
চার্লস সিমিচের কবিতা
অনুবাদে সুদেষ্ণা ঘোষ
সার্বিয়ান-আমেরিকান কবি চার্লস সিমিচ (১৯৩৮-২০২৩) ছিলেন কবি, আলোচক এবং প্যারিস রিভিউয়ের কো-পোয়েট্রি এডিটর। 'দ্য ওয়ার্ল্ড ডাজনট এন্ড' কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৯০ সালে পেয়েছিলেন পুলিতজার পুরস্কার। গত দু’দশক ধরে সিমিচের কবিতার অনুরাগী সংখ্যা বাড়লেও চিরকালই সমালোচকদের প্রশংসা পেয়ে এসেছে। ত্রিশ বছরের উপর নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর অধ্যাপক। ১৯৯০ সালে পুলিৎজ়ার, গ্রিফিন আন্তর্জাতিক কবিতা পুরস্কার সহ পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতি। কিশোর বয়সে যুগোস্লাভিয়া থেকে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিয়েছেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বেলগ্রেডের সমাজ ও সময় তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলে গেছে। “My travel agents were Hitler and Stalin.” পরে লিখেছিলেন সিমিচ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তার ঝোড়ো কৈশোর কেটেছে। বোমা পড়ার আশঙ্কায় বহুবার বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। যুদ্ধে শেষেও বাতাসে কান্না ও অনটন ঝুলেছিল। প্রথমে বাবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। তারপর সিমিচকে নিয়ে মা পালাতে গিয়ে বহুবার ব্যর্থ হন। অবশেষে সিমিচের যখন ১৫ বছর বয়স, মার্কিন দেশে গিয়ে পরিবারটি আবার মিলিত ও থিতু হয়। ইংরেজিতে মৌলিক কবিতা লেখা ছাড়াও সিমিচকে বিশ্ব মনে রাখবে একজন অসামান্য অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও। তাঁর ফরাসি, সার্বিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান কবিদের অনুবাদ খুবই প্রশংসাধন্য হয়। তাঁর অনূদিত ও সম্পাদিত ‘দ্য হর্স হ্যাজড সিক্স লেগস: অ্যান অ্যান্থোলজি অফ সার্বিয়ান পোয়েট্রি’ সে দেশের অনুবাদ-কবিতার প্রথম সারির একটি বই। সিমিচের মৌলিক কবিতায় সুররিয়্যালিজ়মের সঙ্গে ভায়োলেন্স ও নৈরাশ্যের এক আশ্চর্য উপত্যকা লক্ষ করা যায়।
গোপনীয়তা
হে মৃত্যু, আমারও কিছু অজুহাত আছে।,
যেদিন আমি স্কুলে যেতে পারলাম না
সেদিন আমার মা একটি পুরনো লেখা লিখেছিল।
বরফ পড়ছিল। মাকে বললাম আমার মাথা আর বুকে খুব ব্যথা।
ঘড়িতে বারোটা বাজল। আমি বাবার খাটে শুয়ে ঘুমোনোর ভান করছিলাম।
জানলার ভিতর দিয়ে আমি
বরফে ঢাকা চাদগুলো আমি দেখতে পেয়েছিলাম।
মনে-মনে আমি একটা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলাম। একটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে
আমি জাহাজে চড়ে যাচ্ছিলাম। তারপর একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙল, বাড়িটা কী শান্ত।
মা কোথায় গেল?
লেখাটা লিখে সে কি চলে গেল?
আমি উঠে তাকে খুঁজতে লাগলাম।
রান্নাঘরে আমাদের সাদা বিড়ালটা বসে
একটা রক্তমাখা মাছের মাথার দিকে তাকাচ্ছিল।
বাথরুমে টাব জলে ভর্তি
আয়না ও জানলা কুয়াশায় মুড়ে গেছিল।
যখন আমি ওগুলো মুছলাম, মাকে দেখতে পেলাম
তার সেই লাল বাথরোব আর চটি পরে
রাস্তায় একজন সেনার সঙ্গে কথা বলছেন।
যখন বরফ পড়ে যাচ্ছিল,
আর মা ঠোঁটে একটা আঙুল রেখেছিল
এবং ওটা সেখানেই থাকল।
সন্ধে শুরুর অ্যালজেব্রা
উন্মাদ মেয়েটি স্কুলের একটা ছোট্ট চক দিয়ে
অ-সন্দেহজনক, হাত ধরে থাকা, বাড়ির দিকে ফিরতে থাকা
দম্পতিদের পিঠে ‘X’ লিখতে থাকল।
শীতকাল তখন। তখন সন্ধে নেমে গেছে।
কেউ তার মুখ দেখতে পায়নি
কেননা বেশ জঘন্যই ছিল সে।
সে চলে যাচ্ছিল যেভাবে বাতাস চলে যায়, যেভাবে কাকেরা ডানা ঝাড়ে।
নিশ্চয়ই কোনও বাচ্চা ওকে চকটা দিয়েছিল।
ভিড়ের মধ্যে কেউ তাকে খুঁজেছিল,
হয়তো খুব ফ্যাকাসে, খুব সিরিয়াস কাউকে দেখার আশায়,
যার পকেটে একটি কালো স্লেটের টুকরো আছে।
স্মৃতির ছোট্ট পিনগুলো
এক দর্জির ডামিতে বাচ্চাদের একটি
রবিবারের জামা আটকানো ছিল।
এক ধুলট দোকানের জানলায়।
দোকানটা দেখে মনে হত বহু বছর ধরে বন্ধ।
একদিন আমি ওখানে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
হয়তো কোনও এক শান্ত রবিবার,
সেদিন রোববার বিকেলের মতো আলো পড়েছিল
লাল ইটের বাড়ি সাজানো এক রাস্তায়।
তোমার কেমন লাগে এ সব?
আমি অবশ্য কাউকে বলিনি।
তোমার কেমন লাগে ও সব?
আমি জেগে উঠে আজ আবার বললাম।
রাস্তাটা চলে গেছে অনন্তের দিকে
আর সেটি বরাবর আমি পিনগুলো টের পাই
আমার পিঠে, কাঁটার মতো বিঁধে আছে
অন্ধকার আর ভারী সেই জামা।
সান্ধ্য কথোপকথন
সব কিছু তুমি বোঝোনি
তার জন্যই তুমি তুমিই হয়েছ।
রাস্তায় যেসব আগন্তুকের চোখ তুমি দেখো
তারা তোমায় পড়তে চায়। হতে পারে তারা সর্বদ্রষ্টা
সর্বজ্ঞ? তারা জানে তুমি কী করোনি,
এক অদ্ভুত স্বপ্নের ভিতর ছটফট করা অবস্থায় তারা তোমাকে ফেলে যায়।
এমনকি আলোটাও স্থির থাকে না।
কোথা থেকে অত কঠিন চাউনি আসে?
আর ওই গন্ধটাও, যেন কোনও অলীক প্রাণী
সন্ধের মেঘ ভেসে যাওয়া ছাদগুলোয়
যাদের সাজিয়ে তোলা হয়, খড় খাওয়ানো হয়।
তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারোনি।
দিনের শেষে তুমি ওই লোকেদেরই ভালবাসবে
যারা তোমাকে অনেক রহস্যের খোঁজ দেয়।
সবসময় একজন থাকবেই যাকে তুমি দেখতে চাইছ
যে কোনও কারণেই হোক অপেক্ষা করছিল না।
কিংবা হয়তো করছিল? কিন্তু এখানে নয়, বন্ধু।
তোমার উচিত ছিল রাস্তাটা পার হওয়া
এবং ওই উদ্ভ্রান্ত মহিলাকে অনুসরণ করা
ওই রক্তের মতো লাল আর লম্বা চুল যার
যাকে আকাশ দূর থেকে ভেসে আসা কান্নার মতো আগলে রেখেছে।
ভয়-পাওয়ানো খেলনাগুলো
ইতিহাস অন্ধকারে তার কাঁচি নিয়ে
প্র্যাকটিস করে,
ফলে শেষে দেখা যায় কারও হাত নেই
কারও বা পা।
তা সত্ত্বেও, যদি সেগুলোই
তোমার আজকের খেলনা হয়…
পুতুলটির একটা অন্তত মাথা ছিল,
আর ওর ঠোঁটগুলো বেশ লাল!
ফাঁকা রাস্তায় সার দিয়ে থাকা
পিচবোর্ডে মোড়া কাঠের বাড়িগুলো কী গম্ভীর।
যেখানে একটি বাচ্চা মেয়ে ফুল ফুল রাতপোশাক পরে
সিঁড়িতে বসে আছে, কথা বলছে রাস্তার সঙ্গে।
এটা বেশ সিরিয়াস একটি ঘটনাই ছিল,
এমনি বৃষ্টিও সে কথা শুনতে চেয়েছিল,
তাই তার চোখের পাতায় ঝরে পড়ল,
আর ঝিলিক ফিরিয়ে আনল।