয়ে উদ্বন্ধন মেনে নেওয়ার জন্য
হাত বাড়িয়ে মহুয়া ডাল ধরার চেষ্টা করছ। ” ( ছোটনাগপুর)
কিছু কবিতা উঠে এসেছে আত্মখনন থেকে। উপলব্ধির উপর নির্ভর করে। অহং অস্মি বোধ। সমসময়ের মধ্যে এক চিরকালীন সময়। সমাজের দুর্নীতি, ভণ্ডতা, আবেগহীন বাস্তবতা যুগ যুগ ধরে যেভাবে চলে আসছে; তেমনই চলছে। কবিও যেন এখানে উদাসীন, নিস্পৃহ। ঠিক যেন ওই ক্যান্সার রোগীকে যে ডাক্তারবাবুটি দেখেন; তাঁর মতো। বুঝতে পারছেন, রোগী আর কিছুকাল, রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর। মৃত্যু শিয়রে। উপশমের কোনও লক্ষণ নেই। কিন্তু ওই রোগীকে ঘিরেই তাঁর ডাক্তারি পেশার যাত্রাপথ। ঔদাসীন্য নয়, আশাও নেই! যা আছে তাই নিয়ে কিছুকাল চলা।
” তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
সহজ হবে তুমি আমার মতো,
নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,
কীর্তিনাশা পথে নমিতা নদী!
গোধূলি হল। “(একটি কথার মৃত্যু বার্ষিকীতে)
” জীবন শূন্য হয়ে গেল আলোর ধারে এসে,
রেললাইনের সুবিস্তৃত উজ্জ্বল বিনয়,
আকাশপ্রমাণ বড় উঠোন চাষীর বাড়ির বাইরে,
বাড়ির বুকটা বাড়ির মধ্যে নয়। “( বিস্তৃত উজ্জ্বল)
এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন একজন কবিই। আত্ম অহমিকা নয় আত্ম অনুসন্ধান। আত্ম তলাশ। নিজেকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা। ভেঙে মুচড়ে নিজের নির্যাসের মুখোমুখি হতে পারেন যে কবি তাঁর নামই হল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কেননা নির্মম বাস্তব তাঁকে করে তুলেছে নুড়ি পাথর ময় পথে হাঁটার উপযোগী। আর তাই তিনি কল্পনার স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বাস্তব থেকেই আহরণ করেন তাঁর কবিতাদের। শব্দকে। আর স্বাভাবিকভাবেই তিনি ধরে ফেলতে পারেন নির্মম বাস্তবতার মধ্যেও লুকিয়ে থাকা কালের, সময়ের ব্যাখ্যাটিকে। আত্মবিশ্বাসের ভরপুর একজন কবিই পারেন শব্দ, ব্রহ্ম এবং গতানুগতিকতাকে ভেঙে সামনাসামনি হতে বিরাট অনিয়মের- অসংযোগের। আর তখনই ফুটে উঠে সেই চির শাশ্বত পথ। শব্দের। ব্রহ্মের। বাইবেলে দেখি ” In the begining was the word… and the word was God.” শব্দব্রহ্ম নিয়ে খেলা যে তার, আত্ম নিবেদন তো প্রয়োজনীয়। আর সঙ্গে মিলিত হয় চেতনার। কবি অলোকরঞ্জন, তাঁর সেই চেতনার সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন শব্দ এবং তার মননের মাত্রাকে। তাই তো কবিতা আত্মার। উপলব্ধির। বাস্তবতা এবং রক্ত মাংসের।এই যুগপৎ রসায়ন তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে হৃদয়ের উপনিষদ।
একাকীত্ব কী শুধুমাত্রই অভ্যেস একটা! অভ্যেস মানেই তো সাধনা। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে এগোই যাওয়া কোন এক স্বপ্নের দেশে। হ্যাঁ স্বপ্নই তো, মনের কুঠুরিতে পুষে রাখা সন্দর্পনে আলোক বিন্দু, কেউনা জানুক, ভাবুক তাইতো। কবিকে তবে হাঁটতে চেয়েছেন ওই গোপন কুঠুরির দিকে। যে কুঠুরি ছুঁয়েছে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের রথের চাকা, ভীষ্মের মুকুট অথবা ইলিয়াস থেকে উঠে আসা দেবীর স্তন। দৌড়ে গেছেন পরাশরের কাছে শব্দের মানে খুঁজতে আবার মায়ের কাছে বসেছেন বর্ণপরিচয়ের যুক্তাক্ষর খুলে। পাণিনি তখন চুপ করে হাসছেন। চুপ করে ভাবছেন, এইযে হেঁটে আসছে প্রস্তর যুগ, সেখানে কী সুশীতল জলের আভাস পিয়াস মেটাতে পারবে! বিষ্ণুপুরের রাসে ভাঙা বাঁশির সুর তো পিরামিডে নিজস্ব আত্মাকে দান করেছে তাঁর কবিতারা! একই আত্মতুষ্টি! নাকি হত্যা! হত্যা শব্দটি মানানসই হবে না কারন সবটুকু লেখা এসে পৌঁছেছে সাক্ষাৎ বর্তমানে— যেখানে অতীতের মৃত্যুস্তুপ নেই নাকি ভবিষ্যতের ভুলভ্রান্তিময় আশা-নিরাশা।
” তোমরা তো সহজেই দুর্বোধ্য পাথরে বাঁধো রাখী।
তোমরা তো পাহাড় ডিঙিয়ে যাও মুক্তক ডানায়,
আমরা পাহাড় গড়ি, আর তোরা ধরিত্রীর পাখি
সূর্যে উপনীত, যবে পুরুষেরা পাহাড় বানায়। ”
মৃত্যু কি নতুন করে সন্ধান দিতে পারে জন্মের? তুলে ধরতে পারে অচেতনের জগত থেকে চেতনার পর্বকে? হ্যাঁ, কবির মতে ঠিক এটাই ঘটে। অসংখ্য, অসীম মৃতের শরীর থেকে তুলে আনা যেতে পারে নতুন কোনও মন্থন পর্ব। এঁকে ফেলা যেতে পারে নতুন কোনও সরস্বতীর চিত্র। আর এটাই যেন কবির কাছে, শব্দের কাছে একজন কবির দায়বদ্ধতা। তাই তাঁর সহবাসে এসে ঢুকে পড়ে সামান্য বাজারের ব্যাগ, আলোর খোঁজ, আনন্দধ্বনিময় হাট ভাঙার শব্দ। তাঁর এই রোজকার সংসার সাদা কাগজের পৃষ্ঠায় যেন খুঁজে পায় তার মুক্তির আস্বাদ। কবি তখন শুধুমাত্র চালক। নাকি কবি নিজের চালক তাঁর সেই বিচিত্র ধর্মী কলমের কাছে! আলোচনার পর্বকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলা যেতে পারে সমস্তই মেটাফিজিকসের একটা অংশ। কিন্তু যদি মেনে নিই, আইনস্টাইনের কথাকে, বাড়িতে কেউ না থাকলেও এই টেবিলের অবস্থান একই থাকবে— বস্তুর বাস্তবতা মানুষের অস্তিত্ব নিরপেক্ষ। তবে কাকে খোঁজেন কবি? মানুষের সচেতন বুদ্ধিমত্তাকে! তাঁর সচেতন অবস্থানকে! নাকি ছেড়ে আসা, সামান্য স্মৃতির মোড়কে মুড়ে রাখা আদি অনাদি কালের সেই দৃশ্যটিকে। নিজেকে ভেবে নিতে পারেন সক্রেটিস। আর তার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে অসংখ্য হেমলকের পাত্র আবার অমৃতেরব। বাজার ফর্দ থেকে, রাতের বিছানা পর্যন্ত সেই সেই পাত্রের সঙ্গে তাঁর বসবাস। তবে কি জীবন অতটাই রহস্যময়? আনন্দ জর্জরিত? দেখা যাক—
” গেল আমার ছবি- আঁকার সাজসরঞ্জাম,
কোথায় পটভূমি কোথায় পড়ে রইল তুলি,
তুমি আঁকলে ছবি আবার তুমি রাখলে নাম
ফকিরি সাজ নেওয়ার ছলে ভরে নিলাম ঝুলি,
শুধু নিলাম সব মাধুরী, দিতে পারলাম না।
আকাশ আমার ক্ষমা, আমার অসীম নীহারিকা;
প্রিয়া, আমার ক্ষমা, আমার নিরালা অঙ্গনা;
মাগো, আমার ক্ষমা, আমার প্রদীপ অনিমিখা;
মর্ত্য ভূমি ভরা আমার আনন্দবেদনা;
নিয়ে গেলাম সব মাধুরী, দিতে পারলাম না।। “(মাধুকরী)
বিশ্ব-আধুনিকতার যে প্রেক্ষাপট তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর যৌবন বাউলে, তা এক নিজস্ব আধুনিকতার বীজের দিকেই আমাদের নিয়ে যায়। যেখানে মিশে যায় আমাদের বাংলার নিজস্ব জল-হাওয়া-প্রকৃতি ও সংস্কৃতির বিশ্ব। ঈশ্বরের সঙ্গে ভক্তের অভিমানের মতো তাঁর সম্পর্ক। এই সম্পর্কের মধ্যে যেমন রয়েছে বিশ্বাস, তেমন রয়েছে প্রশ্ন-ও। আধুনিকতা, বিশ্বজনীন সাহিত্যের আঙিনা, সময়ের পরিবর্তন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে অনেক পরিবর্তনের পথে নিয়ে গেলেও, এ কথা অনস্বীকার্য, এক গভীর মায়া ও মমতার নিজস্ব কাব্যভুবন তিনি এই যৌবন বাউল নামক কাব্যগ্রন্থেই গড়ে তুলেছিলেন, আজও আমরা যার দিকে পরম বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকি। পটভূমিকা যতই অন্ধকার হোক, যৌবন বাউল সেই অলোকরঞ্জনের বাউল সত্ত্বাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসে।


এটি কবির প্রথম কাব্য গ্রন্থ। এবং সাড়া জাগানো তো বটেই। খুব সুন্দর আলোচনা পড়লাম। বছরের বেশির ভাগ সময় তিনি থাকতেন বিদেশে, পাকাপাকি ভাবে। শীত এলে স্বদেশ তাঁকে টেনে আনতো কলকাতায়, দেখা হতো বইমেলার মাঠে, তাঁকে শুনতাম কোন সভায়– সেখানে ছড়িয়ে থাকত তাঁর প্রাজ্ঞতার মণিমুক্তো।
আলোচক বেবী সাউকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই এই মরমী আলোচনার জন্য।